মন ময়ূরী পর্ব -০৪

#মন_ময়ূরী
#Tahmina_Akther

৪.

-তোমার সাথে আমার প্রথম দেখা যতটা না অপ্রীতিকর ছিল তারচেয়েও বেশি দ্বিতীয় দেখাটা আমার জন্য ছিল তোমার প্রেমে খুব শক্ত করে ডুব দেয়া।
আচ্ছা, কেউ যদি খুব বেশি পছন্দের মানুষ হয় তবে তার সাথে জড়িত সকল কিছু ভালো লাগে! হয়তো।
নতুবা লাল রঙ ছিল এযাবতকাল পর্যন্ত আমার সবচেয়ে অপছন্দনীয় রঙ। সেই তোমাকে আজ লাল শাড়িতে দেখে আজ আমার মনে হলো পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর রঙ হচ্ছে লাল। এতদিন আমি বুঝতে পারিনি তোমাকে এই রঙে দেখার পর আমার বুঝে এলো।
আমার দিকে সবসময় রেগে তাকাতে হবে কেন তোমার?মিষ্টি চাহনি নিয়ে তাকাতেও পারো। যে চোখে তাকালে অনুভব হবে চমচম, গোলাপ জামুন খেলে অনেক সময় পর্যন্ত যে মিষ্টতা থাকে ঠিক সেরকম অনূভুতি।
লাল শাড়ি পড়নে তোমাকে ঠিক নতুন বৌ বৌ লাগছিল, চোখের লেপ্টে যাওয়া কাজল,চুলের খোঁপায় গোঁজানো বেলিফুলের মালা।ইশশ্, বেশ মোহনীয় দেখাচ্ছিল তোমায়।
আমি ভাবছি অন্যকথা, আমাদের বিয়ের রাতেও ঠিক এমন সাজে ক্লান্ত হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে থাকবে তো তুমি?

রাতের আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে ফায়েজ। লক্ষ তারার মাঝে আলোকিত হয়ে থাকা চাঁদের দিকে তাকিয়ে আনমনে কথাগুলো বলে ফায়েজ।

নিজের কথায় নিজে লজ্জা পেয়ে হেসে ফেললো ফায়েজ। কপালে ছড়িয়ে যাওয়া চুলগুলো পিছনের দিকে ঠেলে দিয়ে, পকেট থেকে মোবাইল বের করলো।

স্ক্রীণে ভেসে উঠলো লাল শাড়ি গায়ে একটি কন্যা। আজ লুকিয়ে খেয়ার ছবিটি তুলেছে ফায়েজ। সরাসরি তো কখনোও ছবি চাইলেও দিবে না এই মেয়ে।

ফায়েজ ছবিটির দিকে কিছু পলক তাকিয়ে ফেসবুকে গিয়ে তার অফিসিয়াল পেইজ থেকে কিছু একটা পোস্ট করে দিল।

হুট করে ফায়েজের মন পড়লো আগামীকাল খুব সকালে তার গাজীপুর যেতে হবে। শুটিং স্পট সেখানেই সেট করা হয়েছে। নিজেকে যথেষ্ট স্বাভাবিক করার চেষ্টা করছে ফায়েজ কিন্তু খেয়ার সেই রাগান্বিত চেহারা মনে পড়লে সব কিছু এলোমেলো হয়ে পড়ে৷ল তার।

সন্ধ্যায় ডিরেক্টর কল করে জানতে চেয়েছে ওর কোনো প্রবলেম হয়েছে কি না? কিন্তু, ফায়েজ এই প্রসঙ্গে কিছুই বলে নি, শরীর খারাপের অজুহাত দেখিয়ে কল কেটে দিয়েছে।

দীর্ঘশ্বাস ফেলে ব্যালকনি থেকে নিজের ঘরে এসে টেবিলের উপর মোবাইল রেখে খাটে গিয়ে শুয়ে পড়লো। ফায়েজ জানে আজও তার ঘুম আসবে না কিন্তু চেষ্টা করতে ক্ষতি কি? আজ দু’রাত ধরে তো ঘুমানোর চেষ্টা করছে। চোখ বন্ধ করতে খেয়া দৃশ্যমান হলো ফায়েজের দুচোখের পাতায়।

******************

ক্যাম্পাসের সামনে এসে রিকশা থেমে গেলো। খেয়া রিকশা থেকে নেমে ব্যাগ থেকে টাকা বের করে ভাড়া মিটিয়ে সামনের দিকে অগ্রসর হতে লাগলো।

একটু সামনে এগুতেই খেয়া তার বন্ধুদের দেখতে পেলো। হাসিমুখে সেদিকে এগিয়ে গেলো, খেয়াকে নিজেদের কাছে আসতে দেখে রওশান,নিধি,রিমি উঠে গিয়ে খেয়ার সামনে দাঁড়িয়ে একসাথে বলে উঠে,

-শুভ জন্মদিন খেয়া।

খেয়া প্রথমে অবাক হলেও পরে খুশি হয়ে রিমি,নিধিকে জরিয়ে ধরলো আর রওশানকে ধন্যবাদ দিয়ে বললো,

-এইজন্য কি তোর আজ আমাকে সকাল থেকে এই পর্যন্ত একবারও কল দিস নি।

-দেই নি, কারণ আজ ক্যাম্পাসে আসার পর থেকে নিধির কান্না দেখে আমি আর রিমি পাগল হয়ে যাচ্ছি।

রওশানের কাছ থেকে এই কথা শুনে নিধি নাক টেনে ভ্যা ভ্যা করে কেঁদে উঠলো। রিমি, রওশান আর খেয়া ভয় পেয়ে একসাথে বললো,

-কি হয়েছে, এবার তো বল?

নিধি নাক টেনেটুনে চোখমুখ মুছে কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে বলে,

-এই দেখ কি হয়েছে? এখন আমার কি হবে?

নিধি তার মোবাইল থেকে কি যেন বের করে রওশানের হাতে দিলো। রওশান মনোযোগ দিয়ে দেখে পরক্ষণেই হেসে ফেললো।

রওশানকে হাসতে দেখে নিধি আবার কেঁদে ফেললো।খেয়া বিরক্তিকর চাহনি নিয়ে নিধিকে দেয় এক ধমক। খেয়ার ধমক শুনে নিধি কান্না বন্ধ করে ফেলেছে। খেয়া রওশানকে বলে ,

-দেখি মোবাইলটা দে, ও কি এমন দেখে মরা কান্না জুড়ে বসে আছে।

খেয়া রওশানের হাত থেকে মোবাইল নিয়ে দেখলো, একজনের ফেসবুক আইডিতে পোস্ট দেয়া ,

“প্রেমে পড়েছে মন ”

খেয়া এবার আইডির মালিকের প্রোফাইলে পিকে তাকিয়ে দেখলো, ফায়েজের ছবি। তারমানে, এইটা নায়ক সাহেব ফায়েজ চৌধুরীর আইডি!খেয়া এবার কমেন্টে গিয়ে দেখলো, হাজার হাজার মেয়েদের দুঃখ ভরা কমেন্ট, কেউ কেউ তো লিখেছে, ফায়েজ তোমাকে না পেলে আমি মরে যাবো, কে সেই কাল নাগিনী যার জন্য তুমি আমায় ভুলে যাবে?খেয়া এই কমেন্টটি পড়ে চেক করে দেখলো কে লিখলো?লিখেছে নিধি।

খেয়া মোবাইলটা রুশানের কাছে দিয়ে নিধির দিকে রাগীদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। নিধি খেয়ার তাকানোর মানে বুঝতে পেরে আমতাআমতা করে বলে,

-কি হয়েছে খেয়া?

-কি হয়নি, না!ওই হিরো কারো প্রেমে পড়ুক নয়তো জলে পড়ুক তোর কি? আবার কি সব উল্টাপাল্টা কমেন্ট করে রেখেছিস। দাড়া, আজকেই আন্টিকে বলবো, উনার মেয়ে নায়কের প্রেমে মজে গিয়ে ক্যাম্পাসে বসে কান্নাকাটি করছে লোক দেখিয়ে।

নিধি এসে খেয়ার হাত ধরে বলে,

-প্লিজ,খেয়া মা’কে কিছু বলিস না। আমি তো জাস্ট ফান করছিলাম তোদের সাথে। আমি ওসব হিরোদের জন্য।

-থাক থাক আর বলতে হবে না। আমরা দেখেছি তুই ওসব হিরোদের জন্য কি করিস। বাট, আমার না ভীষণ হিংসে হচ্ছে, না জানি কোন মেয়েটা এত সৌভাগ্যবতী যার প্রেমে পড়েছে ফায়েজ চৌধুরী।

রিমির কথায় কিছুটা ভ্রু কুচকে ফেললো খেয়া। মনে মনে কয়েকটা বকা দিলো ফায়েজকে, আজ ফায়েজের জন্য তার বান্ধুবি এত কান্না করলো।

-আচ্ছা, সত্যিই কি নায়ক সাহেব প্রেমে পড়েছে? নাকি কাউকে ইমপ্রেস করার ধান্দা! খেয়া কিছুটা ভাবুক হয়ে গেলো।

ক্যাম্পাস থেকে বাড়িতে ফিরে এলাম দুপুরে। একটু ক্লাস ছিল মাত্র৷ ডাইনিং টেবিলে যেতেই অতি পরিচিত একটি মুখ দেখে খুশিতে আমার পাগলপ্রায় অবস্থা। কারণ, আমার বাবা কবির খাঁন আজ পনেরো দিন পর ইন্ডিয়া থেকে এসেছেন। বাবা আমাকে দেখেই চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন,

-আধঘন্টা ধরে অপেক্ষা করছি তোর জন্য। এত দেরি হলো কেন?

আমি গিয়ে বাবাকে একপাশের জড়িয়ে ধরে বলি,

-আমি কি জানতাম, আপনি আজ আসবেন? যদি জানতাম তবে আজ ভার্সিটিতে যেতাম না।

মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে কবির বলেন,

-আজ আমার মায়ের জন্মদিন না এসে পারি? তাই চলে এলাম। এখন জলদি করে ফ্রেশ হয়ে চলে আয় সবাই মিলে একসাথে দুপুরের খাবার খাবো।

-মা আর দাদি কোথায়?

-রান্নাঘরে কি যেন করছে শ্বাশুড়ি বৌ মিলে।তুই তাড়াতাড়ি যা।

খেয়া একদৌঁড় তার রুমে চলে গেলো। গোসল শেষ করে আবারও ডাইনিংয়ে চলে গেলো। গিয়ে দেখে তার দাদি আজ ইলিশ মাছ ভাজা আর খিচুড়ি রান্না করেছে সাথে নানান পদের ভর্তা। এসব কিছুই খেয়ার পছন্দের। খেয়া চেয়ারে বসে তার দাদি আর মা’কে উদ্দেশ্য করে বলে,

-তোমরা দু’জন আজ আমায় উইশ করোনি কেন?

-কারণ,তোকে তোর বাবা সারপ্রাইজ দিবে তাই আমি আর তোর মা উইশ করিনি৷ এখন জলদি খেয়ে নে।
জয়নাব বেগম কথাটি বলে খেয়ার পাতে খিচুরি তুলে দিলেন।

খেয়া সহ পরিবারের সকল সদস্য একসাথে খেতে বসে পড়লো।

*****************

গাজীপুর থেকে শুটিং শেষ করে বাড়ি ফিরতে ফিরতে প্রায় সন্ধ্যে হয়ে গেলো ফায়েজের। বাড়িতে ঢুকতে ফায়েজ দেখলো তার বাবা, মা, ফাহিম সবাই কোথাও যাওয়ার জন্য তৈরি হয়ে বসে আছে। ফায়েজ ক্লান্ত শরীর নিয়ে সোফায় গা এলিয়ে বসে পড়লো।

ফায়েজের মা গিয়ে ছেলের পাশে বসলেন। ফায়েজ জানে তার মা তাকে কিছু বলতে চায়। তাই ফায়েজ তার মা’কে বলে,

-কিছু বলবে মা?

-আমরা সবাই একটা পার্টিতে যাবো, এতক্ষণ তোর জন্য আমি,তোর বাবা, ফাহিম অপেক্ষা করেছি।

-মা, আমি ভীষণ ক্লান্ত আজ। তোমরা চলে যাও তাছাড়া, আনি কোথাও গেলে তো জানোই সবাই কি পরিমানে হট্টগোল শুরু করে দেয়।

-কিন্তু, স্যার এই পার্টি তো আমাদের বাংলাদেশের ভবিষ্যত সাংবাদিক খেয়া ম্যাডামের।

জব্বারের কথা শুনে চোখ বড় করে তাকালো ফায়েজ। ফায়েজ ফাহিমের দিকে তাকাতেই ফাহিম হ্যা সূচক মাথা নাড়িয়ে সায় জানায়।ফায়েজ চটজলদি সোফা ছেড়ে তার ঘরে গিয়ে দশমিনিটের মাঝে তৈরি হয়ে চলে আবারও ফিরে আসে ড্রইংরুমে।

এসে দেখে মাহমুদ চৌধুরী, রেহনুমা চৌধুরী আর ফাহিম একটি কারে চলে গিয়েছে। বাকি রইলো জব্বার আর ফায়েজ। জব্বার ফায়েজকে বলে,

-স্যার, চলুন। দেরি হয়ে যাচ্ছে।

ঢাকার একটি আলিশান ক্লাবে খেয়ার জন্মদিনের উপলক্ষে পার্টির এ্যারেন্জ করেছে কবির খাঁন।খেয়ার বাবা শিক্ষা মন্ত্রনালয়ের সচিব। তাই এই পার্টিতে মন্ত্রী, সচিব এবং খেয়ার বন্ধুরা এবং তার মামার বাড়ির লোকেরা উপস্থিত হয়েছে।

ফায়েজের গাড়ি এসে থামলো সেই ক্লাবটির সামনে৷ ফায়েজ মুখে মাস্ক লাগিয়ে নেমে পড়লো কার থেকে। মাস্ক লাগানোর কারণ অনেকেই নয়তো ফায়েজকে এই মূহুর্তে দেখলে ঝাপিয়ে পড়বে৷

ফায়েজ ক্লাবে ঢুকে দেখলো, অনেক লোক আজ এই অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছে। ফায়েজের দুচোখ একজনকে খুঁজে বেড়াচ্ছে, একটু খুঁজতেই পেয়ে গেলো সেই কাঙ্ক্ষিত মানুষকে।

হাসিমুখে এগিয়ে যাওয়ার আগে একটি দৃশ্য দেখে ফায়েজের পায়ের গতি কমে গেলো।

ফায়েজ দেখলো একটি ছেলে খেয়ার চুলে হাত দিতেই খেয়া হাসিমুখে সেই ছেলেটির দিকে রইলো।

এমন সময় পেছন থেকে জব্বার এসে বললো,

-স্যার, বেয়াদবি না নিলে একটা কথা বলি?

ফায়েজ একপলক খেয়ার দিকে তাকিয়ে জব্বারকে ইশারা করলো বলার জন্য।

-স্যার, খাঁন বাড়ির মেয়েদের কাজ হলো স্যার দুইটা।

এক. সারাদিন খালি খাওয়া।
দুই.ছেলেদের মাথা খাওয়া

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here