#মন_কেমনের_বৃষ্টি
#পর্ব_২৫
#পুষ্পিতা_প্রিমা
আচমকা মিনির ডাক শুনে রেহান চমকে উঠল। মিনি ফিরেছে? তারমানে চাচ্চু ও ফিরেছে? আইমি ও ফিরবে? কিন্তু না মিনিকে উড়ে উড়ে যেতে দেখা গেল আদির ঘরের দিকে। আদিকে না পেয়ে মিনি প্রত্যেকের রুমে রুমে গেল। আদির নামটা মুখে আনতে পারল না। শুধু ডানা ঝাপটে ঝাপটে বলল,
‘ মিস ইউ। মিস ইউ।
বাড়ির প্রত্যেকে অবাক হলো। জানতে চাইল, কোথায় ছিলে তুমি মিনি?
মিনি কিচ্ছু বলতে পারল না। শুধু বলল, মিস ইউ। মিস ইউ।
মিনুমা বলল, আদি কোথায়?
মিনি এবার ডানা ঝাপটে ডাকল,
‘ আদি। আদি মিস ইউ। মিস ইউ।
আদি আসল না। কোথায় আদি?
মিনি উড়ল এপাশওপাশ। এদিকওদিক। পুরো বাড়ি ঘুরল। উড়ল। কোথাও দেখতে পেলনা আদিকে। তার অবুঝ মন ও রাগ করে বসল আদির সাথে।
_____________________
চকচকে মেঝের উপর শোয়া ঘুমন্ত মেয়েটির আদুরে চেহারা, ঠোঁটদুটো ফুলানো। ঘুমন্ত চেহারায় ঠিক পরীর মতনই লাগছে। আলিয়া কাঁপাকাঁপা হাতে কোলে তুলে নেয় পরীকে। তার হাত কাঁপছে। পা কাঁপছে। কন্ঠনালী পর্যন্ত কাঁপছে। কিছুক্ষণ আগে ফোনে কথা বলা মেয়েটির কথাগুলো কানে বাজছে। ডক্টর আদি চৌধুরীর সন্তান আদিশা। চৌধুরী বংশের প্রদীপ। আমার ঘেন্না হলে ও ওই বাড়িরই সন্তান পরী। কতটা নিচ আপনারা মিসেস চৌধুরী। চৌধুরী বাড়ির প্রত্যেকটা মানুষকে আমি ঘেন্না করি। আমি ঘেন্না করি ডক্টর আদি চৌধুরীকে। আমার সন্তানের বাবাকে। আমার ভাবতেই কষ্ট হয় ডক্টর আদি চৌধুরীই পরীর বাবা আর আপনারা তার দাদু দাদা। স্বার্থপর। পাষাণ। হৃদয়হীন।
আলিয়ার কানজোড়া ঝা ঝা করে উঠে। কথাগুলো অত বিষাক্ত কেন?
নরম তুলতুলে শরীরটা স্পর্শ করতেই যেন শক লাগল। হাত সত্যি সত্যি কেঁপে উঠল আলিয়ার। পরীকে তার দিকে ফিরিয়ে আনতেই কপালে সেই আঘাতের চিহ্ন দেখতে পায়। আঙুলে কাটা চিহ্ন। রক্ত শুকিয়ে গেছে। কচি চেহারাটায় ক্লান্তি,ভয়ের ছাপ। এমন নরম তুলতুলে শরীরটা তো আগে অনুভব হয়নি। নিজের রক্ত জেনেছে বলেই কি এত মায়া কাজ করছে? আসলেই কি তারা স্বার্থপর?
আলিয়া পরীকে কোলে নিয়ে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে দাঁড়াল। পরীর মুখ তার বুকের কাছে গিয়ে আটকাল। আদুরে মুখটা বুকের সাথে ঠেকে গেল। উষ্ণ কোল পেয়ে পরী আবার ও ঘুমিয়ে গেল। ঘুমের মাঝে ভ্রু কুঞ্চন করে মৃদুমন্দ কাঁদছে। আলিয়া কাঁপাকাঁপা ঠোঁট দিয়ে ছুয়ে দিল পরীর নরম ঠোটে, কপালে,সারামুখে। তারপর আবার বুকের সাথে চেপে ধরল। আপনাআপনি হাসি আসল তার। বুকের সাথে চেপে ধরে ছোট্ট মেয়েটির চুলের উপর চুমু খেয়ে বলল, আমার আদির মেয়ে! আদির একটা মেয়ে আছে? আদি বাবা?
আলিয়ার সত্যি সত্যি হাসি পেল। এই দিনই তো আদি ছোট একটা বাচ্চা। মা মা করে পুরো বাড়ি ঘুরে বেড়াত। তার এখন একটা ছোট্ট মা আছে। আদি কি জানে?
আলিয়া পরীর পিঠে আদর করে চাপড় দিয়ে বলল,
‘ তুমি আমার আদরে ভাগ বসাতে এসেছ আদিশা? আদি এখন তোমাকে মা ডাকবে।
পরী নড়েচড়ে গুজে গেল আলিয়ার বুকে। আলিয়া হাসল। তার সুড়সুড়ি লাগল। বলল, তুমি আমাকে কি ডাকবে দাদুমণি? দাদু ডাকবে? তুমি ঘুমোচ্ছে আদিশা? উঠো দেখো তোমার দাদু কোলে নিয়েছে তোমায়?
আলিয়া সিড়ি বেয়ে উপরে উঠতে থাকে। তার কোলে পরীকে দেখে মিনুমা আর রাইনা অবাক হলো। যখন দেখল আলিয়া পরীকে আদর করছে তাদের বিস্ময় আকাশ ছু্ঁল। কান্নাহাসিতে তারা একাকার হলো।
আজিজ চৌধুরী যখন রুমে ডুকে বিছানার উপর শোয়া ছোট্ট মেয়েটিকে দেখল অবাক হলো। বলল, লিয়া কি হচ্ছেটা কি? এই মেয়েটা এখানে কেন? বিছানায় কেন? তোমার গায়ে এমন শাড়ি কেন?
আলিয়া হাসল। বলল, আমার শাড়িতে ওর বুকে মাথা রাখতে অসুবিধা হচ্ছে। ও ব্যাথা পাচ্ছে। তাই সুতি শাড়ি পড়েছি। আমার ও ভালো লাগছে। আদিশা ও ব্যাথা পাবেনা। ঘুমিয়েছে তাই সেই সুযোগে চেন্জ করে নিয়েছি।
আজিজ চাপা রাগ দেখিয়ে বলে, এটা আমার প্রশ্নের উত্তর নয় লিয়া। এই মেয়েটার প্রতি তোমার এত দরদ উতলে উঠছে কেন?
আলিয়া ঠোঁটের উপর আঙুল দিয়ে চুপ করার জন্য বলল। বলল, উঠে যাবে। আস্তে কথা বলো।
আজিজ চৌধুরী এবার ধমকে উঠল। ‘ এই মেয়েটাকে ওই রুমে রেখে আসো লিয়া। আমার এমনিতেই মাথা খারাপ। আদির কোনো খোঁজ পাচ্ছি না।
আলিয়া পরীর মাথার পাশে বসল। বলল,
‘ যদি এখন এখানে রেহান ঘুমোতো তাহলে কি করতে?
‘ রেহানের সাথে এই মেয়েটাকে কেন মিলাচ্ছ লিয়া? তোমার কি মাথা খারাপ হয়েছে?
‘ ওর নাম আছে মিঃ চৌধুরী। আদিশা চৌধুরী।
আজিজ চৌধুরী পাত্তা দিলনা। কানে নিল না সেইকথা। কিন্তু যখনি বোধগম্য হলো সে অবাক চোখে তাকাল আলিয়ার দিকে। বলল, ও চৌধুরী কি করে হয় লিয়া? আদি শা? আদির? না কি করে লিয়া? আমার আদির সন্তান?
আলিয়া হাসে। কান্নায় চোখ ভাসে। বলে, এই পুঁচকুটা আদির মেয়ে। আমি ভুল ছিলাম না। আমার ধারণায় সত্যি।
‘ তুমি সিউর কি করে? আদির সন্তান নেই। আমি তো নিজ হাতে মেরেছি। এই মেয়েটা কিছুতেই আদির সন্তান নয়। এই মেয়েটার শরীরে খান বাড়ির রক্ত বইছে। আমাদের নয়। রিক রেজওয়ান খানের মেয়ে সে।
আলিয়া পরীকে আলতোহাতে কোলে তুলে নেয়। পরীর গালে গাল লাগিয়ে বলে,
‘ আমি শতভাগ নিশ্চিত এই মেয়েটা আদির মেয়ে। ইশা এবরশন করায়নি। তোমার হাতে ভুল রিপোর্ট এসেছে। আমার কষ্ট হচ্ছে এটা ভেবে যে আমরা মারতে চেয়েছি আদির মেয়েকে। আদির রাজকন্যা সে। দেখো নাকটা আমার। চোখদুটো খেয়াল করে দেখিও পুরোটাই আদির। আমার আদির। আদি যদি জানতে পারে আমরা ওর বাচ্চাকে মারতে চেয়েছি কোনোদিন তাকবেনা আমাদের দিকে।
আজিজ চৌধুরী অবাক হয়। লিয়া এসব কি বলছে?
‘ তুমি ইমির কথা ভাবছ না কেন লিয়া? কিছুদিন পর তাদের বিয়ে। এসব সন্তান টন্তান তুমি দূরে রাখো। আদিকে জানিও না।
আলিয়া চিন্তায় পড়ে যান। বলে,
‘ এটা কি করে হয় আজিজ? আদির জানার অধিকার আছে তার একটা রাজকন্যা আছে। তুমি একবার অতীত ঘেটে দেখোনা আজিজ। আমি একটা মেয়ের জন্য কতই না পাগলামি করেছি। আদির সাথে অন্যায় হচ্ছে। ইশার সাথে ও অন্যায় হয়েছে।
আজিজ চৌধুরী দাঁড়িয়ে পড়েন। বলে,
‘ আমি মানিনা এই মেয়েটা আদির। আদির মেয়ে না এই মেয়ে। আমি ওই ইশা নামের মেয়েটিকে কিছুতেই মানতে পারব না। আমার আদির পাশে ইমিকেই চায়। আদি ও চায়।
‘ কিন্তু আদি মিষ্টিকে খুঁজে বেড়াচ্ছে। ও মিষ্টিকেই চায়। তুমি দেখোনি ইন্ডিয়া গিয়ে ও ছয়মাস কি অবস্থায় ছিল। ও সত্যি মিষ্টিকে চায় আজিজ। আমরা হয়ত বুঝতে পারছিনা। আমরা ওর উপর সবকিছু চাপিয়ে দিচ্ছি না তো? আদির ভালো থাকাটা ঠিক কোথায়?
‘ আদি তোমাকে একবার ও বলেছে ও মিষ্টিকে চায়। তুমি কিসব উল্টাপাল্টা বলছ? এই মেয়েটা যাতে কিছুতেই আদি আইমির চোখে না পড়ে। আমি আফাজ সাহেবের কাছে মুখ দেখাব কি করে? উনি কত আয়োজন করছেন বিয়ের।
আলিয়া চৌধুরী দেখে পিটপিট করে চোখ খুলছে পরী। আড়মোড়া ভাঙছে। সোজা হয়ে না উঠে বিছানায় হাতের ভর দিয়ে হামাগুড়ি দিয়ে উঠল। উঠে চোখ কচলাতে কচলাতে কেঁদে দিল। ডাকল,মামমমমমমমমা………
আলিয়া চৌধুরী কোলে ডাকলেন। বললেন
‘ এসো আদিশা। এই দেখো। এদিকে।
পরী তার দিকে ফিরল। চোখ থেকে হাত নামিয়ে পিটপিট করে তাকাল আলিয়ার দিকে। হামাগুড়ি দিয়ে গেল আলিয়ার কাছে। তার গা বেয়ে উপরে উঠে বসল। আলিয়া দেখল মশা কামরে লাল লাল দাগ বসিয়ে ফেলেছে। পরী তার উরুতে পা দিয়ে দাঁড়াল। আলিয়া ব্যাথা পেলে ও কিচ্ছু বলল না। পরী আলিয়ার গাল ছোট ছোট হাত দুটো দিয়ে আঁকড়ে ধরল। জোরে জোরে আওয়াজ করে মারতে মারতে ডাকল, দাদদদদদদা….
আলিয়া হেসে উঠল। এভাবে কেউ মারে আদিশা? মাইর গুলো শক্ত আছে।
পরী তার মুখ দিয়ে দুমদুম আঘাত করল আলিয়ার মুখে। গালের ভেতর আঙুল ডুকিয়ে বলল, দাদদদদদদদদদা আমমম।
আজিজ চৌধুরী আড়চোখে তাকাল পরীর দিকে। বলল,
‘ লিয়া ছাড়ো ওকে। তোমার কোলের উপর দাঁড়িয়েছে ব্যাথা পাচ্ছ না? ছাড়ো।
আলিয়া ছাড়ল না। বলল, এগুলো কোনো ব্যাথা না আজিজ। নাতনীর হাতে যদি এটুকু ব্যাথা সহ্য করতে না পারি?
পরী চেঁচিয়ে কাদঁল। দাদদদদদা আমম……
আলিয়া তাকে কোলে নিয়ে নিল। বলল,চলো। আজকে তোমাকে মিষ্টিমুখ করাব। তোমার পাগলা বাবা কোথায় চলে গিয়েছে কে জানে? তাকে ফোন করব। তাকে খুঁজে বের করব।
পরী ঠাসসস ঠাসসস আওয়াজ তুলে মারল আলিয়াকে, প্রশ্ন করল,
‘ বাববববববা?
আলিয়া মাথা দুলিয়ে বলল, হ্যা।
আজিজ আলিয়ার পেছন পেছন ছুটে গেল। বলতে লাগল, লিয়া তুমি এসব বাজে কথা কাউকে বলবে না। আদিকে তো একদম না । আমি বিশ্বাস করিনা ও আদির মেয়ে। ওই মেয়েটা সহানুভূতি আদায় করার জন্য মিথ্যে বলেছে। আর তুমি গলে গিয়েছ। আইমি যাতে এসবের কিছুই না জানে। লিয়া???????
আলিয়া শোনেনা কারো কথা। আজ তার খুশির দিন। রেহান আর আদিশার সাথে সে সময় কাটাবে। হাসবে,খেলবে, খাবে,ঘুমোবে।
আজ সে পরীকে নিজ হাতে খাওয়াল। কোলে কোলে রাখল। মিনিকে দেখার সাথে সাথে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে ডাকল,
‘ মিননননননি ওততততততো……..
আলিয় আর আজিজ চৌধুরী সহ সবাই অবাক হলো। মিনি উড়ে এল। উড়ে উড়ে পরীর গালে গাল ছুয়ে ডানা ঝাপটে ডাকল,প্রিন্সেস প্রিন্সেস মিস ইউ। মিস ইউ।
এতদিন মিনি কোথায় ছিল তা আর বুঝতে বাকি রইল না কারো। পরীকে তার মিননননিকে পেয়ে কাঁদা ভুলে গেল। আলিয়া চৌধুরী তাকে নিজ হাতে গোসল করাল। খাওয়াল। পড়াল। মিনু আর রাইনাকে ছুঁতে ও দিল না। খেলনাপুতুল কিনে এনে মাঝখানে বসিয়ে দিল পরীকে। পরী ভুলে গেল সব কষ্ট। সব দুঃখ। সব আঘাত। খেলতে খেলতে মাঝেমাঝে মিনমিন করে হঠাৎ হঠাৎ ডাকে, পাপপপপপপা? মামমমমমমমা? রিইইইইই?
এত যত্ন আত্তির আদর ভালোবাসায় আলিয়া তাকে ডুবিয়ে রাখল। কারো কথা মনে পড়ার,তার কান্না করার কোনো সুযোগ রাখল না। তারপর পরী খেলতে খেলতে,খেতে খেতে, হাঁটতে হাঁটতে মিনমিন করে নিজের আনমনে ডাকে, আমমমমা…….. আমমমমা……
_______________________
খাবার টেবিল সাজিয়ে দিল মুনা আর ইশা। কারো মুখে টু শব্দ নেই। সবার চেহারা বিমর্ষ, বিবর্ণ। ফোনে কথা বলতে বলতে নিচে নেমে এল রিপ। এত তার ব্যস্ততা ফোন কানে নিয়ে বসে পড়ল চেয়ার টেনে। ইশা কাঁপাকাঁপা হাতে প্লেট ঠেলে দিল রিপের দিকে। রিপ তাকাল ও না। কিচ্ছু বলল ও না । ফোনে কথা বলা শেষ করে চুপচাপ খেল। রিক কিছু প্রশ্ন করবে ভেবেছিল কিন্তু করা হলোনা। রিপ কারো দিকে একপলক তাকাল না। ইশা আগ বাড়িয়ে বলল,
‘ আরেকটু দিই?
রিপ জবাব দিল না তার প্রশ্নের। ইশা সরে গেল। মুনা এসে দাঁড়াল রিপের পাশে। বলল, রিপ কখন ফিরবি বাসায়? কিছু জানতে পেরেছিস?
রিপ পানি খেয়ে থামল। বলল, না।
‘ পরীকে নিয়ে আসবি না? তুই কথা দিয়েছিলি আমায়।
‘ পরী তো তোমার মেয়ে নয়। তাহলে তোমার এত চিন্তা কিসের?
রিক খাওয়া বন্ধ করে তাকাল রিপের দিকে। সেই একটুখানি খাবার মুখে তুলতে গিয়েছিল সে। কিন্তু আর মুখে তোলা হলোনা। খাওয়া রেখে বলল,
‘ পরী আমার মেয়ে রিপ।
রিপ কিচ্ছু বলল না। চুপচাপ খেতে লাগল। খাওয়া শেষে উঠে পড়ল। তালহা বেগম বলল,
‘ কোথায় যাবি এখন রিপ?
রিপ সোজা বলল, থানায়।
ইশা আঁতকে উঠল। রিপ খেয়াল করলে ও তার দিকে ফিরে তাকাল না। হেঁটে বেরিয়ে গেল। সদর দরজা পেরোতেই ডাক পাড়ল ইশা।
‘ রিপদা দোহাই লাগে তোমার। পুলিশকে কিছু বলোনা। রিপদা শুনতে পাচ্ছ ??????
রিপ বেরিয়ে পড়ে বাইরে। আবার ইশার ডাক শুনে বলে,
‘ শুনতে পাচ্ছি। রিপদা নামে আর কে আছে এই বাড়িতে।
ইশা সামনে গিয়ে দাঁড়াল। দুইজনের কেউ তাকাল না কারো চোখের দিকে। ইশা অপরাধবোধ নিয়ে বলল,
‘ রিপদা তুমি এভাবে কথা বলোনা আমার সাথে। আমার কপালে যা ছিল তাই পেয়েছি আমি। আমার অপরাধ আমি তোমাকে না জানিয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছি। দ্বিতীয় অপরাধ আমি তা তোমার কাছ থেকে লুকিয়েছি। আমি মানছি আমি অপরাধ করেছি। আমি স্বীকার করেছি। এই ভুলের কারণে আমি শাস্তি ও মাথা পেতে নেব। তুমি আমায় শাস্তি দেবে রিপদা?
এইবার চোখ তুলে তাকায় রিপ। সরাসরি ইশার দিকে। হাসে। ম্লান হাসি। বিষাদ মেশানো হাসি।
ইশা টলমলে চোখে তাকায় রিপের দিকে। তার অবুঝ মন চেয়েছে রিপদা তার কান্নামাখা চোখদুটো দেখে একটিবার বলুক,
‘ আমি কি তোকে শাস্তি দিতে পারি ইশু?
কিন্তু না,, রিপদা কিছুই বলল না। অপরিচিত একটি বাইরের মানুষের মতো করে বলল,
‘ যার উপর আমার কোনো অধিকার নেই। যে আমার কেউ না। আমি যার কেউ নই। আমি তার উপর অধিকার কাটাতে যাই না মিসেস চৌধুরী। সেখানে আপনি তো চৌধুরী বাড়ির বউ, এত সুনামধন্য বাড়ির বউ আপনি! আপনাকে কি করে শাস্তি দেওয়া যায়? আর কিসেরই বা শাস্তি? কিসেরই বা ভুল। ভালোবাসাটা কোনো ভুল নয় মিসেস চৌধুরী। ভালোবাসা তাদের জন্যই ভুল হয়ে দাঁড়ায় যারা আসলেই বামন। চাঁদে যাওয়ার মতো অনাকাঙ্ক্ষিত এমন দুর্লভ কাজটাই তাদের জন্য ভুল। তাই শাস্তিটাই তাদের পাওয়া উচিত। আপনি ঠিক কাজ করেছেন। একদম ঠিক কাজ। অল দ্য বেস্ট অফ ইউ।
রিপ দাঁড়ায় না কেন জানি। কিছু লুকোনোর জন্য বোধহয় এত তাড়া তার। বাইকে উঠে মুহূর্তেই নিরুদ্দেশ হলো। পেছনে রেখে গেল একরাশ অপরাধবোধ নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা বোকা,পাষাণ মেয়েটির ছলছলে চোখজোড়া । পরে আনমনে হেসে মেয়েটি আওড়ায়।
‘ আমি সত্যিই তোমার কেউ না রিপদা। ভাই হয়ে আমার পাশে ছিলে তুমি। আমি হারিয়ে ফেললাম তোমাকে। নিজের দোষে। এক ভুল মানুষকে বিয়ে করে,ভালোবেসে।
রিপ এক ধ্যানে চালায় বাইক। বাইকের মিররে তার বেহায়া চোখদুটো দেখে নিজে নিজে আচমকা বাইক দাঁড় করায়। কতগুলো কলেজের মেয়ে চেঁচিয়ে উঠে তাদের গায়ে কাদা ছিঁটকে পড়ায়। রিপ ফিরে ও তাকায়না। নিজের উপর রাগ বাড়ে তরতর করে। এসব ন্যাকামো দেখার সময় নেই। বাইক স্টার্ট দিয়ে সে আবার চলে যায়। মেয়েগুলো চেঁচিয়ে উঠে। কি অভদ্র ছেলে? একটা সরি পর্যন্ত বলার প্রয়োজন মনে করল না। তারমধ্যে একজন নীরব দর্শক চেয়ে রইল সেই বাইক নিয়ে ছুটে চলা ছেলেটার যাওয়ার পানে। তার গায়ে বেশি কাঁদা পড়েছে। তাকে চুপ থাকতে দেখে তার বাকি বান্ধবীরা চেঁচিয়ে উঠল।
‘ তোর মতো গাধী জীবনে আর দুটো দেখিনি। এত কাঁদা পড়ল,কিছুই বললি না। স্ট্রেঞ্জ? তোর কাপড়ে তো বেশি পড়েছে। দেখ কি বাজে অবস্থা? ক্লাসে কিভাবে করবি?
মেয়েটি নিশ্চুপ তাকিয়ে দেখল নিমেষেই ধোঁয়াশা হওয়া বাইকে বসা ছেলেটিকে। মাথা নামিয়ে বলল, কিছু হবেনা। আমি আজ ক্লাসে আর যাব না। তোরা যাহ।
#মন_কেমনের_বৃষ্টি
#পর্ব_২৬
#পুষ্পিতা_প্রিমা
আজিজ চৌধুরীর ফোনে কল এল। তখন বেলা বারোটা হবে। আজিজ ফোন কানে দিতেই ওপাশ থেকে পুলিশ অফিসার শাহেদের কন্ঠস্বর ভেসে এল।
‘ আপনাদের বাড়িতে তল্লাশি চালানো হবে মিঃ চৌধুরী। একটি বাচ্চা মেয়ের কিডন্যাপিংয়ের অভিযোগ এসেছে আপনার উপর। ধারণা করা হচ্ছে ওই বাচ্চাটা এখন আপনাদের বাড়িতেই আছে।
আজিজ চৌধুরী গর্জে উঠলেন। আমি কেন একটি বাচ্চা মেয়েকে কিডন্যাপ করব? আপনাদের কাছে কোনো আইউইটনেস আছে? কোনো প্রুফ ছাড়া একটা নির্দোষ মানুষকে ফলস অ্যালিগেশন দেওয়াটা ও এক ধরণের অপরাধ।
পুলিশ অফিসার বেশি কিছু বলল না। শুধু বলল,
‘ এডভোকেট মিঃ রিপ এই অভিযোগ এনেছেন। আমরা উনার কথা ফেলতে পারিনা স্যার। তাই আমরা যাচ্ছি। জানানোর প্রয়োজন ছিল তাই জানিয়ে দিচ্ছি।
আজিজ চোধুরী ফোনটা রাখলেন জোরে আওয়াজ করে। চেঁচিয়ে ডাকল আলিয়াকে। আলিয়ার ধীর পায়ে হেঁটে এল। কারণ তার কোলে পরী। পরীর গায়ে ফ্রক নেই। সাদা কালো চেকের একটি ঢিলা শার্ট। মাথার ছোট ছোট চুল গুলো ছোট ছোট করে দুটো ঝুটি বেঁধে দিয়েছে আলিয়া। ঠোঁটে লিপিস্টিক দিয়ে দিয়েছে। কপালের একপাশে বড় করে একটি নজরটিকা লাগানো। একটা বেবি ডলের মতো দেখাচ্ছে। পরীর হাতে একটা প্লাস্টিকের পাতলা আয়না। সেই আয়না দু হাতে ধরে মুখের সামনে একবার আনছে আরেকবার খিলখিল করে হাসছে। আলিয়াকে আয়নাটা দিয়ে দুম করে মেরে জিজ্ঞেস করছে,
‘ দাদদদদা ওয়াহ না???
আলিয়া হেসে বলছে, ইয়েস আদিশা ইজ সো সুইট, ওয়াও……
পরী আয়নাটা নাড়াতে নাড়াতে হাসে। আজিজ চৌধুরীর দিকে চোখ যাওয়ায় চুপ হয়ে যায়। আলিয়ার কাঁধের কাছে চেপে যায়। আবার আজিজ চৌধুরীর দিকে মাথা তুলে তাকায় ,দেখল আজিজ তার দিকেই তাকিয়ে আছে। পরী আবার চেপে গেল। মুখ তুলে আবার দেখল আজিজ চৌধুরীকে। ঠোঁটদুটো ফুলিয়ে মোচড়ে দিল। আজিজ চৌধুরী রেগে বলল,
‘ লিয়া দেখেছ মেয়েটা আমাকে মুখ ভাঙিয়ে দিয়েছে। দেখেছ তুমি?
আলিয়া হো হো করে হেসে উঠল। পরীকে তার সাথে চেপে ধরে বলল। আমি শিখিয়েছি মুখ ভাঙানো।
আজিজ চৌধুরী বেজায় রেগে যান। পরীর দিকে তাকাতেই পরী আবার ঠোঁট ফুলিয়ে মুখ মোচড় দেয়। আজিজ চৌধুরী চেঁচিয়ে বলে উঠে,
‘ তোমার নাতনীকে বারণ করো লিয়া। আমার এসব সহ্য হচ্ছেনা।
পরী আজিজ চৌধুরীর মতো চেঁচিয়ে বলল, ইননননননননা……
আলিয়া হাসল। এবার তাহলে স্বীকার করছ তো যে আদিশাই তোমার নাতনী?
আজিজ চৌধুরী কিছু বলতে যায় তার আগেই রাইনা দৌড়ে এল। বলল, মা আদিশাকে আমার কাছে দিন।
আলিয়া প্রথমেই দিতে চাইল না। কিন্তু আজিজ চৌধুরী যখন বলল, তখন বহু সংকোচ করে দিয়ে দিল। রাইনা তো বেজায় খুশি। পরী রাইনার কোলে যাওয়া মাত্র রাইনাকে আয়না দেখাল। ঠোঁটে লাল লিপস্টিক দেখাল। বলল, ওয়াহ না????
রাইনা খিক করে হেসে দিল। বলল, হ্যা হ্যা ওয়াও। মামনিকে খুব সুন্দর লাগছে।
পরী রাইনার মতো বলার চেষ্টা করল। পারল না। শুধু বলল, মামোনননি?
রাইনা হাসতে হাসতে পরীকে নিয়ে নিজের রুমে চলে গেল। পরীকে ছেড়ে দিল রুমের ভেতর। আফি তখন বিছানায় গা এলিয়ে ঘুমোচ্ছে। রাত বারোটাই ঘরে ফিরে দিনের বারোটাই ও ঘুম থেকে উঠেনা সে। রাইনা পরীকে দেখিয়ে দিল আফিকে। হাত দিয়ে দেখিয়ে বলল,
‘ খুব খুব মেরে এসো। যাও। ডাকবে, আফিইই,,
পরী রাইনার দিকে ভ্রুকুঞ্চন করে তাকাল। ডাকল,আফফিইই……
রাইনা হাসল। বলল, যাও, যাও। দুমদুম মেরে এসো।
পরী এগিয়ে গেল। পড়নের শার্টটা হাঁটুঅব্দি। মাঝেমাঝে আদি ও এমন ঢিলা শার্ট পড়ে বাগানের কাজ করে। রাইনা হেসে আওড়াল। বাবা মেয়ের একই দশা।
পরী হাতে থাকা প্লাসটিকের গোল আয়নাটা দিয়ে আফির বিছানার শেষে এসে পড়া মুখে দুম করে মারল। বলল, আফফি…
আফফি নড়েচড়ে ঘুমোলো। কিন্তু চোখ মেলে তাকাল না। পরী আয়নাটা দিয়ে দুমদুম দুমদুম মারল আফির মাথায়। আফি এবার ব্যাথা পেল। মাথায় হাত দিয়ে ঘুম ঘুম চোখে উঠে বসল। পরী খিলখিল করে হেসে উঠল। আফি চোখ কচলে দেখল, ছোট একটি বাচ্চা মেয়ে। আফি চেঁচাল না। মেয়েটির খিলখিল করা হাসি দেখল। বলল, এখানে কি চাই?
পরী তার মুখ বাড়িয়ে কন্ঠস্বর টেনে বলল, আফফফফি এতততো ……
আফি রাইনাকে দেখল। বলল, এই মেয়েটা এখানে কি করে?
রাইনা ভয়ে ভয়ে বলল, ও আপনার ভাইয়ের মেয়ে। এত কিউট একটা মেয়েকে একটু আদর করতে ইচ্ছে করেনা আপনার?
আফি রাইনার কথায় অবাক হয়ে বলল, আদির মেয়ে? আদর?
নিজের হাতের দিকে তাকায় আফি। চেঁচিয়ে উঠে পরমুহূর্তেই। এই মেয়েটাকে নিয়ে যাও এখান থেকে। আমাকে যাতে না ছুঁই। তোমার সাহস কি করে হয় আমার পারমিশন ছাড়া আমার রুমে যাকে তাকে নিয়ে আসো। দূরে সরাও এই মেয়েকে।
পরী ভড়কে গেল। ডাগর ডাগর চোখগুলো বড় বড় করে তাকাল আফির দিকে। আওয়াজ করে ডাকল, আফফফফফি….
আফি ও বড় বড় চোখ করে তাকাল। বলল, ওমা এই মেয়ে তো দেখছি আমাকেই ধমক দিচ্ছে।
পরী খাটে ভর দেয় বুকের। একটা পা কোনোমতে তুলে দেয়। বুকে ভর দিয়ে দিয়ে কোনোমতে কষ্ট করে উঠে বসে খাটের উপর। আফির কাছে গিয়ে পিঠে দুহাত দিয়ে ঘিরে ধরে। চুল টেনে ধরে। দুমদাম মারে পিঠে। নখ দিয়ে আঁচড় দেয়। আয়নাটা দিয়ে যেমন ইচ্ছে তেমন ভাবে মারে। তারপর ঠোঁটের কাছে আঙুল দিয়ে বলে, ভোববব।
রাইনা নিজের অজান্তেই হেসে দেয়। আফি সেভাবেই থাকা অবস্থায় বলে, মেয়েটার কত সাহস? ভোবব মানে কি?
রাইনা ফট করে বলে ফেলল, মনে হয় চুপ করতে বলছে।
আফি ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল পরীর দিকে। পরী তার এভাবে তাকানো দেখে আবার বলল,ভোবববব।
খিটখিটে মেজাজের আফি পরীর কথায় হেসে ফেলল। পরক্ষণে চোখ লাল করে বলল, চোপ……..
আলিয়া ভড়কে গেল আজিজ চৌধুরীর মুখে অমন কথা শোনায়। তার চোখজোড়া টলমল করে উঠল। বলল, না আমি আদিশাকে কাউকে দেব না। আদিশা আমার নাতনী। আমার আদির মেয়ে। আমি ওকে দেব না। আজিজ চৌধুরী একরাশ বিরক্তি নিয়ে বলল,
‘ কি করে আদির মেয়ে হয় লিয়া? আদির সন্তান বলতে কিচ্ছু নেই। তুমি শুধু শুধু পাগলামি করছ। মেয়েটাকে নিয়ে এসো। আমি ওকে সরিয়ে ফেলব। অন্য কোথাও রাখব। নিয়ে এসো।
আলিয়া না না করে উঠে। বলে, আমি ওকে দেবনা। তুমি ওকে কোথাও নিয়ে যাবেনা। আদিশা আমার কাছে থাকবে। তুমি নিয়ে যেওনা প্লিজ।
আজিজ চৌধুরী বোঝাতে পারেনা আলিয়াকে। আলিয়া জেদ ধরে আদিশাকে ও দেবেনা। কিছুতেই না।
কিন্তু আজিজ শোনেনা। পুলিশ আসার আগেই পরীকে সরিয়ে ফেলতে হবে। আজিজ চৌধুরীর রেপুটেশনে কিছুতেই কিডন্যাপিং নামক স্পটটি ফেলা যাবেনা। আলিয়ার সাথে মনোমালিন্য হয় আজিজের। আলিয়া শেষপর্যন্ত কাঁদতে কাঁদতে পরীকে তুলে দেয় আজিজ চৌধুরীর হাতে। পরী আজিজ চৌধুরীর কোলে যেতে না যেতে শক্ত করে টেনে ধরে দাড়ি। চুল। মুখ দিয়ে রাগে ইইইইই শব্দ বের হয় তার। আলিয়ার দিকে হাত বাড়িয়ে ডাকে দাদদদদা?
কিন্তু আজিজ চৌধুরী আর দাঁড়ায় না। নিমেষেই নিরুদ্দেশ হয়। ঘন্টাখানেক পরে ফিরে আসে বাসায়। তার প্রায় আধঘন্টা পর পুলিশ আসে বাড়িতে। কোনো প্রুফ পায়না। রিপ শুধু অবিশ্বাস্য চোখে তাকায় চৌধুরী বাড়ির প্রত্যেকটা সদস্যের দিকে। বেরিয়ে আসার আগে সে আবার থমকে দাঁড়ায়। তা ও মিনির ডাকে। মিনি ডানা ঝাপটে ঝাপটে ডাকে, রিইইই নাইস বয়। মিস ইউ। মিস ইউ।
রিপের হঠাৎ খারাপ লাগে। মিনি ও যে চৌধুরী বাড়ির সদস্য এটা ও লুকিয়েছে মেয়েটি। দিনের পর দিন তাকে মিথ্যে বলেছে। তার বিশ্বাস নিয়ে খেলেছে। কি বোকা সে? কতটা বোকা হলে মানুষ এভাবে অন্ধবিশ্বাস রাখে অপরের প্রতি। যেখানে সব মিথ্যে, পুরো পৃথিবীটা মিথ্যে।
কিন্তু কোথায় পরী? কি জবাব দেবে সে তার ভাই ভাবিকে। মাকে কি জবাব দেবে? কোনো উপযুক্ত প্রমাণ নেই তার হাতে। কি করবে এখন সে? কোথায় যাবে? কার কাছে যাবে? ডক্টর আদি চৌধুরীই বা কোথায়? কোথায় সে সৌভাগ্যবান পুরুষ?
___________________
একহাত দেয়ালে লাগিয়ে দেয়ালে টানানো পিচ্চিটার ছবির দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে রিক। হাসিখুশি গুলুমুলু মেয়েটা তার মেয়ে। আজ মেয়ো নেই তার কতগুলো দিন। কতগুলো রাত। পরীর কান্নায় তার ঘুম ভাঙত মাঝরাতে। কিন্তু আজকাল মাঝরাত পার হলে ও তার চোখে ঘুম ভর করেনা। মাঝরাতে নরম তুলতুলে শরীরের মেয়েটি তার ছোট ছোট হাত দিয়ে বাবাকে ডাকেনা। গায়ের উপর উঠে গালে গাল লাগিয়ে আদর করেনা। নরম নরম হাতগুলোর মাইর ও খাওয়া হয়না কতগুলো দিন। খাওয়ার সময় আচমকা দৌড়ে এসে হা করে বলেনা, পাপপপপা আমম।
রিকের ও আর হাসা হয়ে উঠেনা। একসাথে বসে কতদিন খাওয়া হয়না। মা টা কোথায়? কি খাচ্ছে? কার হাতে খাচ্ছে? আদৌ খাচ্ছে তো? পাপার কথা কি তার একবার মনে পড়েনা? পাপার যে তার কথা খুব মনে পড়ছে। খুব কষ্ট হচ্ছে তাকে ছাড়া। অফিসে বেরোনোর সময় কান্না করে মা টা আর পুরো বাড়ি মাথায় তোলেনা। কি শান্ত পরিবেশ? রিকের ভালো লাগেনা। বুকে কষ্ট হয়। বুকটা একদম খালি হয়ে গেছে। পরীকে দরকার। খুব করে দরকার। পাপা খুব খুব মিস করছে পরীকে। কখন দৌড়ে এসে পাপার কোলে ঝাপিয়ে পড়ে ডাকবে, পাপপপপা। কখন। সেই সুদিন কবে আসবে? আদৌ আসবে তো?
মুনা এসে তাড়া দেয় রিককে। রিক সন্তর্পণে চোখদুটো চেপে ধরে দুই আঙুল দিয়ে। বহুক্ষণ পর হেঁটে বেরিয়ে যায় রুম থেকে। বাড়ি থেকে বেরোনোর আগে দেখা রিপের সাথে।
‘ আর কতদিন রিপ? আজিজ চৌধুরীর কাছে আমি এবার নিজেই যাব। আর বসে থাকব না।
রিপ অন্যদিকে মুখ করে রাখে। বলে, ধীরে ধীরে ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করো। কারণ ডক্টর আদি চৌধুরী যেদিন জানবে পরী তার মেয়ে যেকোনো মূল্যে সে পরীকে তার কাছে নিয়ে যাবে।
রিক আচমকা রেগে যায়। রিপের শার্টের কলার টেনে ধরে। মুনা আর তালহা বেগম আঁতকে উঠে। তালহা বলে, ছেড়ে দে রিক। কি করছিস? ও তোর ভাই।
রিক ছেড়ে দেয়। স্থির দৃষ্টি নিক্ষেপ করে রিপের উপর। রিপ শক্ত ভঙ্গিতে দাঁড়ানো। রিক মায়ের দিকে তাকিয়ে বলে, হ্যা, ও আমার ভাই। তাই আমি ছেড়ে দিয়েছি। নাহলে ওর অবস্থা করুণ হতো। ওর উপর নির্ভরশীল হয়েছি তাই ও আমাকে এত বড় কথা বলতে পারল। ওর ভাবা উচিত ছিল পরী শুধু আমার মেয়ে। তার ভাইঝি। পরীকে আমার খুব করে দরকার মা। পরীকে আমার চাই। তোমরা বুঝতে পারো না মা। তোমরা বুঝোনা। পরীকে ছাড়া আমার প্রত্যেকটা কতটা দুর্বিষহ কাটছে। কতটা কষ্ট হয় আমার। কতটা একা লাগে আমার।
রিপ তারপর ও শক্ত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে। রিক বলে, তুই বুঝবি না আমার কষ্ট আজ। কিন্তু সেদিন ঠিক বুঝবি যেদিন তোর সন্তান ও পরীর মতো কোথাও নিখোঁজ হয়ে যাবে। পরী তো তোর কেউ না।
রিপের শক্ত খোলসে আঘাত পড়ে। সে তারপর ও সামান্য নড়েনা। শুধু রিকের দিকে তাকায় চোয়াল শক্ত করে প্রশ্নবিদ্ধ চোখে।
‘ পরী আমার কেউ নয়?
‘ না কেউ নয়। তুই পরীর কেউ নস। তুই তো নিজেই বলেছিস পরী আমার কেউ নয়। তাহলে তোর ও তো কেউ নয়। তোর তো একটু ও কষ্ট লাগার কথা নয়। একটু ও না।
রিপ একরাশ ক্ষোভ নিয়ে তাকায় ভাইয়ের দিকে। দাঁতে দাঁত চেপে বলে,
‘ পরী আমার সবটা। আর এই পরীকে আমি দ্বিতীয় বার চোখের আড়াল হতে কিছুতেই দেবনা। শুধু একবার আমি পরীকে পাই। শুধু একবার।
রিকের ঠোঁটে খানিকটা হলে ও হাসির ছটা দেখা যায়। সে বলে,
‘ পরীর রিইইই কে একদম পড়ে ফেলা যায়। কিন্তু মাঝেমাঝে একদম চেনা যায় না। পড়া যায় না। মনের কথাটা এবার অন্তত বলা শেখ রিপ।
রিপ হাসে। অবজ্ঞার হাসি। ব্যঙ্গার্থ হাসি। বলে,
‘ কি লাভ তাতে? যারা পড়তে জানে এবার না হয় তাদের কথা ভাবি। তাদের কথা রাখি। মরিচীকার পেছনে আর কতদিন ঘুরব? আর কতকাল? এবার থেকে নিজেকে নিয়ে ভাবি। অন্যের কথা ভেবে এভাবে নির্ঘুম রাত কাটার কোনো মানে হয়? নিজে ভালো থাকার লড়াইয়ে না হয় নামি এবার। নিজেকে ভালো রাখার।
আচমকা দুতলার রেলিং ধরে দাঁড়ানো মেয়েটি রিপ তাকানোর সাথে সাথে সরে যায়। কান্নাহাসিতে সে একাকার হয়। দেয়ালে পিঠ চেপে দাঁড়ায়। কান্নাহাসির সংমিশ্রণে সে বলে,
‘ আমি আজ খুব খুশি রিপদা। কারণ তুমি আজ থেকে নিজের কথা ভাববে বলেছ। নিজের দিকে তাকাও এবার। নিজের ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবো। আর কতদিন আমার মতো এক অভাগীর জন্য নিজে নিজেই আত্মঘাতী হবে? আর কতকাল আমার কষ্টগুলো দূরীভূত করার চেষ্টা করবে? আর কতদিন এভাবে ছন্নছাড়া হয়ে কাটাবে? এবার তুমি গুছিয়ে নাও তোমার জীবন। আমার সুখ সেখানেই। আমার আপনদের ভালো থাকতে দেখা। তুমি ভালো থেকো রিপদা। হাসিখুশিতে থেকো। তোমার সেই আগের মুগ্ধ করা হাসিটা আমি আবার দেখতে চাই। আমি আবার ও বিরক্ত হতে চাই। তোমার পাশে আমি তোমার জীবনসঙ্গীকে দেখতে চাই। তোমার ছোট্ট একটি সাজানো সংসার দেখতে চাই। আমার চিন্তা আর করোনা তুমি। আমি এভাবেই ভালো আছি। এভাবেই ভালো থাকব।
যদি কখনো মন কেমন করা সুখ ধরা দেয় জীবনে সেদিন তোমায় আমি ঠিক বলতে আসব, রিপদা দেখো আমি খুব সুখী। খুব খুব সুখী। তুমি ও সুখী হও।
তুমি কিন্তু সেদিন আর রাগ পুষিয়ে রেখোনা। আমি জানি তোমার রাগের কারণ, বুঝি আমি। কেন আমি সুখী হলাম না? যদি আমি সুখী হতাম তাহলে আজ তুমি এমনটা করতে না। আমাকে আবার ইশু বলে ডাকতে। মিসেস চৌধুরী বলে ডাকতে না । জানিনা তোমাকে আমি সুখী হয়ে দেখাতে পারব কিনা?
কিন্তু কোনোদিন যদি শতবাধা পেরিয়ে ও সেই কাঙ্ক্ষিত দিনটি আসে। যদি কখনো গর্জন করে আকাশের বুক ছিড়ে সেই বৃষ্টি আসে, তাহলে সবার আগে আমি আগে তোমার কাছে ছুটে আসব। এক মন কেমনের শুভক্ষণে তোমাকে বলতে আসব,
‘ রিপদা দেখো আমি আজ খুব সুখী একজন। আজ ডক্টর আছে আমার পাশে। আমার কাছে। আমি আজ ডক্টরকে শুনতে পায়। আমি খুব সুখী রিপদা।
সেদিন তুমি খুব করে হেসো রিপদা। আর তোমার সেই আশীর্বাদের হাত আমার মাথার রেখে বলো,
‘ তুই ভালো থাক ইশু। সুখে থাক। আর তোর এই রিপদাকে মনে রাখ।
_____________
রিপ চোখ সরিয়ে নেয়। কেন মেয়েটি লুকিয়ে তার কথা শোনে? কিসের এত অনুতাপ তার? সে তো জানেনা, বুঝেনা তার রিপদা তাকে হারিয়ে ফেলার যন্ত্রণায় এমন হয়ে আছে। তাহলে সামনে আসতে তার কিসের এত ভয়, কিসের এত লাজ?
সেদিন কেন একটিবার মনে হয়নি যে জীবনের এত বড় একটি সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে রিপদাকে একটু জানানো দরকার। যে তার জীবনের সবচাইতে বড় কন্ট্রিবিউটর। সেদিন কেন একটিবার ভাবেনি অন্য একটি ছেলেকে কবুল বলার আগে রিপদাকে একটিবার জানানো দরকার। রিপদা যে জানার অধিকার রাখে! সেদিন কেন বলেনি?
আচ্ছা রিপদা তাকে বারণ করত বলে? বিয়ে করতে বারণ করত বলে? ডক্টরকে এতটা ভালোবাসে সে? এতটা ?
ডক্টরকে হারিয়ে ফেলার ভয়ে জানায়নি। নাকি রিপদা নামক সামান্য জীবটিকে জানানোর প্রয়োজন মনে করেনি? হয়ত সেটাই হবে। ডক্টরের ভালোবাসার কাছে রিপদা তো তুচ্ছ একটি বালি কণামাত্র। জানালেই কি না জানালেই বা কি? রিপদা একদিন ঠিক ক্ষমা করে দেবে? কিন্তু প্রশ্ন তো একটা থেকেই যায়, আদৌ কি ক্ষমা শব্দটি আসে? যদি সে কখনোই মেয়েটিকে ভালো বা বাসত? তার চাওয়ায় বোধহয় কোনো ত্রুটি ছিল। নাহলে তার ভালোবাসা কেন পূর্ণতা পেল না। তার ভালোবাসাই তো ত্রুটি ছিল না।
আদির চাওয়ায় বোধহয় ত্রুটি ছিলনা। তাই সে পেয়েছে। কাঙ্ক্ষিত মানুষটিকে এক মুহূর্তের জন্য হলে ও পেয়েছে। কিন্তু তারপর পেতে পেতে ও হারিয়েছে। আচ্ছা প্রশ্ন তো আর ও একটা থেকে যায়,
‘ এটা কে কি পাওয়া বলে?
প্রশ্নটা যদি একবার,শুধু একটিবার মেয়েটিকে করা হতো। তাহলে সে বলত,
না পাওয়ার যন্ত্রণা ম্লান হয় অন্যকারো সংস্পর্শে। কোনে না কোনো সময়। কিন্তু পেয়ে ও হারানোর যন্ত্রণার মতো যন্ত্রণা কি আর দুটো আছে?
রিপ মেয়েটির কথার পুরো বিপরীতে অবস্থান করে।
‘ কে বলেছে না পাওয়ার যন্ত্রণা ম্লান হয়? তুই জানিস ম্লান শব্দটার মানে কি? তুই বুঝিস? বুঝিস না। জানিস না। ম্লান শব্দটার মানে হচ্ছে সেই পাষাণকে ভুলে থাকার জন্য অন্য কারো সাথে ভালো থাকার অভিনয় করা। আর দিনশেষে রাত নামলেই সেই নিজের আসলরূপে বেরিয়ে আসা। আর সেই রূপের সাক্ষী ওই খোলা আকাশ,আর চাঁদ। বিছানার বালিশ। নইলে এই ক্ষত বিক্ষত হৃদয়টি। খোঁজ রাখিস? খোঁজ না রেখে কি করে বলিস অমন কথা? কেন বারবার প্রমাণ করিস তুই বড্ড পাষাণ। বড়ই পাষাণ।
চলবে,
চলবে,,