#মন_ছুঁয়েছে_সে
#পর্বসংখ্যা_৬
#মৌরিন_আহমেদ
ক্যাম্পাসে হেঁটে বেড়াচ্ছে কানিজ-অনন্যা। কথা হচ্ছে সকালের সেই ঘটনা নিয়ে। লেবু মামা কেমন করে ক্ষেপে যান সেটা নিয়েই রাগে গজরাচ্ছে কানিজ। বললো,
– দেখেছিস অনু, তোর লেবু মামাটা কেমন যেন!… আমি এতো মিষ্টি করে ডাকি ‘লেবু মামা’ বলে, অথচ কেমন করে ক্ষেপে যায়!… বলে কি না সৈয়দ মামা বলে ডাকবি! ইসস্! শখ কত!… আরে নাম যার লেবু তার অত ভাব কিসের?… আমাকে বলে কি না ‘কোনাচি বেগম’!… বলি, কানিজ ফাতেমা নামটা কখনো খেয়াল করেছে সে?…. কী সুন্দর একটা নাম, শুনলেই প্রশান্তির হাওয়া লাগে গায়ে…. আর…
– আহ্ হা কানিজ, বাদ দে না! মামু তো অমনই। তোকে তো নিষেধ করেইছি ওই নামে না ডাকতে… তুই লেবু না ডাকলে মামুও তো তোকে কোনাচি না ব্যাঙাচি, বলে ডাকে না…
– কিন্তু তুই যে ডাকিস?… শুধু তুই কেন গুষ্টিশুদ্ধ লোক তাকে লেবু বলে ডাকে।… পাড়ায় লেবু মামা বললেই একনামে চেনে।… আর আমি ডাকলেই দোষ!
– আমার ব্যাপারটা আলাদা। মামার তো কপাল ভালো এখন তাকে অন্তত লেবু মামা বলে ডাকি। ছোটবেলায় যে নাম উচ্চারণ করতে না পেরে কি কি উদ্ভট নামে ডাকতাম, শুনলে তুই হার্টফেইল করবি!…. আর কথায় আছে না যার নয় এ হয় না ‘নব্বইয়েও হয় না’!.. নয় বছর বয়সে যখন লুৎফর মামা না ডেকে ঘাড়ত্যাড়ামি করে লেবু মামা বলে ডেকেছি সেটা এখন কি আর বদলানো সম্ভব?
– একই কথা তো আমার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। ওনাকে ছোট থেকেই লেবু মামা বলেই ডাকছি.. তাহলে এতদিনেও ওনার ক্ষোভ যায় না কেন? এখনও ক্ষেপে যান কেন?
– ক্ষেপার বিশেষ কারণ হচ্ছে, তোর সাথে তার বোনে না। যদি বুনত, কথায় কথায় তাল মিলত, তাহলে এতোটা রাগ হতো না। বুঝলি?
ওর কথার প্রতি উত্তরে কানিজ আর কিছু বললো না। মামার প্রতি চাপা ক্ষোভে মুখ ঘুরিয়ে নিল। অনন্যাও আর কিছু না বলে চুপচাপ হাঁটতে থাকে।
– এই সুন্দরী কোথায় যাও? আজ বুঝি ক্লাস ফাঁকি দেয়ার ইচ্ছে?
কারও বিদ্রূপে ভরা কণ্ঠ শুনে সামনে তাকালো কানিজ-অনন্যা। দেখল তাদের ঠিক বিপরীত দিক থেকে আসছে একটা বাজে ছেলেমেয়ের দল। তিনটা ছেলে আর মেয়ে দুইটা। তাদের সবাইকেই ওরা চেনে। ওদের মধ্যে লিডার টাইপ যে ছেলেটা, অনন্যাকে উদ্দেশ্য করে কথাটা বলেছে সে হলো ইফতি। বড়লোক বাবার বখে যাওয়া সন্তান। তার বাড়িটা ঠিক অনন্যাদের বাড়ির অপজিটেই। অবশ্য ওর সাথে কোনো পরিচয় নেই এদের। বাড়ি সামনা সামনি সেটাও হয় তো জানে না। না জানাই ভালো। পড়ালেখার নাম-ধাম নেই। বাবার টাকার জোরে ভার্সিটিতে ভর্তি হয়েছে। আর ডিস্টার্ব করে বেড়াচ্ছে উঠতি বয়সী মেয়েদের।
অবশ্য সে এতোদিন এলাকায় ছিল না। শুধু এলাকায় না দেশেই ছিল না। নিউজার্সিতে ছিল লেখাপড়ার জন্য। ছয়মাস হলো দেশে ফিরেছে। আর ফিরেই শুরু করেছে তার বখাটে পনা!
অনন্যার অবশ্য ধারণা ইফতির লেখাপড়া ওখানে হয় নি। নয় তো আমেরিকার মতো একটা আধুনিক, আরামদায়ী দেশে না থেকে এ দেশে মরতে এসছে কোন দুঃখে? দেশপ্রেম তো অবশ্যই নয়! নিশ্চয় ওর চালচলনের জন্য সেখান থেকে বের করে দিয়েছে!
ইফতির পাশে দাড়ানো যে দু’টো চামচা টাইপ ছেলে দেখা যাচ্ছে, তাদের একজনের নাম শানীল অন্যজন অরুণ। আর মেয়ে দু’টোর নাম শ্রেয়া, মৌনতা। এরা সবাই বেশ ধনী পরিবারের সন্তান। অতি আদরে উচ্ছনে যাওয়া তারা! ভার্সিটিতে আসেই অন্যদের জ্বালাতন করতে। সারাক্ষণ হাতে সিগারেট, মাঝে মাঝে যে মদ-টদও খায় সেও লোকে বলে! মেয়েদের বিরক্ত আর জুনিয়র ছেলেদের সাথে অহেতুক দাপট দেখায় বলে এদের একটাকেও অনন্যার পছন্দ নয়। মোটামুটি বিরক্ত গলায় জবাব দিল,
– কোথায় যাই, যাই তাতে আপনাদের কী?
– আমাদের কী মানে?.. এতো সুন্দর ফুলটুসিরা রাস্তা দিয়ে একা একা হেঁটে বেড়াবে আর আমাদের কিছু হবে না?… বলি, আমাদের সাথেও তো ডেটিংয়ে যেতে পার, মজা পাবে কিন্তু!
শানীলের কথা শুনে রাগে গা জ্বলে উঠলো কানিজের। রাগ সংবরণ করতে না পেরে বলেই ফেললো,
– আমাদের ঠ্যাকা পড়ে নি আপনাদের মতো ফকটিয়াদের সাথে ঘুরে সময় নষ্ট করার!… অহেতুক কথা না বলে পথ ছাড়ুন!..
এতক্ষণে কথা বললো শ্রেয়া নামের মেয়েটা। নাক সিটকানো ভাব ধরে বললো,
– এতো ফটরফটর করো না, ফল ভালো নাও হতে পারে!.. বাড়াবাড়ি না করে যা বলছি করো…
অনন্যাও বেশ তেজ দেখিয়ে বললো,
– ফল ভালো হোক বা না হোক, সেটা আমরা বুঝব।.. আপনাদের বলে দিতে হবে না!…
– রাস্তা ছেড়ে নিজের কাজে যান!… অহেতুক ঝামেলা!..
বলেই ওর হাত ধরে সামনে হাঁটা দেয় কানিজ। কিন্তু তৎক্ষণাৎ পথ আটকে ধরে ওরা। ইফতি ছেলেটা ঠিক ওদের সামনে দাড়িয়ে বলে,
– এতো যে তেজ দেখাচ্ছ, এখন এখান থেকে বেরোতে পারবে?
– রাস্তাটা আপনার বাপের নয় যে আপনি আমাদের আটকাবেন!…
দাঁত চিবিয়ে চিবিয়ে পাল্টা জবাব দেয় অনন্যা। ইফতি কিছু না বলে ওর দিকে আরও একধাপ এগিয়ে আসে। পিছন থেকে অরুণ ছেলেটা বলে উঠলো,
– ভাই, মা’ল দুইটা কিন্তু জোস!.. ফিগারটা তো….
কথা শেষ করে না সে। হাত দুটো কেমন করে বাজে ইশারা করে। ইফতি একবার ওর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করে,
– তুলে নিয়ে যেতে বলছিস?
– রাতটা জমবে ভালো!
বলেই অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে শানীল। অরুণের দিকে তাকিয়ে বলে,
– বুদ্ধিটা কিন্তু জোস দিছস, মাম্মা!
হাইফাইভ করে নেয় অরুণ-শানীল। শ্রেয়া আর মৌনতা একজন আরেকজনের দিকে তাকিয়ে রাগে বিড়বিড় করে কি যেন বলতে থাকে। সম্ভবত অনন্যাদের উদ্দেশ্যেই বলছে,
– শয়তান দু’টোর আচ্ছা শাস্তি হওয়া উচিত!
ওদের কথাবার্তা শুনে বাঁকা হাসি ফুটে উঠলো ইফতির মুখে। অনন্যার মুখের সামনে ঝুলতে থাকা ছোট ছোট চুলগুলো ওর কানের পিঠে গুঁজতে গুঁজতে বিচ্ছিরি ভাবে স্পর্শ করে ওর কপাল আর গাল। পৈশাচিক হাসি দিয়ে বলে,
– বুদ্ধিটা আমারও বেশ পছন্দ হয়েছে…. মাইক্রো ডাক… নিয়ে যাই এদের….
রাগে গা কাঁপতে থাকে অনন্যার। কিন্তু মুখে কিছু বলতে পারে না। ভয়ে আড়ষ্ঠ হয়ে যায় গা- হাত-পা। ছেলেগুলোর মতিগতি সুবিধার না! আর এমনভাবে ঘিরে রয়েছে যে ব্যাপারটা ভালো লাগছে না। কানিজেরও একই অবস্থা! সে যে ভীষণ ভাবে ভীত সেটা জানে অনন্যা। আর এখন এই পরিস্থিতি তে ও যে ভয়ে জবুথবু হয়ে গেছে তা বেশ বুঝতে পারছে সে। তবুও বেশ সাহস করে বললো,
– এবার কিন্তু বেশি বেশি করছেন আপনারা…. ভা-ভালোই বলছি…. ছেড়ে দিন আমাদের….
– আমাদের ছেড়ে দিন…
আকুতি করে অনন্যাও। বদগুলো নিজেদের মতো করে আনন্দে লিপ্ত হয়। সিগারেট জ্বালাতে জ্বালাতে বিশ্রী হাসি দেয়। মৌনতা মেয়েটা ফোড়ন কেটে বলে,
– এতক্ষণ তো খুব তেজ দেখাচ্ছিলে, এখন কী হলো? সব হাওয়া টায় টায় ফুস?…. হা হা হা।
– দেখি ভাই, রাস্তা ছাড়েন তো!….
হঠাৎ ভিড়ের পেছন থেকে কার যেন গলা শুনতে পাওয়া যায়।
– এটা আবার কোন মা’ল!…
বিড়বিড় করতে করতে পেছনে ফিরলো ইফতি। দলের বাকিরাও ফিরে তাকায়। সেই সাথে অনন্যা- কানিজও। দেখতে পায় ধ্রুব আর তার সাথের সেদিনের ছেলেটা। সিয়াম। ওদের দেখে কানিজ অনন্যার কানে কানে বলে,
– হিমু এলো না কি হিরো হয়ে?
অনন্যা ওর দিকে বিরক্ত চোখে তাকালো। সে কোনোভাবেই কোনো অবস্থাতেই ধ্রুবকে নিয়ে বদ মন্তব্য রাজি নয়! শানীল ওদের দুজনের দিকে তাকিয়ে বললো,
– দুনিয়াতে তোদের আর রাস্তা চোখে পড়ে নাই?… দেখছিস, বড় ভাইরা দাড়ায় আছে… তাও সাইড চাস মানে?… বেয়াদব!
সিয়াম কিছু বলতে পারে না। বখাটে গুলোর খপ্পরে পড়েছে ভেবেই চুপসে যায়। তবে ধ্রুবের মোটেও তেমন কিছু হয় না! সে বেশ স্বাভাবিক ভাবেই বললো,
– সিনিয়র হলেই যে রাস্তা আগলে দাড়িয়ে থাকতে হয়, জানতাম না তো!… তা বেশ! ভুল যখন হয়েছে শুধরে নিচ্ছি।… কিন্তু আপনারা এখানে কি নিয়ে জটলা পাকিয়েছেন সেটা তো বুঝলাম না..
বলেই অনন্যার দিকে তাকালো। ও সভয়ে জানালো,
– ও… ওরা আমাদের টিজ করছে, তুলে নিয়ে যাবার হুমকি দিচ্ছে….
– সে কি!… এতো বেশ ভয়ঙ্কর ব্যাপার!
ধ্রুবের আঁতকে ওঠা দেখে ওদের দিকে তাকিয়ে বাঁকা হাসি দেয় ইফতি। যেন সে নিজেকে এভারেস্ট জয়ী মূসা ইব্রাহিম ভাবতে শুরু করেছে। অনন্যাদের কেউ বাঁচাতে আসবে না ভেবেই মূলত তার এই হাসি!
ধ্রুবকে দাড়িয়ে থাকতে দেখে ধমক লাগায় অরুণ,
– তোদের রাস্তা ছেড়েছি না?… এখনও দাড়িয়ে আছিস কোন আক্কেলে?… যা বলছি!…
বলেই হাত ধরতে যায় কানিজের। ইফতিও অনন্যার হাতটা টেনে ধরে। ওরা দুজনই এখন ভয়ে কাঁপছে। শেষ পর্যন্ত ওদের ভাগ্যে কী জুটছে সেটা ভেবেই আতঙ্কিত ওরা। ধ্রুব কে দেখে মনে মনে সাহস পেয়েছিল, আশ্বাস ছিল ধ্রুব ওদের বাঁচাবে। এক মুহূর্তের জন্য তাই ভয়টা ছিল না। কিন্তু ধ্রুব কিচ্ছু করবে না জেনে নিরাশ হলো তারা।
হঠাৎ করেই আবারও কথা বলে উঠলো ধ্রুব,
– কিন্তু ভাই, ভার্সিটি এলাকায় এমন করছেন… আরে স্যার যে!
বলেই ইফতিদের পেছনে কাকে যেন দেখতে পেল ও। ওর দৃষ্টি অনুসরণ করে বাকিরাও কৌতূহলী চোখে তাকালো সেদিকে। আর ধ্রুবও ঠিক এই সুযোগটাই কাজে লাগালো। ইফতিকে পেছন দিকে ধাক্কা দিয়ে অনন্যার পিঠে চাপড় মেরে নির্দেশ দিলো,
– পালাও!
অনন্যা আর একমুহুর্ত দেরি না করলো না। কানিজের হাত ধরে চট করে দৌড় শুরু করলো। কানিজও সমান তালে ছুটতে ছুটতে একেবারে ডিপার্টমেন্টের ক্লাসে চলে গেল। ওদের এভাবে চলে যেতে দেখে শানীল বেশ অবাক হয়ে বললো,
– এটা কি হলো?
– পালিয়ে গেল!
ধ্রুব বেশ স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বলতেই হঠাৎ গর্জে উঠে ইফতি,
– আব্বে শা’লা, তোকে তো…
বলেই ওকে মারার জন্য এগোয় সবাই। ধ্রুবও চট করে একটা দুঃসাহসিক কাজ করে বসে। নিজের ডান পা’টা দিয়ে সোজা প্রচন্ড একটা লাথি মারে ইফতির দু’পায়ের ফাঁকে। মুহুর্তেই ‘ও মাগো’ বলে রাস্তার অপর দিকে ছিটকে পড়ে ইফতি। ব্যাথায় কঁকিয়ে উঠলো,
– মরে গেলাম গো!
এ দিকে কি করতে হবে ভেবে পায় না বাকিরা। ইফতির দিকে তাকিয়ে হ্যাবলার মতো চেয়ে থাকে। ফাঁক পেয়ে ধ্রুবও দৌড় লাগায় পেছন দিকে। সিয়ামও হুশ ফিরতেই ছুট দেয় পেছন পেছন। যেন দৌড়ের প্রতিযোগিতা লেগে গেছে!
#চলবে—-