#মনোহারিণী
লেখনীতে—ইলোরা জাহান ঊর্মি
১৯.
জ্বরের সঙ্গে আমার এক আত্মিক সম্পর্ক আছে। সেই ছোটোবেলা থেকে প্রত্যেক পরীক্ষা আসার আগমুহূর্তে আমার জ্বর হয়। যেকোনো বিশেষ দিন এলেই বিনা নিমন্ত্রণে জ্বর মশাই এসে উপস্থিত হয়। জ্বরের একটা ভালো দিক হচ্ছে, আম্মুর ভালোবাসার মাত্রা বেড়ে যায়। যেমন, সাধারণত দু-এক বেলা ভাত খাইয়ে দেয়, অথচ জ্বর হলে প্রতিবেলা খাইয়ে দেয়। বলতেও হয় না। কিন্তু এবার তো আম্মু নেই। আম্মি শত ব্যস্ততার মাঝেও যতটুকু সম্ভব করে চলেছে। তবে আজ আব্বু থাকায় সে একটু স্বস্তি পেয়েছে। গতকাল রাতেও আব্বু আমার কারণে ঘুমাতেও পারেনি। আজও সকাল থেকে পাশ থেকে নড়ার নাম নিচ্ছে না। এদিকে আমার ভাল্লুক জ্বর আবার বেড়েছে। ওদিকে রাজ ভাইয়ের বিয়ের আনন্দোৎসব চলছে। যে যার মতো রেডি হচ্ছে কমিউনিটি সেন্টারে যাওয়ার জন্য। এই অসুস্থ শরীরে রেডি হওয়া তো দূর, বাসা থেকে বেরোতেও শরীর সায় দিচ্ছে না। এরমধ্যে সায়মা আপু এসে আমার হাতে একটা প্যাকেট ধরিয়ে দিয়ে বলল রেডি হতে। আমি জিজ্ঞেস করলাম,
“এটা কিসের?”
আপু বলল,
“খুলে দেখ।”
প্যাকেট খুলে পেলাম একটা লাল শাড়ি। অবাক হলাম।
“শাড়ি! এটা পড়বে তুমি?”
সায়মা আপু বুঝি ঈষৎ বিরক্ত হলো। আমার ওপর, না আমার কথার ওপর?
“চশমা লাগিয়ে কানা হওয়া থেকে বেঁচেছিস জানতাম। তাই বলে যে আজকাল চোখে কোনোকিছুই দেখতে পাস না, তা তো জানতাম না।”
“অ্যাঁ!”
“হ্যাঁ, আমাকে দেখে তোর কেন মনে হচ্ছে আমি আবার রেডি হব? কষ্ট করে একবার রেডি হইনি?”
খেয়াল করে দেখলাম সায়মা আপু শাড়ি-টারি পড়ে একদম রেডি। নিজের উদাসীন মনটার ওপর ভীষণ বিরক্ত হলাম।
“আমি রেডি হয়েই তোর কাছে এসেছি। জানতাম এখনও বসে আছিস। নে, চটপট রেডি হ। আয়, আমি দ্রুত শাড়ি পরিয়ে দিই।”
আমি শাড়িটার দিকে আপত্তিকর চাহনিতে তাকিয়ে রইলাম। এই অসুস্থ শরীরে শাড়ি পরার মতো মানসিকতা নেই। তার ওপর আবার টকটকে লাল শাড়ি! আপু তাড়া দিলো,
“তোর লাল পেটিকোট আছে না? বের কর তাড়াতাড়ি। সবাই রওয়ানা হতে চলেছে। আমরা পড়ব সবার শেষে।”
আমি কাঁচুমাচু মুখে বললাম,
“শাড়ি পরে থাকতে পারব না আপু। শরীরের যেই অবস্থা!”
“সবাই পরেছে, তুই পরবি না মানে কী? শরীর ঠিক হয়ে যাবে। তুই কি দৌড়ঝাঁপ করবি? গিয়ে চুপচাপ বসে থাকবি, আমরা তো আছিই। না করিস না প্লিজ।”
“তুমি বুঝতে পারছ না, আমার একটুও ইচ্ছে করছে না শাড়ি পরতে। শেষে দেখবে মাথা ঘুরে-টুরে পড়ে থাকব।”
সায়মা আপু নাছোড়বান্দা, সে শাড়ি পরাবেই। আমিও সমানে আপত্তি জানিয়ে জামাও বের করে ফেলেছি। এরমধ্যে আম্মি এসে বলল তারা চলে যাচ্ছে। আমরা যেন জুম্মান ভাইয়ার সাথে আসি। যাওয়ার সময় শাড়ি দেখে প্রশ্ন করল,
“শাড়ি কার?”
সায়মা আপু উত্তর দিলো,
“আমি এনেছি ইলোর জন্য। সুন্দর না?”
“হ্যাঁ, কবে এনেছিস?”
“এনেছিলাম শপিংয়ে যাওয়ার দিনই, আজ বের করলাম।”
“ওহ্ আচ্ছা, কিন্তু ও শাড়ি পরবে না বলছে। সেজন্যই তো আমিও জোর করিনি। অসুস্থ শরীর, পরতে না চাইলে জোর করার দরকার নেই। ও যাতে আরাম বোধ করবে, তা-ই পড়ুক।”
আম্মি চলে যাওয়ার পর আমি সায়মা আপুকে বললাম,
“আপু, আমি কিন্তু বাচ্চা না। শাড়িটা যে তুমি কিনোনি, তা বুঝতে আমার এক সেকেন্ডও সময় লাগেনি। আর না তুমি আমার হাতে মেহেদি পরিয়েছিলে। সবাইকে বুঝাচ্ছ তুমি পরিয়েছ, আমি কিন্তু ওসব বুঝিনি। আজকাল আমার বিপক্ষে চলে যাচ্ছ।”
আপু অবাক হয়ে বলল,
“এই, আমি কি রাজনীতি করছি? পক্ষ-বিপক্ষ আবার কী? তুই বাচ্চা না তা আমিও জানি। এখন তোকে কিচ্ছু বুঝতেও হবে না। পাকামি রেখে পেটিকোট নিয়ে আয়, আর ওই জামা রাখ।”
আমি সে কথা কানে তুললাম না। জামা নিয়ে ওয়াশরুমে ঢোকার আগে শুধু বললাম,
“শাড়িওয়ালাকে বলে দিয়ো, অতিরিক্ত ভাবওয়ালা মানুষের এসব ঢং মানায় না। ভাবে ভাটা পড়ে যাবে।”
জুম্মান ভাইয়া, সায়মা আপু, আমিরা আপু আর মিনহা আপু আমার জন্য অপেক্ষা করছিল। ফলস্বরূপ সবার শেষে কমিউনিটি সেন্টারে পৌঁছালাম আমরা। তখন চারদিকে এলোপাথাড়ি ফটোশুট চলছে। থামাথামির বালাই নেই কারো। অসুস্থতায় বিরক্তি নামক শব্দটা ধরা দেয় খুব সহজেই। বিরক্তি না আসার মতো বিষয়েও বিরক্তি এসে যায়। আমিও কিঞ্চিত বিরক্ত হলাম। যেচে কারো সাথে কথা বাড়ালাম না। কেউ কিছু জিজ্ঞেস করলে দু-এক লাইনে উত্তর দিলাম। অবাধ্য চোখ জোড়া চারদিকে সন্ধান চালিয়ে আজকের সবচেয়ে বিরক্তিকর দৃশ্যে আটকাল। মহাশয় তার প্রাণপ্রিয় বান্ধবী জেসিকা আনামের সাথে সেলফিতে মগ্ন। মুখে সেকি বিশ্ব জয়ের হাসি! যেন বহু বছরের সাধনার পর কোনো প্রকৃত সুন্দরীর সাথে বহুল আকাঙ্ক্ষিত সেলফি তুলতে সক্ষম হয়েছে। চারপাশের সুন্দরী মেয়েদের নজর কাড়ার ধান্দাও হতে পারে। একে বিশ্বাস নেই। লোকটার স্বভাবে বিশাল আকারের দোষ আছে। দু-একটা ছ্যাঁ’কা খেলে উচিত শিক্ষা হত। ছ্যাঁ’কা একেবারে উত্তম মেডিসিনের কাজ করত। এমতাবস্থায় ছ্যাঁ’কাটা আসলে দিবে কে, তা নিয়ে ভয়া’বহ চিন্তায় পড়ে গেলাম। আমার বিরক্তির আ’গুনে ঘি ঢালতে কুলসুম আপার আগমনই যথেষ্ট ছিল। এসেই বক্তৃতা শুরু করলেন,
“দেখছেন আফা? সবাই কত আনন্দ করতাছে, আর আপনে চুপচাপ বইয়া দেখতাছেন। এরেই কয় নিয়তি। আপনের লাইগা আমার যে কী কষ্ট লাগতাছে! অসুখটা আর সময় পাইল না।”
আমাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে সে পুনরায় বলে চলল,
“আমি না একটা জিনিস বহুদিন ধইরা খেয়াল করতাছি। প্রথমে আপনে ছোডো ভাইজানের থিকা দূরে থাকার কত চেষ্টা করতেন। অথচ অহন যেই সময়ই আপনেগরে দেখি, সেই সময়েই দেখি দুইজন আঠার মতো চিপকায় আছেন।”
আমি কপাল কুঁচকে তাকাতেই কুলসুম আপা দাঁতে জিব কে’টে সংশোধন করল,
“কিছু মনে নিয়েন না আফা। আমি কইতে চাইছিলাম, দুইজনরে সবসময় একসাথেই দেখি। আর ছোডো ভাইজান যে আপনেরে অনেক ভালো জানে, তা-ও কিন্তু আমি বুইঝা গেছি। খালি-খালি আপনে ওনারে ডরাইতেন। কিন্তু আফা, দুইদিন ধইরা আপনেরা দুইজন দূরে-দূরে থাকতাছেন, আবার কথাও কইতাছেন না ক্যান? আপনেগো কি ঝগড়া হইছে? কিন্তু আমি তো জানি আপনে কারো সাথে ঝগড়া করেন না। আর আমার বিশ্বাস, আপনের মতো মাইয়া কোনো দোষও করতে পারে না। তাইলে কি ছোডো ভাইজান দোষ করছে? ও আফা, কন না বুঝাইয়া।”
আমি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বসে রইলাম। এ সার্ভেন্ট, না কি সিসি ক্যামেরা? কাজের ফাঁকে এতকিছু খেয়াল করে কীভাবে? মনে তো হচ্ছে এতদিন ধরে সে নিজের কাজ রেখে ডিটেকটিভের ওপর ডিটেকটিভিটি চালিয়েছে। কী সাংঘা’তিক মহিলা! তবে আমার বিরাট ভক্ত হিসেবে যে সে আপাতত আমাকে নির্দোষ, আর তাজ ভাইকে দোষী সাব্যস্ত করে নিজেই ভয়া’নক বিশৃঙ্খলায় পড়ে গেছেন, তা তার চুপসানো মুখ আর কুঁচকানো কপাল দেখেই বুঝা যাচ্ছে। নিজের বিরক্তি দমাতে আর কুলসুম আপার মুখ বন্ধ করতেই আমি প্রসঙ্গ পালটে ফেললাম। কৌতুহল নিয়ে জানতে চাইলাম,
“আপনার ছেলেকে আনেননি, কুলসুম আপা?”
কুলসুম আপা দারুণ খুশি হলেন। দু পাটি দাঁত বের করে হেসে মাথা ঝাঁকিয়ে বললেন,
“হ, আনছি তো। অর বাপেও আইছে। পোলায় কান্দে দেইখা অর বাপের কোলে দিয়া দিছি। আমার পোলাডা হইছে বাপের মতোই হাঁড়ে ব’জ্জাত, বুঝলেন? অর বাপে আমার মগজ ভাইজ্জা ফালায়, আর অয় ভাজে কলিজা। দুইজনে মিল্যা আমার জীবনডারে ভাজা-ভাজা কইরা দিছে। আমি দেইখা তবু সংসার করতাছি। অন্য মহিলা হইলে কবে সংসারের পা’ছায় লা’ত্থি মা’ইরা বিদায় হইত।”
আমার বিরক্তি কমার বদলে আরও একগুণ বাড়ল। কুলসুম আপার এই সংসার জীবনের চরম দুঃখের বিখ্যাত গল্প শুনতে-শুনতে পুরোনো হয়ে মরিচা ধরার জোগাড়; তবু তার এই গল্পের শেষ নেই। সুযোগ পেলেই সে দুঃখের ঝুলি খুলে বসে আর কান ঝালাপালা করে ফেলে। কুলসুম আপার গল্প জমে ওঠার আগেই আমি দ্রুত বাঁধা দিলাম।
“আমার ভালো লাগছে না কুলসুম আপা। আপনি কি আমায় এক গ্লাস ঠান্ডা জুস এনে দিতে পারবেন?”
সে বকবক থামিয়ে ব্যস্ত হয়ে উঠল। কপালে হাত দিয়ে বলল,
“আবার জ্বর উঠছেনি আফা? বড়ো আফারে ডাকমু?”
“না, আমি ঠিক আছি। শুধু এক গ্লাস জুস এনে দিন।”
“আইচ্ছা।”
আপা বিদায় হওয়ায় হাঁফ ছাড়লাম। তার বকবক শুনে না আবার মাথা ধরে যায়। কিন্তু না, শান্তি মিলল না। কোত্থেকে উড়ে এসে আলগোছে পাশের চেয়ারে বসলেন সম্মানিত ডিটেকটিভ সাহেব। আমি ভাবলেশহীন ভঙ্গিতে বসে রইলাম। উনি সরাসরি তাকালেন না। নীরবে হাত উঁচিয়ে কপালে ঠেকালেন। তাপমাত্রা বুঝে নিয়ে আবার নামিয়ে নিলেন। এর পরের কাজটা করলেন আরও শান্তভাবে। আমার কোলের ওপর থেকে ডান হাতটা তুলে নিজের কোলে নিলেন।আমি নীরব চোখে চাইলাম দুটো শক্তপোক্ত হাতের মুঠোয় বন্দী আমার অবলা হাতটার পানে। দেখলাম শক্তপোক্ত হাত দুটির একটি নিজের রক্তলাল পাঞ্জাবির পকেট থেকে একটা বেলি ফুলের ছোটো মালা বের করে আমার হাতে প্যাঁচিয়ে দিলো। অনুভূতিটুকু সূক্ষ্ম অভিমানে বুঝি গ্রাস হলো। আগ বাড়িয়ে মুখ ফুটে কথা বেরুল না। কেবল মন আওড়াল, সে কেন বলার চেষ্টা করছে না। রাগ থেকে ছোটো একটা কথাই তো বলেছিলাম, তার জন্য এমন কি মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে গেছে? মুখে তো একবার জিজ্ঞেসও করতে পারত, শরীর কেমন আছে। পেছনে যত্ন দেখিয়ে মনে রাগ পুষে রাখবে কেন? সে স্বাভাবিক হলে আমি কি মুখ ভার করে থাকতাম? একটামাত্র কথা বললে কি উত্তর না দিয়ে এড়িয়ে যেতাম? চেষ্টাটুকু তো করল না। পৃথিবীর সমস্ত রাগ, অভিমান বুঝি শুধু তার মধ্যেই আছে? এই যে হাতে এত যত্ন নিয়ে মালা পরাল, আমি কি বাঁধা দিয়েছি? মুখ না খুলে বোবার মতো হাতের দিকে তাকিয়ে থাকার কোনো মানে হয়? হাতের রূপ বেড়েছে, না বেলি ফুলের মালার প্রেমে-ট্রেমে পড়ে গেছে? কখন না আবার কেউ এ বিরল দৃশ্য দেখে চেঁচিয়ে অজ্ঞান-টজ্ঞান হয়ে পড়ে থাকে। সতর্ক দৃষ্টি চারদিকে ঘুরাতে গিয়ে সর্বপ্রথম আমার দৃষ্টিগোচর হলো আফরা আপু। তার পাশাপাশি হাঁটছে তার হাস্যোজ্জল হবু বর। তাদেরকে বিয়েতে নিমন্ত্রণ করেছেন নূর আঙ্কেল। এদিকে আফরা আপুর চোখে-মুখে রাজ্যের বিরক্তি। নিজের হবু বরকে না পারছে সাদরে গ্রহণ করতে, না পারছে এড়িয়ে চলতে। আমি আলগোছে নিজের হাতটা সরানোর চেষ্টা করলাম। কিন্তু পারলাম না। হাতের বাঁধন শক্ত হলো। আফরা আপু এদিকেই আসছে। আমি বিরক্ত হলাম। একটু জোর খাটানোর প্রয়োজন বোধ করলাম। কিন্তু তাতেও লাভ হলো না। হাত ছাড়ানোর বৃথা চেষ্টা করে বিরক্ত চোখ তুলে তাকালাম। ওমা! মহাশয় সূক্ষ্ম চোখে আফরা আপু আর তার হবু বরকে দেখছে। বাড়তি বিরক্তিতে কপাল কুঁচকে এল। এভাবে দেখার কী আছে? এমন তো নয় যে প্রথম দেখছে। কষ্ট লাগছে বুঝি? কই? এদিকে তো একবারও চোখ ঘুরল না। আমাকে অবাক করে দিয়ে আফরা আপু আমাদের কাছে থামল না। পাশ দিয়ে চলে গেল। আমি ঘাড় ঘুরিয়ে দেখতে লাগলাম আফরা আপু কোন দিকে যাচ্ছে। এদিকে উনি আমার হাতের মুঠোয় একটা বস্তু গুঁজে দিয়ে হাত ছেড়ে উঠে হনহনিয়ে চলে গেলেন। তবু একবার তাকালেন না, আশ্চর্য! গুমোট মুখে মুঠোর চিরকুট খুললাম।
“প্রখর আত্মসম্মানের অধিকারী দুজন মানুষের মধ্যকার অভিমান বড়ো ভয়া’নক হয়। না যায় বলা, না যায় সওয়া। কেউ-কেউ তো অপর মানুষটার মনের খোঁজটাও নেয় না। তারা কী ভাবে? অপর মানুষটা বেশ আছে? দিব্যি হেসে-খেলে দিন পার করছে? আরামসে ঘুমিয়ে রাত ভোর করছে? আদৌ কি তা হয়? অভিমানে বুঝি মনের খোঁজ নেওয়া-ও বারণ?”
এতক্ষণে কুলসুম আপারও আসার সময় হলো। সে এসেই জুসের গ্লাস বাড়িয়ে ধরে ছোটোখাটো কৈফিয়ত দিয়ে বসলেন।
“কিছু মনে কইরেন না আফা। আমার ব’জ্জাত পোলাডায় কাইন্দা ভাসাইয়া ফালাইতাছিল। অরে ঠান্ডা করতে গিয়া আপনের ঠান্ডা জুস গরম হইয়া গেছিল। অহন আবার ঠান্ডাডা নিয়া আইছি। লন, লন, তাড়াতাড়ি খাইয়া লন।”
চিরকুটটা হাতের মুঠোয় মুচড়ে ধরে আমি গভীর শ্বাস নিলাম। চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে মৃদু স্বরে বললাম,
“আপনি খেয়ে নিন। আমার আর ইচ্ছে করছে না।”
“ক্যান? আবার কী হইল আপনের? হাছা কইরা কন তো আফা, আপনের শইল আবার খারাপ লাগেনি।”
“না।”
ছোট্ট উত্তরটা দিয়ে আমি সেখান থেকে প্রস্থান করলাম। জমজমাট অনুষ্ঠানের পুরো আয়োজন আমায় বিন্দুমাত্র ছুঁতে পারল না। খাবারটাও খুব একটা মুখে রোচল না। সবাই বরাবরের মতোই ভেবে নিল শরীর খারাপের পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া। ইতোমধ্যে আফরা আপুর আরও এক ধাপ ক্রো’ধের মুখোমুখিও হতে হয়েছে আমায়। পূর্বের ন্যায় নিজের নোংরা মানসিকতা আর লাগামহীন কটূক্তি ঝাড়তে সে আজকের পরিবেশটাও বিবেচনা করেনি। তখনকার মুঠোবন্দী হাতের দৃশ্যটুকু মোটেও তার শকুন দৃষ্টি এড়াতে পারেনি। যা নয় তা বলে আমায় এটাই বুঝানোর চেষ্টা করেছে যে, আমি লোভ থেকে তাজ ভাইয়ের পেছনে পড়ে আছি। এমনকি সে আমার চরিত্রের দিকে আঙুল তুলতেও ভুলেনি। কমিউনিটি সেন্টার ভর্তি লোকজনের সামনে নিজের সম্মানটা হারানোর ভয়ে আজ আর জোর গলায় প্রতিবাদ করা হয়নি। তার মতো হওয়া সম্ভব ছিল না। চাপা স্বরে থামানোর শত চেষ্টাটা করেও ব্যর্থ হয়েছি। কিন্তু আত্মসম্মানে লাগা আঘা’তটা আজ আর সয়ে নিতে পারলাম না। শেষমেষ ঠিক করে নিলাম তাজ ভাইয়ের সাথে এ বিষয়ে কথা বলব। অনেক হয়েছে, এবার এর একটা বিহিত অবশ্যই জরুরি। নইলে এই আফরা মেয়েটার বাড়াবাড়ি সহ্যের সীমা অতিক্রম করেও থামার নাম নিবে না। আজ ওনাকে এর সমাধান দিতেই হবে। আমি কেন ওনার জন্য এসব ভোগ করব? কিন্তু ওনাকে একা পাওয়া গেল না। অনুষ্ঠানের পুরোটা সময় পুরোদস্তুর ব্যস্ত ছিলেন। কয়েকবার চারপাশে ঘুরঘুর করেও ফিরে আসতে হয়েছে, তবু উনি মুখ খোলেননি। জানতে চাননি কিছু বলার আছে কি না। মাইন্ড রিডিংয়ের কী হলো? ভাবলাম বাসায় ফিরে কথা বলব। অনুষ্ঠানের পাট চুকিয়ে সন্ধ্যার পর বাসায় ফিরলাম ঠিকই, কিন্তু ওনাকে আর পেলাম না। বাসা থেকেই নিরুদ্দেশ সে। খুঁজেও দেখা মিলল না, আর না ফোনে পাওয়া গেল। ওদিকে আব্বু বাড়ি ফেরার তাড়ায় আছে। সবাই তাকে অনেক অনুরোধ করেছিল বউ-ভাতের পর যাওয়ার জন্য। কিন্তু সে থাকতে পারবে না। কী এক জরুরি কাজ আছে তার। হুট করে আমি বায়না ধরে বসলাম আব্বুর সাথে বাড়ি যাওয়ার। আমার কথা শুনে সবাই অবাক হলো। এক কথায় না-বোধক উত্তর দিয়ে দিলো। কিন্তু আমি রীতিমতো অনুরোধ করলাম। আম্মিকে বুঝালাম আমার আম্মুর কাছে না যাওয়া পর্যন্ত আমি সুস্থ হব না। তার কাছে গেলেই আমি সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠব। তারপর রাজ ভাইয়ের বউ নিয়ে গ্রামে গেলে তাদের সাথে আবার ফিরে আসব। নূর আঙ্কেল বললেন আমি যেন আর পাঁচটা দিন অপেক্ষা করে রাজ ভাইয়াদের সাথেই যাই। কিন্তু আমি নিজের কথায় অটল থাকলাম। শেষমেষ আব্বু আমার হয়ে সবাইকে বুঝাল, এই অসুস্থতা নিয়ে আমি যখন কোনো অনুষ্ঠান উপভোগ করতে পারছি না, তখন আম্মুর কাছ থেকে ঘুরে আসাই ভালো হবে। তার কথায় নূর আঙ্কেল আর আম্মি মিনমিনে গলায় রাজি হলেন। রাজ ভাইয়াকে বুঝাতেও কষ্ট হলো। কিন্তু আজ আর এখানে থাকার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে আমার মধ্যে নেই। এখানে থাকা মানেই নিজের সম্মান ন’ষ্ট করা। আফরা আপু বিদায় না হতে আমি কোনোভাবেই এ মুখো হব না। হলেও আর এখানে থাকব না। প্রয়োজনে হলে উঠব, কিংবা ভাড়া বাসায়। পরবর্তীতে যে আবার কখনও আমায় এমন বাজে পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হবে না, তার তো মোটেও নিশ্চয়তা নেই। এতটা নির্লজ্জ তো আমি হতে পারব না। থাক যে যার রাগ, অভিমান, প্রখর আত্মসম্মান পুষে। যে প্রয়োজনের সময় খোঁজ নেওয়ার বদলে নিজেই নিখোঁজ হয়, তাকে আর খোঁজার মানে হয় না। এরপর না হয় সে-ও বুঝুক, তার আত্মসম্মানের কাছে কেউ হেরে বসে থাকবে না। তার অভাবেও কেউ ম’রে যাবে না। অভিমানটা তবে ভয়া’নকই হোক।
#মনোহারিণী
লেখনীতে—ইলোরা জাহান ঊর্মি
২০.
“আমায় দাও স্নিগ্ধ এক সকালের ঋণ
বিনিময়ে পাবে গোটা এক আনন্দঘন দিন,
আমায় দাও সকালের একটুখানি প্রশান্তি
বিনিময়ে দিবো মুছে অন্তস্তলের ক্লান্তি।
আমায় দাও সকালের এক ফোঁটা কোমলতা
বিনিময়ে পাবে হৃদয় নিংড়ানো সরলতা,
আমায় দাও সকাল, হলেও তা হ্রস্ব
বিনিময়ে দিবো তোমায় এক মহাবিশ্ব।”
স্নিগ্ধ সকাল, আমার প্রিয় একটা সময়। আমার বহু পুরোনো এক অভ্যাস হচ্ছে, ভোরের আলো ফোটার পর বাড়ির সামনের রাস্তায় হাঁটাহাঁটি করা। কখনও সামনের রাস্তা ধরে পেছনে চলে যাওয়া, কখনও সোজা রাস্তা ধরে বাড়ির অনতিদূরে অবস্থিত নদীর তীরে যাওয়া। নদীর তীরে গিয়ে খালি পায়ে ভেজা তুলতুলে মাটিতে হাঁটা, তারপর নদীর পানিতে পা ধোয়া বা পাড়ের ঢেউয়ের পানিতে পা ডুবিয়ে দাঁড়িয়ে থাকার মতো আনন্দ সকালের অন্য কোনো কিছুতেই পাওয়া যায় না। তার সাথে নদীর তীরের মাটির টিলার ওপর দাঁড়িয়ে স্নিগ্ধ সকালের সূর্যদয় দেখা তো আছেই। পূর্ব আকাশ লালচে আভা ছড়িয়ে সফেদ মেঘের আড়াল থেকে থালার মতো গোলগাল লাল টুকটুকে সূর্যটা উঁকি মা’রে। তারপর ধীরে-ধীরে মেঘের আড়াল থেকে বেরিয়ে গোটা ধরণি উত্তপ্ত আলোয় আলোকিত করে তোলে। আহ্, কী মনোরম সে দৃশ্য! নদীর পাশে একটা ইটের ভাটাও আছে। যে ছয় মাস ওটা বন্ধ থাকে, সে সময়টাতে পুরো ইটের ভাটা সবুজ ঘাসের আস্তরনে ঢাকা থাকে। সকালের শিথিল পরিবেশে খালি পায়ে সেই ঘাসের ওপর হাঁটলে মন আপনা-আপনি হেসে ওঠে। এবার বাড়ি আসার পর এমন সকাল উপভোগ করা হয়ে ওঠেনি। অথচ এক সপ্তাহ হয়ে গেছে বাড়ি এসেছি। এই এক সপ্তাহ রোজ সময় কেটেছে এক রুটিনে। সারাদিন পরিবারের সাথে হাসি-খুশি সময় কাটানো, আম্মুর হাতের মজার-মজার সব খাবার খাওয়া আর রাত হলে চুপচাপ বিছানায় পড়ে থাকা। কোথাও ঘোরাঘুরি করারও ইচ্ছে নেই। রাত হলে কোনো এক কারণে মনটা বড্ড উতলা হয়ে থাকে। ফলস্বরূপ সকালটা অলসতা মাখিয়ে ঘুমিয়েই কাটাই। আজকের সকালটাও এর ব্যতিক্রম হয়নি। ফজরের নামাজের পর সেই যে আবার ঘুমিয়েছিলাম, এখন উঠে দেখি বেলা সাড়ে আটটা। অলস শরীরটাকে টেনেহিঁচড়ে বিছানা থেকে নামিয়ে ফ্রেশ না হয়েই রান্নাঘরে চলে গেলাম। দেখলাম আম্মু সকালের নাস্তা বানাচ্ছে। আমাকে দেখেই হাঁক ছাড়ল,
“অমি, মুখটাও ধুসনি এখনও? যা হাত-মুখ ধুয়ে আয় তাড়াতাড়ি।”
আম্মুর আদেশের দিকে আমার বিশেষ খেয়াল নেই। তখন আমার বিস্মিত দৃষ্টি খাবারের আইটেমের দিকে। সকাল-সকাল এত পদ রান্না করছে কেন? তবে প্রশ্নটা নিয়ে ঘাঁটলাম না। কারণ অনেক দিন পর আমি এলে আম্মু এই কাজটাই করে। আজ সকাল-সকাল করেছে বলেই একটু অবাক হয়েছি। ফ্রেশ হয়ে চুলে চিরুনি চালানোর সময় চোখ গেল শিয়রের পাশে পড়ে থাকা অলস ফোনটার ওপর। গত একটা সপ্তাহ কতশত বার ম্যাসেজ বক্স চেক করেছি। কিন্তু কেবল সিম কোম্পানির ম্যাসেজ ছাড়া বাড়তি একটা ম্যাসজও কারো থেকে আসেনি। রাজ ভাইয়ের বউ নিয়ে পুরো পরিবার শরীয়তপুর এসেছে দুদিন ধরে। আব্বুকে বারবার ফোন করে বলা হয়েছে আমাদের সবাইকে নিয়ে যেন সে সদরে যায়। কিন্তু আব্বুর এক কথা, নতুন বউ নিয়ে আগে আমাদের বাড়ি আসতে হবে। আম্মি আমাকে যেতে বলার পর আমিও এ কথাই বলেছি। এই অছিলায় জেনিফার ভাবি আমাদের বাড়িও চিনতে পারবে, আর মনমতো ঘোরাঘুরিও করতে পারবে। নূর আঙ্কেল বলেছেন আসবেন, তবে কবে আসবেন সেটা অনিশ্চিত। খুব বেশিদিন শরীয়তপুর থাকা হবে না তাদের। হয়তো আগামী সপ্তাহেই ঢাকায় ফিরে যাবেন। আমার একটা বাজে অভ্যাসের মধ্যে একটি হচ্ছে চুল আঁচড়ানোর সময় সারা ঘর হেঁটে বেড়ানো। আজও স্বভাবসুলভ মাথায় চিরুনি চালাতে-চালাতে রুম থেকে বেরিয়ে এলাম। হঠাৎই চোখ গেল ডাইনিং টেবিলের দিকে। বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে আমি সেখানেই দাঁড়িয়ে পড়লাম। মাথা থেকে চিরুনি ধরা হাতটা আপন শক্তিতে নেমে পড়ল। সকাল-সকাল এমন শক নেওয়া যায়? এরইমধ্যে আম্মুর ডাক পড়ল।
“কিরে? দাঁড়িয়ে আছিস কেন? চিরুনি রেখে খেতে বোস।”
আমি চিরুনিটা রেখে চুপচাপ আব্বুর পাশের চেয়ার টেনে বসে পড়লাম। আড়চোখে এদিক-ওদিক দৃষ্টি বিচরণ করতে-করতে রুটি চিবোচ্ছিলাম। হঠাৎ আব্বু কথায়-কথায় বলে উঠল,
“এত তাড়াহুড়োর কিছু নেই। আজকের দিনটা থেকে কাল যেয়ো, তাজ।”
আয়েসি ভঙ্গিতে একের পর এক খাবার গলধঃকরন করা তাজ সাহেব নড়েচড়ে বসলেন। কায়দা করে একবার সরাসরি আমার চোখের দিকে তাকিয়ে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিয়ে বললেন,
“না আঙ্কেল, আজই যেতে হবে। আমাদের কিছু প্ল্যান প্রোগ্রাম আছে। কাল সকালেই ঢাকায় রওয়ানা হব।”
আম্মু আহাজারি করে উঠল,
“এ কেমন কথা? রাজের বউটা নতুন। আমাদের বাড়িতে একবার আসতেও পারবে না? ভাই তো বলেছিল আসবে।”
“আব্বু বলেছিল, কিন্তু আমাদের প্ল্যানিংয়ের জন্য আসতে পারবে না। তাতে কী হয়েছে আন্টি? পরেরবার এসে না হয় বেশিদিন বেড়াবে।”
আব্বু-আম্মু বড়ো নারাজ হলো। দুজন আহাজারিতে পরিবেশ ভারী করে তুলছে। এদিকে আমার মাথায় এক প্রশ্নই ঘুরপাক খাচ্ছে, এই আপদ কখন এল? আমি টের পেলাম না কেন? একদম সকালে সেই সদর থেকে হাটুরিয়া আসা তো মুখের কথা নয়। তবে এল কীভাবে? আবার বলছে আজই চলে যাবে। কী আজগুবি ব্যাপার-স্যাপার! পরে শুনলাম গতকাল রাতে এসেছে। গতকাল রাতে আমি একটু তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, তাই টেরও পাইনি। খাবার টেবিলে আমি প্রয়োজনের বেশি বাক্য ব্যয় করলাম না। একপ্রকার চুপচাপ খাওয়া শেষ করে কে’টে পড়লাম। তাজ ভাইও আব্বুর সাথে বাইরে বেরুল। সকাল এগারোটার দিকে আমি আমাদের বাড়ির সবচেয়ে ছোটো সদস্য তাসবির সাথে দুষ্টুমি করছিলাম। তাসবি আব্বুর চাচাতো ভাইয়ের ছোটো মেয়ে। বাড়ির সবার আদুরে মিষ্টি মেয়ে সে। বয়স মাত্র তিন বছর হলেও তার কথার ধরন ছয় বছরের বাচ্চাদের মতো। অতিরিক্ত দুষ্টু মেয়েটা। সারাদিন সারা বাড়ি দৌড়ানো আর দুষ্টুমি করাই তার প্রধান কাজ। কথাগুলোও মন ভালো করার মতো। আমাকে সে খুব ভালোবাসে। বাড়ির সবাই আমাকে ডাকে ‘অমি’ নামে। তাসবি ‘অমি’ ডাকতে পারে না বলে ‘ইমি’ ডাকে। মিহি সুরে ‘ইমি’ ডাকটা কী যে মিষ্টি লাগে! ওর আর আমার জন্ম তারিখ, মাস একই। তাই সবাই মজা করে বলে এই কারণেই তাসবি আমাকে এত পছন্দ করে। আমি এলেই ও আমার পেছনে ফেভিকল আঠার মতো লেগে থাকে। এই তো এখন আমার রুমের সব ওলট-পালট করে খেলছে। ওর খেলাই হচ্ছে গোছানো ঘর অগোছালো করা। আমি ওকে টেনেটুনে এনে বিছানায় বসালাম। আবার শুরু হলো বালিশ নিয়ে খেলা। খেলার মাঝেই সে ফটাফট সব কথার উত্তর দিচ্ছে। আমি প্রশ্ন করলাম,
“তোমার নাম কী?”
সে সুমিষ্ট সুরে উত্তর দিলো,
“তাবজি।”
“তাবজি না, তাসবি,” সংশোধন করে দিলাম আমি।
“তাবজি।”
যতবারই সংশোধন করে দেই না কেন, ও এই ভুল উচ্চারণই করবে। তাই পরবর্তী প্রশ্ন করলাম,
“তোমার বাবার নাম কী?”
“বাশা উকিল।”
আমি ফিক করে হেসে উঠে বললাম,
“বাশা না, বাশার। আর তোমার আম্মুর নাম?”
“পাব্বিন।”
নাম পারভীন, ওর উচ্চারণ পাব্বিন।
“তোমার ভাইয়ার নাম কী?”
“পঅশ।”
“পঅশ? না কি পরশ?”
“না, পঅশ।”
অর্থাৎ ও যা বলবে তা-ই ঠিক। আমারটাই ভুল। ক্যালেন্ডারে কাঁঠালের ছবি দেখে বলল,
“কাঁতাল।”
“কাঁঠাল? আচ্ছা, বলো তো জ্যাকফ্রুট।”
তাসবি কপাল কুঁচকে তাকিয়ে উচ্চারণ করার চেষ্টা করল,
“ঝ্যাপ্রুত।”
আমি হেসে বললাম,
“বলো জ্যাক?”
সে মাথা দুলিয়ে বলল,
“জ্যাক।”
“ফ্রুট।”
“প্রুট।”
“জ্যাকফ্রুট।”
“ঝ্যাপ্রুত।”
আমি খিলখিল করে হেসে উঠলাম। এরপর যতবারই শব্দটা সঠিকভাবে উচ্চারণ করাতে চাইলাম, ততবারই ও ভুল উচ্চারণ করল। বড়ো শব্দ বলে সম্পূর্ণ উচ্চারণ করতে কষ্ট হয়ে পড়েছে, তবু মেয়েটা চেষ্টা তো করেছে। আমি হাসতে-হাসতে বিছানায় লুটিয়ে পড়েছি দেখে তাসবিও ছোট্ট ঝকঝকে দাঁতগুলো বের করে হাসছে। হাসলে ওর চোখ দুটোও কুঁচকে যায়। হঠাৎ দরজায় দৃষ্টি পড়তেই আমার হাসি কর্পূরের মতো উবে গেল। মুখ বন্ধ করে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলাম। দরজায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটা নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে ভেতরে চলে এল। বিছানার একপাশে বসে তাসবিকে টেনে নিজের কোলো তুলে নিল। কিন্তু তাসবি এই মুহূর্তে কোলে উঠতে নারাজ। সে হাত-পা ছুঁড়ে কোল থেকে নামার চেষ্টা করছে। তাজ ভাই সামলানোর চেষ্টা করতে গিয়ে উলটো তাসবির কনুইয়ের গুঁতো খেয়ে নাকে ব্যথা পেলেন। মৃদু সুরে ব্যথাতুর শব্দ তুলতেই আমি চমকে উঠলাম। তাসবিও শান্ত হয়ে গেল। হয়তো ভেবেছে তার জন্যই মানুষটা ব্যথা পেয়েছ। তাই তাজ ভাই যে হাত দিয়ে নাক ঘঁষছিলেন, ওই হাতটা ধরে চট করে বলে বসল,
“ছুরি।”
তাজ ভাই অবাক হয়ে বলল,
“এই পুঁচকি, স্যরি মানে বুঝিস তুই?”
তাসবি চোখ পিটপিট করে তাকিয়ে আছে। তাজ ভাই রেগে আছে ভেবে এবার তার গালে একহাত রেখে বলল,
“আবিউ।”
এবার তাজ ভাই আরও অবাক হলেন। আমি আবার হেসে উঠলাম। তাজ ভাই তাসবির থুতনি ধরে বলল,
“আই লাভ ইউ?”
“আবিউ,” পুনরায় বলল তাসবি।
তাজ ভাই ওর নরম গালে চুমু খেয়ে আদর করে দিলেন। আমাকে হাসতে দেখে বলে উঠলেন,
“এত খুশি হওয়ার কী আছে? ওকে এসব তুই শিখিয়েছিস তাহলে? আহহা, বুঝেছি। নিজে বলতে পারছিস না বলে এই পুঁচকিকে কাজে লাগাচ্ছিস। এত কষ্ট করার দরকার ছিল না, নিজেই বলতে পারতি। যদিও আমি পাত্তা দিতাম না।”
আমি হাসি থামিয়ে চোখ সরু করে বললাম,
“নিজেকে এত স্পেশাল ভাবা বন্ধ করুন, তাজ ভাই। কাকি ওকে এসব শিখিয়েছে, আমি নই। আমার ঠেকা পড়েনি। পৃথিবীতে বহু ছেলে আছে।”
তাজ ভাই ঠোঁট প্রসারিত করে হেসে বললেন,
“তারা সবাই তাজের মতোই ছেলে, কিন্তু কেউ তাজ নয়। স্বীকার করে নে, তাজ দ্য গ্রেট ডিটেকটিভ। যদিও তুই হিং’সুটে, স্বীকার করবি না। তাতে আমার কিচ্ছু যায় আসে না। নিন্দুকদের মুখে চুনকালি মেখে তাজ সবসময়ই গ্রেট থাকবে।”
“হাহ্, ওভার কনফিডেন্স।”
তাচ্ছিল্যের স্বরে কথাটা বলেই আমি বিছানা ছেড়ে হাঁটা ধরলাম। পেছন থেকে তাজ ভাই বলে উঠলেন,
“তাড়াতাড়ি ব্যাগ গুছিয়ে নিন ম্যাম। পরে রওয়ানা হওয়ার সময় তাড়াহুড়ো যেন না হয়।”
আমার পা দুটো দরজার কাছেই থমকে গেল। ঘুরে দাঁড়িয়ে অবাক হয়ে বললাম,
“আমি ব্যাগ গুছিয়ে কী করব? আমি কি আপনার সাথে যাব বলেছি?”
“তো আমি কি চেহারা দেখাতে এসেছি? আম্মিই তো পাঠাল তার পালিত মেয়েকে নিতে।”
“কী? মিথ্যে কথা বলছেন আপনি। আমাকে তো কেউ কিছু বলেনি। যাওয়ার কথা তো না-ই।”
“বলতে হবে কেন? তুই নিজেই না কি বলে এসেছিস সবাই এলে তাদের সাথে ফিরবি?”
আমি হোঁচট খেলাম। কথাটা তো তখন অজুহাত হিসেবে বলেছিলাম। আমি আর ওখানে দাঁড়ালাম না। চলে যেতে-যেতে শুধু বললাম,
“আপনি চলে গেলে যান, আমি যাব না।”
রান্নাঘরে গিয়ে আম্মুকে বললাম,
“আমি তাজ ভাইয়ের সাথে যাব না। আরও কয়েকটা দিন থাকব।”
“থাকতে তো না নেই। কিন্তু তখন তোকে দিয়ে আসবে কে? তোর আব্বু তো যেতে পারবে না।”
“আমি কিছু জানি না। আজ আমি যাব না মানে যাব না। আর একটা কথা, এবার গিয়ে আমি নূর আঙ্কেলের বাসায় উঠব না। হয় হলে উঠব, নয় ভাড়া বাসায়। তুমি আব্বুর সাথে কথা বলে এসো। বলবে আমায় যেন কোনো একটা ব্যবস্থা আরে দেয়।”
আম্মু রান্না থামিয়ে অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।
“হঠাৎ এসব বলছিস কেন? কেউ কিছু বলেছে?”
“কে কী বলবে? আমারই মনে হচ্ছে ওখানে এভাবে মাসের পর মাস পড়ে থাকা ঠিক হচ্ছে না।”
আম্মু সন্দিহান কন্ঠে বলল,
“সত্যি করে বল তো, কে কী বলেছে। আমি নিশ্চিত তুই কিছু লুকাচ্ছিস।”
“ওই বাসার কেউ আমাকে কিচ্ছু বলেনি, আম্মু। তুমি কি জানো না তারা কেমন?”
“তাহলে যেতে চাইছিস না কেন? কোনো সমস্যা থাকলে বল আমাকে।”
“অন্য সমস্যা। ওসবে তারা জড়িত না, তাই পরে বলব। আপাতত তুমি আব্বুকে বলে আমার যাওয়াটা আটকাও আর থাকার ব্যবস্থা করো।”
আম্মু বলে উঠল,
“তুই নিজে গিয়ে কথা বল। হুট করে এমন কথা শুনলে তোর আব্বুও নিশ্চিত সন্দেহ করবে।”
“সন্দেহ করার কী আছে?”
“না করারই বা কী আছে? এখন এই কথা শুনলে যেকেউ সন্দেহ করবে। আসল কারণ জানতে চাইবে। তুই আসল কারণটা না বললে আমি গিয়ে কী বলব তোর আব্বুকে?”
আমি চুপসানো মুখে বললাম,
“সমস্যা আফরা আপুকে নিয়ে।”
আম্মু গোয়েন্দার মতো প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলো,
“আফরা, তাজের ফুপাতো বোনটা না? মেয়েটার চালচলন আমার কাছে সুবিধার লাগে না। কী করেছে তোর সাথে?”
আমিও এই পর্যন্ত আমার সাথে আফরা আপুর করা সব দুর্ব্যবহার আর বাজে কথাগুলো গরগর করে বলে দিলাম। পৃথিবীতে এই একটা মানুষটার কাছে এসেই আমি আটকে যাই। কখনও কোনো কথা গোপন রাখতে পারি না। যতক্ষণ না অবধি বলতে পারি, ততক্ষণ পেটের কথা হজম হয় না। আফরা আপুর বি’শ্রী কথা শুনে আম্মুর মেজাজ তুঙ্গে উঠে গেল। তবে আম্মু বুদ্ধিমান নারী। আগেই আব্বুর সাথে কথা বলল না। কারণ আব্বু বদমেজাজি পুরুষ। মেয়েকে কেউ এমন কুরু’চিপূর্ণ কথা বলেছে শুনলে মাথায় র’ক্ত চড়ে বসবে। তাই আম্মু গেল আগে তাজ ভাইয়ের সাথে কথা বলতে। আমিও পেছন-পেছন গিয়ে দরজার বাইরে থেকে আড়ি পাতলাম। আম্মু ঠান্ডা মাথায় তাজ ভাইকে ব্যাপারটা জানাল। আমি ভেবেছিলাম তাজ ভাই এসব শুনলে রেগে যাবেন। কিন্তু তেমন কিছুই হলো না। উনি স্বাভাবিক গলায় বললেন,
“আমি এসব জানি আন্টি। এই ঘটনার সময় আমি ওখানে ছিলাম না। পরে সৌরভ আমাকে সব বলেছে। সৌরভ তখন সব কথা শুনেছিল। ওর থেকে জানার পর আমি তখনই এসবের সমাধান করেছি।”
আমি অবাক হলাম। সৌরভ ভাইয়া তখন আশেপাশে ছিল তা আমি একদমই জানতাম না। এই লোক কী সমাধান করেছে তা শোনার জন্য কৌতুহলী হয়ে উঠলাম। আম্মু জিজ্ঞেস করল,
“কী সমাধান করেছ? তোমার ফুপা-ফুপুকে জানিয়েছ?”
“আসলে আফরার তো বিয়ে ঠিক হয়ে আছে। দু-এক মাসের মধ্যেই বিয়ে হয়ে যাবে। এই মুহুর্তে এমন কিছু শুনলে হয়তো আব্বু রেগে যাবে। আমি আসলে চাচ্ছিলাম না যে আব্বুর সাথে ফুপা-ফুপুর মনোমালিন্য হোক। ব্যাপারটা সবাই জানলে আরও খারাপ হয়ে দাঁড়াত। তাই আমি শুধু ভাইয়াকে জানিয়েছিলাম। ভাইয়া আর আমি মিলে আফরার সাথে কথা বলেছি। ধরা পড়ে যাওয়ায় ও আমাদের কাছে ক্ষমাও চেয়েছে। কারণ ফুপা জানলে ওকে-ও ছেড়ে কথা বলবে না। বউ-ভাতের অনুষ্ঠানের পরদিনই আমি ওকে ওর বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছি। ও কথা দিয়েছে যে ওর বিয়ের আগে আর ও আমাদের বাসায় পা রাখবে না। এখন আপনিই বলুন আন্টি, আমার সমাধান কি ভুল হয়েছে? আপনার যদি মনে হয় ভুল হয়েছে, তাহলে আপনাদের সিদ্ধান্তই মেনে নিবে সবাই। আপনাদের মেয়ের সম্মান আমাদের কাছে কোনোকালেই তুচ্ছ ছিল না।”
আম্মুর প্রত্যুত্তর শোনার অপেক্ষায় রইলাম না আমি। দীর্ঘশ্বাস চেপে সরে পড়লাম। মানসপটে ভাসছে আমার অনুপস্থিতিতে কী অবস্থাই না হয়েছিল ওদিকে। আফরা আপুর ক্ষমা প্রার্থনার ব্যাপারটা ভেবে শান্তিও পেলাম। উচিত শিক্ষা পেয়েছে মেয়েটা। এটারই দরকার ছিল। কিন্তু আমার যাওয়াটা আর আটকাতে পারলাম না। আম্মুর কথায় সেই তাজ ভাইয়ের সাথেই যেতে হলো। আমাদের সাথে গেল আব্বু। আব্বু সবার সাথে দেখা করে আজ রাতেই আবার ফিরে আসবে। তাজ ভাইদের গ্রামের বাড়িতে থাকে শুধু হিমেল কাকার পরিবার আর দাদিমা। নূর আঙ্কেল এলে যখন সবাই এই গ্রামের বাড়িতে একত্রিত হয়, তখন বাড়িটা যেন জীবন্ত হয়ে ওঠে। এবার শুধু ফুপুর পরিবার ছাড়া বাকি সবাই এসেছে। আমি আসার পর থেকে আমার কানের কাছে পুরো গ্যাং মাছির মতো ভনভন করে চলেছে। গ্রামে এসে গত দুদিন ধরে তারা কী করেছে, কোথায় গিয়েছে, কী খেয়েছে সব বিবরণ কানে ঢালছে। এদিকে আমি বড্ড আফসোসে ম’রে যাচ্ছি। সব বিনোদন মিস করে ফেললাম আমি। কেন যে অতিরিক্ত রাগে বাড়ি বসে থাকতে গিয়েছিলাম। এখন এ বাড়িতে শুধু আজ রাতটুকুই আমার কপালে জুটবে। তা-ও আজ রাতটা সবাই ঘুমিয়ে কা’টাবে। কারণ আগামীকাল সকালেই ঢাকার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হতে হবে। রাজ ভাইকে রাজি করিয়ে সবাই সন্ধ্যাটুকু বাইরে থেকে ঘুরে আসার পরিকল্পনা করছে। এদিকে তাজ ভাইকে দেখে আমি বললাম,
“আপনার কার্ডটা দিন তো তাজ ভাই।”
“কোন মহাবিশ্ব উদ্ধার করতে?”
“আপনি তো ঘুরতে যাবেন না বললেন। আমি ভাবছি শরীয়তপুর পুলিশ লাইনের দিকে ঘুরতে যাব। ভেতরে গিয়ে আপনার কার্ডটা দেখিয়ে একটু আদর-আপ্যায়ন পেলে মন্দ কী? ঘুরতে যাওয়াটা সার্থক হবে আমাদের।”
উনি বিদ্রুপ করে বললেন,
“ওটা তো তোর শশুর বাড়ি, তুই যাবি আর তোকে বউআদর করতে লেগে পড়বে সবাই। তাই না? আর শ্বশুরবাড়িতে উঠলে তো জামাইয়ের পরিচয় অত্যধিক জরুরি। তা, কার্ড দেখিয়ে নিজেকে কার বউ পরিচয় দিবি ঠিক করেছিস?”
আমি বিরক্ত চোখে চেয়ে বললাম,
“লাগবে না আপনার কার্ড। মাফ চাই মাননীয় ডিটেকটিভ সাহেব।”
“ওমা! তুই কেন মাফ চাইছিস? মাফ তো আমার চাওয়া উচিত, তাই না?”
আমি অবাক হয়ে শুধালাম,
“আপনি কিসের মাফ চাইবেন?”
“আমার কারণেই না কি অত বাজে পরিস্থিতিতে পড়তে হয়েছিল?”
সেই এক কথা। আমি আন্দাজ করেছিলাম ঠিক এই কথাটার কারণেই মহাশয় কটা দিন মুখে কুলুপ এঁটে ছিলেন। লাভ কী হলো? সেই তো আবার নিজেই আগে কথা বলেছে। শুধু-শুধু মাঝের কয়েকটা দিন অসহ্যকর করে তুলেছিল।
“এতদিন পর মাফ চাওয়ার কথা মনে হলো কেন?”
“আমাকে না দূরে থাকতে বলা হয়েছিল?”
“বড়ো বাধ্য ছেলে, হুহ্। দূরে থাকল কই?”
“সেই তো, যত দোষ নন্দ ঘোষ। দূরে থাকার তাড়ায় একেবারে হলে ওঠার পরিকল্পনা, ভাবা যায়!”
“হুঁ, খুব তাড়া।”
উনি সূক্ষ্ম চোখে তাকালেন। হুট করে এসে একদম মুখোমুখি দাঁড়িয়ে একহাতে চুলের মুঠি চেপে ধরলেন। খুব বেশি শক্ত করে না ধরলেও চুলে টান পড়ায় আমি মুখ কুঁচকে ছাড়ানোর চেষ্টা করলাম। ওই জল’ন্ত চোখে একবারের বেশি চোখ রাখার সাহস করলাম না। উনি চোয়াল শক্ত করে আরেক হাতের দুই আঙুল আমার মাথায় ঠেকিয়ে নিচু স্বরে বললেন,
“খুলি এফোঁড়-ওফোঁড় করে দিবো ইলুরানি। গানটা কিন্তু লাইসেন্সধারী।”
চলবে, ইন শা আল্লাহ্।🖤
(