মনোহরিণী পর্ব -৩০ ও শেষ

#মনোহারিণী
লেখনীতে—ইলোরা জাহান ঊর্মি

৩০.
প্রতিটি মা এক দারুণ অভ্যাসে নিদারুণভাবে অভ্যস্ত। তা হচ্ছে নিজের মেয়ের মাথায় তেলের বোতল ঢেলে দেওয়া। আমার মা-ও তার ব্যতিক্রম নয়। শ্যাম্পু করতে দেখলেই চুলে তেল মাখানোর জন্য তার হাত বোধ হয় নিশপিশ করে। আপত্তি জানালে কখনো-সখনো চোখ পাকিয়ে বসিয়ে তেল দিয়ে দেয়। আজকেও তা-ই করছে। ইচ্ছে মতো তেল মাখাচ্ছে আর বকবক করেই চলেছে। তেল দিই না বলে চুল পড়ে গেছে, মাথা ব্যথা বেড়ে গেছে এসবই তার মূল বক্তব্য। আমি মাঝে-মাঝে উত্তর দিচ্ছি আর ফোন ঘাঁটাঘাঁটি করছি। হুট করে আননোন নাম্বার থেকে একটা ম্যাসেজ এল। ম্যাসেজ ওপেন করে আমি চোখ বুলাতে লাগলাম।

“তাজওয়ার এক নে’শার নাম। এতে এতটাই মাদ’কতা মিশে আছে যে, যেকেউ নে’শাগ্র’স্ত হতে বাধ্য। কিন্তু সেই নে’শাগ্র’স্তরা জানেও না এই নেশা কতটা বি’ষা’ক্ত। ওভার অল, পুরো পৃথিবীর প্রেমিকাদের কাছে তাজওয়ার বি’ষ হলেও, কেবলমাত্র তোমার কাছে সে শুদ্ধ। হ্যাঁ, তাজওয়ার কেবল ইলুরানির জন্য মিঠা নে’শা। সে কোনোরকম দ্বিধা ছাড়াই অকপটে এ নে’শায় আস’ক্ত হতে পারে।”

আমি ভ্রু কুঁচকে তাকিয়েই রইলাম। এ আবার কেমন ম্যাসেজ! এর মাথায় কোন শ্যাওড়া গাছের পে’ত্নী চেপেছে? অদ্ভুত! এখন কি আমার অনলাইনে যাওয়া উচিত? কৌতুহল নিয়ে টানা এক সপ্তাহ বন্ধ নেট অবশেষে অন করলাম। সঙ্গে-সঙ্গে নোটিফিকেশনের ভীড়ে পাগল হওয়ার জোগাড় হলো। হোয়াটসঅ্যাপের ম্যাসেজ চেক করলাম। পরপর দুই জনের কুড়ি খানিক ম্যাসেজ। ওপরের ইনবক্সে ঢুঁ মা’রলাম। সাত দিনে গুণে-গুণে ম্যাসেজ দিয়েছে মোটে একটা। তা-ও লেখা, “এই ম্যাসেজ যেদিন সিন হবে, মনে করো তার পরদিনই তোমার সর্বনা’শের শুরু। বি রেডি ইলুপাখি।”
আরও একবার আহাম্মক হলাম। এই লোকের মাথায় চলছেটা কী? দুটো ম্যাসেজেই নিজের সুপরিচিত ঘাড়ত্যাড়া ভাব ধরে রেখেছে। আচ্ছা? আজ ম্যাসেজ সিন করেছি মানে কাল আমার কোনো সর্বনা’শের ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে? এ আবার কোন জ্যোতিষ শাস্ত্র! একটা আস্ত সর্বনা’শ এতদিন ধরে মাথায় বয়ে বেড়াচ্ছি, আমার আবার সর্বনা’শের ভয়! ইঙ্গিতপূর্ণ কথাটা ঠিক বুঝে উঠতে পারলাম না। তবে মনের মধ্যে খোঁচাখুঁচি শুরু হলো। একে দিয়ে বিশ্বাস নেই। নি’র্ঘা’ত মাথায় কোনো ব’দ বুদ্ধি জুটিয়েছে। আজ ডিটেকটিভের ওপর ডিটেকটিভিটি করার ভীষণ প্রয়োজন বোধ করছি। কিন্তু ওই প্রতিভা তো কেবল কুলসুম আপারই আছে। তার থেকে প্রতিভা ধার নিলেও আমি ওটা পেরে উঠব না। মাথায় একগাদা কনফিউশন নিয়ে দ্বিতীয় ইনবক্স চেক করলাম। পরবর্তী উনিশটা ম্যাসেজ শ্রেয়ান ভাইয়ার। সবটাতেই আমার সাথে যোগাযোগ করার প্রচেষ্টা। শ্রেয়ান ভাইয়ার একটা অনুনয়ের ম্যাসেজে চোখ পড়তেই চট করে গত সাত দিন আগের ঘটনাগুলো কেমন মানসপটে মাথা‌ তুলল। তাজ ভাইয়ের ইনজুরির খবর জানার পরদিনই আমার ফোনে শ্রেয়ান ভাইয়ার কল এসেছিল। প্রথম কয়েকবারেও আমি রিসিভ করিনি। কেন জানি তার সাথে কথা বলার ইচ্ছে হারিয়ে গিয়েছিল। তারপর যখন উনি থামলেনই না, তখন অনেকটা বিরক্তি নিয়ে রিসিভ করেছিলাম। ভেবেছিলাম শ্রেয়ান ভাইয়া আবারও নিজের ভালোবাসা নিয়ে পড়বে। কিন্তু হলো তার বিপরীত। এমনই বিপরীত যে আমার মাথা উত্তর থেকে দক্ষিণে ঘুরে যাওয়ার জোগাড় হয়েছিল। শ্রেয়ান ভাইয়া কোনোরকম দ্বিধা ছাড়া খুব অপরাধবোধ নিয়ে জানিয়েছিলেন তাজ ভাইয়ের কাছে আমার প্রোপোজ অ্যাকসেপ্টের মিথ্যে কাহিনি উনি ইচ্ছে করেই বলেছিলেন। কিন্তু এতে ওনার কোনো খারাপ উদ্দেশ্য ছিল না। উনি এই কাজটা করেছিলেন তাজ ভাইয়ের মুখ থেকে মনের কথা বের করার জন্য। উনি না কি কয়েকদিন ধরেই তাজ ভাইকে সন্দেহ করছিলেন। সরাসরি জিজ্ঞেসও করেছিলেন। কিন্তু তাজ ভাই হেঁয়ালি করেছিলেন। শেষে নিজের সন্দেহ নিশ্চিত করতেই শ্রেয়ান ভাইয়া মিথ্যের আশ্রয় নিয়েছিলেন তাজ ভাইকে পরীক্ষা করার জন্য। আমার সঙ্গে তাজ ভাই ঝামেলা করেছিল তা উনি জানতেন না। এ পর্যন্ত সবই ঠিক ছিল। কিন্তু ইনভেস্টিগেশনে গিয়ে তাজ ভাইয়ের ইনজুরির পরেই শ্রেয়ান ভাইয়ার টনক নড়েছিল। কাজের মাঝে থেকেও তাজ ভাইয়ের অন্যমনস্ক ভাবটা উনি ধরতে পেরেছিলেন। তখন থেকেই না কি মনের মধ্যে অপরাধবোধ কাজ করছিল। মনে হচ্ছিল তাজ ভাইয়ের ইনজুরিটা তার কারণেই হয়েছে। তখন উনি নিজেই আবার তাজ ভাইয়ের কাছে সত্যিটা স্বীকার করে সরি-ও বলে দিয়েছেন। তাজ ভাইয়ের আর রাগ করার পথ ছিল না। তারপর ওনার মুখেই শ্রেয়ান ভাইয়া শুনেছিলেন উনি আমার সাথে খারাপ ব্যবহার করেছেন। এই পুরো ব্যাপারটা শ্রেয়ান ভাইয়ার মুখে শুনে আমি তখন উপস্থিত জ্ঞানও হারিয়ে বসেছিলাম। ঠিক কী বলা উচিত হবে বা ভালো হবে, তা মাথায় ধরছিল না। কিন্তু সাং’ঘা’তিক রাগ উঠেছিল দুই বন্ধুর ওপর। এক বন্ধু না বুঝে ভুল করেছে, আরেকজন বন্ধুর ভুলকে বিশ্বাস করে আমাকেও কষ্ট দিয়েছে, নিজেও ছাড় পায়নি। রাগে-দুঃখে সঙ্গে-সঙ্গে অফলাইন হয়েছিলাম। তারপর সাত দিনের মধ্যে আর ওই রঙিন জগতে উঁকি মা’রিনি। কন্টাক্ট নাম্বারও ব্লক করে দিয়েছিলাম। আননোন নাম্বারে কল এলেও রিসিভ করিনি। তবু শ্রেয়ান ভাইয়া কন্টাক্ট নাম্বারে ম্যাসেজ করত। উত্তর না পেলেও করত। কিন্তু অন্য ত্যাড়া মানবটা তা-ও করেনি। এমনকি ইনজুরির পর সে যে শরীয়তপুরে চলে এসেছে, এই খবরটাও আমি আম্মি মারফত জানতে পেরেছিলাম। কী মনে করে সাত দিন পর আজ এক অদ্ভুত ম্যাসেজ পাঠাল, সে-ই জানে। মাথায় জট নিয়ে আমি আর উত্তরও দিলাম না। চুপচাপ আবার অফলাইন হলাম। কী এমন বিখ্যাত সর্বনাশ হবে, তা যখনকারটা তখন দেখা যাবে। তাই যতটা সম্ভব চিন্তামুক্ত থাকার চেষ্টা করলাম। রাতেই নূর আঙ্কেলের ফোনে আব্বুর কাছে খবর এল তারা কাল গোসাইরহাট আসছেন। এ কদিন আব্বু-আম্মু বারবার করে আসতে বললেও, তারা তাদের প্রাণপ্রিয় ছেলের অনুপস্থিতির কারণে আসেননি। এখন ছেলে এসেছে বলেই আসতে রাজি হয়েছেন।‌ খবর শুনে খুশিও লাগল, চিন্তাও বাড়ল। এদিকে আব্বু-আম্মুর যেন ইদ লেগেছে। খুশিতে আব্বু ব্যাগ ভর্তি বাজার করে এনেছে, আর আম্মু কী রেখে কী রান্না করবে তা ঠিক করতে গিয়ে আমাকেও পা’গল করে ফেলছে। সকাল থেকে রান্নাঘরে পড়ে আছে। আমিও যতটুকু পারলাম সাহায্য করলাম। সদর থেকে তাদের আসতে-আসতে দুপুর হয়ে গেছে। জেনিফার ভাবি, আম্মি, আর নূর আঙ্কেলের সাথে দেখা করে বেশি সময় সামনে থাকিনি। তাজ ভাইয়ের সাথে ভুলে একবার চোখাচোখি হয়েছিল। নীরব চোখের ভাষা আমি পড়তে পারিনি। তবে খেয়াল করেছি ব্যান্ডেজগুলো এখনও আছে। দুপুরে একসঙ্গে খাওয়ার জন্য সবাই ডাকাডাকি করলে গোসলের বাহানায় সরে রইলাম। আমার জন্য আম্মুরও তখন খাওয়া হয়নি। আমি একা খাব ভেবে পরে আমার সঙ্গে খেয়েছে। খাওয়া-দাওয়ার পর হঠাৎ করেই আম্মু আমাকে রুমে ডেকে নিল। গিয়ে দেখলাম আম্মিও বসে আছে। আমাকে দেখে আদর করে কাছে বসাল। মাথায় হাত বুলিয়ে আচমকা প্রশ্ন করে বসল,
“শাশুড়ি মা হিসেবে তোমার চোখে আমি কেমন বলো তো ইলো?”
আমি কেমন‌ চমকে উঠলাম। ইতস্তত করে জবাব? দিলাম,
“বুঝলাম না আম্মি।”
“তুমি তো বলো জেনিফার কপাল করে আমার মতো শাশুড়ি পেয়েছে। জেনিফারের শাশুড়িকে কি তোমার নিজের শাশুড়ি হিসেবে পছন্দ হয়?”
এবারে আমি পুরোদস্তুর হতভম্ব হয়ে গেলাম। চোখ বড়ো করে একবার আম্মির দিকে, আরেকবার আম্মুর দিকে তাকালাম। বুকের ভেতরটা ভীষণভাবে কাঁপছে। শুকনো গলায় কোনোরকমে বললাম,
“কী বলছ আম্মি?”
আম্মি মিষ্টি করে হাসল। বলল,
“এত অবাক হচ্ছ কেন আম্মু? আমার ত্যাড়া ছেলেটাকে আর কতকাল লাগাম ছাড়া রাখব বলো? ভাবলাম এবার একটা লাগাম ভীষণ দরকার। এমনিতে কিন্তু আমার ছেলে লাখে একটা। ওই যে বলে না, তাজ দ্য গ্রেট ডিটেকটিভ? আমার গ্রেট ছেলের জন্য আমি আমার মিষ্টি মেয়েটাকে পছন্দ করেছি সেই কবে। তাই জানতে ইচ্ছে করছে আমার মেয়ে আমাকে শাশুড়ি হিসেবে পছন্দ করবে কি না।”
আমি সঠিক কোনো রিয়্যাকশন দিতে পারলাম না। মাথার মধ্যে কেমন ঘুরপাক খাচ্ছে। এমন একজন মা কি কখনও শাশুড়ি মা হিসেবে অপছন্দ হতে পারে? কখনোই না। কিন্তু এ জবাব কে দিবে। হুট করেই আমার ভেতর কোত্থেকে এত লজ্জা এসে ভর করল কে জানে? আমি এলোমেলো হয়ে বসে রইলাম। আম্মু আম্মিকে বলল,
“ভাবি, আমি বরং ওর সাথে একটু কথা বলি।”
আম্মি সঙ্গে-সঙ্গেই উঠে পড়ে বলল,
“হ্যাঁ, তা-ই করুন। আমি পরে আসছি।”
“আরে আপনাকে যেতে হবে না, বসুন।”
“না, না। সমস্যা নেই। আপনি মেয়ের সাথে মন খুলে কথা বলুন। আমি পরেই আসছি।”
আম্মি দরজা ভেজিয়ে দিয়ে চলে গেল। মুহূর্তেই আমি আম্মুর হাত চেপে ধরলাম। ব্যস্ত হয়ে শুধালাম,
“আম্মু, এসব কী? হঠাৎ করে আম্মি-”
আম্মু আমাকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে বলল,
“সব কথাই তো হঠাৎ করে হচ্ছে।”
“মানে?”
“এসে হতেই ওনারা তাজের জন্য তোকে বউ হিসেবে চায় বলে চলেছে। হঠাৎ করে ওনারা এমন কথা তুলবেন, তা আমরাও বুঝিনি।”
আমি রুদ্ধশ্বাসে পুনরায় শুধালাম,
“তারপর?”
“তোর আব্বু খুব খুশি হয়েছে। সেজন্যই তোর মতামত জানতে আমাকে পাঠিয়েছে। এখন সবটা তোর ওপর নির্ভর করছে। সবাই-ই অনেক আশা নিয়ে আছে।”
ফট করে বলে বসলাম,
“আর তাজ ভাই? তার মতামত কি জানা হয়েছে?”
“তাজের কথাতেই তো এসব তুলেছে।”
“কিহ্!”
দারুণ অবিশ্বাস ভর্তি চোখ জোড়া রসগোল্লার আকার ধারণ করল। আম্মু মাথা দুলিয়ে বলল,
“হুম, তাজ না কি গতকাল রাতেই ভাই-ভাবিকে জানিয়েছে তোকে বিয়ে করতে চায়।”
অ্যাঁ! তাজ ভাই! ইনজুরিতে এর মাথার তারও ছিঁড়েছে না কি? বলা নেই কওয়া নেই, হঠাৎ করে বিয়ের ভূ’ত চাপল কীভাবে? এবার আমি কী করব? কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে আমি অসহায় মুখে আম্মুর দিকে চেয়ে রইলাম। আম্মু ভরসার হাত বাড়িয়ে দিয়ে খুব আদুরে গলায় বলল,
“চিন্তা করছিস কেন? তোর মন যা চাইছে তা-ই বল। তাজকে তো তুই অপছন্দ করিস না। আর ভাই-ভাবির মতো শ্বশুর-শাশুড়ি, রাজ-জেনিফারের মতো ভাসুর-জা কি তুই চাস না? এমনিতেই তো ওটা তোর আরেক পরিবার। তোকে সবাই কত ভালোবাসে! ওরা এটাও ভেবে বসে আছে তুই অবশ্যই রাজি হবি।”
আমি নিজের মস্তিষ্কের চাপ বাদ দিয়ে জানতে চাইলাম,
“তুমি কি চাইছ আম্মু?”
“এই ছেলেটা মানুষের মন জয় করে নেয় কি এমনি-এমনি? ওর ভেতরে প্রচুর ভালোবাসা আছে। বুঝলি? তাজের মতো মেয়ের জামাই পাওয়া মানে আমার কাছে নিজের একটা ছেলে পাওয়ার মতোই।”
আমার মনটা কেমন আবেগী হয়ে উঠল। তিন মেয়ের মা আমার আম্মু। সবসময়ই তার মুখে শুনেছি মেয়ে জামাই হবে তার ছেলের মতো। তাদের মায়ের মতো ভালোবাসা দিয়ে সে ছেলের অভাব ঘুচাবে। কোনোকিছু না ভেবেই বলে দিলাম,
“আমার পরনের একটা জামাও আমি তোমার পছন্দ অনুযায়ী কিনি। জীবনের সবচেয়ে বড়ো সিদ্ধান্তে আমি তোমার পছন্দের বিপরীতে কেন যাব আম্মু?”
আম্মু কী বুঝল কে জানে? তার চোখ জোড়া ছলছল করে উঠল। আমাকে বুকে জড়িয়ে আদর করে দিয়ে বলল,
“আমার ছোট্ট অমি এত বড়ো হয়ে গেল কখন?”
আম্মুর বুকে মাথা রেখে ভেতরের কান্না আমি শুনতে পেলাম। এটা কি আনন্দের কান্না, না কি মেয়েকে অন্য এক পরিবারের পার্মানেন্ট মেম্বার করে দেওয়ার কান্না? এই মানুষটার কষ্টে আমি কোনোদিনই শান্ত থাকতে পারি না। কখন যেন ডান চোখের কোণ বেয়ে খুব নিঃশব্দে এক ফোঁটা গরম জল গড়িয়ে পড়ল। আদুরে বিড়ালের মতো আমি আম্মুকে জড়িয়ে ধরে চুপটি করে বসে রইলাম। আজ আর এই মানুষটাকে ছাড়তে ইচ্ছে করল না। ছাড়লেই যেন দূরত্ব বেড়ে যাবে। পৃথিবীর নিয়মগুলো এমন কেন? খুব কি অসুবিধা হত যদি আজীবন আমি এই এই মানুষটাকে আঁকড়ে থাকতে পারতাম? কিন্তু আম্মু আমায় তখনই তাড়া দিলো। বলল তার সাথে সবার সামনে যেতে। সবাই যে অপেক্ষা করে আছে। আমি হকচকিয়ে গেলাম। আম্মির সামনেই তো আমার লজ্জা লাগছিল, সবার সামনে গেলে কী হবে? বিশেষ করে ওই লোকটা। মাথা কে’টে নিবে আমার। আমি ঠোঁট উলটে বললাম,
“এখন না গেলে হয় না?”
“নূর ভাই বলেছে তোকে সাথে নিয়ে যেতে। ওঠ তো।”
“আমার লজ্জা লাগছে আম্মু।”
আম্মু ফিক করে হেসে ফেলল।
“মনে হচ্ছে তোকে এখনই বিয়ে দিয়ে দিচ্ছি? বোকা মেয়ে। চল, ওঠ।”
লজ্জা আর অনিচ্ছা নিয়েই আমাকে আম্মুর সাথে বেরুতে হলো। সবার সামনে এসে আমি আর মুখ তুলতে পারলাম না। ইশ্! না জানি সবাই কী ভাবছে। নির্ল’জ্জ লোকটা নিজের বিয়ের কথা কীভাবে বলল? ভাবছিলাম আম্মু যদি এখন সবার সামনে বলে বসে মেয়ে রাজি আছে, তাহলে কী অবস্থা হবে। কিন্তু তেমনটা হলো না। আম্মু মুখে কিছুই বলল না। চোখের ইশারাতেই বোধ হয় বুঝিয়ে দিলো। নূর আঙ্কেল আমাকে বেশ কয়েকবার জিজ্ঞেস করলেন,
“আম্মু, তুমি কি মন থেকে খুশি?”
আমি লজ্জায় উত্তর দিতে পারিনি। উনি যেন নাছোড়বান্দা। আমার মুখের কথা শুনবেনই। শেষে আম্মু আমার হয়ে বলল,
“ও লজ্জা পাচ্ছে ভাই। থাক, আমি কথা বলেছি ভালোভাবে। চিন্তা করবেন না।”
জেনিফার ভাবি আমাকে টেনে নিয়ে বসিয়ে দিলেন তার দেবরের পাশে। তারপর শুরু হলো বড়োদের বড়ো আলোচনা। আমি গোবেচারার মতো একপাশে চেপে বসে চুপটি মে’রে সবার কথা গিললাম। কথাবার্তা শেষে আবার উঠল আরেক বিষয়। আম্মি জানাল সে সাথে করে আংটি নিয়ে এসেছে। এখন সে চাইছে আংটি পরিয়ে রাখতে।‌ মূলত নূর আঙ্কেল সৌদি ফিরে যাওয়ার আগে ছেলের বিয়েটা দেখে যেতে চাইছে। আমি হতচকিত হয়ে আড়চোখে আম্মির মুখের দিকে তাকালাম। সব ব্যাপারে এত ফাস্ট কেন এই আম্মি? আমার আব্বু-আম্মুও আপত্তি জানাল না। তাদের সমর্থন আছে। এতক্ষণ ধরে বসে থেকেও আমার মনে হচ্ছে আমার পাশে আদতে কোনো মানুষের অস্তিত্ব নেই। একেবারে ভদ্র বাচ্চাটি সেজে বসে আছেন জনাব। অথচ সবার সম্মতি পাওয়ার পর আম্মির হাত থেকে আংটি নিয়ে আমার আঙুলে পুরে দেওয়ার সময় তার কত তাড়া ছিল, সে কি আমার চোখে পড়েনি? তারপর যখন আমি আংটিটা পর্যবেক্ষণ করলাম, সাধেই কি চমকে উঠলাম? এই আংটি আমার কাছে মোটেও নতুন নয়। রাজ ভাইয়ের বিয়ের সময় তাজ ভাই জেনিফার ভাবির জন্য গিফট কিনতে গিয়ে দুটো আংটি এনেছিলেন। বলেছিলেন আম্মির যেটা পছন্দ হবে সেটা রেখে অন্যটা ফেরত দিয়ে দিবেন। ভেবেছিলাম সত্যিই অন্যটা ফেরত দিয়ে দিয়েছিলেন। অথচ সেই ফেরত দেওয়া আংটি উঠল আমার আঙুলে। নির্ঘাত এটা এতদিন রেখে দিয়েছিল। হুট করেই আমি এক রহস্য উদঘাটন করলাম। কেন জানি মনে হলো এই আংটি পরানোর বুদ্ধিটা মোটেও আম্মির মাথা থেকে বেরোয়নি। তার তো ছেলের‌ চাওয়াই শেষ চাওয়া। আহা, ভদ্র বাচ্চাটা! কিচ্ছু জানে না, কিচ্ছু বুঝে না। পেছনে-পেছনে তার সাধের ডিটেকটিভিটির উপাদানে তৈরি মাথাটা ঠিকই খুব সন্তর্পণে সবখানে গলিয়ে দেয়। যেন বাকিরা সবাই ফিডার খাওয়া আন্ডা বাচ্চা। আংটি পরানোর পর যখন সবাই খুশিতে মিষ্টি মুখ করতে গিয়ে হৈচৈ পড়ে গেল, তখন উনি হুট করে এক মুহুর্তে আমার হাতের মুঠোয় কিছু একটা পুরে দিলেন। ওই চোখে চোখ না রেখে, মুঠো না খুলেও আমার বুঝতে অসুবিধা হলো না জিনিসটা কী। এ যে বহু পরিচিত অনুভূতি। কোনোমতে বড়োদের বলে আমি ওখান থেকে সরে এলাম। দরজা ভেজিয়ে রেখে জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম। মুঠো খুলে চিরকুটটা বের করলাম।

মনোহারিণী,
আমার মিষ্টি অভিমানীনি, নীরব অধিকারীনি। অধিকারটুকু স্থায়ী করার এবার সময় হয়েছে। দোষী তাজের একমাত্র মালকিন কি এবারেও দোষ ধরবে? ধরলেও বারণ নেই। তার ওই গভীর চোখে না হয় দোষী হয়েই ঠাঁই নিলাম। গোটা জীবন সে আমায় দোষী ভাবুক। সবকিছুর বিনিময়ে তাকে আমি একান্ত ব্যক্তিগত করে নিব। ছোট্ট হরিণীটা আমার বক্ষ জুড়ে থাকবে, গোটা ঘরে ভাগ বসাবে। যাবতীয় আমিতে তার মিষ্টি ছোঁয়া থাকবে। য’ন্ত্রণাগুলো হাওয়ায় উড়িয়ে দিবে। পিচ্চিটার অভিমান দিন-দিন আকাশ ছুঁয়ে যাচ্ছে। ভাবলাম এবার থেকে অভিমানগুলো আড়ালে নয়, মুখোমুখি থাকুক। ইলুরানির মাথায় তাজ পরানো হোক। অনিচ্ছাকৃত দূরত্বগুলো অক্কা পাক। অপেক্ষাগুলো একপাক্ষীক নয়, সে কি আমার অজানা? দীর্ঘ অপেক্ষার অবসানের শুভেচ্ছা ইলুপাখি।
ইতি
তোমার ব্যক্তিগত তাজ

পড়তে-পড়তে আমি জানালার পাশে থেকে সরে এসে বিছানায় উঠে বসেছি। বুকের কোথাও একটা সূক্ষ্ম ব্যথারা টনটন করছে। কিছু ভালো লাগা, কিছু অভিমান, কিছু ব্যথা, কিছু আশা। অনুভূতিগুলো অদ্ভুত এক সংমিশ্রণ। কী ভীষণ অসহ্যকর সে অনুভূতি! কতটা সময় যে আমি জাগতিক ধ্যান-ধারণা ভুলে বসে রইলাম। বিকেলের দিকে আব্বু আর নূর আঙ্কেল বেরুল। আম্মি আর জেনিফার ভাবি আম্মুর সাথে গল্প করছে। সেই ফাঁকে আমি ঘর থেকে বেরিয়ে পেছনের উঠানে নামলাম। আকাশে তখন মেঘের তোলপাড়। মনে হচ্ছে বৃষ্টির আয়োজন চলছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই মেঘেরা গর্জন তুলল। অদূরেই বাড়ির ছোটোরা ছুটাছুটি করছিল। আচমকা মেঘের তোলপাড় শুরু হতেই তাসবি ছুটে এসে ছোটো দুই হাতে আমার পা জড়িয়ে ধরে মুখ গুঁজে ভীতু স্বরে চেঁচিয়ে উঠল,
“ইমি, ইমি। বাঁচাও, বাঁচাও। গুড়ুম আসে, গুড়ুম।”
আমি হেসে ফেললাম। নিচু হয়ে ওকে কোলে তুলে নিলাম। ও ছোট্ট ভীতু মুখটা কাঁধে গুঁজে দুহাতে আমার গলা জড়িয়ে ধরে আবারও চেঁচিয়ে উঠল। ঝিরিঝিরি বৃষ্টি শুরু হতেই বাচ্চাদের আনন্দ বাড়ল। সবাই মিলে উল্লাস করে উঠল। আমি তাড়া দিতেই সবাই যার-যার ঘরে ছুট লাগাল। তাসবিকে ওদের ঘরে রেখে আমি এক ছুটে এসে নিজেদের ঘরে উঠলাম। দরজায় দাঁড়িয়ে বৃষ্টিতে হালকা ভেজা চুলগুলো ঝাড়তে লাগলাম। দরজা বন্ধ করতে নিতেই আচমকা এক শক্ত হাতের মুঠোর দখলে চলে গেল আমার বাঁ হাতটা। চকিতে ফিরে তাকাতেই মিষ্টি হাসিভরা মুখটা চোখে পড়ল। নিমেষেই আমি কেমন এলোমেলো হয়ে গেলাম। উনি আমার হাতটা মুঠোয় নিয়ে চুপচাপ পাশে দাঁড়িয়ে রইলেন। দৃষ্টি বাইরের বৃষ্টির পানে। মিনিট খানেক পার হতেই আমার ভেতরের অভিমানগুলো নতুন করে জেগে উঠল। সবকিছু তার ইচ্ছেতেই কেন হবে? আমি কি কোনোকিছুই জানার অধিকার রাখি না? হুটহাট সিদ্ধান্তগুলো কেন তার একার থাকবে? মুঠো থেকে হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করলাম। উনি ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বললেন,
“ওরে বাবা! মহারানি ইলুবতী এত রাগ কোত্থেকে আমদানি করে? কিন্তু মহারানি, ট্রেনিংপ্রাপ্ত ডিটেকটিভের হাত থেকে ছাড়‌ পাওয়ার চেষ্টাটা এনার্জি লস ছাড়া কিছু নয়। বিশেষ করে এমন পিচ্চি-পাচ্চার ক্ষেত্রে।”
আমি গম্ভীর মুখে হাত মুচড়ে চললাম। এবার উনি আরেক হাতও মুঠোয় চেপে ধরলেন। দুই হাত বন্দী করে এক পা এগিয়ে দাঁড়িয়ে স্বাভাবিক গলায় বললেন,
“কী হয়েছে?”
আমি ওনার চোখে চোখ রাখতে পারলাম না। চুপসানো মুখটা নিচু করে রইলাম। উনি স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে নরম গলায় বললেন,
“অভিমানগুলো উগড়ে দাও তো। আজ তোমার বাঁধা নেই। বলো।”
আমার নীরবতায় উনি পুনরায় আদুরে স্বরে ডাকলেন,
“ইলুপাখি?”
আমি চোখ না তুলে ভার গলায় মিনমিনিয়ে বললাম,
“ঠিকই তো প্রমাণ হলো শ্রেয়ান ভাইয়া ইচ্ছে করে মিথ্যে বলেছিল।”
উনি ছোটো একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন,
“ওসব কথা আর না টানি?”
“আমায় অবিশ্বাস করেছেন।”
“ভুল ছিল।”
“বারবার এই অবিশ্বাস যে ভবিষ্যতেও প্রভাব ফেলবে না, তার কি নিশ্চয়তা আছে?”
“আমি কোনো মহামানব নই, সাধারণ একজন। জীবনের কোনো না কোনো মুহূর্তে ভুল প্রত্যেকটা মানুষেরই হয়। আমি তার ঊর্ধ্বে নই। আমি মানুষটা একদম সাধুও না। তাই বলে যে অনিচ্ছাকৃত ভুলটাই বারবার করব, এতটা খারাপও বোধ হয় আমি না। তাই না ইলু?”
আমি প্রত্যুত্তর করলাম না। অন্যান্য সময় বুক ফুলিয়ে যে মানুষটা বলে বেড়ায়, তাজ দ্য গ্রেট, সবাই তাজ হতে পারে না; সে-ই কত নির্দিধায় নিজের ভুল স্বীকার করছে। এই বিচিত্র মানুষটাকে সত্যিই আমি বুঝার ক্ষমতা রাখি না। চোখ তুলে ওই কোমল দৃষ্টিতে দৃষ্টি মেলালাম। কতশত কথা ওই গভীর চোখে। কিছু ব্যথাও কি আছে? হালকা কারুকার্য খচিত শুভ্র পাঞ্জাবি পরিহিত মানুষটা এই মুহূর্তে এক মুগ্ধতা মেশানো প্রেমিক পুরুষ। সবসময় ইচ্ছে করে ধমকে, তাচ্ছিল্য করে, খেপিয়ে কথা বলা মানুষটাই আজ কোমল কন্ঠের প্রেমিক। এত অদ্ভুত কেন এই মানুষটা? এই অদ্ভুত সত্তাটাই কি আমার দূর্বলতা নয়? হয়তো এই অদ্ভুত সত্তাটাই দ্য গ্রেট তাজ সাহেবের আসল সৌন্দর্য। আমি আর ওই প্রসঙ্গ টানতে চাইলাম না। ওনার ব্যান্ডেজগুলো যতবার চোখে পড়ছে, ততবারই ভেতরটা ডুকরে উঠতে চাইছে। তবু কপট রাগত ভাব নিয়ে বললাম,
“এত বড়ো সিদ্ধান্ত আমাকে কেন জানানো হলো না?”
উনি ঠোঁট প্রসারিত করলেন। নিজস্ব ভাবটায় ফিরে গিয়ে উত্তর দিলেন,
“সর্বনাশ কি কাউকে বলে কয়ে আসে রে বল’দ?”
আমার চোখ সরু হয়ে এল। গতকালের ম্যাসেজটার অর্থ তাহলে এই ছিল? হায় খোদা! এই লোকটার হাঁড়ে-হাঁড়ে এত ব’দ বুদ্ধি আসে কোত্থেকে? মুখ কুঁচকে বললাম,
“সর্বনাশই বটে! ভাবছেন এবার নিশ্চিন্তে নিজের ব’দ বুদ্ধিগুলো ফলাতে পারবেন। উঠতে-বসতে একশোর বদলে হাজারটা ধমক দিতে পারবেন।”
উনি মিষ্টি হেসে বললেন,
“কাম টু দ্য মেইন পয়েন্ট গা’ধী। আমার ঘর গোছানো, জামা-কাপড় ধোয়া, এটা-ওটা এগিয়ে দেওয়ার মানুষ পাব। তবে নো চিন্তা, তোর অলস স্বভাবটা আমি দুদিনে উড়িয়ে দিবো। ভাবতে পারছিস, আমি কত উপকারী লাইফ পার্টনার? তা-ও তোর মতো মাথামোটার কপালে জুটেছি। কী লাকি রে তুই! তোর তো উচিত শুকরিয়া জানিয়ে মসজিদে খিচুড়ি দেওয়া।”
“হ্যাঁ, এই লাকের ঠেলায় শেষে বনবাসে না যেতে হয়।”
“যেতে পারিস। তবে যাওয়ার আগে ভালোভাবে খবর নিয়ে নিবি যে ওই বনে গা’ধার বাস আছে কি না। নিজস্ব প্রজাতির সাথে বাস করতে কোনো অসুবিধা হবে না।”
আমার সত্যি-সত্যিই রাগ উঠল। হাত ঝাঁকুনি দিয়ে বললাম,
“গাধা প্রজাতির কাছে আপনাকে আসতে বলে কে? আপনার জন্য ওই আফরা আপুর প্রজাতিই বেস্ট। সরুন, হাত ছাড়ুন।”
উনি মৃদু শব্দ তুলে হাসছেন।
“নাহ্, আমার আবার এই একটা গা’ধীকে লাগবে। থেকে যাক সে। বনবাসে যেতে হবে না, তাজবাসে যাবে তা-ই ভালো।”
কথাটা বলার সঙ্গে-সঙ্গেই উনি নিজের ডান হাতের আঙ্গুল ঠোঁটে ছুঁয়ে, তারপর আঙুলগুলো আমার কপালে ছুঁয়ে দিলো। রাগে ভাটা ফেলে আমি থমকাল। উনি নিজের ঠোঁট আর আমার কপালে ইশারা করে হাসিমুখে ফিসফিসিয়ে বললেন,
“বাঁধাটুকু কে’টে গেলে এই দুটোর মাঝে আঙুলগুলো থাকবে না। ততদিন পর্যন্ত তো বাঁধা পেরোনো যাবে না।”
লজ্জায় আমি মুখ লুকানোর জায়গা পেলাম না। এদিক-ওদিক দৃষ্টি বিচরণ করলাম। অথচ নির্ল’জ্জ লোকটা আমার দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছেন। প্রসঙ্গ ঘুরানোর জন্য আমি ওনার কপালের ব্যান্ডেজটা আলতো করে ছুঁয়ে নরম সুরে শুধালাম,
“ব্যথা আছে?”
“কোন ব্যথা?”
ওনার উলটো প্রশ্নের ধরনটা আবারও আমার ভেতরটা নাড়িয়ে দিলো। নাহ্, এই মানুষটার সাথে পেরে ওঠা সহজসাধ্য না। তাই আবারও লাফ দিয়ে প্রসঙ্গ পালটানোর ধান্দায় নিজের হাতের দিকে তাকিয়ে বলে উঠলাম,
“এই আংটিটা আমি চিনি। এটা তখন ফেরত দেননি কেন?”
“রেখে দিয়েছিলাম এক ডা’কাতরানির জন্য। বারবার এক জিনিস কিনে পকেটের টাকা ভ্যানিশ করার মতো বোকা আমি নই। বুঝলি? এমনিতেই আস্ত এক ধান্দাবাজ মহিলা ঘাড়ে চাপিয়ে ভবিষ্যতে নিজের পকেটের দুরব’স্থা নিয়ে আমি ভীষণ চিন্তিত। তাই বেশি রিস্ক নিতে চাইনি। ডিটেকটিভ হয়ে এটুকু বুদ্ধি না রাখলে চলে?”
“বাহ্! বুদ্ধির গোডাউন একটা। এই মহান বুদ্ধির সুবাদে ভবিষ্যতে আপনার পকেটের দুরব’স্থা সত্যিকারের ডা’কাতই না করে দেয়।”
“তাজের জীবনে হা’না দেওয়ার সাধ্য কেবল একজন ডা’কাতেরই আছে ইলুপাখি। ওপস্! আমার বলদ মনোহারিণী।”
কথাটা বলেই উনি আমার হাত ছেড়ে মাথার পেছনে লাগালেন এক গাট্টা। আমি চেঁচিয়ে ওঠার আগেই মহাশয় গায়েব। হাতের তালুতে মাথা ঘষতে-ঘষতে আমি চেঁচাতে গিয়েও থেমে গেলাম। কেন জানি রাগ কাজ করছে না। ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসির রেখার দখল। এই অদ্ভুত সুন্দর তাজটা আমার মাথায় আজীবনের জন্য জায়গা করে নিয়েছে। এটা কি আমার চাওয়া ছিল না? ভালো তো আমায় শ্রেয়ান নামক মানুষটাও বেসেছে। কই? তার প্রতি তো আমার বিন্দুমাত্র চাওয়া ছিল না। ইলুপাখি ডাকটার অনুভূতি তো ইলোমিলোতে ছিল না। হুট করে আমার মনে পড়ল কদিন আগে তাজ ভাইয়ের বলা একটা কথা। সেদিন আমাকে পচানি দিতে গিয়ে খুব গর্বের সাথে বলেছিলেন, ‘পৃথিবী জুড়ে বহু তাজ পাবি, কিন্তু ইউনিক তাজ এই একটাই। তার কোনো বিকল্প হয় না।’ সেদিনও অবশ্য আমি বিরক্তি নিয়ে বরাবরের মতোই তাকে ‘তাজ দ্য গ্রেট ব’দের হাড্ডি’ উপাধি ছুঁড়ে দিয়েছিলাম। কিন্তু আজ এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে দ্য গ্রেট ডিটেকটিভ সাহেবের মতো আমারও বলতে ইচ্ছে করছে, ‘তাই তো। তাজের কোনো বিকল্প হয় না। হতে পারে না। তাজ একটাই।’

~সমাপ্ত~

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here