#মাতোয়ারা
#পর্ব_০৬
আমার কোলে কাঁদতে কাঁদতেই ইরিন বেহুঁশ হয়ে গেলো।
পৃথিবীতে দুটো দৃশ্য নাকি চাইলেও না তাকিয়ে থাকা যায় না, এক হলো সদ্য জন্মানো নিজের সন্তানের মুখ, আর কাঁদতে কাঁদতে বেহুঁশ হয়ে যাওয়া কোনো কুমারী মেয়ের মুখ। আমি সেই মুখের দিকে তাঁকিয়ে ছিলাম নিস্পলক।
হাসপাতালে নিয়ে গেলাম।
ডক্টর চেক-আপ করে বললেন,
—বাঁ-পায়ের পাতার তিনটে হাড্ডি ভেঙ্গে গেছে। সিরিয়াস ইনজুরি। এডমিশন করিয়ে নিন। প্লাস্টার নিয়ে হাসপাতালে তিন দিন, এরপর একুশ দিন। কমপ্লিট বেডরেস্ট।
ইরিন জিজ্ঞেস করলো,
—কি হয়েছে? বেশি কিছু? আমি বাঁচবো তো?
আমি বিরস মুখে বললাম
—নাও বাঁচতে পারো। পায়ের আঘাত থেকে ব্রেন হেমারেজ। ব্রেনের কয়েকটা তার ছিঁড়ে গেছে।
—ব্রেনের তার? ও মাই গড। অপারেশনের কোনো ব্যবস্থা নেই?
—মাথা খারাপ, তার আবার অপারেশন। তোমার গার্ডিয়ান কেউ আছে? থাকলে খবর দাও, পেপারে সাইন করতে হবে।
—কিসের পেপার?
—ব্রেনের অপারেশন তো, বলা যায়না ভালো মন্দ কিছু হয়ে গেলে..
বেডে শুয়ে প্লাস্টার করা পা নিয়ে ইরিন আমার দিকে তাঁকিয়ে বিশ্বাস অবিশ্বাসের দোটানায় দুলতে থাকলো।
আমি আরো মন খারাপ করে বললাম,
—শেষ কোনো ইচ্ছে টিচ্ছে আছে? বলে ফেলো। এসব অপারেশনে নাইন্টি পার্সেন্ট রোগীর সেন্স ফিরে না।
—আপনি কি অামাকে ভয় দেখাচ্ছেন ভাইয়া?
—ভয় কেন দেখাবো? আশ্চর্য! শুধু পা-ভাঙার জন্য ডাক্তার তো তোমায় এডমিশন করাতো না। সিরিয়াস ইনজুরি বলেই তো… তোমার বিশ্বাস না হলে, তুমি নিজে ডক্টরের সাথে কথা বলো। তুমি কি ভেবেছো? আমি তোমার মত মিথ্যেবাদী?
ইরিন কুঁই কুঁই করা গলায় কোনোরকমে বললো,
—বাবাকে একটা ফোন করবো।
—তোমার ফোন করার দরকার নেই, আমাকে বলো, আমি করে দিই.. ব্রেনের ব্যাপার তো, ডাক্তার ফোন করতে নিষেধ করেছেন।
আমি ইরিনের ফোন থেকে নাম্বার ডায়াল করতে করতে বললাম,
—বাবাকে কি বলতে হবে?
ইরিন দ্বিধান্বিত চেহারা করে অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নিলো।
—অপারেশনে তো বেশ টাকা পয়সা লাগবে তাই না ভাইয়া?
—অফকোর্স লাগবে। ডাক্তার তো আর বাবা না।
—তাহলে বাবাকে বলুন, রান্নাঘরের মিটসেফের নিচের তাকে কোণায় একটা নীল প্লাস্টিকের বয়ামে ১৬ হাজার টাকা আছে। আর সানসেটে বড় পাতিল যেটা উপুড় করা, তার নিচে গোলাপি টিফিনবক্সে সাত হাজার টাকা আছে, আর আমার কাপড় যে ট্রাংকে রাখি তাতে বারো হাজার ছয়শ টাকা আছে। সব টাকা নিয়ে আসতে বলুন। দুটো টিউশনির বেতন দিবে আগামী রোববারে। এখন আমার এইরকম অবস্থা শুনলে আগে ভাগে দিয়ে দেবে। বাবাকে টাকাগুলো…
—কেন তোমার বিছানার চিপায় টাকা নেই? ইরিন বোধহয় আমার খোঁচাটা ধরতে পারলো না।
উল্টো দিকে মুখ রেখেই বললো,
—ওগুলো বাবার টাকা। আর এগুলো আমার টাকা, টিউশনির।
—বাহ্। তুমি তো দেখছি অনেক টাকার মালিক।
এত টাকা কেন জমিয়েছো বলোতো? এরকম গাছ থেকে লাফিয়ে পড়ে ব্রেনের অপারেশন করাবে বলে?
ইরিন আমার কথার জবাব দিলো না।
আমি ইরিনের বাবাকে ফোন করে ব্যাপারটা জানালাম। হাসপাতালে আসতে মানা করলাম। বললাম, আমি আছি; আমি দেখছি সব!
তারপরও তিনি চলে এলেন, রোগা পাতলা চেহারার বয়স্ক লোক। বিশ হাজার টাকা আমার হাতে গুঁজে দিয়ে বললেন,
—খরচ পাতি যা লাগে করো বাবা। আমি সব টাকা দিয়ে দিবো। আসলে আমার স্যার, মোখলেস সাহেব খুলনা গেছেন অডিট করতে। তিনি ঢাকায় থাকলে টাকার চিন্তা করতে হতো না।
চলে যাবার সময় তিনি আমার হাত ধরে কাঁদলেন।
—অফিস ছুটি হলেই আমি আসবো বাবা, তুমি কি কিছু খেয়েছো? এখানে একটু খাবার আছে, খেয়ে নিয়ো বাবা।
এই এত কিছুর মাঝে একটা জিনিস আমি প্রবলভাবে টের পেলাম, ইরিনের শূণ্যতার জায়গাটা। ইরিনের তাহলে মা নেই।
ইরিনের বাবা মেয়েকে দেখে এসে বললেন,
—বাবা, ব্রেনের অপারেশনটা হবে কখন? আমি অফিস থেকে বলে ছুটি নিয়ে আসতাম।
আমি লজ্জিতভাবে উনাকে পুরো ঘটনাটা খুলে বললাম।
আর এদিকে পুরো ইউনিভার্সিটিতে ঘটনাটা চাওর হয়ে গেলো। কিন্তু একটু উল্টোভাবে। আমি নাকি ইরিনের পা ভেঙে দিয়ে নিজেই হাসপাতালে নিয়ে এসেছি। আমার বিরোধী দলের ছেলেগুলো বেশ সুন্দর একটা ইস্যু পেয়ে গেলো…… সুনামি শুরু হয়ে গেলো। সোশ্যাল মিডিয়ায় ইরিনকে কোলে নেয়া আমার একটা ছবি ভাইরাল হয়ে গেলো, নোংরা আর অশ্লীল ক্যাপশনে ভরে গেলো সবার মুখ। আমার বাহিনী বিশাল দল বেঁধে হাসপাতালে এলো। বিরোধীরাও এলো। বিচার চাই বলে, একদল দাঁড়িয়ে গেলো ইরিন পার্টি।
আর আমি ঘুমন্ত ইরিনের পায়ের প্লাস্টারের কাছে বসে আছি। বাইরের ঝড় আমার জন্য কিছু নয় কিন্তু ইরিনের ঘুমন্ত মুখ কোথাও যেনো আমার বুকের ভেতরে ঝড় বইয়ে দিচ্ছিলো। যে ঝড় আমাকে রিয়া নামক ঝড় থেকে সরিয়ে দিচ্ছিলো ক্ষণে ক্ষণে…..
(চলবে)
#তৃধা_আনিকা