#মায়ায়_জড়ানো_সেই_তুমি
#বোনাস_পার্ট
জাওয়াদ জামী
তানিশা ঘুমন্ত মেয়ের মুখপানে সেই কখন থেকে চেয়ে আছে তবুও ওর দেখার তৃষ্ণা মেটেনা।
ঘুমের মধ্যেই খিলখিল করে হেসে উঠে মেয়েটা। আবেগে তানিশার চোখে পানি আসে। এত আদর আদর কেন ওর ছোট্ট মেয়েটা! ওর মুখের পানে তাকালেই দুনিয়ার সব মায়া এসে ভর করে তানিশার মনে। এজন্যই বুঝি মা বলত, ” মা হলে বুঝবি, সন্তানের মায়ার কাছে দুনিয়ার সব মায়া হার মানে। ” আজ হাড়েহাড়ে কথাটার সত্যতা টের পাচ্ছে সে।
কিন্তু এখনো মেয়েটার নাম রাখা হয়নি। তানিশা ভেবে পায়না কোন নাম রাখবে।
জামিল চৌধুরী অনেক ভেবেছেন সাদিফের বিষয়ে। শেষে কোন কুল-কিনারা না পেয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, সাদিফকে তানিশার ফোন নম্বর দিবেন। আর তানিশার কাছ থেকে জানার চেষ্টা করবেন ও সিলেটের কোথায় থাকে। অবশ্য তানিশা না বললেও সমস্যা নেই কারন সাদিফ একবার নম্বরটা পেলে নিজেই খুঁজে নিবে।
তার বারবার মনে হচ্ছে, এভাবে কিছুতেই চলতে পারেনা। তার ছেলে অন্যায় করেছে এবং শাস্তি তার প্রাপ্য। কিন্তু তাই বলে এভাবে নয়। এতে তানিশারও কম কষ্ট হচ্ছেনা। আপনজন ছেড়ে একটা মেয়ে কিভাবে দিনের পর দিন কাটাবে! তাই তিনি ঠিক করেছেন সাইরার বিয়ের পরই তিনি সাদিফকে জানাবেন।
চৌধুরী বাড়ির বাগানে গায়ে হলুদের বিশাল আয়োজন করা হয়েছে। আত্মীয় স্বজনরা ভিড় করেছে বাগানে। সুখের বিষয় হলো জামিল চৌধুরীর ভাই-বোনেরা সবাই এসেছে। শায়লা চৌধুরী নিজ দ্বায়িত্বে তাদের এখানে এনেছেন। তিনি নিজে গিয়েছিলেন দেবর-ননদদের কাছে। সবার কাছে ক্ষমা চেয়েছেন নিজের কৃতকর্মের জন্য। কেউ যখন নিজের কৃতকর্মের জন্য লজ্জিত হয় তখন তাকে সুযোগ দেয়া অপরপক্ষের জন্য কর্তব্য হয়ে দাঁড়ায়। তাই জামিল চৌধুরীর ভাই-বোনেরা কেউই আর মুখ ফিরিয়ে থাকেননি। আনন্দের সাথে ভাইয়ের বাড়িতে এসেছে। কাঁধে কাধ মিলিয়ে শায়লা চৌধুরীকে সহযোগিতা করছে।
রাত দশটা বেজে দশ। জামিল চৌধুরী বাগানের কোলাহলে স্বাচ্ছন্দবোধ না করায় নিজের রুমে এসে বিছানায় শরীর এলিয়ে দেন। বিছানা পেয়েই শরীরটা পেয়ে বসে। অবসাদে চোখ বুজে আসে। ঠিক তখনই সব আরামকে হারাম করে ফোন বেজে ওঠে। বিরক্তিতে মুখ দিয়ে দুর্বোধ্য শব্দ বেরিয়ে আসে। চোখ বন্ধ অবস্থায়ই হাতড়ে ফোন খুঁজে রিসিভ করে কানে ঠেকায়।
” হেই জামিল কেমন আছিস দোস্ত? ”
এক ঝটকায় চোখ খুলে জামিল চৌধুরী। ফোন সামনে নিয়ে এসে দেখল তার ছোট বেলার বন্ধু আসাদ।
” আরে দোস্ত যে। আমি ভালো আছি। তুই কেমন আছিস? ”
” আমিও ভালো আছি দোস্ত। তা আজকে তোর মেয়ের হলুদ চলছে তো? খুব আফসোস হচ্ছে দোস্ত, না যেতে পারায়। ”
” ইট’স অল রাইট। এত টেনশন নিসনা। দেশে থাকলে তুই নিশ্চয়ই না এসে থাকতিসনা। এটা আমি ভালো করেই জানি। ”
” দেশে ফিরেই আমার প্রথম কাজ হবে সাইরা মামুনির শ্বশুর বাড়িতে বেড়াতে যাওয়া। ওর জন্য অনেক গিফ্ট নিয়ে আসব দেখিস। ”
” তোর গিফ্ট আনতে হবেনা। শুধু আমার মেয়েটার জন্য দোয়া করিস। আর খুব তারাতারি দেশে আয় এটাই কাম্য। ”
” দোয়া জীবনে দোয়া আর দাওয়া দুটোই সমান কার্যকরী। দোয়ার সাথে দাওয়াও লাগে। ”
” তোর সাথে কথায় সারাজীবন হেরে যাই।”
” জামিল একটা দরকারী কথা বলতে তোর কাছে ফোন দিয়েছি। ” সিরিয়াস গলায় বলেন আসাদ আলম।
একটু নড়েচড়ে বসেন জামিল চৌধুরী। উনার নিরবতাকে সম্মতি ধরে আসাদ আলম বলতে শুরু করেন, ” জামিল তুই আমাকে একটা দ্বায়িত্ব দিয়েছিলি সেটা আমি পালন করার যথেষ্ট চেষ্টা করেছি। কিন্তু অবশেষে বোধকরি ব্যর্থতার তকমা জুটবে! ”
” তুই কি বলছিস বলতো! ” জামিল চৌধুরীর গলায় ভয়ের ছাপ স্পষ্ট।
” জামিল, বিষয়টি সাইফকে নিয়ে। ” জামিল চৌধুরী তার বন্ধুর অস্বস্তি বুঝতে পারে।
” তুই নির্দিধায় বলতে পারিস আসাদ। ”
” জামিল, সাইফ এখানকার এক মেয়ের সাথে সম্পর্কে জড়িয়েছে। মেয়েটার নাম লিন্ডা এ্যান্ডারসন। এবং এটা লিভ-ইন রিলেশনশিপ পর্যায়ে গড়িয়েছে। কিন্তু এটার চেয়েও চিন্তার বিষয় হল মেয়েটার মা একটা ব্র*থে*ল চালায়। মেয়েটা পিতৃ পরিচয়হীন। একসময় ওর মা সেই ব্র*থে*লে*র সাধারণ প*তি*তা ছিল। আর এই মেয়ে এর আগেও বিভিন্ন ছেলের সাথে সম্পর্কে জড়িয়েছে। এবং পরে ব্ল্যাকমেইল করে তাদের নিঃশেষ করেছে। সোজা কথায় মেয়েটা একটা ফ্রড। আমি এটা নিয়ে সাইফের সাথে কথা পর্যন্ত বলেছি। কিন্তু বুঝতে পেরেছি সাইফ এই সম্পর্ক নিয়ে সিরিয়াস। এবং সাইফ আমি কথা বলাতে বেশ বিরক্ত হয়েছে। ইদানীং সে আমাকে এড়িয়ে চলছে। এইসব কথা তোকে না জানালে হচ্ছিলনা। আমাকে ক্ষমা করিস জামিল। ”
জামিল চৌধুরী ভাষা হারিয়ে ফেলেছেন। কি বলবেন তিনি! তার সাথেই কেন যত অঘটন, বিপদ যত খারাপ কিছু ঘটে! জীবন তার সাথে এত লুকোচুরি খেলে কেন বারবার! তিনি তাহলে সত্যিই একজন ব্যর্থ পিতা! তিনি সন্তানদের আদর্শ মানুষ হিসেবে গড়তে পারেননি। সারাজীবন অফিস,চাকরি, ক্যারিয়ারের পিছনে ছুটেছেন আর হয়েছেন টাকা কামানোর মেশিন।
জামিল চৌধুরীর নিস্তব্ধতায় ভয় পায় আসাদ আলম।
” জামিল তুই ঠিক আছিস? জামিল কথা বল। ”
” হু…হ্যাঁ বল। আমি ঠিক আছি তুই চিন্তা করিসনা। তোর কাছে একটা অনুরোধ আমার ছেলেটাকে একটু দেখিস। ” আর কিছুই বলতে পারেনা জামিল চৌধুরী। হুহু করে কেঁদে উঠেন।
বন্ধুর কান্নার আওয়াজে আসাদ আলমের বুক কেঁপে উঠে।
” তুই চিন্তা করিসনা জামিল। আমি আছি তো। ও আমার সাথে যতই অন্যায় করুকনা কেন আমি নিজের সন্তানের মতই ওকে আগলে রাখব। ” জামিল চৌধুরীকে যতটাসম্বভ শান্তনা দিয়ে ফোন কেটে দেয় আসাদ আলম।
জামিল চৌধুরী নিজেকে সামলাতে পারছেনা। এত ঝড় কেন তার উপর দিয়েই বয়ে যায়! কিভাবে ফিরাবেন তার ছেলেকে। সবকিছু আগেরমত হবে তো। নানান চিন্তা ঘুরপাক খেতে থাকে তার মস্তিষ্কে। অনেক ভেবে সাইফকে ফোন করার সিদ্ধান্ত নিলেন। তিনিই বুঝাবেন ছেলেকে।
বেশ কয়েকবার ফোন দেয়ার পরও রিসিভ হয়না। কিন্তু তিনি চেষ্টা চালিয়ে যান। আবারো ফোন দেন সাইফের নম্বরে। পাঁচ বারের প্রচেষ্টায় তিনি সফল হন। ঘুম জড়ানো গলার আওয়াজ পেলে তার মন শান্ত হয়।
” হ্যালো। ”
” সাইফ! কেমন আছো? ঘুমাচ্ছ না কি? “বাবার গলা শুনে সাইফের ঘুম উবে যায়।
” ড্যাড! কি ব্যাপার, এখন ফোন দিয়েছো? কিছু বলবা? ”
” কিছু বলার প্রয়োজন হলেই শুধু তোমাকে ফোন দেয়া যাবে, তাছাড়া নয়? ”
” ওহ, কামঅন ড্যাড। তোমার খোঁচা দিয়ে কথা বলার স্বভাব আর গেলনা। বয়স তো কম হলোনা।এবার অন্তত নিজেকে বদলাও। ”
” হুম তোমাদের মানুষ করার জন্য, টাকার পেছনে ছুটতে ছুটতে আর নিজেকে বদলানোর সময় হয়ে উঠেনি। যখন সময় ছিল তখন যদি নিজেকে বদলাতে পারতাম আজ অন্তত এই দিন দেখতে হতোনা। ”
” তুমি এসব বাজে বকতেই ফোন দিয়েছ? তাহলে ফোন রাখো। তোমার ওসব বাজে কথা শোনার সময় আমার নেই। ”
” বাহ! আজকাল দেখছি ছেলে আমার লায়েক হয়ে গেছে! বাবার কথাও তার কাছে বাজে মনে হয়! তা তুমি এখনো ঘুমাচ্ছ! পড়াশোনা নেই? শুধু ঘুমিয়ে কাটালেই হবে? ”
” আবার এসেছ জ্ঞান দিতে? শোন আমি একজন এ্যাডাল্ট। আমাকে শেখাতে এসোনা কি করতে হবে না হবে৷ তাছাড়া এটা তোমার বাংলাদেশ নয় যে ধ*ম*ক দিয়ে চুপ করাবে। ”
” ঠিক ঐটা বাংলাদেশ নয় বলেই যা খুশি করতে পারছ। নিজের পরিবারের লোকজনকে ভুলতে পারছ। আজ একমাত্র বোনের বিয়ে অথচ সারাদিন একটাবার খোঁজ নেয়ার প্রয়োজন বোধ করনি। অথচ তোমার সেই বোনটা তার প্রবাসী ভাইয়ের জন্য কেঁদে বুক ভাসাচ্ছে। এতকিছুর পরও তোমাকে ধমক দেওয়ার কোন অপশন নেই। ”
” শুরু হয়ে গেল তোমার টেপরেকর্ডার! আমি ব্যস্ত থাকি তাই ফোন দিতে পারিনি। এটাই আমার অপরাধ? ”
” কি এমন কাজ তোমার? তোমার অ্যাকাউন্টে যথেষ্ট টাকা দিয়েছি আমি। তোমার কাজের মধ্যে শুধু পড়াশোনা ছাড়া আর কিছু দেখছিনা। নাকি কোন জব করছ? যদি জব করেই থাকো তবে ছেড়ে দাও। এখন শুধু পড়াশোনায় ফোকাস করো। নিজেকে একটা স্ট্যান্ডার্ড জায়গায় নিয়ে যাও তারপর জবের কথা ভেবো। ”
” দিয়েছো তো কয়টা টাকা। তাতেই আমার মাথা কিনে নিয়েছ? এই টাকায় কি হয়? কিচ্ছুনা বুঝেছ কিচ্ছুনা। আমার আরো অনেক টাকার প্রয়োজন। তোমার মত ফ*কি*ন্নি মার্কা জীবন আমার নয়। ”
” টাকা কি তোমার নিজের জন্য প্রয়োজন না লিন্ডার জন্য? না কি তোমার নেশার জন্য? এসব ভালো নয় বেটা। তুমি ফিরে এসো। ঐ মেয়েকে ছেড়ে দাও। আমি এদেশেই তোমার চাহিদা অনুযায়ী সব করে দিব। তুমি শুধু আমাদের চোখের সামনে থাকবে। আমরা তোমাকে অনেক ভালোবাসি বেটা। ”
” ভালোবাসা মাই ফুট। আমি আর কোনদিন দেশে যাচ্ছিনা কান খুলে শুনে রাখো। আর না লিন্ডাকে ছাড়ছি। প্রয়োজনে তোমাদের ছাড়ব।আর ঐ বুড়ো তাহলে তোমার কানে কথাটা দিয়েই দিয়েছে। ”
” সাবধানে কথা বলো সাইফ। আসাদ আমার বন্ধু। ওকে সম্মান দিয়ে কথা বলো। ”
” আর কিছু বলবে? তোমার সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করছেনা। খুশি হব আমাকে ফোন না দিলে।
তোমার, মমের ঘ্যানঘ্যান শুনতে শুনতে বোর হয়ে গেছি। আমাকে এবার একটু শান্তিতে থাকতে দাও। ” জামিল চৌধুরীকে কথা বলার সুযোগ না দিয়েই ফোন কেটে দেয় সাইফ।
জামিল চৌধুরী নিজের কানকেই বিশ্বাস করতে পারছেননা। এ কি শুনলেন তিনি! তার ছেলেটা মুক্তি চায়! বুকে হালকা ব্যথা অনুভব করেন তিনি। আস্তে আস্তে সেটা বাড়তে থাকে। তারপর মাথার প্রতিটা শিরা-উপশিরায় ব্যথা প্রবাহিত হতে শুরু করে। তিনি সাদিফকে ডাকতো চেষ্টা করেন কিন্তু ব্যর্থ হন। পাশে থাক ফোন হাতে নিতে চাইলে বুঝতে পারেন তার পুরো শরীর অসার হয়ে গেছে। বিছানায় তড়পাতে থাকেন জামিল চৌধুরী। কেউ নেই তার পাশে। সবাই সাইরার গায়ে হলুদ নিয়ে ব্যস্ত।
রাত বারোটার দিকে সাদিফ বাবার খোঁজে তার রুমে আসে। রুমে ঢুকেই বিছানায় চোখ যায়। জামিল চৌধুরী এলোমেলো অবস্থায় বিছানায় শুয়ে আছেন। বমিতে ভেসে গেছে পুরো বিছানা। তিনি তার মধ্যে অজ্ঞান হয়ে পরে রয়েছেন।
বাবাকে এই অবস্থায় দেখে সাদিফের মাথা খারাপ হয়ে যায়। চিৎকার করে সবাইকে ডাকে। কিন্তু কেউই ওর চিৎকার শুনতে পায়না। বাধ্য হয়ে বাবাকে কোলে নিয়ে ছুটে গাড়ির কাছে।
চলবে…