#মুক্ত_পিঞ্জিরার_পাখি
#Ipshita_Shikdar
#পর্বঃ১২
৩৭।
ডান হাতে, পায়ে ও মাথায় ব্যান্ডেজ নিয়ে বিছানায় আধশোয়া অবস্থায় আছে আরিজ। বাম পাশেই চিন্তিত মুখে বসে আছে নয়ন্তিনী ও নয়না, বামপাশে তাদের পারিবারিক ডাক্তার। আর বিছানার ঠিক সামনে দাঁড়িয়ে জামান পরিবারের অন্যান্য মানুষগুলো। পক্ষী দরজা ধরে বিষাদ মুখশ্রীতে দাঁড়িয়ে আছে, তার গোটা দেহ যেন দুরুদুরু কাঁপছে, হৃদস্পন্দনের গতি বেড়েছে তিনগুণ হারে। মনটা বেশ ছটফটে লাগছে, এমনটা আজ দ্বিতীয়বারের মতো লাগছে তার। প্রথম লেগেছিল বিয়ের দিন প্রথমের হাসপাতালে থাকার খবর শুনে।
এই কথাটা মাথায় আসতেই অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবে এক চেনা ভয়ে কেঁপে উঠে তার হৃদয়। মনে মনেই সে বলে উঠে,
“একবার বক্ষমাঝে থাকা পাখিটির উড়াল দেওয়াটা মেনে নিয়েছে, তবে আর পারবো না গো আল্লাহ। একবার নিঃস্ব হয়েছি আর কোরো না। যতোই ঠুনকো হোক এই সম্পর্ক, লোকটা আমার স্বামী তা না চাইতেও মানতে বাধ্য আমি এবং কোথাও না কোথাও হয়তো মেনেও… আল্লাহ তুমি এই অভাগীর দিকটা একটু ভেবো, আমার সুস্থতা বা জীবন দিয়ে হলেও আমার স্বামীকে সুস্থ রেখো।”
এর মাঝেই খালা শ্বাশুড়ি নয়না বলে উঠেন,
“পক্ষী! এদিকে আসো!”
আচমকা ডাকায় পক্ষী হচকচিয়ে উঠে বলে,
“জী, খালা। আসছি।”
খালার সামনে দাঁড়াতেই তিনি বিছানা থেকে উঠে পক্ষীকে নিজের জায়গায় বসায় এবং উপদেশ করার ন্যায় বলে উঠেন,
“শোনো রহমত ভাইয়ের থেকে বুঝে নেও আরিজের সেব-যত্ম কীভাবে করতে হবে। কারণ নয়ন্তিনীর নিজেরই বয়স হয়ে আছে, আর তার উপর আরিজ নিজের জিনিসে কারো ধরাছোঁয়া পছন্দ করে না বলে আমিনাও পারবে না। তাছাড়া তুমি ওর ব্যক্তিগত জিনিসপত্র ধরলো দেখলাম ও তেমন কিছু বলে না, তাই বরং তুমিই এই দায়িত্ব নেও।”
শ্যামাঙ্গিনী বাধ্য নারীর মতো মাথা ঝাঁকিয়ে সায় জানিয় বলে,
“সমস্যা নেই, আমি পারবো।”
তখনই অপরপাশ থেকে ডাক্তার সাহেব তথা ডাক্তার রহমত বলে উঠেন,
“এই রাজকন্যাটা আবার কে! মাশা আল্লাহ! একদম ছোট্ট পরীর মতো দেখতে, মায়া ভরা গোটা মুখ। দেখলেই কলিজা ঠাণ্ডা হয়ে যায়, আমার আযানের জন্য এমনই একটা মেয়ে খুঁজছি, মা তোমার বাড়ি কোথায়?”
পক্ষীর তীব্র অস্বস্তি বোধ হচ্ছে। নয়ন্তিনী যেন তা ধরে ফেললেন। কিছুটা কঠোর গলাতেই বললেন,
“ভাই, আপনি বাজে প্যাঁচাল বাদ দিয়ে আমার ছেলের কথা বলেন তো।”
“হ্যাঁ, তাই-ই বলছি। ওর হাতের ব্যথা দিন দুয়েকের মাঝে একাই ঠিক হয়ে যাবে, এর মধ্যে হাত না নাড়ানোই ভালো। মাংসতে একটা ছেঁচা খেয়েছে আর কী! শুধু স্প্রেটা দুবার দিয়েন। কপালের ক্ষতটাও অত গভীর না, তবে দাগ সারতে সময় লাগবে। বাদ বাকি পা সেরে উঠতে কম করে হলেও এক সপ্তাহ তো লাগবেই। ঔষধ আমি কখন ও কীভাবে খেতে হবে লিখে দিয়েছি প্রেসক্রিপশনে লিখে দিয়েছি, তা দেখে খাওয়ালেই হবে।”
তিনি কথা শেষ করতেই নয়না পক্ষীকে উদ্দেশ্য করে জিজ্ঞেস করেন,
“বুঝেতো কী বলেছে?”
“হ্যাঁ।”
কিন্তু শ্যামাঙ্গিনীর মাথায় ঘুরছে অন্য ভাবনা। তার অবচেতন মন বারবার ভাবতে বাধ্য করছে তাকে।
“যেখানে লোকটা অন্যকারো আগমন নিজের ব্যক্তিগতজীবনে বা জিনিসপত্রে সহ্য করতে সেখানে তাকে এতোটা সাধারণভাবে মেনে নিল কেন?”
তারপর আর কিছুক্ষণ অহেতুক নানা কথা বলে ডাক্তার সাহেব বিদায় নিলেন। সে যাওয়ার পর ধীরেধীরে সবাই বেডরুম থেকে বের হয়ে গেল, রয়ে গেল শুধু পক্ষী ও অসুস্থ আরিজ।
আরিজ অবশ্য কপালে হাত রেখে ভাবছে কী থেকে কী হয়ে গেল। ব্রেকফাস্ট করেই সে বের হয়েছিল নিজের কাজে। দুর্ভাগ্যক্রমে আজ বাইকে করেই বের হয়েছিল, রাস্তায় হঠাৎ পিছন থেকে একটা প্রাইভেট কার এসে ধাক্কা মারে। সেখান থেকে কিছু মানুষ তাকে কাছাকাছি হাসপাতালে নিয়ে চিকিৎসা করায়, এরপর বন্ধু মানিককে কল করলে তাকে বাসায় দিয়ে যায় সে। মা এসব দেখে সাথে সাথেই ডাক্তারকে কল করে। অতঃপর এসব ঘটলো।
পক্ষী আরিজের দিকে খেয়াল করলো ছেলেটার চেহারা একটা ঘটনাতেই কেমন মলিন হয়ে গিয়েছে, রক্তজবার মতো ঠোঁটজোড়া শুকিয়ে কালচে হওয়ার দোয়ারে। তাছাড়া যুবককেও বেশ গভীর চিন্তায় নিমজ্জিত লাগে তার নিকট। কিছু একটা ভাবতেই ঘর থেকে বের হয়ে যায় সে।
রান্নাঘরে যেয়ে চুলোয় পানি বসিয়ে। দারোয়ান চাচার কাছে যায় প্রেসক্রাইব করা ঔষধাদি আনতে বলতে। আবার রান্নাঘরের দিকে যেতে যেতে ভাবে,
“এবার লোকটা সুস্থ হলেই হলো।”
৩৮।
পক্ষীরর বেরিয়ে যাওয়ার কিছুক্ষণ পেরিয়ে যেতেই ঘোর ভাঙে যুবকের। বেশ মেজাজ খারাপ হয় তার পক্ষীর বের হয়ে যাওয়ায়। তার ভাবনাটা এমন সে যেহেতু অসুস্থ সুতরাং যুবতীর উচিত তার নিকটস্থ থাকা। আনমনেই বাচ্চাদের মতো গাল ফুলিয়ে সে ভেবে উঠে,
“ভাইয়া অসুস্থ হলে ভাবি এক মিনিটের জন্যও দূরে যায় না, মাও তো তাই করে। আর আমার ঝাটা মারা কপাল আমার বউয়ের পা ঘরেই টিকে না।”
পরক্ষণেই নিজের ভাবনায় নিজেই স্তব্ধ হয়ে যায়। বিড়বিড় করে অবাক গলায় বলে উঠে,
“আমার বউ…?”
তখনই কল আসে তার মোবাইল ফোনে, মোবাইলটার হাতে নিয়ে দেখে স্ক্রিন প্রটেক্টর ভেঙ্গে গেলেও তেমন ক্ষতি হয়নি। প্রিয়ার কলটি রিসিভ করতেই সে সাধারণ ভাবেই বলে উঠে,
“আরিজ, কী করো?”
“তেমন কিছু না। তুমি…?”
“এই কলেজের টিচার্সরুমে বসে আছি, অফ পিরিয়ড। শোনো, আমি না কয়েকদিনের জন্য স্কুল থেকে স্টাডি ট্যুরে কক্সবাজার যাচ্ছি।”
“ওহ, ঠিক আছে।”
কথাটা অনায়াসে বলে ফেলায় বিস্মিত হয় প্রিয়া। মনে মনে ভাবে
“ছেলেটা কেমন অনায়াসেই এই কথা বলে দিল, কিন্তু স্বভাব অনুযায়ী একশোটা উপদেশ তো আর দিলো না। আরিজের গলাও কেমন যেন লাগছে…”
চিন্তিত গলায় পুনরায় প্রশ্ন করে উঠে,
“আরিজ, তুমি ঠিক আছো তো?”
প্রশ্নটা শুনে যুবকের একবার ভাবনা এলো এক্সিডেন্টের কথা মেয়েটাকে বলে দেওয়ার। কিন্তু পরক্ষণেই মত বদলিয়ে ভাবলো,
“শুধুশুধু প্রিয়ার মন খারাপ করাবো কেন? ট্যুর্টা উপভোগও করতে পারবে না আবার।”
যেই ভাবনা সেই কাজ করে সে।
“না, আ’ম ফাইন। তুমি যাও তোমার মতো।”
এভাবে আরও বেশ সময় ধরে নানান ধরনের কথোপকথন হলো তাদের মাঝে। কল ডিসকানেক্ট হওয়ার পর আরিজের মুখশ্রী আবারো গম্ভীর রূপ ধারণ করলো, কারণ সে যেই কাজটার জন্য বেরিয়েছিল তাই-ই হয়নি আর একসপ্তাহের আগে সম্ভবও না হওয়ার। তাছাড়া কপালের ক্ষতাটায় জ্বালা না করলেও মাথাটা ধরেছে বেশ।
তার মন খারাপের মাঝেই কফির দুটো কাপ নিয়ে ঘরে প্রবেশ করে পক্ষী। ঠোঁটের কোণে ছেয়ে আছে মুচকি হাসি। এককাপ কফি পক্ষী নিজের জন্য বিছানায় আরেক কাপ আরিজের দিকে এগিয়ে দেয়। আরিজ প্রথমে ডান হাত দিয়ে ধরতে যেতেই ব্যথায় চোখমুখ কুঁচকে যায় তার।
পক্ষী নিরবে বকার ন্যায় চোখজোড়া ছোট ছোট করে আরিজের বামহাতে ধরিয়ে দেয়। কফি খেয়ে আরিজের বেশ আরাম লাগছে, তবুও নিজের কাজের ভাবনায় ব্যস্ত সে। বিষয়টি হয়তো বুঝতে পারে শ্যামাঙ্গিনী অনেকটা শীতল গলায় বলে,
“বেশি ভাববেন না আল্লাহর অসীম দয়া ও রহমতে খুব দ্রুতোই ঠিক হয়ে যাবে সবকিছু, তাছাড়া আমার সবাইও তো আছি পাশে। জানেন প্রথম সবসময় আমাকে বলতো, ‘সময় যতোই খারাপ হোক কখনো নিরাশ, হতাশ কিংবা বেঁচে থাকার ইচ্ছেশক্তি হারাবে না। মনে রাখবে আর কেউ না থাকুক ঐ সাত আসমানের উপরে একজন আছে তোমার জন্য, তার চাইতে বেশি তোমার ভালো কেউ করতে পারবে না। কারণ সেই যে তোমার সৃষ্টিকর্তা ও পালনকর্তা।'”
পক্ষী বলা প্রথম বাক্যে আরিজের মনে যতোটা শীতল হয়েছে, পরের কথাটুকুতে ততোটাই জ্বলছে। মনে হচ্ছে হৃদয় বেশ ছোট্ট তবে বিষাক্ত অসংখ্য সূচ গেঁথে গিয়েছে। সে যে কী এক অসহ্যকর যন্ত্রণা!
প্রথমবার অনুভব করায় সহ্য ক্ষমতার বাইরেই তা আরিজের। অতি শিঘ্রই আধশোয়া অবস্থাতেই মাথাটা বালিশে এলিয়ে দেয় যুবক, চোখজোড়া নিজ দায়িত্বেই বদ্ধ হয়ে আসে।
‘প্রেম যদি হয় আস্ত এক গোলাপফুল,
তবে অনুভূতিগুলো একেকটা ধারালো কাটা,
আর সবচেয়ে ভয়ংকর কাটাটিই হলো ঈর্ষা,
যা সঙ্গীর মুখে অন্যের নাম শুনলেও অনুভব হতে বাধ্য হৃদয়।’
চলবে…