#মুক্ত_পিঞ্জিরার_পাখি
#পর্বঃ১৬
#Ipshita_Shikdar
৪৫।
বেডরুমের এদিকওদিক পাগলের মতো ছন্নছাড়া ভাব ধরে হাঁটছে আরিজ, তার মাঝে যেন অনুভূতি শূণ্য হয়ে উঠেছে। ব্যথায় যেন কাতর হয়ে কাঁদছে হৃদয়মহলের প্রতিটি দেয়াল। এতো যন্ত্রণা কী সহ্য করার মতো! একটু পর পর জোরে শব্দ তুলে লাথি মারছে আলমারি, খাটকে। মোটা সেগুন কাঠ না হলে এতক্ষণে ভেঙ্গেই যেতো, তার আক্রোশে।
হঠাৎই চোখ পড়লো বেডের কোণে পড়ে থাকা একদম উলটো করে রাখা একটি কাঠের ফটোফ্রেমে। কৌতূহল হলো প্রচণ্ড যাতে ঘুচে গেল রাগ। ধীর পায়ে বেডে বসে ফ্রেমটা নিতেই বুঝলো এ কোনো সাধারণ ফ্রেম নয়। বরং, নিজ হাতে অত্যন্ত যত্ন করে তৈরি ছবির ফ্রেম।
ছবিটা চোখে ফুটে উঠতেই ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল আরিজ। কী মিষ্টি দেখতে এক সদ্য কিশোরে পা দেওয়া তথা তেরো-চৌদ্দ বছরের মেয়ে মুক্ত ঝরা হাসি দিয়ে এক সুপুরুষের হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছে। সাদা রঙের মেঝে ছোঁয়া ফ্রকে ঠোঁটে চাপা হাসি হাটু অবধি আঁকাবাঁকা কেশে স্বয়ং মায়াবিনী যেন ছবিটিতে দাঁড়িয়ে।
আনমনেই ভেবে উঠে সে,
“এই মেয়ের নাম নিশ্চয়ই পুতুল! স্বপ্ন নগরের এই অনগণ্য পরী কে আসলে! ”
তখনই তার চোখজোড়া যেয়ে স্থির হয়ে যায় কিশোরী চঞ্চল চোখজোড়ার একটি পাশে থাকা কিঞ্চিৎ দৃশ্যমান দাগটিতে। মুহূর্তেই শীতলতা ছেয়ে যায় তার সর্বাঙ্গে। মনে মনে বলে,
“এই মেয়ে তো এক জলজ্যান্ত ছোট্ট পরী! আচ্ছা, এই পূর্ণাঙ্গ যুবতী দেহেও কী শুভ্র পোশাক জড়ালে সেই কিশোরী ছোট্ট পরী রূপেই দেখতে পাবো তাকে? একদিন পরতে বলতে হবে নিশ্চিত!”
পরক্ষণেই কয়েক ঘণ্টা আগের কথাগুলোর মনে পড়ে যায় তার, রাগের অগ্নিকুণ্ড আবার জ্বলে উঠে হৃদয়ের গহীনে। তবে এবার সারা ঘরের রফাদফা করে না সে, বরং চোখমুখ খিচে যুবতী অপেক্ষা করতে ব্যস্ত সে।
তখনই হাসি হাসি মুখে ঘরে ঢুকে পক্ষী। কানে দৃশ্যমান মোবাইল ফোন, কারো সাথে কথা বলছে সে ফোনে।
“আচ্ছা, আচ্ছা, অনেক মজা হবে। প্রজেক্টটাই যে এমন আদনান ভাই!”
আরিজের রাগ মাথাচাড়া দিয়ে উঠে যায় ‘আদনান’ শব্দটি কানে আসতেই। হুট করেই উঠে যেয়ে যুবতী কান থেকে ফোন নামিয়ে কলটা কেটে ফোন ছুড়ে মারে নরম বিছানায়।
পক্ষী কী করে কী হলো বুঝতেও পারেনি। প্রথমে সে অবাক হলেও পরক্ষণেই ভাবে,
“লোকটা হয়তো এমনেই দুষ্টুমি করছে।”
তার এমন ভাবনার কারণ পক্ষী এতদিনে যে আরিজকে দেখেছে তাতে প্রথম রাত্রিতে আরিজের যেই রূপের সাক্ষাৎ ভুলেই গিয়েছে। আপন মনেই সে বিরক্তির সুরে বলতে লাগে,
“আপনি না আরিজ…! মাত্র ভার্সিটি থেকে এসেছি, আর আসতেই তুমি এসব দুষ্টুমি শুরু করেছে। পুরাই পাগল হয়ে গেছো! মাথার ডাক্তার দেখান!”
এসব অহেতুক কথাবার্তা বলতে বলতেই মাথার হিজাবের পিন খুলতে খুলতে ড্রেসিংটেবিলের সামনে দাঁড়ায় সে। হিজাবের শেষ কোণাটা মাথা থেকে খুলবে, ঠিক সেই মুহূর্তে আরিজ তার পিঠ ঘেঁষে দাঁড়ায়। তার তীক্ষ্ম দৃষ্টি স্থাপিত হয়ে আছে আয়নায় বিদ্যমান যুবতীর প্রতিবিম্বের দিকে।
পক্ষী আয়নার দিকে তাকিয়ে কেঁপে উঠে সরে যেতে চায়, কিন্তু আরিজ এমনভাবে ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে যে যেতে হলেও তাকে সরিয়ে যেতে হবে। মাথা নত করেই মিনমিনে কণ্ঠে যুবতী জিজ্ঞেস করে,
“আপনি… মানে আপনি একটু দূরে সরে দাঁড়াবেন, প্লিজ?”
আমের আঁটিকে যেমন খাদক অবজ্ঞা করে তেমনই অবজ্ঞার পাত্র হলো এই বাক্যটি আরিজের নিকট। সে গম্ভীর গলায় নিজের তীক্ষ্ম দৃষ্টি স্থির রেখেই বলে উঠে,
“ঐ ছেলের সাথে এত কীসের কথা চলছিল? কথা তো কথা, তবে এত হাসাহাস!”
মেজাজ খারাপ হয়ে যাচ্ছে পক্ষীর। তার মস্তিষ্কের প্রশ্ন ও যুক্তি তাকে যেন বলছে,
“সেও তো তার মতো চলে, নিজের প্রেমিকার সাথে কথা বলে। তুমি তো প্রশ্ন করোনি কখনো কোনো অধিকার নিয়ে, তাহলে সে কোন অধিকারে করছে?”
কথাগুলো ভাবতেই চোখমুখ শক্ত করে আলতো ধাক্কায় সরিয়ে দেয় আরিজকে। দৃঢ় গলায় উত্তর দেয়,
“যা-ই কথা বলি, আপনি প্রশ্ন করার অধিকার রাখেন না। রাখেন কী?”
বলেই ঘর থেকে বের হয়ে যায় সে। এদিকে আরিজ বুঝতে পারছে না তার কার উপর রাগ দেখানো উচিত, না নিজের উপর। আসলে তার রাগটা নিজের উপরেই বেশি হচ্ছে, যখন থেকে মৃণ্ময় তাকে তার জীবনের অদম্য সত্যের আয়না দেখিয়েছে।
অতীত,
পক্ষী ভার্সিটির জন্য বেরোতেই নিজের কাজের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে যায় আরিজ। ঘণ্টার পর ঘণ্টা ব্যস্ততার মাঝে কাটিয়ে হঠাৎই তার মনে পড়ে একটি। আনমনেই সে ভাবে,
“আরে এখন তো পক্ষীর বের হওয়ার সময়, আমি ওকে নিতে গেলে কেমন হবে? না, না, মেয়েটা আবার কিনা কী মনে করে!”
বিভিন্ন দ্বিধার মাঝেও তীব্র ইচ্ছের কাছে হার মানে যুবক। কাজ ফেলে চলে যায় ভার্সিটিতে। রাস্তার অপরপাশে গাড়ি থামিয়ে অপেক্ষা করছিল তখনই যেই এক সাধারণ দৃশ্য দেখে। তবে কেন যেন এই সাধারণ দৃশ্য আস্ত এক তলোয়ার দেহেকে ক্ষত-বিক্ষত করছে বলেই মনে হয় তার।
বলা বাহুল্য, দৃশ্যটি ছিল সেদিনের সেই ছেলেটি তথা আদনান ও পক্ষীর এক গভীর আলাপ-আলোচনার। তারা কথা বলতে বলতেই নানা হাসাহাসিতে মশগুল হচ্ছিলো। এই দৃশ্যটিই যুবকের হৃদয়কে যেমন ক্ষত-বিক্ষত করছিল তেমনই হৃদয়মহলে জ্বালিয়ে ফেলছিল ঈর্ষা ও রাগের অগ্নিকুণ্ড।
রেগে গাড়িতে তিন-চারটা লাথি মারতেই পরিচিত গলায় কেউ চেঁচিয়ে নাম ধরে ডাকে তাকে। পিছনে তাকিয়ে দেখে মৃণ্ময় দাঁড়িয়ে, মৃণ্ময় তার ছেলেবেলার বন্ধু, ছোটবেলা থেকেই দুজনের গলায় ভাব। কিন্তু দুজনের ব্যস্ত কর্মজীবনের দেখা-সাক্ষাৎ তেমন একটা হয় না বললেই চলে। তবে কথোপকথনটা বেশ হয় শুধুমাত্র পার্থক্য আগে সরাসরি হতো এখন এক কৃত্রিম মাধ্যমে। তবে আরিজের বিয়ে হওয়ার দুয়েকদিম আগ থেকে দুজনের মাঝে কোনো এক ব্যস্ততায় আর কথা হয়নি।
মৃণ্ময় হাসি মুখে বন্ধুকে জড়িয়ে ধরে জিজ্ঞেস করে,
“কী রে, কেমন আছিস?”
আরিজের যেহেতু মেজাজ খারাপ সে তেমন মুখভঙ্গি রেখেই বলে,
“আছি ভালোই।”
“তোকে দেখে তো তা মনে হচ্ছে না। চল সামনে রেস্টুরেন্টটায় যেয়ে বসি।”
আরিজ নাকোচ করলেও বন্ধুর জোরাজুরিতে তাকে বাধ্য হয়ে যেতেই হলো। দু’জন রেস্টুরেন্টের এক নিরব কোণে যেয়ে বসে দুজন সামনাসামনি যেয়ে বসে।
“এখন বল তো কী হয়েছে?”
আরিজ একে একে তার জীবনের সব অপরিকল্পিত পাতাগুলো তুলে ধরে বন্ধুর নিকট। সব শুনে ছোট্ট এক শ্বাস ফেলে মৃণ্ময়। তখনই ওয়েটার তাদের অর্ডার করা উষ্ণ ধোঁয়া উঠানো কফি নিয়ে উপস্থিত।
উষ্ণ কফিতে অধর ডুবিয়ে মৃণ্ময় বলতে শুরু করে,
“অরনিকে মনে আছে?”
“যার সাথে মাস সাতেক আগে আঙ্কেল-আন্টি তোকে জোর করে বিয়ে দিয়েছিল? ওকে তুই ডিভোর্স দিয়ে তোর গার্লফ্রেন্ডকে বিয়ে করবি বলেছিলি। কিন্তু এরপর কী করেছিস কিছু বলিসনি আমিও জিজ্ঞেস করোনি।”
“অতি শিঘ্রই আমরা আব্বু-আম্মু হচ্ছি। জানিস অরনি আমার এক্স দিয়ার মতো এত সুন্দর না, আবার অত ফ্যাশনও করতে পারে না। যেমন গায়ের মেয়ে তেমন গাইয়া স্বভাব। আমি ভেবেছিলাম, এমন একটা মেয়ে আমি ডিজার্ভ করি না, দিয়াকে ভালোবাসি আমি। কত যে অত্যাচার করেছি মেয়েটাকে বের করতে! ছোট্ট মেয়েটা তবুও কোনোদিন বিচার দেয়নি, অবশ্য তা আমাকে ভালোবেসে নাকি বৃদ্ধ পিতামাতার চিন্তা বাড়াতে চায়নি বলে তা জানি না। তবে যেই মেয়েটা বিয়ের টানা তিনমাসেও আমাকে ছেড়ে যায়নি, সে যখন তিনমাস পর বাবার বাড়ি যায় খুব খুশি হয়েছিলাম আমি। কিন্তু দুয়েকদিন যেতেই না বুকটায় খালি খালি লাগতো। ঘরের প্রতিটি কোণ তার স্মৃতির চিহ্ন ছড়িয়ে। আমার সর্বাঙ্গে যেন বিচরণ তার। একদিন উপলব্ধি করলাম, আমি না দিয়াকে কোনোদিন ভালোই বাসিনি, তার রূপের মোহে পড়েছিলাম মাত্র। তাই তো একটু কষ্টও পাইনি তার বিরহে, অথচ অরনির বিরহে…”
বলেই থামে সে। মৃদু হাসি ফুটে উঠে তার ঠোঁটের কোণে, সাথে অতীতের কিছু কাজের অপরাধবোধও মুখশ্রীতে স্পষ্টতর।
“শোন রিলেশনশীপে থাকা মানেই ভালোবাসার বন্ধনে জুড়ে থাকা না। ভালো জীবনে বহুবার বাসা যায়, একটা বন্য কুকুরকেও চাইলেই ভালোবাসা যায়। কিন্তু একজনকে নিজের সবটা দিয়ে ভালোবাসা মানুষের শ্রেষ্ঠ প্রাপ্তি, কারণ এটাতেই প্রকৃত ভালোবাসার স্বাদ পাওয়া যায় শুধুমাত্র। আজকালের যুগে আমরা ইনফেচুয়েশন, এট্রাকশন, ক্রাশ সবকিছুকেই ভালোবাসা মনে করে এক অধিকারহীন মিথ্যে সম্পর্ক অর্থাৎ রিলেশনশিপে জড়াই। নিজের সবকিছু লুটিয়ে দেই সেই মিথ্যে সম্পর্কে। অথচ, সেখানে ভালোবাসা ও অধিকার দুটোরই থলি শূণ্য, ফলাফল আত্মহানি। আর বিয়ে এতে অধিকার থাকে, কবুলের জোর থাকে, এক ঘরের সঙ্গী হয়ে থাকতে থাকতে মায়া থেকে কবে যে ভালোবাসা শুরু হয় বোঝাও যায় না।”
আরিজ হতবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে,
“তুই কী বলতে চাচ্ছিস, আমার পক্ষীকে…?”
“উহু, আমি বলতে চাচ্ছি যাকে ভালোবাসিস তার নিকট যা। তা যেই-ই হয়। আচ্ছা, একটা কথা বল, প্রিয়ারও তো ছেলে বন্ধু আছে। কই কখনো তো রাগিসনি? এমন কি প্রিয়াকে তো তোর সামনে এক ছেলে প্রাপোজ করেছিল তাও রাগিসনি। প্রিয়া কোনো ছেলের সাথে কথা বললে তো তোর এমন লাগেনি। তাহলে পক্ষী কেন? কারণ তুই কখনো প্রিয়াকে ভালোই বাসিসনি। তোর জন্য প্রিয়া একটা সৌন্দর্য বর্ধনের শোপিস বৈকি আর কিছুই ছিল না। অথচ, পক্ষীর জন্য তুই অধিকারবোধ করিস। এখন বাকিটা তুই বুঝ। আমি যাচ্ছি, তোর ভাবি আবার অপেক্ষা করছে।”
কথাটা বলে নিজের অফিস ব্যাগটা তুলে বিল দিয়ে বেরিয়ে যায় সে। আরিজ সেখানেই বসে থাকে গভীর ভাবনায় ডুবে, সে যেন কিছুতেই পারছে এই সত্যকে মেনে নিতে।
চলবে…