#ধারাবাহিক_রহস্য_গল্প
#মুখ_ও_মুখোশ
#পর্ব_২
অ্যানাউন্স হয়ে গেছে, বোর্ডিং পাস ইস্যু করে প্লেনের ভিতর ঢুকে সিটবেল্টটা বেঁধে নিল অনামিকা | এর আগে বহুবার প্লেনে উঠেছে প্রবালের সঙ্গে কিন্তু এমন শান্তি এই প্রথম | চোখ বন্ধ করে অনামিকা নিজের সিটে বসে ছিল….. হঠাৎ ঘড়ঘড় শব্দ শুনে চোখটা খুলে গেল, বাইরের দিকে তাকিয়ে দেখল প্লেনটা রানওয়ে দিয়ে ছুটছে, তারপর একটা ছোট্ট লাফ, পেটবোঝাই যাত্রীদের নিয়ে প্লেনটা উড়ল…. আহ্ ! মুক্তি বলে চোখদুটো বোজালো অনামিকা | না যাত্রাপথের দৃশ্য উপভোগের শখ তার আর নেই, কিন্তু হানিমুনে জানালার ধারে বসার জন্য সে প্রবালের সঙ্গে কত ঝগড়াই করেছে…. হাল্কা হাসি ছড়িয়ে গেল ঠোঁটের কোণে | আপনমনেই বিড়বিড় করল, ভালোয় ভালোয় একবার মুম্বই পৌঁছতে পারলে হয়, মিঃ মানসুখানির যথেষ্ট ইনফ্লুয়েন্সিয়াল, ওর সঙ্গে লড়ার সাহস কি আছে প্রবালের ? মনে হয় না …. ম্যাম আপনার কিছু লাগবে ? সুবেশিনী বিমান সেবিকার সুরেলা গলা শুনে অনামিকা চোখ মেলল, তারপর মিষ্টি হেসে না বলে ক্লান্ত চোখদুটো বুঝিয়ে ফেলল…
ইতিমধ্যে ঘন্টা তিনেক কেটে গেছে | গাড়ির বাইরে তরুণ উত্তেজিতভাবে পদচারণা করছে | ম্যাডামের তো কোনদিনই এতক্ষণ সময় লাগে না …. আজকেরটা কি স্পেশাল কেস ? …. ম্যাডাম এখনো আসছে না কেন ? ঘড়ির কাঁটা ঘোরার সঙ্গে সঙ্গে তরুণের সন্দেহ একটু একটু করে বাড়তে থাকে …… হোটেলের রিসেপশনে গিয়ে বলে, একটা ইনফরমেশন চাই | হ্যাঁ বলুন…আমি ম্যাডাম অনামিকার ড্রাইভার | ম্যাডাম অনেকক্ষণ আগে উপরে গেছেন, আমি বাইরে অপেক্ষা করছিলাম | এখনো কাজ শেষ হল না কেন বুঝতে পারছি না ! যদি জানান আমার ম্যাডাম হোটেলের কোন রুমে আছেন তাহলে খুব ভালো হয়… দেখুন স্যার, এটা নেক্সট টু ইম্পসিবল …. আমাদের হোটেলের একটা রেপুটেশন আছে | আমরা যে কাউকে গেস্টদের পার্সোনাল ইনফরমেশন শেয়ার করি না | কথায় চিঁড়ে ভিজবে না দেখে তরুণ সোজা ওর বস প্রবালকে ফোন লাগায়, স্যার একটা সমস্যা হয়ে গেছে !
সমস্যা ! কেমন সমস্যা ? প্রবাল বেশ উদ্বিগ্ন |
স্যার ম্যাডাম তিনঘন্টা হল গাড়িতে করে হোটেল লা ভ্যানিলায় এসেছেন | আপনার নাকি আজ পার্টিকে দিয়ে কি একটা ডিল সাইন করানোর ছিল !
আমার ডিল ! আজকে ?
ম্যাডাম তো আমায় তাই বললেন | স্যার ম্যাডামের হাতে একটা স্মলসাইজ ট্রলি ছিল |
মনে হচ্ছে সর্বনাশ হয়েছে | ও বোধহয় আমায় ধোঁকা দিয়ে অন্য কোথাও পালিয়েছে | তরুণ তুমি ওখানকার রিশেপসনে ওয়েট করো | আমি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব হোটেলে আসছি |
নিজের পোর্শেটায় উঠে এয়ারপোর্টের দিকে চটজলদি গাড়ি চালিয়ে দিলেন মিঃ দত্ত | মাথায় ভীষণ চাপ, মাথা কাজ করতে চাইছে না | চিন্তাগুলো এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে …. সত্যি কি সোনার ডিম দেওয়া রাজহাঁস খাঁচা ছেড়ে উড়ে গেল !
হোটেলে পৌঁছে প্রবাল দেখল, রিশেপসনে রাখা সোফার একপাশে তরুণ গুটিসুটি মেরে বসে আছে | প্রবাল ওর দিকে না তাকিয়ে রিশেপসনে বসা মেয়েটিকে জিজ্ঞেস করল, মিসেস অনামিকা দত্ত আপনাদের হোটেলের কত নম্বর রুমে আছেন ? দেখা গেল রিশেপসনের মেয়েটা প্রবালকে ভালোই চেনে | এখনকার ম্যাগাজিন আর কাগজগুলোর পেজ থ্রি পার্টি ওদের মতো ব্যবসায়ীদেরও একটা সেলিব্রিটি স্ট্যাটাস দিয়েছে | আপনি স্যার প্রবাল দত্ত না ?
হুম ! আমিই প্রবাল দত্ত | গলায় একটু জোর এনে বলল, জলদি বলো তুমি কি আমায় এই ইনফর্মেশনটা দিতে পারবে ?
দেখুন স্যার, এটা ফাইভ স্টার রেপুটেড হোটেল | মিসেস দত্ত আপনার কে হন সেটা না জেনে এভাবে তো ইনফো দিতে পারি না !
উনি আমার মিসেস হন মিসেস | রাগ করে বাড়ি ছেড়ে চলে এসেছেন | এবার কি ওনার রুম নম্বরটা বলা যাবে ?
ওয়েট স্যার | হ্যাঁ, আমি কম্পিউটারে চেক করে জানাচ্ছি | হ্যাঁ, ওনার ভোটার কার্ডে হাসবেন্ড হিসাবে আপনার নাম দেওয়া আছে | এই রণি প্রবাল স্যারকে একবার অনামিকা দত্তের রুম নং ২০২ তে নিয়ে যা তো !
রুম নং ২০২ | দরজার ল্যাচে ডু নট ডিসটার্ব বোর্ড লাগানো রয়েছে | প্রবাল বেশ কয়েকবার দরজায় টোকা দিল | কেউ সাড়া দিল না, দরজাও খুলল না |
প্রবাল রনিকে রিশেপসনে রাখা ডুপলিকেট চাবি দিয়ে দরজা খুলতে বললে সে সভয়ে জানাল, এটা হোটেলের নিয়ম বিরুদ্ধ | দয়া করে আপনি একটু দাঁড়ান, আমি এখুনি হোটেলের ম্যানেজারকে ডেকে আনছি |
বিখ্যাত বিজনেস ম্যান প্রবাল দত্তর নাম শুনে ম্যানেজার পাঁচ মিনিটের মধ্যে চলে এলেন | রুমের সামনে দাঁড়িয়ে পুরো ব্যাপারটা শুনে ম্যানেজার ভয় পেয়ে গেলেন | বললেন, আচ্ছা আসুন, দরজাটা খুলে দেখা যাক ! ভেতরে কি হয়েছে দেখা যাক ! রণি তুমি গিয়ে রিসেপশন থেকে ডুপলিকেট চাবি নিয়ে এস | চাবি দিয়ে দরজা খুলতেই সবাই হুড়মুড় করে রুমে ঢুকে পড়ল, রুম বিলকুল ফাঁকা | চাদরের ভাঁজও পরিপাটি | এই রুমে যে কিছুক্ষণ আগে কেউ ছিল, কোথাও তার চিহ্নমাত্র নেই | হোটেলের রুম থেকে মিসেস অনামিকা দত্ত যেন পুরোপুরি হাওয়ায় উবে গেছেন | এখানে তো অনামিকা নেই ,অথচ এই রুমের বাইরে ডু নট ডিসটার্ব বোর্ড ঝুলছে …. আপনাদের সিকিউরিটি ব্যবস্থা এত ঢিলাঢালা হয় কি করে ? প্রবাল ম্যানেজারের উপর গর্জে উঠল |
ম্যানেজার বিনয়ীভাবে বললেন, দেখুন স্যার, এতবড় হোটেল এতজন অতিথি থাকেন কে কখন কোথায় যাচ্ছেন সেদিকে নজর দেওয়া আমাদের পক্ষে সবসময় সম্ভব হয় না…. কখনো কখনো এরকম ঘটনা ঘটে যায় | তবে আপনি চিন্তা করবেন না…. আমাদের হোটেল ২৪*৭ সিসিটিভির আওতায় থাকে | আমি দেখছি কি করা যায় !
প্লিজ একটু তাড়াতাড়ি করুন, প্রবাল বলে উঠল | আমি আপনাদের হোটেলের সিসিটিভি ফুটেজ দেখতে চাই ….
ফুটেজ চেক করতেই দেখা গেল দরজায় ডু নট ডিসটার্ব বোর্ড ঝুলিয়ে হোটেলের ব্যাকডোর দিয়ে ট্রলি হাতে বেরিয়ে যাচ্ছে অনামিকা | স্যার আমরা কি পুলিশে খবর দেব ? প্রবাল কিছু একটা ভাবছিল হঠাৎ ম্যানেজারের গলা শুনে চমকে উঠল |
নো নো, একদম এসব কাজ করবেন না | বাড়ির সমস্যা, আমি নিজের মতো করে মিটিয়ে নেব | বউ রেগে চলে গেছে বলে পুলিশে গেলে আমার রেপুটেশনে প্রভাব পড়বে |
কিন্তু স্যার, ঘটনাটা আমাদের হোটেলে ঘটেছে | জলঘোলা হলে তো আমরাও ফেঁসে যাব |
আমি তো বলছিই আমি পুলিশে খবর দেব না |
কিন্তু স্যার আপনার মিসেসের বাড়ির লোকজন ?ওদের দায়িত্ব আমি নিলাম | ওরা তো আর জানে না অনামিকা আপনাদের হোটেলে এসেছিল !
তাও স্যার ! আমাদের একটা দায়িত্ব থেকে যায়…. ম্যানেজার বলে উঠলেন |
আই উইল কম্পেনসেট ! ইয়ু ডোন্ট ওরি ! চেকবুক বার করে মোটা অ্যামাউন্ট লিখলেন মিঃ দত্ত | মে আই গো নাও ?
ইয়েস স্যার |
তরুণ চল ! এমনিতেই অনেকটা দেরি হয়ে গেছে |
গাড়িতে উঠে তরুণের উপর প্রায় ফেটে পড়ল প্রবাল… তোকে কত করে বলেছি ম্যাডামের উপর নজর রাখতে | তারপরেও কিভাবে তুই ….. অপদার্থ |
স্যার যদি রাগ না করেন একটা কথা বলি ?
কি আর বলবি ? তোর চোখের সামনে দিয়ে ড্যাং ড্যাং করে অনামিকা হোটেলের পিছনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেল | তুই চোখে দেখতেও পেলি না …… লজ্জা করে না তোর ! আচ্ছা বল কি বলবি ?
স্যার বলছিলাম যে, এয়ারপোর্টে একবার এনকোয়ারি করলে হয় না ? ম্যাডাম যদি ফ্লাইটে কোথাও গিয়ে থাকেন ?
এটা তো আমার মাথায় আসে নি | গাড়ি এয়ারপোর্টের দিকে ঘোরা |
এক্সকিউজ মি ! অনামিকা দত্ত বলে কেউ কি আজ ফ্লাইটে উঠেছেন ? ফ্লাইট ইনফরমেশন কাউন্টারে গিয়ে প্রশ্ন করল প্রবাল |
হু আর ইউ ! আপনাকে আমি কোনো বিমানযাত্রীর ইনফরমেশন দিতে পারি না |
উদভ্রান্ত প্রবাল দও বেশ রেগেই ওই মেয়েটাকে বলল, আমি ওনার হাসবেন্ড ! তাছাড়া আপনি বিখ্যাত বিজনেস ম্যান প্রবাল দত্তের নাম শুনেছেন নিশ্চয়ই ? আমি সেই প্রবাল দত্ত !
সরি স্যার ! আপনার আইডি কার্ড না দেখে আমি এই ইনফো দিতে পারি না !
ওয়েট ! চেক দিস ! নিজের আইডি কার্ড ছুড়ে দিল প্রবাল |
ওকে স্যার ! আপনার মিসেসের আইডি কার্ডে হাসবেন্ড হিসাবে আপনার নামই দেখাচ্ছে | উনি ৩:৩০ এর ফ্লাইটে মুম্বাই গেছেন |
একা গেছেন ? না সঙ্গে আর কেউ ছিল ?
না, এখানকার ইনফরমেশন অনুযায়ী অনলাইন একটা টিকিটই কাটা হয়েছে দেখাচ্ছে | সম্ভবতঃ ওনার সঙ্গে আর কেউ ছিল না | তবে একটা কথা স্যার ! আপনার মিসেসকে আপনি পাগলের মতো খুঁজছেন তাই আমি কিন্তু নিয়মের বাইরে গিয়ে আপনাকে ইনফরমেশন দিলাম | দেখবেন কথাটা যেন পুলিশ কোনভাবেই জানতে না পারে….
( চলবে )
©️ অনিন্দিতা