#মুগ্ধতায়_তুমি
#পর্বঃ১৪
#Saiyara_Hossain_Kayanat
“কিছু কিছু জিনিস এমনিতেই নিজের করে নেওয়া যায়। আবার নিজের মুগ্ধতায় আটকে বন্দী করে রাখা যায়। ”
পিছন থেকে এই কথা আমাদের কানে ভেসে আসতেই আমি আর মিমশি পিছনে তাকিয়ে দেখলাম শুভ্র ভাই দুহাত পকেটে গুজে বেশ ভাব নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মিমশি ভ্রু কুচকে তাকিয়ে আছে শুভ্র ভাইয়ের দিকে হয়তো চিনতে পারেনি তাই। আমি মিমশিকে দেখিয়ে শুভ্র ভাইয়ের উদ্দেশ্যে বললাম-
— ও আমার বেস্ট ফ্রেন্ড মিমশি আর উনি হলেন….
আমি কথা শেষ করার আগেই শুভ্র ভাই আমার দিকে এগিয়ে এসে আমার পাশে দাঁড়িয়ে বললেন-
— আমি শুভ্র…. নিশ্চয়ই এতোক্ষন আমাকে নিয়ে কথা হচ্ছিলো!!
শুভ্র নাম শুনেই মিমশি খুশিতে গদগদ করে বললো-
— আপনিই তাহলে আমার দুলা….
মিমশি আর কিছু বলার আগেই ওর বাহুতে এক চিমটি কাটলাম। মিমশি হাত ঘষতে আমতা-আমতা করে বললো-
— মানে আপনিই তাহলে অনন্যার শুভ্র ভাই!! অনন্যার কাছে আপনার কথা শুনেই আপনাকে দেখতে ইচ্ছে করছিল।
শুভ্র ভাই একটা অমায়িক হাসি দিয়ে বললেন-
— আগের নামটাই কিন্তু বেশ ভালো ছিলো।
এই কথা বলেই মিমশি আর শুভ্র ভাই এক সাথে হেসে উঠলেন। আর আমি বোকার মতো তাদের দিকে তাকিয়ে আছি। হাসির মাঝেই মিমশি বললো-
— ভাইয়া আপনি কিন্তু প্রচুর হ্যান্ডসাম। অনন্যার জায়গায় আমি থাকলে এতোদিন প্রেমে হাবুডুবু খেয়ে আপনার গলায় ঝুলে থাকতাম। আর যাইহোক আমি তো আর অন্য কারও মতো হাদারাম না।
মিমশি শেষের কথাটা যে আমাকে উদ্দেশ্য করে বলেছে তা ওর আড় চোখে তাকানো দেখেই বুঝে গেছি। এই কথা বলেই ওরা দুজন উচ্চস্বরে গাঁ জ্বালানোর মতো হাসি দিলেন। রাগে আমি চোখ মুখ শক্ত করে বললাম-
— এখানে কি সার্কাস শো হচ্ছে না-কি এভাবে হাসার কি আছে।
আমার কথা শুনে শুভ্র ভাই অসহায় কন্ঠে বললেন-
— এসব বোঝার বয়স তোর এখনো হয়নি। যদি এতো কিছু বুঝতি তাহলে আমার আর এতো কষ্ট করতে হতো না। কি বলো মিমশি আমি ঠিক বলেছি না!!
শুভ্র ভাইয়ের কথা শুনে মিমশি দ্রুত ওর মাথা উপর নিচে ঝাকালো যার মানে উনি ঠিক বলেছেন। আমার দুই শত্রু এক সাথে মিলেছে এখন কি আর আমার নিস্তার আছে নাকি!! আমি চোখ গরম করে শক্ত গলায় বললাম-
— আমার বোঝার বয়স হয়নি আপনাদের দুজনের তো হয়েছে তাহলে থাকুন আপনারা দুজন আমি যাই।
আমি চলে যেতে নিলেই শুভ্র ভাই খপ করে আমার হাত ধরে নেকামো করে বললেন-
— রাগ করছিস কেন অনন্য কে তোকে কি বলেছে??? মিমশি কিছু বলেছে?? দাড়া আমি ওকে বকা দিয়ে দিচ্ছি।
এই কথা বলে মিমশির কাছে গিয়ে চোখ টিপ দিয়ে বললেন-
— এই শালি তোমার এতো সাহস তুমি অনন্যকে আজে বাজে কথা বলো….
কথাটা বলেই শুভ্র ভাই আর মিমশি এক সাথে হাসিতে ফেটে পরলেন।
আমি রেগেমেগে ওখান থেকে চলে আসলাম। ভার্সিটির থেকে বেরিয়ে রাস্তায় আসার সাথে সাথেই পেছন থেকে শুভ্র ভাই আমার ধরে ফেললেন। আমার সামনে এসে দাড়িয়ে স্বাভাবিক ভাবেই বললেন-
— তুই এতো বোকা কেন অনন্য!! বাচ্চাদের মতো অল্পতেই রেগে গাল ফুলিয়ে থাকিস।
আমি রেগেই বললাম-
— আমি এমনই আপনার যদি ভালো না লাগে তাহলে আমার থেকে দূরে থাকলেই পারেন।
শুভ্র ভাই রেগে ধমক দিয়ে বললেন-
— এক চড় দিয়ে একদম গাল লাল করে দিবো ফাজিল। সব সময় বেশি বুঝিস কেন!! আমি কি কখনও একথা বলেছি???
এই লোকটা এতো অদ্ভুত কেন! হঠাৎ করেই রেগে যায়। আমি কিছু না বলে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলাম। পুরো রাস্তা একটা কথাও বলিনি। বাসায় পৌঁছে চুপচাপ নিজের রুমে চলে আসলাম।
—————
বিকেলে ছাদে দাঁড়িয়ে আছি ভালো লাগছে না কিছু। শুভ্র ভাইয়ের উপর প্রচন্ড রাগ হচ্ছে ইচ্ছে করছে একদম গলা টিপে মেরে ফেলি। সব সময় আমাকে ধমক দেন, বার বার চড় দেওয়ার কথা বলেন অসহ্যকর লোক। মনে মনে শপথ করলাম আজ থেকে আমি আর এই লোকটার সাথে কথা বলবো না।
সন্ধ্যা হয়ে যাওয়ায় ছাদ থেকে নেমে আমাদের ফ্ল্যাটে যাচ্ছি তখনই দেখলাম শুভ্র ভাই ওনাদের ফ্ল্যাটের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। চেহারা দেখেই বোঝা যাচ্ছে উনি বেশ ক্লান্ত আর প্রচন্ড বিরক্ত এই মুহূর্তে হয়তো আন্টি দরজা খুলতে দেরি করছে তাই। শুভ্র ভাই এখনো আমাকে খেয়াল করে নি। আমি সিড়ি দিয়ে নেমে ওনারা দিকে না তাকিয়েই আমাদের ফ্ল্যাটের দরজার সামনে এসে চুপচাপ লক খুলে ভিতরে ডুকে দরজার লাগাতে যাবো ওমনি শুভ্র ভাই দরজা ধাক্কা দিয়ে আমাকে একপ্রকার ঢেলে ভিতরে ডুকে পরলেন। সোজা গিয়ে সোফায় বসে গাঁ এলিয়ে দিলেন।
ক্লান্ত সুরে শুভ্র ভাই আমাকে বললেন-
— এক গ্লাস পানি দে তো অনন্য। তাড়াতাড়ি দিস প্লিজ….
ওনাকে দেখে ক্লান্ত লাগছিল তাই আর না করতে পারলাম না। কোনো কথা না বলে চুপচাপ রান্নাঘরে গিয়ে আম্মুকে বললাম-
— মা শুভ্র ভাই আসছে আন্টি হয়তো বাসায় নেই। উনি খুব ক্লান্ত তাই বললেন এক গ্লাস পানি দিতে তুমি যাও পানি দিয়ে আসো।
আম্মু এক গ্লাস লেবুর শরবত বানিয়ে আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললেন-
— যা তুই নিয়ে যা আমি কাজ করছি। শুভ্রকে বল আমি আসছি।
আম্মু আমাকে প্রায় জোড় করেই পাঠিয়ে দিলেন শরবত নিয়ে যাওয়ার জন্য। কি আজব ব্যাপার যার সাথে কথা বলবো না বলে শপথ করলাম বার বার তার সামনেই পরতে হচ্ছে।
আমি ড্রয়িং রুমে গিয়ে দেখি শুভ্র ভাই চোখ বন্ধ করে সোফায় আধশোয়া হয়ে আছে। আমি সোফার পাশের টেবিলে গ্লাসটা রাখতে রাখতে বললাম-
— আম্মু শরবত পাঠিয়েছে আপনার জন্য আর আপনাকে বসতে বলেছে আম্মু আসছে একটু পর।
গ্লাসটা রেখে চলে যাবো। হঠাৎই শুভ্র ভাই হেচকা টান দিয়ে আমাকে সোফায় বসিয়ে দিলেন। উনি উঠে সোজা হয়ে শরবত নিয়ে একটু খেয়ে কপালের ঘাম গুলো মুছতে মুছতেই বললেন-
— জানিস অনন্য আমার শাশুড়ী মা খুব ইন্টেলিজেন্ট। আমি কখন কি চাই না চাই সব কিছুই আগে থেকে বুঝে যায়। এমন শাশুড়ী ক’জনের থাকে বল।
আমি বেশ খানিকটা অবাক হয়ে বললাম-
— আপনি বিয়ে করলেন কবে?? শাশুড়ীই বা আসলো কোথা থেকে?
শুভ্র ভাই আবার সোফায় এলিয়ে বেশ আরাম করে বসে বললেন-
— বিয়ে এখন হয়নি কিন্তু ভবিষ্যতে তো হবে তাই না। আর শাশুড়ী তো আছেই ওনার মেয়েকে বিয়ে করার আগে থেকেই আমাকে কতো ভালোবাসে খেয়াল রাখে।
আমি কিছুটা বিরক্তি নিয়ে বললাম-
— সেটা না হয় বুঝলাম কিন্তু হঠাৎ করে আমাকে এসব বলছেন কেন?
শুভ্র ভাই সোজা হয়ে বসে টিভির রিমোট নিয়ে টিভির চ্যানেল পাল্টাতে পাল্টাতে বললেন-
— আমার শাশুড়ীর প্রসংশা তোর কাছে না করলে আর কার কাছেই বা করবো!!
আমি ওনার কথার মানে কিছুই বুঝলাম না তাই চুপ করে ওনার দিকে তাকিয়ে আছি। শুভ্র ভাই আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন-
— কিছু বুঝিস নি???
আমি ডানে বামে মাথা নাড়ালাম মানে আমি বুঝিনি। শুভ্র ভাই আমার মাথায় আস্তে একটা টোকা দিয়ে বললেন-
— তোর এই ছোট্ট মাথায় এতো কিছু ঢুকবে না বাদ দে।
আমি কিছু বলার আগেই আম্মু এসে পরলেন। শুভ্র ভাইয়ের পাশে বসে ওনার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন-
— ইসস কি হাল হয়েছে তোর শুভ্র। তোর মা-র হয়তো আসতে সময় লাগবে তুই যা শাকিলের রুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে ওর আলমারি থেকেই কিছু একটা পরে নে। আর আজ রাতে না হয় এখানেই থেকে যা।
শুভ্র ভাই এক হাতে আম্মুকে জরিয়ে ধরে বললেন-
— আন্টি তুমি কতো ভালো। আমাকে কত্তো ভালোবাসো কিন্তু তোমার মেয়েটা এমন হলো কি কিরে!! আমাকে সহ্যই করতে পারে না আর ভালোবাসা তো দূরের কথা।
আম্মু মুচকি হেসে শুভ্র ভাইয়ের পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন-
— হয়েছে হয়েছে এখন এতো কথা না বলে যা ফ্রেশ হয়ে আয় কিছু খাবি।
আমি সোফায় বসে অসহায়ের মতো ওদের দুজনের কাহিনি দেখছি। আমার মতো এতো বড় জলজ্যান্ত একটা মানুষ যে এখানে বসে আছে তার কোনো খেয়ালই হয়তো ওনাদের নেই।
শুভ্র ভাই উঠে চলে গেলেন। আর আমি এখনও স্তব্ধ হয়ে বসে আছি আগের জায়গায়। আমার আপন মা-ও এই লোকটার জন্য আমাকেই পাত্তাই দিলো না!!!
—————
ডাইনিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শুভ্র সাহেবের হাজার খানেক হুকুম একের পর এক পালন করেই যাচ্ছি। এটা দে, ওইটা দে একটু পর পর বলেই যাচ্ছে। আম্মু কড়া গলায় আমাকে হুকুম দিয়ে গেছেন ওনার আদরের শুভ্রকে যেন আমি দাঁড়িয়ে থেকে সব কিছু ঠিক মতো করে খেতে দেই। আর শুভ্র ভাইয়ের উদ্দেশ্যে বলে গেছেন আমি উলটা পালটা কিছু করলেই যেন শুভ্র ভাই আম্মু কে ডাক দেয়। তাই বাধ্য হয়ে এই অসভ্য লোকের সব কথা মেনে চলছি চুপচাপ। উনি যে ইচ্ছে করেই আমাকে বিরক্ত করার জন্য একের পর এক হুকুম দিয়ে যাচ্ছে তা আমি বেশ ভালো করেই টের পাচ্ছি।
রাত প্রায় নয়টা বাজে হয়তো। ড্রয়িং রুমের সোফায় বসে আড্ডা দিচ্ছে আর টিভি দেখছে শুভ্র ভাই, আম্মু আর ভাইয়া। আমি শুধু নামমাত্রই বসে আছি এখানে। শুভ্র ভাইয়ের প্রতি সবার এতো আদিক্ষেতা আমার একদম অসহ্য লাগছে।
হঠাৎ করেই শুভ্র ভাই দাঁড়িয়ে টিশার্টের কলার ঠিক করতে করতে আম্মুকে উদ্দেশ্য করে বললেন-
— আন্টি আমি অনন্য কে নিয়ে বাহির থেকে একটু হেটে আসি। এভাবে বসে থেকে আমার পা ব্যথা করছে।
আম্মু কিছু বলার আগেই আমি ফটাফট করেই বলে ফেললাম-
— আমি যেতে পারবো না আপনি বরং ভাইয়াকে নিয়ে যান।
শুভ্র ভাই আমার দিকে রাগী চোখে তাকিয়ে বললেন-
— শাকিল মাত্রই বাহির থেকে এসেছে। ও হয়তো ক্লান্ত এখনই আবার বাহিরে যেতে পারবে না আমার সাথে।
ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন-
—কিরে শাকিল যেতে পারবি আমার সাথে??
ভাইয়া সোফায় পুরো শরীর এলিয়ে দিয়ে বললেন-
— না না শুভ্র ভাই আমি এখন আবার যেতে পারবো না। আপনি অনুকেই নিয়ে যান।
আমি শুভ্র ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বললাম-
— শুভ্র ভাই আপনি না হয় একা একাই যান হেটে আ….
পুরো কথা শেষ করার আগেই আম্মু ধমকের সুরে বললেন-
— এই অনু তোর কি সমস্যা বল তো!! শুভ্র কিছু বলেই সব সময় মুখে মুখে তর্ক করা শুরু করে দিস। ছেলেটা যখন বলছে তাহলে চুপচাপ যা ওর সাথে। শুভ্র কি তোকে খেয়ে ফেলবে নাকি!!
আম্মুর কথায় আমি চুপসে গেলাম। আর শুভ্র ভাই আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসছেন।
———————
রাস্তায় দিয়ে চুপচাপ হেঁটে চলছি প্রায় দশ মিনিট ধরে। শুভ্র ভাই আমার পিছনেই হাঁটছে ওনার সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করছে না তাই আমি দ্রুত পায়ে সামনের দিকে হেঁটে যাচ্ছি। শুভ্র ভাই দৌঁড়ে আমার সামনে এসে দাড়িয়ে বললেন-
— অনন্য তুই কি এখানে হাঁটার প্রতিযোগিতা করছিস নাকি আমার সাথে!!
আমি কিছু না বলে পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছি তখনই শুভ্র ভাই খপ করে আমার ধরে ফেললেন। আমাকে দিকে তাকিয়ে কিছুটা অসহায় কন্ঠে বললেন-
— এমন করছিস কেন আমার সাথে অনন্য!!
আমি এবারও কিছু না বলে চুপ করে রইলাম। হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করছি বার বার। শুভ্র ভাই এবার প্রচন্ড রেগে আমার হাত আরও শক্ত করে ধরে হুংকার দিয়ে বললেন-
— সমস্যা কি তোর কথা বলছিস না কেন??
#মুগ্ধতায়_তুমি
#পর্বঃ১৪ ( Extra part)
#Saiyara_Hossain_Kayanat
— “সমস্যা কি তোর কথা বলছিস না কেন আমার আমার সাথে?”
শুভ্র ভাই আমার হাত খুব শক্ত করে চেপে ধরায় আমি ব্যথায় মৃদুস্বরে আর্তনাদ করালাম। শুভ্র ভাই সাথে সাথেই আমার হাত ছেড়ে দিলেন। নিজের রাগ কন্ট্রোল করে কিছুটা শান্ত কন্ঠে বললেন-
— “আমার প্রতি তুই খুব বিরক্ত তাই না অনন্য?? আচ্ছা যা আজ থেকে আমি আর কখনো তোকে বিরক্ত করবো না।”
শুভ্র ভাইয়ের কথা শুনে কিছুই বললাম না। ওনার কথা শুনে কেন যেন একটু একটু খারাপ লাগছে কিন্তু পাত্তা দিলাম না আমার জন্যই ভালো শুভ্র ভাই আমাকে আর বিরক্ত করবে না। ওনার জন্য আম্মুর কাছেও বকা খেতে হবে না।
শুভ্র ভাই বাড়ির পথে হাঁটা শুরু করলেন চুপচাপ। সারা রাস্তা একটাও কথা বলেনি আর আমিও কিছু বলিনি।
——————
আজ এক সপ্তাহ হলো শুভ্র ভাই আমার সাথে ঠিক মতো কথা বলেন না। আমাকে সব সময় অনন্যা বলেই ডাকে এখন। তবে যতই আমাকে এড়িয়ে চলুক না কেনা কেন ওনার হাজার ব্যস্ততা থাকলেও উনি আমাকে কলেজে নিয়ে আসেন আবার নিয়ে যান। কিন্তু সব সময়ই চুপচাপ থাকেন প্রয়োজন ছাড়া কোনো কথাই বলেন না আমার সাথে। আজ শুভ্র ভাই ভার্সিটি থেকে আমাকে নিতে আসেনি। শুভ্র ভাই তো কখনো এমন করেন না। হয়তো ভুলে গেছেন আমাকে বাসা পৌঁছে দেওয়ার কথা। কিন্তু উনি যতই ব্যস্ত থাকুক আমার কথা তো ভুলে যান না। কেন যেন আজ খুব কষ্ট হচ্ছে ওনার এই অবহেলা আমার একদমই সহ্য হচ্ছে না। আমি অভ্যস্ত হয়ে পরেছি শুভ্র ভাইয়ের ধমকানো, ওনার কেয়ার আর আমাকে বিরক্ত করা সব কিছুর প্রতি। এতোদিন শুভ্র ভাই আমার সাথে ঠিক মতো কথা না বললেও অন্তত ওনাকে দেখতে পারতাম কিন্তু আজ তা-ও হলো না। শুভ্র ভাইয়ের কথা মাথা থেকে বের করতেই পারছি না। এই কিছুদিনে আমি বুঝে গেছি আমি শুভ্র ভাইয়ের প্রতি দূর্বল হয়ে পরেছি খুব খারাপ ভাবেই দূর্বল হয়েছি। উনি আমার অভ্যাসে পরিণত হয়ে গেছেন।
প্রায় এক ঘন্টা দাঁড়িয়ে থেকে শুভ্র ভাইয়ের জন্য অপেক্ষা করার পর মিমশির জোড়াজুড়ি তে একা একাই বাসায় এসে পরলাম। শুভ্র ভাইকে ফোন দিয়েছিলাম কিন্তু রিসিভ করেনি। বাসায় এসে কারও সাথে কোনো কথা না বলে নিজের রুমে এসে দরজা লাগিয়ে দিলাম। পা ব্যথা করছে খুব মাথাটাও প্রচন্ড যন্ত্রণা করছে। এই কয়দিন ভালো করে ঘুম হয়নি তবে আজ আমার খুব ঘুম পাচ্ছে এখন। কোনো রকম গোসল করে এসেই বিছানা শুয়ে পরলাম।
সন্ধ্যায় আম্মুর চেচামেচির শব্দে ঘুম ভাঙলো। সারাদিন কিছু না খেয়ে রুম আঁটকে ঘুমাচ্ছি তাই বকাবকি করছেন দরজার বাহির থেকে। আমি আস্তে আস্তে উঠে দরজা খুলে আবার এসে শুয়ে পরলাম। শরীর খুব দূর্বল লাগছে তাই শোয়ার সাথে সাথেই আবার চোখ লেগে গেলো।
——————
ঘুমের মধ্যে মনে হচ্ছে কেউ আমার কপালে হাত রেখেছে। চোখ মেলে তাকিয়ে দেখলাম শুভ্র ভাই আমার বিছানার পাশেই একটা চেয়ারে বসে আছে এক হাত আমার কপালে দিয়ে। তার পাশেই ভাইয়া আর আম্মু দাঁড়িয়ে আছে। আমাকে তাকাতে দেখে ভাইয়া উত্তেজিত হয়ে বললো-
— “এতক্ষন পর তোর হুশ আসলো অনু। এখন কেমন লাগছে??”
আমি ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে আস্তে আস্তে বললাম-
— “কেন কি হয়েছে আমার?? আমার তো এমনিতেই একটূ দুর্বল লাগছে।”
— “কি বলিস তুই শুধু দূর্বল লাগছে?? সেই কখন থেকে জ্বরে বেহুশ হয়ে না খেয়ে পরে আছিস কোনো কিছুর কি খেয়াল তোর আছে!! নিজের একটু যত্ন করতে পারিস না তুই!! ভেজা চুল নিয়ে কেউ ঘুমায় গাধি??”
ভাইয়া আম্মুর দিকে তাকিয়ে আবার বললো-
— “আম্মু যাও অনুর জন্য স্যুপ রান্না করে নিয়ে আসো অনু সারাদিন না খেয়ে আছে । ১২টা বেজে গেছে প্রায়।”
আম্মূ সাথে সাথেই চলে গেলেন আর আমি শোয়া থেকে উঠে বিছানায় হেলান দিয়ে বসে ভাইয়ার কথা শুনে অনেকটা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম-
— ” এখন রাত ১২ টা বাজে??? আমি এতক্ষন ঘুমিয়ে কাটিয়েছি???”
— “জ্বি গাধা একটা। আচ্ছা তুই থাক আমি একটু আসছি।”
ভাইয়া চলে যেতেই মনে পরলো শুভ্র ভাই আমার পাশেই বসে আছে। এতক্ষন ওনার দিকে একটুও তাকাইনি। শুভ্র ভাইয়ের প্রতি অভিমান জমেছে অনেক। এতোদিন ধরে আমার সাথে ঠিকঠাক কথা বলেন না। আর আজ তো আমাকেই ভার্সিটি থেকে আনতেই যায় নি। আমি আর কথাই বলবো না ওনার সাথে।
শুভ্র ভাই আমার দিকে তাকিয়ে শান্ত গলায় বললেন-
— “সরি তোকে আজ ভার্সিটি থেকে নিয়ে আসতে পারিনি। হঠাৎ করেই একটা মিটিং পরে গেছিল তাই তোর ফোনও রিসিভ করতে পারিনি। মিটিং শেষে আমি তোকে কল দিতে চেয়েছিলাম কিন্তু ফোনের চার্জ না থাকায় ফোন অফ হয়ে গেছিলো।”
আমি কিছুই বললাম না স্থির হয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে বসে আছি। শুভ্র ভাই আবার একটু পর নরম গলায় বললেন-
— “একদিনে নিজের এই হাল কিভাবে করলি অনন্যা?”
আমি কোনো কথা বললাম না অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে নিলাম অভিমানে।
— “কিরে কথা বলবি না? রাগ করেছিস?? কিন্তু কেন? তুই তো এমনটাই চেয়েছিলি তাই না অনন্যা?”
এবার আমি আর নিজেকে সামলাতে পারলাম না। শুভ্র ভাইয়ের প্রতি সব রাগ অভিমান ভুলে কান্নায় ভেঙে পরলাম। হঠাৎ করে আমাকে কান্না করতে দেখে শুভ্র ভাই আমার মুখ ঘুরিয়ে ওনার দিকে করে উত্তেজিত হয়ে কপালে গালে হাত দিয়ে অস্থির কন্ঠে জিজ্ঞেস করছেন-
— “কিরে অনন্য বেশি খারাপ লাগছে?? এভাবে কান্না করছিস কেন? জ্বর তো কমে গেছে এখন… কি হয়েছে বল আমাকে।”
আমি ওনার হাত ঝাড়া দিয়ে সরিয়ে দিলাম আমার কপাল থেকে। হিচঁকি তুলতে তুলতে বললাম-
— “ধরবেন না আপনি আমাকে। আপনি আসলেই খুব খারাপ মানুষ শুধু শুধুই আমাকে কষ্ট দেন। কতদিন ধরে আমাকে ইগ্নোর করছেন আর আজ তো আমাকে কতোক্ষন অপেক্ষা করিয়েছেন।”
এতোটুক বলেই আবার চুপচাপ চোখের পানি ফেলছি অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে। শুভ্র ভাই চেয়ার থেকে উঠে বিছানায় আমার পাশে বসলেন। আমার দুই বাহু ধরে ওনার দিকে ঘুরিয়ে বসিয়ে দিলেন। আমি এখনও নিচের দিকে তাকিয়ে চোখের পানি ফেলছি। উনি আমার মাথা উঁচু করে আমার চোখের পানি মুছে দিতে দিতে বললেন-
— “আমার প্রতি এতো রাগ, এতো অভিমান তোর অনন্য!! কিন্তু কেন? আমি তোকে বিরক্ত করিনি তাই!! আমি তোকে এই ক’দিন ধমক দেইনি বলে!! আর আজ তোকে ভার্সিটি থেকে আনতে যাইনি তাই?? কিন্তু তুই তো এসবের প্রতি খুব বিরক্ত ছিলি অনন্য।”
আমি নিজেকে সামলে কান্না থামিয়ে ওনাকে দু’হাতে ধাক্কা দিয়ে রাগী কন্ঠে বললাম-
— “কথা বলবেন না আপনি আমার সাথে যান আমার রুম থেকে বেরিয়ে যান।”
শুভ্র ভাই একটা বিশ্বজয়ী হাসি দিয়ে বললেন-
— “সত্যি চলে যেতে বলছিস আমাকে??”
আমি কিছু বললাম না চুপ করে বসে আছি। শুভ্র ভাই আবার বলে উঠলেন-
— “ওকে তুই যখন কিছু বলছিস না তাহলে চলে যাচ্চি আমি তুই রেস্ট নে।”
শুভ্র ভাইয়ের কথা শুনে ওনার দিকে তাকালাম। শুভ্র ভাই আমার দিকে এগিয়ে এসে কানে ফিসফিস করে বললেন-
— “অনেক বড় ভুল করলে অনন্যময়ি নিজেকে আমার কাছে ধরা দিয়ে। এখন চলে যাচ্ছি কিন্তু আজকের পর থেকে আর কখনো আমার কাছ থেকে রেহাই পাবে না তুমি। একবার এই শুভ্রের খাচায় বন্দী হলে সেখান থেকে বের হওয়া তার জন্য নিষিদ্ধ। এই মুগ্ধ প্রেমিককে তার মুগ্ধতার কাছ থেকে দূরে সরানোর ক্ষমতা এখন আর কারও নেই।”
এই কথা বলে উনি আমার এক হাত ধরে হাতের উল্টো পিঠে ওনার ঠোঁট স্পর্শ করে দিয়েই দ্রুত পায়ে হেঁটে চলে গেলেন।
আমি স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে আছি ওনার যাওয়ার দিকে। কি বলে গেলেন এইসব। কিসের খাচা! কিসের কি বললেন? আর আমার হাতে কি উনি চুমু দিলেন????
হাতের দিকে তাকিয়ে ওনার কথা ভেবে পরক্ষণেই লজ্জায় লাল হয়ে গেলাম।
আম্মু খাবার নিয়ে এসে আমাকে এভাবে দেখে জিজ্ঞেস করলো-
— “কিরে মুখ এমন লাল হয়ে আছে কেন! আবার জ্বর বেড়েছে নাকি?”
আমি অপ্রস্তুত হয়ে আমতা-আমতা করে বললাম-
— “জ্ব্বরের জন্যই হয়তো এমন হয়েছে।”
আম্মু আর কিছু না বলে আমাকে খাইয়ে দিলেন। আর সাথে হাজার খানেক বকাবকি ও শুনিয়ে দিলেন।
চলবে….
(