#মুগ্ধতায়_তুমি
#পর্বঃ১৬
#Saiyara_Hossain_Kayanat
মাথা নিচু করে কান্না করছি আচমকাই শুভ্র ভাই উচ্চস্বরে হাসতে লাগলেন। আমি মাথা তুলে তার দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি। বোঝার চেষ্টা করছি হঠাৎ করে ওনার এভাবে হাসির কারন কি হতে পারে। ওনার এমন আচরণ দেখে আমার কান্না এমনিতেই থেমে গেছে চোখে মুখে এখন বিস্ময়ের ছাপ ফুটে উঠেছে আমার। শুভ্র ভাই আমার দিকে তাকিয়ে আমার পাশে এসে বসলেন।
হাসি থামিয়ে কিছু সময় চুপ থেকে শান্ত গলায় বললেন-
—” আজ তোকে কিছু কথা বলি অনন্য মনোযোগ দিয়ে শুনবি ঠিক আছে??”
আমি উপর নিচ মাথা ঝাকালাম। শুভ্র ভাই আমার দিকে তাকিয়ে বলতে শুরু করলেন-
—” যখন আমার বয়স ছয় তখন আম্মু আমাকে নিয়ে হসপিটালে নিয়ে গেছিলো আন্টি অসুস্থ তাই। সেখানে যাওয়ার কিছুক্ষন পরেই তোর জন্ম প্রথম প্রথম অনেক খুশি হয়েছিলাম। আব্বু ও তোদের ফ্ল্যাটের সাথেই আমাদের ফ্ল্যাট কিনে ওখানে সিফট হয়ে গেলেন। তোকে সারাক্ষণ আমার কাছেই রাখতাম। কিন্তু আস্তে আস্তে খেয়াল করলাম তোকে সবাই অনেক বেশি আদর করে ভালোবাসে কারন আমাদের রিলেটিভ দের মধ্যে এক মাত্র মেয়ে সন্তান হলি তুই। তোর প্রতি সবার এতো গুরুত্ব দেখে সেটা আমার সহ্য হতো না। তাই তোকে আমার অসহ্য লাগতো সব সময় বকা দিতাম ধমক দিতাম।”
এইটুকু বলে শুভ্র ভাই একটু থামলেন আমি আগ্রহের দৃষ্টিতে তার দিয়ে তাকিয়ে আছি। বেশ আগ্রহ নিয়ে বললাম-
—” তারপর কি হলো বলেন।”
শুভ্র ভাই একটু মুচকি হেসে আবার বলা শুরু করলেন-
—” যখন তোর দশ বছর তখন রাগের মাথায় তোকে একটা থাপ্পড় দিয়ে ছিলাম। আব্বু আম্মু ওইদিন আমাকে অনেক বকা দিয়েছিল। এমনকি অন্য বাসায় সিফট করেছিলেন খুব অবাক হয়েছিলাম। শুধু মাত্র একটা থাপ্পড়ের জন্য এতো কিছু!! আম্মুকে অনেক বার জিজ্ঞেস করার পর বললেন – “শুভ্র তুই এখন অনেকটাই বড় হয়েছিস তাই তোর কাছে লুকিয়ে রেখে লাভ নেই। আমরা দুই পরিবারের মানুষ অনেক আগে থেকে ঠিক করে রেখেছিলাম তুই আর অনন্য বড় হলে তোদের বিয়ে দিব। কিন্তু দিন দিন তুই মেয়েটার সাথে বাজে ব্যবহার করা বাড়িয়ে চলছিস। আর এবার তো থাপ্পড়ই মেরে দিলি। এখনই এরকম হলে যে পরে তোর ব্যবহার আরও খারাপ হবে না তার তো ঠিক নেই। তাই বাধ্য হয়ে ওই বাসা থেকে চলে আসলাম।” আম্মুর কথায় অনেক রেগে গিয়েছিলাম তোর মতো একটা বাচ্চা মেয়েকে বিয়ের কথা বলছিল তাই। রাগারাগি বেশি করার ফলে আব্বু ঠিক করলেন আমাকে বিদেশে পাঠিয়ে দিবেন আর তাই করলেন উনি। তবে যাওয়ার আগে আব্বু বলেছিলেন- “নিজের রাগ কন্ট্রোল করতে পারলেই দেশে আসবে তার আগে না।”
এরপর তোর প্রতি অনেক রাগ হচ্ছিলো আমার। শুধু মাত্র তোর জন্যই এমন হয়েছে বলে আমি মনে করতাম।”
শুভ ভাই কথা থামিয়ে আকাশের দিকে দৃষ্টি দিলেন। আর আমি বিস্ফোরিত নয়নে তাকিয়ে আছি ওনার দিকে। কি বলছেন এসব শুভ্র ভাই!! আমাদের বিয়ে ঠিক সেই ছোট্ট বেলা থেকে!!! শুভ্র ভাই একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন-
—” বিদেশ যাওয়ার পর এসব প্রায় ভুলেই গিয়েছিলাম। স্বাভাবিক ভাবেই জীবনযাপন করছিলাম। প্রায় চার বছর পর অর্ক আর শাকিল কিভাবে যেন আমাদের বিয়ের কথা জেনে গেল। মজা করেই তোর একটা ছবি দিয়ে বলেছিলো- “শুভ্র দেখ তোর বউ।” তখন নিজের অজান্তেই মনের ভিতর কেমন যেন আলাদা একটা অনুভূতি সৃষ্টি হলো। তুই আর আগের মতো পিচ্চি নেই বেশ বড়ই দেখাচ্ছিলো ছবিতে। তোর ছবিটা দেখে দেখে ভাবতাম এটা আমার বউ!! ভার্সিটিতে কোনো মেয়ে প্রপোজ করলে মনে মনে একটা কথাই আসতো “আমার তো বউ রেডি আছে”। সব মেয়েদের থেকে নিজেকে দূরে রাখতাম। ধীরে ধীরে আমার এই ভাবনার মাঝেই তোর প্রতি অনেকটাই দূর্বল হয়ে পরেছিলাম। অর্ক আর শাকিলের কাছ থেকে তোর সব খোঁজ খবর নিতাম প্রতিদিন। এভাবেই এগারোটা বছর চলে গেল। দেশে আসার সময় সবাইকে বলে দিয়েছিলাম তোকে যেন এসব ব্যাপারে কেউ না জানায়। তুই নিজে থেকে যেদিন তোর মনে আমাকে জায়গায় দিবি ওইদিনই সব বলবো ভেবেছিলাম। আমার মনে হলো আজ হয়তো সেই সময় এসে পরেছে অনন্য তাই বলে দিলাম সব।”
আমি স্তব্ধ হয়ে গেছি ওনার সব কথা শুনে। এতো কিছু আমার অগোচরে ঘটে যাচ্ছে আর আমি একটু টের ও পেলাম না!! আসলেই আমি একটা বোকা হাদারাম। নির্বাকের মতো তাকিয়ে আছি শুভ্র ভাইয়ের দিকে। কোনো কথা বলছি না মানে কি বলবো কিছুই বুঝে উঠতে পারছি না। শুভ্র ভাই আমাকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে মাথায় একটা চাপড় মেরে বললেন-
—” কিরে অনন্য এভাবে তাকিয়ে আছিস কেন?? কিছু বল..”
আমি হঠাৎ করেই রেগেমেগে চোখ গরম করে বললাম-
—” আমার সাথে বাজে ব্যবহার করার জন্য জন্য এতো কিছু হলো তবু্ও নিজের রাগ কন্ট্রোল করতে পারেনি আপনি। সব সময়ই তো ধমকিয়ে কথা বলেন রাগ দেখান।”
শুভ্র ভাই আমার কথায় মুচকি হাসলেন। তারপর শান্ত গলায় বললেন-
—” আমি ইচ্ছে করেই তোর সাথে বেশি করে রাগ দেখিয়ে কথা বলতাম। কারন আমি চাই তুই আমার সব রাগ আর ধমকানো সহ্য করেই আমাকে নিজের মনে জায়গায় দিস। বুঝলি অনন্য??”
আমি একটু ভাব নিয়ে বললাম-
—” হুম সবই বুঝলাম।”
শুভ্র একটু চুপ থেকে হুট করেই আমার দিকে তাকিয়ে বললেন-
—” বিয়ে করবি আমায় অনন্য?”
আচমকা শুভ্র ভাইয়ের এই কথা শুনে আমি বিষম খেলাম। অবাকের দৃষ্টিতে চোখ গোল গোল করে ওনার দিকে তাকালাম। শুভ্র ভাই আবার নিশ্চুপ হয়ে গেলেন আমার থেকে দৃষ্টি সরিয়ে আকশের দিকে দৃষ্টি দিলেন। বেশ কিছু সময় চুপচাপ কাটিয়ে দেওয়ার পর শুভ্র ভাই দোলনা থেকে উঠে দাড়ালেন। একটু সামনে গিয়ে আবার পিছন ফিরে আমার কাছে এসে মাটিতে বসে পরলেন। আমার পা ধরে কিছু একটা করছেন আমি বার বার পা সরাতে চাইলেই উনি এক ধমক দিয়ে বললেন-
—” কি সমস্যা তোর এমন করছিস কেন আমি কি তোর পা কেটে নিয়ে যাবো নাকি!! আরেকবার পা নাড়িয়ে দেখ একদম পা ভেঙে দিব।”
ওনার ধমক শুনে আমি চুপসে গেলাম নিচের দিকে তাকিয়ে দেখলাম শুভ্র ভাই আমার পায়ে একটা পায়েল পরিয়ে দিচ্ছেন। পায়েল পরানো শেষে উনি দোলনায় আবার আমার পাশে বসলেন। আমার সামনে আসা চুল গুলো কানের পিছনে গুজে দিয়ে কানে ফিসফিস করে বললেন-
—” তোমার মুগ্ধতায় আমি অনেক আগে থেকেই নিজেকে পোড়াচ্ছি অনন্যময়ি। আমার সকল মুগ্ধতায় তুমি শুধুই তুমি অনন্যময়ি। আর শুধু মাত্র তোমার মনে নিজের জন্য একটু জায়গা করার অপেক্ষা করছি আমি। কখনো ভালোবাসি বলিনি আর বলতেও চাই না আমি শুধু চাই তুমি অনুভব করো তোমার প্রতি আমার সকল অনুভূতি। মানুষ বলে ভালোবাসার কোন কারন হয় না, স্বার্থ হয় না তবে আমি তো তোমাকে পাওয়ার আশায় ভালোবাসতে চাই। তোমাকে এই শুভ্রের বুকের খাচায় বন্দী করে রাখতে চাই সারাজীবন এই স্বার্থে ভালোবাসতে চাই। যৌবন পেরিয়ে বার্ধক্য এক সাথে কাটাতে চাই তোমার মুগ্ধ প্রেমিক হয়ে। এতো এতো কারন আর স্বার্থ আমার মধ্যে তবে কি আমি তোমায় ভালোবাসি না অনন্যময়ি!!”
শুভ্র ভাই থেমে গেলেন একটু দূরে সরে বসলেন। শুভ্র ভাইয়ের বলা প্রতিটা শব্দ যেন এক একটা অনুভূতির বহিঃপ্রকাশ। ওনার বলা কথা গুলো শুনে আমার ভিতর এক আলাদা শিহরণ বয়ে চলেছে। লজ্জায় আমি যেন জমে বরফ হয়ে গেছি কোনো প্রতিত্তোর করছি না শব্দহীন হয়ে বসে আছি।
শুভ্র ভাই দাঁড়িয়ে আমার সামনে আসলেন আমি মাথা উঁচু করে তার দিকে তাকালাম। ওনার ঠোঁটের কোণে মন ঘায়েল করা এক হাসি লেগে আছে। অগোছালো চুলগুলো হাত দিয়ে আলতো ছুঁয়ে ঠিক করলেন। পকেটে হাত দিয়ে একটা শুভ্র রঙের গোলাপ বের করে আমার দিকে এগিয়ে দিলেন। শীতল কণ্ঠে বললেন-
—”বিয়ে করবি এই মুগ্ধ প্রেমিককে? না-কি এখনো বলবি তুই অন্য কাউকে বিয়ে করতে চাস না??”
ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছি শুভ্র ভাইয়ের দিকে। শুভ্র ভাই আমার হাত ধরে উনি নিজেই আমার হাতে গোলাপটা ধরিয়ে দিয়ে বললেন-
—” সমস্যা নেই তুই বিয়ে না করলেও এই মুগ্ধ প্রেমিক তার মুগ্ধতাকে ঠিকই বিয়ে করে নিবে দেখে নিস।”
এই কথা বলেই আমার হাত উঁচু করে তার ঠোঁটের স্পর্শ দিলেন। পরক্ষণেই আমি লজ্জা পেয়ে মাথা নিচু করে ফেললাম। শুভ্র ভাই এবার হাসতে হাসতে বললেন-
—” জানিস অনন্য তুই কোনো উত্তর না দিলেও তোর এই লজ্জায় নুয়ে পরা মুখটাই সব বলে দেয়। এই শুভ্র মুখের কথায় নয় অনুভব করতেই বেশি পছন্দ করে।”
কি সাংঘাতিক লোক উনি!! বার বার আমাকে লজ্জায় ফেলছেন ইচ্ছে করে। নাহ… এই লোকের সামনে বেশিক্ষন থাকা যাবে না। আমি নিজেকে সামলিয়ে শুভ্র ভাই এর থেকে হাত ছাড়িয়ে একপ্রকার দৌড়ে নিচে চলে আসলাম।
চলবে…..
(রিচেক করা হয়নি তাই ভুল ত্রুটি হলে ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। আর ভালো লাগলে অবশ্যই রেসপন্স করবেন। ধন্যবাদ আর ভালোবাসা ❤️)