#মুহূর্তে
পর্ব-২৫
নিলুফার ইয়াসমিন ঊষা
মুহূর্তটা উদাসীন ছিল। কিন্তু কবিতার এত সুন্দর দিনে উদাসীন মুহূর্তটা ভালো লাগলো না। সে চায় না তাহিরার জীবনের সবচেয়ে সুন্দর দিনটায় সে কান্না করুক। তাই মশকরা করে বলল, “আপি তুমি চিন্তা করো না, আজ সারারাত তোমরা একে অপরের সাথেই কাটাবে। কিন্তু বিয়ের আগে এইসব, তাই ছোট ভাই বোনদের সামনে… ছিঃ ছিঃ ছিঃ।”
সকলে হেসে দিল কবিতার কথা ধরণ দেখে। তাহিরাও লজ্জা পেয়ে সাথে সাথে ধ্রুবকে ছেড়ে দিল। কবিতা সেখানেই থামলো না, আদেশ করে পলাশকে বলল, “এই’যে হাদারাম ভাইয়া আপনি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কি দেখছেন? বরকে টাকা না দিয়ে সেন্টারে ঢুকতে দিলেন কেন? বাইর করেন এখনই।”
“যো হুকুম আপু।”
পলাশ এসে ধ্রুবকে বাহির করতে নিলেই ধ্রুব বলে, “তুই না বরপক্ষ? তাহলে কন্যাপক্ষের কথা মানছিস কেন? এতক্ষণ ধরে অনুষ্ঠানের সকল আয়োজন আমরা করলাম এখন আমাদেরকে বের করে আমার থেকেই টাকা নিবে। শখ কত?”
পলাশ মাথা চুলকে কবিতাকে বলে, “আসলে আপু আমি তো বরপক্ষের তাই না?”
“কীসের বরপক্ষের? আপনি না আমার ভাই?”
ধ্রুব বলে, “ও তীর্থের ভাই আগে। তীর্থ কিছু তো বল।”
তীর্থ ফোনে ব্যস্ত ছিল। ধ্রুবর কথা শুনে সে একটু বিরক্ত হলো। তার আবার এইসব হাসি-ঠাট্টা মোটেও ভাল্লাগেনা। গেট ধরলে আরও আঁধাঘন্টা এখানে দাঁড়িয়ে এইসব বকবকানি শুনতে হবে তাই সে আদেশের সুরে বলল, “পলাশ ভেতরে চল।”
“জ্বি ভাই।”
পলাশ ভেতরে ঢুকতে নিলেই কবিতা আবারও বাঁধা দিলো, “জ্বি ভাই মানে কী? আমার কথা বেশি না তোমার তীর্থ ভাইয়ের।”
“তীর্থ ভাইয়ের।”
ফিক করে হেসে দিলো ধ্রুবর বন্ধুরা। অপমানে কবিতার মুখ থমথমে হয়ে যায়। তবুও সে হার মানার মানুষ তো না। সে একগাল হেসে বলে, “আর তোমার তীর্থ ভাই আমার কথা শুনবে।”
ধ্রুব আর তীর্থের বন্ধুরা এইবার শব্দ করে হেসে দিলো। একজন বলল, “তীর্থ ভাই কারও কথা শুনে না ভাবি। আগে প্রথম প্রথম প্রেমে পড়ছিলো তাই শুনতে হতো কিন্তু এখন তো আপনি তার বউ, তাই হারানোরও ডর নাই। শুনবে না একদম।”
কবিতা তাদের কিছু বলে না। তীর্থের কাছে এসে তার হাত প্রথমে মিষ্টি করে বলে, “তুমি আমার কথা শুনবে না?”
বাচ্চাদের মতো মুখ করে বলে কবিতা। তাকে দেখলে এই মুহূর্তে যে কারও মনই গলে যাবে। কিন্তু তীর্থের পিছন থেকে তার বন্ধুরা বলে, “ভাই একদম গলবেন না। আমগো ইজ্জত মাটিতে মিশে যাইব।”
তীর্থ একপলক তাদের দুই তাকিয়ে আবার তাকায় কবিতার দিকে। যদিও কবিতার কিউটনেস দেখে এক মুহূর্তের জন্য তীর্থ গলে গেলেও সে নিজেকে শক্ত রেখে বলল, “একদম না। আমাদের একটা ব্রো-কোড আছে।”
“তোমাদের ব্রো-কোডের গুষ্টিকিলাই।” কবিতা বিরক্ত হয়ে বলল। তীর্থের বন্ধুদের দেখে তার আরও মেজাজ খারাপ হলো। তারা কবিতাকে নিয়ে হাসা-হাসি করছে আর তীর্থ তাদের সাইড নিচ্ছে? এইবার তো তার ইগোতে কথা আসলো। সে তীর্থের কানের কাছে ঝুঁকে বলল, “ঠিক দশমিনিট আগে তাহিরা আপুর এক কলিগ আমাকে সিঙ্গেল ভেবে সোজা বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছে। তাহিরা আপু আসায় কিন্তু তাকে বলাও হয় নি আমি বিবাহিত। তুমি যদি এই মুহূর্তে কন্যাপক্ষে না আসো তাহলে আজ সারা ফাংশনে সে যদি আমার দিকে তাকিয়ে থাকে এবং ফ্লার্টিং করার চেষ্টা করে তাহলে আমি ভুলেও বলব না যে আমি তোমার ওয়াইফ। একদম করতে দিব। সাথে দুইমাস না আমাকে চুমু খেতে পড়বে আর না ছুঁতে দিব। এখন ভেবে দেখ কার পক্ষ নিবে তুমি?”
কবিতা একগাল হেসে আবারও যেয়ে দাঁড়ায় তাহিরার পাশে। যেয়ে হাত আড়া-আড়ি ভাঁজ করে তীর্থের দিকে তাকায়।
তীর্থ একবার তাকায় তার বন্ধুদের দিকে। আবার কবিতার দিকে। পলাশ জিজ্ঞেস করে, “ভাই আমি কী করব?”
তীর্থ একটু কেশে যেয়ে দাঁড়ায় কবিতার কাছে। বলে, “কবিতা যা বলছে তা কর।”
“ভাই আপনি এভাবে আমাদের ধোঁকা দিতে পারেন না।” একে একে ধ্রুব ও তীর্থের সব বন্ধুরা চেঁচামেচি শুরু করে। কবিতা শুধু এতটুকু বলে, “দেখেন আপনাদের ভাই আপনাদের যত সাইডই নেক না কেন তার দুর্বলতা আমার হাতেই আছে। বিয়ের আগেও এবং এখনো। এখন সবাই লাইন মতো যান গেইটের কাছে। যেয়ে টাকা দেওয়ার প্রিপারেশন নেন। একমিনিটে না লাইন ধরে যান, নাহয় আপনাদের তীর্থে ভাইয়ের বলতে হবে।”
কেউ আর কিছু বলার সাহস পেল না। কবিতার কথা মতোই চলে গেল।
গেইট ধরার পর নিয়ম অনুযায়ীই বিয়ের কাজ শুরু করা হয়। তাহিরা এবং ধ্রুবকে বসানো হয় স্টেজে। বিয়েটা একটু অকপটে ছিলো। বয়স্ক বলতে সেখানে কেবল ছিলো কবিতার শাশুড়ী এবং তাহিরার দাদী। আর বাকিরা তাদের বন্ধু, কলিগ অথবা প্রতিবেশী। তাহিরা অথবা ধ্রুব কারও আত্নীয়দের মধ্যে কেউ-ই আসে নি। ধ্রুবর পরিবার তো আগের থেকেই তার সাথে সম্পর্ক ভেঙে ফেলেছিলো। তাহিরার বাবার সাথে সম্পর্কিত সকলে বিদেশে সেটেল্ড তাই তাদের আশা হয় নি। আর মা’য়ের সাথে সম্পর্কিত আত্নীয়রা তার সাথে সম্পর্ক রাখতে ইচ্ছুক নয়। কবিতা যখন থেকে তীর্থকে বিয়ে করেছে তখন থেকেই তাদের মধ্যে কেউ তাহিরার সাথে কথাও বলে নি। তাদের ধারণা, কবিতার এই ভুলটি করার কারণ হলো তাহিরা। কেননা, কবিতা তাহিরার কাছে এসে থাকার পরই এমন কান্ড ঘটিয়েছে।
তাহিরার আপন বলতে সেখানে কেবল ছিলো কবিতা এবং তার দাদী। যেহেতু দাদীর বয়স অনেক হয়েছে তা সে উঠে হাঁটা চলাও করতে পারে না, সেহেতু কবিতাই সব দায়িত্ব নিলো। যদিও তার এইসবের প্রতি বেশি জ্ঞান নেই তবুও সে যতটুকু পারে করছে।
কবিতা খেয়াল করে আজ সারা অনুষ্ঠানে তীর্থ তার পিছু পিছু ঘুরছে। অবশেষে সে তীর্থকে জিজ্ঞেস করেই নিলো, “তোমার সকল বন্ধুরা ওখানে গল্প করছো, আর তুমি আমাকে আমার পিছু নিচ্ছ কেন?”
তীর্থ মুখ গোমড়া করে কাঠকাঠ গলায় বলল, “ওই ছেলেটা কোথায় যে তোমাকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিল?”
কবিতা কিছু মুহূর্ত স্তব্ধ হয়ে রইলো। তারপর মুখ টিপে হাসতে থাকে।
তীর্থ বিরক্ত হয়ে বলে, “এখানে হাসার কী আছে?”
“তুমি এই কারণে আজ সারাটাক্ষণ পিছু পিছু ঘুরছিলে? এখন তো ভাবছি ছেলেটাকে পার্সেল করে আমার সাথে নিয়ে যাব। তোমার প্রথম প্রেমিকাকে ছেড়ে আমার প্রতি একটু ধ্যান তো দিবে তুমি। উফফ জেলাস হলে কত কিউট লাগে তোমাকে।” কবিতা গাল টেনে বলল।
তীর্থ কবিতার হাত ধরে বলল, “করছটা কী? এখানে আমার সব কর্মীরা আছে। এভাবে আমাকে গাল টিপতে দেখলে কী ভাববে সবাই? পরে আর ভয় পাবে না।”
“তোমাকে কতবার বললাম ভয় না পাইয়েও কাজ করানো যায়। আর এই কী ভাববে? ভাববে যে তোমার প্রিয় ওয়াইফ তোমাকে আদর করছে।”
তীর্থ বিরক্তি হাত সরায় কবিতার। আবদারের সুরে বলে, “এত সাজার কী প্রয়োজন ছিলো? তোমাকে সুন্দর লাগছে তো। যেয়ে এই সাজগোজ মুছে আসো যাও। ঐ ছেলেকে তো খুঁজে পেলাম না কিন্তু ওকে খুঁজে চক্করে দেখি কতজন তোমার দিকে তাকিয়ে আছে।”
“তাহলে বুঝ তুমি কতটা লাকি? এতজনের মাঝে আমি তোমাকে বাছাই করেছি। এরপর আমাকে ছাড়া তোমার প্রথম প্রেমিকাকে সময় দেওয়ার সময় এবং আমার সাথে ঝগড়া করার এইটা মাথায় রেখ।”
কবিতা ভেংচি কেটে একরাশ ভাব নিয়ে হাঁটতে শুরু করল। তীর্থও তার পিছনে যায় তাকে মানানোর জন্য, যেন সে এত সাজগোজ মুছে নেই।
নীল রঙের মসলিন শাড়ি পরে আছে মৃণা। শাড়িটি রুপার কাছ থেকে ধার নেওয়া। এত দামি শাড়ি সে আগে পড়েনি। রুপা যে একবার বলাতেই তাকে শাড়িটি পরতে দিবে তা সে ভাবেও নি। সে হলে তো কখনই দিত না। পরেই তার মনে পড়, রুপার কাছে এমন শাড়ির অভাব নেই। রুপার বাবার অবস্থা যেমন ভালো, তেমনি তার বয়ফ্রেন্ডের অবস্থাও ভালো। এর উপর নিজেও তার বাবার জন্য কাজ করে ভালোই টাকা রোজগার করে। রুমার ভাগ্য দেখে মাঝেমধ্যে হিংসা লাগে তার, এত সুন্দর ভাগ্য তার কেন হলো না?
.
.
.
মৃণা সেন্টারের গেইট দিয়ে ঢুকতেই চমকে যায়। চারপাশটা অসম্ভব সুন্দর করে সাজানো। রাতের অন্ধকারে জ্বলজ্বল করছে চারপাশ। তার মনে হল এক বিশাল রাজমহলের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে সে। চারদিকে বাতি এবং ফুল দিয়ে সাজানো। পার্কিং-এ গাড়ির মেলা লাগানো। এর মাঝে একটি পুরনো বাইক থেকে নামতে ভীষণ লজ্জা লাগে মৃণার। সে বাইক থেকে তড়িঘড়ি করে নেমে আইদ থেকে দূরে সরে যায়। তারপর দোয়ার দিয়ে প্রবেশ করার সময় বলে, “আপনাকে বলেছিলাম একটা গাড়ি ভাড়া করে আনতে। এইখানে সবাইকে দেখছেন? সবাই কত সুন্দর গাড়িতে এসেছে?”
মৃণার কথার ধরণটা রুক্ষ ছিলো। অন্যকোনো পুরুষ হলে কড়া জবাব দিয়ে দিতো মৃণাকে কিন্তু আইদ এমন না। সে সবসময়ের মতো ঠোঁটের কোণে হাসি রেখে বলল, “অন্যদের দেখিয়ে কী হবে বলো? নিজেদের সামর্থ্য থেকে বড় দেখাতে নেই।”
মৃণার আইদের কথার উওর দিতে মন চাইলো না। আইদের কথাগুলো শুনলে মৃণার মেজাজ খারাপ হয়ে যায়। অজ্ঞ মনে হয় তাকে।
সে বিশাল সদর দরজা দিয়ে প্রবেশ করার সময় মৃণার চোখ জ্বলজ্বল করে উঠে। এমন ধরনের বিয়ে তার করার ইচ্ছা অথবা এর থেকেও বড়। তার মনটা ফুরফুরে হয়ে উঠে মহলটা দেখে। আইদ আলতো করে হাত ধরে তার, “আসো তোমাকে তাহিরা আপুর সাথে দেখা করাই। উনারই আজ বিয়ে। তুমি তার সাথে দেখা করে অনেক খুশি হবে, খুবই ভালো সে।”
মৃণার কারও সাথে দেখা করার জন্য মোটেও আগ্রহী ছিলো না। এই বিশাল হলরুমের সাজগোজের মাঝেই তার মন ধরে আছে।
কিন্তু একটু সামনে এগিয়ে ধ্রুবকে বধূর পাশে দেখতে পেয়েই সে চমকে যায়। আজ ধ্রুবরও বিয়ে হওয়ার কথা। অর্থাৎ তাহিরার সাথে ধ্রুবর বিয়ে?
এর আরেক অর্থ হলো এইখানে তীর্থও আছে। মনটা আকুপাকু করে উঠে মৃণার। তার অবাধ্য নজর তীর্থের খোঁজে ব্যস্ত। কিন্তু তীর্থের দেখা পেয়ে সে বেশি খুশি হলো না, বরং তার মনটাই উদাসীন হয়ে গেল। তীর্থ কবিতার সাথে। সাথে বললেও ভুল হবে, তার পিছু পিছু ঘুরছে সে।
আইদ মৃণাকে নিয়ে স্টেজে উঠে তাহিরা এবং ধ্রবর সাথে নিজের হবু বউ বলে পরিচয় করাতেই ধ্রুব বলে উঠে, “আরে মৃণা যে! আমি তো জানতামই না তোমার বিয়ে ঠিক হয়েছে। কখনো বলোই নি।”
খানিকটা লজ্জা পায় মৃণা। সে ভালো করে বুঝতে পারছে যে ধ্রুব তাকে খোঁটা মেরে কথাটা বলছে। তীর্থ বিবাহিত জেনে সে যেমন প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছিল সে ঘটনাকে উদ্দেশ্য করেই কথাটা বলেছে ধ্রুব।
আইদ জিজ্ঞেস করে, “ভাইয়া আপনারা একে অপরকে চিনেন?”
“একদম। ও তো প্রায় প্রতিদিনই আমাদের অফিসে আসে।”
আইদ অবাক হয়ে তাকাল মৃণার দিকে। সে এই ব্যাপারে কিছু জানেনা। তবে অন্য মানুষদের সামনে কিছু বলে না তাকে। মৃণা তার হবু স্ত্রী, তার সম্মান রক্ষার দায়িত্ব আইদের।
ধ্রুব নিজ থেকেই কথাটা পরিষ্কার করে, “মানে প্রথমে ভার্সিটির এসাইনমেন্টের জন্য আমাদের ব্যবসা সম্পর্কে জানতে এসেছিলো। এখন কাজ সম্পর্কে ধারণা নেবার জন্য আসে। ভালোই কাজ করছে, আমি তো ভাবছি অফিসে কিছু সময়ের জন্য একটা কাজ দিয়েই দেখি। কী বলো মৃণা?”
মৃণা মুখে উত্তর দিলো না, শুধু জোরপূর্বক হাসলো।
স্টেজ থেকে নামার পর আইদ তাকে জিজ্ঞেস করে,
“তুমি বললে না যে তুমি এসাইনমেন্টের জন্য কারও অফিসে যাচ্ছ?”
“আমার কী সবকিছুর জন্য আপনার পারমিশন নেওয়া লাগবে এখন? আমার মা বাবাও তো আমাকে এত প্রশ্ন করে না। আপনি বললে আমি আমার নিশ্বাসও আপনার অনুমতি নিয়ে নিব।”
“আমি তো সাধারণভাবে জিজ্ঞেস করছিলাম।”
“আচ্ছা শুনুন, আমার তৃষ্ণা পেয়েছে।”
“তুমি দাঁড়াও আমি এখনই তোমার জন্য কিছু নিয়ে আসছি।
আইদ যেতেই মৃণা আবারও খুঁজে বের করে তীর্থ ও কবিতাকে। সে যেয়ে ইচ্ছা করেই ধাক্কা খেল তীর্থের সাথে। সে পড়ে যেতে নিলেই তীর্থ তাকে ধরে নেয়। মৃণাকে এই অনুষ্ঠানে দেখে অবাক হয়ে যায় সে। এইখানে কী করছে মৃণা? ভয়ে বুক কেঁপে উঠে তীর্থের। কবিতা ঠিক তার পাশে দাঁড়ানো। যদিও মৃণা তাকে ওয়াদা করেছে যে সে কখনো কাউকে কিছু বলবে না, কিন্তু সে কী বিশ্বাস রাখতে পারে মৃণার উপর? তাকে চিনে একমাস বটে।
কবিতা তড়িঘড়ি করে জিজ্ঞেস করে, “তুমি কি ঠিক আছ?”
কবিতার কন্ঠ শুনতেই তীর্থ মৃণাকে সোজা করে দাঁড় করিয়ে নিজে এক’পা পিছিয়ে যায়।
মৃণা এক পলক তীর্থের দিকে তাকিয়ে চোখ নামিয়ে নেয়। তারপর মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ উওর দেয়। কবিতা বলে, “ওয়েট, তোমাকে আমি কোথাও দেখেছি। তুমি সেদিন তীর্থের ইন্টারভিউ নিতে এসেছিলে তাই না?”
মাথা নাড়িয়ে আবারও হ্যাঁ জানায় মৃণা। সে ভালোভাবে চোখ বুলিয়ে নেয় কবিতা শাড়ির উপর। সে ভেবেছিল কবিতা যেহেতু তীর্থের বউ, সেহেতু দামী শাড়ি পরে আসবে। অথচ সে সাধারণ একটি শাড়ি পরে এলো। এমনই এক শাড়ি আইদ তার জন্য এনেছিলো। কিন্তু কমদামী বলে তা পরে নি মৃণা। এত বড় অনুষ্ঠানে এমন শাড়ি কে পরে আসে?
কবিতা নমনীয়ভাবে তাকে জিজ্ঞেস করে, “কখন এলে?”
তখনই তীর্থ তার হাত ধরে নেয়, “কাজি আসার সময় হয়ে যাচ্ছে। তাহিরা এবং ধ্রুবকে একবার দেখে আসা উচিত।”
“হ্যাঁ, ঠিক বলেছ।” কবিতা মৃণার দিকে তাকিয়ে তার হাত ধরে মিষ্টি করে বলে, “কিছু লাগলে জানিও।”
তীর্থ কবিতাকে স্টেজে নিয়ে যায়। তাকে তাহিরার সাথে ব্যস্ত করে দিয়ে ধ্রুবকে নিয়ে আলাদাভাবে কথা বলতে যায় সে।
“তোকে আমি এখনো গতবারের জন্য ক্ষমা করি নাই আর তুই আবার তোর কাহিনী শুরু করছিস?”
“আরে ভাই কী করলাম আমি?” হতবাক হয়ে বলে ধ্রুব।
“কী করেছিস? মৃণাকে তুই ডাকোস নাই?”
“না তো। তাহিরার এক কলিগ ওর বাগদত্তা। তার সাথেই এসেছে। আমি ডাকতে যাব কোন দুঃখে? তোর থেকে আবার মাইর খাবার জন্য? এত তেল নাই আমার বাবা।”
“বাগদত্তা!” চমকে উঠে তীর্থ।
“হ্যাঁ আমিও জানতাম না ওর এনগেজমেন্ট হয়েছে। আজই জানলাম। এখন তো তোর এতটা গিলটি ফিল করার কথা না। তুই যা করেছিস জ্ঞানহীনভাবে করেছিস। কবিতার সাথে অন্যায় করলেও সজ্ঞানে তো করিস নি। মেয়েটা তো জেনে-বুঝে ওর ফিয়োন্সেকে চিট করলো।”
“আমার এতে কিছু আসে যায় না। ওর এনগেজমেন্ট হয়েছে কিংবা হয় নাই, এতে আমার কিছু আসে যায় না। কিন্তু একটা জিনিস বুঝে নে, ও যদি ভুলেও কবিতাকে কিছু বলে তোর এই বিয়ে আমি হতে দিব না। মাথায় রাখিস।”
“আরে ভাই আমি কী ডাকছি ওকে?”
“তুই ডাকছিস, না ডাকিস নি আই ডোন্ট ইভেন কেয়ার। এটা তোর দায়িত্ব, তুই ওকে কবিতার থেকে দূরে রাখবি। আমি আসছি।”
“আরে ভাই আমার বিয়ে আজ। আজ আমি দারোয়ানগিরি করব না’কি?”
“প্রয়োজনে তাই করবি।”
তীর্থ সেখান থেকে সোজা যায় ছাদে। ছাদে যেয়ে সিগারেট ধরায়। আজকাল আবার তাকে সিগারেটের নেশায় ধরেছে। ব্যাপারটা কবিতা জানলে সর্বনাশ। তার সিগারেট মোটেও পছন্দ না। সহ্য হয় না তার সিগারেটের ধোঁয়া। কিন্তু তীর্থের আপাতত এর প্রয়োজন। হাজারো চিন্তা তীর্থের মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। আগে কবিতার ভালোবাসা তার সকল চিন্তা দূর করে দিতো কিন্তু আজকাল কবিতার জন্য সময় হয় না। তাই সিগারেটকেই নিজের সাথী বানাতে হলো তীর্থের।
ছাদে দরজা খোলার শব্দে চমকে উঠে তীর্থ। সাথে সাথে তীর্থ তার হাতে সিগারেট জ্বালিয়ে দিল। ভয়ে ভয়ে পিছনে ফিরে সে। কেবল কবিতা না হলেই হল। পিছনে ফিরে দেখে মৃণা দাঁড়ানো। তার নিঃশ্বাসে নিঃশ্বাস এলো। মৃণা এগিয়ে এলো তীর্থের কাছে, “আপনার ওয়াইফকে ভেবে সিগারেট ফালিয়ে দিলেন? এত ভয় পান নিজের বউকে?”
তীর্থ বিরক্তি নিয়ে মুখ ফিরিয়ে নিলো। আজকাল মৃণার উপর প্রচন্ড রকমের বিরক্তি কাজ করে তার। মেয়েটা প্রতিদিন তাকে দেখতে আসে। বিষয়টা আসলেই অস্বস্তিকর।
মৃণা পাশে এসে দাঁড়ায় তীর্থের। আবারও জিজ্ঞেস করে, “আপনি নিজের ওয়াইফ কে খুব ভালোবাসেন তাই না?”
“নিসন্দেহে।”
এক ঢোক গিলে মৃণা। কেমন উদাসীন গলায় বলে, “আপনি এর একভাগও আমায় ভালোবাসতে পারেন না?”
তীর্থ চোখ ঘুরিয়ে থাকায় মৃণার দিকে, ” ফিয়ন্সে থাকা সত্ত্বেও তোমার মুখে এইসব কথা মানায়?”
চমকে উঠে মৃণা। আইদের কথা তীর্থ জানলে কি হবে তা সে ভাবে নি। এমন বোকামি কিভাবে করলো সে? সাথে সাথেই সে বাহানে বানায়। জোরপূর্বক হেসে বলে, “এই বিয়েতে আমি রাজি না। আমার মা বাবা জোর করে করাতে চাইছে। আইদকে আমি কখনো চেয়েও ভালোবাসতে পারি নি। সে সবার সামনে এত ভালো সাজে অথচ একা আমাকে কত কটু কথা বলে আপনি ভাবতেও পারেন না।”
তীর্থ খেয়াল করে চোখ ভরে এসেছে মৃণার। কথাটা শুনেও তার মন খারাপ হয়ে গেল। মেয়েটার সাথে এত খারাপ হচ্ছে, এর উপর সে নিজেও তার সাথে কোনোদিন সুন্দরভাবে কথা বলে নি। ভেবেও মন খারাপ হয়ে গেল তার। সে একটু কেশে বলল, “তুমি চাইলে আমি ধ্রুবকে দিয়ে তোমার মা বাবার সাথে কথা বলাতে পারি।”
“না না আমার মা বাবা আমাকে মেরেই ফেলবে। এমনিতেও তাদের কষ্ট দেবারও কোনো ইচ্ছা আমার নেই।” তারপর জোর করে একগাল হেসে বলল, “আমি তো আপনাকে ভালোবেসেছিলাম কিন্তু কখনো আপনাকে পাওয়ার ভাগ্য আমার হবে না তাই কার সাথে বিয়ে করছি এতে কি আসে যায়? আপনার কাছে হয়তো আমাকে বেশ বিরক্তিকর লাগতে পারে কিন্তু আমি কি করব? আমি চেয়েও আপনার প্রতি আমার অনুভূতিকে দাবাতে পারছি না। আমি জানি এইটা ভুল, তবুও এই ভুলটাও কেন যেন তৃপ্তি দিচ্ছে।”
তীর্থ কি বলবে সে বুঝতে পারে না।
মৃণা গভীর নিশ্বাস ফেলে, “আচ্ছা আমি যাই তাহলে। আইদ যদি আমাকে না পায় তাহলে ভীষণ সমস্যা করবে।”
বলেই চলে গেল মৃণা। তীর্থ তার যাওয়ার প্রান্তে তাকিয়ে রইলো। তার মনে হলো, মেয়েটার সাথে এত রুক্ষ ভাবে কথা না বললেও সে পারতো। এরপর দেখা হলে অবশ্যই ক্ষমা চেয়ে নিবে সে।
#মুহূর্তে
পর্ব-২৬
নিলুফার ইয়াসমিন ঊষা
মৃণা অনুষ্ঠানে ফিরে যেয়ে মুখোমুখি হয় আইদের। আইদ তাকে দেখেই চিন্তিত সুরে বলে, “কোথায় চলে গিয়েছিলে তুমি? কতক্ষণ ধরে খুঁজছি। আমিতো ভয় পেয়ে গেছিলাম।”
“এখানে খোঁজার কী আছে? এইখানে এত মানুষের মধ্যে কি হবে আমার? সব জায়গায় বলে যেতে হবে আপনাকে? এক কাজ করি, কাল থেকে নিশ্বাসটাও আপনার অনুমতি নিয়ে নিব।”
“যুগ ভালো না মৃণা। আচ্ছা বাদ দেও, আসো তোমাকে আমার কলিগদের সাথে পরিচয় করিয়ে দেই।”
মৃণার বিশেষ ইচ্ছা না থাকলেও সে আইদের সাথে গেল। কলিগদের সাথে পরিচয় করানোর পর সেখানে বেশ প্রশংসা হলো তার। আনন্দিত হয় মৃণা। তার ব্যাপারটা ভালো লাগে। নিজের প্রশংসা শুনে কে না খুশি হয়? খানিকক্ষণ পরেই আবার তাহিরা এবং কবিতা প্রশংসা শুরু হয়। তাহিরার প্রশংসা বুঝা যায় সে তো বউ। কিন্তু কবিতার এত প্রশংসা কেন সে বুঝতে পাড়ল না। বিশেষ করে তার শাড়ি নিয়ে। মৃণার পরা শাড়ি তো কবিতার থেকে অনেক বেশি দামী তাহলে কেন তার শাড়ির প্রশংসা হলো না এই ব্যাপারটা মাথায় ধরছে না তার।
আইদ কিছু সময়ের জন্য গিফট কাউন্টারে দিয়ে আসতে গেল। এরই মাঝে মৃণা খুঁজে নেয় কবিতাকে। কবিতা তাকে দেখে জিজ্ঞেস করে, “আরে মৃণা কিছু লাগবে? খাওয়া-দাওয়া করেছ? খালি টেবিল দেখব তোমার জন্য?”
” না, পরে খাব। আচ্ছা আপনাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করি, এই শাড়িটা কোথা থেকে নিয়েছেন?”
কবিতা হাসে, “তুমি এই প্রশ্ন এত চিন্তা করে করছ? এটা অনেক বছর আগের। তীর্থ উপহার দিয়েছিলো।”
তীর্থ উপহার দিয়েছে শুনে মৃণার মেজাজ খারাপ হয়ে গেল কিন্তু তা সে বুঝতে দিলো না। উল্টো জিজ্ঞেস করল, “আইদও এমন একটি শাড়ি উপহার হিসেবে দিয়েছিল আমাকে। কিন্তু আমি এত বড় অনুষ্ঠানে আসব বলে পরে আসেনি। তীর্থ স্যার তো অনেক বড় ব্যবসায়ী উনি যেকোনো শাড়ি অফোর্ড করতে পারে তাহলে আপনি আপনার বোনের বিয়েতে এই শাড়িটা পরে আসলেন কেন? আর আপনার স্বামী এত বড় ব্যবসায়ী হয়ে এই উপহার দিলো কেন?”
এমন প্রশ্নের জন্য অপ্রস্তুত ছিলো কবিতা। অচেনা কেউ এভাবে প্রশ্ন করতে পারে ব্যাপারটা কেমন যেন!
তবুও কবিতা তার ঠোঁটের কোণে মিষ্টি হাসি বজায় রেখে উওর দেয়, “এই উপহার তখনের যখন তীর্থ প্রথম নিজের ব্যবসা থেকে আয় করেছিলো। আমার প্রথম সন্তান কাব্য যখন আমার গর্ভে ছিলো তখনের। তাই শাড়িটা আমার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এছাড়া দামী জিনিসই সুন্দর হয় এই ধারণাটা ভুল।”
“আমি খারাপ ভাবে প্রশ্নটা করলে সরি। আসলে আমি গুছিয়ে কথা বলতে পারিনা। মানে আমার প্রশ্ন ছিলো যে তীর্থ স্যারের নিজের এত বড় পোশাকের কারখানা আছে। সেখানে দামী জিনিস পাওয়া যায় তাহলে আপনি এটা পরলেন কেন? আচ্ছা আপনি নিজেদের কারখানাতেই এই শাড়ির উপরের কাজ করিয়েছেন?”
“না, আমি নিজে করেছি। ওই’যে বললাম না যখন কাব্য আমার গর্ভে ছিলো তখন তীর্থ আমাকে উপহার দিল। তখন তীর্থ আমাকে কোন কাজ করতে দিত না, তাই বসে বসে এই করেছি।” বলে নিজেই হাসলো কবিতা। মৃণাকে অবাক দেখাল, “আপনি নিজে এই কাজ করেছেন?”
কবিতা একবার বলতে চাইলো তীর্থের ব্যবসায়ের বেশিরভাগ পোশাকই তার ডিজাইন করা। কিন্তু ব্যাপারটা আর সে বলল না। এরই মধ্যে ডাক পড়ে কবিতার। বিয়ে পড়ানোর সময় হয়ে গেছে। তাহিরার বোন হিসেবে তাকে সেখানে থাকতে হবে।
বিয়ের অনুষ্ঠান শেষ হতে হতে রাত বারোটা বাজে। এরপরও সেন্টার থেকে বাসায় আসে তাহিরা ও ধ্রুবর কাছের মানুষেরা। তবে কবিতা থাকতে পারলো না। তার শাশুড়ির কারণে চলে যেতে হলো। তাহিরাকে বাসর রাতে বসানো হয়। ধ্রুবর বন্ধুরা তাকে তো প্রথমে ঢুকতেই দেয় না। পরে যেমন তেমন করে সে রুমে আসে। রুমে আশেপাশে কোথাও খুঁজে পেল না। সে তাহিরাকে খুঁজে পায় বারান্দায়। আঁধারের রাতে তার সোনালী রঙের লেহেঙ্গাটা উজ্জ্বল দেখাচ্ছে। এর উপর আজকের জ্যোৎস্নার রাতটা এই মুহূর্তের সৌন্দর্য আরও বাড়িয়ে তুলল।
ধ্রুব যেয়ে পিছন থেকে তাহিরাকে জড়িয়ে ধরল। হাতদুটো আবদ্ধ তাহিরার পেটের উপর। তার কাঁধে মাথা রেখে বলল, “আমার এত বছরের সাধনা আজ পূর্ণ হলো। তোকে আজ আমি নিজের করে পেলাম। জানিস আমি ভেবেছিলাম যে আমাদের জীবন আগের মতই থাকবে। ছোট কাল থেকে তো আমরা একসাথে। কী পরিবর্তন হতে পারে? কিন্তু কেন যেন কবুল বলার সময় আমার এতটা নার্ভাস লাগছিলো যা বলার বাহিরে। কেন আমি ঠিক বুঝতে পারছি না। আমাদের সবকিছু কী আগের মতোই থাকবে না?”
তাহিরার ধ্রুবর হাতের উপর হাত রাখে। তারপর মৃদু স্বরে বলে, “আমি জানি আমরা এক জীবন একসাথে কাটিয়েছি। পাশাপাশি বাসা, একই স্কুলে, একই কলেজ একই ভার্সিটি। কিন্তু তবুও বিয়ের কথাটা ভিন্ন। আমরা আজ পবিত্র বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছি। আজ থেকে সম্পূর্ণভাবে আমাদের একে অপরের উপর অধিকার আছে। দায়িত্ব আছে। স্বামী স্ত্রী একে অপরের পরিপূরক।”
“তুইও কবুল বলার সময় নার্ভাস ছিলি তাই না? কেমন শক্ত করে আমার হাত ধরে নিলি।”
“আমার হার্টবিট এত জলদি আগে কখনো দৌড়ায় নি। আমার জান বের হয়ে যাচ্ছিলো। আমি তো কান্নাও করে দিতাম পরে কবিতা আমার কানের কাছে এসে বলে, ‘আপু খবরদার কাঁদবে না। কত হাজার দিয়ে মেকাপটা করল, কাঁদলেই শেষ। টাকার শোকে আমি নিজেই হার্ট অ্যাটাক করব।’ ওই মেয়ের কথা শুনেই হেসে দিয়েছিলাম। মেয়েটার দুটো বাচ্চা হয়ে গেল কিন্তু বাচ্চামি স্বভাব আর গেল না।” আবারও হাসতে থাকে তাহিরা।
ধ্রুব তাহিরাকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে আঙুল দিয়ে তাহিরার গাল আলতো করে ছুঁয়ে দিলো। আর বলল, “তোর কী মনে হয় না কাব্য এবং কুহুর একটা ভাই অথবা বোন দরকার?”
“না-তো। মনে হয় না।”
“কিন্তু আমার তো তোকে দরকার। আর আমাদের ভালোবাসার অংশকেও। এতবছর ধরে তোকে নিজের করে পাবার অপেক্ষায় আছি।”
ধ্রুব তাহিরার উন্মুক্ত পেটে হাত রাখতেই কেঁপে উঠে সে। ধ্রুব একটানে তাকে নিজের কাছে টেনে নেয়। তারপর ঝুঁকে তাহিরার ঠোঁটের কাছে যেয়ে বলে, “আজ থেকে তুই শুধু আমার।”
ধ্রুব দখলে নিয়ে নিলো তাহিরার ঠোঁটজোড়া। এই জ্যোৎস্নার রাতে চারপাশে প্রেমের ঘ্রাণ যেন ম ম করছে। ধ্রুব এবং তাহিরা ডুবে গেলে এই প্রেমের মাঝে। ডুবে রইলো একে অপরের মাঝারে।
.
.
ছয়মাস পর,
তীর্থ গাড়ির কাছে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে ধ্রুবর। আজ তাদের সিলেট যাওয়ার কথা। জরুরী একটি মিটিং আছে সেখানে। বড় এক প্রজেক্ট পেয়েছে তারা। প্রায় একঘন্টা ধরে ধ্রুবর অপেক্ষা করছে সে। তার আসার নাম গন্ধও নেই৷ ধ্রুবর কাছে তার সকল তথ্য, ফাইল এবং প্রজেক্টের জন্য করা প্রেজেন্টেশনের পেনড্রাইভ। এগুলো না থাকলে তো তীর্থ ধ্রুবর জন্য ভুলেও অপেক্ষা করতো না। তাকে রেখেই চলে যেত।
অপেক্ষা করতে করতে ধ্রুবকেই কল দিচ্ছিল তীর্থ। এমন সময় তার সামনে এসে হাজির হলো মৃণা। তাকে দেখে কপাল কুঁচকে জিজ্ঞেস করে তীর্থ, “তুমি এইখানে কী করছ?”
“জ্বি ধ্রুব স্যার আপনার সাথে সিলেটে যেতে বলেছে।”
“ধ্রুব যেতে বলেছে মানে? ও কোথায়?”
মৃণা তার ব্যাগ থেকে কিছু ফাইল বের করে বলল, “উনিই তো আমাকে এগুলো দিয়ে পাঠিয়েছে। আর সব বুঝিয়েও দিয়েছে।”
তীর্থের মাথায় রক্ত চড়ে গেল মুহূর্তে। পাঁচ মাসের মতো হলো মৃণা তাদের অফিসে কাজ করছে। কাজটা ধ্রুবই দিয়েছে তাকে। মৃণার পরিবারের অর্থনৈতিক অবস্থা খারাপ শুনে তীর্থ তাকে অন্যকোথাও জব অফার করেছিলো কিন্তু ধ্রুব তাকে বুঝিয়ে তাদের অফিসেই কাজ দেওয়াল। ধ্রুবর মতলব ভালো করেই জানে তীর্থ। কিন্তু কিছু বলতে পারে না। সেদিন রাতের কথা নিয়ে একরকম ব্লাকমেইল করে ধ্রুব। কিন্তু আজ তো সীমানা পাড় করে ফেলেছে ধ্রুব। অন্য এক মেয়ের সাথে একা যাবার কথা তীর্থ চিন্তাও করতে পারে না। যেখানে তাদের দুইজনের বাজে একটা স্মৃতি আছে।
তীর্থ সাথে সাথে আলাদা যেয়ে ধ্রুবকে কল দিলো,
“হ্যালো দোস্ত কি খবর? রওনা দিয়েছিস নাকি?”
ধ্রুবর কন্ঠ শুনে আরও বেশি রাগ উঠল তীর্থের। গলা চড়িয়ে বলল, “তোর কি মাথা খারাপ হয়েছে? তুই কীভাবে একটা মেয়েকে আমার সাথে ঢাকা সিলেট পাঠানো চিন্তাও করতে পারিস? তোকে আমি মানা করেছিলাম তোর এসব ফাইজলামি বন্ধ কর। ”
ধ্রুব হাসে তীর্থের কথায়, “সব দোষ আমার উপর চাপিয়ে লাভ কি বল? সে রাত তুই কাটিয়েছিল। এছাড়া কয়দিন ধরে যে তোর ওর সঙ্গ ভালো লাগছে। তুই যে ওর প্রতি আকর্ষণ অনুভব করিস তা আমার চোখ এড়ায়নি। আমি তোর জন্যই ওকে পাঠিয়েছি। তোর ভালো লাগবে বলে।”
“ফাইজলামি করিস? এমন কিছুই না। মেয়েটার ভাগ্য ভালো না, তাই মাঝে মাঝে ওর জন্য খারাপ লাগে। মায়াও লাগে। প্রথমেই ওর ফিয়ন্সে ভালো না। এর উপর আমাকে ভালোবেসে মেয়েটা কষ্ট পেল। এরপর আমি আবার আরেক অন্যায় করলাম। খারাপ লাগাটা স্বাভাবিক। কিন্তু আমার মনে কবিতা ছাড়া কেউ নেই।”
“আহা আমি কি বলেছি না কি কবিতাকেও ভালবাসিস না? শুধু বলেছিস মৃণার প্রতি আকর্ষণ অনুভব করিস। এটা তো খারাপ কিছু না। মানুষের স্বভাবটাই এমন। এই পৃথিবীতে শুধু আমি তাহিরাকে ভালোবাসি কিন্তু এর মানে এই না যে অন্যকোনো মেয়ের উপর আকর্ষণ অনুভব করা বারণ।”
“তোর সাথে কথা বলাটাই বৃথা।” বলেই রাগে কটমট করে ফোন কেটে দেয় তীর্থ।
ধ্রুব তার পাশে বসা রুপাকে বলল, “রাগ করেছে মনে হয়।”
ধ্রুব রুপার সাথে একটি ক্যাফেতে বসা। ক্যাফেটা একটু অন্যরকম। তাদের সম্পূর্ণ আলাদা একটি কেবিন দেওয়া হয়েছে। কেবিনে তাদের অনুমতি ছাড়া কারও আসা মানা। রুপা হেসে ধ্রুবর বুকে মাথা রাখল, “তোমার মতো বাজে মানুষ আমি জীবনে দেখিনি। বন্ধুর উপকারের নামে নিজের স্বার্থ বের করছো তুমি। তবে মানতে হবে তোমার বুদ্ধি আছে ভালো।”
“তুমি আমার প্রশংসা করছ না’কি বদনাম। বুঝাটা মুশকিল। বাই দ্যা ওয়ে, আমি কী করলাম নিজের স্বার্থের জন্য?”
“তুমি অন্য কাউকে বোকা বানাতে পারবে, আমাকে পারবে না। তুমি মৃণার সাথে তীর্থকে এইজন্যই সেট করতে চাচ্ছ যেন তীর্থ তোমার এইসব বাজে কান্ড সম্পর্কে জানতে পারলে তোমার বউকে যেন না বলে। আমি না বুঝি না, এত সুন্দর বউ থাকতে তোমার অন্যদিকে নজর যায় কিভাবে?”
“সুইটহার্ট আমি তোমাকে আগেও বলেছি তাহিরা ছাড়া অন্যকেউ আমার মনে নেই। কিন্তু ভালোবাসা ছাড়াও অন্য চাহিদা থাকে। আর তোমাদের মতো সুন্দর মেয়ের সামনে নিজেকে শক্ত রাখা যায়? এই অভ্যাসটা অনেক আগের। ছাড়াটা কষ্টকর।”
“আর এইসব জানলে তোমার ওয়াইফ তোমাকে ছেড়ে চলে যায়?”
“অসম্ভব। তাহিরা আমাকে অনেক বেশি ভালোবাসে। ওর নিজের জীবন থেকেও বেশি। ও আমাকে ছেড়ে যাবার কথা চিন্তাও করতে পারে না। আমি ওর দুর্বলতা। এছাড়া আমার মা’কে ওয়াদা করেছিলো ও। তাহিরা আবার কখনো ওয়াদা ভঙ্গ করে না।”
.
.
তীর্থ বিরক্তি নিয়ে কল কেটে আবার এলো মৃণার কাছে। এসে বলল, “তোমার তো বুঝা উচিত একটা ছেলের সাথে এভাবে তুমি একা আসতে পারো না। তুমি বাসায় কী বলে এসেছ?”
মৃণা মাথা নিচু করে ইতস্ততভাবে বলল, “বলে…বলেছি যে এক বান্ধবীর বিয়েতে যাচ্ছি।”
“তুমি এমন মিথ্যা বলবে এই আশা আমি করি নি। আচ্ছা যাই হোক, তুমি আমাকে এসব ফাইলগুলো আমাকে বুঝিয়ে দিয়ে চলে যাও।”
মৃণা প্রস্তুত ছিলো। সে জানতো তীর্থের এমন কথা বলবে। তাই সে কাঁচুমাচু হয়ে বাহানা করে, “ধ্রুব স্যারের কথায় তোয় আমি মিথ্যা বলে আসলাম। এখন গেলে আরও সমস্যা হবে। হাজারো প্রশ্ন করবে সবাই। আর আইদ যদি জানে আমি মিথ্যা বলেছি তাহলে বিশাল সমস্যা হবে।”
“তাহলে রুপার বাসায় যেয়ে থাকো দুইদিন।”
“ওর পরিবারকে কী বলব? যদি মা’য়ের সাথে কথা বলতে চায়।”
তীর্থ মাথায় হাত রেখে বলল, “কোথায় ফেঁসে গেলাম আমি!”
“আপনার সমস্যা হলে আমি ফিরে যাব। আমার জন্য আপনার চিন্তা হোক, আমি চাই না।” মৃণা জানে, এই কথাটাই যথেষ্ট। এখন তীর্থের তার জন্য মায়া হবে। তীর্থ এমনিতেই এই কয়েক মাসে তার প্রতি একটু হলেও দুর্বল হয়ে পড়েছে। তা ভালো করেই বুঝতে পারে মৃণা।
সে যা ভাবলো তাই। তীর্থ তাকে বলল, “ঠিকাছে, আসো।”
বলে গাড়িতে উঠে যায় তীর্থ। মৃণাও যায় তার পিছু পিছু। ব্যাকসিটে তার ব্যাগ রেখে তীর্থের পাশে বসে। তারপর বলে, “থ্যাঙ্কিউ।”
সিলেট পৌঁছাতে তাদের সময় লাগে সাতঘন্টার মতো। সেখানে একটি হোটেলে দুটো রুম নেয় তাঁরা। হোটেলের কর্মচারীরা তো এভাবে তাকিয়ে ছিলো যেন তারা এমন কিছু আগে দেখে নি। একটা ছেলে তো রুমে ব্যাগ রেখে যাওয়ার সময় বলেই ফেলে, “সাহেব ভাবির সাথে ঝগড়া হইসে না’কি? আলাদা রুমে থাকেন কেন?”
তীর্থ সাথে সাথে বিরক্ত হয়ে উওর দেয়, “ও আমার অফিসে কাজ করে। কাছে এসেছি আমরা। আর তুমিও নিজের কাজ করে এইখান থেকে যাও। আর হ্যাঁ, দুইজনের রুমে রাতের খাবার দিয়ে যেও।”
বলেই চলে গেল তীর্থ নিজের রুমে। মৃণা নিরাশ হয়। ভারী নিরাশ। সুযোগ পেয়েও হাতছাড়া করবে এমন কোনো পুরুষ সে আগে দেখে নি। তীর্থ কী একটু বেশি সৎ না বোকা?
পরেরদিন সকালেই মিটিং-য়ের জন্য রওনা দেওয়ার কথা। যেহেতু তীর্থ সিলেটের কোনো রাস্তা চিনে না তাই ড্রাইভারের অপেক্ষা করছে সে। যাদের সাথে মিটিং, তারাই পাঠাচ্ছে গাড়ি। এতক্ষণ সে কবিতার সাথে কথা বলল। কথা বলা শেষে ফোন রাখতেই দরজায় টোকা পড়ে। তীর্থ যেয়ে দরজা খুলতেই অবাক। মৃণা একটি সাদা রঙের শাড়ি পরে দাঁড়িয়ে আছে। সাদার সাথে রুপালি রঙের সব গহনা এবং হাল্কা সাজ। ঠোঁটে গাঢ় লাল লিপ্সটিক তাকে দেখে কতক্ষণ চোখ ফেরাতে পারে না তীর্থ। তার মনে পড়ে যায় কবিতাকে প্রথম সাদা শাড়িতে দেখার দৃশ্যটি। মৃণাকে অনেকটা তখনের কবিতার মতোই দেখাচ্ছে। এখন কবিতা পাল্টেছে। বাচ্চা হবার পর থেকে সে অনেক দিক থেকেই পরিবর্তন হয়েছে। স্বাস্থ্য বেড়েছে, মুখটা কেমন মলিন হয়ে গেছে, চোখের নিচে রাত জাগার কালি পড়েছে, আগের মতো আর উজ্জ্বলতা নেই কিন্তু তার মুখের মায়া ও স্নিগ্ধতা পরিবর্তন হয় নি। তার মুখের মতো মায়া এই জগতে অন্যকারো আছে বলে সন্দেহ তীর্থের।
মৃণা তীর্থকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে খানিকটা লজ্জা পায়। তার চোখে মুখে ছড়িয়ে আছে লজ্জার আভা। সে চোখ নামিয়ে বলে, “জায়গাটা সুন্দর তো তাই ভাবলাম শাড়িটা পরি। আমাকে কী বাজে দেখাচ্ছে?”
তীর্থের ঘোর ভাঙ্গে এই কথায়। সে অপ্রস্তুত হয়ে আশেপাশে তাকাতে থাকে। তারপর আমতা আমতা করে বলে, “না। নিচে চলো, ড্রাইভার আসা পর্যন্ত যেয়ে চা খাব।”
মৃণার মেজাজ খারাপ হলো। কোথায় সে তীর্থের সাথে কিছু একা সময় কাটাতে চায়, আর কিন্তু তীর্থ শুধু তার থেকে দূরে পালাচ্ছে। কিন্তু সে মেজাজ খারাপটা আসে তীর্থকে দেখাতে পাড়লো না। তাঁর কথামতো নিচে গেল কফি খেতে। সেখানে রেস্তোরাঁয় বসে চা খাওয়ার সময় অনেক পুরুষের নজরই এসে আটকাচ্ছিলো মৃণার দিকে। সে এমনিতেই রূপবতী। এর উপর তার শ্যামলা রঙে এই শুভ্র শাড়ি এবং সাজে সৌন্দর্য আরও বেড়ে গেছে। কিন্তু মৃণার নজর কেবল তীর্থের দিকে। এমনভাবে একত্রে বসে চা খাবার সময় তার নিজেকে তীর্থের স্ত্রী মনে হচ্ছিলো। ইশশ!
ভাবনাটা ভাবতেই মনটা ফুরফুরে হয়ে গেল মৃণার।
.
.
কাজ শেষ হতে হতে সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলো। সিলেটেও নিজের শো-রুমের একটা আউটলেট দেবার ইচ্ছা আছে তীর্থের। এছাড়া এখানে পোশাক কারিগরদের হাতের কাজ নিখুঁত তার কারখানায় তাদের কাজ দেখতে আসে সে। আসার সময় সে বেছে বেছে সেখানের সবচেয়ে সুন্দর তিনটি মনিপুরী শাড়ি নিয়ে নেয় কবিতার জন্য। মেয়েটার শাড়ির প্রতি ঝোঁক খুব বেশি। শাড়িগুলো দেখে সে খুশিতে নেচে উঠবে। তাকে শাড়িতে কল্পনা করতেই মনটা ফুরফুরে হয়ে যায় তীর্থের।
গাড়িতে উঠে অর্ধেক রাস্তা যাওয়া পর্যন্তই মৃণার নজর থাকে শাড়িগুলোর উপর। সে ভেবেছিলো তীর্থ তার জন্য শাড়ি নিচ্ছে। কিন্তু জিজ্ঞেস করায় সে বলে শাড়িগুলো কবিতার জন্য। মুহূর্তে তার মেজাজ খারাপ হয়ে যায়। মুখ ফুলিয়ে সে আসে এতখানি পথ। কিন্তু তীর্থের তা খেয়ালও করে নি। অবশেষে সে না পেরে বলল,
“কবিতা আপু অনেক লাকি।”
“হঠাৎ এ কথা?”
“এই’যে আপনি তার এত খেয়াল রাখেন। আইদ তো আমাকে কোনদিন একটা চকলেট কিনে দেয় নি। কবিতা আপু আসলেই ভাগ্যবান। ”
কথাটা বলে মন খারাপ করে বসে রইল মৃণা।
তীর্থের বেশ খারাপ লাগলো তার জন্য। শাড়ির প্যাকেটটা এগিয়ে দিয়ে মৃণাকে বলল, “এখানে তিনটা শাড়ি আছে একটা পছন্দ করে তুমি রাখতে পারো।”
“না, না আমি এজন্য বলিনি। প্রয়োজন নেই।”
“অসুবিধা নেই রাখো।”
মৃণা আর কথা বাড়ায় না। প্যাকেটটা হাতে নিয়ে দেখে সেখানে তিনটি রঙের শাড়ি। কমলা, বেগুনি এবং গাঢ় নীল। সে জানে তীর্থের পছন্দের রং বেগুনি। তাই সে ওই শাড়িটাই নিল। তারপর বলল, “অনেক অনেক ধন্যবাদ।”
তীর্থ জোরপূর্বক হাসে। এই শাড়িতে কবিতাকে দেখার ভীষণ ইচ্ছা ছিলো তার। কিন্তু মৃণার মন খারাপ করা রয়েছে তার হলো না। তীর্থ প্রায় ঘুমিয়েই গিয়েছিল। মাঝরাতে তুফান এলো। আকাশে বজ্রপাত হচ্ছে। চারদিকে বাতাসে ছড়াছড়ি। তীব্র বাতাসের জানালাগুলো নড়তে থাকে। শব্দে ঘুম ভেঙ্গে যায় তীর্থের। সে উঠে জানালাগুলো বন্ধ করলো। আবারও যেয়ে ঘুমানোর জন্য চেষ্টা করে। চোখ লেগে আসতেই দরজায় টোকা পরে।
সময় কে এলো?
তীর্থ উঠে দরজা খুলে দেখে দরজার সামনে মৃণা দাঁড়ানো। আজকের তার দেওয়া শাড়িটি পরে।
“তুমি এত রাতে এখানে কি করছ?”
মৃণা কাঁচুমাচু হয়ে বলল, “আমার প্রচুর ভয় করছে রুমে একা থাকতে। গতকাল রাতেও ঘুমাতে পারিনি। আরও আজ বজ্রপাত হচ্ছে। আমার প্রচুর ভয় করে। আমি আজ রাত আপনার রুমে থাকতে পারি? আপনি ঘুমান আমি সোফায় বসে থাকব।”
এক অস্বস্তিতে পড়ে গেল তীর্থ। তাদের মাঝে একরাত কেটেছে। এর উপর আজ একইরুমে পরনারীর সাথে কাটানোর বিষটা কেমন যেন। এর উপর আবার তাকে ভালোবাসে মৃণা। কিন্তু আবার কথা হচ্ছে, সাজেকের সে রাতের কথা একটিবার কাওকে বলে নি সে। তীর্থ কোনো এক ভাবে তার কাছে দায়ী। তাই তাকে মানা করার সাহসও তার হলো না।
“আসো। তুমি বিছানায় ঘুমাও। আমি সোফায় ঘুমাচ্ছি।”
“সিঙ্গেল সোফাতে আপনি কীভাবে ঘুমাবেন। একই বিছানায় ঘুমাতে আমার সমস্যা নেই। বিছানাটা তো বড়। কাছে না এলেও হলো। আর এমনও তো না যে আগে আমরা….” বলতে বলতেই থেমে গেল মৃণা। তারপর ইতস্ততভাবে বলে, “আমার সে কথা তোলার উদ্দেশ্য ছিলো না।”
তীর্থ বিশেষ প্রতিক্রিয়া দেখায় না। সে শান্ত গলায় বলে, “তুমি যেয়ে বিছানায় ঘুমিয়ে পড়ো।”
বলেই তীর্থ সোফায় যেয়ে বসে পড়ে।
মৃণা কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রয় সেখানে। আজ সে তীর্থকে নিজের করেই ছাড়বে। নিজের ভালোবাসায় তীর্থকে এভাবে ডুবিয়ে দিবে যেন কবিতাকে তার ভাবনাতেও না আনে। এতমাস ধরে এমন এক সময়ের অপেক্ষায় ছিলো সে। আজ পেয়ে তো এভাবে ছেড়ে দিতে পারে না।
মৃণা যেয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ে। সেখানে শুয়েও তাকিয়ে রইলো তীর্থের দিকে। কিছুক্ষণ পর উঠে দেখে তীর্থ বসে থাকতে থাকতেই ঘুমিয়ে পড়েছে। সে উঠে যায় তীর্থের কাছে। চোখ বন্ধ করে থাকা তীর্থের দিকে ঝুঁকে তাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে থাকে। মুগ্ধ নয়নে। তারপর আলতো করে ছুঁয়ে দেয় তার মুখখানি।
হঠাৎ করেই চোখ খুলে তীর্থ, “কী করছ তুমি?”
মৃণা একটু চমকে উঠে। দুই’পা পিছিয়ে যায়।
তীর্থ কঠিন গলায় জিজ্ঞেস করে, “তোমাকে আমি ঘুমাতে বলেছি। তুমি এখানে কি করছ?”
“ওই…আসলে…আসলে আমার চেইনটা খুলতে পারছিলাম না। অস্বস্তি লাগছে। খুলে দিবেন একটু?”
মৃণা তীর্থের পাশে বসে তার চুলগুলো কাঁধের একপাশে নিয়ে এলো। উন্মুক্ত হয়ে গেল তার পিঠ।
আকস্মিকভাবে মৃণার এমনটা করায় চমকে উঠে তীর্থ। সে চোখ সরিয়ে নেয় প্রথমেই। তার এই মুহূর্তে ধমক দিয়ে সরিয়ে দেওয়া উচিত ছিলো মৃণাকে। কিন্তু সে পাড়ল না। সে মৃদু স্বরে বলে, “ঢাকা যেয়ে খুলে নিও।”
মৃণা তীর্থের কন্ঠ শুনেই বুঝে নেয় তীর্থ রেগে নেই। সে তার পরিকল্পনা সত্যি করবার সাহস পেয়ে গেল। সে বলল, “আমার খুব অস্বস্তি লাগছে। প্লিজ খুলে দিন।”
না চাওয়া সত্ত্বেও তীর্থের দৃষ্টি বারবার যাচ্ছিলো মৃণার ঘাড়ে। কেন যেন তার হৃদস্পন্দন বাড়লো। নিশ্বাস ঘন হয়ে এলো তার। সে কাঁপা-কাঁপা হাতে মৃণার লকেট খোলার জন্য হাত বাড়ায়।
কবিতার কাঁধে একটা তিল রয়েছে। সে তিলটা কবিতার প্রতি তাকে খুব বেশি আকর্ষণ করে। কিন্তু মৃণা সে তিনটা মৃণার না থাকা সত্ত্বেও মৃণার এই স্থানে ভীষণ আকর্ষণ অনুভব করছে সে।
তার আবারও চোখের সামনে ভেসে উঠে কবিতার কথা। কথার কথা ভাবতেই সে নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করে। মৃণা অনেকটা তাকে কবিতার কথা মনে করিয়ে দেয়। এই কারণেই মৃণার প্রতি মাঝেমধ্যে দুর্বল হয়ে পড়ে সে। কিন্তু সে নিজেকে সামলে নেয়। তার হাত পিছিয়ে নিয়ে বলে, “আমি পাড়ব না। তুমি ঢাকা যেয়ে খুলে নিও।” বলেই উঠে যায় সে। মৃণাও উঠে তার পিছু নেয়। সে যেয়ে হাত ধরে নেয় তীর্থের, “আপনি কী আমার থেকে রাগ করেছেন?”
তীর্থ তাকায়ও না মৃণার দিকে। তার মনে হচ্ছে ধ্রুবর কথাটাই ঠিক প্রমাণিত হচ্ছে। সে না চাওয়া সত্ত্বেও আকর্ষণ অনুভব করছে মৃণার প্রতি। এটা বেঠিক। তার তো এমন অনুভব করা উচিত না। সে কেবল কবিতাকে ভালোবাসে। কেবল কবিতাকে।
মৃণা পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে তীর্থের মুখ দুইহাতের মাঝে ধরে বলে, “প্লিজ আপনি আমার সাথে রাগ করবেন না। আপনার রুক্ষতা আমার সহ্য হয় না।”
মৃণাকে বেশি কাছে আসতে দেখে তীর্থে তাকে দূরে সরিয়ে দেয়। বলে, “মৃণা তোমার হঠাৎ কী হলো? এমন করছ কেন?” দেখ আমার বিবাহিত এবং তোমার বিয়ে অন্যকারো সাথে ঠিক করা। আমাদের দুইজনের এক সীমানা আছে। নিজের সীমানায় থাকো।”
এই কথা শুনে শব্দ করে কেঁদে উঠে মৃণা, “প্লিজ আপনি আমার সাথে এমন করবেন না। আমার কষ্ট হয়। আমি ভালোবাসি আপনাকে।”
“আমি বিবাহিত মৃণা। কথাটা মাথায় ঢুকে না তোমার? কাল এইখান থেকে যাবার পর তুমি নিজের কাজ ছেড়ে যাচ্ছ। তোমাকে অন্য অফিসে কাজ দিব আমি।” আর্তনাদ করে উঠে তীর্থ। কিন্তু মৃণার উপর এতে কোনো প্রভাব পড়লো না। সে উঁচু হয়ে চুমু খেতে চাইলো তীর্থ। তীর্থ আবারও সরিয়ে দেয় তাকে। অবশেষে মৃণা তীর্থের দুইহাত ধরে নিজের গালে রেখে তীর্থের সাথে নয়নবন্ধন করে বলল, “আপনি আমার চোখে তাকান। আপনি এই চোখে আপনার প্রতি ভালোবাসা দেখতে পান না। আমি আপনার জন্য যেকোনো সীমানা লঙ্ঘন করব। সারা পৃথিবী ছেড়ে দিব। তবুও আপনি আমাকে নিজের থেকে দূরে পাঠাবেন না।”
চলবে….
[