মৃত কাঠগোলাপ পর্ব -৩৭+৩৮

#মৃত_কাঠগোলাপ – ৩৭
#আভা_ইসলাম_রাত্রি
_________________________
এ কি করছে আয়েশী? পাপ করছে না তো? মৃদুলকে ভালোবেসে অন্য কাউকে স্পর্শ করতে আয়েশীর বুক কেঁপে উঠল না? ছিঃ! নিজের প্রতি প্রচন্ড ঘৃণাবোধ আয়েশীর মনের ভেতরের সমস্ত অনুভূতি দুমড়ে মুচড়ে দিল। আয়েশী ধ্রুবর বুকে ধাক্কা দিল। প্রচন্ড জোড়ে! আয়েশীর হঠাৎ ধাক্কায় ধ্রুব ছিটকে পড়ল মাটিতে। মাটিতে এক হাত ঠেসে ধ্রুব হতভম্ব হয়ে চাইল। আয়েশীর আচমকা ধাক্কা ধ্রুবর মস্তিষ্ক অচল করে দিল। ধ্রুবর ভ্রু কুঁচকে আছে। আয়েশীর এমন কঠিন সময়ে বিরক্ত করা ধ্রুবকে রাগিয়ে তুলছে। ধাক্কা দেয়ার সময় পেল না? ধ্রুব যখন আয়েশীর অধরে সম্পূর্ণ পাগল হয়ে মেতে ছিল, তখনই ধাক্কাটা দিতে হল? রাবিশ মেয়ে!
আয়েশী রাগে কাঁপছে। তার নরম দেহের থরোথরো কাঁপুনি ধ্রুব স্পষ্ট দেখতে পারছে। ধ্রুব এগিয়ে আসতে চাইল। আয়েশী চিৎকার করল, ‘ এগুলে মেরে ফেলব একদম। ‘
ধ্রুব থেমে যায়। আয়েশী উন্মাদ হয়। দু হাতের তালু দ্বারা ঘষে ঠোঁট হতে ধ্রুবর স্পর্শ মুছে ফেলতে চায়। সম্ভব হলো কি? হলো না। আয়েশী পারল না ধ্রুবর স্পর্শ নিজের ঠোঁট হতে মুছে ফেলতে। এই তো, এখনো আয়েশী অনুভব করতে পারছে ধ্রুবর গরম গরম নিঃশ্বাস, ধ্রুবর অস্থির স্পর্শ, ধ্রুবর বেহায়া চঞ্চলতা! তবুও নাছোড়বান্দা আয়েশী বারবার ঘষতে লাগল ঠোঁট। এতে যদি ধ্রুবর স্পর্শ মুছে যায়!
ধ্রুব আয়েশীর পাগলামি দেখে রাগে ফেঁটে পড়ে। অথচ মুখশ্রী স্বাভাবিক করে আয়েশীর হাত আটকে ফেলে। আয়েশী রক্তলাল চোখে তাকায় ধ্রুবর দিকে। যেন এখনি ধ্রুবকে আস্ত চি’বিয়ে খেতে ফেলবে সে। ধ্রুব মৃদু স্বরে আয়েশীর ঠোঁটে আঙ্গুল বুলিয়ে বলে, ‘ আর ঘষবে না। ঠোঁট কেঁটে যাবে। ‘
আয়েশী ধ্রুবর কলার চেপে ধরে! ধ্রুব ঘাড় কাত করে কলারের দিকে চায়। ধ্রুব অতি শান্ত সুরে জানায়, ‘ আয়েশী, কলার ছাড়ো। ‘
আয়েশী ছাড়ে না। বরং চেঁচিয়ে উত্তর করে, ‘ ছাড়ব না। আপনার সাহস কি করে হয় আমাকে স্পর্শ করার? ‘
ধ্রুব চোখ বুজে রাগ নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে। বলাবাহুল্য, ধ্রুবর নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা প্রশংসনীয়! আয়েশীর কারণে ধ্রুব যতবার রাগ করেছে, অন্যান্য মেয়ের বেলায় ধ্রুব তার এক ফোঁটা রাগ করে নি। অন্যান্য মেয়েদের ধ্রুব তার সামনে গলা উঁচু করে কথা বলার সাহস দেয়নি। যে ধ্রুবর সামনে গলা উঁচু করেছে, সে নিজের প্রাণ হারিয়েছে। তবে আয়েশীর বেলায় তা ব্যতিক্রম। আয়েশী সেসব পেরেছে, যা অন্যান্য মেয়েরা পারে নি। ধ্রুব আয়েশীকে চাইলেও অন্যান্য মেয়েদের ন্যায় আঘাত করতে পারে না। ধ্রুবর ন্যায় ভয়ংকর পুরুষটি অত্যন্ত দুর্বল তার জীবনের প্রিয় নারীর ক্ষেত্রে!
ধ্রুব ঘুর্নাক্ষরে ভাবেনি, তার জীবনেও এমন নারী আসবে। যার সামনে ধ্রুব মাথা নত করবে, হেরে যাবে, দুর্বল হবে, ভালোবাসবে। তবে আজ? ধ্রুবর একটাই প্রার্থনা, আয়েশী, এ নারীর পায়ে যেন ধ্রুবর জীবন কুরবান হোক! এ কি সময়ের লীলাখেলা! সবাই বলে মানুষ রহস্যময়! তবে ধ্রুব আজ বলছে! মানুষ নয়, সময় হচ্ছে এই পৃথিবীর সবচে রহস্যময়।
আজকের সময়, কাল পৌঁছে মুহূর্তেই মুখোশ বদলে ফেলে। কালকের সময় কেমন হবে, কেউ তার রহস্য ভেদ করতে পারে না। সময়কে ঘিরে মানুষের কৌতুহলের শেষ নেই। যেদিন মানুষ সময়কে জয় করে নিয়ে পারবে, সেদিন মানুষ পৃথিবী ছাড়িয়ে মহাকাশে ত্রাস চালাবে।

ধ্রুব চোখ উল্টে বিড়বিড় করে, ‘ আমি কিছু করতে চায়নি। তুমি বাধ্য করেছ। এখন যা হবে, তার জন্যে তুমি দায়ী। ‘
আয়েশী বুঝতে পারে না ধ্রুব কি বোঝাতে চাইছে। আপাতত সে রাগ পুষতে ব্যস্ত। চোখ দিয়ে যেন আগুন ঝড়ছে। ধ্রুব আয়েশীর রাগান্বিত চোখে একপল চেয়ে চট করে আয়েশীকে কোলে তুলে নেয়। আয়েশীর চোখ ছানাবড়া হয়। ধ্রুবর বুকের মধ্যে ক্রমাগত ঘুষি দেয়। অথচ ধ্রুব নির্বিকার। সে স্থির চিত্তে আয়েশীকে নিয়ে সেই পরিত্যাক্ত কক্ষ ছেড়ে বেরিয়ে যায়।
___________________________
হোটেলে ফিরে নিজেদের কক্ষে এসে ধ্রুব থামে। এতক্ষণে আয়েশী ধ্রুবকে পালাক্রমে আক্রমন করেছে। যার দরুন ধ্রুবর শক্তি কমে গেছে। ধ্রুব আয়েশীকে নিয়ে ধাম করে বিছানায় ফেলে দিল। আয়েশী ছাড়া পেয়ে উঠে বসল। চেঁতে উঠে ধ্রুবকে আঘাত করতে উদ্যত হল। তবে ধ্রুব সরে গেল। হাত ঘড়ি খুলতে ব্যস্ত হয়ে বলল, ‘ যাও, শাওয়ার নিয়ে নাও। নোংরা জায়গা থেকে এসেছ। শরীর নোংরা হয়ে আছে। ‘
আয়েশীর চোখ বেয়ে টপ করে এক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল। ধ্রুবকে সে কখনোই হারাতে পারে না। কেন পারে না? ধ্রুব কেন আয়েশীর থেকে পাঁচ কদম এগিয়ে থাকে?
‘ কারণ আমি ধ্রুব। ধ্রুব হচ্ছে চিতা বাঘের ন্যায়। যার মস্তিস্কের গতি তোমাদের মত ক্ষুদ্র মনুষ্য থেকে বহুদূর প্রসারিত। ‘
আয়েশী ধ্রুবর দিকে চায়। ধ্রুব আয়নায় নিজেকে দেখছে। শার্ট খুলে উদোম শরীরে মেডিসিন লাগাচ্ছে। আয়েশী একপল ধ্রুবর পেটানো দেহের দিকে চাইল। সঙ্গেসঙ্গে আঁতকে উঠল আয়েশী। উপরওয়ালা কি নিজ হাতে ধ্রুবকে তৈরি করেছেন। মেধা, মনন, বুদ্ধি, সৌন্দর্য্য, কোনো কিছুতেই কি কার্পণ্য করেন নি? ধ্রুবর পেটানো, বলিষ্ট দেহ যে কোনো নারীর মন চুরি করে ফেলতে পারে। দু হাতের বাহু ফুলে ফেঁপে ঢোল হয়ে আছে। পিঠের অংশতে স্পষ্ট মাসেলসমূহ। ধ্রুবর পিঠে কয়েকটি স্থান জ’খম হয়ে আছে। বোধহয় আজ আয়েশীকে বাঁচাতে গিয়ে ধ্রুব আঘাত পেয়েছে। ধ্রুব সেই আঘাতপ্রাপ্ত স্থানে মলম দিচ্ছে।
‘ আমার বডি দেখে কি ম্যাডামের রাগ ভ্যানিশ হয়ে গেছে? ‘
ধ্রুব আয়নার দিকে চেয়ে খানিকটা কৌতুক করে বলল। আয়েশী থতমত খেয়ে দ্রুত চোখ সরিয়ে নিল। ধ্রুব দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে, চোখ সরু করে আয়েশীর দিকে চেয়ে আছে। আয়েশী কেন যেন লজ্জা পেয়ে গেল। লজ্জায় জমে গেল পা দুখানা। দ্রুত পালিয়ে গেল বাথরুমে। পেছন থেকে ধ্রুবর অট্টহাসি শুনে হৃদয়ে ঢেউ খেলে গেল। পায়ের মত হৃদয়ও বুঝি জমে গেল? ইশ!

আয়েশী আয়নার সামনে এসে দাঁড়াল। পরিষ্কার ফকফকা আয়নায় নিজেকে নিখুঁতভাবে পর্যবেক্ষণ করল। হঠাৎ করে ও উপলব্ধি করল, এই যে আয়নার সামনে যে আয়েশী দাঁড়িয়ে আছে, তাকে আয়েশী চেনে না। এ এক অন্য আয়েশী! এই আয়েশী মৃদুলকে ঘৃনা করে। তার অবচেতন মনে ধ্রুবকে নিয়ে ভাবে। আয়েশী কি ধ্রুবকে পছন্দ করে? ছিঃ,ছিঃ! ভাবলে আয়েশীর গা গুলায়। সে আর ধ্রুব, হতেই পারে না। কিন্তু কেন হতে পারে না? ধ্রুব আয়েশীকে পছন্দ করে। আয়েশী কি একবার চেষ্টা করবে ধ্রুবকে পছন্দ করার? কি লাভ মৃদুলকে ভেবে আয়েশীর কাঁটা ঘাঁয়ে নুনের ছিঁটে দেবার। মৃদুল তো আয়েশীকে কখনো ভালোবাসতো না। আয়েশী মৃদুলের কাছে শুধু এক মরীচিকা ছিল। একজন ভুল মানুষকে ভেবে, আয়েশীর সারাজনম আফসোস কেন করবে ? কেন ধ্রুবর ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত হবে? যে ঘৃনা করেছে তাকে ভেবে, যে ভালোবেসেছে তাকে অবহেলা করার কি প্রয়োজন? বরং যে ভালোবেসেছে তাকে আঁকড়ে ধরে বাঁচাটাই কি বুদ্ধিমানের কাজ নয়? অবশ্যই!
আয়েশী বুঝতে পারছে না কি করা উচিৎ তার! ধ্রুব, মৃদুল! ধ্রুব, মৃদুল! এই দুই পুরুষের দ্বন্ধে আয়েশী পিষে! আয়েশী অনেকক্ষণ নিয়ে চোখে মুছে পানি ছেটালো। ওড়না গায়ে জড়িয়ে বেরিয়ে এল বাথরুম থেকে। ধ্রুব তখন বারান্দায়। ইজি চেয়ারে দুলছে। চোখ দুখানা বন্ধ! এই প্রথম আয়েশী লক্ষ্য করল, ধ্রুব দেখতে ভয়ংকর সুপুরুষ! ধ্রুবর দিকে একবার চাইলে চোখ ফেরানো মুশকিল! এই যে আয়েশী এখন চোখ ফেরাতে পারছে না, কেন পারছে না? তার কারণ, ধ্রুবর ঘন পাঁপড়ি, তার বুজে থাকা চোখ, চাপা মুখ, গলার মধ্যখানে উঁচু হয়ে থাকা অংশ! সবকিছু আয়েশীকে ভীষন রকম টানছে।

‘ এভাবে না দেখে, কাছে এসে বসলেও তো পারো। ‘
ধ্রুব চোখ বুজে ঠোঁট নাড়িয়ে বলল। ধ্রুব তো চোখ বুজে আছে। তাহলে সে বুঝল কি করে আয়েশী তাকে দেখছিল! ধ্রুবর কি মাথার পেছনে আরো দুখানা চোখ আছে? হবে হয়তো! ধ্রুবর জন্য অসম্ভব কিছু না। আয়েশী পা টিপে টিপে ধ্রুবর পাশের চেয়ারে বসল।
ধ্রুব এবার চোখ খুলে তাকাল। আয়েশীকে আপদমস্তক গভীর ভাবে দেখে বলল, ‘ শাওয়ার নাও নি? ‘
আয়েশী মাথা নেড়ে না বোধক উত্তর দিল। আয়েশী উশখুশ করছে। হাত দুখানা একসাথে বেঁধে ঘষছে। ধ্রুব ভ্রু বাঁকিয়ে আয়েশীর হাত নাড়ানো দেখল। অতঃপর নেশাকণ্ঠে বলল, ‘কিছু বলবে? ‘
আয়েশী দম ফেলল। মনে হল, ভেতরে এক টন নিঃশ্বাস আটকে আছে। আয়েশী যেন মাত্রই তাদের মুক্ত করল। ধ্রুব ভ্রু কুঁচকে চেয়ে আছে আয়েশীর দিকে।। আয়েশী এবার ধ্রুবর চোখে চোখ রাখল। অতঃপর বলল,
‘ আমি আপনাকে একটা সুযোগ দিতে চাই। আমি চাই, আপনি আমার মন থেকে মৃদুল নামক অভিশাপকে চিরতরে মুছে ফেলুন। আমাকে এমন ভালোবাসুন, যেন আমি ভুলে যাই আমার অতীতের সমস্ত জঘন্য স্মৃতি! আমি চাই, আপনি আমার দেওয়া এই সুযোগকে কাজে লাগান। আমার মন ভাঙার কারণ না হোন। একবার আমি হেরেছি, বারবার হারতে পারবো না। আমার মধ্যে সে শক্তি আর নেই। অনেক কষ্টে আমি নিজের মনকে বুঝিয়েছি। দয়া করে আমার মনকে আবার ভেঙে ফেলবেন না। আমি মরে যাব তবে! ‘

আয়েশী কাদঁছে। ধ্রুব অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে আয়েশীর দিকে চেয়ে। সে কি ঠিক শুনছে? তার কান তার সাথে কি বে’ইমানি করছে? যে ভালবাসা পাওয়ার জন্যে সে এতদিন যন্ত্রণায় ছটফট করেছে, নীচু থেকে নীচু স্তরে নেমেছে, খারাপ থেকে খারাপ হয়েছে, সে ভালোবাসা তাকে এখন হাত নেড়ে ডাকছে। ধ্রুবর শকুনি মস্তিষ্ক অচল হয়ে রইল। কিছু মাথায় প্রবেশ করছে না! মাথা ভনভন করছে!
#মৃত_কাঠগোলাপ – ৩৮
#আভা_ইসলাম_রাত্রি
______________________________
ধ্রুব, একজন নিখুঁত পরিকল্পনাকারী ব্যক্তি। আজ অব্দি সে যে ছক সাজিয়েছে, তা দুর্দান্ত ভাবে সফল হয়েছে। আয়েশী হলো ধ্রুবর জীবনের সবচেয়ে জটিল একটি কেইস! ধ্রুব ভেবেছিল, আয়েশীকে অর্জন করা তার বা হাতের খেল। যে উপায়ে সে অন্যান্য মেয়েদের বশ করেছে, একই উপায়ে সে আয়েশীকে বশ করতে সক্ষম হবে। অথচ ধ্রুব ভুল ছিল! আয়েশী ছিল একটি ছোট্ট বৃত্ত! যাকে কেন্দ্র করে অনবরত ঘুরপাক খাচ্ছে মৃদুল নামক এক শক্ত প্রাচীর! ধ্রুব যখন আয়েশীকে ছুঁতে চেয়েছে, মৃদুল তখন তার প্রাচীর তুলে আয়েশীকে রক্ষা করেছে। ধ্রুব পারেনি আয়েশীকে তার বশে আনতে। তাই সে ভেবেছে, যদি না থাকে প্রাচীর, কেন্দ্র হয়ে পড়বে একা, মলিন, দুর্বল! প্রাচীরের অভাবে কেন্দ্র যখন ধুঁকে ধুঁকে মরবে, ধ্রুব তখন কেন্দ্রকে ছুঁয়ে দিবে। বশীভূত করবে নিজের ইন্দ্রজালে! হ্যাঁ, ধ্রুব তাই করেছে! মৃদুল নামক প্রাচীরকে ধ্রুব উপড়ে ফেলেছে। ছুঁড়ে ফেলেছে নর্দমায়! যে নর্দমা ঘৃণা দ্বারা বেষ্টিত! যে নর্দমা ঘৃণার কাছে পরাজিত! অতঃপর ধ্রুব বহু ত্যাগ তিতিক্ষা করে আয়েশীকে নিজের করেছে। আজ, এখন, এই মুহূর্ত থেকে আয়েশী ধ্রুবর! ধ্রুবর এতদিনের কঠোর পরিশ্রম সফল হয়েছে। ধ্রুব অবশেষে আয়েশীকে অর্জন করেছে। হা হা হা, মৃদুল কি বিভৎস ভাবেই না হেরে গেলে। আয়েশী মেয়েটা অবশেষে ধ্রুব নামক জঘন্য লোকে প্রেমে পড়ল!

আয়েশী শির অবনত করে বসে রয়েছে। পিঠ ঠেকিয়ে দিয়েছে চেয়ারের শক্ত হাতলে! আঁখিদ্বয় ছলছল, টলমল! বৃষ্টিরা যেন ধেই ধেই করি খেলছে আয়েশীর ওই মায়াবী আঁখিদ্বয়ে! ধ্রুব আয়েশীর নরম মাখন ন্যায় হাত নিজের হাতে পুড়ে নিল। আয়েশীর গরম গালে হাত রেখে শুধাল,
–’ আয়েশী, তাকাও আমার দিকে! ‘

আয়েশী আঁখির পল্লব নেচে উঠে। পল্লবের ধাক্কায় চোখের কার্নিশ বেয়ে দু ফোঁটা জল গড়ায়। আয়েশী ঠোঁট চিপে ধ্রুবর দিকে দৃষ্টিপাত করে। গভীর একটি নিঃশ্বাস ছেড়ে ধ্রুব বলে,
–’ আমাদের প্রেমের শুরুটা খুব কঠিন ছিল, তাইনা আয়েশী? মানুষ সুখের লাগি প্রেম চাহে, অথচ প্রেম মেলে না। আমি তোমায় চেয়েছিলাম, পেলামও। তবে পেয়েও যেন পেলাম না। জীবনে আমি কোনো কিছু নিয়ে আফসোস করি নি। তবে আমার একটা বিষয়ে সারাজীবন আফসোস থেকে যাবে। যদি আমি মৃদুলের আগে তোমায় পেয়ে যেতাম! হয়তো আমাদের প্রেমের শুরুটা তখন অন্যরকম হত! আমাদের ছোট্ট একটা সংসার হত! বারান্দায় দু একটা কাঠগোলাপের চারা থাকত। কাঠগোলাপের সুভাসে গায়ে মেখে তুমি আমি প্রেমে মত্ত হতাম। অথচ তা হয়নি। তবে এখন যা হয়েছে, আমি তাতেই খুশি! তুমি আমার কাছে সর্বদা আমার গোটা জগৎ ছিলে। আমি তোমায় পেয়ে গেছি মানে সম্পূর্ণ দুনিয়ার সুখ পেয়ে গেছি। এখন আমার আর কিছুতে আফসোস নেই। ‘

ধ্রুব সমুদ্রের ন্যায় শান্ত, স্থবির দৃষ্টিতে আয়েশীর পানে তাকায়। ধ্রুবর চোখে এখন কতশত স্বপ্ন ভেসে বেড়াচ্ছে। চোখে আশার রংধনু জ্বলজ্বল করছে। আয়েশী চেয়ে রয় ধ্রুবর দিকে! ধ্রুব এমন কঠিন কথা বলছে কেন? ধ্রুবর মুখে প্রেমের বাণী, ইশ কি ভীষন অদ্ভুত! আয়েশীর মাথা বোধহয় ঘুরপাক খেল।
তবে ধ্রুব যে মিষ্টি আশ্বাসের কথা বলেছে, সে একই কথা মৃদুলও তো বলেছিল। আয়েশী মৃদুলকে নিজের চেয়েও বেশি বিশ্বাস করত। অথচ, আজ? আজ মৃদুল আয়েশীর সকল আশার উপর কাঁটাতার বিছিয়ে দিয়েছে। আয়েশীর অমূল্য আশাসমূহকে আয়েশীর সামনে পা দিয়ে পি’ষে ক্ষ’তবি’ক্ষত করেছে। ধ্রুবও কি এমন করবে? আয়েশী কি একবার বিশ্বাস করে দেখবে ধ্রুবকে?
বিশ্বাস না করে যে আর উপায় নেই! আয়েশীর জীবনের সকল প্রিয় মানুষ হারিয়ে গেছে! আয়েশী চায় না ধ্রুবও সবার মত আয়েশীকে ফাঁকি দিয়ে হারিয়ে যাক! ধ্রুব থাকুক, যতদিন আয়েশীর নিঃশ্বাস থাকে ততদিন ধ্রুবর আয়েশীর মনে উত্তপ্ত সূর্যের ন্যায় জ্বলজ্বল করুক! ঘৃনার মত নোংরা অনুভূতি যেন আয়েশীর মনে কখনো ঠায় না পাক!
ধ্রুব ক্ষুদ্র নিঃশ্বাস ছাড়ে। ধ্রুব মাথা চুলকে, মৃদু স্বরে বাচ্চাদের মত আবদার করে,
–’ আমি কি তোমায় একবার জড়িয়ে ধরতে পারি? ইফ ইউ ডোন্ট মাইন্ড! ‘

আয়েশী অশ্রুতে টুইটুম্বর মুখে মাথা তুলে চায়। মন খারাপকে পুঁজি করে মাথা কিঞ্চিৎ দুলায়। ধ্রুব যেন বিশ্ব জয় করেছে, ভূমণ্ডল, ভুনিম্ন সব যেন ধ্রুব হাতের মুঠোয় আজ! ধ্রুব দারুন করে হেসে আয়েশীকে টেনে চট করে নিজের কোলে বসিয়ে দেয়। আয়েশী হকচকিয়ে যায়। আচমকা ধ্রুবর এমন বেহায়াপনা কাজে হতভম্ব হয়! ধ্রুব আয়েশীর বাহু টেনে ধরে নিজের সাথে তার সাধের রক্তজবাকে মিশিয়ে ফেলে! আয়েশীর ঘাড়ে মুখ ডুবায়! ধ্রুবর উষ্ণ স্পর্শে আয়েশী থরথর করে কেঁপে উঠে। সর্বাঙ্গ যেন ভ’য়ংক’র ভাবে শিরশির করে উঠে। আয়েশী ধ্রুবকে জড়িয়ে ধরবে কি ধরবে না, দ্বিধায় পড়ে যায়। অতঃপর নিজের সাথে একপ্রকার যুদ্ধ করে ধ্রুবর পিঠে হাত গুলিয়ে দেয়। ধ্রুবর কাঁধে মাথা রেখে চোখের জল বিসর্জন দেয়। অশ্রুমাখা কন্ঠে বলে,
–’ ধ্রুব! প্লিজ, হাগ মি স্ট্রংলি। আমার শরীর থেকে মৃদুলের স্পর্শ মুছে দিন! মৃদুলের স্পর্শের কালো গন্ধে আমি ক্ষয় হয়ে যাচ্ছি। আমাকে বাঁচান! ‘

ধ্রুব মৃদু হাসে। অবশেষে সে সফল!
আয়েশী ধ্রুবকে নাম ধরে ডেকেছে। ধ্রুবর বুকে শীতল স্রোত বয়ে গেল। সম্পূর্ন দেহ মৃদুমন্দ কেঁপে উঠে। ধ্রুব স্পষ্ট শুনতে পায়, বারান্দায় প্রতিটা কোণায় আয়েশীর কণ্ঠে উচ্চারিত নিজের নাম!
ধ্রুব আয়েশীকে আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। আয়েশী যেন পিষে যায় ধ্রুবর বুকের সাথে। ধ্রুব যেন আজ আয়েশীর নরম দেহ নিজের বুকের ভেতর প্রবেশ করিয়ে ফেলবে। আয়েশীর কিছুটা কষ্ট হয়, দম বন্ধ হয়ে আসে। তবুও কষ্ট সহ্য করে পড়ে রয় ধ্রুবর বৃত্ত বুকের উপর!
ধ্রুব শুধু জড়িয়ে ধরে থামে না। প্রিয়তমাকে আরো গভীর ভাবে অনুভব করতে আয়েশীর ঘাড়ে মুখ ডুবায়! ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র চুমু দেয় আয়েশীর ঘাড়ে, কাঁধের আশপাশে। আয়েশীর পা থেকে রক্ত মাথায় উঠে যায়। মুঁচড়ে ধরে ধ্রুবর টিশার্ট! চোখের ক্যানভাসে ভাসে মৃদুলের হাস্যোজ্জ্বল মুখ! আয়েশী চোখ খিঁচে নেয়। বিড়বিড় করে বলে,
–’ আমি তাকে মনে করতে চাই না, কিছুতেই না, কিছুতেই না! ‘

একটুপর, ধ্রুব অনুভব করে আয়েশীর নিথরতা! আয়েশীর ঠান্ডা নিঃশ্বাস! কাঁধে আয়েশীর ঠান্ডা নিঃশ্বাসের অনুভবে ধ্রুবর পশম জেগে উঠে। ধ্রুব ভ্রু কুঁচকে আয়েশীর মুখ টেনে নিজের সামনে ধরে। আয়েশী জ্ঞ্যান হারিয়েছে! ধ্রুব ক্ষুদ্র নিঃশ্বাস ছাড়ে। সে জানে আয়েশী কেন জ্ঞ্যান হারিয়েছে। ধ্রুবর স্পর্শ আয়েশীর সহ্য হয়নি। আয়েশী মনেমনে ধ্রুবর স্পর্শে মৃদুলকে ভেবেছে। আয়েশী যত বলুক সে মৃদুলকে ঘৃনা করে, ধ্রুব জানে আয়েশী চাইলেও মৃদুলকে ঘৃনা করতে পারবে না। আয়েশীর সে শক্তি নেই! ধ্রুবকে আয়েশী মেনে নিয়েছে ঠিকই! তবে তার পেছনে এক গুরুত্বপূর্ন কারণ আছে। আয়েশী মৃদুলকে ভুলার জন্যে ধ্রুবকে আপন করেছে। ভেবেছে ধ্রুব পারবে আয়েশীর স্মৃতি থেকে মৃদুলের নাম চিরতরে মুছে দিতে। অথচ ধ্রুব আজ সামান্য স্পর্শ করতেই, আয়েশী মৃদুলকে ভেবে অচেতন হয়েছে। মেয়েটা অনুভূতির ক্ষেত্রে বড্ড নাজুক!
ধ্রুব ক্ষুদ্র নিঃশ্বাস ছেড়ে আয়েশীকে কোলে করে বিছানায় শুইয়ে দেয়! হোটেলের ল্যান্ডলাইনে ফোন করে ডাক্তার ডাকে!
ডাক্তার এসে আয়েশীকে চেকাপ করেন। অতঃপর ফরাসি ভাষায় বলেন,
–’ মিস্টার ধ্রুব, আমার মনে হয়, আপনার স্ত্রী খুব গভীর এক মানুষিক ট্রমায় আছেন। তার মস্তিষ্ক খুব আঘাত পেয়েছে। আপনি শুধু দেখবেন, তিনি যেন তার পুরনো আঘাতের বিষয় নিয়ে খুব বেশি চিন্তা না করেন। এতে তার উন্মাদ হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা প্রবল! ‘

ডাক্তার চলে যান! ধ্রুব আয়েশীর পাশে শুয়ে পড়ে। আয়েশীর চুলে হাত বুলিয়ে দেয়। আয়েশীর সুন্দর মুখশ্রীর দিকে চেয়ে রয় অপলক! ধ্রুবর কাছে আয়েশী হলো এই পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর নারী! পূর্বে ধ্রুব অনেক সম্পর্ক করেছে, তবে তাদের সবাই ছিল ধ্রুবর কাছে সস্তা! ধ্রুব যখন তাদের চেয়েছে, তারা অবলীলায় ধ্রুবকে সঙ্গ দিয়েছে। তবে আয়েশী ভিন্ন! আয়েশীকে ধ্রুব পায়নি। বরং অর্জন করেছে। পাওয়া আর অর্জন করা দুটোর মধ্যে কিঞ্চিৎ পার্থক্য আছে। যে পেয়েছে, সে হারায় না কখনো। আর যে অর্জন করেছে, সে পেয়েও একদিন না একদিন হারিয়ে ফেলে। আয়েশীকে পেয়েছে মৃদুল! আর ধ্রুব আয়েশীকে অর্জন করেছে। মৃদুল আয়েশীর কাছে খারাপ হওয়া সত্বেও আয়েশী মৃদুলকে মনে করে। তাহলে ধ্রুব? ধ্রুব কি একদিন আয়েশীকে হারিয়ে ফেলবে? ভয়ে আঁতকে উঠে ধ্রুব!

ধ্রুব আয়েশীর কপালে ঠোঁট বুলায়। ছোট ছোট স্পর্শ এঁকে দেয় আয়েশীর সম্পূর্ন মুখে! প্রিয়তমাকে ছুঁয়ে দেবার তৃষ্ণা যেন নেভে না, ক্রমশ বৃদ্ধি পেয়ে ধ্রুবর মনকে ঝলসে দেয়। ধ্রুব নিজেকে সামলায়। এখনও সময় আসে নি। আয়েশীর মনে প্রেমের ফুল সদ্য ফুটেছে। এখনি সেই ফুলকে ছুঁয়ে দিলে তা পরিণত হওয়ার পূর্বেই ঝড়ে পড়বে। সময় দিয়ে হবে, নিজেদের সম্পর্ককে! একদিন ধ্রুব আয়েশীকে ছুঁবে। ছুঁয়ে ছুঁয়ে আয়েশীর দেহে ডুবে যাবে। আয়েশীকে মাতাল করে নিজের মাতাল হবে! সেদিন কবে আসবে? আজ, কাল নাকি বহুদূর?
ধ্রুব আয়েশীর ঠোঁটের পাশে আঙ্গুল বুলিয়ে হুইস্কি কণ্ঠে বলে,
–’ আমাকে ছেড়ে যাবার সমস্ত পথ আমি বন্ধ করে দিব! দুনিয়া উল্টে দেব, ভূমণ্ডল ধ্বংস করে দেব, তবুও আমার তোকে চাই! তুই যতদিন আছিস, আমি আছি। তুই নেই, এই ধ্রুব ইউহান শেখও আর থাকবে না। প্রিয় রক্তজবা, আমার ভালোবাসার পরিমাপ তুই করতে পারবি না। পরিমাপের উর্ধ্বে আমার ভালোবাসা! আমার ভালোবাসার অর্জনের ধরন যেমন আলাদা, তেমনি আমার ভালোবাসা প্রকাশের ধরনও ভিন্ন! অতি শীঘ্রই তুই তা বুঝতে পারবি। ‘

#চলবে ( শব্দসংখ্যা- ১৩০০+)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here