মেঘদিঘির পাড়ে – ৩
মালিহা খান
অতন্দ্রিতা নয়নে জানলার লোহার শিকে কপাল ঠেকিয়ে দাড়িয়ে আছে তন্দ্রা। মেয়েটার চোখে ঘুমের ছিঁটেফোঁটা নেই। অপেক্ষারত চোখদুটো নিষ্পলক চেয়ে আছে বাড়ির লোহার ফটকে। সরফরাজ ফিরেনি এখনো। দীর্ঘক্ষণ একাধারে চেয়ে থাকায় চোখে জ্বলছে। তন্দ্রা চোখ বুজে। কোঁণ দিয়ে আচমকাই একফোঁটা তাজা জল গড়ায়। নাকের পাশ গড়িয়ে ঠোঁটের কাছে জমে। মানুষটা এতো ব্যস্ত থাকে। দু’দন্ড নির্ভার শ্বাস ফেলার সময় পায়না। বিয়ের পর থেকে আজপর্যন্ত খুব কম দিন আছে যে সরফরাজ তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরেছে। রাতের খাবারটা একসাথে খাওয়া হয়েছে। তন্দ্রার অভিযোগ করার জায়গা নেই। মা- বাবা, ছোট দুইবোন, বাহাদুর, তার, আবার এখনতো নতুন একজন আসছে, সবার খেয়াল রাখার অঘোষিত দায়িত্ব সরফরাজের। সে বাড়ির বড় ছেলে। মানুষটা একবিন্দু কমতি রাখেনা। বোনদুটোকে একটু হলেই চোখে হারায়। সরফরাজের বাবারা দুই ভাই। সরফরাজের বাবা বড়। ইউসুফের বাবা ছোট। সরফরাজ- ইউসুফ পিঠাপিঠি হলেও বিভারা তাদের চেয়ে অনেক ছোট।
তন্দ্রা একমনে ভাবে, এইতো বছরদুয়েক আগে তাদের যখন বিয়ে হলো, প্রথম রাতে প্রথম বারের মতোন শ্যামরঙা টানটান চেহারার টগবগে পুরুষটিকে দেখে তন্দ্রা ভেবেছিলো ইনি বোধহয় প্রচন্ড রাগি। সে তোতলাচ্ছিলো। ভয়ে গলা দিয়ে কথা অবধি বেরোচ্ছিলোনা। মনে হচ্ছিলো এই বুঝি দিলো ঘরকাঁপানো ধমক। কিন্তু না? তার অবস্থা দেখে উল্টো হো হো করে হেসে ফেলেছিলো সরফরাজ। মাথায় হাত রেখে সহজ গলায় বলেছিলো,”এই মেয়ে, এত ভয় পাচ্ছো কেনো? আমি কি মারবো নাকি তোমাকে? কসাই কসাই মনে হচ্ছে? ঘুমিয়ে পড়ো। ভয়ের কিছু নেই।”
তন্দ্রার ঘোর কাটে। হাতের পিঠে আলতো করে ঠোঁটের কাছে জমা জল মুছে পুনরায় ফটকে তাকাতেই দেখে দারোয়ান চাচা দরজা খুলে দিচ্ছে, গাড়ি ঢুকছে। সাদা গাড়ি। হেডলাইট নিভলো। তন্দ্রা দ্রুত গোসলখানায় ঢুকে। চোখে মুখে পানি দিয়ে আসতে আসতেই দেখে সরফরাজ খাটে বসে পান্জাবির বোতাম ছাড়াচ্ছে। তন্দ্রাকে দেখতেই ক্লান্ত শ্রান্ত নিচুস্বরে বলে,
-“তুমি ঘুমাওনি কেনো তনু? তোমার নামের সাথে তোমার বিন্দুমাত্র মিল নেই। তোমার বাবা কি দেখে তোমার নাম তন্দ্রা রেখেছে বলোতো? নামে ঘুম অথচ চোখে ঘুম নেই। তোমার নামটা বড় বেমানান। আমার কথা না শোনো, অন্তত নিজের নামের মান রাখার জন্য হলেও রাত দশটার মধ্য কম্বল জড়িয়ে ঘুমিয়ে পড়া উচিত তোমার।”
তন্দ্রা চোখমুখ কুঁচকায়,
-“আমার নাম বাবা রাখেনি, মা রেখেছে। আপনি সবসময় ভুল বলেন।”
-“উদ্ধার করেছে নাম রেখে! শোনো তনু, আমি ভেবেছি ক’দিন পর মেয়ের আকিকার সাথে তোমারও আরেকটা আকিকা করে দিয়ে দিবো। ভালো হবেনা?”
তন্দ্রা নাক ফুলিয়ে তাকালো। সরফরাজ আচমকাই শব্দ করে হেসে ফেলে। হাসতে হাসতেই বলে,”এখন আবার ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে কেঁদে দিওনা কিন্তু।”
তন্দ্রা মাথা নুইয়ে ফেললো। অধরকোঁণে ঠাঁই পেলো এক চিলতে নরম হাসি। কাছে যেয়ে বিছানা থেকে সরফরাজের পান্জাবি হাতে তুলে নিতেই কনুই চেপে তাকে কোলে বসায় সরফরাজ। তন্দ্রা আৎকে উঠে,
-“পাগল নাকি? আমার ওজন দেখেছেন?”
সরফরাজ হাসে। তন্দ্রার দু’গালে হাত রাখে। বড় হাতের আজলায় তন্দ্রার সেই ছোট্ট রক্তিম লাজুক মুখটা ভারী সুন্দর দেখায়। সরফরাজ অপলক চেয়ে থাকে অনেকক্ষণ। তন্দ্রা ধীরগলায় বলে,
-“ছাড়ুন, ভাত খাবেন না?”
সরফরাজ ছেড়ে দেয়। তন্দ্রা উঠে যেতেই ক্লান্ত গলায় বলে,”ভাত খাবোনা তনু। মাথা ধরেছে। ঘুমাবো।”
-“বিভা, ইভা জমজ না হয়ে আপনার আর ইভার জমজ হওয়া দরকার ছিলো। ভাইবোন দুজনে এক্কেবারে একরকম। ইভাটাও আজ ভাত খায়নি, মাথা ধরেছে বলে সেই ন’টা বাজে ঘুমিয়ে পড়েছে। দেখি সরুন, বিছানা করে দেই।”কথাটা বলেই বিছানা ঝাড়তে ব্যস্ত হয়ে পড়ে তন্দ্রা।
সরফরাজ চিন্তায় মগ্ন হয়। মনে মনে দীর্ঘশ্বাস ফেলে।
৭.
সকালে সরফরাজের ডাকে ঘুম ভাঙে ইভার। ভাইয়ের কন্ঠ কানে যেতেই পিটপিট করে চোখ মেলে সে। মাথাটা ভার হয়ে আছে এখনো। চোখদুটোতে কেমন দপ দপ ব্যাথা! বাহাদুর তাকে আষ্টেপিষ্টে জাপটে ধরে ঘুমাচ্ছে। ইভা আস্তে করে ঘাড় ফিরায়। ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে হাসার চেষ্টা করে। সরফরাজ একটু ঝুঁকে তার কপালে হাত রাখে। যাক ঠান্ডা! স্বস্তি মিলে।
ইভা আলতো করে বাহাদুরের হাত ছাড়িয়ে নেয়। সরফরাজ তাড়াহুড়ো করে বলার চেষ্টা করে,”উঠতে হবেনা..।”
কথা শেষ হয়না। তার আগেই উঠে বসে ইভা। নিচু স্বরে বলে,”বসেন ভাইজান। দাড়িয়ে আছেন কেনো?”
সরফরাজ বসলো। কোমল গলায় বললো,”এখন কেমন আছিস? শরীর খারাপ শুনলাম।”
ইভা বিরবির করে বলে,”শরীর খারাপ না ভাইজান, একটু মাথাব্যাথা হয়েছিলো।”
-“রাতে খাসনিও।”
ইভা অপরাধীর মতোন উওর দেয়,”ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।”
নড়চড়ে বসে সরফরাজ। কিয়ৎক্ষণ ইভার মুখে চেয়ে থেকে আলতো করে মাথায় হাত রাখে। বলে,
-“ওসব ভেবে শরীর খারাপ করছিস কেনো বুড়ি? বলেছি না ভুলে যেতে?”
ইভা মাথা নুইয়ে ফেলে। আস্তে করে বলে,
-“ভাইজান আপনি…ওকে…।”তার কন্ঠে সংকুচিত। স্বর বেরোচ্ছে না। চোখের পাতায় ঘুরপাক খায় জমিলার বর্ণনা করা মইদুলের সেই বিভৎস্য বর্ণণা। ভালো করেই জানে সরফরাজই করিয়েছে এমনটা।
-“ওই কু*** বাচ্চা তোকে…”। সরফরাজ হঠাৎই প্রচন্ড রেগে যায়। রক্তলাল হয়ে যায় চোখ। কপালের রগ ঠেসে উঠে।
ইভা চমকে ঘুমন্ত বাহাদুরকে দিকে তাকায়। ভীত গলায় বলে,” ভাইজান আস্তে, বাহাদুর উঠে যাবে।”
–
সেদিন প্রায় সন্ধ্যা হয়ে যাচ্ছিলো। বিশাল দিঘির সিঁড়িঘাটে মগ্ন হয়ে বসেছিলো ইভা। পাশে বাহাদুর। দিঘির সচ্ছ টলমলে পানিতে ইভার প্রতিচ্ছবিটাও তিরতির করে কাঁপছিলো। দিঘিটা বেশি দূরে নয়। বাড়ি থেকে দু’মিনিট লাগে যেতে। দিঘির পাড় থেকে তাদের দোতালা বাড়িটাও দেখা যায় স্পষ্ট। বিকেলের দিকে নিরিবিলি থাকে। ইভা মাঝেমধ্যেই একাকী যেয়ে বসে থাকে সেখানে। অনেকসময় বাহাদুরকে নিয়ে যায়। দিঘির শাপলা তুলে আনে। সরফরাজের বোন বলে কেও কোনোদিন ভুল করেও তার সাথে ভিড়ে না, ঘুনাক্ষরেও বিরক্ত করতে আসেনা। সেদিনও বসে ছিলো। মনটা খারাপ ছিলো বিধায় আসতেও ইচ্ছে হচ্ছিলো না। আর সেই অনিচ্ছাই কাল হয়ে দাড়িয়েছিলো।
সেদিনও বাহাদুরকে নিয়েই গিয়েছিলো ইভা। বাহাদুর হঠাৎ কনিষ্ঠআঙ্গুল দেখিয়ে প্রাকৃতিক বেগের ইশারা করলো। ইভা অনুমতি দিতেই একছুটে দৌড়ে চোখের আড়াল হয়ে গেলো। ইভা বসেই ছিলো। বাহাদুর ফিরছিলোনা দেখে একসময় ভ্রু কুঁচকে উঠে দাড়ায়। মাগরিবের আজান পড়ে যাবে যাবে। চারিদিক অন্ধকার হয়ে আসছে। ছেলেটা গেলো কই?
পেছনে যেই ঘুরবে, তক্ষুনি কে যেন মুখ চেপে ধরে। ইভা শব্দ করতে পারেনা। পুরুষালী শক্ত হাতের মাঝে কাঁটা মুরগীর মতোন ছটফট করে। লোকটা তাকে পাশের ঝোঁপে টেনে নিয়ে যায়। গাছের সাথে গাল ঠেসে ধরে। ঘাড়ের কাছে ফিসফিসিয়ে বলে,”আজ পাইছি তরে।”
বাহাদুর ফিরে এসেছে তখন। ইভাকে না পেয়ে বুবু বুবু বলে চেঁচাচ্ছে। ইভা দেখতে পাচ্ছিলো অথচ সামান্য নড়াচড়া করার শক্তিও পাচ্ছিলোনা। ছোট্ট বাহাদুর ভেবেছে বুবু বোধহয় বাড়ি ফিরে গিয়েছে বিধায় সেও বাড়ির দিকে পা বাড়ায়। নিরুপায় ইভা যখন আসা প্রায় ছেড়েই দিচ্ছিলো ঠি ক তখনই সরফরাজকে দেখা যায় গেটের সামনে। সেদিন বাসায়ই ছিলো সে। ইভারা এখনো দিঘির পাড়ে শুনে বেরোচ্ছিলো ডেকে আনতে। ইভা দুর থেকে দেখে ভাইজানকে। মনে মনে হাজারবার আল্লাহকে ডাকে। সরফরাজ ঝুঁকে কি যেনো কথা বলে বাহাদুরের সাথে। বাহাদুর বাড়ির ভিতর দৌড়ে যেতেই সে উদ্ভ্রান্তের মতোন এদিকে এগিয়ে আসে। পিছের ছেলেটা ভয় পেয়ে যায়। সরফরাজ দিঘির পাশে কাছে এসে দাড়াতেই বিরবির করে বিশ্রি গালি দিয়ে ইভাকে ছুঁড়ে ফেলে মাটিতে। সরফরাজ চমকে উঠে। দ্রুত যেয়ে ইভাকে ধরে। অজ্ঞানপ্রায় ইভা ভাইকে জাপটে ধরে সশব্দে ডুঁকড়ে উঠে। মইদুল উল্টোপথে দৌড় ততক্ষণে। সরফরাজ তীক্ষ্নচোখে মইদুলের দিকে তাকায় একবার। আবছা অন্ধকারেও চিনতে অসুবিধা হয়না।
সপ্তাহখানেক পরে গতকাল বিকেলে ওই ঝোঁপেই মইদুলের মৃতপ্রায় দেহ পাওয়া যায়।
–
-“আমি ওকে মেরে ফেলিনি এইতো বেশি ইভা।”
ইভা চুপ করে থাকে। মইদুল বাঁচবেওনা। ভাইয়ের সামনে বলার সাহস হয়না আর। প্রসঙ্গ পাল্টে বলে,
-“আব্বা, আম্মা আর কয়দিন ঢাকায় থাকবে?”
এবার নরম হলো সরফরাজ। আব্বা, আম্মা ঢাকা গেছে সপ্তাহ পেরিয়েছে। আম্মার শরীরটা খারাপ ছিলো, আব্বা আর ছোটচাচা মিলে ঢাকার হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছে। ওখানে এক আত্নীয়ের বাসায় থাকছে।
সরফরাজ উওর দেয়,
-“আর দু’চারদিন। এরপরই চলে আসবে।”
-“আচ্ছা।”ইভা বলার মতোন কিছু পেলোনা।
-“আচ্ছা ঘুমা, আসি। বেরোবো।”
সরফরাজ উঠে দাড়ায়। ইভা পিছু ডাকে,”ভাইজান আমি আর কক্ষণো ওদিকে যাবোনা, কোনোদিন যাবোনা। কসম!”
সরফরাজ যেতে গিয়েও থেমে যায়। ফিরে এসে ইভার মাথায় চুমু খায়। বলে,
-“কেনো যাবিনা? আমি একবারো মানা করেছি? তোর যখন মন চায় যাবি। ভয়ের কিছু নেই। আমি আছিনা?”
৮.
সায়ান্হের লালাভ বর্ণে অন্তরিক্ষের ধার রাঙা শুরু হতেই বিভাকে নিয়ে বেরিয়ে গেলো ইউসুফ। বাসায় দু’টো গাড়ি। একটা সরফরাজ নিয়ে গেছে। আরেকটা নিয়ে ইউসুফ বেরোলো। উদ্দেশ্য বড়মার্কেট। রাস্তা অনেকক্ষণের। পৌছোতে সময় লাগবে। বিভা গতকাল ফোন ভেঙেছে, নতুনটা কিনতেই বেরোচ্ছিলো। সঙ্গে বিভাকে কেনো নিয়ে এলো জানেনা। হয়তো ফোনটা বিভা ভেঙেছে বলেই। মেয়েটা তার কথার অমান্য করেনা ঠি ক। বিকেলের শান্তির ঘুম ঘুমিয়েছিলো। ইউসুফ একবার ডাকতেই উঠে পড়েছে। জেদ দেখিয়ে একটু আপত্তি করলেও ইউসুফের গম্ভীর কন্ঠের কাছে টি কতে পারেনি।
গাড়ি চলছে। বিভা একটু পরপর চোখ ডলছে। মুখ হা করে হাই তুলছে। হাতে খালি দইয়ের মাটির কাপ। ইউসুফ কিনে দিয়েছে আসার পথে। সে পছন্দ করে মিষ্টিদই।
গ্রামের রাস্তা এবড়োথেবড়ো। গাড়ি সমতলে চলছে না। তন্দ্রাচ্ছন্ন বিভার মাথাটা ঠুক করে জানালায় ঠেকে। কাঁচ নামানো। মাথার ওড়না পড়ে গেছে। দীঘল কালো চুল সাঁই সাঁই উড়ছে। ইউসুফ গাড়ির গতি কমায়। একহাত স্টেয়ারিংয়ে রেখে আরেকহাতে বিভার হাত থেকে দইয়ের কাপটা নিয়ে সরিয়ে রাখে। জানলার কাঁচ উঠিয়ে দিয়ে সরে যায়। ভাঙা রাস্তায় এদিক ওদিক করতে করতে শ্যামময়ীর মাথাটা যেয়ে ঠেকে ইউসুফের বাহুতে। ইউসুফ একপলক তাকায়। ঘুমন্ত বিভার মাথাটা সযত্নে বুকে নিয়ে বিরবির করে বলে,
-“তুমি জানো একপাক্ষিক, আমি জানি অপ্রকাশিত।”
~চলবে~
[