#মেঘবৃত্ত
#পর্ব_২৩
#আভা_ইসলাম_রাত্রি
আজ আকাশটা বেশ কালচে। বৃষ্টি নামবে নামবে ভাব। অদূরেরর মেঘেরা জড়ো হচ্ছে একস্থানে। জমছে মেঘ, নামবে বৃষ্টির বৃত্তাকার ফোঁটা। মেঘবৃত্ত বসে আছে ভার্সিটির একটা নিরিবিলি জায়গায়। জায়গাটা বেশ শান্ত, স্থবির। এই জায়গাকে মেঘবৃত্তের অবকাশ নেওয়ার জায়গা বলা যায়। যখনই দুজন কাহিল হয়, অবিন্যস্ত হয়, এই জায়গায় এসে বসে। গল্প করে, হাসে, কিছু সুন্দর মুহূর্ত কাটায়। আজও তারা এখানে এসেছে। গল্প করার মাঝখানে হঠাৎ আকাশ ডেকে উঠলো। আকাশের গুড়ুম গুড়ুম ডাক শুনে বৃত্ত সচেতন হলো। আকাশের কালিমায় চোখ রেখে বললো,
— বৃষ্টি পড়বে মনে হয়। দ্রুত বাসায় যেতে হবে।
মেঘা নিজেও বুঝতে পারলো বিষয়টা। বললো,
— হ্যাঁ, তাইতো।
— চল, চল। জলদি চল। নাহলে, কাকভেজা হয়ে বাসায় ফিরতে হবে।
বৃত্ত কথাটা বলে বড়বড় পা ফেলে গেইটের দিকে এগিয়ে চললো। তবে, মেঘা নিশ্চল, থমকানো। আকাশের দিকে চেয়ে রইলো অপলক। হুট করেই মনে হলো, বৃষ্টির মত পবিত্র কিছু বোধহয় আর দুটো নেই। বৃষ্টি নামে, ধুয়ে মুছে দেয় সকল খারাপকে, শুদ্ধ করে সকল আত্মাকে। নিজেকে বৃষ্টির কাছে সপে দিতে ক্ষতি কি?
আচমকা বৃষ্টি নামলো। ভিজলো মাটি, ভিজলো মেঘা স্বয়ং। মেঘার ঘন চুল বেয়ে গড়ালো বৃষ্টির ফোঁটা। শ্যামা রঙের মুখশ্রী মাখামাখি হলো বৃষ্টির অথৈ জলে। মেঘা মেতে উঠলো বৃষ্টিতে। অনেকক্ষন হলো, মেঘার কোনো দেখা নেই। বৃত্ত চারপাশে তাকালো। এই মেয়েটা এখনো আসছে না কেনো? কোথায় গেলো? বৃত্ত মুখ ফুলিয়ে নিঃশ্বাস নিলো।
ঝুম বৃষ্টি নামছে। এখন আবার গেইট পেরিয়ে ভেতরে যেতে হবে। উফ, বিরক্তিকর! বৃত্ত সেই বৃষ্টির মধ্যেই পা চালালো।
শিল্পকলা ভবনের সামনে মেঘাকে ভিজতে দেখে বৃত্তের মাথা গরম হয়ে গেলো। এই মেয়েটার কি কখনো বুদ্ধিশুদ্ধি হবে না। প্রেগন্যান্সি টাইমে এভাবে বৃষ্টির পানি গায়ে লাগাচ্ছে। বৃত্ত হনহনিয়ে এগিয়ে গেলো মেঘার দিকে।
মেঘার কাছাকছি যেতেই, মেঘা চোখ বন্ধকরে চেঁচিয়ে বললো,
— দেখ বৃত্ত। কি সুন্দর বৃষ্টি! গায়ে ছুঁয়ে দিতেই মনে হচ্ছে, গা ছমছম করে উঠছে। দেখ, দেখ। হ
বৃত্ত অবাক হলো। মেঘা তো বৃত্তকে দেখে নি। তাহলে, বুঝলো কি করে সে এসেছে। চোখ বন্ধ করে বৃত্তের উপস্থিতি কি করে সে বুঝে গেলো? বৃত্ত ভাবলো, উত্তর পেলো না। নিজে একপল আকাশের দিকে তাকালো। আকাশের গা বেয়ে গড়াচ্ছে জল আর জল। সেই জলে ভিজছে ধরনী। বৃত্তের হুট করেই মনে হলো, আসলেই তো। বৃষ্টি বিষয়টা দারুন, দারুন, দারুন।
মেঘা চোখ খুললো। অস্থির চোখ নিক্ষেপ করলো বৃত্তের সুন্দর দুটো চোখে। বৃত্ত তখনো আকাশের দিকে চেয়ে। আর মেঘা? সে তাকিয়ে তার জীবনের সবচেয়ে সুন্দরতম আকাশের দিকে। বৃত্তের চোখ সরু, ঘন চুল কপালের উপর লেপ্টে, পুরু ঠোঁট দুটো ঠান্ডায় রক্তিম, সর্বোপরি মেঘা ব্যাকুল চোখে চেয়ে রইলো সে মুখপানে। হুট করেই অস্থির হয়ে উঠলো, বৃত্তের চোখে নিজের জন্যে ভালোবাসা দেখতে। কিন্তু, সামলালো নিজেকে। বৃত্ত তাকে বন্ধু ভাবে, আর সে জায়গাটা মেঘা কখনো হারাতে পারবে না। যদি তার জন্যে নিজের এই যন্ত্রণাদায়ক অনুভূতি মনের মাঝেই মাটিচাপা দিতে হয়, তবে তাই সই। স্বামী হিসেবে নয়, অন্তত একজন ভালো বন্ধু হিসেবে তার বৃত্তকে চাই।
বৃত্ত চোখ সরালো। তাকালো মেঘার দিকে। বৃষ্টির তীব্রতার কারণে চোখ খুলে রাখা দায়। তবুও, সরু চোখে মেঘার দিকে চেয়ে বললো,
— অনেক ভিজেছিস! এবার বাসায় চল। ঠাণ্ডা লেগে যাবে।
মেঘা শুনলো না। বরং, নিজের সালোয়ার গোড়ালি থেকে একটু বটে নিলো। ওড়নাটা সুন্দর করে গলা থেকে কোমর অব্দি গিট্টু দিয়ে তাকালো বৃত্তের দিকে। হেসে বললো,
— চল, ভিজি।
বৃত্ত গম্ভীর চোখে চেয়ে রইলো মেঘার পানে। মেঘা সে চাওনি পরোয়া করলো না। বরং, বৃষ্টির পানিতে পা ডুবিয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে হাঁটতে লাগলো। প্রতিটা পদক্ষপে সে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বলছে,
— উফ, কি ঠান্ডা জল। জম্পেশ লাগছে, জম্পেশ লাগছে।
বৃত্ত মেঘার এমন পাগলামি দেখে আর রেগে থাকতে পারলো না। হুট করেই হেসে ফেললো। বৃত্তের হাসির শব্দ শুনে মেঘার ধ্যান ভঙ্গ হলো। পাগলামি ছেড়ে অপলক চেয়ে রইলো বৃত্তের হাসির পানে। বুকে হাত রেখে বিড়বিড় করলো,
— তুই কি জানিস বৃত্ত? এই পৃথিবীর সবচেয়ে চমৎকার হাসিটা শুধু তোর। শুধু এবং শুধুই তোর। এত সুন্দরভাবে হাসিস কি করে? কষ্ট হয় না? আমাকে এভাবে মেরে ফেলতে কষ্ট হয়না তোর?
তবে, আফসোস মেঘার এই আহাজারি বৃত্ত শুনতেই পেলো না। বৃত্ত নিজেও জিন্সের প্যান্ট বটে নিয়ে মেঘার কাছে এসে দাঁড়ালো। মেঘার হাতের ভাঁজে হাত ডুবিয়ে হেসে বললো,
— চল, এবার সত্যি সত্যিই ভিজি। মেঘের বৃত্তে ভিজে দুজন পাগল হয়ে যাই।
মেঘা পূর্ণতার হাসি হাসলো। বৃত্ত আর মেঘা একসাথে বৃষ্টির পানিতে পা ডুবিয়ে লাফাতে লাগলো। মেঘবৃত্তের লাফানোর তালে বৃষ্টির পানি ছলকে উঠতে লাগলো। ফোঁটায় ফোঁটায় ভিজিয়ে দিতে লাগলো, মেঘবৃত্তের কাপড়, শরীর আর মনপাখি। আজকের দিন এত সুন্দর কেনো? এত পাগল করা কেনো? এতটা মারাত্মক কেনো?
#চলবে