মেঘবৃত্ত পর্ব ২২

#মেঘবৃত্ত
#পর্ব_২২
#আভা_ইসলাম_রাত্রি

সকালের ভোজন শেষ করে, বৃত্ত সদর দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেলো। যাওয়ার আগে চেঁচিয়ে বলে গেলো,
— মেঘ, আমি বাইরে আছি। জলদি আয়।

মেঘা যতটা দ্রুত সম্ভব সবকিছু গুছিয়ে রেডি হয়ে বেরিয়ে গেলো। বৃত্ত বাইকের সাথে হেলান দিয়ে মোবাইল চালাচ্ছে। মেঘা মাথায় ওড়না দিতে দিতে বৃত্তের দিকে এগিয়ে গেলো। মেঘাকে দেখে বৃত্ত বাইকে উঠে বসলো। বাইক চালু করে মেঘার উদ্দেশ্যে বললো,
— উঠে বস।

মেঘা বৃত্তের কাঁধে এক হাত রেখে বৃত্তের পিছনে বসলো। মেঘার বসার তালে বাইকটা খানিক নড়ে উঠলো। বৃত্ত ভ্রুকুটি করে বললো,
— আস্তে। বাইকে ভূমিকম্প ডেকে আনবি নাকি? বাইক আমার নিজের টাকায় কেনা কিন্তু। তোর বাপ যৌতুক দেয়নি, মাইন্ড ইট।

মেঘা মুখ লটকালো। বৃত্তের কাঁধে একটা চাপর মেরে বললো,
— সাবধান, বাবাকে নিয়ে কোনো বাজে কথা না।

বৃত্ত হাসলো। মেঘা ঠিকঠাক হয়ে বসতেই বৃত্ত বাইক চালু করলো।
বৃত্তের বাসা থেকে ভার্সিটি খুব একটা দূরে না। এই তো, আধা ঘন্টার রাস্তা হবে। তবে, মাঝপথে জ্যামে আটকে গেলে এক ঘণ্টায় পৌঁছাবে কিনা সন্দেহ। বৃত্ত বাইক চালাচ্ছে আর মেঘার সাথে কথা বলছে। তার যত কথা! তবে, সবার সাথে বৃত্ত যতটা সহজ থাকুক না কেনো, একমাত্র মেঘার সাথেই বৃত্তের সবচেয়ে ভালো জমে। মেঘার সাথে নিজের পছন্দ অপছন্দের কথা বলতেই বৃত্ত সবচেয়ে বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। মেঘা বৃত্তের সকল কথায় তাল মেলায়। তাই তো, দুজনের একদম গলায় গলায় বন্ধুত্ব! একে অপরের প্রাণ বলা যায় তাদের। সম্পূর্ণ ভার্সিটি তাদের বন্ধুত্বের প্রশংসায় মুখরিত। অনেকে তো আবার সন্দেহ করতো, মেঘা আর বৃত্ত শুধু বেস্ট ফ্রেন্ড না, তারা প্রেমিক যুগল। তবে, বৃত্ত আর মেঘা বরাবরই এই কথা নাকোচ করতো। মাঝেমধ্যে তো দুজনেই মানুষের এসব আজগুবি কথার মজা লুটতো। আজ তাদের দেখো? সবার সেই গুজব’টাকেই তারা সত্যি প্রমাণ করে দিয়েছি। কি আশ্চর্য!

বৃত্ত কথা বলছে। তবে, তার একটা কথাও মেঘার কান ভেদ করে মস্তিষ্কে প্রবেশ করছে না। বরং, সে তাকিয়ে আছে। বাইকের আয়না বৃত্তের অতীব সুন্দর মুখশ্রীর দিকে অবলীলায় তাকিয়ে আছে। বৃত্ত কথা বলছে, ভ্রু কুঁচকাচ্ছে, হাসছে, মন খারাপ করছে, মাঝেমধ্যে হাত উঁচিয়ে কপাল চুলকাচ্ছে। মেঘা সব পুঙ্খানুুঙ্খভাবে লক্ষ্য করছে, দেখছে আর বারবার প্রেমে পড়ছে এই বৃত্ত নামক মানুষটার। মেঘার হুট করেই মনে হলো, প্রেম কত সুন্দর একটা অনুভুতি! যাকে একবার ছুঁইয়ে দেয়, সে’ই পাগল হয়ে যায়, মাতাল হয়ে যায়। চারপাশ ভুলে যায়, বেহায়া হয়। প্রতিটা দোয়াতে শুধু সেই মানুষটার নাম’ই জপ করতে থাকে। প্রেম কতটা চমৎকার এক যন্ত্রণা! ভালোবাসার তলোয়ারে হৃদয়কে ছিঁড়ে একদম এফোঁড় ওফোঁড় করে ফেলে।

মেঘার ভাবনার সুতো কাটে বৃত্তের রামধমকে,
— এই, ধরে বস। আর একটু হলেই তো পড়ে যেতি। মন কোথায় থাকে তোর? ভালো করে বস।

মেঘা হাসলো। বৃত্তের ‘ মন কোথায় থাকে তোর ‘ প্রশ্নের উত্তরে মনে মনে উত্তর করলো, ‘ মনটা তো কবেই তোর নামে করে দিয়েছি। আমার মন আমার কাছে কোথায়?
তবে, বৃত্তকে বলার সাহসটা কর হলো না। সবকথা মনের মাঝেই উৎপত্তি হয়, মনেই ঝরে পড়লো।

চল্লিশ মিনিটের রাস্তা পেরিয়ে বাইক এসে থামলো ভার্সিটির সামনে। মেঘা বাইক থেকে নামলো। বৃত্ত বললো,
— তুই ভিতরে যা। আমি বাইক পার্ক করে আসছি।

মেঘা মাথা নেড়ে সম্মতি জানালো। বৃত্তকে ফেলে ভার্সিটি গেইট দিয়ে ভিতরে চলে গেলো।

— মেঘা, এই মেঘা?
ভার্সিটিতে প্রবেশ করতেই নাহিদার কণ্ঠ পেতেই মেঘা পিছন ফিরে তাকালো। নাহিদা মেঘার দিকেই এগিয়ে আসছে। মেঘা খানিক দাঁড়ালো। নাহিদার হঠাৎ ডাকের কারণ মেঘা কিছুটা হলেও আন্দাজ করতে পেরেছে। উত্তর দেওয়ার জন্যে মনে মনে সে একটু প্রস্তুত হয়েই রইলো।

নাহিদা মেঘার কাছে এসে থামলো। মেঘাকে ফটাফট প্রশ্ন করলো,
— কেমন আছিস? ভালো আছিস তো? শুনলাম বিয়ে করেছিস? তা, কাকে করেছিস, বল না?

নাহিদার প্রশ্নে এটা স্পষ্ট যে, সে জানে মেঘা কাকে বিয়ে করেছে। তবুও, মেঘার মুখের স্বীকারোক্তির জন্যেই তার এমন ঘোরানো প্রশ্ন। মেঘা হাসলো। বললো,
— আরে, দমটা তো ফেল। নাহলে, এখানেই শ্বাস আটকে মরে যাবি।

নাহিদা সজাগ হলো। মেঘার কথায় তার মনে হলো, আসলেই তার দম ফুরিয়ে আসছে। নিঃশ্বাস নিতে পারছে না সে। নাহিদা মুখ ফুলিয়ে দু একটা শ্বাস নিলো। তারপর, বললো,
— এবার বল। কাকে বিয়ে করেছিস?

মেঘা স্বাভাবিক সুরে বললো,
— নিজের সবচেয়ে কাছের মানুষকে।
নাহিদা জিজ্ঞেস করলো,
— কাছের মানুষ? সেটা আবার কে?
মেঘা বাঁকা চোখে নাহিদার দিকে তাকালো। বললো,
— জেনেও না জানার ভান করা কি তোর অভ্যাস?
নাহিদা হঠাৎ করেই ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেলো। এক ঢোক গিলে বললো,
— আরে, আমি সত্যিই জানিনা।
মেঘা বুঝলো, এই মেয়ে হার মানার মানুষ নয়। তাই সেও হেসে বললো,
— তাহলে আর জেনে কাজ নেই। আমি যাই, দেরি হচ্ছে।
নাহিদাকে তার নিজের জালে ফাঁসিয়ে মেঘা সে জায়গা প্রস্থান করলো। আর নাহিদা? সে তো সেখানেই মুখ বাঁকিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। মনে মনে হয়তো কয়েকবার মেঘাকে ভয়ংকর রকমের গালি দিলো।

ফরম পূরন করা শেষ করে বৃত্ত আর মেঘা অফিস রুম থেকে বের হলো। বৃত্ত বাইকের চাবি আঙ্গুলে অনবরত ঘোরাতে লাগলো। হাঁটতে হাঁটতে মেঘা একসময় বললো,
— ওই জানিস? আজ নাহিদার সাথে দেখা হয়েছে।
বৃত্ত ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো,
— কোন নাহিদা? ওই আঁতেল নাহিদা?
— আরে না! ওই যে থার্ড ইয়ারের চুল কালার করা নাহিদা।
— ওহ, ওই নাহিদা। কি বললো?
— আর কি বলবে? জিজ্ঞেস করেছে, আমার বিয়ে হয়েছে কিনা, কার সাথে হয়েছে?
বৃত্ত এবার মেঘার দিকে তাকালো। ভ্রু কুটি করে বললো,
— পুরো ভার্সিটি জানে তোর আর আমার বিয়ে হয়েছে। তাহলে, ওই মেয়ে জানলো না কিভাবে?
— আরে, ও জেনেও না জানার ভান করেছে। আমার মুখ থেকে শুনবে বলে। তার আর ন্যাকামির শেষ নাই।
— ওরে বেদনা মহিলা কি এমনি এমনি বলি। শি ডিজার্ভস ইট, ম্যান।
কথাটা বলে মেঘা আর বৃত্ত একসাথে হেসে উঠলো।

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here