মোনালিসা পর্ব ২

মোনালিসা
লেখা- ইসরাত জাহান তানজিলা
পর্ব-২
পুলিশি সব ঝামেলা মিটিয়ে মোনা নিশান কে নিয়ে এয়ারপোর্টের দিকে রওয়ানা হলো। ফ্লাইট পাঁচটায়। নতুন‌ কিছু মুখের সাথে পরিচিত হয়েছে মোনা । তাঁদের সাথে কথা বলার বিন্দুমাত্র আগ্রহ পেলো না। মোনার এমন অনাগ্রহ মিশ্রিত আচরণ তাঁদের কিছুটা বিচলিত করলো। যাদের জন্মের পর থেকে কখনো দেখেনি, চিনে না, জানে না, বাবার মৃত্যুর পর তাঁদের সহানুভূতি প্রত্যাশা করা’টা মূঢ়তা।মোনা আর নিশানের প্রতি আন্তরিকতা দেখিয়ে মোনার দাদা বলেছে মোনা আর নিশান কে তাঁদের কাছে বাংলাদেশে থাকতে। এমন আন্তরিকতায় মোনা সহানুভূতি খুঁজে পায়না বরংচ বিরক্ত হয় মনে মনে।
মোনা তাঁদের কাছে থাকতে চাচ্ছে না, না থাকতে চাওয়া পুলিশের চোখেও অস্বাভাবিক কিছু মনে হলো না। আর মোনার খালা ছাড়া যেহেতু আর কেউ নেই , এমন পরিস্থিতিতে মোনার খালার কাছে আমেরিকা চলে যাওয়া’টাও স্বাভাবিক। মোনা সবেমাত্র এইচএসসির গন্ডি পেরুনো একটা মেয়ে। বোবা ভাইকে নিয়ে তো কোন আশ্রয় ছাড়া থাকা সম্ভব না। তাই মোনার আমেরিকা চলে যাওয়া নিয়েও পুলিশের কোন খটকা লাগলো না। মোনার আচরণে যদিও বাবা মৃত্যুর শোকের কোন রেশ নেই তেমন,তবুও মোনার প্রতি খুন নিয়ে সন্দেহ করার কোন মানে খুঁজে পেলো না।
মোনা এয়ারপোর্টে পৌঁছালো। এখন মার্চ মাস। শীতের তীব্রতা যদিও কমে এসেছে তবুও বিকালের দিকে হালকা শীত লাগে। মোনা ব্যাগ খুলে গাঢ় বেগুনি রঙের একটা চাদর বের করলো। মোনার মায়ের চাদর এটা,ওর মায়ের খুব পছন্দের চাদর। মোনা এসএসসি পরীক্ষার পর যখন কলেজে ভর্তি হয়ে হোস্টেলের উদ্দেশ্য বাসা ছাড়ল তখন মোনার মা এই চাদরটা মোনা কে দিয়েছিল। চাদর টা মোনা নাকের কাছে নিয়ে ঘ্রান নিলো। ওর মায়ের শরীরের পরিচিত সেই ঘ্রানটা এখনো এই চাদরে যেন মিশে আছে। নিশানের শরীরে চাদরটা জড়িয়ে দিলো মোনা। মোনার মনে মনে আফসোস হলো, নিশান কেন আর পাঁচটা মানুষের মত স্বাভাবিক হলো না? নিশানের দিকে তাকালে মোনার অসহায়ত্ব যেন বৃদ্ধি পায়।
কিছুক্ষণ পর প্লেন উড়তে শুরু করলো। প্লেনে উঠে নিশান ভয়ে চুপসে গেলো। এর আগে কখনো প্লেনে উঠেনি নিশান। প্লেন জিনিস’টা নিশানের কাছে একদম নতুন কিছু।
আমেরিকা পৌঁছে প্লেন থেকে নেমে মোনা চারদিকে খুঁজতে লাগলো ওর খালা কে। মোনার হঠাৎ নিজেকে খুব নির্বোধ মনে হলো। মোনা তো কখনো ওর খালা’কে দেখেনি, যে মানুষটা’কে কখনো দেখেনি সে মানুষটা কে কিভাবে খুঁজে বের করবে? খালার সাথে মোনার শুধু ফোনে কথা হয়েছে। অনন্ত একটা ছবি দেখা উচিত ছিলো। নিশান মোনার হাত ধরে এদিক ওদিক হাঁটছে। মোনা খুব ভয়াতুর হয়ে গেলো। খালাকে যদি খুঁজে না পায় তাহলে কি হবে? যে মানুষটা কে কখনো দেখেনি সে মানুষটা কে খুঁজে কিভাবে বের করবে? ওর খালাও তো ওঁদের দেখেনি,তাহলে খালাও বা কিভাবে খুঁজে বের করবে ওঁদের?মোনা নির্বুদ্ধি হয়ে গেলো। একবারের জন্যও এই কথা’টা মাথায় আসেনি! কঠিন গোলকধাঁধায় পড়ে গেলো মোনা। মোনার মুখ দুশ্চিন্তায় পাণ্ডুবর্ণ হয়ে যায়।এক ঘন্টার মত হয়ে গেলো মোনা নিশান কে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে উদ্বিগ্ন, উদগ্রীব চিত্তে। হাজার শঙ্কা মোনার চিন্তিত মনে উঁকি দিচ্ছে।
খানিক বাদে একটু তফাতে মোনা এক ভদ্র মহিলা’কে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে।মোনা কিছুক্ষণের জন্য বিগড়ে যায়। শ্যেন দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে।মোনার দৃষ্টি কিছুক্ষণের জন্য থমকে যায়। প্রচণ্ড বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যায় যেন।
মোনা মন্থর গতিতে সেখানে এগিয়ে যায়। ভদ্রমহিলা দেখতে হুবহু মোনার মায়ের মত। মোনার হৃদস্পন্দন দ্রুত থেকে দ্রুততর হচ্ছে। নিজের দৃষ্টি’কে বিশ্বাস করতে পারছে না।মোনা কিছু মুহূর্ত স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে বিমগ্ন আর নির্বাক হয়ে। খানিক বাদে মোনার মস্তিষ্ক সায় দেয় এটা ওঁর খালা লিলি বেগম ব্যতিত অন্য কেউ না। মোনা নিঃশব্দে ভদ্র মহিলার পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। কি বলে কথা শুরু করবে বুঝতে পারছে না। হতবাক হয়ে গেছে যেন মোনা। সংকোচ,জড়িমা কাটিয়ে মোনা ইতস্তত বোধ করে বলল,
-“আমি মোনালিসা। বাংলাদেশ থেকে এসেছি।”
এই টুকু বলে অজ্ঞাত এক শঙ্কা নিয়ে উত্তরের অপেক্ষায় থাকে মোনা।ভদ্রমহিলা মোনা আর নিশান’কে দেখে চমকালো। তাঁর অপেক্ষার অবসান ঘটলো। ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটিয়ে মোনা আর নিশান’কে জড়িয়ে ধরলো। মোনার চোখ জুড়ে বিস্ময়ের বন্যা বয়ে যাচ্ছে। মোনার কখনো বুঝতে পারেনি লিলি বেগম দেখতে ওর মায়ের মত হবে।
লিলি বেগম জড়িয়ে ধরায় মোনার কেন যেন লজ্জা লাগছে। কথা বলতে অস্বস্তি লাগছে। লিলি বেগম হৃষ্টচিত্তে বলল,
-“তোদের দুইজনকে দেখে আমার কি যে খুশি লাগছে।”
লিলি বেগম নিশানের মাথায় হাত বুলিয়ে দেয় আদুরে ভঙ্গিতে। ঠোঁটের কোণে হাসি লেগে আসে। উদগ্রীব হয়ে বলল,
-“তোদের কে খুব ক্লান্ত দেখাচ্ছে। বাসায় চল তারপর কথা হবে।”
মোনার তখনো অস্বস্তি লাগছে।সহজ ভাবে কথা বলতে পারছে না। নিশান হাঁ করে তাকিয়ে রইল লিলি বেগমের দিকে। মোনা অস্বস্তি বোধ কিছু’টা দমিয়ে বলল,
-“খালা তুমি দেখতে একদম মায়ের মত।”
লিলি বেগম ম্লান হেসে বলল,
-“আমায় দেখে অবাক হয়েছিস?”
প্রত্যত্তুরে মোনাও একটু হাসলো। লিলি বেগমের দিকে আড়চোখে তাকাচ্ছে । লিলি বেগমের চেহারা ওর মায়ের মত হলেও লিলি বেগম এখনো খুব সুন্দর। চেহেরায় বয়সের ছাপ নেই কোন। প্রাণবন্ত, উচ্ছ্বাসিত মহিলাটি কে এখনো মোনার কাছে যুবতী মনে হচ্ছে যেন।মোনা কে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে লিলি বেগম বলল,
-“কি দেখছিস?তোর মায়ের মত দেখতে তাই এভাবে তাকিয়ে আছিস?”
লিলি বেগম একটু থেমে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বললো,
-“তোর মা আর আমার চেহেরার গঠন এক হলেও তোর মা আমার থেকে বেশি সুন্দরী ছিলো। চোখ ধাঁধানো সৌন্দর্য ছিলো ওর। আমার কাছে অনেক বাঁধানো ছবি আছে , ছবির এলবাম আছে তোকে দেখাবো নে।”
মোনার মায়ের ছোট বেলার ছবি! মোনা কৌতূহল বোধ করলো। খুব সন্তপর্ণে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। মোনার কখনো লাবণ্যময়ী মা’কে দেখেনি।দেখেছে চোখের নিচে গাঢ় করে দেওয়া কাজলের ন্যায় কালি পড়া, গায়ে মাইরের দাগ, মুখে বিষাদের ছায়া।
লিলি বেগমের চেহারা ওর মায়ের মত বলে চিনতে পেরেছে, যদি ওর মায়ের চেহেরার সাথে মিল না থাকত তাহলে কি হত? এই অচেনা দেশে কোথায় যেত নিশান কে নিয়ে?ভাবতেই মোনা আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে যায়। লিলি বেগম গাড়ি ড্রাইভ করছে স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে। আমেরিকার রাস্তায়।বাংলাদেশের মত যানজট নেই।
লিলি বেগম মোনার দিকে তাকিয়ে চিন্তিত হয়ে বলল,
-“আচ্ছা আমার চেহেরা যদি তোদের মায়ের মত না হত তাহলে আমাকে খুঁজে বের করতি কিভাবে? আর আমিও কি নির্বোধের মতো কাজ করলাম। অন্তত তোদের একটা ছবি দেখা উচিত ছিলো।”
মোনা অবাক হয়ে গেল। এই কথাটাই মোনা মাত্র মনে মনে ভেবেছিল। লিলি বেগমও একই কথা জিজ্ঞেস করল। লিলি বেগমের করা প্রশ্নের উত্তরে মোনা একটু হাসলো ।
বাসায় পৌঁছে মোনা দেখে সোফায় বসে এক ভদ্রলোক কফির কাপে চুমুক দিচ্ছে। মোনা বুঝতে পারলো লোকটা ওঁদের খালু। ভদ্রলোক বিরক্ত চোখে মোনা আর নিশানের দিকে তাকালো। আশ্চর্য ব্যাপার ভদ্রলোকের সাথে ওর ওঁদের পরিচয় করিয়ে দিলো না।মোনার খালা লিলি বেগম ওঁদের একটা রুম দেখিয়ে দিয়ে বলল,
-“এই রুমে তোমরা দুই ভাইবোন থাকবে। তোমরা অনেক ক্লান্ত। ফ্রেশ হয়ে রেস্ট নেও।”
মোনা জিজ্ঞেস করল,
-“খালু কোথায় খালা?”
-“সোফায় বসা একজন ভদ্রলোক কে দেখেছ? উনি তোমাদের খালু।”
মোনা আর নিশান রুমে গিয়ে ওঁদের ব্যাগ গুছিয়ে রেখে খাটে বসে। মোনার বার বার কেন জানি মনে হচ্ছে ওঁরা এখানে আসাতে খালু মোটেও খুশি নন। মোনার মন বিষণ্ন হয়ে গেলো।মোনা শুনেছে ওঁর খালার দুই ছেলে আছে। বড় ছেলে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ে, আর ছোট ছেলে মোনার এক বছরের ছোট। ওঁদের কাউকে তো দেখলো না।মোনা চিন্তা ভাবনা বাদ দিয়ে নিশান কে গোসল করিয়ে, নিজে গোসল করে নিলো। কয়েকদিন বাদে মোনার ভার্সিটি। নতুন জায়গা, নতুন পরিবেশ সব মিলিয়ে কেমন যেন অস্থির লাগছে মোনার।

মোনা ওর খালাকে দেখে খুব বেশী বিস্মিত হয়।চোখে-মুখে এখনো বিস্ময়ের ছাপ লেগে আছে যেন। মোনার খালা দেখতে একদম মোনার মায়ের মত। অথচ এ কথাটা মোনা এতদিন জানত না!
নিশান মোনার গা ঘেঁষে বসে আছে। মোনা নিশানের চুলে হাত বুলাচ্ছে আর নানান রকম চিন্তা ভাবনা করছে।ডাইনিং রুম থেকে চিকন গলায় মোনালিসা, মোনালিসা বলে ডাক আসলো। মোনা নিশান কে নিয়ে সেদিকে পা বাড়ালো।‌ মোনার খুব বেশী অস্বস্তি লাগছে এ বাসায়।মোনা দেখলো টেবিলে ওর খালা, খালু আর দুইটা ছেলে বসা। মোনা বুঝতে পারলো ছেলে দুইটা ওর খালাতো ভাই।
বড় ছেলেটা ব্লাক কালারের টি-শার্ট, কালো একটা থ্রী কোয়ার্টার প্যান্ট, হাতে চমৎকার একটা কালো ঘড়ি পড়া। গায়ের রং ধবধবে সাদা হওয়ার কারনে ব্লাক টি-শার্টে অদ্ভুত রকমের সুন্দর লাগছে ছেলেটা’কে। আর ছোট ছেলেটার গায়ের রং একটু চাপা।
মোনা’কে দেখে ব্লাক টি-শার্ট পরিহিত ছেলেটা চেয়ার ছেড়ে এগিয়ে এসে মোনা কে জড়িয়ে ধরলো। ইংরেজি তে বলল,
-“হায় মোনা! রিয়েলি ইউ আর লাভলি!”
মোনা হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। নিজেকে যত দ্রুত সম্ভব ছাড়িয়ে নিয়ে দূরে সরে জড়সড় হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। লিলি বেগম এসে বলল,
-“মোনা ওঁরা তোমার খালাত ভাই। আমার বড় ছেলের নাম ইফতিয়াদ প্রিয়ম আর ছোট ছেলে ইফতিয়াজ এরিক।”
লিলি বেগম প্রিয়ম কে চোখের ইশারায় আড়ালে ডেকে নিয়ে ফিসফিস করে বলল,
-“বাঙালি কালচারে বড় হওয়া মেয়ে। এভাবে জড়িয়ে ধরা ওঁদের কাছে খুব বেমানান।”
(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here