মাত্র তিনমাসের জন্য বউ হয়েছি আবিদের। আমার ননদ শিলার স্বামী আবিদ। এই তিনমাস শিলা থাকবে তার বাবার বাড়ি। আর আমি থাকবো শিলার শ্বশুরবাড়ি।
একজন নারীর জন্য এটা কতটা লজ্জার। তা কেবলমাত্র এমন পরিস্থিতির শিকার হওয়া নারীটিই অনুধাবন করতে পারে। আবিদের কাছে আমাকে জোর করে বিয়ে দিয়েছে আমার শ্বাশুড়ি ও আমার স্বামী ফয়সাল। মা ছেলে কৌশলের আশ্রয় নিয়েছে।
ফয়সালের সাথে আমার প্রেমের বিয়ে ছিলো। আমাদের দীর্ঘ দুই বছর প্রেম ছিলো। তারপর দুই বছর সংসার করেছি। তুমুল প্রেমের স্রোতে ভেসে যেতে যেতে ফয়সালকে ভুলভাবে চিনেছি। অতিরিক্ত আবেগ মানুষকে ভুল পথে আর ভুল সিদ্ধান্ত নিতে প্রবলভাবে প্রশ্রয় দেয়।
ফয়সালদের তুলনায় আমাদের অর্থনৈতিক অবস্থা অনেক খারাপ।বলতে গেলে গরীব। এসব ফয়সাল প্রেমের শুরু থেকেই জানতো। বরং আমি হীনমন্যতায় ভুগলে সে বকা দিতো। বলতো একজন মানুষের চেয়ে অন্যকিছু কখনোই বড় হতে পারেনা। আমার জন্য তুমিই পারফেক্ট। তুমিই ইম্পর্ট্যান্ট।
ঝামেলা দানা বাধঁতে শুরু করে ঠিক তখন থেকেই। যখন ফয়সালের মা বুঝতে পারলো ছেলের শ্বশুরবাড়ি থেকে আশানুরূপ উপহারসামগ্রী পাচ্ছেনা প্রতি সিজন হিসেবে। এদিকে আমিও কিন্তু বাবার এই অক্ষমতা ঢাকার আপ্রাণ চেষ্টায় নিমগ্ন থাকতাম ভোর থেকে নিশি অবধি।
তাদের সংসারের যাবতীয় কাজগুলো কলুর বলদের মতো খেটে খেটে সম্পন্ন করতাম। তবুও ননদ শ্বাশুড়ির মনের কোন চিপাচাপায় ও আমার এতটুকু স্থান হতোনা। বিদ্রুপের ছলে মা মেয়ে কথা শোনাতে যেন বদ্ধ পরিকর।
ফয়সালের মনকে বিষিয়ে দিল তারা দিনের পর দিন আমার সম্পর্কে নানা কথা কথা বলে। আমি অলস। কোন কাজ করিনা। মুখে মুখে তর্ক করি। ইত্যাদি।
এভাবে একদিন ফয়সাল আমাকে জিজ্ঞেস করলে এক দুই কথা থেকে তর্ক শুরু হয়। তা চরম আকার ধারণ করে। এক পর্যায়ে সে আমাকে ফকিরনী বললে, আমিও তাদেরকে লোভী সেলফিস বলে বাবার বাড়িতে চলে যাই।
তারপর তার মা বোনের কথায় প্রলুব্ধ হয়ে সে আমাকে ডিভোর্স দেয়। তার মা নাকি তাকে কোটিপতির মেয়ে বিয়ে করাবে।
উপস্থিত ঘটনার আকস্মিকতায় আমার গোটা পৃথিবী দুলতে লাগলো ঝড়ো হাওয়ায় দুলতে থাকার বৃক্ষের ন্যায়। সামান্য তুচ্ছ বিষয়কে ইস্যু করে ফয়সাল এমন ভয়ানক সিদ্ধান্ত নিতে পারে তা আমার কল্পনার ও বাইরে ছিলো। যদিও অনেকটা মা বোনের রোষানলে পড়েই সে এমন করতে বাধ্য হয়েছে। তবুও মানা যায়না। সে কেমন পুরুষ। কেমন ব্যক্তিত্ব তার।
নিজের উপরে সেদিন থেকেই এক দরিয়া ঘৃণা। কেন বাবা মায়ের অমতে নিজের পছন্দে বিয়ে করেছিলাম।
ছয়মাস কেটে গেল। সময়ের সাথে সাথে নিজেকে সামলে নিলাম। মনকে প্রবোধ দিলাম এই বলে। স্রষ্টা যা করে বান্দার কল্যাণের জন্যই করে। ভালো একটা চাকরি হয়ে গেলো আমার স্থানীয় উপজেলা কার্যালয়ে। ফয়সালের সাথে আমার যোগাযোগ বন্ধই ছিলো।
আচমকা সে এক সপ্তাহ আগে আমাকে ফোন করে তার কৃতকর্মের জন্য ক্ষমা চায়। এবং আমাকে তার জীবনে পূনরায় ফিরে পেতে চায়।
আমি গর্জে উঠলাম শুনে, বললাম তোমরা আসলেই লোভী। যখন শুনলে আমি ভালো আছি। ইনকাম করছি। অমনি বাহানা শুরু করলে। আর তোমাদের ঘরের সমস্ত কাজ করার ও তো লোকের অভাব এখন।এটা কি মামার বাড়ির আবদার? মন চাইবে ভালোবাসবে। মন চাইবে ছুঁড়ে মারবে। মন চাইবে ফিরে পেতে চাইবে।
এরপর ফয়সালের একটা বাক্যেই আমার কন্ঠ স্তব্দ হয়ে গেলো আগুনে পানি ঢালার মতোই। যা আমি প্রায় ভুলতে বসেছিলাম।
ফয়সাল দম্ভের সাথে জানালো,
ওকে ফাইন। তাহলে তোমার বাবা যে ৫ লক্ষ টাকা ধার নিয়েছে তোমার ভাই বিদেশ যাওয়ার সময় তা ফেরৎ দাও।
আমি বিড়ালের মত মিনমিন স্বরে বললাম,তুমি বলছ সাব্বির যেদিন দিতে পারে সেদিন নিবে। তার আগে চাইবেনা।
হ্যাঁ বলছি ঝুমুর। এখন দৃশ্যপট পাল্টে গিয়েছে না? শিলাকে আমি আর মা ম্যানেজ করেছি। আমাদের দেশে হিল্লা বিয়ে কুসংস্কার হলেও বহুল প্রচলিত নিয়ম। তোমার বিয়ে অন্য কারো সাথে দিলে সেটা যতটা খারাপ লাগবে আমাদের, তার চেয়ে নিজের মানুষের সাথে হলে খারাপ লাগাটা কম হবে। সবাই জানে তুমি বাবার বাড়িতে কারণবশত রয়েছ।
তুমি ফিরে এলে সাব্বিরের টাকার বিষয়ে আমার আগের কথাই বহাল থাকবে। টাকা কিন্তু পাঁচ লক্ষ। মনে রেখো। সিদ্ধান্ত তোমার প্রস্তাব আমার।
আমি একটু থেমে রাজী হলাম। জীবনে বহুসময়ে অনেক নিষ্ঠুরতম সিদ্ধান্ত নিতে হয় আমাদের। নিয়তির উপরে কারো হাত নেই। আরেকবার চুড়ান্তভাবে উপলব্ধি করতে পারলাম,গরীব হওয়া আসলেই পাপ। গরীব বাঁচে অন্যের শোষণ আর শাসনে।
ফয়সাল ফোনের ওপাশে আনন্দের হাসি হাসলো। বললাম,আবিদের বাড়ি থাকলে তার মা বাবা ?
তারা কিছুই জানবেনা ঝুমুর। আবিদ যেহেতু ঢাকায় জব করে। সে ওখানে বাসা নিয়েছে তোমার জন্য। তোমাকে বউ সাজতে হবেনা। কিছুইনা। জাস্ট কাজী অফিসে বিয়ে হবে আমাদের উপস্থিতিতে। তারপর আবিদ ঢাকায় নিয়ে যাবে তোমাকে। ও তোমাকে স্পর্শ করবেনা। কথা দিয়েছে আমাদের। তুমিও দূরত্ব বজায় রেখ।
অফিস থেকে তিনমাসের ছুটি নিয়েছি। লিংক ছিলো বিধায় তারা ছুটি দিতে বাধ্য হয়েছে। সত্যি বলতে আজ তিনমাস আবিদ আমার দিকে ভালো করে ফিরেও চায়নি। বরং এমনভাবে চলেছে সে যেন আমার ভাশুর।
ফয়সাল রোজ ফোন দিয়ে জিজ্ঞেস করে আবিদ আমাকে স্পর্শ করার চেষ্টা করে কিনা। জবাব শুনে উল্লসিত হয় ফয়সাল। দিনগুনতে থাকে তিনমাস শেষ হওয়ার। রুদ্ধশ্বাস অপেক্ষায় ফয়সাল।
কিন্তু আমার ভিতরে কোন অপেক্ষা নেউ। নতুন একজনের বউ হয়েছি। তাওনা। স্বামীরূপী প্রেমিকের কাছে যাব তাওনা।
একবুক চাপা হতাশায় দিন পার হচ্ছে। এ কেমন নারী জীবন। কখনো রঙধনু, কখনো ঝলমলে রোদ্দুর, কখনো ভরা শ্রাবণ, কখনো ধূসর অমাবস্যা, কখনো তিমির আঁধার,কখনো মায়াবী জোছনা।
আর মাত্র চারদিন বাকি আছে তিনমাস শেষ হওয়ার। গরম বেশী হওয়ায় একদিন অনেক সময় নিয়ে গোসল করেছি। রাতে ভীষণ জ্বর এসেছে। দুই রুমের বাসা। আবিদ এক রুমে ঘুমায়। আমি একরুমে। এই কয়দিনের জন্য আমি না করেছি আবিদকে খাট কিনতে। সে তার রুমে খাটে ঘুমায়। আমি ফ্লোরে বিছানা করে ঘুমাই। আবিদ রাতে পানি খেতে উঠে শুনে আমি জ্বরে কাতরাচ্ছি। সে পা চালিয়ে রুমে এলো। ভয় লাগে বিধায় আমি রুমের দরজা বন্ধ না করে চাপিয়ে রাখতাম।
কাছে বসে জিজ্ঞেস করলো,ভাবী কখন থেকে খারাপ লাগছে? ডাকনি কেন? কপালে চেপে ধরলো হাত দিয়ে। আমি ঘোরের মধ্যে আবিদের হাতের উপর হাত রাখি। একটু ভালো লাগছিলো আবিদের হাতের উষ্ণতায়। আবিদ ও কেমন কেঁপে উঠলো আমার নরম হাতের ছোঁয়া পেয়ে। নিশুতি রাত। বাইরে ঝুম বৃষ্টি শুরু হয়েছে। বজ্রপাতের গর্জনে আমি আবিদকে জড়িয়ে ধরলাম ভয়ে। আবিদ বললো, ভয়ের কি ঝুমুর ভাবি। আমি আছি। আচ্ছা আমি যাবনা তোমার কাছ থেকে। তোমার মাথায় জলপট্টি দিতে হবে। সারারাত আবিদ আমার কাছে বসে ছিলো। যেনো আমার সেবা করাই তার ব্রত।
এরপরের দিন ফয়সাল ফোন দিয়ে বলে একটা দূর্ঘটনা ঘটে গিয়েছে।
আমি চমকে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম কিই?
শিলা পালিয়ে বিয়ে করেছে।
মানে?
সে বিয়ের আগে যে ছেলের সাথে প্রেম করতো সেই ছেলের কাছেই গিয়েছে। ছোট্ট একটি চিঠি লিখে গিয়েছে,
আবিদ ভাবিকে বিয়ে করে কি এমনি সাধু রয়েছে। আর আবিদকে আমার পছন্দ না বলেই তো রাজী হলাম তোমাদের প্রস্তাবে। তা না হলে কোন স্ত্রী রাজী হবে স্বামীর এমন বিয়েতে? তখন তোমরা বিয়ে দাওনি হাসিব বেকার বলে। কিন্তু হাসিব এখন ভালো জব করে। বিয়েও করেনি আমার আশায়।
ফয়সালকে কি বলে শান্তনা দিব ভাষা খুঁজে পাচ্ছিনা। নিজেরই খুব খারাপ লাগছে। আবিদ রাতে বাসায় এসে বলল,শিলার নাম্বার অফ পাচ্ছি ভাবি। তাদের ঘরে ফোন দিলাম বলল,কোন খালার বাড়িতে গিয়েছে। কিন্তু মোবাইলের সুইচড অফ থাকবে কেন। অটো চার্জার ত তার সাথেই থাকে।
আমি আবিদকে সব খুলে বললাম ধীরভাবে। আবিদ থম মেরে রইলো কিয়ৎক্ষন। তড়াক করে আমার দুগাল চেপে ধরে বলল, আমি তোমাকে ছাড়বোনা ঝুমুর।
আমি আৎকে গেলাম। কি বলছ আবিদ? এটা কোনভাবেই সম্ভব নয়। টাকার বিষয়টাও জানালাম আবিদকে।
বলল আমি এক সপ্তাহের ভিতরে টাকার ব্যবস্থা করে দিচ্ছি।
তিনমাস শেষ। আবিদ ফয়সালকে জানিয়ে দিয়েছে। আমি আমার বিয়ে করা স্ত্রীকে ডির্ভোস দিবনা।
ফয়সাল আমাকে ফোন দিলো। কালসাপের মতো ফুঁসতে ফুঁসতে জিজ্ঞেস করলো,
তুমি কি চাও সারাজীবন আবিদের সাথে না ফয়সালের সাথে কাটাবে?
আমি বললাম, আমি কারো সাথেই থাকবোনা। তোমার ৫ লক্ষ টাকা দিয়ে দিব এজ আরলি এজ পসিবল।
বলল, বুঝতে পেরেছি কাহিনী। ওই বেঈমানকে আমি ছাড়বোনা। কালই আমি ঢাকায় আসছি।
আমি আবিদকে জানালাম। আবিদ সে রাতেই বাসায় তালা দিয়ে আমাকে নিয়ে বের হয়ে গেলো। আমি আবিদকে বললাম, আমি চিৎকার করে মানুষ জড়ো করবো। আমাকে গ্রামে যেতে দাও।
আবিদ আহত সুরে বলল,লাভ নেই ঝুমুর। তুমি আমার বিয়ে করা স্ত্রী। এইকয়দিনে তোমাকে ভালোবেসে ফেলছি। তোমাকে নিয়ে ভালো থাকবো আমি। এই কয়দিনে আমাকে চিনতে পারনি ঝুমুর?
ব্যস্ত শহরের মানুষজন, দালানকোঠাকে পিছনে ঠেলে গাড়ি নির্জন রাস্তা ধরে এগিয়ে চলছে সাইঁ সাইঁ করে। আবিদ উচ্ছ্বসিত। আমার হাত ধরে বসে আছে।
ভাবছি হায়! আমার জীবনটা বুঝি ফানুসের মতো হয়ে গেলো। পথ চলায় স্থানে স্থানে আটকে যাচ্ছে এর হাতে ওর হাতে।
আমি ক্লান্ত অবসন্ন। মলিন মুখে নরম করে জানতে চাইলাম,
আবিদ কোথায় নিয়ে যাচ্ছ আমাকে?
আবিদ আমার কপাল থেকে চুলগুলো কানের পাশে গুঁজে দিতে দিতে বলল,সিলেট যাচ্ছি আপাতত। গন্তব্যহীন গন্তব্যই হবে আমাদের ঠিকানা। মানুষ চায় এক পায় আরেক। ভাবে এক হয় আরেক। আর এ নিয়েই আমাদের ভালো থাকতে হয়।বেঁচে থাকতে হয়।
#যে_জীবন_ফানুসের
#সুচনাপর্ব– ১
#রেহানা_পুতুল
চলবে…