#যে_বর্ষণে_প্রেমের_ছোঁয়া
#আনিশা_সাবিহা
পর্ব ১২
গলি পেরিয়ে স্বচ্ছের বাইক এসে থামল মোহের বাড়ির সামনে। বৃষ্টি ততক্ষণে থেমে গিয়েছে। অন্তরিক্ষ এখনো গুড়গুড় শব্দ করেই চলেছে। মোহ বাইক থেকে নেমেই প্রথমে নিজের কোঁকড়ানো চুল থেকে গড়িয়ে পড়া পানি ঝেড়ে নেওয়ার জন্য চুল ঝাড়তে আরম্ভ করল। তখনি নিকটে বাইক থেকে নামতে থাকা স্বচ্ছের চোখেমুখে গিয়ে আ/ঘাত হা/নে মোহের কেশগুচ্ছ। স্বচ্ছ চমকে উঠে চোখমুখ খিঁচে বলে,
“এই মেয়ে আস্তে! চুল দিয়েই আমাকে মে/রে ফেলবে।”
মোহ পিছু ফিরে তাকাল। অতঃপর বাড়ির দরজার দিকে তড়িঘড়ি করে হাঁটা ধরে বলল,
“সামান্য চুল দিয়েই কপোকাত হয়ে যাচ্ছেন? বাকি হাত-পা একসাথে অ্যা/টাক করলে কী করে টিকবেন?”
“যা ইচ্ছে হা/মলা করুক। শুধু মন দিয়ে হা/মলা করো না মেয়ে। কারণ মন দিয়ে যু/দ্ধ করতে গেলে আমার মতো পুরুষ মানুষ টিকবে না।”
মোহের কানে বাকি কথা পৌঁছায় না। সে দরজায় কড়া নাড়তে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। মাথায় চেপে বসেছে ইথানের চিন্তা। দরজার ছিটকানি বাজাতে গিয়ে সেটা খোলাই দেখে দ্রুত ভেতরে ঢুকে পড়ল মোহ। স্বচ্ছ ঠাঁই দাঁড়িয়ে রইল ভেজা গায়ে। মস্তিষ্ক তার একই প্রলাপ বকে যাচ্ছে, এই মেয়েটার সত্যিই একটা জলজ্যান্ত ছেলে আছে? কেন যেন সেটা বিশ্বাস করতে মন চাইছে না তার। জোর করে বিশ্বাস করাতে গেলে হাঁসফাঁস লাগছে। নিজেকে কিছুটা সময় দিয়ে বাইকের চাবি খুলে নিয়ে মোহের বাড়িতে প্রবেশ করল স্বচ্ছ।
বাড়িতে ঢুকেই ঘাড়ের ব্যাগ ফেলে দিয়ে বিছানায় অবচেতন হয়ে পড়ে থাকা ইথানকে দেখে যেন শ্বাস নিতেই ভুলে গেল মোহ। ছেলেটার মাথায় মিসেস. সুফিয়া ওড়না বেঁধে দিয়েছে র/ক্ত পড়া বন্ধ হতে। তা সত্ত্বেও সবুজ ওড়নাটি ভিজে উঠেছে র;ক্তে। মিসেস. সুফিয়া কাঁদো কাঁদো চেহারায় ইথানের দিকে চেয়ে আছেন। মোহকে দেখেই তিনি উঠে এসে বললেন,
“মোহ রে! ইথানটা যে চোখ খুলছে না।”
মোহ ছুটে এসে ইথানের পাশে বসল। ইথানের গাল ধরে ঝাঁকিয়ে বিভ্রান্ত হয়ে জোরে জোরে ডেকে উঠল,
“ইথান সোনা! ইথান সোনা! এই দেখো তোমার মাম্মা এসেছে। চোখ খোলো সোনা।”
ইথানের চোখের পাতা পিটপিট করে নড়তে থাকে। তার ছোটো হাত দিয়ে মোহকে স্পর্শ করতে চায় তবে পেরে ওঠে না। মোহের কান্না আসে। কণ্ঠস্বর আঁটকে যায়। পুরুষালী কণ্ঠস্বর শুনে পিছু ফিরে তাকায় সে।
“এভাবে বারবার ডাকাডাকি করে লাভের লাভ কিছুই হবে না। ওকে দ্রুত হসপিটাল নিতে হবে। ঝগড়া করার সময় বুদ্ধি তো মাথাতেই থাকে। কাজের সময় বুদ্ধি কোথায় যায়? হাঁটুতে?”
ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল মোহ এবং তার মা দুজনেই। স্বচ্ছ দ্রুত এসে ইথানকে দেখে নিলো একবার। কোনোকিছু আর না ভেবে দৃঢ় শ্বাস ফেলে ইথানকে টেনে সাবধানে কোলে তুলে নিলো সে। মোহ উঠে দাঁড়িয়ে বিস্মিত হয়ে বলল,
“আপনি এখানে কী করছেন? ওকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন?”
“রাস্তায় বলেছিলে বাড়িতে তোমার বাবা উপস্থিত নেই। বাড়িতে এমন বিপদের সময় পুরুষ মানুষকে দরকার পড়ে। তাই ভেতরে এলাম নিজ থেকে। আমায় তো তুমি ডাকবে না। এজন্য একা চলে এসেছি। ওকে হসপিটালে নিয়ে যাব আসো।”
ইথানকে নিজের বুকে জড়িয়ে নিলো স্বচ্ছ। বেরিয়ে যাওয়ার আগে মিসেস. সুফিয়াকে হতভম্ব অবস্থায় দেখে তড়িঘড়ি করে বলল,
“আমি জানি আপনি অনেক কিছু ভাবছেন। তবে প্রথমে আপনাদের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে ফেলেছিলাম রাগের বশে। কিন্তু আমি ততটাও খারাপ মানুষ না। আপনি একটু কষ্ট করে অন্য গাড়ি নিয়ে হসপিটালে আসুন। বাচ্চাটাকে ইমিডিয়েট হসপিটালে নিয়ে যাওয়া প্রয়োজন।”
স্বচ্ছ ঝড়ের গতিতে ইথানকে নিয়ে বেরিয়ে গেলে দৌড়ে তার পিছু নিলো মোহ।
ইমারজেন্সি রুমের সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে মোহ, স্বচ্ছ আর মিসেস. সুফিয়া। মোহ এবং স্বচ্ছ দুজনেরই শরীর ভিজে আবার শুঁকিয়ে আসতে শুরু করেছে। মাঝে মাঝে ঠাণ্ডায় মৃদু কাঁপছে স্বচ্ছ। তবুও যেন ভাবান্তর হলো না নিজের ভালো বুঝে সেখান থেকে চলে যাওয়ার। কিছুটা সময় থেকে যেতে ইচ্ছে করল তার। মোহ দাঁড়িয়ে বারবার উদগ্রীব হয়ে তাকিয়ে রয়েছে ইমারজেন্সি রুমের দিকে পলকহীন হয়ে। এর ফাঁকে আঁড়চোখে স্বচ্ছের দিকে দৃষ্টিপাত করে স্বচ্ছকে বোঝার চেষ্টা করে যাচ্ছে সে। তবে পারছে না। ব্যর্থ হচ্ছে।
ডক্টর বেরিয়ে এলেন নার্স সহ। মোহ উত্তেজনায় কী বলবে এই ভেবে কথা আঁটকে যাচ্ছে তার। ততক্ষণে স্বচ্ছ সোজা প্রশ্ন করল,
“বাচ্চাটা কেমন আছে ডক্টর? ঠিক আছে তো? কোনো সমস্যা হয়েছে কি?”
ডক্টর মাথা নাড়িয়ে জবাবে বললেন,
“না স্বচ্ছ। শুধু তিনটা সেলাই দিতে হয়েছে কপালে। মাত্র ড্রেসিং দিয়ে কাজ হতো না। ক্ষতটা বেশ জটিলই ছিল। কিন্তু এ নিয়ে চিন্তার কিছু নেই। ব্যান্ডেজ ভালো করে দিয়েছি। রাতে সামান্য ব্যথা হতে পারে। আর তিনদিন পর এখানে আবার আসতে হবে সেলাই কাটার জন্য। তাহলেই চলবে।”
স্বচ্ছ মোহের দিকে তাকাল এবার। জিজ্ঞেস করল,
“শুনে নিয়েছ তো সব? একটু খেয়াল রাখবে। সেলাইয়ের জায়গা যেন পানিতে না ভিজে যায়।”
মোহ বাধ্য মেয়ের মতো মাথা ঝাঁকিয়ে সম্মতি জানায়। স্বচ্ছ ডক্টরের সাথে সাথে কথা বলতে চলে গেলে মোহ বিলম্ব না করে দরজা ঠেলে ইমারজেন্সি রুমে ঢোকে। ইথানের পাশে গিয়ে ধপ করে বসে পড়ে। ইথান এখনের জ্ঞান এখনো ফেরেনি। চোখ বন্ধ করে স্থির সটান হয়ে শুয়ে আছে চাদর জড়িয়ে। মোহের গলা ধরে আসে। মাথায় ব্যান্ডেজ দেখে হৃদয় ক্ষ/ত বিক্ষ/ত হয়। ইথানের চুলে হাত ঢুকিয়ে আলতো করে বুলিয়ে বেডের সাথে মাথা ঠেকিয়ে দিয়ে রাখে মোহ। মিসেস. সুফিয়া ধীর পায়ে এসে মোহের কাঁধে হাত রাখতেই মোহ ফের সোজা হয়ে বসে মায়ের দিকে তাকায়। তার মা আশেপাশে তাকিয়ে বিস্মিত হয়ে বলে,
“এটা তো প্রাইভেট হসপিটাল মনে হচ্ছে রে মোহ। নিশ্চয় অনেক বিল হয়ে গিয়েছে। আমরা তো চিন্তায় এত কিছু ভাবিই নি। তোর বাবাও কল ধরছে না এখনো।”
মোহও এবার খানিকটা বিচলিত হলো। এত ঝামেলার মাঝে ব্যাগটাও নিয়ে আসতে ভুলে গেছে। অবশ্য ব্যাগেই বা টাকা ছিল কোথায়? মাত্র একশ আশি টাকা দিয়ে কী এমন হবে? মোহ উঠে দাঁড়ায়। আশেপাশে স্বচ্ছকে না পেয়ে মিসেস. সুফিয়াকে চঞ্চলিত কণ্ঠে বলল,
“মা তুমি ইথানের পাশে বসো। আমি আসছি।”
মোহ এলোমেলো পায়ে রুম থেকে বের হলো। তার উৎসুক সৃষ্টি চারিপাশে চাইল। পেল না কাঙ্ক্ষিত ব্যক্তিটিকে। হতাশ হয়ে সোজা হাঁটা ধরল মোহ।
স্বচ্ছকে না পেয়ে রিসেপশনে আসতে হলো মোহকে। ভেজা চুল কানের পাশে গুঁজে রিসেপশনিস্টকে প্রশ্ন করল,
“এক্সকিউজ মি! এখানে ইথান আহমেদ বলে একটা বাচ্চা ভর্তি হয়েছে। তার ভর্তি হওয়ার বিলটা যদি দিতেন ভালো হতো।”
“ইয়েস ম্যাম! আমি এখনি চেক করে দেখছি।”
রিসেপশনিস্ট দ্রুত কম্পিউটারে চেক করতে ধরল। খানিকটা সময় পর মোহের দিকে কিছু অবাক চোখে তাকিয়ে বলল,
“বাট বাচ্চাটার পুরো বিল তো পে হয়ে গেছে ম্যাম।”
মোহের বুঝতে বিন্দুমাত্র বাকি রইল না কাজটি স্বচ্ছ নিজেই করেছে। মোহ ফের রিসেপশনিস্টকে বলল,
“বিল হতো হয়েছিল?”
“ঔষধপত্র সব মিলিয়ে আট হাজার হয়েছিল।”
“ওকে থ্যাংক ইউ।”
মোহ ফের হাঁটা ধরে ইথানের নিকটে যাওয়ার উদ্দেশ্যে। মনে একটাই কথা খোঁচাতে থাকে, যাওয়ার সময় লোকটা একবারও দেখা করে যাবে না?
বাড়িতে এসে সেই আধভেজা গায়েই শুয়ে পড়ল স্বচ্ছ। চোখটা বন্ধ করে নিজের অশান্তি দূর করার প্রচেষ্টায় ব্যস্ত হয়ে পড়ল সে। কান গরম হয়ে এসেছে তার। এমতাবস্থায় সে অনুভব করল তার পাশে কেউ বসেছে। আঁখিদ্বয় ছোটো করে মেলে তাকায় স্বচ্ছ। সৌমিত্র আপেল খাচ্ছে আর হাস্যোজ্জ্বল মুখে স্বচ্ছের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। সৌমিত্র আপেল খেতে খেতে ভরাট গলায় বলল,
“এটা কী ভাই? তোমার চোখ লাল দেখায় কেন? আমার যে ভাইয়ের ঘোলাটে চোখে অনেক মেয়ে হারিয়ে যেতে পারে সেই ভাইয়ের চোখে কী হলো?”
স্বচ্ছ জবাব দিলো না কোনো। সৌমিত্র ছেলেটা জন্মগত বাঁচাল। অতিরিক্ত জ্বালাতে পছন্দ করে মানুষকে। সৌমিত্র এবার খেয়াল করল তার ভাইয়ের গায়ে ভেজা শার্ট এবং চুলগুলো ভিজে নুইয়ে পড়েছে এলোমেলোভাবে। সে দ্রুত বলে উঠল,
“ভাই তুমি কি ফার্স্ট মিট করতে গিয়ে মা/রামা/রি করে এসেছ? তুমি তো বাহিরে থেকে এসে একভাবে তখনি শুয়ে পড়ো যখন তোমার মেজাজ চড়ে থাকে। কাহিনী কী?”
স্বচ্ছ এবার দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠে বসে। বেশ সন্দিহান হয়ে সৌমিত্রের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয়,
“আচ্ছা একটা কথা বল! একটা মেয়ে বিবাহিত না হয়েও সন্তানের মা হয়ে এই সমাজে কী করে টিকে থাকতে পারে?”
সৌমিত্রের চোখ দুটোও সরু হয়ে আসে। পরক্ষণে সে ভেবে উত্তর দেয়,
“এটা তো অনেক জটিল ব্যাপার ভাই। আজকাল বেশির ভাগ মেয়েরা যদি ভুল করে বসে তাহলে সবার আগে অ্যাবরশন করে ফেলে। এখন কোনো মেয়েই বিয়ের আগে সন্তান চায় না। কিন্তু তুমি হঠাৎ এসব জানতে চাইছ কেন? তুমি কি কোনো এমন মেয়ের প্রেমে পড়েছ যার বাচ্চাকাচ্চা আছে? দেখো ভাই! ভয় পেও না বলে ফেলো। মেয়ের দশটা বাচ্চা থাক। তবুও আমি তোমার প্রেম কাহিনীতে তোমার সাথে আছি। ভয় করো না। কিন্তু একটা বিষয় অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে। মেয়েটার স্বামী যেন না থাকে আবার।”
স্বচ্ছের কড়া দৃষ্টি দেখেই গলা খাঁকারি দিলো সৌমিত্র। স্বচ্ছ সরাসরি এবার জিজ্ঞেস করল,
“মোহকে আমি ভালোবাসি এই কথাটা তুই যামিনী আন্টিকে বলেছিস?”
সৌমিত্র চোখ বড়ো বড়ো করে তৎক্ষনাৎ বলতে লাগল,
“না, না ভাই। আমি…”
“মিথ্যে কথা আর একটা বলবি তো ঘাড় ধরে টেনে নিয়ে গিয়ে তোর সাথে বক্সিং খেলব। সত্যি বলবি আমাকে।”
সৌমিত্র স্বচ্ছের এই ধমকানিতে বরাবরই ভয় পায়। সে ঢক গিলে স্বীকার করে,
“জি ভাইয়া। আমি বলেছিলাম মজা করে। কিন্তু ভাবিনি আন্টি এত সিরিয়াস নিয়ে নিবে যে ওর বাড়িতে প্রস্তাব পাঠিয়ে দেবে।”
“তুই তো আগে কিছুই ভাবিস না। ঝামেলা বাঁধানোর পর তোর ভাবাভাবি শুরু হয়।”
“সরি ভাইয়া। আমি তো এতদূর ভাবিও নি।”
স্বচ্ছ পুনরায় শুয়ে পড়ে। অন্যপাশ ফিরে থেমে থেমে বলে,
“মোহের একটা ছেলে আছে।”
কথাটুকু কর্ণকুহরে পৌঁছানো মাত্র মুখ হা হয়ে গেল সৌমিত্রের। হাম/লে পড়ল ভাইয়ের দিকে।
“কী বলছ ভাই! ঠাণ্ডায় মাথা খারাপ হলো নাকি তোমার?”
“আজ বাচ্চাটার এক্সি/ডেন্ট হয়েছিল যখন আমরা মিট করতে গিয়েছিলাম। মনুষ্যত্বের খাতিরে ওকে হেল্প করেছি। ব্যস…এটুকুই। এখন ওই মেয়ের সাথে আমার কোনোরকম সম্পর্ক নেই সেই ডাউট তুই ফ্যামিলির কাছে ক্লিয়ার করবি। এরপর থেকে যেন কারোর মুখ থেকে মোহ নামটা না শুনি।”
সৌমিত্র বিভ্রান্ত হয়ে পড়ল। মাথায় তার কিছুই আসছে না।
“কিন্তু ভাইয়া! মোহের মতো মেয়েকে যতটুকুই দেখেছি তাতে কিন্তু মনে হয়নি ও এতবড়ো ভুল করতে পারে!”
স্বচ্ছ জোর গলায় প্রতিত্তোরে বলে,
“কারোর চেহারা দেখে বোঝা যায় নাকি এসব? অদ্ভুত কথাবার্তা বলিস তুই। আর মেয়েরা সামান্য ভালোবাসার অভিনয়ে যেভাবে গলে যায় তত তাড়াতাড়ি আইসক্রিমও গলতে পারে না। হোয়াটএভার, ওর বিষয়ে কিছু আলোচনা করতে ভালো লাগছে না। অশান্তি লাগছে আমার। দমবন্ধ অনুভূতি হচ্ছে। তুই যা এখান থেকে এখনি।”
সৌমিত্র বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। ফট করে বলে,
“তোমার এই অদ্ভুত অশান্তি হওয়ার কারণ কী ভাই? আমার কথায় বিরক্ত হচ্ছো নাকি ওই মেয়েটার কথা ভেবে অস্থির হচ্ছো?”
স্বচ্ছ মুহূর্ত না থেমে ঝড়ের গতিতে উঠে বসে বিছানায় নিচে ঝুঁকে নিজের পায়ের স্লিপার হাতে তুলে সৌমিত্রের দিকে তাক করতেই ছুট লাগায় সৌমিত্র।
রাতটা ভালোই হয়েছে। ইথান মোহকে জড়িয়ে ঘুমিয়েছে বেশ শান্তি মতো। মোহের চোখের পাতায় ঘুমের রেশ মাত্র নেই। তার বোধ হলো স্বচ্ছের সাথে কথা বলা বেশ প্রয়োজন। তাকে টাকা ফিরিয়ে দিতে বলেছে আজহার সাহেব। সেই সঙ্গে ধন্যবাদ স্বচ্ছ নামক ব্যক্তিটির প্রাপ্য। হয়ত শুধু ধন্যবাদ নয় তার চেয়ে বেশি কিছুই পাওয়া থেকে যায় স্বচ্ছ। কিন্তু এই মুহূর্তে মোহের কাছে কিছুই নেই।
মোহ আস্তে করে ইথানের হাত অন্যপাশে দিয়ে উঠে বসে ফোন হাতে নিয়ে জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। দমকা হাওয়ায় শান্তি মিলে তার। কল করে স্বচ্ছের নম্বরে। প্রথম দুইবার ফোন বেজেই চলল তবে কল ধরল না স্বচ্ছ। ইচ্ছে করেই ধরল না। এই অনিচ্ছার কারণ তার জানা নেই। তৃতীয় বারের বেলায় স্বচ্ছের মন বাঁধা মানল না যেন। উঠে বসে কল ধরে বেজায় রূঢ় সুরে বলল,
“হ্যালো! কী বলবে বলো?”
আচমকা স্বচ্ছের এমন কথা আশা করেনি মোহ। কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে সে। পরক্ষণেই নিজেকে ধাতস্থ করে বলে,
“তখন না বলেই চলে গেলেন যে! আসলে আপনাকে খুঁজছিলাম।”
“হঠাৎ আমাকে খোঁজার কারণ কী? প্রতিদিন তো এই দোয়া করো তাই না? যেন আমার সাথে তোমার দেখাই না হয়।”
“হ্যাঁ। তবে প্রথমবার আপনাকে খুঁজতে বাধ্য হয়েছি আজ।”
“কী কারণে?”
“ধন্যবাদ দিতে।”
স্বচ্ছ কাঠকাঠ গলায় বলে ওঠে,
“ব্যস…এইটুকুর জন্য? তোমার ধন্যবাদ পাওয়ার জন্য আমি তো হেল্প করিনি। যা করেছি বাচ্চাটার জন্য। তাই আলাদা করে ধন্যবাদ জানানোর কোনো দরকার নেই।”
মোহের ভ্রু কুঁচকে গেল এরূপ কথা শুনে। এইতো কিছুটা সময় আগেও যাকে মধুর লাগছিল তার এখন তার তিক্ত কথা শুনে বড়োই অপমানিত বোধ করছে সে। তখনি মোহের মনে হলো লোকটির সাহায্য করা শেষ সেকারণে ফের নিজের যতসব শত্রুতা টেনে এনেছে মনে। মোহও ঠিক করল মিষ্টি হলে চলবে না তার। সেও কণ্ঠে গাম্ভীর্য এনে জবাব দিলো,
“আপনার দরকার না থাকলেও কেউ উপকার করলে ধন্যবাদ দিতে শিখিয়েছে আমার বাবা। যাই হোক, আপনি ইথানের জন্য টাকা খরচ করেছেন। তার জন্যও ধন্যবাদ। আমি সেসব টাকা ফিরিয়ে দিতে চাই আপনাকে।”
“ওসবের কোনো দরকার নেই। কয়েক টাকার চিন্তা আমার নেই। টাকা ফিরিয়ে দেওয়ার চিন্তা করতে হবে না।”
কল কেটে দিলো স্বচ্ছ একথা বলেই। মোহ হতভম্ব হয়ে গেল। কিছু সময়ের ব্যবধানে একটা মানুষের মাঝে এত পরিবর্তন কী করে আসতে পারে সেটা তার বোধগম্য হলো না। একরাশ বিরক্তি নিয়ে বিড়বিড়িয়ে বলল,
“অদ্ভুত অসহ্যকর লোক তো!”
ফোনটা রেখে বাহিরের শীতল হাওয়ার কাছে নিজেকে তুলে ধরল মোহ। সারাদিনের এত জটিলতা শেষে পুরো দিনের স্মৃতি নাড়া দিতে থাকল মোহের মস্তিষ্কে। শীতলতা অনুভব বেশি হলো যখন তার এবং স্বচ্ছের বাইকে কাছাকাছি বসার মুহূর্ত মনে হলো! এত অস্বস্তিতে আগে কখনো পড়েনি সে। তার ধ্যান ভাঙল বাহিরের চেঁচামেচিতে। বসার ঘর থেকে মায়ের ক্রুদ্ধ কণ্ঠস্বর শুনে হন্তদন্ত হয়ে বাহিরে ছুটল।
বসার ঘরে পা রাখতেই পুলিশের আগমন দেখে বাকশক্তি হারায় মোহ। শরীরের লোম শিউরে ওঠে যখন দেখতে পায় তার বাবার হাতে জোর করে হ্যান্ডকাপ পরানো হচ্ছে। মিসেস. সুফিয়া বারংবার জোর গলায় মানা করছেন,
“সে কিছু করেনি। কেন তাকে ধরে নিয়ে যাচ্ছেন? আমার স্বামী অনেক ভালো মানুষ। সে অন্যায় করতে পারে না। এমনটা করতে পারেন না আপনারা।”
মস্তিষ্কের কার্যক্রম যেন বন্ধ হয়ে গেছে মোহের। সামনের এই দৃশ্যটা সবথেকে জঘন্য ঠেকছে তার কাছে। শক্তি জুগিয়ে দ্রুত সামনে এগিয়ে পুলিশের সামনে বাঁধ সেধে বলে,
“কেন আমার বাবাকে নিয়ে যাচ্ছেন? কী করেছে আমার বাবার? এটা উত্তর আপনাদের দিয়ে যেতে হবে।”
পুলিশ অফিসারটি বললেন,
“যদি না দিই তাহলে?”
“এইটুকু উত্তর দিতে আপনারা বাধ্য।”
মোহের গলায় জোর কমল না। পুলিশ অফিসার বললেন,
“তোমার কথার এই অতিরিক্ত তেজের জন্যই বোধহয় তোমার বাবাকে নিয়ে যেতে হচ্ছে।”
“মানে?”
“মানেটা হচ্ছে মন্ত্রী সাহেবের আদেশ, যতক্ষণ তোমার কণ্ঠস্বর নিমজ্জিত না হচ্ছে ততক্ষণ তোমার বাবা পুলিশ কাস্টারিতে থাকবে।”
মোহ বুঝতে পারল এবার কাজটি কার! পুলিশ আজহার সাহেবকে নিয়ে যেতে চাইলে ফের বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় মোহ। চিৎকার করে বলে,
“এটা আপনারা করতে পারেন না।”
“আমরা কী করতে পারি আর কী পারি না সেটা তোমার বাবা ঠিকই বুঝতে পারবে। বেশি আমাদের কাজে আটকালে পুরো পরিবারকে তুলে নিয়ে যেতে হবে।”
মোহ আরো কিছু বলতে চাইলে একহাতের ইশারায় আজহার সাহেব তাকে থামিয়ে দেন। তিনি চান না পরিবারের সবাইকে এই সমস্যায় ভুগতে দিতে। তিনি ছোট্ট করে বলেন,
“তোমার বাবা যদি সৎ হয়ে থাকে তাহলে ফিরে আসবেই চিন্তা করো না। তোমার মায়ের খেয়াল রেখো।”
পুলিশ নি/ষ্ঠুর ভাবে মোহের বাবাকে টেনে নিয়ে যেতে থাকে যেন তিনি কোনো পলাতক অ/পরাধী। মোহ নিজেকে সামলে উঠতে পারে না আর। পা দুটো অসার হয়ে আসে।
#যে_বর্ষণে_প্রেমের_ছোঁয়া
#আনিশা_সাবিহা
পর্ব ১৩
সোফার কাছে মেঝেতে বসে একাধারে কেঁদে চলেছেন মিসেস সুফিয়া। মোহ সোফার উপরে বসে রয়েছে মাথা নুইয়ে। না চাইতেও একজন অপ/রাধী মনে হচ্ছে নিজেকে। তার জন্য আজকে তার বাবা যে কিনা কোনো অ/ন্যায় আদতেও করেন নি তাকে তুলে নিয়ে গেল পুলিশ। মোহের বাবা সাইফুল এবার নিজেকে দোষারোপ করে বসলেন।
“সব দোষই আসলে আমার। না আমি ফ্যাক্টরি নিয়ে এসব ঝামেলায় জড়াতাম। আর না আজহার ভাইকে এভাবে পুলিশ ধরে নিয়ে যেত।”
মিসেস সুফিয়া কান্নারত সুরে চিল্লিয়ে বললেন,
“তোরা তো আমাকে কিছু জানাসও নি। এতকিছু ঘটল আমাকে বলার প্রয়োজনবোধও করিস নি। এখন পুলিশ তাকে নিয়ে গিয়ে কী করছে কিছুই বুঝতে পারছি না।”
মোহ মিসেস সুফিয়ার কাঁধে হাত রেখে শান্ত করার প্রচেষ্টায় বলল,
“মা, বাবার কিছু হবে না। বাবা তো কিছু করে নি।”
মিসেস সুফিয়া যেন এবার দাবানলের মতো জ্বলে উঠলেন। চিল্লিয়ে বলে ওঠেন,
“তুই তো কথাই বলিস না। কিছু করেনি তোর বাবা আমিও জানি। তবে কিছু না করেও কেন তাকে এমন শাস্তি ভোগ করতে হবে বলতে পারিস? তোর জন্য এতসব সইতে হচ্ছে তোর বাবাকে। আমি তো এটাই দোয়া করছি যেন তোর বাবার গায়ে ওরা হাত না তো/লে।”
মোহ আর কিছু বলার মতো সাহস জুগিয়ে উঠতে পারল না। নিজের মাঝে ভাঙতে থাকল সে। ছোটো হয়ে পড়ল নিজের কাছে। চোখ ভরে অশ্রু টলমল করল। কণ্ঠস্বর দুর্বল হয়ে পড়ল। সাইফুল তাড়াহুড়ো করে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন,
“আমার চেনাজানা একটা উকিলকে কল করেছিলাম। তিনি পুলিশ স্টেশনে যাচ্ছেন। আমাকেও যেতে হবে। সুফিয়া আপা তুমি চিন্তা করো না। আমি দ্রুতই দুলাভাইকে নিয়ে ফিরব।”
সাইফুল যেতে নিলে মোহ নিজেকে ধাতস্থ করে ঢক গিলে স্পষ্ট বলে ফেলল,
“মামা প্লিজ আমিও যাই?”
তৎক্ষনাৎ তার হাতটি চেপে ধরলেন মিসেস সুফিয়া। ধ/মকে উঠে বললেন,
“খবরদার না। এমনিতে অনেককিছু করে ফেলেছিস তুই। আর তোকে কিছু করতে হবে না। এবার থেকে আমার কথা অনুযায়ী চলবি মোহ। তোকে নিজের মতো অনেক চলতে দিয়েছি।”
“দয়া করে যেতে দাও মা। আমার জন্য বাবা আজকে পুলিশ কাস্টারিতে। একজন সন্তান হিসেবে এটা যে কত লজ্জাজনক সেটা আমি বুঝতে পারছি। নিজেকেই ধিক্কার জানাচ্ছি। আমিও বাবাকে ফিরিয়ে আনতে চাই।”
ঠাণ্ডা মাথায় সাইফুল বুঝলেন মোহের ব্যাপারটা। তিনি শান্ত গলায় বোনকে বোঝালেন,
“আপা ছেড়ে দাও ওকে। মেয়েটা তো খারাপ কিছু করে নি। যারা করছে তাদের কিছু বলা হচ্ছে না। মোহ শুধু কয়েকটা কথা বলেছিল যা ওদের সামনে বলা খুব দরকার ছিল। ওকে যেতে দাও।”
বারণ করতে আর পারলেন না মিসেস সুফিয়া। মাকে ইথানের খেয়াল রাখতে বলে মাথায় ওড়না জড়িয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলো মোহ হাতে ফোন নিয়ে।
“বললেই তো আর হয় না উকিল সাহেব। ওই লোকটাকে ততক্ষণ আমি ছাড়তে পারব না যতক্ষণ না আমি মন্ত্রী সাহেবের একটা কল পাচ্ছি।”
পুলিশ ইন্সপেক্টরের কথায় ভ্রু কুঁচকে এলো উকিল সাহেবের। মোহ আরো বেশি বিচলিত হয়ে পড়লেও সামলাতে হলো নিজেকে। উকিল সাহেব বরাবরের মতো ঠাণ্ডা গলায় জবাব দিলেন,
“কিন্তু কেন? আমি আজহার সাহেবকে ছাড়ানোর জন্য সব কাগজপত্র নিয়ে এসেছি। চাইলে চেক করে দেখতে পারেন।”
“তার কোনো দরকার নেই। এসব কাগজপত্র দিয়ে আদেও কোনো লাভ হবে না। এই মেয়েটা অযথায় মন্ত্রী সাহেবের মতো লোকের সাথে মুখ লাগাতে গিয়েই সব ঝামেলার সৃষ্টি করল। এমনিতে সরোয়ার সাহেবের মতো লোক আমি দুটো দেখিনি আর পৃথিবীতে। উপরে দেখাবে সরল আর আড়ালে থাকবে নি/কৃষ্ট রূপ! উকিল সাহেবের তো উনাকে চেনার কথা। কারোর সামনে মাথা নোয়াতে পছন্দ করেন না। উনার ইগোকে হার্ট করেছে এই মেয়ে।”
মোহ আর নিজেকে দমাতে পারল না। উঠে দাঁড়াল চেয়ার থেকে। তীব্র আক্রোশ ঝেড়ে বলল,
“আমি উনার সামান্য ইগো হার্ট করেছি বলে উনি আমার বাবাকে এই অবধি টেনে এনেছেন। আর ওই লোকটা যখন আমার মামাকে ধোঁকা দিয়ে এত গরীব লোকজনের কর্ম কেঁড়ে নিলো তার শা/স্তি ঠিক কী হওয়া উচিত আপনারাই বলে দিন? আর আমার তো মনে হচ্ছে না শুধু উনার ইগো হার্ট হয়েছে বলে উনি আমার বাবার সাথে এমন করলেন। এর পেছনে কারণ আরেকটা আছে। সেটা হচ্ছে ভয়। উনি আমাকে ভয় পাচ্ছেন। ভাবছেন আমি উপরমহলে পৌঁছালে ঠিক কী কী হতে পারে। একারণেই তিনি এমন একটা পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন।”
পুলিশ ইন্সপেক্টরও ক্ষেপলেন এবার। চটে গিয়ে ধমকালেন মোহকে।
“এই মেয়ে তুমি জানো কার সম্পর্কে কী কথা বলছ? আর একটা শব্দ বলেছ তো তোমার অবস্থাও তোমার বাবার মতো করে দেব।”
“করতে পারেন। আমার আপত্তি নেই। তবে ওই নির্দোষ মানুষটি অর্থাৎ আমার বাবাকে ছেড়ে দিতে হবে। আর আমি যা বলেছি তার একটা অক্ষরও ভুল বলিনি। উনার যদি এতই ইগো হার্ট হয় তাহলে বলবেন আমার সামনাসামনি হতে। কাপুরুষের মতো যেন পেছন থেকে কলকাঠি নেড়ে আমায় দুর্বল না করার চেষ্টা করে। আমার বাবাকে ছেড়ে দিন।”
মোহের ক্রোধ যখন লাগামহীন ভাবে বাড়তে দেখলেন সাইফুল তৎক্ষনাৎ তার হাত ধরে শান্ত করে বসালেন তিনি। মাথায় হাত বুলিয়ে ফিসফিসিয়ে বললেন,
“এভাবে বলিস না মোহ। আমার এই মুহূর্তে দুলাভাইকে ছাড়ানো প্রয়োজন।”
“ওরা আমার বাবাকে ছেড়ে দেবে না মামা। যতক্ষণ না ওই লোকটির ক্রোধ মিটবে ততক্ষণ আমার বাবাকে ছাড়বে না ওরা। নিজের ক্ষমতার অপব্যবহার করতে খুব ভালো করে জানে।”
মোহের কথা সত্যি হলো। কোনোমতেই আজহার সাহেবকে ছাড়তে রাজি হলো না পুলিশ। ব্যর্থ মোহ ভীষণ ছোটো হয়ে গেল নিজের কাছে আবারও। নিজের মাকে বড়ো মুখ করে বলেছিল বাবাকে নিয়ে ফিরবে। কিন্তু তা যে পারল না! এই মুখ নিয়ে মায়ের সামনে কীভাবে দাঁড়াবে এই ভাবতেই নিজের প্রতি চরম রাগ হচ্ছে তার। বিষাক্ত লাগছে সবটা। সারা রাস্তা নির্বিঘ্নে অবিরাম ক্রন্দনে র/ক্তবর্ণ হয়ে এলো ডাগরডাগর আঁখি। বক্ষস্থলের যাতনা দেখাতে পারল না কাউকেই।
সারারাত ঘুম হলো না মোহের। লোচনে জ্বালা ধরতে শুরু করল। ভোরের আলো ফুটতে না ফুটতেই স্বচ্ছের কথা স্মরণে এলো তার। বিলম্ব না করে ফোন হাতিয়ে দ্রুত ফোন লাগায় স্বচ্ছের নম্বরে।
সারারাত পেরিয়ে যখন নিশাবসান হলো তখন দুচোখের পাতা এক হয়েছিল স্বচ্ছের। নিন্দ্রা পুরো রজনি পালিয়ে বেরিয়েছিল তার থেকে। যখনি ঘুমটা গভীরতর হয়েছে তখনি ফোনের রিংটোনের শব্দটা সবথেকে বিরক্তিকর হয়ে উঠল তার কাছে। ইচ্ছে করল ফোন দূরে ছুঁড়ে ফেলে দিতে। তবে গুরুত্বপূর্ণ বোধ হলো হঠাৎ করেই। ফোনটা হাতাতে লাগল সে। কাছে পেয়ে চোখ বুঁজেই রিসিভ করে ঘুম জড়ানো দুর্বল কণ্ঠে কোনোরকমে বলতে সক্ষম হলো,
“হ্যালো!”
মোহ স্বচ্ছের কণ্ঠস্বর পাওয়া মাত্র উদগ্রীব হয়ে বলে ওঠে,
“হ্যালো! আপনার বাবার সঙ্গে আমি কথা বলতে চাই। যদি ফোনটা উনাকে দেওয়া যেত তবে উপকৃত হতাম।”
মেয়েলি চেনা কণ্ঠ। যার কণ্ঠস্বর সারারাত তার কানে বেজেছে। সেটা ভুলে যায় কী করে স্বচ্ছ? ভড়কে গিয়ে মাথা উঠিয়ে ফোন নম্বরের দিকে তাকাল সে। না ভুল নয়। মোহ মেয়েটিই কল করেছে তাও এ সময়! তাও কিনা তার বাবাকে চাইছে? কেন? বহু প্রশ্ন মনে নিয়ে সে বলল,
“মানে? এসময় কল দিয়েছ হঠাৎ? আবার আমার বাবাকে চাইছ। কী হয়েছে বলো তো? এখন কী চাইছ তুমি?”
“আপনার বাবাকে জিজ্ঞেসা করুন উনি কী চাইছেন? উনাকে প্রশ্ন করুন কেন আমার বাবাকে পুলিশে ধরিয়ে দিয়েছেন? আমার বাবা কী করেছে?”
স্বচ্ছের মাথা এবার ঘুরে উঠল মোহের কথায়। দ্রুত উঠে বসল সে। বিশ্বাস করতে যেয়েও বাঁধা পড়ল মনে। কারণ তার বাবার দিকে আঙ্গুল উঠছে।
“কী বলছ তুমি? যা বলছ ভেবেচিন্তে বলছ? তুমি জানো তুমি কী বলছ? আমার বাবা এমন না। আমি জানি আমার বাবার সাথে তোমার কথা কাটাকাটি হয়েছে। কিন্তু এর জন্য তিনি তোমার দুর্বলতার সুযোগ নেবেন না। এমন অপবাদ দিও না মোহ। ভালো হবে না।”
মোহ তাচ্ছিল্যের সহিত বলল,
“ভালো আর কী হবে? যখন থেকে আপনার সঙ্গে দেখা হয়েছে ঠিক তখন থেকে আমার জীবনে যা খারাপ হওয়ার ছিল সব হয়ে গিয়েছে। এখন আমার বাবার মতো একটা মানুষ জেলে অপ/রাধীর মতো রেখে দেওয়া হয়েছে। এবার মুক্তি দিন আমাদের।”
মোহের কথা এবার মোটেও হাওয়ায় উড়িয়ে দিতে পারল না স্বচ্ছ। সে সন্দিহান হয়ে শুধাল,
“প্লিজ মোহ! উনি আমার বাবা। তুমি না ভাবনাচিন্তা করে এসব বলো না। তুমি নিশ্চিত উনি তোমার বাবার সাথে এমনটা করেছে? করলেও কেন করবে বলো?”
“এটা আপনার জানা উচিত। শুনেছি আপনার বাবার বিশাল অহম। এই অহমের চোটে উনি যা ইচ্ছে তাই করতে পারেন। পুলিশ নিজে বলেছেন আপনার বাবার কথা। মুক্তি দিন আমার বাবাকে। দরকার হলে আমি উনার কাছে ক্ষমা চাইব। তাও আমি চাইনা আমার জন্য আমার বাবা এভাবে কষ্ট পাক।”
কল কেটে দিলো স্বচ্ছ বিনা উত্তর করেই। তার মস্তিষ্ক এই মুহূর্তে কেমন যেন ফাঁকা লাগছে। নিজের বাবার এই কর্ম বিশ্বাস হচ্ছে না তার। কেমন যেন সারাদেহ প্রদাহে ধ্বংস হচ্ছে। হনহনিয়ে নিজের ঘর থেকে বেরিয়ে এসে সরোয়ার সাহেবের ঘরের সামনে দাঁড়ায় স্বচ্ছ। আগপাছ না ভেবে জোরে আঘাত করে বসে দরজায়। ঘুমন্ত সরোয়ার সাহেব এবং মিসেস জেবা চমকেই ঘুম থেকে উঠে পড়েন। ধীর পায়ে গিয়ে মিসেস জেবা দরজাটি খুলতেই স্বচ্ছ শুধু বলে,
“সরি, মা। ডিস্টার্ব করতে চাইনি।”
এই বলেই গটগট করে ঘরে প্রবেশ সরোয়ার সাহেবের মুখোমুখি দাঁড়ায় সে। ছেলের এমন কর্মকাণ্ডে সরোয়ার সাহেব বেশ হতবাকই হয়েছেন বটে। পাশ থেকে চশমা নিয়ে চোখে দিতে দিতে বললেন,
“কী হয়েছে স্বচ্ছ? কোনো সমস্যা?”
“তুমি কবে থেকে নিজের ক্ষমতার অপব্যবহার করা শুরু করেছ বাবা?”
স্বচ্ছের সরাসরি এমন প্রশ্নে বিভ্রান্ত হয়ে পড়েন সরোয়ার সাহেব। মিসেস জেবাও খানিকটা ভ্রু কুঁচকে তাকালেন। মনে মনে ভাবলেন, ছেলেটা আবার বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে উল্টাপাল্টা কিছু খেয়ে এলো না তো?
“এইসময় আমাদের ঘুম ভাঙিয়ে এসব কী প্রশ্ন করছ তুমি স্বচ্ছ? তুমি কি সজ্ঞানে আছো?”
সরোয়ার সাহেবের কথায় স্বচ্ছও পাল্টা প্রশ্ন করল,
“আমিও জানতে চাই তুমিও কি সজ্ঞানে মোহ নামক মেয়েটির বাবাকে পুলিশে এ/রেস্ট করিয়েছ?”
সরোয়ার সাহেব এবার খানিকটা চকিতে তাকালেন। তারপর নিজের বিস্ময় সামলে নিলেন দ্রুতই। গম্ভীর হওয়ার প্রচেষ্টায় বললেন,
“তুমি তো নিজ চোখে দেখেছ ওই মেয়েটার আচরণ। ওর তো একটা শিক্ষা হওয়া উচিত। নয়ত ভবিষ্যতে আবার পেছনে লাগতে ছাড়বে না।”
স্বচ্ছ নিশ্চুপ রইল খানিকটা সময়। বুঝে উঠতে পারল না তার বাবার মতো বিচক্ষণ মানুষের চিন্তাভাবনা এতটা ছোটো হলো কী করে? নাকি আগের থেকেই ছোটো ছিল সেটা তখন বোঝেনি?
“বাবা! সবকিছুতে মেয়েটার বাবার দোষ কোথায় আমায় বলতে পারবে?”
“তুমি বুঝবে না স্বচ্ছ। ওই মেয়েটা আমাকে ভাঙার চেষ্টা করছে। রাজনীতির কারবার এসব…”
“আমি এত রাজনীতি বুঝিনা বুঝতেও চাই না। আমি শুধু বুঝি যার কোনো দোষ নেই তার শাস্তি হওয়া উচিত নয়। তুমি এখনি ইন্সপেক্টরকে কল করবে আর ওর বাবাকে ছেড়ে দিতে বলবে। নয়ত…”
ছেলের এমন কথায় কিছুটা ক্রোধ চেপে গেল সরোয়ার সাহেবের মনে। মিসেস জেবা ছেলেকে শান্ত করতে বললেন,
“স্বচ্ছ তোর বাবার সাথে কীভাবে কথা বলছিস?”
সরোয়ার সাহেব তাচ্ছিল্য করে বললেন,
“আজ নিজের ছেলেকে এত যত্ন করে বড়ো করে তাকে অন্যের তরফদারি করতে দেখতে হচ্ছে। তুমি কিন্তু ওই মেয়েটার জন্য আমার বিরুদ্ধে চলে যাচ্ছো স্বচ্ছ।”
“তোমার যা মনে হয় সেটা তুমি ভাবতেই পারো। তোমাকে আমি সবসময় একজন আদর্শ মানুষ ভেবে এসেছি। আমার ধারণাটাকে একটু একটু করে ভেঙে দিও না প্লিজ। আমি এক ঘণ্টার মধ্যে মোহের বাবার মুক্তির খবর জানতে চাই। নয়ত ভালো হবে না।”
স্বচ্ছ ঘর থেকে বের হওয়ার উদ্দেশ্যে পেছন ঘুরল। সরোয়ার সাহেব তীব্র ক্ষোভ নিয়ে বললেন,
“নয়ত কী করবে তুমি?”
এতক্ষণ কষ্টে চেপে রাখা রাগগুলো দাবানলের ন্যায় বেরিয়ে এলো এবার। সামনে ফিরে টেবিলের সমস্ত জিনিস একটানে ফেলে দিয়ে চিল্লিয়ে বলল,
“তুমি যা বলছ সেটাই করব বাবা। তোমার বিরুদ্ধে গিয়ে দাঁড়াব। আমার রাগ আর জেদ তোমার সূত্রেই পাওয়া। আশা করি সেইসবের ভয়া/নক ব্যবহার তুমি দেখতে চাও না। আমাকে ছোটো করে দিয়েছ তুমি। অস্বস্তি হচ্ছে নিজের প্রতি।”
নিজের চোখমুখ দুহাতে পাগলের মতো ঘষে দ্রুত বেগে প্রস্থান করল সে। সরোয়ার সাহেব যেন স্পষ্ট দেখতে পেলেন তার ছেলে তার থেকে আলাদা হয়ে যাচ্ছে। যার কারণ মোহ নামক রমনী।
চলবে…
[