#রঙধনুর_রঙ_কালো(১)
**********************
মিলার পরকীয়া প্রেম যেদিন মামুনের সামনে ধরা পড়লো, মিলা নিজেও খুবই অবাক হয়ে গিয়েছিলো, তার একটুও লজ্জা লাগলো না ! মিলা নিজেও চাইছিলো যে মামুন বিষয়টা জানুক । তারচেয়েও অবাক কান্ড তার দুই ছেলে মেয়ে যখন শুনলো তাদের মা অন্য কারো সাথে সম্পর্কে জড়িয়েছে তখন মিলার মনে হলো, সত্যিই সে ভারমুক্ত হলো । মিলা, মামুনেরও প্রেমের বিয়ে । গভীর প্রেম ছিলো ওদের । ভার্সিটিতে ওদের প্রেম ছিলো সবার মুখে মুখে । সবাই জানতো, মামুন পাগলের মতো ভালবাসে মিলাকে । সারাক্ষণ দুজন একসাথে । দুজন দুজনকে সব ঝড় ঝঞ্ঝা থেকে আগলে রাখতো সবসময় । সেই মিলা আজ অন্য কারো সাথে প্রেমের সম্পর্ক গড়েছে । জীবনের হিসাব নিকাশ বড়ই অদ্ভুত!
কখন যে প্রেম হয়ে গেলো সাইফের সাথে মিলা বুঝতেই পারেনি । সাইফ ওর ক্লায়েন্ট । মিলা আর মামুন দুজনেই ব্যাংকে কাজ করে । সারাদিন ব্যস্ত থাকতে হয় ওদের । দুজন আছে দুই ব্যাংকে । সারাদিনে দুএকবার ফোনে কথা হয় ওদের । বাচ্চাদের খোঁজ নেয় । ছুটির সময় মামুন চলে আসে মিলার ব্যাংকে । তারপর একসাথে বাড়ি ফেরে । ভালোই চলছিলো সবকিছু ।
প্রথম যেদিন সাইফ ব্যাংকে এসে মিলার খোঁজ করেছিলো, মিলা তখন ভীষন ব্যস্ত । কর্পোরেট শাখায় পাঠানোর জন্য কোনো একটা ফাইল রেডি করছিলো । মিলার ভাই নিশো’র পরিচিত সাইফ । মিলা সাইফকে কিছুটা সময় বসতে বলে খুব দ্রুত হাতে গুছিয়ে নিচ্ছিলো কাজগুলো । এরমাঝে দুএকবার চোখাচুখি হতেই মিলা দেখলো, সাইফ অপলক চেয়ে আছে ওর দিকে । মিটিমিটি হাসছে । একটু অস্বস্তি লাগছিলো মিলার । তারপরও সৌজন্য হাসি বিনিময় করে মিলা বলেছিলো –
সাইফ ভাই, সরি আপনাকে অপেক্ষায় রাখছি । কাজটা খুব জরুরী । আর একটু অপেক্ষা করতে হবে প্লিজ ।
টেক ইওর টাইম প্লিজ। আমি তো আছি । আপনার জন্য সারাদিন অপেক্ষা করতে পারব ।
থ্যাংকস সাইফ ভাই ।
অথবা সারাজীবন ।
জ্বী? কিছু বললেন?
না, না । আপনি কাজ শেষ করুন । তাড়াহুড়োর দরকার নেই । আমার হাতে সময় আছে । আমি অপেক্ষা করছি ।
নিজের কাজে মন দিয়েছিলো মিলা । কাজ শেষে সাইফের সামনে এসে বসলো সে । সাইফের বড় ব্যাবসা । কারেন্ট একাউন্ট খুলবে মিলার ব্যাংকে । সারা বছর বড় বড় লেনদেন। এমন ক্লায়েন্টের অপেক্ষায়ই তো থাকে ওরা সবসময় । মিলা একটু বাড়তি খাতির করেছিলো সাইফকে সেদিন । ফেরার পথে মামুনের সাথে সাইফের গল্প করেছিলো মিলা –
জানো, ভাইয়ার এক পরিচিত লোক এসেছিলো আজ । একাউন্ট খুলল আমাদের এখানে । বিরাট ব্যাবসা ।
ভালোই তো হলো । ভাইয়াকে ট্রিট দিও, সাথে আমাদেরও ।
হুম, মনটা খুব ভালো লাগছে জানো । এমন বড় দুই চারজন ক্লায়েন্ট থাকলে একটু নির্ভার থাকা যায় । টার্গেট ফিল আপ অনেক সহজ হয় ।
এমন দু’একটা ক্লায়েন্ট আমাদের এখানেও মাঝেমধ্যে পাঠিও । আমারও কাজে আসবে ।
হুম, সত্যি তাই । আচ্ছা শোনো, কাল কিন্তু প্যারেন্টস মিটিং । আমি আগে থেকেই বলে রাখছি, কাল আমার সারাদিন টাইট সিডিউল। কাল তোমায় ম্যানেজ করতেই হবে ।
আরে দুর, দুই চারটা মিটিংয়ে না গেলে কী হয়? আমরা কী লেখাপড়া করিনি? আমাদের মা বাবা তো জানতো ই না স্কুলের ভিতরটা কেমন দেখতে। কী প্রতি মাসে সব হাবিজাবি, ভাল্লাগে না । আর আমার ছেলেমেয়ে তো লেখাপড়ায় ভালো, আচরণ ঠিকঠাক । প্রতিবার তো মিস এই একই কথা বলে । যাওয়া লাগবে না, বাদ দাও ।
আরে না, না, বাদ দেয়া যাবে না । না গেলে মিস ভাববে, আমরা বাচ্চাদের বিষয়ে সচেতন না ।
এইবার শেষ, এরপর তুমি যাবা । এই সক্কাল সক্কাল স্কুলে যাও তাও যদি বাচ্চাদের বাবারা থাকতো? আর শোনো, এই সাত সকালে কিছু বাচ্চার মা এমন বস্তা বস্তা মেকআপ করে আসে যে পিলে চমকিয়ে যায় । এরা কী আগের রাত থেকে সাজা শুরু করে নাকি!
আহা,, মেয়েরা তো একটু সাজেই ।
এইটা একটু সাজ!! তাহলে যেদিন বেশী সাজ দিবে সেদিন তো সাজের ভারে পৃথিবী একদিকে কাত হয়ে যাবে ।
তোমাকে কী বাচ্চার মা’দের সাজ দেখতে পাঠাই?
এইজন্যই তো বলি তুমি যাও । আমি আর যাবো না ।
ঠিক আছে, এরপর থেকে আমি যাবো শুধু কালকের দিনটা ম্যানেজ করে নাও প্লিজ ।
হুম, ঠিক আছে ।
এই এই গাড়ি থামাও, মামুন গাড়ি থামাও প্লিজ।
গাড়ি থামবে না । কারন আমি তোমাকে এখন রাস্তার ধুলামাখা ফুচকা খেতে দেবো না ।
মাত্র একপ্লেট খাবো তো ।
একটাও না ।
প্রতিদিনের এই খুনসুটি করতে করতে বাড়ি ফেরা । বাড়িতে ফিরে ছেলেমেয়ের মুখ দেখলে সমস্ত ক্লান্তি দুর হয়ে যায় । মেয়েটা আগে খুব মন খারাপ করতো । প্রায়ই বলতো –
মা, কেন তুমি সারাক্ষণ আমাদের সাথে থাকো না?
কেন মা, বিনু খালা তো থাকেই তোমাদের সাথে সবসময় । বিনু কী তোমাকে বকা দেয়?
না মা, বিনু খালা খুব ভালো । আমাকে চুল বেঁধে দেয়, আমার সাথে পুতুল খেলে, ভাইয়ার সাথে বল খেলে কিন্তু বিনু খালা তো মা না, তাই না মা?
মা যে অফিস করে সোনা ।
কেন অফিস করতে হয় তোমার? বাবা যাক না অফিসে । সবার বাবা অফিসে যায় আর সবার মা বাচ্চাদের আদর করে ।
আমিও তো তোমাদের আদর করি ।
করো..…. কিন্তু আমার বন্ধুদের মতো না । ওদের মা’রা টিফিন টাইমে এসে বসে থাকে, তুমি জানো? ছুটির সময় সবাই কম্পিটিশন করে, কে সবার আগে দৌড়ে তার মাকে জড়িয়ে ধরবে । আর আমি শুধু দেখি । আমার খুব মন খারাপ লাগে মা ।
আচ্ছা আমিও একদিন যাবো তোমার স্কুলে ।
একদিন? শুধু একদিন যাবে?
এখন যাও তো তাড়াতাড়ি হোমওয়ার্ক গুলো করে নাও । অনেক কথা হয়েছে । এবার মা একটু কাজ করব, তুমি যাও ।
বাচ্চাদের সাথে মিলার চেয়ে মামুনের বেশী ভাব । বাচ্চারা বোধহয় ওকে একটু ভয়ও পায় । পাক, এই ভয় পাওয়াটা এনজয় করে মিলা । সারাক্ষণ লেপ্টালেপ্টি একদম পছন্দ করে না সে । বিয়ের পর অন্তত কয়েকটা বছর ফ্রি থাকতে চেয়েছিলো সে । বাচ্চা, বাচ্চা করে তাকে পাগল বানিয়ে ফেলেছিলো মামুন । বার বার বলতো –
তোমার কিচ্ছু করতে হবে না । সব কাজ আমি করবো । বাবুর সব দেখাশোনার কাজ আমার ।
একটা বাচ্চা মানেই অনেক দায়িত্ব মামুন । আমরা দুজনই চাকরিতে ঢুকবো । বাচ্চার দেখাশোনা করবে কে বলো?
একটা ব্যবস্হা হবেই ।
আমার মা, শ্বাশুড়ি সবাই তো আছেন । দেখো ঠিক একটা ব্যবস্থা হবেই ।
শেষ পর্যন্ত মামুনই জিতলো । মিলার অনিচ্ছা সত্ত্বেও বাচ্চা নিয়েছিলো ওরা । ছেলের অন্য একটা নাম ঠিক করেছিলো মামুন তবে ছেলের মুখ দেখে সেই নাম পাল্টে নাম রাখলো অপূর্ব । ছেলে পুরো মা’র চেহারা পেয়েছে । মিলা অসম্ভব রুপবতী । মেয়ে পূর্বা’র জন্ম তার পরের বছর ।
সত্যি সত্যিই মিলা তেমন কোনো দায়িত্ব নেয়নি বাচ্চাদের। সমস্ত কাজ মামুন করতো । তার যেন কোনো ক্লান্তিই লাগতো না । প্রথম কিছুদিন তারা মিলা’দের বাড়িতে ছিলো তারপর নিজেদের ফ্ল্যাটে চলে এসেছে । গ্রামের বাড়ি থেকে মা বিনুকে পাঠিয়েছিলেন । সেই থেকে বিনু আছে তাদের সাথে । বিনু ভীষন যত্ন আর আদর করে অপূর্ব, পূর্বাকে । ওরাও বিনু খালা বলতে অজ্ঞান । মা’র আদরটা ওরা আসলে বিনু’র কাছ থেকেই পায় ।
সাইফ ঘন ঘন আসতে শুরু করলো অফিসে । কখনো কাজ নিয়ে আসে, কখনো এসে বলে, এই পাশেই কাজ ছিলো তাই ভাবলাম আপনার সাথে একটু দেখা করে যাই । সাইফ এতো ভদ্র ভাবে কথা বলে যে মিলা রাগ করতে পারে না । আর সে আসে সবসময় লাঞ্চ আওয়ারে । তখন কাজের চাপ সামান্য কমে । এক কাপ চা খেয়েই চলে যায় । এমন কোটিপতি ক্লায়েন্টের সাথে মিলা হাসিমুখেই এক কাপ চা খেতেই পারে ।
এরপর যেদিন সাইফ এলো, পুরোই চমকে গিয়েছিলো মিলা । সেদিন ওর জন্মদিন । লাঞ্চ আওয়ারে সাইফ যখন ওর ডেস্কের সামনে এসে দাঁড়ালো, হাতে একটা বক্স আর ছোট্ট একটা ফুলের তোড়া । মাত্র তিনটে গোলাপ দিয়ে তোড়া বানানো কিন্তু এতো সুন্দর গোলাপ এর আগে কখনোই দেখেনি মিলা । রঙগুলোও খুব অদ্ভুত- বেগুনি, নীল আর সাদা গোলাপটার থেকে মনে হলো আলো ঠিকরে বেরোচ্ছে। মিলার অবাক ভাব কাটছিলো ই না । গোলাপগুলো হাতে নিয়ে চিন্তার কোনো কুলকিনারা করতে পারছিলো না যে সাইফ তার জন্মদিনের কথা কী করে জানলো! বক্সটা তখনো খোলেনি সে । মুগ্ধতা নিয়ে ফুলের দিকেই চেয়ে আছে । সাইফের কথায় মিলা’র ঘোর কাটে –
হ্যাপি বার্থডে মিলা ।
থ্যাংকস সাইফ ভাই, বসুন । কিন্তু আপনি কী করে জানলেন আজ আমার জন্মদিন?
ইচ্ছে থাকলে জানা যায় বুঝেছো ।
আমার সত্যিই ভীষন অবাক লাগছে ।
আচ্ছা তোমার বয়স কতো হলো বলতো, পঁচিশ?
মানে কী! আমার ছেলে ক্লাস সেভেনে পড়ে, মেয়ে সিক্সে ।
যাহ,, একদমই বিশ্বাস করলাম না । তুমি অফিসে বসে আছো বলে পঁচিশ বললাম, বাইরে হলে আঠারোর বেশী আমি মানতামই না ।
কী যে বলেন না আপনি সাইফ ভাই ।
একদম সত্য কথা বলি আমি । তোমাকে দেখলে তো মাঝে মাঝে আমার কাছে রুপকথার রাজকন্যার মতো লাগে । তুমি নিজেও জানো না তুমি কতোটা সুন্দর ।
এইসব মন গলানো কথা মিলা এই পর্যন্ত অনেকবার শুনেছে তবে সাইফের কথার মধ্যে কেমন একটা মাদকতা আছে । কেমন যেন চুম্বকের মতো টানে ।
আচ্ছা আজ দুপুরটা কিন্তু তুমি আমাকে দিচ্ছো । মানে আমি জোর করে তোমার আজকের এই বেলাটা নিয়ে নিচ্ছি ।
ঠিক তখনই মামুনের ফোন আসলো । মামুনের ফোনটা রিসিভ করার আগেই মিলার মনে পড়লো আজ দুপুরে ওদের একসাথে লাঞ্চ করার করার কথা । আজ প্রথম মিলা মামুনের সাথে মিথ্যে কথা বললো –
হ্যালো মামুন..
হ্যা মিলা আমি আসছি ।
না,না, শোনো না, আজ না হঠাৎ খুব জরুরী একটা ফাইল রেডি করার কথা । আমার না মনেই ছিলো না । এখন বেরুলে আজ আর ফাইলটা জমা দিতে পারব না । আচ্ছা রাতে তো সবাই বাইরে যাবোই, তাই না ।
রাতেরটা রাতের হিসাব । এতো বছরে এমন কখনো হয়েছে যে এদিন দুপুরটা আমরা একসাথে কাটাইনি?
আরে বাবা কাজ কী বলে কয়ে আসে? এখন একদমই সম্ভব না । প্লিজ একটু বোঝার চেষ্টা করো । আমাদের কাজের খবর তুমি জানো না বলো?
হুম, ঠিক আছে । সন্ধ্যায় দেখা হচ্ছে । রাখছি, বাই।
বাই । ফোন রেখে মিলা নিজেই অবাক হয়ে যায় । এভাবে সে মিথ্যে বললো মামুনের সাথে! সাইফের জন্য! কীভাবে সম্ভব? আর একটা বিষয় খেয়াল করলো সে, সাইফ আজ তাকে তুমি করে বলছে । আর অদ্ভুত ব্যাপার হলো, বিষয়টা তার কাছে কেন যেন ভালো লাগছে । চিন্তা ভাবনাগুলোকে আপাতত পাশ কাটিয়ে মিলে বেরিয়ে পড়লো সাইফের সাথে…………
চলবে …