রইলো তোমার নিমন্ত্রণ পর্ব -০১

পাত্র হিসাবে নিজের ভার্সিটির বহিষ্কৃত ইংলিশ টিচারকে দেখে থমকে যায় ভূমি। অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে সেই টিচারের দিকে। এক বছর আগের বহিষ্কার করা টিচার আর আজকের এই পাত্র প্লাজ এক্স টিচারের মাঝে আকাশ-পাতাল তফাৎ। সেদিনের সেই হাসিখুশি শিক্ষক আজ বদলে গেছে এক গম্ভীর কঠিন এন্ড ডিটারমাইন্ড মানুষে। চোখে তার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি, যেন একনজর কাউকে দেখলে তার মনের কথা হলপ বলে দিতে পারবে। ভূমি চায়ের ট্রেটা পাশের টেবিলে রেখে তার সামনে দাঁড়িয়ে বলে,

“স্যার আপনি?”
লোকটা কোন জবাব না দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে তার পাশে থাকা ভদ্র মহিলার দিকে তাকিয়ে বলল,

” মা, আমি আসছি আর তুমিও এসো।” তারপর কাউকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে সে চলে যায় বাড়ির বাহিরে। ভদ্র মহিলা তার ছেলের চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে। তারপর সামনে তাকিয়ে ভূমির বাবা মায়ের সামনে হাত জোড় করে ক্ষমা চেয়ে উঠে দাঁড়ায়। তখনি ভূমি প্রশ্ন করে,

” স্যার এখন ঠিক আছেন?” ভদ্র মহিলা মৃদু হেসে সম্মতিসূচক মাথা নাড়ায়। তারপর প্রস্থান করেন। ভূমি ওর বাবা মায়ের দিকে একনজর তাকিয়ে দৌড়ে নিজের রুমে চলে যায়। ফ্রেশ হয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়াতেই এক রাশ দক্ষিণা বাতাশ ছুয়ে যায় ভূৃমির মন। সারাদিনের তিক্ত থাকা মনটা মূহুর্তের ভালো হয়ে যায়। জানালায় হাত রেখে আবেশে দুচোখ বন্ধকরে নেয় সে। তখনি চোখের সামনে ভেসে উঠে আরাভের গম্ভীর মুখ। চট করে চোখ খুলে ভূমি। আর বলে,

” একটা ঘটনা মানুষকে কতটা বদলে দিতে পারে। আগে স্যারটা কত সুন্দর হাসি খুশি ছিলো। আর আজ স্যারকে দেখলে মনে হয় স্যার হাসতেই ভুলে গেছেন।”

ভূৃমির ভাবনার মাঝেই ওর মা রোজিনা হোসাইনের ডাক পরে। রোজিনা হোসাইন ভূমির কাছে এসে বললেন,

“খাবি চল।”
” আমার ক্ষিদে নেই মা, প্লিজ আমাকে একটু একা থাকতে দাও।”
রোজিনা হোসাইন ভূমির মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন,
” ছেলেটাকে আগে থেকেই চিনিস?”
“হ্যাঁ, ইনিই সেই টিচার মা। জুহায়িন আহমেদ আরাভ। ড্রাগ এডিক্টের কারনে যাকে কলেজ থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। কিন্তু জানো মা স্যার সেদিন একবারের জন্যেই স্বীকার করেননি সে ড্রাগস নেয়, আবার অস্বীকার ও করেনি। শুধু বলেছিলো, আমার শরীরে যখন ড্রাগস পাওয়া গেছে তাহলে নিশ্চয় সেটা সঠিক। ডক্টরের সাথে তো আমার শত্রুতা নেই যে সে ভুল রিপোর্ট দিবে না। আমাকে সাসপেনন্ড করুন স্যার।’ জানো মা স্যার সেদিন নিজের ইচ্ছেয় চলে গিয়েছিলেন। যাওয়ার সময় কলেজের দিকে অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে হাসছিলো।”

“ছেলেটা সত্যিই অদ্ভুত।” ভূমির দিকে তাকিয়ে বললেন রোজিনা হোসাইন।

” হুম।”

” আচ্ছা অনেক কথা হলো এবার খাবে চল। তোর বাবা অপেক্ষা করছে।” রোজিনা হোসাইন ভূমিকে তাড়া দিয়ে বললেন। ভূমি বলল, ” আমার ক্ষিদে নেই মা তুমি যাও না, যাও। প্লিজ আমাকে জোর করো না।” রোজিনা হোসাইন ভূমির দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে দীর্ঘশ্বাস ফেলেন তারপর ভুমির মাথায় হাত বুলিয়ে প্রস্থান করেন। ভূমির দৃষ্টি এখন জানালার বাইরে।

____________
ড্রাইনিং এ রাতের খাবার সাজাচ্ছে আর নিজের কপালকে দোষারোপ করে চলেছেন অনিমা বেগম। এত এত মেয়ে দেখেও ছেলেকে বিয়ের জন্যে রাজি করাতে পারেনি সেই দুঃখে এখন নিজের ভাগ্যকেই দায়ি করছেন তিনি। এমন সময় নিচে নামলো আরাভ। পড়নে হোয়াইট জিন্স আর ব্রাউন কালারের শার্ট, মাথার চুলগুলো বরাবরের মতো পরিপাটি। শার্টের হাতা গুটাতে গুটাতে বাহিরে বেড়িয়ে যাচ্ছে আরাভ এমনি সময় অনিমা বেগম বলে উঠলেন,
” রাতের খাবার ফেলে কোন রাজকার্য করতে যাচ্ছো শুনি?” দাঁড়িয়ে পরে আরাভ। সন্দিহান চোখে মায়ের দিকে তাকিয়ে বলে,
” তুমি এভাবে কেন কথা বলছো মা?” অনিমা বেগম রাগে গটগট করতে করতে বললেন,

” তো তোমার সাথে কি মুখে মধু দিয়ে কথা বলতে হবে নাকি। আজ তুমি যা করলে না, মান সম্মান আর রাখলে কই।”

আরাভ ওর মায়ের কাছে এসে গভীর ভাবে তার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে গম্ভীর গলায় বলল,
” আমার বিয়ে দিবে ভালো কথা তাই বলে তুমি আমার ছাত্রীর বাড়িতে বিয়ের প্রপোজাল নিয়ে যাবে। তুমি তো ছাত্রীকে পাত্রী বানতো চাইছো মা। এটা হবে না।”

” কেন হবে না শুনি। আর ওই মেয়েটা তোর ছাত্রী আগে ছিলো এখন নেই। তাই আমি ওই মেয়েটাকেই তোর বউ হিসাবে দেখতে চাই।”

” ওহ্ মা, বাচ্চাদের মতো জেদ করনা তো। আমি নেক্সট মান্থে ভাসানী প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে জয়েন করছি।”

” আবার ভাসানী প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়! ”

” হুম মা। আশা করি এবার এই পাত্রী নামক ছাত্রীর ভুত তোমার মাথা থেকে নামবে। আসছি আমি, ফিরতে লেট হতে পারে।”

অনিমা বেগমকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে চলে যায় আরাভ। অনিমা বেগম কপাল চাপড়াতে চাপড়াতে চেয়ার টেনে বসে পড়েন। বিড়বিড় করে বলেন,
” কেন যে এই ছেলেটা কোন কথা শুনেনা। যে কলেজ মান সম্মান প্রফেশন সব কেড়ে নিলো আবার কেন সেই কলেজেই জয়েন করতে হবে। ওহ আল্লাহ এই ছেলেটার মাথায় একটু তো বুদ্ধি দাও।

দরজা খুলতেই মৃদু আলো এসে পড়ে যুবকটার চোখে। নিঃশব্দে দরজা বন্ধকরে সামনের দিকে এগিয়ে যায়। পুরো রুম অন্ধকার। শুধুমাত্র ডেক্সটপের আলোয় আলোকিত। চারজন লোক যারা তাকিয়ে আছে পিসির দিকে। একজনের হাতে ছোট্ট মাউস আর মাথায় হেডফোন। আরাভ ওদের সামনের গিয়ে দাঁড়াতেই সে লোকটা তার আসন ছেড়ে দিলো। আর যুবকটা পিসির সামনে বসে মাথায় হেডফোন গুজে দ্রুত কিবোর্ডে কিছু টাইপ করতে লাগলো।

_____________________
একবছর তিনমাস পর ইংলিশ টিচার্স জুহায়িন আহমেদ আরাভ আবার কলেজ জয়েন করেছেন। পুরো ভার্সিটি জুরে কানাঘুষা চলছে স্যারকে নিয়ে। আগে যে স্যার ছাত্রদের আইডেল ছিলো আজ সেই স্যারকে নিয়ে কলেজে সমালোচনা চলছে। কেউ কেউ বাকা চোখে তাকাচ্ছে স্যারের দিকে। অফিসরুমে বসে নিজের কাজ করছে আরাভ এমনি সময় কম্পিউটার সাইন্স ডিপার্টমেন্টের হ্যেড স্যার মনিরুল ইসলামের প্রবেশ। আরাভকে দেখে মনিরুল বলে উঠল,

” হেই ইয়াংম্যান, কি অবস্থা আপনার?”

আরাভ লেপটপ থেকে চোখ সড়িয়ে মৃদু হেসে বলল,
” আই এম ফাইন স্যার।”

আহনাফ লেপটপ বন্ধকরে উঠে দাঁড়িয়ে গম্ভীর গলায় বলে,
” আমাকে ইয়াংম্যান বলার আগে নিজেকে দেখে নিবেন স্যার। আপনাকে তো আমার চেয়েও ছোট লাগে। আসছি স্যার। থার্ড ইয়ারে একটা ক্লাস আছে।”

মনিরুল স্যারকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে আরাভ বেড়িয়ে আসে। মনিরুল স্যার চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিজের কাজ করতে থাকেন। একবছর তিনমাস চারদিন পর আজ থার্ড ইয়ার ক্লাসে আসছে আরাভ। Victorian Poetry ক্লাস এখন। ক্লাসে আসতেই বরাবরের মতোই তাকে সম্মানের সহিত সবাই দাঁড়িয়ে যায়। আরাভ গুড মর্নিং বলে সবাইকে বসতে বলে সে Victorian Poetry বইটা হাতে নেয়। পড়ার মাঝে তার চোখ একটা জায়গায় আটকে যায়। ভূমি! এটা ভূমিই তো। মেয়েটা এমন অদ্ভুত ভাবে তাকিয়ে আছে কেন? চোখে চসমাটা একটু নেড়েচেড়ে ঠিক করে নেয়। নাহ মেয়েটা এখন আর তাকিয়ে নেই। তারমানে সে এতক্ষণ কল্পনা দেখছে। ভূমিকে দেখে আসার পর থেকে অনিমা বেগম বিয়ের জন্যে এত এত প্রেশার দিয়েছে আর সারাক্ষণ বাড়িতে ভূমির কথা চলতে থাকায় আরাভ এখন যেখানে সেখানে ভূমিকে দেখতে পায়। এইতো সেদিন সকালে আরাভ ঘুমিয়ে আছে তখনি দেখলো আকাশি রংয়ের শাড়ি পরিহিতা একটা মেয়ে মাথায় ভেজা চুলথেকে চুইয়ে চুইয়ে পানি পড়ছে তার কোমড়ে। ঠোঁটে হাসি আর হাতে এককাপ ধোয়া উঠা চা নিয়ে তার সামনে দাড়িয়ে তাকে ডাকছে। আরাভ বেঘোরে ঘুমাচ্ছে কোন সাড়াশব্দ করছে না তাই মেয়েটা বাধ্য হয়ে তার মাথাচুল ঝাকি দিলো আরাভের মুখের উপর। মুখের উপর পানি পড়তেই আরাভ আরাভ হুরমুর করে উঠে বসে আর মেয়েটা আরাভের হাতে চায়ের কাপ দিয়ে চলে যায়। আরাভ চায়ে চুমুক দিয়ে মিষ্টি হেসে বলে, ” তোমার সিগ্ধ চুলের মাতাল করা পানি আমার মুখের না পড়লে যে আমার ঘুৃমটাই ভাঙে না।” মেয়েটা কিছু না বলে মিষ্টি হেসে চলে যায়। আরাভ পিছু ডেকে বলে, কোথায় যাচ্ছো? যেন। যেও না ভূমি।” মেয়েটা চলে গেল। হুমড়ি খেয়ে উঠে বসে আরাভ। আশেপাশে তাকায় না কে নেই। সে একা ঘরে। সে তো বিয়ে করেনি ভূমি আসবে কোথা থেকে। এটা স্বপ্ন ছিলো। হ্যাঁ স্বপ্ন ছিলো এটা। চমকে উঠে আরাভ। চারিদিকে চোখ বুলিয়ে দেখে সবাই তার দিকে তাকিয়ে আছে। আরাভ চোখ বন্ধকরে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, আরাভ এটা তোর ক্লাস, ক্লাসে কনসেন্ট্রেন্ট কর।” চোখ খুলে সামনে আরো একবার ভূমির দিকে তাকিয়ে নিজের পড়ানোতে মনোযোগ দেয়। ভূমি এতক্ষণ মাথা নিচু করে বসেছিলো। তখন আরাভের সাথে চোখ চোখ পড়ায় লজ্জায় মাথা নিচু করে নিয়েছিলো। পড়ার ফাঁকেফাঁকে আরাভের দিকে তাকাচ্ছে ভূমি। আর মেলানোর চেষ্টা করছে ভার্সিটি থেকে বহিষ্কার করার আগে স্যার পড়ার ফাঁকেফাঁকে কতশত গল্প করতো আর এখন স্যার দরকারের বেশী কথাই বলে না।

ছুটির শেষে রাস্তায় দাঁড়িয়ে রিক্সার জন্যে অপেক্ষা করছে ভূমি আর দিয়া। দিয়া ভূমির বেস্ট ফ্রেন্ড। ছোট থেকে দুজনে একসাথে বড় হয়েছে। দুজনের স্কুল এক কলেজ এক ভার্সিটিও এক। তবে বেশ কিছুদিন যাবৎ দিয়ার মাঝে বিরাট পরিবর্তন এসেছে। আগে দিয়া খুব একটা কথা বলতো না তবে এখন তার মুখে সারাক্ষণ কথার ফোয়ারা ফুটেই থাকে। সবচেয়ে বেশী কথা বলে তার বয়ফ্রেন্ড ইমাদকে নিয়ে। ভূমি রাস্তায় উকি দিচ্ছে এমনি সময় দিয়া বলে,

” দোস্ত চলনা আজকে হাইটা হাইটা বাড়ি যাই। কতদিন একসাথে দুজনে হাটি নারে।”

ভূমি নিঃচুপ। সে রাস্তার দিকে তাকিয়ে আছে। দিয়া আবার বলল,
” এই ভূমি তুই জানিস কাল ইমাদ আমার জন্যে কেক বানিয়ে আনছিলো। জানিস খেতে খুব টেষ্ট। ভাবছিলাম তোর জন্যেও নিয়ে আসবো কিন্তু সকালে উঠে দেখি দিশা সব ফিনিশ করে ফেলছে। শোননা বলছি কি ইমাদকে না আবারও কেক বানিয়ে দিতে বলবো। তারপর সেটা তুই আর মিলি খাবো। ভালো হবে না।”

ভূমি মাথা নাড়িয়ে ছোট্ট্ করে বলল,
” হু।

ঠোট চেপে লম্বাশ্বাস নেয় ভূমি। তখনি ওর পাশ দিয়ে যায় একটা বড় কালো গাড়ি। গাড়ির জানালা খোলা রাখায় বুঝতে অসুবিধা হলো না এটা কার গাড়ি। আরাভ ড্রাইভ করছে। ভূমির সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় একপলক ভূমির দিকে তাকিয়ে গাড়িয়ে চালানোতে মন দেয় সে। ভূমি তাকিয়ে রইলো গাড়ির দিকে। যতক্ষণ না চোখের আড়াল হলো সে তাকিয়ে রইলো। গাড়ি চোখের আড়াল হতেই একটা রিক্সা এসে থামলো ভূমি আর দিয়ার সামনে। রিক্সা ওয়ালা বলল,

” ম্যাডাম রিক্সায় উঠেন।”

দিয়া আর ভূমি একে অপরের দিকে তাকায়। ভূমির কপালে সুক্ষ্মভাজ। ভ্রুদ্বয় কিৎচিত ভাজ। এবং এভাবে সে রিক্সায় উঠে বসলো। রিক্সাওয়ালা যেতে যেতে বলল,

” ম্যাডাম কোথায় যাবেন?

ভূমির কপালের ভাজ আরো গাঢ় হলো। মনে হাজারো প্রশ্ন নিয়ে বলল, বৌ-বাজার তিন নম্বার রোড।

চলবে,,,,,,

#রইলো_তোমার_নিমন্ত্রণ।
[০১]
Mahfuza Afrin Shikha.

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here