#রঙ_বেরঙের_খেলা
#আলিশা
#পর্ব_১৩
— বুঝিনি তোমার কথা।
অসম্ভব আশ্চর্যতায় জড়িয়ে গিয়ে সভ্য প্রশ্ন ছুড়ে দিলো সাবিহার দিকে। সাবিহার চিকচিক করা জল অবাধ্য, বেয়াড়া হয়ে উপচে পরলো গালে। সভ্য স্থির হয়ে তাকিয়ে রইলো সাবিহার পানে। সাবিহার পক্ষ হতে কোনো জবাব আসছে না। একসময় সাবিহা ধীর গতিতে নিজের হাত আলগা করলো সভ্যর শার্ট হতে। দূর আকাশের জ্যোৎস্না শোভা ছড়িয়েছে। তারই রূপা বরণ আলোয় সাবিহার রূপ জ্বলজ্বল করছে। সাবিহা সোজা হয়ে বসে তার অপরূপ, মোহিত করা মুখটা রাখলো নিজের ভাজ করা হাঁটুতে। বাম আর ডান হাত হাঁটুতে আলিঙ্গন করে অদ্ভুত সুন্দর সুরে বলল
— আপনি বাবা হচ্ছেন। আপনার অনাগত সন্তান আমার পেটে।
এতটুকু বিতৃষ্ণা ঝড়ে পরার অবকাশ পায়নি সাবিহার কথায়। সভ্য কেঁপে উঠেছে। স্তব্ধ, শান্ত হয়ে গেছে তার তনু, মন। চোখ পলক ফেলবে না বলে যেন পণ করে নিলো। সাবিহার দৃষ্টির স্থানান্তর হচ্ছে না।
— আবার বলো সাবিহা
বিষ্ময় দমিয়ে প্রায় দুমিনিট পর সভ্য শান্ত কন্ঠে বলল। সাবিহা এবার এবার দৃষ্টি পুরোপুরি সভ্যতে মেলে দিলো। একটু সময় সভ্যকে পরখ করে বলল
— সাম্য বা সন্ধ্যা আসছে।
এবার সাবিহার কথা বেশ নরম। নেই তেজ, নেই কোনো ষৃণা, রাগ। সভ্য শুকনো গলায় একটা ঢোক গিলল। মনে হচ্ছে সে দেহের শক্তি, সাধ্য ক্রমশ হারিয়ে ফেলছে। পাথর হয়ে যাচ্ছে দেহ। বুকের মাঝে শুরু হয়েছে ভাংচুর। কন্ঠ তার রুদ্ধ। শুধুই সে অপলক তাকিয়ে আছে সাবিহার দিকে। সাবিহা মুখ ফিরিয়ে নিলো সভ্য হতে। বলে উঠলো একটু পর
— আমি যেদিন শুনলাম আমি….. আপনার সন্তানের মা হবো তখন আমার প্রচন্ড ঘৃণা হচ্ছিল আপনার উপর। সারারাত কান্নাকাটি করলাম। রাগে দুঃখে ঘরের জিনিসপত্র ছোড়াছুড়ি করলাম। মনে হয়েছিল আপনাকে সামনে পেলে আমি গলা চেপে ধরবো। একা একাই অনেক বকাঝকা করলাম আপনাকে। আমার বাচ্চাকেও। দু’দিন হলো কিছু হলেই একা একা কথা বলি ওদের সাথে। আবার নামও ঠিক করেছি। মেয়ে হলে নাম রাখবো সন্ধ্যা। ছেলে হলে সাম্য।
কথাটা বলে সাবিহা সভ্যর দিকে সিক্ত নয়নে ঠোঁট প্রসারিত করে চাইলো। হুট করে যেন সে এই মুহূর্তে পৃথিবীর বড্ড বেশি শীতল মনের মেয়ে হয়ে গেছে। সভ্যর বিষ্ময় ভুবনের পথ ফুরোয়নি। সে হাঁটছেই বিষ্ময়ের পথ ধরে।
— আমি আপনাকে বলতে চাইনি কিন্তু বলে দিলাম ভুল করে। আমি চেয়েছিলাম আপনি যখন মিডিয়া জগতে খুব উঁচুতে উঠবেন তখন আমি ঠাস করে সেখান থেকে আপনাকে ফেলে দেবো। চোখের পলকে একেবারে নিচে নেমে আসবেন। সরাসরি লাইভে বাচ্চা নিয়ে হাজির হবে বলতাম ” এই যে সুপারস্টার, মডেল তারকা সাজিদ আহমেদ সভ্যর হিডেন অতীত। সে আমায় লুকিয়ে বিয়ে করেছে এবং তার একটা বাচ্চাও আছে।” কিন্তু পরিকল্পনা মোতাবেক এগোতে পারলাম না আমি। এর আগেই আমার দ্বিতীয় সর্বনাশ হয়ে গেলো।
কথাটা বলে সাবিহা সভ্যর দিকে চাইলো। সভ্য অতি উৎসুক হয়ে তাকিয়ে আছে সাবিহার দিকে। আজ সে শুধুই মৌনতার দাশ। সাবিহা বলল
— জানেন, আমার দ্বিতীয় সর্বনাশটা কি? আমি নিভৃতে না চাইতেও আমার মনটায় আপনার বসত বাড়ি তৈরি করে দিয়েছি। আমার মনে হয় আমি ফেঁসে গেছি। রঙ বেরঙের খেলায় আপনি জিতে গেছেন বোধ হয়।
আর একটা কথাও বের হলো না সাবিহার কন্ঠনালি হতে। সভ্য থম মেরে বসে আছে। সাবিহা নত মুখে প্রতিক্ষায় রইলো সভ্যর কোনো একটা কথার। এতোক্ষণে সভ্য সব অভিব্যাক্তি উবে দিয়ে স্থির হয়েছে। আচমকা একসময় সাবিহা অনুভব করলো সভ্য তার পাশ থেকে উঠে দাড়িয়েছে। সাবিহা ঝড়ের বেগে পাশ ফিরে চাইলো। সত্যি তাই! সভ্য উঠে দাড়িয়ে পা বাড়িয়েছে অজানা উদ্দেশ্যে। সাবিহার চোখ থেকে ঝট করে এক ফোঁটা অশ্রু পতিত হলো নিচের দিকে। কেমন এক বিদঘুটে কষ্ট বুকে চেপে সাবিহা হেসে উঠে সভ্যর উদ্দেশ্যে বলল
— নিউটনের তৃতীয় সূত্রর মতোই পরম একটা সত্য হলো পুরুষ মানুষ শুধু চেনে নারীর দেহ। দেহের মাঝে যে একটা মনে সুদ্ধ, পবিত্র ভালোবাসা থাকে তা ওরা মূল্যায়ন করে না।
— তুমি আমায় যে নারীতে মত্ত হতে বলছো সে যে আমায় খুব বেশি আঘাত করেছে। সেই আঘাতের দাগ মুছে ফেলা কি এতো সহজ?
আচমকা সভ্য স্থির দাড়িয়ে পেছন ফিরে বলে উঠলো কথাগুলো। একে অপরের মুখ দর্শন হচ্ছে না। শুধু বুকের উচাটন গুলো জ্যান্ত হয়ে এ মানব থেকে ওমানবের বুকে ছোটাছুটি করছে। সাবিহা পুরো পৃথিবী ঘুরেও যেন খুঁজে পেলো না আর কোনো কথা। তার অপরাধ যে আকাশ ফারি দিয়ে সাত আসমান ছুঁয়েছে তা আজ বেশ উপলব্ধি হচ্ছে।
.
সভ্য ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো। যেন শেষ মুহূর্তে সে ছিল নির্বিকার। সাবিহা একটু সময় বেলকনিতে বসে নিজেও ঘরে ঢুকলো। সন্তর্পণে দরজার আড়ালে দাড়িয়ে একটা উঁকি দিয়ে নিশ্চিত হলো সভ্য আদৌ বাড়ি ছেড়ে গেলো নাকি তাকে ছেড়ে। যখন দেখলো সভ্য ড্রয়িং রুমের সোফেয় গা এলিয়ে বসে আছে বন্ধ চোখে তখন সাবিহা কিঞ্চিৎ স্বস্তি পেলো। তবে মনে প্রশ্ন রয়েই গেলো। সভ্য কি এতোটাই নিষ্ঠুর? তার সন্তান সম্পর্কে তো একটা কথাও বলল না। তবে কি সাবিহার মায়ের কথাই সঠিক? স্বীকৃত দিলো না সভ্য তার সন্তানের? সাবিহা গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো সভ্যর পানে। আবারও একটুকরো আফসোসে আর্তনাদ করে উঠলো মন। কেন সে সভ্যকে ওভাবে অপমান করেছিল? আবার কেনই বা সভ্যকে ভাবনার আঙ্গিনায় ডেকে এনে দেখতো নিঝুম রাতে। হুটহাট টিভিতে বাচ্চাদের কোনো টিভিসি দেখে কি দরকার ছিল ভাবার যে তার সন্তানও একদিন বাবার হাত ধরে হাঁটবে। সাবিহা দূর হতে হাত ছড়িয়ে দিয়ে ডাকবে। গুটিগুটি পায়ে আলতো স্পর্শ মাটিকে করে পিচ্চি কেউ এগিয়ে যাবে মায়ের দিকে।
.
সেদিন রাত পেরিয়ে দিবা উপগমন হতেই সভ্য বাসা ছাড়লো না। যদিওবা তার শুটিং আছে দুপুর বারোটায়। সকাল দশটায় আছে ডান্স ক্লাবে ডান্স অনুশীলন। মধ্য রাতে সাবিহার বমির শব্দ। সে ধীর পায়ে এগিয়ে গিয়েছিল। সাবিহার পাশে শান্ত চোখে তাকিয়ে ছিল। তারপর ঘর অব্দি ধরে নিয়েও এলো বমি করা শেষে। মাথায় দু তিন ফোঁটা তেল দিয়ে নিজের অপটু হাতে মালিশ করে দিলো। সাবিহা মাত্রই নীরবে অনুভব করলো সভ্যর যত্ন। তার খুব জানতে ইচ্ছে হয়েছিল। বলতে মন চেয়েছিল
” বাচ্চার জন্য এমন যত্ন করছেন তাই না? আচ্ছা ও পৃথিবীতে এলেই কি আমাকে ঘৃণায় ছেড়ে চলে যাবেন? আপনাদের বাবা আর সন্তানের মাঝে আমাকে রাখবেন না? আমি কিন্তু মানবো না। বরং আমার বাচ্চা আমি আপনাকে ধরতেই দেবো না। ”
এতোগুলা কথা মনের মাঝে ছোটাছুটি করলেও সাবিহা বলতে পারে নি। কোনো এক বাঁধা বা সভ্যর উত্তর তার জানা সে কারণে। সভ্য শুধু নিরুত্তর চুপিসারে নিজের মতো থাকতো। কোনো কথা বলতো না সে।
রাহেলা ইসলাম বাসায় ফিরলেন দুপুর ধরধর বেলা তখন। সভ্য ড্রয়িং রুমে বসে ক্রিকেট খেলা দেখে। সাবিহা সকালের নাস্তা খেতে ডেকেছিল দুবার। অদূর হতে। নিজের ঘরের দরজার ওপাশ থেকে। সভ্য খায়নি। সে শুধু সাবিহার থেকে নিজের রুমের চাবি নিয়ে পোষাক পাল্টিয়েছে, শাওয়ার নিয়েছে। যখন রাহেলা ইসলাম বাসায় পৌঁছালেন তখন সভ্য প্রস্তুতি নিলো বাসা ছাড়ার। রাহেলা ইসলাম ভেতরে ভেতরে অবাকতা চেপে রেখে সভ্যকে জোর করলেন থাকার জন্য। কিন্তু সভ্য বরাবরের মতোই থাকলো না। সাবিহা দরজার আড়াল হতে দেখছিলো সভ্যকে। একটা সময় সাবিহাকে ঈষৎ অবাক করে দিয়ে সভ্য তার ঘরে যায়। শেষ মুহূর্তে একটা কথা বলে সে
” আমি…. সরি, সাবিহা। এমনটা আমারও ধারণায় ছিল না। আফসোস হচ্ছে। তোমার জন্য আর আমার ভবিষ্যতের জন্য। একটা কালো ছেলের সন্তান তোমার পেটে আর আমার সন্তান একটা অহংকারী নারীর গর্ভে। এখন আমার একটাই রিকোয়েস্ট তোমার কাছে। দয়া করে ওর কোনো ক্ষতি তুমি কোরো না। ”
সভ্যর কন্ঠে ছিল ব্যাকুলতা। সাবিহা হা হয়ে তাকিয়ে ছিল সভ্যর পানে। কথার শুরুতেই ছিল সাবিহাকে কষ্ট দেওয়ার সুর। আর শেষে? বিষমাখা বাঁক পান করিয়ে দিলো সভ্য। কিভাবে বলল, সাবিহা তার সন্তানের ক্ষতি করবে? সাবিহার ইচ্ছে হলো সভ্যকে বলতে
” যে সন্তানের জন্য আমি হার মানতে বাধ্য, যে সন্তানের জন্য আপনার উপর ভালোবাসার জন্ম, যে সন্তানের জন্য আার অহংকার চূর্ণ হয়ে আমি সঠিক পথে হন্টনরত তাকে আমি কোন যুক্তিতে ফেলে দেবো বলুন তো? তাছাড়া আমি মা। মা মানে আমি ওর জন্য মরতেও রাজি।”
#রঙ_বেরঙের_খেলা
#আলিশা
#পর্ব_১৪
সভ্য চলে যাওয়ার সাত দিন হতে চলল। এর মাঝে আর না নিলো সে খোঁজ আর না করলো একটা ফোন। সাবিহার দিন কাটে বিষন্ন হয়ে। বেলকনিতে সভ্য সেদিন রাতে যেখানে বসে ছিল ঠিক সে জায়গায় বসে বসে অনাগত অতিথির সাথে কথা কথা বলে। এর মাঝে অবশ্য ফারজানা বেগম এসেছেন। সভ্য যাওয়ার একদিন পরই। সাবিহা প্রথম প্রথম কিছু অন্তঃকরণ করতে না পারলেও পরে বুঝলো হয়তো এপার ওপারের সবাই জেনে গেছে তার বাচ্চার কথা। সভ্য হয়তো বলেছে। ফারজানা বেগম গত ছয়দিন হলো শশুড় বাড়ি থেকেই কলেজ যাতায়াত করছেন। পরোক্ষ প্রত্যক্ষ সাবিহার খেয়াল রাখছেন। সাবিহার এখন অস্বস্তি হয়। সে শাশুড়ি কে দেখে পালিয়ে বেড়ানোর প্রয়াসে মত্ত প্রতিনিয়ত। লজ্জায় মাথা কাটা যায়। বিয়ের প্রথম রাতের ব্যাবহারের জন্য বুকে অনুশোচনার আগুন জ্বলে। সভ্যর মা সহজ, স্বাভাবিক। তার মুখের কোনো এক অভিব্যাক্তিতে ঈষৎ বিতৃষ্ণা, অভিযোগ, তাচ্ছিল্য ফুটে ওঠে না সাবিহার নামে। আর এটাই হয়েছে সাবিহার কাল। অন্তর জ্বলে পুড়ে খাক করে দেয় বড় মার এমন ব্যাবহার। সাবিহা চায় বড় মা তাকে অপমান করুক, অবজ্ঞা করুক, যত্নের ছিটেফোঁটা তাকে দান না করুক। এর নিমিত্তে সাবিহার পাপ সাবিহার কাছে মহাকাশসম ভারি না হয়ে শুধু হয়তো পৃথিবীর মতো ভারি হতো।
— সাবিহা ঘরে খাবার দিয়ে যাবো?
ভাবনার মাঝে ডাক। সাবিহা দরজার দিকে ফিরে চাইলো। সভ্যর মা দাড়িয়ে আছে। নাকে মুখে চোখের নিচে বিন্দু বিন্দু ঘাম দেখা যায়। হাতে দুইটা চিকন চুড়ি, নাকে নাকফুল। আস্ত এক মমতার সাগর। সাবিহা চোখ ফিরিয়ে নিলো। আজ তো অনেক সুন্দর মনে হচ্ছে সভ্যর মাকে? আগুনে পোড়া চেহারার মাঝেও মুগ্ধতার সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে। সত্যিই সবাই সুন্দর। তাদের সৌন্দর্য দেখার জন্য দুইটা সুন্দর চোখের দরকার হয়। যা সাবিহার এতো দিন ছিল না।
— বড় মা আমি এখন খাবো না। ক্ষুধা নেই।
— এটা কেমন কথা? এই সময় এমন হেয়ালিপনা সাজে না। বেশি বেশি খেতে হবে সাবিহা। শুকিয়ে যাচ্ছো দিনদিন।
— কিছু খেতে না খেতেই বমি আসে।
— সভ্যকে বলবে এসে যেন ডাক্তারের কাছে নিয়ে যায়। ওর এই সময় ঢাকায় এতো কি কাজ বুঝি না আমি। ইদানীং ফোনটাও ধরে না। এতো ব্যাস্ত।
ঈষৎ বিরক্ততে বলে উঠলেন ফারজানা বেগম। সাবিহা নিরুত্তর রইলো। সভ্য সত্যিই ব্যাস্ত। সাবিহা নেট থেকে বার্তা পায় সভ্য ফ্যাশন তাড়কা হিসে বড্ড ব্যাস্ত। বড় বড় কোম্পানি তাকে অফার করছে কখনো টিভিসির জন্য কখনো ফ্যাশন মডেলের জন্য। ইতিমধ্যে সভ্যর ফেসবুক পেইজ খোলা হয়ে গেছে। ফলোয়ার এক মিলিয়ন পারিয়ে দুই ধরধর। থিয়েটারের শুটিং নিয়ে তো আছেই। আবার ইদানীং দেখা যাচ্ছে মিডিয়া জানাচ্ছে সভ্য দুর্দন্ত ক্রিকেট খেলছে। ঢাকা ম্যাট্রো তে একজন কোচও ধরেছে। মিডিয়ায় নাম জশ বেশ থাকায় সে তো এখন হাতের তুড়িতেই প্রায় সব খানে যেতে পারছে। তারউপর ছোট বেলায় বেহুঁশ হয়ে খেলেছে ক্রিকেট। সাবিহার মনে পরে গেলো ছোট বেলার কথা। সভ্য পড়ালেখায় ছিল দুর্দান্ত ফাঁকি বাজ। পাজির পা ঝাড়া ছিল সন্তপর্ণে। বড় বাবা আর বড় মা যখন যার যার কর্মক্ষেত্রে যেতে তখন সভ্য স্কুল পালিয়ে ঝট করে চলে আসতো সাবিহাদের বাসায়। রাহেলা ইসলামের কাছে গিয়ে ঘুরঘুর করতো। তার আঁচলে থাকতো সভ্যর রুমের চাবি। সভ্য অত্যন্ত ভদ্র সেজে আলাভোলা একটা হাসি দিয়ে কখনো নিজের ঘরের চাবি জয় করতো কখনো বা চুপিসারে ছোট মায়ের আঁচলের গিট খুলে চাবি নিয়ে ঝটপট রুম খুলে টর্নেডোর গতিতে ব্যাট বল নিয়ে দৌড়ে চলে যেতো। তার স্কুল মাঠে গিয়ে ক্লাস ফাঁকি দিয়ে অহরহ বার ক্রিকেট খেলার কাহিনি আছে। কত যে বাচ বিচার হলো তাকে নিয়ে। শিক্ষকরা সভ্যর মা বাবার কাছে বিচার দিয়ে দিয়ে হয়রান। সভ্য ধরা খেয়ে কাচুমাচু মুখে বলতো
” সরি, আমি আর ক্লাস ফাঁকি দেবো না। ”
কিন্তু ঘরির কাটা সেকেন্ডের ঘর পেরোতে না পেরোতেই তার সরি পরি হয়ে উড়ে যেতো। ক্লাস ফাইভ থেকে এই জ্বালাতন শুরু হলো। ছয় মাস এভাবে দেখার পর সভ্যর বাবার ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যায়। এগারো বছরের একটা ছেলে এতো বাঁদরামি করলে কেমন লাগে? ক্রিকেটের প্রতি তার নেশা ভয়াবহ হতে ভয়ংকর হতে লাগলো দিনকে দিন। উপায়ান্তর না পেয়ে সভ্যর বাবা বিকেএসপিতে ভর্তির প্রস্তুতি নিতে বলে ছেলেকে। সভ্য মহা আনন্দ আর জেদ নিয়ে ওটুকু বয়সেই শুধু করলো অনুশীলন। তাকে কোচ ঠিক করে দেওয়া হলো। সকলে ভেবেই নিলো ছেলেকে দিয়ে আর লেখাপড়া হবে না। এই ছেলের অজানা ভবিষ্যত ক্রিকেটের দিকে এগোচ্ছে। প্রথম বার সভ্যর চান্স হলো না। পরীক্ষার মাধ্যমে টিকলেও ছোট হওয়ায় তাকে স্পোর্টস সায়েন্টিস্ট রিজেক্ট করে দিলো। সভ্যর কান্না দেখার মানুষের অভাব হলো না। সে কি কান্না! তারপর সকলে বুঝিয়ে সুজিয়ে আবার চেষ্টা করতে বলল। পরেরবার আর কপাল ঘুমোয়নি। জেগে ছিল। অতঃপর দু বছরের প্রচেষ্টায় বাংলাদেশের বিখ্যাত স্পোর্টস স্কুল বিকেএসপিতে সভ্যর জায়গা হলো। সাবজেক্ট নিলো সে ব্যটসম্যানের। তাকে রাখা হলো খালার বাসায়। মহা আনন্দ আর খুশি নিয়ে সে ব্যাট বল আকড়ে ধরে বাঁচার স্বপ্ন বুনলো। দিন গেলো, মাস গেলো, বছর কাটলো। সভ্যর স্বপ্ন আর কর্ম গড়িয়ে গড়িয়ে যেতে লাগলো আন্তর্জাতিক পর্যায়ে। কিন্তু এই কিশোর ছেলের স্বপ্ন থমকে যায় ঠিক সে সময়। যখন সে পনেরো বছরে পা দিয়ে অনূর্ধ্ব ১৫ দলের সদস্য হলো, দুর্দান্ত খেলে অনূর্ধ্ব ১৭ তে জায়গা করে নিলো কিন্তু অনূর্ধ্ব ১৮ খেলার দিন তার বাবা পৃথিবী থেকে চলে গেলো। সভ্য খেলার পোশাক পরে সেদিন তৈরি। বাবার সাথে ফোনে কথাও হলো তার। প্রায় এক ঘন্টা পর যখন খেলার মাঠে নামতে যাবে সে ঠিক তখন এই সংবাদটা তার কানে আসে। আর খেলা হয় না তার। তার আপনজন, অত্যন্ত ভালো বাবা পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছে শোনা মাত্র সভ্য খেলার মাঠে আচমকা ধুপ করে পরে যায়। হয়তো অতো ছোট হৃদপিণ্ড মেনে নিতে পারেনি এতো বড় একটা দুঃসংবাদ। জীবনের গতিপথ, স্বপ্নের মহল সেখানেই ভেঙে গুড়িয়ে যায়। ফিরে আসতে হয় মায়ের কাছে। কোনোভাবে সেখানে দশম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ে পৃথিবী চেনার জন্য পথিক হতে হয়। মা বোঝালো, পড়ালেখা করে সরকারি চাকরি কর। ক্রিকেটার হওয়ার ভাগ্য তোর কপালে নাও থাকতে পারে। অন্ধকারে হাঁটিস না।
.
— আপনি নাকি আজ চলে যাচ্ছেন?
ব্যাস্ত ভঙ্গিতে সভ্য আরশিতে শার্টের কলার ঠিক করছিলো। পাশে দাড়িয়ে মেকআপ ম্যান তার মাথায় স্প্রে করছিলো কিছু একটা। পরিপাটি করে দিচ্ছে। সুষ্মিতারও চুল বেঁধে দিচ্ছিলো একটা মেয়ে। এহেন ব্যাস্ত মুহূর্তে সভ্যকে দুরুদুরু বুকে সুষ্মিতা প্রশ্ন ছুড়ে দিলো। সভ্য সুষ্মিতার পানে তাকিয়ে কৃত্রিম এক চিলতে হাসি হেঁসে বলল
— হুম। দুদিনের শুট একদিনে করার চেষ্টা করলাম। সফল আমি।
— কিন্তু সিম কোম্পানি থেকে মনে হয় ডেকেছিল আপনাকে।
— না করে দিয়েছি।
সুষ্মিতা অবাক হলো। বিষ্ময় নিয়ে হুট করে বলে ফেলল
— সত্যি? কিন্তু ওটা তো বড় রকমের কিছু ছিল।
সভ্যর পরিপাটি হওয়া শেষ। সে হাত ঘড়িটা পড়তে পড়তে শুধু মুচকি হাসলো সুষ্মিতার কথার নিমিত্তে। তার অনেক কাজ। গত দুই রাত হলো ঘুম তাড়িয়ে রিহার্সাল করেছে। যে যে শুট গুলো একক সব করলো। মোটামুটি দু’দিন আর তার না আসলেও চলবে। সন্ধ্যা বা সাম্য আবার রাগ করবে। পৃথিবীতে এসেই বলবে
” বাবাই তুমি ভালো না। মাম্মার মধ্যে যখন থাকতাম তখন তুমি আমার খোঁজ নাও নি। শুধু দুই একটা খবর নিছো দাদির থেকে। এটা বড্ড নিষ্ঠুর কাজ”
ভাবনার মাঝে সভ্য হাসলো। জীবনটাই যাচ্ছে সাবিহার ওপর জেদের তড়ে যুদ্ধ করতে করতে। সুষ্মিতা আড় চোখে তাকিয়ে সভ্যর ঠোঁটের হাসি চোখ দিয়ে দেখে মনে গেঁথে রাখলো। যেন চোখ বন্ধ করলেই ভেসে ওঠে প্রিয়র একফালি চাঁদের মতো এক চিলতে হাসি। দিন যাচ্ছে সভ্য সুন্দর ও সফল হচ্ছে। সুষ্মিতার প্রেম নদী থেকে সমুদ্রে পরিণত হয়ে গেছে। ভালোবাসা হয়ে যাচ্ছে ভয়াবহ পর্যায়ের। এবার প্রকাশ করার সময় এসেছে। আচ্ছা সুষ্মিতাকে কি সভ্য রিজেক্ট করে দেবে? ভাবতেই সুষ্মিতার মন ইতি উতি করে যুক্তি খুঁজে এনে বলে, মোটেই না। বাবা বলে সুষ্মিতার মতো শাহজাদী সকল শাহজাদার স্বপ্নের কুমারী। এমন অসাধারণ, রূপবতী, গুণবতী, বুদ্ধিমতীকে কেউ রিজেক্ট করার কথা কল্পনাই করতে পারে না।
চলবে……
(