#রাজমহল
#লেখিকা-শারমিন আঁচল নিপা
#পর্ব-৯
এসব ভেবে ভেবে সন্ধি আর হাসিবকে নিয়ে ভয়ে ভয়ে বাসার ভেতর ঢুকতেই গা টা শিউরে উঠল। কারণ উঠানে একটা খাটিয়া পড়ে আছে। পাশেই গরম পানি করা হচ্ছে। গোসলের জন্য নির্ধারণ করা জায়গাটা চারপাশে কাপড় দিয়ে ঢেকে দেওয়া হচ্ছে। খাটিয়াটা দেখে ভেতরটা কেঁপে উঠে মনে হলো সায়রা আপুর কিছু হয়নি তো। সায়রা আপু বেঁচে আছে তো। এসব ভেবেই মনটা ব্যাকুল হয়ে যেতে লাগল। কষ্টে বুকটা ফেটে চৌচির হয়ে যাচ্ছিল। অজানা এক আতঙ্কে যেন অন্তরটা বারবার কেঁপে উঠছিল।
অপরদিকে এ মুহুর্তে সন্ধিকে সবাই দেখলে সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকাবে। এত কষ্টের মধ্যেও মনটাকে শান্ত করে সন্ধির দিকে তাকালাম। সন্ধি জীর্ণশীর্ণ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এখনো কেউ সন্ধিকে দেখেনি৷ তবে কেউ একজন যদি সন্ধিকে দেখে তাহলে হাজারটা প্রশ্নের তীর উঠবে সন্ধির উপর৷ তাই সন্ধিকে হালকা গলায় বললাম উড়না দিয়ে পেট টা ভালো করে ঢাকতে তারপর হাসিবকে ঈশারা করলাম সন্ধিকে নিয়ে গেস্ট রুমে বসাতে। হাসিব বেশ কয়েকবার আমাদের বাসায় এসেছে তাই সন্ধিকে সঠিক জায়গায় নিয়ে যেতে তার সমস্যা হবে না। হাসিব সন্ধিকে নিয়ে সামনের দরজা দিয়ে যেতে চাইলে আমি তাকে আটকে দিয়ে বললাম
– সন্ধিকে নিয়ে পেছনের দরজা দিয়ে যাও। সামনের দরজায় অনেকেই আছে। সবাই জটলা পাকিয়ে কিছু একটা দেখছে।জানিনা কী হয়েছে। সবাই কেন এভাবে জটলা পাকিয়ে আছে তাও জানি না।সায়রা আপুর কিছু হলো না তো।
বলতেই আমার চোখ দিয়ে অনর্গল পানি পড়তে লাগল। হাসিব আমাকে কি স্বাত্ত্বণা দিবে সে ভাষা খুঁজে পাচ্ছিল না হয়তো তাই চুপ করে রইল কিছুক্ষণ। তারপর সন্ধিকে ধরে পেছনের দরজার দিকে এগুতে নিলে সন্ধি আমার হাতটা ধরে কান্না করে বলল
– আপুই আমাকে তোর সাথে নিয়ে যা। সায়রা আপুর কিছু হলো কিনা আমি দেখব।
আমি সন্ধির কথা শোনে নিজের ভেঙ্গে যাওয়া মনটাকে গড়ে নিয়ে বললাম
– এখন তুই গেলে হাজারটা সমস্যার সম্মুখীন হতে হবে। তুই বাড়ির পেছনের দরজা দিয়ে গিয়ে হাসিবের সাথে গেস্ট রুমে বস। সায়রা আপুর কিছু হয়নি। শুধু শুধু চিন্তা করিস না। আমি বাকিটা দেখছি।
বলেই হাসিবকে বললাম সন্ধিকে নিয়ে যেতে। হাসিব সন্ধিকে নিয়ে গেল। আর এদিকে আমি বাড়ির সম্মুখ দরজার দিকে এগুতে লাগলাম। গুটিকয়েক মানুষ সেখানে ভীর করে ছিল। যতই এগুচ্ছিলাম ততই মনে প্রশ্ন জাগছে আপু বেঁচে আছে তো। আপুর মুখটা দেখতে পারব তো৷ আমার বুকের স্পন্দন জোরে জোরে প্রতিধ্বনি তুলছিল। পা যেন ভয়ে সামনের দিকে এগুচ্ছিল না। বারবার থেমে পড়ছিলাম। চল্লিশ কদম রাস্তাটা মনে হচ্ছে চল্লিশ কিলোমিটার রাস্তা। এটুকু রাস্তা পার হওয়া যে এত কষ্ট সেটা আজকের আগে জানা ছিল না। নিজেকে শান্ত করে মনে সাহস জুগিয়ে সামনের মানুষগুলো সরিয়ে ভেতরে ঢুকতেই কলিজাটা কেঁপে উঠল, একটা মানুষকে সাদা কাপড় দিয়ে ঢাকা দেখে।
মনের অজান্তে বলে উঠলাম আস্তে করে, আমার সায়রা আপু আমাদের ছেড়ে চলে গেল না তো। এসব ভেবে ভেবে সামনে এগিয়ে কাপড়টা কাঁপা কাঁপা হাতে সরাতে নিলেই একটা কান্নার চিৎকার আমার কানে আসলো। আমি কাঁপড় টা না সরিয়ে কান্নার স্বরটা ভালো করে লক্ষ্য করলাম। খেয়াল করলাম সায়রা আপুর কন্ঠস্বর। আপুর কন্ঠস্বরের উৎসটা খুঁজার চেষ্টা করলাম। বুঝতে পারছিলাম পাশের রুমে আপু কাঁদছে। মনে বেশ প্রশান্তি লাগল যে আপুর কিছু হয়নি। তবুও না দেখা পর্যন্ত ভেতরে শান্তি লাগবে না। দৌঁড় লাগালাম পাশের রুম বরাবর। পাশের রুমে গিয়ে দেখলাম আপু খাটে হেলান দিয়ে কাঁদতেছে জোরে জোরে।
আপুকে দেখে শান্তি পেলেও ভেতরে একটা প্রশ্ন জাগল ঐ লাশটা তাহলে কার? মনের ভেতর যেন প্রশ্নের তুলপাড় শুরু হলো। নিজেকে সামলে নিয়ে আবার গেলাম সেই জায়গায়। গিয়ে সাদা কাফনটা কাঁপা কাঁপা হাতে উঠালাম। উঠিয়ে মুখটা দেখে শরীরটা শিউরে উঠল।এত বিভৎসভাবে কাউকে মারতে পারে জানা ছিল না। মাথার চারপাশ এভ্রোথেভ্রো হয়ে রক্ত জমাট বেঁধে লাল হয়ে আছে। ঘাড়ের কাছে শক্ত শক্ত গোলা হয়ে যেন রক্ত জমাট বেঁধে রয়েছে।সারা শরীরে কাটা ছিড়ার শেষ নেই।এসব দেখে লাশটা বেশিক্ষণ দেখার সাহস হলো না। তবে লাশটা দেখে একেবারের জন্য স্তব্ধ হয়ে বসে রইলাম।লাশটা আর কারও ছিল না আমার বোনের স্বামী অনিক ভাইয়ার ছিল। যে কিনা ব্যবসায়ের কাজে বাইরে ছিল।
সারা শরীরে যেন গায়ের লোম কাঁটা দিয়ে উঠল। রুম থেকে ক্ষণে ক্ষণে আপুর চিৎকারের আওয়াজ শোনা যাচ্ছিল।আপুকে কি বলে স্বাত্ত্বণা দিব সে ভাষা আমার নেই। এক যুগ প্রেমের পর অনেক বাঁধা পেরিয়ে আপুর সাথে অনিক ভাইয়ার বিয়ে হয়েছে। আর সে বিয়ের সংসার তিনমাসের বেশি করতে পারল না। কলিজাটা যেন ভেদ করে কোনো বান বের হয়ে যাচ্ছিল। এতটা কষ্ট হচ্ছিল সেটা বর্ণণা করার ভাষা নেই।
নিজের মধ্যে থাকা সকল শক্তি যেন হারিয়ে ফেলছিলাম। বেশ অস্বস্থি হচ্ছিল। অনিক ভাইয়ার লাশটাও চোখে ভাসছিল। এত বিভৎস ভাবে মৃত্যু কীভাবে হলো জানি না। ঠাঁই চুপ হয়ে বসে রইলাম। আশে পাশের সবার থেকে জানতে পারলাম ভাইয়ার এক্সিডেন্টে মৃত্যু হয়েছে। কথাটা শোনে ভেতরে গভীর একটা প্রশ্নের চড়াও দিল। সন্ধির বাবাও এক্সিডেন্টে মারা যায়,আমার বাবা, মা ও এক্সিডেন্টে মারা যায় আর আজকে অনিক ভাইয়াও মারা গেল। বিষয়টা হয়তো সবার কাছে স্বাভাবিক লাগতে পারে যে এক্সিডেন্ট তো অস্বাভাবিক কিছু না। তবে একই জায়গায় তিনজনের মৃত্যু কি করে সম্ভব। তার উপর সন্ধির মায়ের মৃত্যু এক্সিডেন্টে না হলেও সেই জায়গায় মৃত্যু হয়েছে। সন্ধির মাকে নিয়ে হাসপাতালে যাওয়ার সময় সেই জায়গায় সন্ধির জন্ম হয় আর সন্ধির মায়ের মৃত্যু হয়। এটার সাথে অবশ্যই কোনো যোগসূত্র আছে বলে আমার মনে হয়।
নিজের ভেতরটা এসব ভেবে ভেঙ্গে যেতে লাগল। এমন সময় আপু পাশের রুম থকে চিল্লায়ে এসে ভইয়ার লশটাকে জড়িয়ে ধরে বিলাপ করে কাঁদতে লাগল। প্রতিবেশীরা আপুকে ভাইয়ার কাছ থেকে ছাড়িয়ে পাশের রুমে নিয়ে গেল। ভইয়ার বাড়ির সবাই এসেছে। সবাই চাচ্ছে লাশটা কাফন পড়িয়ে তাদের বাড়ি নিয়ে কবর দিতে। তবে আপু বিলাপ করে বলছে আমার অনিককে আমার কাছ থেকে নিয়ে যেও না।
এদিকে ভাইয়ার লাশ ধরাধরি করে গোসল করাতে নিয়ে গেল। গোসল শেষে সাদা কাফনে মুড়িয়ে ভইয়াকে নিয়ে যাচ্ছে তাদের বাড়ি। আর আপুকে বাসায় রেখে যাচ্ছে। আমি শুধু অপলক দৃষ্টিতে সবটা তাকিয়ে দেখছি। মনের অজান্তে শুধু ভাবতে লাগলাম। কী হচ্ছে এসব। কেনই বা এমন হচ্ছে। আস্তে আস্তে মানুষ কমতে কমতে বাড়িটা শূন্য হয়ে গেল।আপু পাশের রুমে বসে কাঁদছে। আমি আপুর রুমে না গিয়ে সন্ধি আর হাসিবের কাছে গেলাম।লক্ষ্য করলাম তার স্বাভাবিক আছে।
তাদের নিয়ে আপুর রুমের দিকে এগুলাম।যতই এগুচ্ছিলাম ততই মনে হচ্ছিল আপুকে কি এ সময় নতুন করে কষ্ট দেওয়া ঠিক হচ্ছে। তবে এত ভেবেও তার কোনো উত্তর পাচ্ছিলাম না।নিজেকে খুব অপারগ মনে হচ্ছে। আপুর রুমের দিকে যতই এগুচ্ছিলাম ততই অজানা আতঙ্ক মনে বিরাজ করছিল। অসহায়ের মতো হাসিব আর সন্ধিকে নিয়ে আপুর সামনে গেলাম। আপু তখন ফ্লোরে বসে খাটে মাথা গুজে কাঁদছিল। আমি আস্তে করে আপুর পাশে বসে আপুকে স্পর্শ করতেই আপু আমাকে ধরে জড়িয়ে কাঁদতে লাগল। আপু যখন আমাকে জড়িয়ে কাঁদছিল তখন আপুর চোখ গেল সন্ধির দিকে। আপু সন্ধিকে দেখে হুট করে কান্না থামিয়ে নিস্তব হয়ে গেল। অবাক দৃষ্টিতে একবার আমার দিকে আরেকবার সন্ধি আর হাসিবের দিকে তাকাচ্ছিল। কিছুক্ষণ নীরব থেকে আকস্মিকভাবে বলে উঠল
– সন্ধির কী হয়েছে এরকম পেট ফুলা কেন?
আমরা আপুর প্রশ্নের জবাবে সবাই চুপ ছিলাম। কোনো উত্তর যেন মুখ দিয়ে বের হচ্ছিল না। আপু পুনরায় আমাদের বলল
– কী হলো? সন্ধির কী হয়েছে বলছিস না কেন?
আপুর কথা শোনে সন্ধি জোরে কান্না করে বসলো। সন্ধির কান্না দেখে আপু অবাক হয়ে সন্ধিকে দেখতে লাগল। কিছুটা বিস্মিত হয়ে বিস্ময়ের সুরে বলল
– কী হয়েছে বলবি তো।
আমি আপুর কথা শোনে নিজেকে সামলে নিয়ে সন্ধিকে কান্না থামাতে বলে আপুকে সব কাহিনি খুলে বললাম। আপুও নির্বাক চোখে সব তাকিয়ে শোনল। তারপর সজোরে চিৎকার দিয়ে আমাকে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলল
– এ কোন কালো ছায়ার কবলে পড়লাম। একটু ও কি আশার আলো দেখব না।
আমি আপুকে ধরে জোরে কান্না করে দিলাম।আপুও কাঁদছে,সন্ধিও কাঁদছে। ঘরটায় যেন আমাদের কান্নার হাহাকার বইতে লাগল। আমাদের কান্নার মাঝে বাঁধা দিল আপুর মোবাইলের রিংটন। কোনো এক অচেনা নম্বর থেকে আপুকে কেউ কল দিয়েছে। স্বামীর শোকে কাতর আপু তবুও কাঁপা হাতে কলটা ধরে হ্যালো বলতেই অজ্ঞান হয়ে গেল।
আপুর আকস্মিক অজ্ঞান হওয়াতে আমরা ভয় পেয়ে গেলাম। সবাই মিলে আপুকে পানির ঝাঁপটা দিতে লাগলাম। পানির ঝাঁপটায় আপুর চোখ মুখ ঠোঁট কাঁপতে কাঁপতে জ্ঞান ফিরল। আপুর জ্ঞান ফেরার পর আপুকে হালকা গলায় জিজ্ঞেস করলাম
– কে কল দিয়েছিল?
তারপর আপু যা বলল তা শোনে আমাদের চোখ কপালে উঠে গেল।
(কপি করা নিষেধ চাইলে শেয়ার করতে পারেন।)