রৌদ্র কুয়াশা পর্ব ৩৬

#রৌদ্র_কুয়াশা
Suvhan Årag(ছদ্মনাম)
পর্ব ৩৬

প্রকৃতির প্রতিশোধ বলে একটা কথা আছে।কথার কথা চেয়ে বেশি অনেক ক্ষেত্রে প্রকৃতি নিজেই যেন তার প্রমাণ দিয়েছে।আজ মাইশা র ও মনে হচ্ছে প্রকৃতি তাকে এমনি এমনি ছাড়েনি।মাহিরের সাথে সে বেশিই অন্যায় করেছিল।আজ প্রকৃতির পাল্টা ধাক্কায় সে নিজেই ক্ষত বিক্ষত।

-আই এম রিয়েলি সরি মাহির।আমি জানি আমার ভুলের ক্ষমা নেই।কিন্তু আমার বিশ্বাস তুমি আমাকে ফেরাবে না।আমি তো জানি তুমি আমাকেও কতোটা ভালো বাসো।তুমি আজো নিশ্চয়ই আমার অপেক্ষা তেই আছো।আমি আজ তোমার কাছে যাব মাহির।

৯৯

-নিবিড়,তুমি ওষুধ খেয়েছো?

ঘরে ঢুকতে ঢুকতে নিবিড়কে প্রশ্ন করলেন ইসমাত বেগম।নিবিড় দ্রুত অনুর ছবিটা আড়াল করে নিল।চোখের কোনটা মুছে নিল।

-জি আম্মাজান।
-তুমি অফিসে যাবে না?
-আম্মাজান আমার জয়েন পরশু থেকে।
-ওহ হো।
-আম্মাজান।
-বলো।
-একটু আমার পাশে এসে বসবেন?

নিবিড় এর নিরীহ চাহনি আবদার শুনে ইসমাত বেগম মুচকি হাসলেন।এগিয়ে গিয়ে খাটের ওপর নিবিড়ের পাশে বসলেন।

-এদিকে এসো।আমার কোলে শুয়ে পড়ো তো।কতদিন তুমি আমার কোলে মাথা রাখো না নিবিড়।

নিবিড় এক ছুটে এসে ইসমাত বেগমের কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়লো।ইসমাত বেগম আলতো করে নিবিড়ের মাথার চুলের ভেতর আঙুল ঢুকিয়ে ধীরে ধীরে মালিশ করে দিচ্ছেন।

-আম্মাজান।
-বলো।
-আমি খুব খারাপ তাই না?

নিবিড়ের কথা শুনে চুপ করে গেলেন ইসমাত বেগম।কি বলবেন তিনি?নিবিড় যে তার সন্তান থেকে কম তার ওয়াদা বেশি।তাকে কোনো ভাবেই ফেলতে পারবেন না তিনি।

-আম্মাজান কিছু বললেন না যে?
-কিছু উওর নিরাবতাতেই উওম বাবা।

নিবিড়ের মুখে খুশির ঝলকানি।সে জানে নীরবতা সম্মতির লক্ষণ।আর তার অর্থ এটাই নিবিড় ইসমাত বেগমের কাছে কোনো খারাপ মানুষ না।ইসমাত বেগমের মুখে এক রহস্যময় হাসি।কিছু সময় নীরবতা অপর পক্ষকে প্রতিহত করেই ছাড়ে।তার কাছে যেটা সম্মতি অন্য পক্ষের সেটা অসম্মতি হলেও মনঃতুষ্ট ই যেন বড় হয়ে যায়।

-আম্মাজান।
-বলো।
-ঢাকায় এসে আপনার খুব কষ্ট হচ্ছে তাই না?নতুন জায়গা।
-না বাবা।তুমি আছো না?তোমার জন্য এটুকু করতেই পারি আমি।
-জানি তো।
-শোনো।কাল তুমি বাজার করে রাখবে এই সপ্তাহের।নাহলে অফিস শুরু হলে এর মধ্যে তোমাকে কষ্ট করতে হবে।
-আচ্ছা।আম্মাজান আমি বিকেল বেলা একটু বের হব।
-কেন?
-এমনি।বদ্ধ শহরে ঘরে থাকতে আরো বদ্ধ লাগে যে।
-আচ্ছা ঠিকাছে।তুমি বিকেল বেলা কি নাস্তা খাবে বলে দিও।করে রাখব।
-আলুর চপ,পেয়াজু খেতে মন চাইছে।
-ঠিকাছে বানিয়ে রাখব।
-অনু এগুলো খুব পছন্দ করতো তাই না আম্মাজান।
-হুম।

ইসমাত বেগমের ভেতর থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো।

-নিবিড় তুমি থাকো।আমি ভাত বসাতে ভুলে গেছি।
-আচ্ছা।

নিবিড় উঠে বসতেই ইসমাত বেগম চলে গেলেন।অনুর ছবিটা বালিশের নিচ থেকে বের করে হাতে নিল নিবিড়।দু ফোটা পানি ছবির ওপর পড়লো।

-অনু।তুই আমাকে এতো কষ্ট দিলি কেন?তোকে না আমি খুব ভালোবাসি।তুই দেখিস এই অজানা বদ্ধ শহরের অলিগলি থেকে ঠিক খুঁজে নিয়ে আসব তোকে।আমার খাঁচায় বন্দী করব।তোর ডানা ছেঁটে রেখে দেব।আর যেন কখনো আমার থেকে চলে যেতে না পারিস।

দরজার ছিটকিনি লাগিয়ে চোখের চশমা টা খুলে বিছানায় বসলেন ইসমাত বেগম।

-তুমি এখানে আমাকে না আনলেও পারতে নিবিড়।আমার মাহির কোথায় আছে কে জানে?এতো গুলো বছর কষ্ট পেয়েছি।এবার আমি আর সহ্য করতে পারছিনা নিবিড়।আমার যে মাহিরকে দেখতে মন চাইছে।আমার ছোট্ট সোনা ও নিশ্চয়ই অনেক বড় হয়ে গেছে।অনেক।

১০০

বিকেল হয়েছে।অনু কলেজ থেকে ফিরেই দোকানে বসেছে।এটা ওটা দেখছে।সারাদিন কি কেনা বেচা হয়েছে সব দেখছে সে।

-ম্যাডাম।

বিথীর কথায় পিছু ঘুরলো অনু।বিথী দোকানের ই একজন কর্মচারী।

-আরে বিথী আপু বলো।
-ম্যাডাম একটা কথা বলবেন?
-কি?
-ম্যাডাম কিছু মনে করবেন না।
-কি হয়েছে?
-আরিয়ান স্যারের সাথে আপনার কিসের সম্পর্ক?

বিথীর কথা শুনে অনুর চোখ বড় বড় হয়ে গেল।

-মানে?কিসের সম্পর্ক এর কথা বলছো তুমি?
-দেখুন ম্যাডাম আপনি তো ছোটো বাচ্চা নন যে কিছু বুঝবেন না।আপনি একটা মেয়ে।স্যারের বাড়িতে থাকেন।এই দোকানের মালিক ও ধরতে গেলে আপনি।স্যারের সাথে নিশ্চয়ই কোনো সম্পর্ক না থাকলে আপনি বাইরের লোক হয়ে এতো কিছু পাবেন না?তাই বলছিলাম আর কি।আরিয়ান স্যার তো নিশ্চয়ই দেনা পাওনা ছাড়া কিছু করবেন না।তাই কৌতুহল হলো।আপনাকে এতো কিছু দেওয়ার বদলে আরিয়ান স্যার আপনার থেকে কি নিচ্ছেন,,,,মানে বেড,,,,,।

বিথী কথা শেষ করতে পারলো না।তার আগেই কেউ থাপ্পড় বসিয়ে দিল বিথীর গালে।অনু তো কেঁদেই দিয়েছে এসব শুনে।সে কখনো ভাবেনি কেউ এভাবে তাকে কথা শোনাবে।অনু পাশ ফিরে দেখে তুলি দাড়িয়ে।তুলি ই থাপ্পড় মেরেছে বিথীকে।পাশে আরিয়ান কোলে তুলির বাচ্চাকে নিয়ে দাড়িয়ে আছে।

-অসভ্য মেয়ে।তুমি নিজে খারাপ জায়গার মেয়ে বলে সবাইকে কি সেটা মনে করো?ভাইয়া দেখ।কথায় আছে না কয়লা ধুলে ময়লা যায় না।দেখ এদের স্বভাব।ভাষা দেখেছিস।

তুলি আর আরিয়ানকে থেকে বিথী তো ভয়ে শেষ।আরিয়ানের চোখ দিয়ে যেন আগুন বের হচ্ছে।

-বিথী।আর এক মুহূর্ত তুমি এ দোকানে থাকবে না।বেরিয়ে যাও এখান থেকে।
-স্যার আমার ভুল হয়ে গেছে।স্যার মাফ করে দিন।আমি কোথায় যাব?আপনি তো জানেন এই ছাড়া আমার কাজের কোনো উপায় নেই।

বিথী আরিয়ানের পা ধরে বসেই পড়লো।

-ছাড়ুন বলছি।আপনার মতো মেয়েকে কাজ দেওয়াই ভুল হয়েছিল আমার।আসলে কি বলুন তো ঘি সবার পেটে সহ্য হয়না।
-স্যার মাফ করে দিন।আর কোন দিন এমন বলবো না।
-আপনি,,,,,।
-ওকে মাফ করে দিন আরিয়ান সাহেব।

অনুর কথায় চমকে গেল আরিয়ান আর তুলি।

-অনু তোমার মাথা ঠিকাছে?
-তুলি আপু।কেউ কিছু বললেই তো সেটা সত্যি হবে না।আমি জানি আরিয়ান সাহেব আমাকে কতোটা সম্মান দেন।তাই কেউ কিছু বললেই আমি খারাপ হয়ে যাবো না।আপু লোকে তো অনেক কথাই বলে কিন্ত সব সময় কি লোকের কথা শুনলে হয়?আমিও তো লোকের কথার ভয়ে সংসার করেছিলাম মুখ বুজে।কই কেউ তো কখনো আসেনি আমার চোখের পানির দাম দিতে।আজ যখন লোকের কথা গায়ে না লাগিয়ে আমি চলছি আমি ভালো আছি।আর আরিয়ান সাহেব ই তো আমাকে এতো কিছু বুঝিয়ে ছেন।

অনুর কথা শুনে আরিয়ানের মুখে হাসি ফুটে উঠলো।বরাবরের মতো আজ ও অনুর কথার মধ্যে এলকোহলের ঝাঝ পাচ্ছে সে।বরাবরের মতোই নেশা ধরার।

-এক্সকিউজ মি।আচ্ছা এখানে বয়স্ক মহিলাদের জন্য কোনো বোরখার কালেকশন আছে?

সবার কথার মধ্যে ই হুট করে পেছন থেকে একটা আওয়াজ ভেসে আসলো।আওয়াজ শুনে অনু চমকে গেল।এই আওয়াজ তার যে ভোলার নয়।অনু রীতিমতোসাড়া কাঁপতে শুরু করলো।

১০১

এই নিয়ে চারবার কলিংবেলের আওয়াজ।ঘড়ির দিকে তাকালো ইলা।সন্ধ্যা হওয়ার ও অনেক দেরী আছে।

-এতো তাড়াতাড়ি তো মাহির আসেনা। আর দরজা তো লক করা।আমাকে না পেলে নিজেই তো ডুপ্লিকেট চাবি নিয়ে দরজা খোলে।কে এলো তাহলে?

এর মধ্যে আরো একবার কলিংবেলের আওয়াজ।ইলা বই খাতা রেখে উঠে দাড়ালো
নিচে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালো।

দরজা খুলেই ইলার চোখ বড় বড় হয়ে গেল।

-আপনি?
-কি রে শালিকা আমাকে ভুলে গেছো দেখছি?

কামরুল মুখে একটা বিশ্রী হাসির রেখা টানলো।কাচা হলুদ রঙের শাড়ি পড়েছে ইলা।কামরুল ইলার মাথা থেকে পা অবধি খুটিয়ে খুটিয়ে দেখে ইলাকে সরিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়লো।

-আরে আরে।আপনি ভেতরে ঢুকলেন কেন?বের হন বলছি।

কামরুল পুরো বাড়ি মাথা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখছে।একটু দেখে সোফায় গিয়ে বসলো কামরুল।

-বাহ!তুই তো দেখছি বড় সড় ঘর হাতিয়েছিস ইলা।তা রাত প্রতি কত দেয় তোকে?যে এতো রাজার হালে আছিস?

কামরুলের কথা শুনে ইলার মাথায় রক্ত উঠে গেল।

-একদম বাজে কথা বলবেন না।নোংরা লোক একটা।মাহির আমার স্বামী হয়।এটা আমার স্বামী র বাড়ি বুঝেছেন?
-রাত কাটালে তো সবাই স্বামী হয়।এই ধর এখন যদি আমি তোর সাথে কাটাই আমিও তোর স্বামী হব।সেই তো একি হলো।
-দুলাভাই।লজ্জা শরম নেই আপনার।বের হন এখান থেকে।কে আপনাকে এখানে আসতে বলেছে?
-কে আসতে বলবে।নিজেই এসেছি।আগের দিন দেখেছিলাম তো তোর ঐ নাগরের সাথে বড় মলে কেনাকাটা করছিস।ঐ দিন ই ফলো করেছি।আর আজ চলে এসেছি।চল তোর বর তো মনে হয় বাড়ি নেই।চল আমরা মজা করব।আর এই তোর ঐ বোন কোথায় রে?মরেছে নাকি?মরলো একটু খবর তো দিতি?অন্তত কেদে কেটে নাটক করতাম।
-অসভ্য শয়তানের বাচ্চা বের হ বলছি।তোর খবর আছে বলে দিলাম।ইশতিয়াক ইশতিয়াক,,,,।

ইলা চেঁচাতে লাগলো।দরজার দিকে যেতেই তার আগে কামরুল এসে ইলার মুখ চেপে ধরলো।

-শালি অনেক জ্বালিয়েছিস তুই।তোকে ভালো কথা বলেছিলাম আমার বউ হয়ে যা তোর বোন বোনঝি সব দেখব।শুনলি না।আজ তো তোকে শেষ করেই ছাড়ব।কারোর সামনে মুখ দেখাতে পারবি না তুই।

১০২

মাহির ল্যাপটপ অন করে আবার অফ করে দিল।মাথায় হাত রেখে বসে আছে।

-স্যার কি হয়েছে?আপনার কি শরীর খারাপ?
-নীল মনটা ভালো লাগছে না।
-কেন স্যার?
-ইলা বাড়িতে কি করছে কে জানে?
-ম্যাম কে ফোন দেননি?
-সকালে কথা হয়েছে।দুপুরের পর এতো বার ফোন করছি ও ফোন তুলছে না।বাড়ির ল্যান্ডলাইন নাম্বার এ ও কল করলাম।সেটাও ধরলো না।
-স্যার ইশতিয়াক কে ফোন করে দেখুন।
-ইশতিয়াক এর আজ পরীক্ষা আছে।বাড়িতে গেটে দারোয়ান ছাড়া কেউ নেই।দারোয়ান তো আর বাড়ির ভিতরে যায় না।
-আসলেই চিন্তার বিষয়।ম্যাম আবার ঘুমাতে ও পারেন।
-তাও হতে পারে।ও যা ঘুম কাতরে।
-স্যার এতো চিন্তা করবেন না।আল্লাহ ভরসা।
-ফি আমানিল্লাহ।নীল চলো তো একটু কফি খেয়ে আসি বাইরে থেকে।ভালো লাগছে না।
-চলুন স্যার।

মাহির ব্লেজার টা গায়ে পড়ে নিয়ে উঠে দাড়ালো।বেরোনোর আগেই কেউ দরজা খুলে মাহিরকে এসে জাপটে ধরলো।এতোটাই জোরে মাহির টাল সামলাতে না পেরে একটু পিছিয়ে গেল।

-আমাকে এতোটা ভালোবাসো তুমি।আজ ও আমার পছন্দের চকলেট ফ্রেভারের পারফিউম ই ব্যবহার করো।গন্ধ টা তো আজ ও আমাকেপরিচিতি পাগল করছে মাহির।

মাহির অবাকের চরম সীমায়।মাহিরের ভেতরটা তোলপাড় হয়ে যাচ্ছে।সেই পুরানো অনুভূতি আবার!

চলবে————
বাকীপর্বগুলো পরে দেব লেখা হলে

6 COMMENTS

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here