রৌদ্র কুয়াশা পর্ব ৩৪+৩৫

#রৌদ্র_কুয়াশা
Suvhan Årag(ছদ্মনাম)
পর্ব ৩৪

অনু আবার বলে উঠলো,

-আরিয়ান সাহেব,আমাকে ক্ষমা করে দেবেন।আপনি আমার জন্য অনেক কিছুই করেছেন।বলতে গেলে আমার পরিবার ও আমার জন্য করেনি।আপনি যা বলছেন অবশ্যই সব ভেবেই বলছেন।আমি গতকাল হুট করে বুঝতে পারিনি।আপনাকে ওভাবে অসম্মান করতে চাইনি।

অনুর কথাতে আরিয়ান সোজা হয়ে দাড়ালো।দু হাত প্যান্টের দু পকেটে রাখলো।

-অনু আপনি এতো বেশি কেন ভাবেন বলুন তো?সেই এক কথা ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে।

আরিয়ানের কথায় অনু কোনো উওর দিল না।চুপ করে দাড়িয়ে রইলো।

-কি হলো?
-মাফ করবেন।আপনাকে অযথা বিরক্ত করলাম।
-আবার সেই!আচ্ছা আসি।আল্লাহ্ হাফেজ।
-আল্লাহ্ হাফেজ।
-ও শুনুন।
-জি।
-আমি রিক্সা ঠিক করে রেখেছি।আপনাকে দিয়ে আসবে।আর আশার সময় আমি নিয়ে আসব।
-আপনি?
-হ্যাঁ আমি।আপনার আসতে আসতে অনেক বেলা হবে।রাস্তাঘাটে তখন লোকজন ও কম থাকে।আপনি কিছুই চেনেন না।তাই আমি নিয়ে আসব।অসুবিধা আছে?

আরিয়ানের প্রশ্ন শুনে অনু দুপাশে মাথা নাড়লো।আরিয়ান মুখে মুচকি হাসি ফুটে উঠলো।

-আল্লাহ্ হাফেজ।সাবধানে যাবেন।তুলির কাছে আপনার জন্য একটা ফোন রেখেছি।ওটা নিয়ে যাবেন।কোনো প্রয়োজন হলে কল করবেন।তুলি আপনাকে শিখিয়ে দেবে।
-আচ্ছা।

আরিয়ান পেছনে ঘুরে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালো।অনু ও দরজা দেওয়ার জন্য দু কদম এগিয়ে গেল।আরিয়ান কি ভাবে দাড়িয়ে গেল।আবার পেছনে ঘুরলো।

-অনু।
-কিছু বলবেন আরিয়ান সাহেব?
-হুম।কিছু বলার ছিল।
-বলুন।
-সব সময় সব কিছু বিরক্তির হয়না।কিছু কিছু বিরক্তির কারণ গুলো ভালো লাগে।বড্ড বেশি ভালো লাগে।এ ধরনের কারণ হলে তো আমি বার বার বিরক্ত হতে রাজি।

আরিয়ানের কথা শুনে অনু শুধু হা করে তাকিয়ে আছে।

-কিছু বোঝেন নি?
-না আরিয়ান সাহেব।এতো কঠিন কথা বুঝতে পারিনি।
-থাক বুঝতে হবে না।সব সময় বোঝার দরকার নেই।কিছু কিছু সময় না বোঝাটাই উওম।যেদিন সময় হবে সুযোগ আসবে সব বুঝিয়ে বলব।বোঝার মতো করে বলব।কিন্ত চিন্তা একটাই ধকল টা আপনি সামলাতে পারবেন কি না?
-কি এমন বলবেন?কিছুই বুঝলাম না।
-আসি।

আরিয়ান চলে গেল।অনু কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে দরজা লাগিয়ে দিল।কি বোঝাতে চাইলো আরিয়ান?অনুর মাথায় একদম ঢোকেনি।

৯৪

টেবিলের ওপরে থাকা পেপার ওয়েট নিয়ে বার বার খেলছে নিবিড়।সামনে মানসিক বিশেষজ্ঞ ডা:তন্ময় লাহা বসে আছেন।তিনি আজ না বরং ছোট থেকেই নিবিড়কে দেখে আসছেন।

-নিবিড়।কেমন আছো?

ডাক্তারের কথা শুনে নিবিড়ের মাথায় যেন রক্ত উঠে গেল।পেপার ওয়েট টা জোরে টেবিলে ছুড়ে মারলো সে।এতোটাই জোরে শব্দ হলো যে ডা:তন্ময় লাহা নিজেই কেঁপে উঠলেন।

-দেখতে পারছেন না আপনার সামনে খাম্বার মতো বসে আছি।আবার জিজ্ঞাসা করছেন কেমন আছো?এই ব্যাটা ভালো না থাকলে কি আপনার সামনে বসে থাকতাম!

ডাক্তার একদমই বিরক্ত হলেন না নিবিড়ের আচরণে।নিবিড় এর এসব আচরণ সম্পর্কে তিনি আগে থেকেই অবজ্ঞত।

-সরি নিবিড়।
-হুম।
-আচ্ছা নিবিড় তুমি এই পৃথিবীতে কাকে সব থেকে বেশি ভালোবাসো ?
-কাকে মানে!এটাও আপনাকে বলে দিতে হবে!আম্মাজান কে।আমার আম্মাজান কে।
-হুম।তারপর কাকে?
-আমাকে!আই লাভ মাইসেলফ।আমি জানি আমি খুবই বিশেষ একজন ব্যক্তি।আমাকে যে কেউ ভালোবাসতে বাধ্য।তাই আমিও বাধ্য হয়েছি।
-হুম জানি।পাগলেই তো বলে পৃথিবীর সবাই পাগল।

ডাক্তার তন্ময় কথাটা আস্তেই বললেন।নিবিড় অবধি পৌছালো না।গলা ঝেড়ে ডাক্তার তন্ময় আবার বলতে শুরু করলেন,

-আচ্ছা নিবিড় তোমার পর তুমি কাকে ভালোবাসো?
-কে আবার।অনুকে।আমার বউকে।তিন লাখ টাকা একশত পচাত্তর পয়সা দেনমোহর দিয়ে বিয়ে করেছি।ওকে।
-তোমার বউ কোথায়?
-শয়তানের বাচ্চাটা কোনো নাগরের সাথে পালিয়েছে।বেশ্যা মা*** একটা।
-আচ্ছা নিবিড় তোমার সবচেয়ে পছন্দ এর কাজ কি?
-অনুকে পেটানো।ইচ্ছে মতোপেটানো।জানেন আমার না খুব ভালো লাগে অনু যখন কাদে।আমি চাই ও সারাদিন কাদবে।কিন্তু না ও সারাদিন চুপচাপ থাকে।কেন থাকবে?ওকে সারাদিন কাঁদতে হবে।আর আমি ওকে দেখব।

নিবিড়ের কথা শুনে ঘেমে যাচ্ছেন ডাক্তার লাহা।রক্ত গরম হয়ে যাচ্ছে তার।

-আচ্ছা নিবিড় তোমার কাছে বউ এর কাজ কি?
-খুবই সহজ।বউ এর উচিত সারাদিন স্বামী সেবা করা, স্বামীর কথাতে উঠবস করা, তার চাহিদা মেটানো তার হাতে মার খাওয়া।
-আচ্ছা তুমি কি অনুকে ফিরে পেতে চাও?
-হুম চাই।খুব চাই।
-অনু ফিরে আসলে তুমি কি করবে?
-আগে ওকে ধরে রান্নাঘরে পাঠাব।জানেন ও কতো ভালো রান্না করে।আমি কতোদিন হলো পেট পুরে খাইনা।ওকে দিয়ে বিরিয়ানি,রুটি,হালুয়া ,সুজি,সেমাই, লটপটি সব রান্না করাবো।
-তার পর?
-তার পর সব খাব সব।তার পর আমি কোল্ড ড্রিঙ্কস খাব।
-তার পর?
-তারপর আয়েশ করে বসবো।তারপর একটা মোটা লাঠি দিয়ে ওকে পেটাবো।আচ্ছা করে পেটাবো।এতোই পেটাবো ওর চামড়া ফেটে রক্ত বের হবে।ও চিৎকার করবে।আর আমি আনন্দ করব।

কথা বলার মাঝেই নিবিড় এর মুখে পৈশাচিক হাসি।নিবিড়ের চাহনি দেখেই ডাক্তার লাহা বুঝে যাচ্ছেন বলার সাথে সাথে নিবিড় যেন সামনে একবার দৃশ্যটা কল্পনা ও করে নিলো।

-নিবিড়।তুমি বরং বাইরে যাও।তোমার মাকে এখানে পাঠাও?
-কে মা?আমার কোনো মা নেই।আম্মাজান আমার।
-আম্মাজান কেই পাঠাও।
-আচ্ছা।

নিবিড় উঠে চলে।একটু পর ইসমাত বেগম ভেতর আসলেন।ডাক্তার লাহা ইশারায় ওনাকে বসতে বললেন।

-বলুন ডাক্তার।কি দেখলেন ওকে?
-ভাবি,আপনি হয়তো মা।একটা সত্যি কথা বলি।আজ যদি নিবিড় আমার নিজের ছেলে হতো তো বলে রাখছি আমার বাড়িতে যতো জুতো আছে না একটার ও তলা থাকতো না।ওকে উঠতে বসতে শুধু জুতো দিয়ে পেটাতাম।এতোটা পৈশাচিক চিন্তা কিভাবে আনতে পারে ও?ও পাগল হয়ে গেছে।সাইকো পুরো সাইকো।অনুকে পেলে তো মেরেই ফেলবে ও।
-আপনি তো জানেন সব।কি করব?ওকে যে ফেলতে পারিনা।আমি নিজেও চাই না অনু ফিরে আসুক।আর আসলেও আমি ওকে দূরে কোথাও পাঠিয়ে দেব।নিবিড় মানুষ না আমিও জানি।কি করব বলুন?ও যে অসুস্থ হচ্ছে বার বার।
-আমি ওষুধ লিখে দিচ্ছি।নিবিড়ের কন্ডিশন ভালো না।ও কখন কি করবে নিজেও জানে না।আপনি সাবধানে থাকবেন।
-হুম।

ইসমাত বেগম উঠে চলে গেলেন।বাইরে বের হতেই নিবিড় এসে জড়িয়ে ধরলো ইসমাত বেগমকে।

-আম্মাজান শিগগিরই চলুন।আজ অনুকে বলেছি চিতই পিঠা আর গরুর মাংস ভুনা করতে।তাড়াতাড়ি চলুন নাহলে ঐ শয়তান টা সব খেয়ে ফেলবে।

নিবিড় এর কথা শুনে ইসমাত বেগমের ভেতর থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো।

৯৫

আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে রেডি হচ্ছে মাহির।অফিসের জন্য বের হবে সে।বিছানার দিকে তাকিয়ে দেখে ইলা এখনো ঘুমিয়ে।কাথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে সে।

গতকাল রাতে অনেক কিছু ঘটতে গিয়ে ও ঘটেনি।মাহির আর ইলার মাঝের দেওয়াল টা মাহির ও ভাঙেনি।কিন্তু ইলা হয়তো বেশিই মত্ত ছিল কাল।মাহির নিজেই হিমশিম খেয়েছে ইলাকে সামলাতে।কাল রাত থেকেই ইলা বেশ রেগে আছে মাহিরের প্রতি।একে তো বই খাতা।তারপর মাহির ইলাকে বলেছে সে ভালো ফলাফল না করলে তাকে মাহির ভালোবাসবে না।মাহিরের কাছে যেতে হলে তাকে পড়াশোনা করতে হবে।

মাহির বিছানার কাছে গিয়ে একটানে ইলার গা থেকে কাথা টা সরিয়ে নিল।ইলা এক লাফে উঠে বসলো।রাগি দৃষ্টিতে মাহিরের দিকে তাকালো।

-এই সমস্যা কি আপনার হ্যাঁ?ঘুমিয়ে ছিলাম সেটাও সহ্য হচ্ছে না।
-যাও হাত মুখ ধুয়ে পড়তে বসো।
-আল্লাহ !তুমি এভাবে আমার সুখের দিন গুলো শেষ করে দিলে।আবার পড়াশোনা নামক বাঁশ টা পেছনে লাগলো।
-তুমি কি উঠবে?নাকি আমি মোটা লাঠি নিয়ে আসবো?

ইলা অসহায় চোখে মাহিরের দিকে তাকালো।

-মাহির আমি সিরিয়াসলি বলছি।আপনি দেখে নেবেন আপনার জীবনে বিয়ে হবে না?আপনি এভাবে নারী নির্যাতন করছেন।আজ আমি পালাবো।এর পর কাউকে যদি আনেন সেও পালাবে।

ইলার কথা শুনে মাহিরের বেশ হাসি পাচ্ছে।মাহির নিজে কে সংযত করে কঠোর গলায় বললো,

-ইলা!তুমি কি উঠবে নাকি আমি লাঠি আনবো।
-উঠছি তো।খালি বকেন কেন?

ইলা মুখ গোমড়া করে উঠে ওয়াশরুমের দিকে চলে গেলো।ব্রাশ গালে নিয়ে দাড়িয়ে আছে ইলা।ইচ্ছে মতো মাহিরকে গালাগাল করছে সে।কি এমন দরকার ছিল এই বই খাতা আনার?তার বাচ্চা কাচ্চার কি হবে?সে যদি কলেজ আর বই নিয়ে বসে থাকে তবে তার বাচ্চা গুলো না খেতে পেয়ে চিকন হয়ে যাবে।তাদের কে দেখবে?দুদিন পর দেখা যাবে তার বাচ্চারা তাকে আন্টি বলে ডাকছে।সব সময় মাকে দেখলে যা হয় আরকি।ইলা নিজের ভবিষ্যত টাকে একটু টর্চ লাইট মেরে দেখে নিচ্ছে।

-ধুর ভাল্লাগে না।অন্তত একটা ট্যাপার মা হওয়ার জন্য হলেও বই পড়তে হবে।দুদিন পর মাহিরকে গলিয়ে এক টা ট্যাপা নিতে পারলেই কেল্লাফতে।মাহির নিজেই ওসব বই খাতা ফেরি ওয়ালার কাছে বেচে পাঁপড় কিনে আনবে।তাহলে না হয় কদিন নাটক করে মাহিরকে পটিয়ে দেখি।

ফ্রেশ হয়ে ওয়াশরুম থেকে বের হলো।মাহির বিছানায় বসে ফোন দেখছে।

-তোমার সকল ভাবনার জন্য এক আর এফ বালতি ভরা সমবেদনা।তুমি যদি ভেবে থাকো তুমি আমাকে দুটো মিষ্টি কথা বলবে আর আমি ভুলে যাব তো মনে রেখো তার জন্য আরো বড় বাঁশঝাড় আনবো।

ইলা অসহায় হয়ে মাহিরের দিকে তাকিয়ে আছে।মাহির দুষ্ট হাসি দিয়ে ইলার দিকে তাকিয়ে আছে।

-আপনি কি ভাবে সব শুনলেন?
-ইলা তুমি এতোটাই নিরীহ ব্যক্তি যে তোমার কথা বুঝতে সময় লাগে না।

মাহির উঠে দাড়ালো।বের হতে গেলেই ইলা পথ আটকালো।

-কি হলো?
-কাল ওভাবে কেন ফেরালেন আমাকে?আপনি কি এটা চাননি এতোদিন?আপনি কেন এটা করলেন মাহির?

ইলার চোখে একরাশ অভিযোগ।কাল রাতের অভিমান।মাহিরের অনেক কষ্ট হচ্ছে ইলাকে দেখে।কিন্তু মাহির নিজেই জানে সে কেন এমন করেছে।মাহিরের কষ্ট টা যে মাহির প্রকাশ করতে পারছে না।

-কি হলো মাহির বলুন?
-ভালো বাসো?
-,,,,,,,।
-কি হলো উওর দেও?

ইলা এবার ও নিশ্চুপ।মাহিরের মুখে তাচ্ছিল্যের হাসি ফুটে উঠলো।

-ইলা মানুষ ভালোবেসে মিলিত হয়।যেখানে ভালোবাসা নেই সেখানে মিলন টা নিতান্ত ই অযৌক্তিক।খেয়াল রেখো।নিচে খাবার আনিয়ে রেখেছি।খেয়ে নিও।আর তোমার আরবি টিচার আজ আসবেন।ওনার কাছে পড়ে একটু রেস্ট নিবে।একটা তরকারি রান্না করবে।বেশি কষ্ট করার দরকার নেই।আমি আসলে আরেকঁ টা পদ রান্না করব।বাকি সময় শুধু পড়বে।

মাহির ইলার কপালে চুমু দিয়ে সরতে যাবে তার আগেই ইলা মাহিরকে জড়িয়ে ধরলো।মাহির এর শার্টের বুকের অংশটা গরম অনুভব হচ্ছে।বোঝা যাচ্ছে ইলা কাঁদছে।মাহির ইলাকে জড়িয়ে নিল।

-কি হয়েছে পানিজল?আমি তোমার চোখের পানি দেখতে পারিনা।কেন বোঝো না?
-আপনি সব কিছু বোঝেন মাহির।কিন্ত আসল কথাটাই বুঝলেন না।অনেকবার বোঝাতে চাই তাও বোঝেন না।এতো অবুঝ কেন আপনি?

ইলার কথার অর্থ মাহির বেশ বুঝতে পারছে।মাহির এর চোখ দুটো ছলছল করে উঠলো।

-কি বুঝিনা আমি?
-কারোর নিঃশ্বাসে মিশে থাকার আনন্দ টা।যেটা আমার নিঃশ্বাস কেও ঘন করে দিয়েছে।কারোর ছোটো ছোটো খুশিগুলো যেগুলো আজ আমার খুশির কারণ হয়েছে।আজ আমি নিজের জন্য ভাবিনা।আমার নিজের পরিধি টা আজ বড় হয়ে গেছে।সেটা আমার আমিতে নেই।কোনো এক আপনির সাথে মিশেছে।আমরা হয়ে গেছে।এই আমরার পরিধি টা বেশিই বড়।খুব বেশি।আমি সামলাতে পারছি না।আমি ঐ আপনি টাকে না অনেক কিছু বলতে চাই।কিন্তু বলতে পারিনা।আমি চেয়েছিলাম সে বুঝে নিক।তার বোঝা উচিত তার তুমি টা মুখ ফুটে বলতে পারে না।কিন্তু না আপনি টা বড্ড খারাপ।সেটাও বুঝলো না।কিছু বুঝে না সে।কিছু না।
– কি বুঝিনা আমি?
-আমি আপনার বাচ্চার মা হতে চাই ব্যস।
-সেই এক কথা।ইলা চুপ করো।

ইলা এবার রেগে মাহিরকে ছেড়েই দিলো।কেঁদেই দিল।

-আপনি কিছু বোঝেন না কিছু না।
-কি বুঝবো?
-আমি আপনার প্রতিটি কথাকে ভালোবাসি,আপনার মুখের হাসিটা ভালো বাসি, আপনার ঘুমন্ত মুখটা কে ভালোবাসি,আপনি রাগী চাহনি টাকে ভালোবাসি,আপনার ছোটো খাটো দুষ্টুমি গুলোকে ভালোবাসি,আমি আপনার আপনি কে ভালোবাসি,আমার আলু পাখি র লাল ঠুকটুকে আংকেল কে ভালোবাসি, আমি আপনাকে ভালোবাসি।শুনেছেন আপনি?আপনি একটুও বোঝেন না আমাকে।একটু ও না।

ইলা চোখ মুছে চলে যেতে নিলেই মাহির ইলার হাত ধরে টান মারলো।এক টানেই ইলা মাহিরের বুকে।

-সব কথা যে বুঝতে ভালো লাগে না বউ।কিছু কথা শুনতে চাই।বার বার শুনতে।যেন বিশ বছর পর ও অনুভূতি টা এমন থাকে।এই দিনটা মনে থাকে।আমার ভালোবাসা আমাকে ভালোবাসেছিল।ভালোবাসি বউ।

৯৬

৬ মাস পর
#রৌদ্র_কুয়াশা
Suvhan Årag(ছদ্মনাম)
পর্ব ৩৫

সময় ও স্রোত কারোর জন্য অপেক্ষা করে না।কিছু সময় গুলো মনে হয় অতীত হলেই ভালো,আর কিছু সময় অতীতে ফিরতে চায়।

মাহিরের জন্য হয়তো অতীতের সময় এর চেয়ে বর্তমান টাই বেশি প্রধান্য পেয়েছে।

বিছানায় শুয়ে আছে মাহির।তার বুকের ওপর মাথা রেখে মাহিরকে কোলবালিশের মতো জড়িয়ে দিব্যি ঘুমিয়ে আছে ইলা।শীতকালের আগমন অতি শীঘ্রই ঘটতে চলেছে।বাইরে থেকে জানালার থাই গ্লাসটাও ঝাপসা হয়ে গেছে।বিন্দু বিন্দু শিশির জমেছে জানালার কাছে।কখনো বা কয়েক ফোটা শিশির ধীরে ধীরে কাচ বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে তালে তালে।সকালের সূর্য টাও যেন দেরী করেই উঠলো।সূর্য মহাশয় ও হয়তো শীতের হিম পড়া রাতের আঁধারে ঘুমোতে খুব ভালোবাসে।আচ্ছা সূর্য মহাশয়ের ও কি কেউ টা আছে?যার জন্য তাকে দেরিতে উঠতে হয়?নাকি সূর্য মহাশয় কোনো মহাশয় নন একজন রমনী।শীত হোক বা গ্রীষ্ম প্রভাত তার ভেজা চুল নিয়েই কাটাতে হয়।চুল থেকে টপটপ করে পানি পড়ে।আর সেই পানিটা শুষে নেওয়ার জন্য ও একটা কেউ থাকে।

আনমনে মাহির ভেবে চলেছে অনেক কথা।জানালার কাচ দিয়ে তার মনে হচ্ছে সূর্যের আলো যেন কুয়াশায় স্নান করে পবিত্র হয়ে তাদের ঘরে ঢুকে পড়েছে।কুয়াশার স্নান মনে পড়তেই মাহিরের মনে পড়লো বেলা হয়েছে তাকে উঠতে হবে।ফ্রেশ হতে হবে।

মাহির উঠতে গিয়ে ও পারলো না।ওঠার আগেই একটা ভার তাকে আটকে দিল।তাকে আরো শক্ত করে জাপটে ধরলো।যেন মাহির তাকে ছেড়ে না যায়।মাহির ও থেমে গেল।মুখে এক অদ্ভুত তৃপ্তির হাসি।ইলা মাহিরের বুকের ওপর মাথা রেখে শুয়ে আছে।মাহিরের উন্মুক্ত বুকে ইলার চুলগুলো ও যেন ছড়িয়ে আছে একদম লতা পাতার মতোন।ইলা মাহিরকে আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো।ইলার ঘুমন্ত মুখটা মাহিরের কাছে আরো বেশি ভালো লাগে।ঘুমালে মানুষের মুখ এমনিতেই একটু ফোলা লাগে।মাহির কোথাও পড়েছিল ঘুমন্ত মেয়েদের নাকি দেখতে পরীর মতো লাগে।তাদের মায়াবতী মনে হয়।কিন্ত মাহির এটা মানতে নারাজ।তার কাছে ঘুমন্ত ইলাকে মনে হয় রসগোল্লা এক হাড়ি রসগোল্লা।তাকে দেখলে মায়া লাগে না।উল্টা মাহিরের মন চায় রসগোল্লা টাকে খেয়েই ফেলে সে।

-পানিজল।ওঠো।অনেক বেলা হয়ে গেছে।তোমার ওঠার নাম নেই।আমাকে অফিসে যেতে হবে তো।

ইলা ঘুম ঘুম কন্ঠে বললো,

-উহুম ছাড়বো না।যা পারেন করুন।
-ছাড়ো।অফিস এর দেরী হয়ে গেছে এমনিতেই।
-উহুম।আরেকটু থাকুন না প্লিজ।
-ইলা এতো ভারী ছোটো খাটো হাতি আমার বুকের ওপর থাকলে আমি কিভাবে শুয়ে থাকব!হায় আল্লাহ রক্ষা করো।সারাটা রাত ধরে এই রকম একটা আস্ত হাতি আমার বুকে র ওপর হামলা করে শুয়েছে।

মাহিরের কথা শুনে রেগে গেলো ইলা।এক লাফে উঠে বসলো।ইলা উঠতে মাহির ও উঠে বসলো।

-এই আপনি কি বললেন?আমি হাতি?আমি?
-হ্যা অবশ্যই।সন্দেহ আছে?
-অবশ্য ই আছে।আমি না বরং আপনি হাতি।আমি কি এমন করেছি হ্যা?শুধু একটু মাথাটা আপনার বুকের ওপর রেখেছি।আর আপনি যে পুরো,,,,,,,,,,,,,তার বেলায়।
-কথাটা অর্ধেক বললে কেন?পুরোটা বলো।

মাহিরের কথা শুনে ইলার চোখ বড় বড় হয়ে গেল।সে বেশ বুঝতে পারছে মাহির তাকে ইচ্ছে করে লজ্জায় ফেলতে চাইছে।

মাহির দুষ্টু হাসি দিয়ে আবার বললো,

-কি হলো?বলো?
-কিছু না।
-আরে!কিছু তো আছেই।বলে ফেলো।আমিই তো।
-হ্যা আপনিই তো।
-আমি আবার কি করলাম?
-লুইচ্যা ঢেড়শ কোথাকার।নিজের তো লজ্জা শরমের ল শ কিচ্ছু নেই আমাকে ও বেহায়া বানাতে চাইছে।ফাজিল লোক একটা।আমি ও আজ আপনার অফিসে যাব।গিয়ে সবাইকে বলে দেব।

মাহির ভ্রু নাচিয়ে জিজ্ঞাসা করলো,

-কি বলে দেবে শুনি?
-এই যে।আপনি দেখতে যতোটা ভদ্র সভ্য একজন মহান ব্যক্তি আপনি মোটে ও তা নন।আপনি আসলে,,,।
– কি আসলে?
-লুচ্চু কোম্পানির এমডি।
-ও হ্যা।তাই তো।আর তুমি সেই এমডির বউ।সুন্দর না!

মাহির হো হো করে হেসে দিল।ইলা লজ্জা পাচ্ছে এদিকে তার রাগ ও হচ্ছে।মাহিরের সাথে সে কখনোই কথায় পেরে ওঠে না।রেগে ইলা মাহিরের গায়ে বালিশ ছুড়ে মেরে ওয়াশরুমে চলে গেল।

মাহির বালিশ কোলে নিয়ে বসে চেঁচিয়ে বললো,

-ডিয়ার লুচ্চু কোম্পানীর এমডির বউ,আপনার যদি সমস্যা হয় তো বলুন আমি ও ওয়াশরুমে আসি আপনাকে একটু হেল্প করতে।

ভেতর থেকে ইলা জবাব দিল,

-কখনো না।ফাজিল বজ্জাত বেশরম লোক একটা।হুহ।

৯৭

ছয় মাসে অনেক কিছুই বদলেছে।অনু পড়াশোনার পাশাপাশি একটা লেডিস কসমেটিক্স এর দোকানে পার্ট টাইম জব করে।যদিও দোকানটা আরিয়ানের ই।আরিয়ান কিছু মেয়েদের সাহায্য করার জন্য দোকানটা ভারা নিয়েছিল।অনু পার্ট টাইম সেখানেই বসে।অন্য সবার মতো আরিয়ান অনুকে ও মাসের বেতন মাসেই বুঝিয়ে দেয়।

এর মধ্যে তুলির ও ছোট্ট একটা ফুটফুটে মেয়ে হয়েছে।তুলির বর দেশের বাইরে আছে।আরো অনু এই বাড়িতে।তাই তুলিও মেয়েকে নিয়ে এখানেই আছে।

-অনু,অনু কোথায় আপনি?আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে।আমার খাবার টা দিন প্লিজ।

আরিয়ান ইউনিফর্ম পড়ে এদিক ওদিক তাকাতে তাকাতে ডাইনিং টেবিলে এসে বসলো।সকাল থেকে একবার ও দেখা হয়নি তার অনুর সাথে।টেবিলে বসেই চমকে গেল আরিয়ান।সব খাবার রাখা।

-আরে!অনুকে তো দেখলাম না।খাবার কে রাখলো?
-আমি রেখেছি ভাইয়া।

আরিয়ান পেছনে ঘুরে দেখে তুলি দাড়িয়ে আছে।

-ও তুই।
-হ্যাঁ।আগে তো আমিই রাখতাম।অসুস্থ ছিলাম তারপর আবার অনু ছিল।তাই ওতো দেখতাম না।
-হ্যাঁ।আসলেই মেয়েটা অনেক ভালো।কদিনেই আমাদের সবার খেয়াল রাখে।
-আসলেই।
-বাবু কে একা রেখে এসেছিস?
-না ও ঘুমাচ্ছে।উঠেছিল।খাইয়ে আবার ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছি।তুই খেয়ে নে।দেরী হয়ে যাচ্ছে তো তোর।
-হুম।

আরিয়ান এদিক ওদিক আবার দেখছে খাওয়ার মাঝে।

-কি হলো ভাইয়া?কি খুজছিস?
-অনুকে তো সকাল থেকে একবার ও দেখলাম না।
-আর বলিস না।কাল রাতে বাবু বড্ড জালিয়েছে।অনু সারা রাত ওকে নিয়ে ঘুরেছে।আমার মাথা ব্যথা করছিল।বাবুকে নিতে পারিনি।তাই অনু ঘুমিয়েছে ওকে আর ডাকিনি।
-যাক ভালো করেছিস।

আরিয়ানের ভেতর টা যেন খচখচ করছে।অনুকে চোখের দেখা দেখে যেতে পারলো না সে।

-ভাইয়া।
-কিছু বলবি?
-তুই না বলেছিলি দুদিন আগে অনুর শ্বশুরবাড়িতে ডিভোর্সের নোটিশ পাঠিয়েছিস।কি খবর সেটার?
-আর বলিস না।
-কেন কি হয়েছে?
-যেই ঠিকানা অনু দিয়েছে সেখানে বাড়িতে তালা ঝুলানো।কেউ নেই।
-তাহলে ওর শ্বাশুড়ি স্বামী কি অন্য কোথাও চলে গেছে?
-জানিনা।অনু তো বলেছিল ওনারা ওখানে স্থানীয়।কি জানি?ঐ আরেক ঝামেলা।ডিভোর্স টা শেষ হয়ে গেলে আমি অনেক নিশ্চিন্ত হতাম।
-তুই আবার নিশ্চিন্ত হতিস কিভাবে?
-ঐ না মানে।অনুর থেকে একটা ঝামেলা নামতো।মেয়েটা এখনো পুরো স্বাভাবিক না।এখনো স্বামীর নাম শুনলেই ভয়ে কাপে।
-হুম।আচ্ছা তুই খাওয়া শেষ কর।আমি একটু দেখে আসি বাবু কে।

তুলি ভেতরে চলে গেল।আরিয়ান আনমনে বসে আছে।সে নিজেই জানে কেন সে নিশ্চিন্ত হতো অনুর ডিভোর্স টা হয়ে গেলে।

৯৮

-তুমি সব সময় নিজের জেদে চলেছো মাইশা।কখনো আমার কোনো কথা শোনোনি।এতোটাই উচ্ছৃঙ্খল হয়েছো তুমি আমার মান সম্মান নষ্ট হয় এমন কাজ করতেও তোমার বাধে নি।

মাইশা নিজের বাবাকে জড়িয়ে কেঁদেই দিল।

-বাবা আমি বুঝতে পারিনি।আমি তো রিদন কে খুব ভালোবাসতাম।
-এটা ভালোবাসা?তুমি মাহিরের সাথে বিয়ের আগেও রিদনের সাথে,,,ছিহ।আজ দেখো ঐ ছেলেটা কি ভাবে তোমাকে ধোঁকা দিল।তুমি তাকে ভালোবাসতে পারো।সে না।তুমি জানো তোমার কপাল যে মাহিরের মতো একটা ছেলেকে তুমি স্বামী হিসেবে পেয়েছিলে।না হলে তোমার মতো ওরকম ছেলে ডিজারব করে না।এতো বড় ঘরের ছেলে হয়েও ছেলেটা র মধ্যে বিন্দু মাত্র উচ্চাভিলাষ নেই।নেই চরিত্রের দোষ।তাকে তুমি এভাবে ঠকিয়েছো দিনের পর দিন।তবুও ও মেনে নিয়েছে।মানলাম ওর সমস্যা ছিল।কিন্তু তুমি দুধে ধোয়া নও মাইশা।চিকিৎসা করলে মাহির এর সমস্যা র সমাধান ঠিক ই হতো।কিন্তু তুমি কি করেছো ওর সাথে?ছিহ মাইশা।তোমাকে নিজের মেয়ে বলতে আমার ঘৃনা লাগছে।

মাইশার বাবা মাইশা কে নিজের থেকে সরিয়ে নিজের ঘরে চলে গেলেন।মাইশা ফ্লোরে বসে পড়লো।আজ কান্না ছাড়া মাইশার কাছে কিছুই নেই।

রিদন মাইশার সাথে সম্পর্ক থাকার আগে পরে ও অনেক মেয়ের সাথেই সম্পর্ক এ জড়িয়েছে।মাইশার থেকে অনেক টাকা নিয়েছে।শেষ মেশ মাইশার ভিডিও বানিয়ে তাকে ব্লাকমেইল করে আরো বড় অংকের টাকা হাতিয়েছে।আজ মাইশা বুঝেছে যে সম্পর্ক শারীরিক চাহিদা তেই পরিণত হয় সেটা ভালো বাসা হতে পারে না।রিদন বিয়ে করে দেশের বাইরে চলে গেছে।তার বদলে মাইশার ঘাড়ে চাপিয়েছে এক গাদা বদনাম।

-আমি তোমাকে ভুল বুঝেছি মাহির।আমি তোমাকে খুব ভালোবাসি মাহির।আমি পেয়েও তোমাকে হারিয়েছি।না মাহির আমি তোমার কাছে যেতে চাই।আমি ক্ষমা চাইব।আমি জানি মাহির তুমি কখনো তোমার মাইশা র থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে পারবে না।আমি জানি তুমি এখনো আমার অপেক্ষা তে আছো।না হলে আলফাজ আংকেল তো বলতেন না যে তুমি আজো একা আছো।আমি প্রমিস করছি মাহির যাই হয়ে যাক আমি আর তোমাকে ছাড়ব না।তোমার সাথেই ভালোবাসার ঘর বাধবো।আমি তোমার কাছে যাব মাহির।

চলবে————-
চলবে————–

(

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here