#লুকানো_অনুরক্তি (১০)
রূপন্তি রাহমান (ছদ্মনাম)
অনাকাঙ্ক্ষিত মাহফুজ এর আওয়াজ পেয়ে হকচকিয়ে গেল অবনি। কেঁপে উঠল তার সমস্ত কায়া। মনে মনে দোয়া করতে লাগল মনের ভুল যেন হয়। পিছন ফিরে সত্যি সত্যি মাহফুজকে দেখে একেবারে স্তম্ভিত, হতবিহ্বল সে। মনের ভুল নয়। এতো রাতে সত্যিই মাহফুজ এসেছে। কিন্তু কেন?
দরজার ছিটকিনি ভালো করে আটকে অবনির সম্মুখে এসে দাঁড়ায় মাহফুজ। ভয় বাড়ল তার। এতো রাতে বদ্ধরুমে একটা ছেলে আর একটা মেয়ে ব্যপারটা মোটেও সুবিধার না। কেউ টের পেলে তার দিকে আঙুল তুলবে। তাকেই দোষারূপ করবে। ভয়ার্ত গলায় প্রশ্ন করল,
‘দরজা বন্ধ করেছো কেন? আর নাদু কোথায়?’
পা থেকে মাথা অবদি অবনিকে পরখ করে মাহফুজ। বিরস গলায় জবাব দিলো,
‘দরকার আছে বলেই দরজা বন্ধ করেছি।’
অবনি তৎক্ষনাৎ জবাব দেয়,
‘তোমার সাথে আমার কোনো দরকার নেই। তুমি চলে যাও।’
‘আমার দরকার আছে বলেই আমি এসেছি। দরকার না থাকলে তো আসতাম না। এখন বল মনের লুকানো সমস্ত অনুরক্তি তুই প্রকাশ করবি নাকি সবটা আমার জোর করে বের করতে হবে?’
‘কোনো কিছু লুকাচ্ছি না আমি। আল্লাহর দোহাই লাগে তুমি যাও। ফুফু কিংবা ফুফা দেখলে কেলেংকারী হয়ে যাবে।’
‘তোর সাথে ঘুমাবো বলে নিশ্চয়ই আসেনি। যে কেলেংকারী হয়ে যাবে। আমার কিছু প্রশ্নের উত্তর চাই। উত্তর পেলে চলে যাবো। নয়তো এভাবে এক রুমে আমার সাথে থাকবি। যতক্ষণ না আমি আমার উত্তর পাবো ঠিক ততক্ষণ। কে কি বলল তাতে আমার কিছু আসে যায় না। কিন্তু আমার উত্তর চাই মানে চাই।’
মাহফুজের লাগামহীন, ঠোঁটকাটা শুনে ফুস করে নিঃশ্বাস ফেলল অবনি।
মাহফুজ আলতো করে অবনির উষ্ম গালে হাত রাখে। মাহফুজের আকস্মিক স্পর্শে চমকে উঠে অবনি। মাহফুজের তপ্ত ছোঁয়ায় থমকে গেল তার ধরিত্রী। শিরশির করে কাঁটা দিয়ে উঠে তার সমস্ত শরীর। অজানা অনুভূতি। অজানা শিহরণ।
মাহফুজ কোমল স্বরে জানতে চায়,
‘এমনটা করার কারন কি? আমার কি কোনো ত্রুটি আছে? থাকলে বল না। নিজেকে শুধরানোর চেষ্টা করবো।’
হাত টা সরিয়ে দেয় অবনি। নিরেট গলায় জবাব দেয়,
‘তোমার কোনো সমস্যা নেই। আমি চাইছি না তোমার সাথে কোনো সম্পর্কে জড়াতে। না প্রণয় আর না বৈবাহিক।’
ভ্রু কিঞ্চিৎ কুঁচকে গেল মাহফুজের।
‘কেন চাইছিস না? আমি সেটাই তো জানতে এলাম। আর এই কেন উত্তরটা যে আমার চাই ই চাই।’
অবনি নত মস্তকে মৃদুস্বরে বলে,
‘আমি বাধ্য নই।’
‘অবশ্যই তুই বাধ্য। আমাকে দিনের পর দিন রিজেক্ট করবি, অবহেলা করবি কেন করবি তা জানার অধিকার নিশ্চয়ই আমার আছে।’
অবনির হাত দুটো মুঠোবন্দি করে নিলো সে।
‘সমস্যাটা ঠিক কোন জায়গায় বলবি তো? না হলে বুঝবো কি করে?’
নিষ্প্রভ চাহনি নিবদ্ধ করে মাহফুজের চোখে। ঝাপসা হলো অবনির আঁখি জোড়া। অশ্রুসিক্ত হলো পল্লব। কাঁপা কাঁপা স্বরে বলল,
‘আমার কাছে আমার সম্মানটা অনেক বড় মাহফুজ ভাই। আমি চাই না কেউ আমার চরিত্রের দিকে আঙুল তুলুক। কেউ মুখ বাঁকিয়ে বলুক এই মেয়েটার চরিত্রে সমস্যা আছে।’
চোখের পাপড়ি ভিজিয়ে নেত্রজলের ক্ষুদ্র ফোঁটা স্পর্শ করল গাল। মাহফুজ সস্নেহে মুছে দিলো তা।
‘প্রেম করলে কিংবা ভালোবাসলে চরিত্রে সমস্যা? আচ্ছা তাহলে আমরা না হয় আমাদের প্রণয়ের সূচনা তিন বার কবুল বলার পরই করবো। তাতে হবে?’
না বোধক মাথা নাড়ে অবনি। মাহফুজ অসহায় স্বরে বলে, ‘আবার কী সমস্যা?’
ফুঁপিয়ে উঠে অবনি।
‘তুমি কি ভেবেছো বিয়ে করে নিলে সবাই চুপ থাকবে?’
‘এই সবাইটা কে? আজব তো। এই সবার কথা চিন্তা করে আমি আমার জীবনের সুখ বিসর্জন দিবো নাকি?’
‘ তোমার চিন্তা করতে না হলেও আমাদের মতো গ্রামের মানুষদের সবার কথা চিন্তা করতে হয়।কে কি বলল না বলল তা নিয়ে ভাবতে হয়। গ্রামের সবাই বাবার দিকে আঙুল তুলে বলবে, মামুনুর রশীদ মেয়েকে শহরে পাঠিয়েছে পড়াশোনার জন্য। আর মেয়ে করছে পীরিত। বাবার সম্মান নিয়ে টানাটানি হবে। আমার মায়ের শিক্ষার উপর সবাই আঙুল তুলবে। বলবে, একজন শিক্ষিকা হয়েও মেয়ে সঠিক শিক্ষা দিতে পারেনি। যে বাসায় থেকেছে সম্পদের লোভে সেই বাসার ছেলেকে রূপের জালে ফাঁসিয়েছে। শুধু এইটুকু বলে ক্ষান্ত হবে না। বলবে, একবাসায় থেকেছে ওদের মাঝে নিশ্চয়ই বিবাহবহির্ভূত সম্পর্ক তৈরি হয়েছে। তুমি কেন পাগলামি করছো? কেন আমার অবস্থাটা বুঝতে পারছো না?’
কথাগুলো বলে অঝোরে কাঁদতে লাগল অবনি।
অবনির দিকে সরু চোখে তাকিয়ে রইল মাহফুজ। অবনির বলা বিরামহীন কথাগুলো কেবল শুনে গেল সে। কথা শেষ হতেই সে রগড় গলায় বলল,
‘বলা শেষ? এক গ্লাস পানি এনে দিবো? এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে নিশ্চয়ই তোর গলা শুকিয়েছে?’
অবনি ব্যাকুল চোখে মাহফুজের দিকে চাইল। বিবশ কন্ঠে পুনরায় বলে,
‘ ফুফুও কষ্ট পাবে। বলবে, আমাকে আশ্রয় দিয়ে ভুল করেছে। তার চোখের আড়ালে তার ছেলেকে ফাঁসিয়েছি।’
‘আমার মাকে তোর এমন মনে হয়?’
‘না ফুফু এমন না। কিন্তু বলতে কতক্ষণ? ফুফু না বললেও বলার মানুষের অভাব হবে না। ফুফু এবং ফুফা দু’জনের পছন্দ থাকতে পারে। তুমি বরং তাদের পছন্দে বিয়ে করো। আমি মানুষের কটু কথা শুনতে পারবো না। বাবা মাকেও শুনাতে পারবো না। বাবার তিলে তিলে গড়ে তোলা সম্মান আমার একটা কাজের জন্য ধুলোয় মিশে যাক সন্তান হয়ে এটা অন্তত চাইবো না।’
‘আত্মীয়তার মাঝে কি মানুষ আবার নতুন করে সম্পর্কে বাঁধা পড়ছে না?’
‘পড়ে তো। তবে তারা নিশ্চয়ই বিয়ের আগে আশ্রিতা হিসেবে থাকে না।’
এবার রেগে গেল মাহফুজ। উঁচু গলায় কথা বলতে গিয়েও পারে না। পাছে যদি তার মা বাবা জেগে যায় তো আসলেই কেলেংকারী হয়ে যাবে।
‘আশ্রিতা, সম্পদের লোভে শব্দগুলো দ্বারা কি বুঝাতে চাইছিস? তোরা গরীব? তোদের কিছু নেই? অভাবে আমাদের বাসায় থাকিস? আজব কথাবার্তা। পড়াশোনার জন্য আছিস। আর তোর বাপের যেই সম্পদ আমার বাপের এসব নেইও।’
পরপর কয়েকটা শ্বাস ফেলে রাগ নিয়ন্ত্রণ করল মাহফুজ। অবনির এলোমেলো, অবিন্যস্ত চুলগুলো কানের পিছনে গুঁজে মলিন মুখটা হাতের আঁজলে নিল।
‘কে কি বলল না বলল তার জন্য নিজের ভালোবাসা ছেড়ে দিবি? ভালোবাসার মানুষটাকে ছেড়ে দিবি? আফসোস হবে না? আকাশ সমান আফসোস নিয়ে বাঁচতে পারবি তুই?’
‘যেখানে তোমায় আমি ভালোই বাসি না। সেখানে আফসোস কেন হবে?’
‘হ্যা সেটা তো তোর গরুর মতো বড় বড় অশ্রুসিক্ত দুই চোখই বলে দিচ্ছে।’
মাহফুজ থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিল অবনি। দৃষ্টি নত করে বলে,
‘তুমি এখান থেকে যাও।’
মাহফুজ প্রখর, শাণিত চোখে অবনির দিকে তাকিয়ে রইল। এই মেয়েকে হাজার কিছু বলেও বুঝাতে পারবে না। যে বুঝতে চায় না তাকে সে কি আর বুঝাবে। যা করার নিজেই করবে।
দরজা খুলে বাইরে আসতেই মাহফুজের নজরে এলো নাদিয়াকে। দুশ্চিন্তায় দাঁতে নখ কাটছে সে।
‘ভাইয়া অ*সভ্যটা মুখ খুলল?’
মাহফুজের বুক গলিয়ে নিঃসৃত হয় দীর্ঘশ্বাস। নিস্তরজ স্বরে বলে,
‘অনেক রাত হয়েছে ঘুমোতে যা।’
অবনি যে নাছোড়বান্দা বুঝে গেল নাদিয়া। হনহনিয়ে রুমে এসে দেখল শুয়ে পড়েছে সে। নাদিয়াও ধপ করে শুয়ে পড়ল। কঠিন গলায় বলল,
‘আমার ইচ্ছে করছে বিছানার ঝাড়ু দিয়ে তোর পিঠের চামড়া তুলে নেই। কিন্তু নিরূপায় আমি। এটা পারবো না। তোর গা*য়ে হাত তুললে তোর ফুফু তেলেবেগুনে জ্বলে উঠবে আর উল্টো আমার পিঠের চামড়া তুলে রোদে শুকাতে দিবে।’
___________________
খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে সবকিছু গোছগাছ করছে মাহফুজ। একটু পরে ফ্রেশ হয়ে নিজেও তৈরি হবে। ব্যাগ গোছানো শেষ করেই ড্রয়িংরুমে এলো সে। নাদিয়ার রুমের দিকে এক নজর তাকাল। হয়তো ওদের ঘুম এখনো ভাঙেনি। শব্দ করে ডাকল আফসানা খানম কে।
‘মা? হালকা পাতলা কোনো নাস্তা বানিয়ে দাও। আমার এক্ষুনি বের হতে হবে।’
আধঘন্টা পরে ফর্মাল ড্রেসআপে বের হয়ে আসে মাহফুজ। আফসানা খানম ততক্ষণে টেবিলে নাস্তা দিয়ে দিয়েছেন। শহিদুল হক বসে পেপার পড়ছেন।
‘আজকে তো আমাদের পাত্রী দেখতে যাওয়ার কথা। তাহলে এই সকাল সকাল ব্যাগ পত্তর নিয়ে কোথায় যাচ্ছিস?’
মাহফুজ গরম গরম চায়ে চুমুক দেয়।
‘তুমি এসব দেখাদেখি ক্যান্সেল করো। আজকেই আমাদের সিলেট যেতে হবে। নতুন একটা প্রজেক্টের কাজে। সাত দিনের জন্য। কাজের উপর ডিপেন্ড করে দিনের সংখ্যা বাড়তেও পারে আবার কমতেও পারে।’
‘তাহলে তুই সিলেট থেকে আসার পরে আমরা দেখতে যাবো।’
‘তারা আমার তাদের মেয়ে ঝুলিয়ে কেন রাখবে? হয়তো আমার চেয়ে ভালো ছেলেও পেতে পারে।’
‘আজকে দেখতে যাওয়ার কথা ছিল আর আজই নিষেধ করবো যে যাবো না। এটা খারাপ দেখায় না?’
‘আমি কি ইচ্ছে করে করছি বলো? রাতে বস ফোন করে বলল। আমি তো আমার কোম্পানির খারাপ চাইতে পারি না।’
শহিদুল হক আর কথা বাড়ালেন না।পুনরায় মনোযোগ দিলেন পেপারে। মাহফুজও খাবারে মনোযোগ দিল।
সেই সময় দরজা খুলে হাত খোঁপা করতে করতে বেরিয়ে এলো অবনি। ফর্মাল ড্রেসআপে মাহফুজকে দেখে কপাল কুঁচকে তাকিয়ে রইল।
মাহফুজ তাকাতেই তড়িঘড়ি করে রান্নাঘরের দিকে চলে গেল সে।
‘ফুফু আজ তো শুক্রবার। কিন্তু এতো সকালেে,,,,,
‘আজ নাকি সিলেট যাবে। অফিসের কাজে। সাতদিন থাকবে।’
অবনিও ‘ওহ্’ বলে চুপ হয়ে গেল।
________________
মাহফুজ বিদায় নিয়ে বেরিয়ে গেছে অনেক্ক্ষণ হলো। বিদায় বেলা ভুলেও অবনি ড্রয়িংরুমে যায়নি। রুমেই ঘাপটি মে’রে বসে ছিল।
মিনিট কয়েকবাদে মোবাইল হাতে নাদিয়া হাসে হাসতে রুমে প্রবেশ করে। হাসার জন্য সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারছে না।
কপালে ভাঁজ ফেলে নাদিয়ার দিকে তাকিয়ে রইল অবনি।
‘এভাবে হাসছিস কেন?’
নাদিয়া মোবাইলটা সামনে ধরে। মাহফুজ নাম্বার থেকে মেসেজ পাঠিয়েছে,
‘আধ পা*গল টাকে একটু দেখে রাখিস। কি বলে আর কি করে নিজেও জানে না। আধ পা*গলের টেনশনে আমি সিলেট গিয়েও শান্তি পাবো না।’
মেসেজটা পড়ে আপনা-আপনি অচৈতন্যের মতো বলে বসল,
‘আধ পা*গল কে? আমি?’
#চলবে
পর্ব ৫ এবং ১১ নাই কেন