#শত্রু_শত্রু_খেলা
#পর্ব_৮
#মেঘা_সুবাশ্রী (লেখিকা)
দিঘির পাড়ে বসে আনমনে এক বিবর্ণ অতীতে ডুব দেয় সৌরভ। যেই অতীত তার জীবনে এক দুঃস্বপ্নের গল্পের মত। সে ভুলে গেছে সেই অতীতকে। কিন্তু কেনো আবার সেই দুঃস্বপ্ন তার সামনে আসতে চাই? আবার নতুন করে কি চাই?
দু’হাত ঠেস দিয়ে সিঁড়ির এককোণে বসে আছে। তার দৃষ্টি পড়ে দিঘির আশেপাশের জায়গাগুলোতে। এই জায়গাগুলোর প্রতিটি কোণে লুকায়িত আছে তার বিষাদের ছাপ।
কত গল্প আর হাসিতে মুখরিত হতো এই স্থান। সেই সময়, সেই দিন চলে গেছে বহুকাল আগেই। কিন্তু তার দাগ কাটেনি আজও, রেখে গেছে তার দগদগে ক্ষতচিহ্ন।
সদ্য কলেজ শেষ করে ভার্সিটির ভর্তি পরীক্ষার জন্য তার কোচিং ক্লাসে সময় ব্যয় হতো অত্যাধিক। পড়াশোনায় এত মনোযোগী ছিলো আশেপাশে কি আছে, কি নেই সে খেয়ালিই করেনি কখনো। কিন্তু তার মত এত পড়াকু ছেলেও সেদিন কাউকে দেখে থমকে গিয়েছিলো।
নব্য প্রেমে পড়া এক চঞ্চল কিশোর তখন।
সেই মোহময় মূহুর্ত্বে আশেপাশের সব কিছুই তার কাছে স্বপ্নময় রঙিন জগতের মতই লাগছিলো। তার আকাশে হাজারো রঙিল প্রজাপতির মেলা। অজান্তেই সে ঐ মোহময়ী মানবীর প্রেমে পড়েছিলো। হারিয়ে ছিল বইয়ের পাতায় গুজে থাকা অক্লিষ্ট পরিশ্রমী তার বোধশক্তিটাকে।
তার দিন কাটছিলো বেশ সেই মোহময়ী মানবীর সাথে। কথার ছলে বন্ধুত্ব, বন্ধুত্ব থেকে প্রণয়। তারপর সেই মানবীর অসাধারণ এক ধোঁকা। সৌরভ আনমনে হেসে উঠে সেই সব কথা ভেবে।
কতই বোকা না ছিলো সে!
____________
ফেণী কলেজের ফটকের সম্মুখে রাস্তার অন্যপ্রান্তে প্রকান্ড পুরনো কড়ই গাছের নিচে অর্ধাবৃত প্লাস্টিকে ঘেরা চটপটি ফুচকার স্টল। পাশাপাশি চটপটি ফুচকার অনেকগুলো স্টল এখানে। কলেজ স্টুডেন্ট আর সাধারণ জনগণ সবাই এখানে এসে ফুচকা খায় বেশ মজা করে। ফেণী শহরে এই দিঘির পাড়ের ফুচকা সবচেয়ে জনপ্রিয়।
প্রিয়ার বন্ধুরাসহ দিঘির পাড়ে এসেছে ফুচকা খাওয়ার জন্য। প্রিয়া, নীল, শ্রাবণ, রাঢ়ী, লুবনাসহ সবাই এক সাথে বেঞ্চে বসেছে। নীল, শ্রাবণ, রাঢ়ী ফুচকার জন্য আর প্রিয়া, লুবনা চটপটির জন্য অর্ডার করেছে। পাঁচজনেই গল্পের মাঝেই মশগুল। একে অপরকে বেশ টিপ্পনী করে কথা বলছে।
তাদের কথার মাঝেই চটপটি আর ফুসকা এসে হাজির হয়। সবাই খাওয়াই মনোযোগী কিন্তু প্রিয়ার চোখ পড়ে কিঞ্চিৎ দূরে থাকা এক মানব অবয়বের দিকে।
এলোমেলো চুল আর গাম্ভীর্যপূর্ণ মুখস্রীতে হতাশার এক ছাপ। সকালের সেই পরিপাটি সুদর্শন শ্যামবর্ণা পুরুষটিকে এখন কেমন বিবর্ণ লাগছে। প্রিয়ার খুব ইচ্ছে করছে লোকটিকে জিজ্ঞেস করতে আহারে সার্কাস তোমাকে এমন জোকারের মত কেনো লাগছে। পাবলিক টয়লেট ভেবে কি সবাই আপনাকে,,,, আনমনে ভাবতেই জোরে ফিক করে হেসে দেয় প্রিয়া।
বাকী চার জোড়া চক্ষু ওর দিকে তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে তাকায়।
লুবনা আচমকাই বলেন উঠলো কি ব্যাপার প্রিয়া তুই কি দিবা স্বপ্ন দেখছিস?
রাঢ়ীর সন্দিগ্ধ নজর। সে আশেপাশে চোখ বুলালো। যা বুঝার সে বুঝে গেছে। প্রিয়ার কানের কাছে গিয়ে ধীর কন্ঠে বলে উঠল,
চোখে চোখে এত কথা মুখে কেনো বলনা,
বলনা’ কেনো করো এত ছলনা?
বলনা, বলনা, বলনা?
প্রিয়া কটমট চাউনিতে তাকালো রাঢ়ীর দিকে।
বিড়বিড় করে বললো চুপ কর।
রাঢ়ী বাকা হাসলো প্রিয়ার দিকে তাকিয়ে। তারপর হাত উঁচিয়ে সৌরভকে চেঁচিয়ে বললো এখানে আসুন ভাইয়া।
প্রিয়া যারপরনাই বিস্মিত হলো রাঢ়ীর এহেন কান্ডে। বাকীরাও কৌতুহলী দৃষ্টিতে তাকালো রাঢ়ীর দিকে। কিন্তু ওর এসব নিয়ে কোনো ভাবাবেগ নাই যা করার সে করবেই।
সৌরভ খুব বিষন্ন উদাসীন হয়ে বসে ছিলো। মনের কোণে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দুঃসহ স্মৃতিগুলো এতক্ষণ তাকে পীড়া দিচ্ছিলো। তাই রাঢ়ীর ডাকে সাড়া না দিয়ে পারলো না। সেও হাসি মুখে প্রিয়াদের সম্মুখে এসে দাঁড়ালো।
রাঢ়ী তাকে বসতে বললো। সৌরভ খুঁজে খুঁজে প্রিয়ার টেবিলটাই বেছে নিলো। প্রিয়ার এক পাশে লুবনা ছিল অন্য পাশে নীল। সৌরভ চোখের ইশারায় নীলকে সরতে বললো।
নীল বেচারা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলো। এভাবে তাকে ভরা মজলিস থেকে উঠিয়ে দিলো। মনে মনে প্রিয়াকে একশ একটা গা*লি দিলো। স্বীকার করবে না আমাদের কাছে সৌরভের সাথে সম্পর্কের কথা। অথচ দুইজনের কি প্রেম ভালোবাসা। জিজ্ঞেস করলে তখন চেতে চাই। শুধুমাত্র বন্ধুত্বের খাতিরে ওরে মাফ করতিছি। নয়তো ওরে কোনোদিনও মাফ করতাম না।
নীল তার জায়গা ছেড়ে দিয়ে শ্রাবণের গা ঘেঁষে বসে। শ্রাবণ কপাল কুঁচকে বলল গা ঘেঁষবি না। নীল সন্দিহান দৃষ্টিতে বললো কেনো গা ঘেঁষলে কি তোর গায়ে ফো*স্কা পড়বে?
শ্রাবণ রক্তিম চোখে তাকালো নীলের দিকে। কটমট করে বললো যা সর বা** আত্তে(আমার) কুতকুতি(কাতুকুতু) লাগের।
নীল আচমকাই হো হো করে অট্টহাসিতে ফে*টে পড়লো।
বাকিরা বিস্মিত নয়নে তার দিকে তাকিয়ে আছে।
সৌরভ গলা খাকারি দিলো। কি ব্যাপার এত হাসি কেনো পাচ্ছে তোমার?
নীল চুপ হয়ে গেলো। আমতা আমতা করে বললো আসলে শ্রাবণের না’কি,,,,,,, বাকীটা বলার আগে শ্রাবণ তার মুখ চে*পে ধরলো। কি সর্বনাশটা না করতে যাচ্ছিলো নীল। শ্রাবণ তপ্ত নিশ্বাস ছেড়ে বলে আরে ভাই হেতের মাথায় চিট আছে। হিল্লাই হেতে এইচ্ছা করের।
প্রিয়ার এখনো চোয়াল শক্ত হয়ে আছে। সে বুঝে পায় না এই সার্কাস-জোকার তার সাথে বসার মতলবটা কি?
লুবনা মিট মিট করে হাসছে আর আড়চোখ সৌরভকে দেখছে। তার তো সৌরভকেই অনেক আগে থেকে পছন্দ। তাকে দেখার জন্যই সে তার কোচিং-এ পড়ে। তবে এত কাছে থেকে তাকে দেখা হয় না। সেখানে সে গম্ভীর, রগচটা টীচার হিসেবে থাকে। অথচ এই লোকটা এখানে কত প্রানবন্ত। কি দারুণ তার হাস্যোজ্জ্বল মুখশ্রী!
রাঢ়ীর মুখে তৃপ্তির হাসি। সে যা ভাবছে তা যেনো সত্যি হয়।
খাওয়ার মাঝে এক অচেনা মানবী তাদের সম্মুখে এসে দাঁড়ালো। সে প্রথমে গলা খাকারি দিলো সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য।
সবাই বিস্মিত হয়ে তাকালো। কিন্তু সৌরভের দায়সারা ভাব। সে আপনমনে ফুচকা গিলছে।
মেয়েটি এবার সৌরভের উদ্দেশ্য বললো কি ব্যাপার সৌরভ কথা বলছো না কেনো?
সৌরভ এবার নড়েচড়ে বসলো। মাত্রই দেখার ভঙ্গিতে বলল আরে পিউ তুমি? কখন এলে? আমি তো ফুচকাই এতো মজেছিলাম তোমাকে দেখতে পায়নি। সরিইই!
পিউ বিড়বিড় করলো তুমি কখনোই আমাকে দেখনি, না আগে আর না এখন।
প্রিয়ার কৌতূহলী দৃষ্টি। মেয়েটাকে সে ভালো করেই পরখ করলো। কাঁচা হলদেটে গায়ের রঙে বাদামী বর্ণের গ্রাউন পরিহিত। লালরঙা ঠোঁটের সাথে মুখশ্রীতে কৃত্রিম প্রলেপ দেয়া। বিয়ের অনুষ্ঠান ছেড়ে এসেছে বোধহয়। তাই তো ভারী পোশাকের সাথে ভারী প্রসাধনীতে সজ্জিত। কিন্তু মেয়েটিকে দেখে সে বেশ অবাক হয়েছে।
লাজুক হাসিতে সৌরভের পাশে বসলো। সৌরভের দিকে তাকিয়ে বললো আমার ফুচকা কই?
সৌরভ নতুন করে অর্ডার দিলো৷ পিউকে বললো তুমি অলওয়েজ লেইট। তুমি আসতে আসতে আমরা খাবার শেষ করে ফেলেছি।
পিউ গম্ভীরমুখে বসে আছে। ভীষণ অস্বস্তি হচ্ছে তার। সে সৌরভকে একাকি দেখা করতে বলেছে। কিন্তু সে তো পুরো ব্যাটালিয়ন নিয়ে বসে আছে। মুখে মেকি হাসি দিলো। সৌরভকে জিজ্ঞেস করল এরা কারা?
সৌরভ সবার পরিচয় দিলো শুধু প্রিয়ার পরিচয়ের সময় বললো ওর পরিচয় দেয়া যাবে না।
পিউ থ’ হয়ে গেলো সৌরভের দায়সারা ভাব দেখে। কৌতূহলী হয়ে বললো কেনো?
সৌরভ সোজাসাপটা বললো কারণ তার অনেকগুলো পরিচয় আছে কোনটা দেবো?
পিউ চরম বিরক্ত হলো কিন্তু মুখে প্রকাশ করলো না। পুনরায় মেকি হাসি দিয়ে বললো সব পরিচয়ই দাও। আমরাও শুনি প্রিয়া তোমার কি হয়?
সৌরভ হাতেল আঙুলে গণনা করতে করতে বললো প্রথমত প্রিয়া আমার বাবার বন্ধুর মেয়ে। দ্বিতীয়ত আমাদের ভাড়াটিয়া। তৃতীয়ত আমার স্টুডেন্ট তাকে আমি টিউশন করায়। চতুর্থত সে আমার,,, বলে প্রিয়ার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হাসি দিলো। পিউকেও একবার আড়চোখে দেখলো।
প্রিয়াসহ তার বন্ধুরাও অধীর আগ্রহ নিয়ে বসে আছে সৌরভ কি বলবে।
সৌরভের দৃষ্টি সম্পূর্ণ প্রিয়াতে নিবদ্ধ। আচমকাই বলে উঠল প্রিয়া আমার উডবি ওয়াইফ।
সৌরভের এহেন বাক্য শুনে প্রিয়ার চক্ষু ছানাবড়া। কটমট চাউনিতে কিছু বলতে যাবে তার আগেই সৌরভ তার মুখে পুরো একটা ফুচকা ঢুকিয়ে দিলো। প্রিয়া বেকুবের মত হা’ হয়ে আছে।
উপস্থিত বাকিরাও মুখে হাত দিয়ে বসে আছে। মুখে কোনো রা’ নেই।
পিউ নিজমনে আক্রোশে ফে*টে পড়ছে। সৌরভ এত হেয়ালিপনা কবে শিখলো। আগে পড়ালেখা ছাড়া কোনো কথায় বলতো না। ছেলে হয়েও সে ল*জ্জায় কুঁকড়ে যেতো। রোমান্টিকের ক’ও না জানা ব্যক্তি এত রোমান্টিক কখন হলো সে। কিন্তু এই সৌরভকে সে চিনে না। বড্ড অচেনা লাগছে পিউর কাছে।
সবাইকে চমকে দিয়ে সৌরভ প্রিয়াকে নিয়ে উঠে গেলো। সবাইকে বিদায় জানিয়ে তার বাইকের পিছনে প্রিয়াকে বসালো। মূহুর্তে হাওয়া হয়ে গেলো দু’জন।
পিছনে রেখে গেছে একজোড়া রক্তিম চোখ আর চার জোড়া কৌতুহলী দৃষ্টি।
চলবে,,,,,,,,,,
তো আপনারাই বলেন এই সৌরভের মতলবটা কি? আমি কিন্তু কিছুই জানি না!