শাওয়াম পর্ব -২৩+২৪

#শাওয়াম
পর্ব ২৩
Suvhan Arag

শাওয়াম মূর্তির ন্যায় বসে আছে। কাঁদতে কাঁদতে এক সময় নিজেই চুপ হয়ে যায় শাওয়াম। ফাইরাজ তাকে থামানোর চেষ্টা করেনি। কাদলে কষ্টগুলো নাকি হালকা হয়। তবে তাই হোক। বেশ কিছু সময় অতিক্রান্ত হয়ে গেল। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হতে যাচ্ছে। দীর্ঘ সময় ধরে শাওয়ামের নিস্তব্ধতা, কাদোকাদো চেহারা ফাইরাজের একটুও ভালো লাগছে না। দীর্ঘ সময় পর ফাইরাজই কথোপকথন শুরু করলো,

“দেখো শাওয়াম, তোমার পুরো ডায়েরি আমি পড়েছি। তোমাকে অনেকটাই কাছ থেকে আমি দেখেছি। তুমি আজীবন ভুল মানুষকেই বিশ্বাস করেছো। সায়েমের ভাবসাব আমার কখনো মনঃপূত হতোনা। তুমি তো যতবার তোমাদের ঝগড়া হয় সেটা ও আমাকে বলতে। তোমার ঐ কালো মলাটের ডায়েরিটার অর্ধেক জুড়ে আছে ভুল মানুষকে বিশ্বাস করার গল্প আর বাকি অর্ধেক জুড়ে ভুল মানুষকে ভালোবাসার গল্প। আমি জানি সায়েমের সামনে তোমাকে ছোট করেছি একটা বড় মিথ্যা কথা বলে। আসলে কি বলোতো আমার না তোমায় নিয়ে ভীষণ চিন্তা হয়। তুমি আমাকে ভালোবাসো না, তোমাকে পাওয়ার জন্য এত কিছু করছি এটা যদি ভেবে থাকো তুমি ভুল একদম ভুল। আমি চাইনা আমার ভালোবাসার মানুষটাকে কোন খারাপ মানুষের হাতে তুলে দিতে। একটা ছেলে আরেকটা ছেলের সম্বন্ধে সবচেয়ে বেশি ভালো বুঝতে পারে। এজন্য আমি সায়েমকে কল করেছিলাম এটা পরীক্ষা করার জন্য আসলে সায়েমের চোখে তোমার স্থান কতটুকু উঁচু বা নিচু। আরে যে তোমাকে বিশ্বাসই করেনা সে তোমাকে কি ভালোবাসে বলোতো? একটা ছেলে ফোন করে তার গার্ল ফ্রেন্ডের নামে কিছু বললো আর সে বিশ্বাস করে নিল! ওহ মোস্ট ইম্পরট্যান্ট পয়েন্ট ও তো তোমাকে গার্ল ফ্রেন্ড হিসেবেও সম্বোধন করলো না তোমাকে এলাকার লোক বলে চালিয়ে দিল। হাউউউ সুইট! আর বাদ বাকি কথা না হয় নাই বললাম। তোমার জীবন তোমার সিদ্ধান্ত। তবে একটা কথা মাথায় ঢুকিয়ে নেও শাওয়াম তুমি আজ থেকে সায়েমের নামটাই চিরকালের মতো ভুলে যাবে আর যদি তা না করো তোমার কি হাল করি আমি দেখে নিও। আমাকে তোমার ভালো না বাসলেও চলবে, আমার সাথে যোগাযোগ না রাখলেও চলবে। তবু আমি বেচে থাকতে ঐ জানোয়ারের ছায়াও তোমার জীবনে আসতে দেব না। এর চেয়ে কোন ভালো ছেলে দেখ পছন্দ হলে বলো আমি তোমার সেটিং করিয়ে দেব। কিন্তু ঐ জানোয়ারের সাথে ইমপসিবল যাস্ট ইমপসিবল।”

“ধন্যবাদ।”

শাওয়াম নিচু স্বরে বলল।

“কেন?”

“আসলেই আমি সায়েমকে আজ অবধি চিনতে পারিনি। আপনি হয়তো আমার জীবনটা বাঁচিয়ে দিলেন।”

“তোমার ডায়েরিটা ঠিক আছে কিনা ব্যাগ খুলে দেখলে না?”

ফাইরাজের কথা শুনে শাওয়াম ভ্রু জোড়া কুঁচকে তাকালো। সেই তো তার ই ঘুটঘুটে কালো রঙের ডায়েরি। সেটাকে আবার দেখার কি আছে? তবু ফাইরাজের কথা শুনে শাওয়ামের কেমন যেন সন্দেহ হলো। শাওয়াম শপিং ব্যাগ থেকে ডায়েরিটা বের করলো। শপিং ব্যাগ থেকে ডায়েরিটা বের করতেই শাওয়ামের চক্ষু চড়কগাছ। এখানে ডায়েরি আছে ঠিকই কিন্তু একটা নতুন চকচকে সাদা মলাটের ডায়েরি।

“আমার ডায়েরি কোথায়? এটা তো আমার ডায়েরি না।”

“হুম জানিতো। তোমার ডায়েরিটা এখন ডাস্টবিনে ছাই হয়ে বসে বসে আবর্জনা গিলছে।”

“মানে টা কি? আপনি আমার ডায়েরি পুড়িয়ে ফেলেছেন?”

“তা আর বলতে? এখন দেখি কালো ডায়েরির সাথে সাথে কালো অতীতটাকেও ভুলে যাও তো। সাদা মলাটের ডায়েরির সাথে শুরু করো নিজের আলোয় মোড়ানো নতুন জীবন, সাদা মানেই শুভ্রতা জানোনা?”

ফাইরাজের কথা শুনে শাওয়াম কোন প্রতিক্রিয়া করলো না। কেবল ডায়েরিটা হাতে নিয়ে অন্যমনস্ক হয়ে বসে আছে।

“শাওয়াম দেখেছো সন্ধ্যা নেমে পড়লো। একটা গান শুনবে শাওয়াম। আমার খুব প্রিয় একটা গান, এই গানটা শুনলে তোমার কথাই বেশি মনে পড়ে।”

শাওয়াম অন্যমনস্ক হয়েই জবাব দিল,

“আমি না বললেও আপনি গাইবেন। আপনি তো একটা তারছিড়া নাছোড়বান্দা।”

শাওয়ামের কথা শুনে ফাইরাজ অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো। তার পর গুনগুন করতে করতে শুরু করলো তাহসানের অনেক খ্যাত একটি গান,

“তুমি আর তুমি আর তো কারো নও শুধু আমার
যত দূরে সরে যাও রবে আমার

স্তব্ধ সময়টাকে ধরে রেখে,
স্মৃতির পাতায় শুধু
তুমি আমার

কেন আজ এত একা আমি ?
আলো হয়ে দূরে তুমি !

আলো-আলো আমি কখনো খুঁজে পাবনা
চাঁদের আলো তুমি কখনো আমার হবে না

আলো-আলো আমি কখনো খুঁজে পাবনা
চাঁদের আলো তুমি কখনো আমার হবে না, হবে না, হবে না, হবে না,,,,,,,,, কারো নও শুধু আমার
যত দূরে সরে যাও রবে আমার

স্তব্ধ সময়টাকে ধরে রেখে,
স্মৃতির পাতায় শুধু
তুমি আমার

কেন আজ এত একা আমি ?
আলো হয়ে দূরে তুমি !

আলো-আলো আমি কখনো খুঁজে পাবনা
চাঁদের আলো তুমি কখনো আমার হবে না

আলো-আলো আমি কখনো খুঁজে পাবনা
চাঁদের আলো তুমি কখনো আমার হবে না, হবে না, হবে না, হবে না,,,,,,,,,”
#শাওয়াম
পর্ব ২৪
Suvhan Arag

২৩

শাওয়াম আর ফাইরাজের গল্পের পরবর্তী অংশ নাতিদীর্ঘ। সেদিনের কার্জন হলের সামনে সায়েমের কথাগুলো শোনার পর শাওয়াম অনেক ভেঙে পড়েছিল। তবে তার বার বার এটা মনে হয়েছিল ফাইরাজ লোকটা হয়তো তার জন্য মন্দ নয়। কোন এক বিকেলে হাতিরঝিলের কাছে দাঁড়িয়ে শাওয়াম সরাসরি ফাইরাজকে বলে বসে,

“এতোই তো বলেন ভালোবাসেন। তাহলে বিয়ে করতে পারবেন আমাকে এত কিছু জানার পরেও? আজকেই এক্ষুণী।”

শাওয়ামের হুটহাট প্রস্তাব ফাইরাজের কাছে আকাশের চাঁদ হাতে পাওয়ার মতোই ছিল। তবু ফাইরাজ দ্বিধায় ছিল শাওয়াম হুজুগে পড়ে এমন সিদ্ধান্ত নিচ্ছে নাতো? তবে সেদিন আর কিছুই ঘটেনি রাত নামতেই দুজন দুজনের রাস্তায় ফিরে গেছিল। কিন্তু পরের দিনই ফাইরাজ নিজের কিছু বন্ধু বান্ধব আর শাওয়াম তার রুমমেটদের নিয়ে কাজী অফিসে উপস্থিত হয়েছিল। কবুল বলেই আবদ্ধ হয়ে গেছিল দুজনে।

তারপরেও ঘটনাটাও ঠিক বাংলা সিনেমার মতোই। শাওয়ামের মা বাবা মেনে নিতে পারেনি তাদের। হুট করে মা বাবাকে না জানিয়ে এত বড় সিদ্ধান্ত।এদিকে ফাইরাজের মা বিয়েতে একদম নারাজ। শাওয়াম ছিল আধুনিক ধাচের, চাল চলন সবদিক থেকে। এদিকে ফাইরাজের মা ছিলেন ধর্ম পালনের বিষয়ে কঠোর। তবে ফাইরাজের সাপোর্টে শুরুতে ভালোই চলছিল শাওয়ামের সংসার জীবন।

ফাইরাজের মায়ের একটাই কথা, “পড়াশোনা মেয়েদের জন্য না।” তিনি সব সময় শাওয়ামের পড়াশোনার বিরুদ্ধে। মায়ের বিরুদ্ধে গিয়ে ও ফাইরাজ শাওয়ামকে আবার মেডিকেল সেকেন্ড টাইম দেওয়ার জন্য সব রকম সহযোগিতা করে গেছে। মেডিকেল সেকেন্ড টাইম পরীক্ষা এলো। ভাগ্য এবার ও শাওয়ামের সঙ্গ দিল না। একটু পয়েন্টের জন্য শাওয়ামের ডাক্তারি পড়ার স্বপ্ন অপূর্ণই রয়ে গেল।

সবকিছুর মাঝেও শাওয়ামের জীবনে সুখপাখিটা চিরস্থায়ীভাবে খাঁচায় বন্দী হয়না। আসে আর যায়। শ্বশুরবাড়িতে শাশুড়ি তাকে একদম পছন্দ করেনা। তাকে স্পষ্ট করে বলে দিয়েছে ফাইরাজের ঘর ছাড়া এ বাড়ির কিছুই তার না সব তার শ্বাশুড়ির। শ্বাশুড়ির মন পাওয়ার জন্য শাওয়াম কম চেষ্টা করেনি। নিজের আধুনিকতার বেশ সেই কবেই ঝেড়ে ফেলেছে। সব কিছু নতুন ভাবে শুরু করেছে। তবু লাভ হয়নি। নিজের মেয়ের একটু মাথা ব্যথা হলে শ্বাশুড়ি সারাদিন বিশ্রাম নিতে বলেন কোন কাজ করতে দেননা। অথচ গায়ে জ্বর নিয়ে ঘুরলেও শাওয়াম বেচে আছে না মরে গেছে সেটা শোনার সময় বা প্রয়োজন কোনটাই তার নেই।

এর মাঝে শাওয়ামের জীবনে আরেক ঝড় আসে। মেডিকেল পরীক্ষার পর পরই শাওয়াম প্রেগন্যান্ট হয়ে পড়ে। শাওয়াম ভেবেছিল এবার তার একটা বন্ধু আসবে, ছোট্ট বাচ্চাটাই হবে এই বাড়িতে তার বন্ধু। সেটাও রইল না। দু মাস যেতে না যেতেই মিসক্যারেজ। ধীরে ধীরে শাওয়ামের জীবনটা যেন আরো দুর্বিষহ হতে লাগল।

সময় পরিবর্তনশীল। সময়ের সাথে সাথে মানুষ ও পরিবর্তনশীল। মানুষের জীবনের সবচেয়ে কঠিন সময় তখন আসে যখন প্রিয় মানুষটাও চোখের সামনে পরিবর্তন হতে থাকে। ফাইরাজের পরিবর্তন শাওয়ামকে আবার মনে করিয়ে দিল সে বোধ হয় আবার জীবনে ভুল করেছে।

চলবে———-

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here