শালিক পাখির অভিমান পর্ব -০৭

#শালিক_পাখির_অভিমান
#পর্ব_০৭
#অধির_রায়

আমি আর ইহান ভাইয়া রিক্সার জন্য দাঁড়িয়ে আছি৷ আজ আমি পৃথিবীর সবথেকে সুখী মানুষ। আমার স্বপ্ন পূরণ হতে চলছে৷ লেখাপড়া করার সুযোগ পাবো আমি কল্পনাও করতে পারিনি৷ দাঁড়িয়ে থেকে রিক্সা পেলাম না৷ আমাকে গেইটের সামনে দাঁড় করিয়ে ইহান ভাইয়া একটা রিক্সা নিয়ে আসেন। ইহান ভাইয়া রিক্সা থামিয়ে বলে উঠল,

“চলে আসো৷”

আমি রিক্সায় উঠার সাহস পাচ্ছি না৷ অজানা অচেনা ছেলের সাথে এক রিক্সায় কিভাবে যাব? স্কুল কতোদূর তাও জানিনা৷ কাছে হলে হেঁটে যেতাম৷ আমি ইহান ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে আছি৷ ইহান ভাইয়া পুনরায় বলল,

“কি হলো? এভাবে মূর্তির ন্যায় দাঁড়িয়ে আছো কেন? তুমি কি লেখাপড়া করতে চাওনা?”

আমি হাত কাচুমাচু করে বললাম,

“আমি আপনার পাশে বসলে অনেকে কথা শুনাবে৷ আমি পারব না আপনার পাশে বসতে৷ আপনি বরং অন্য আর একটা রিক্সা নিয়ে আসেন৷”

ইহান ভাইয়া মুচকি হেঁসে বলল,

“তুমি আমার পাশে বসলে আমার কোন সমস্যা নেই৷ কে কি বলবে সে নিয়ে আমার মাথা ব্যথা নেই। আমি একটা রিক্সাই পেয়েছি৷ বাড়তি গাড়ি থাকলে তোমাকে গাড়ি করেই নিয়ে যেতাম৷ গাড়ি শুধু অফিসে যাওয়া আসার কাছে ব্যবহার করে।”

এপাশ ওপাশ তাকিয়ে কিছুই দেখতে পেলাম না৷ রাস্তা পুরো ফাঁকা। ফাঁকা বলতে রিক্সা নেই৷ ইহান ভাইয়ের পাশে বসা ছাড়া কোন উপায় নেই৷ আমি মাথার ওড়না ঠিক করলাম৷ ওড়না দিয়ে নিজেকে পরিপাটি করে নিলাম৷ বিসমিল্লাহ বলে রিক্সাই উঠলাম৷ মা সব সময় বলতেন, ‘কোথাও যাওয়ার আগে, কোন ভালো কাজ করার আগে বিসমিল্লাহ বলতে হয়। বিসমিল্লাহতে অনেক বরকত।’
ইহান ভাইয়ের কাছ থেকে দূরত্ব রেখে বসেছি। ইহান ভাইয়া এতো ভদ্র কবে থেকে হলো? আমাকে দেখলেই তিনি তেলেবেগুনে জ্বলে উঠতেন৷ সেদিন উনার ফ্লোরে একটু পানি ফেলছিলাম৷ আমার ওড়না দিয়ে সে পানি পরিষ্কার করিয়েছে৷ আমি ঘর মুছতে নিলে জুতা নিয়ে সামনে ঘুরঘুর করতো৷ আমাকে এক কাজ বারবার করানোই তার স্বাভাব৷ শাস্তি হিসেবে আমাকে গান শুনাতে হতো৷ আমি গান না পারলেও তিনি এক লাইন বলে দিতেন সেটা শুনে আমাকে বলতে হতো৷ সেদিন হিন্দি গান বলতে পারিনি বলে আমাকে ত্রিশ বার কান ধরে ওঠবস করিয়েছে৷ উনিও যথেষ্ট দূরত্ব বজায় রেখে বসে আছেন৷ রাস্তায় আমাদের মাঝে কোন কথা হলো না৷ রিক্সা স্কুল গেইটের সামনে নামিয়ে দিল৷ বাড়ি থেকে দূরে নয় স্কুল৷ হেঁটে আসতে দশ মিনিটের মতো লাগবে৷ আমাকে লেখাপড়ার করার সুযোগ দিয়েছে এটাই বেশি৷ প্রতিদিন রিক্সা ভাড়া নিতে পারব না৷ তাই আসার সময় রাস্তা খেয়াল করে করে আসলাম৷”

স্কুলে প্রবেশ করতেই কিছু মেয়ে ইহান ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে আছে৷ ইহান ভাইয়া দেখতে এমনি অনেক সুন্দর। তার উপর কালো প্যান্ট, কালো শার্ট, কালো চশমা, কালো ঘড়ি৷ অনেক সুন্দর লাগছে৷ আমি ভাইয়ার পিছন পিছন অফিস রুমে গেলাম৷ ভাইয়া আমাকে ইশারা করে পাশের চেয়ারে বসে বলেন৷ আমার দিকে ফরম এগিয়ে দিল। কলম হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল,

“শালিক ফরম পূরণ করো৷”

আমি ফরম পূরণ করতে লাগলাম৷ আমার পুরো নাম শালিক আহমেদ লিখলাম৷ বাবার নাম সাদমান আহমেদ, মাতার নাম রিয়া আহমেদ লিখলাম৷ ঠিকানা কি দিব? বুঝতে পারছি না। ইহান ভাইয়াকে বললাম “ঠিকানা কি দিব?”

ইহান ভাইয়া ফরম নিয়ে ঠিকানা বসিয়ে দিলেন৷ আমাকে নবম শ্রেণিতে ভর্তি করানো হলো৷ দশম শ্রেণিতে ভর্তি করল না৷ সাইন্স অনেক কঠিন বলে আমাকে মানবিকে ভর্তি করল৷ ভর্তির পর আমি এক রিক্সায়, ইহান ভাইয়া অন্য রিক্সায়৷ আমাকে নিয়ে শপিং মলে গেলেন৷ আমাকে গাইট, খাতা, কলম, পেন্সিল, জ্যামিতি বক্স, ব্যাগ, সাথে কয়েকটা নতুন থ্রি পিচ। দুই সেট স্কুল ড্রেস বানাতেও দিলেন৷

সবকিছু নিয়ে বাড়িতে চলে আসলাম৷ আমি ফুপিকে জড়িয়ে ধরে কান্না করে দিলাম৷ ফুপি আমার কপালে ভালোবাসার পরশ একে দিল৷ মিষ্টি মধুর হাসি দিয়ে বলল,

“আমার শালিক অনেক বড় হবে৷ শালিক পাখির মতো তোর কথা শোনার জন্য সবাই অপেক্ষা করবে৷”

আমি কিছু বলতে যাব ঠিক তখনই শ্রুতি ভাবি আমাকে ডাক দিলেন৷ আমি দৌড়ে উনার রুমে গেলাম৷ আমার দিকে পা এগিয়ে দিয়ে বলল,

“তাকিয়ে কি দেখছিস? আমার পা ব্যথা করছে। পা টিপে দে৷ শুধু লেখাপড়া করলে হবে কাজ করতে হবে না৷”

শ্রুতি ভাবির কথা কেউ মেনে নেননি৷ শ্রুতি ভাবি চায়না আমি লেখাপড়া করি৷ মুখের উপর না করলে ন্যাকা কান্না শুরু করে আমার নামে হাজারটা মিথ্যা কথা বলবে৷ সাথে থা*প্প*ড় ফ্রী। আমি বাধ্য মেয়ের মতো পায়ের কাছে বসে পা টিপে দিতে লাগলাম৷ উনার মুখে শয়তানির হাসি৷ দেখে মনে হচ্ছে বিশ্ব জয় করে ফিরেছেন৷ বিশ মিনিট হয়ে যাচ্ছে তবুও থামার কোন নামগন্ধ নেই৷ তিনি এক ধ্যানে মোবাইল টিপে যাচ্ছেন৷ আমি এবার জোরে চাপ দিতে লাগলাম৷ তিনি চিৎকার করে আমাকে লা*থি দিলেন৷ রাগী গলায় বলল,

“তুই আমাকে মেরে ফেলতে চাস! আমার পা ভেঙে ফেলবি নাকি৷”

আমি ফ্লোর থেকে উঠে বললাম,

“ভাবি আজ আপনাকে ক্ষমা করে দিলাম৷ আমাকে গ্রামের মেয়ে ভেবে সব সময় লা’থি, থা*প্প*ড় দেওয়ার চেষ্টা করবেন না৷ এরপর আমার সাথে এমন ব্যবহার করলে আপনার হাত পা দু’টোই ভে*ঙে দিব৷”

আমার কথা শুনে আরও রেগে যান৷ আমার গায়ে থা*প্প*ড় মা*রা*র জন্য হাত তুলতেই আমি হাত ধরে ফেলি৷ চোখ পাকিয়ে বললাম,

“আর নয়৷ আমি কালো বলে আমাকে সহ্য করতে পারেন না৷ সাদা চামড়ার দাম বেশি আপনার কাছে৷ আপনি এতো শিক্ষিত হওয়া সত্ত্বেও মূর্খের মতো ব্যবহার করেন৷ আমি এতো বছর মুখ ঘুরিয়ে সব দোষ মাথা পেতে নিয়েছি৷ শুনেননি ক্ষুধার্ত বিলাই সিংহের ন্যায় আচরণ করে৷ আমি কেন নিজের প্রতি অন্যায় মেনে নিব? আপনাদের বাড়িতে কাজের লোক হয়ে আসছি বলে সব মেনে নিতে হবে! আর কখনো আমি অন্যায় মেনে নিব না৷”

আমি কথাগুলো একাধারে বলে চলে আসলাম৷ শ্রুতি ভাবি কখনও আমাকে ভালোবাসার দৃষ্টিতে দেখেন না৷ আমাকে দিয়ে যত পারেন কাজ করিয়ে নেন৷ আমার কথাতে শ্রুতি ভাবি আরও রেগে যান৷ রাগ করে বলল,

“তোর এই বাড়িতে থাকা অসম্ভব হয়ে পড়ল৷ আমি তোকে এই বাড়ি থেকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দিব৷ তোকে দিয়ে সারাদিন পা টিপাতে না পারলে আমার নাম শ্রুতি নয়৷”

চোখে আগুন মনে ভয় কাজ করছে৷ আমাকে এই বাড়ি থেকে বের করে দিলে কই থাকব? এই বাড়ির সবাই ভালো৷ শুধু শ্রুতি ভাবি আর ইহান ভাইয়া আমাকে দিয়ে সারাদিন কাজ করান৷ মায়া ফুপি নিজেই সব রান্না করেন৷ আমাকে তেমন রান্না করতে হয়না৷ ইমন ভাইয়ার নজর খুব খারাপ। আমার দিকে বাজে দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন৷ আমি ইমন ভাইয়ার কাছ থেকে দূরে দূরে থাকি৷

রাতের খাবার খেয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম৷ বাবা মায়ের সাথে কবে থেকে কথা হয়না৷ তাদেরকে কবে থেকে দেখিনা৷ আমার কথা মনে পড়ে কি তাদের? চিন্তা করতে করতে ঘুমিয়ে গিলাম৷ প্রতিদিনের মতো সকালে উঠে সালাত আদায় করা, কুরআন তেলওয়াত করা আমার অভ্যাস হয়ে গেছে৷ এখন তো মায়া ফুপিও আমার সাথে প্রতিদিন সালাত আদায় করেন৷ তিনিও প্রতিদিন পাঁচ ওয়াক্ত সালাত আদায় করেন৷ সকালে সবার সাথে আমিও খেয়ে নিলাম৷ আমি খেতে চাইনি। আফসানা চৌধুরী মানে ম্যাডাম জোর করেছে তাই তাদের সাথে খেয়ে নিলাম৷ ব্যাগ গুছিয়ে স্কুলে চলে আসলাম৷ আমার শ্রেণিকক্ষ কোনটা জানি না৷ একজন মেয়ের কাছ থেকে ক্লাস রুমের কথা জানতে পারলাম৷ তিন তলায় আমাদের ক্লাস হয়৷ আমি সিঁড়ি বেয়ে উঠে গেলাম৷ স্যার এখনও আসেনি৷ আমি যেতেই সবাই হা করে তাকিয়ে আছে৷ দ্বিতীয় বেঞ্চ ফাঁকা পেয়ে সেখানে বসি। সবাই হাসাহাসি করছে আমাকে দেখে৷ একটা মেয়ে বলে উঠল,

“দেখ দেখ নিগ্রো আমাদের সাথে ক্লাস করতে এসেছে৷”

তাদের হাসি দেখে চোখে জল এসে পড়ল৷ কেউ কালো চামড়ার মূল্য দেয় না৷ দুইজন মেয়ে আমার সামনে এসে দাঁড়াল৷ হাসতে হাসতে বলল,

“নিগ্রো সবার পিছনে গিয়ে বস। তোর সাথে আমরা কেউ বসবো না৷ ভালোই ভালোই পিছনে চলে যা৷”

আমি রাগী চোখে তাদের দিকে তাকালম৷ পরক্ষণেই নিজের রাগ তাদের সামনে প্রকাশ করলাম না৷ তাদের কথায় আমি কেন রাগ করবো? যেখানে নিজের মা আমাকে মেয়ে বলে পরিচয় দেয়নি৷ বাবা মেয়ে বলে কোনদিন কাজে টেনে নেয়নি৷ নিজের পরিবার যেখানে আমাকে অস্বীকার করেছে তখন এদের কি দো*ষ? পরের ঘরের মেয়েদের চোখে ভালো হবো কিভাবে? মন খারাপ করে পিছনে বসলাম৷ আজ প্রথম দিন তাই তর্কে জড়ালাম না। একটা মেয়ে আমার পাশে বসল৷ দেখতে বেশ ফর্সা৷ আমি তার দিকে তাকালাম৷ কিন্তু তার মুখে অন্যদের মতো হাসি তামাশা নেই৷ সে বসতেই সামনের বসা একজন বলল,

“আশা তুই নিগ্রোর সাথে শেষে বসলি৷ তোর এসব কাজ আমাদের একদম পছন্দ নয়৷”

আশা নামের মেয়েটা মুচকি হেঁসে বলল,

“গায়ের রং দিয়ে বিচার করতে নেই৷ কাজী নজরুল ইসলামের কবিতা পড়েছি।” সেখানে লেখা ছিল,

❝সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নেই৷❞

আশার কথা শুনে সবাই এক তরফা হেঁসে নিল৷ কেউ কিছু বলল না৷ এখনই স্যার চলে আসবে৷ আশা মুচকি হেঁসে বলল,

” তোমার নাম কি?”

আমি ব্যাগ থেকে কলম বের করতে করতে বললাম,

“আমার নাম শালিক৷ তুমি আমার সাথে কেন বসলে? কারোর মনে কষ্ট দিতে নেই৷”

আশা আমার হাতের উপর হাত রেখে বলল,

“আমি কাউকে কষ্ট দেয়নি৷ আমি সবাইকে সমান চোখে দেখি৷ এই সেকশনে সব মেয়েই আমার কাছে সমান৷ তুমি যে স্কুল ড্রেস পড়ে আসোনি তোমাকে ক্লাস করতে দিবে না৷”

“আমি গতকাল ভর্তি হয়েছি৷ আমি এক সপ্তাহ ড্রেস না পড়ে ক্লাস করতে পারব৷ আমাকে পারমিশন দিয়েছে৷ আমিও ড্রেস বানাতে দিছি৷ ইহান ভাইয়াকে দর্জি ওয়ালাকে বলে দিয়েছে দুইদিন পরই দিবে৷”

“সমস্যা নেই৷ তোমার বাসা কোথায়?”

আমি আশার কথায় চুপ হয়ে গেলাম৷ আমি তো কিছুই চিনি না৷ আমাকে চুপ থাকতে দেখে বলল,

“তুমি ঢাকায় নতুন!”

আমি মাথা নাড়িয়ে জবাব দিলাম৷ আশা আর কিছু বলল না৷ স্যার এসে ক্লাস শুরু করে দিলেন৷ ক্লাস করে বুঝতে পারলাম আশা নামের মেয়েটা খুব ভালো। ছুটির পর আমার সাথে গেইট পর্যন্ত আসলো৷ সে অন্য রাস্তায় চলে গেল৷ আমাকে রিক্সা ভাড়ার টাকা দিয়েছেন৷ আমি আসার সময় হেঁটেই আসছি৷ কাছেই বাড়ি এতোটুকু রাস্তা বিশ টাকা রিক্সা ভাড়া৷ গ্রামে থাকতে কতো হাঁটছি। হেঁটেই বাড়িতে চলে আসলাম৷ কলিং বেল বাজাতে শ্রুতি ভাবি দরজা খুলে। আশেপাশে তাকিয়ে কাউকে দেখতে না পেয়ে আমাকে ধাক্কা দিয়ে ফ্লোরে ফেলে দেন। নিজেও ইচ্ছা করে ফ্লোরে বসে পড়ে ন্যাকা কান্না করে। চিৎকার করে রাগী স্বরে বলল,

“এই মেয়ে চোখ হাতে নিয়ে ঘুরিস৷ দেখতে পারিস না৷ আমার কোমর ভেঙে দিলি৷”

শ্রুতি ভাবির চিৎকারে আফসানা চৌধুরী, মায়া ফুপি দৌড়ে আসেন। আমি নিজে থেকে উঠে দাঁড়ালাম৷ মায়া ফুপি শ্রুতি ভাবির হাত ধরে তুললেন৷ শ্রুতি ভাবি ন্যাকামি করে বলল,

“মা শালিক আমাকে একদম সহ্য করতে পারে না৷ আমি দরজা খুলে দিছি বলে আমাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিছে৷ আমাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে নিজে অভিনয় করছে৷”

ম্যাডাম গম্ভীর কন্ঠে বলল,

“মায়া শ্রুতিকে তার রুমে দিয়ে আসো৷ শালিক ব্যাগ রেখে আমার রুমে আসো৷”

চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here