শালিক পাখির অভিমান পর্ব -০৮

#শালিক_পাখির_অভিমান
#পর্ব_০৮
#অধির_রায়

ভয়ে হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসছে৷ আফসানা চৌধুরীর চোখের দিকে তাকানোর সাহস পাচ্ছি না৷ গম্ভীর হয়ে বসে আসেন৷ শ্রুতি ভাবী সবার চোখ ফাঁকি দিতে পারলেও আল্লাহর চোখ ফাঁকি দিতে পারবে না৷ আল্লাহ দেখেছে, ‘আমি শ্রুতি ভাবিকে ফেলে দেয়নি৷’ আমি কোন অন্যায় কাজ করিনি৷ আমি পুষ্প হয়ে সুবাস ছড়ানোর আগেই কি ঝড়ে পড়ব? আমি মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছি৷ আফসানা চৌধুরী গম্ভীর গলায় বলল,

“তুমি শ্রুতিকে ধাক্কা দিয়েছো কেন? তুমি কি শ্রুতিকে সহ্য করতে পারো না?”

আমি কি বলব? ম্যাডাম আমার কথা বিশ্বাস করবে কি? আমি তো শ্রুতি ভাবিকে ফেলে দেয়নি৷ আমি আমতা আমতা করে বললাম,

“ম্যাডাম আমি সত্যি কথা বলছি৷ আমি শ্রুতি ভাবীকে ফেলে দেয়নি৷ শ্রুতি ভাবী তো…।”

আমার পুরো কথা শুনলেন না৷ আমাকে থামিয়ে দেন৷ বড়লোক মানুষ গরিবের কথার মর্যাদা দিতে পারেন না৷ আমাদের কথা শোনার মতো সময় নেই তাদের৷ ভারী গলায় বলল,

“আমি আজ সকালে খেয়াল করছি তুমি শ্রুতির রুমে কফি নিয়ে যেতে চাওনি৷ শ্রুতির সাথে তোমার এতো কিসের শত্রুতা?”

শ্রুতি ভাবী সকাল বেলা আমাকে তাদের রুমে যেতে মানা করেছেন৷ আমি কিভাবে বলব ম্যাডামকে? চোখের দিকে তাকানোর সাহস হচ্ছে না৷ রক্তিম চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন৷ আমার ভয় হচ্ছে আমাকে বিনা কারণে ভুল বুঝছেন৷ পৃথিবীতে সবাই আমাকেই কেন ভুল বুঝে? আমার উপর কেন সবার এতো ক্ষোভ? আল্লাহ আপনি আমার উপর সহায় হোন৷ আপনি ছাড়া আমাকে কেউ বুঝতে পারবে না৷ আমাকে সোজা হয়ে দাঁড়াতে দেখে পুনরায় প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল আমার দিকে। তবুও কোন প্রশ্নের জবাব দিচ্ছি না৷ ওষুধের বক্স থেকে কি যেন নিল? আমাকে কি ইনজেকশন দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে বিক্রি করে দিবে নাকি! আমি জানি যারা বড়লোক হয় তারা অসহায় মেয়েদেরকে বাহিরের দেশে বিক্রি করে৷ আমি আর কোনদিন মা বাবার মুখ দেখতে পারব না৷ শাকিলাকে জড়িয়ে ধরতে পারব না৷ ভাবতেই চোখের কোণে অশ্রু চলে আসল৷ বুকের মাঝে সূক্ষ্ম ব্যথা শুরু হলো। আমার চারদিকে ঘুরে ঘরে বলল,

“সামনে হাত বাড়াও৷”

আমি হাত কাচুমাচু করছি৷ হাত বাড়ানোর সাহস হচ্ছে না৷ দরজার দিকে তাকালাম ফুপি দাঁড়িয়ে শাড়ির আঁচলে চোখের জল মুছে যাচ্ছে। আমি ভয়ে ভয়ে নিজের হাত সামনের দিকে এগিয়ে দিলাম৷ খিঁচে চোখ বন্ধ করে আছি৷ আমার হাতে একটা মলম দেন৷ মিষ্টি মধুর স্বরে বলল,

“যেখানে ব্যথা পেয়েছো সেখানে মলম লাগিয়ে নাও৷ আমি সবটাই দেখেছি উপর থেকে৷ মিম পাতা যতই তিতা হোক পান করতে পারলে মধুর সন্ধান পাওয়া যায়৷ আমি চাই তুমি নিম পাতা অংশ পান করো। শ্রুতি একদিন তোমাকে নিজের বোনের জায়গা দিবে৷”

আমার শ্বাস বন্ধ হয়ে আসছিল৷ এই বুঝি এখনই মা*রা যাব৷ আমি ভাবতেই পারিনি ম্যাডাম আমার সাথে এমন করবেন৷ আমি ভাবছিলাম আমাকে বাসা থেকে বের করে দিবেন৷ না হয় বাহিরের দেশে প্রচার করে দিবেন৷ চোখের পানি ধরে রাখতে পারলাম না৷ টু*প করে চোখ থেকে নোনা জল গড়িয়ে পড়ল।

ইহান ভাইয়ার কথামতো বই নিয়ে ইহান ভাইয়ার রুমে চলে গেলাম৷ একটা অ*স*ভ্য লোক ইহান ভাইয়া৷ চারিদিকে ঠান্ডা হাওয়া বইয়ে৷ ইহান ভাইয়ার রুম এসির জন্য আরও ঠান্ডা। তবুও অ*স’ভ্য লোকের মতো টু কোয়াটার পড়ে বসে আছেন৷ খালি গায়ে থাকতে লোকটার কি ভালো লাগে? একটা মেয়ের সামনে কিভাবে এভাবে খালি গায়ে থাকে? গ্রামে অনেক ছেলেকে খালি গায়ে দেখেছি কখন লজ্জা পাইনি৷ আজ কেন এতো লজ্জা লাগছে? লজ্জার মাথা খেয়ে বই নিয়ে ফ্লোরে বসতে নিলেই ইহান ভাইয়া বলল,

“টেবিলে দুইটা চেয়ার রাখা আছে৷ যেকোন একটা চেয়ারে বসতে পারো। আমি ফ্লোরে বসার অনুমতি দেয়নি৷”

আমি জানি, ইহান ভাইয়ার কথা অমান্য করলে আজ আমাকে শেষ করে দিবে৷ সেদিন শপিং মলে বলছিলাম এতোগুলো পোশাক আমি নিবো না৷ লোক সমাজের সামনেই হাত তুলতে নিছিল৷ ফর্সা মুখাটা লাল বর্ণের মতো হয়ে গেছিল। আমি চেয়ার টেনে বসলাম৷ অন্য চেয়ার টেনে ভাইয়া বসতেই ভাইয়ার পায়ের সাথে আমার পা লাগে৷ সারা দেহে কারেন্ট বয়ে যায়৷ তিনি সাথে সাথে পা সরিয়ে বলেন,

“সরি৷ আমি খেয়াল করিনি৷ পড়াগুলো বের করো৷ অনেকদিন থেকে পড়ার সাথে তোমার যোগাযোগ নেই৷ সেজন্য সবকিছু নতুন৷ তাই মন দিয়ে পড়তে হবে৷”

একে একে সব পড়া কমপ্লিট করে ভাইয়াকে দিলাম৷ চলে আসতে নিলে গম্ভীর কন্ঠে বলল,

“ম্যাথ বই বের করো! রেগুলার পড়ার পর এক অধ্যায় করে ম্যাথ করতে হবে৷”

আমার এখন কান্না আসছে৷ রাত প্রায় এগারোটা বাজে৷ আমি কখন যাব? ঘুমের জন্য বইয়ের পড়া দেখতে পারছি না। সকল পড়া ঝাপসা হয়ে আছে৷ আমি এখন কিভাবে ম্যাথ করব? বাধ্য মেয়ের মতো ম্যাথ বই বের করে কয়েকটা ম্যাথ করেই টেবিলে ঘুমিয়ে পড়লাম৷
ফজরের আজান কানে আসতে আমার ঘুম ভাঙে৷ ঘুম থেকে উঠে নিজেকে ফুপির পাশে আবিষ্কার করি৷ আমার ঠিক মনে আছে আমি ভাইয়ার ঘরে ছিলাম। আমি এ ঘরে কিভাবে আসলাম? আমি চারদিক মাথার পাশেই আমার বই রাখা আছে৷ আমাকে কি ইহান ভাইয়া এখানে রেখে গেছে৷ মনে হয় ঘুমের মাঝে এখানে এসেছি৷ ফুপিকে ডাক দিলাম৷ একসাথে সালাত আদায় করলাম৷ ফুপি কুরআন পড়তে পারত না৷ আমি রোজ সকালে ফুপিকে কুরআন পড়তে সাহায্য করি৷ এভাবে কেটে যাচ্ছে দিন। সেমিস্টার পরীক্ষায় ভালো রেজাল্ট করতে পেরেছি বলে বাড়িতে সবাই খুশি৷

শ্রুতি ভাবী নিজের বাবার বাড়িতে ঘুরতে গেছেন৷ আমি কফি নিয়ে ইমন ভাইয়ার রুমে গেলাম। টি টেবিলে কফি রেখে চলে আসতে নিলেই ইমন ভাইয়া পিছন থেকে আমাকে জড়িয়ে ধরেন৷ ঘটনা এতো দ্রুত ঘটে কিছুই বুঝতে পারিনি৷ চিৎকার করতে নিলেই মুখ চেপে ধরেন৷ নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করছি৷ কিন্তু ছাড়াতে পারছি না৷ ইমন ভাইয়া আমার কানে ফিসফিস করে বলল,

“বেশি বাড়াবাড়ি করলে আমি বাসার সবাইকে ডেকে বলব তুই আমার সাথে নোং*রা*মি করতে চাস৷ আমি কি বলি চুপচাপ শোন?”

আমি ইমন ভাইয়ার কথার কোন গুরুত্ব না দিয়ে নিজেকে সারানোর চেষ্টা করি৷ ইমন ভাইয়া আমাকে দেয়ালের সাথে চেপে ধরেন৷ আমার আমার ধম বন্ধ হয়ে আসছে৷ আমি নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করছি৷ ধা*ম*রা ছেলের সাথে পেরে উঠতে পারছি না৷ ইমন ভাইয়া এতো খারাপ আমি ভাবতেও পারিরি৷ বাড়িতে এতো সুন্দর বউ থাকতেও আমার দিকে নজর দিয়েছেন৷ ইমন ভাইয়াকে আমার স্বামীর মতো মনে হচ্ছে৷ আমাকে সব সময় এভাবে ভো*গ করত। চোখ পাকিয়ে বলল,

“শালিক পাখি তুই আমর সাথে রাত কাটাবি৷ কেউ কিছু জানবে না৷ আমি তোকে সোনা দিয়ে মোরে দিব৷ আমার চাহিদা তুই পূরণ করবি৷”

এসব বা*জে কথা আমার কাছে বি*ষের মতো শোনাচ্ছে৷ হাতের বাঁধন হলকা হতেই ইমন ভাইয়াকে ধাক্কা দিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে আসি৷ ইমন ভাইয়ার রুম থেকে দৌড়ে ইহান ভাইয়ার রুমে চলে যাই। ইহান ভাইয়া এখনও ঘুমাচ্ছেন৷ চোখ থেকে অনবরত অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে৷ কতোটা অ’স’ভ্য হলে মানুষ এমন কাজ হতে পারে৷ অঝোরে কান্না করতে থাকলাম৷ আজ মানুষ রুপি পশুর দেখা পেলাম৷ আমি উনাকে নিজের বড় ভাইয়ের মতো দেখি৷ উনি আমার সাথে এসব কি করে করলেন? ইহান ভাইয়ার ঘুম ভেঙে যেতে পারে৷ তাই নিজেকে শক্ত করে রুমে চলে আসলাম৷

রান্না ঘরের দিকে আর নজর দিলাম না৷ ফুপি একা একা সব রান্না করলেন৷ বার বার চোখের সামনে ভেসে উঠছে ইমন ভাইয়ার পশুর রুপ। কি করে করতে পারল আমার সাথে এমন কাজ? যারা পরকীয়া করে তাদের কাছে এসব কিছু কিছুই না৷ চোখের জল বাঁধ মানছে না৷ স্কুলে যাওয়া হলো না৷ ফুপিকে বলেছি ‘মাথা ব্যথা স্কুলে যেতে পারব না৷’ সারাদিন রুম থেকে বের হলাম না৷ খাবার গলা দিয়ে নামল না৷ রাতে ইহান ভাইয়ার কাছে পড়তেও গেলাম না৷ ইহান ভাইয়া নিজে থেকে আমার রুমে আসলেন৷ গম্ভীর গলায় বলল,

“শালিক আমার রুমে আয়৷ পড়তে হবে না৷ তোর সাথে আমার কিছু কথা আছে।”

আমি জবাবে বললাম,

“ভাইয়া আমার শরীর ভালো লাগছে না৷ আমি আজ যেতে পারব না৷ বেশি দরকার থাকলে এখানেই বলেন৷”

চোখ রাঙিয়ে বলল,

“আমি এক কথা দুইবার বলতে পছন্দ করিনা৷ ১ মিনিটের মাঝে তোমাকে আমার রুমে দেখতে চাই৷”

ইহান ভাইয়া হনহন করে চলে যান৷ না চাওয়া সত্ত্বেও আমি ধীর পায়ে ইহান ভাইয়ার রুমে যায়৷ আমি রুমে যাওয়ার পর ইহান ভাইয়া রুমের দরজা বন্ধ করে দেন৷ সাথে সাথে মনে পড়ে সকালের ঘটনা। ইহান ভাইয়া আমার সাথে কিছু করবে না তো৷ ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে গেলাম৷ গম্ভীর ভারী গলায় বলল,

“আজ সকালে কি হয়েছিল? তোর ঘাড়ে এভাবে খা*ম*চি কাটছে কে?”

ভাইয়ার চোখ দু’টো লাল৷ ভাইয়াকে এভাবে রাগ করতে কখন দেখিনি৷ আমার ঘাড়ে খা*ম*চির দাগ ভাইয়া কিভাবে দেখল? আমি তো মাথা থেকেই কখন ওড়না সরাই না৷ আমি মনে সাহস জুগিয়ে বললাম,

“জানি না ভাইয়া৷ রাতে ঘুম থেকে উঠে এমন দেখতে পাই৷ সেজন্য আমি আজ স্কুলে যায়নি৷ যদি কারোর নজর পড়ে সে ভয়ে৷”

“তোর চোখে মুখে ভয় দেখতে পাচ্ছি৷ সত্য করে বল, তুই ভয় পাচ্ছিস কেন?”

আমি চড়া গলায় বললাম,

“আমি ভয় পেতে কেন যাব? আমি কি করছি না করছি সেসব বিষয়ে আপনার জানা লাগবে কেন?”

আমায় কথায় ইহান ভাইয়া আরও রেগে যান৷ আমার হাত চেপে ধরে বলল,

“শালিক আমার থেকে তুই কিছুই লুকাতে পারবি না৷ তুই সত্য কথা বলবি? আর সত্য কথা কিভাবে আদায় করতে হয়? আমার ভালো করেই জানা আছে।”

ভাইয়া আমাকে কখনও তুই করে বলেন না৷ আজ কেন তুই করে বলছে? তার মানে ভাইয়া খুব রেগে আছেন আমার উপর৷ আমি ভয়ে ভয়ে মাথা নিচু করে বললাম,

“আপনি কখনও কপাট বন্ধ করেন না৷ আজ কপাট বন্ধ করাতে আমি কটু ভয় পেয়ে গেছিলাম৷ আমি সত্য বলছি৷ আমি কিছুই করিনি৷ আমার ঘাড়ে কখন খামচির দাগ আসল জানি না৷”

আমি কান্না করে ফেললাম৷ আমাকে কান্না করতে দেখে ভাইয়া বলল,

“ন্যাকামি করবি না আমার সামনে। তুই এখন যেতে পারিস৷ আমি তোর মুখ থেকে অন্য সময় সত্য কথা বের করব।”

আমি দ্রুত পায়ে চলে আসলাম। আমি ইমন ভাইয়ার রুম থেকে দৌড়ে বেরিয়ে আসার সময় ইমন ভাই আমাকে ধরতে চান৷ উনার হাত আমার ঘাড়ে পড়ে৷ আমি উনাকে উপেক্ষা করে চলে আসলে আমার জামার কিছু অংশ উনার হাতে রয়ে যায়৷ তখনই ঘাড়ে খা’ম’চি দেয়৷ সেটা দাগ হয়ে গেছে আমিই জানলাম না৷ ভাইয়া আমাকে ক্ষমা করে দিবেন। আমি সত্য কথা কখনও আপনাকে বলতে পারব না৷ আমি জানি, আপনি ইমন ভাইয়াকে অনেক শ্রদ্ধা করেন, ভালোবাসেন৷ আপনি কখনো আমার কথা বিশ্বাস করবেন না৷ আমি নিজেকে বাঁচানোর জন্যই সবকিছু আড়াল করে গেলাম৷ আপনাকে কথা দিচ্ছি, আমি ইমন ভাইয়াকে দীনের পথে নিয়ে আসব। ইমন ভাইয়া যেগুলো কাজ করে ইসলামের দৃষ্টিতে সব গুণা৷ ইসলামের পথে এসে নিজেকে সংশোধন করলে ক্ষমা করে দিব৷ নাহলে আমার অপমানের শাস্তি আমি সময় বুঝে দিব৷ বুঝিয়ে দিব মেয়েরা অবহেলার পাত্রী নয়৷ রুখে দাঁড়ালে সবকিছু করতে পারে৷ প্রতিটি মেয়েই পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ যোদ্ধা। মেয়ে জাতিই পারে নিজের সাথে যুদ্ধ করে সন্তান জন্ম দিতে৷ আর সে মেয়ের জাতির কাছে এসব তুল্য৷ আমি আগের শালিক নেই৷ নিজেকে তৈরি করছি ধীরে ধীরে৷

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here