শাহজাহান তন্ময়
৫.
_______
তন্ময় ছেলে হিসেবে দারুণ। তার বয়সী ছেলেরা এলাকায় মারধর করে বেড়ায়। মেয়েদের রাস্তাঘাটে টিজ করে। গার্লফ্রেন্ড নিয়ে ঘুরে কিংবা পড়াশোনায় ফাঁকিবাজি করে। খারাপ কাজে লিপ্ত হয় অথবা আজে-বাজে ছেলেদের সঙ্গে ওঠবস থাকে। রাতবিরেত বাড়ি ফেরে। এমনটাই তো আজকালকার ছেলেরা করে। মোস্তফা সাহেব নিউজপেপারে এগুলোই দেখেন। আবার নিজের প্রিয়তম বন্ধু রওশন প্রায়সময় বলেন,
‘আমার ছেলেগুলো কথাবার্তা শোনে না। পড়ালেখায় ভালো না। রাতবিরেত বাড়ি ফেরে। আমার কথার মূল্য দেয় না। মুখেমুখে তর্ক করে। লাগামছাড়া হয়ে গিয়েছে একপ্রকার। আর তোর ছেলেটাকে দেখ। মাশাআল্লাহ। সবদিক দিয়েই পারফেক্ট। আমি একটা খারাপ দিক দেখিনা জানিস। আজকাল এতো ভদ্র হয় ছেলেমানুষ? পাব্লিকে চান্স পেল। ফার্স্টক্লাস রেজাল্ট। কী ঠান্ডা মাথার ছেলে! দেখলেই আদুরে লাগে। এতো শান্তি লাগে আমার। সেদিন তন্ময়ের সাথে দেখা হলো নীলক্ষেত। বই কিনছে। গেলাম সামনে। সালাম দিয়ে প্রশ্ন করল কই যাচ্ছি। আমি বললাম বই নিতে এসছি কিছু। উপন্যাসের বই। ফ্রি টাইমে পড়ব। ও সুন্দর আমাকে ফার্স্টক্লাস ইংরেজি বাংলা অনুবাদিত উপন্যাস গুলো একেক দোকানে নিয়ে কিনে দিল। বইয়ের টাকা গুলো ওই দিল। আমি মজা করে বললাম, যেদিন টাকা ইনকাম করবে সেদিন আংকেলকে কিনে দিও। আজ আমি দেই। সে জবাবে বলল, এগুলো আমার টাকা। আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, তোমার টাকা কীভাবে? তুমিতো ইনকাম করছ না! তোর ছেলেটা বলল, টিউশনির টাকা। আমার ভাই-বোনদের আমি পড়াচ্ছি। বাবা-চাচ্চুরা আমাকে দারুণ ভাবে বেতন দেন। এই বিষয়টা আমার অনেক ভালো লাগল। এতো সুন্দর ভাবে ওকে কীভাবে বড়ো করলি বলতো? টিপস দে!’
মোস্তফা সাহেবের বুকটা ফুলে ওঠে তখন। গর্বে দাউদাউ করে জ্বলে রক্তের বিন্দু। ভীষণ ভাবে গর্ববোধ করেন ছেলেকে নিয়ে। তন্ময়কে কিছু শেখাতে হয়নি। ছেলেটা স্বেচ্ছায় ওমন। একটু গম্ভীর স্বভাবের তবে ভীষণ শান্ত। খুবই বুদ্ধিমান। অবশ্য রেগে গেলে অস্থির হয়। ঘরের জিনিসপত্র ভাঙে। তবে সেটা তার চোখে কখনোই বড়ো কোনো ইস্যু মনে হয়নি। এতগুলো ভালোর মধ্যে ওই অতটুকু খারাপ কোনো ব্যাপার না।
কিন্তু হঠাৎ করে সেই ছেলের জন্য বাড়িতে নালিশ এলে, ঠিক কী প্রতিক্রিয়া তার হওয়া প্রয়োজন বুঝে পেলেন না মোস্তফা সাহেব! তন্ময় মারধর করেছে। এলাকার ছেলেপেলে নিয়ে কোন লোককে নাকি পিটিয়েছে৷ ভিক্টিমের পরিবার হতে কোনোপ্রকার বিচার এখনো আসেনি বিধায় তিনি লিভিংরুম বসে। তার শান্ত ছেলেটা এতো বড়ো ধরনের কান্ড তো আর এভাবেই ঘটায়নি। নিশ্চয়ই কোনো কারণ রয়েছে। সেই কারণ জানার জন্যই তিনি বসে। অফিসে যাননি। ছেলে আসবে, কথা বলবেন তারপর অন্যকিছু।
______
তন্ময় এলো দুপুরে। মুখশ্রী থমথমে। টি-শার্ট নোংরা। জুতোয় ধুলাবালি। চুল উষ্কখুষ্ক। ক্লান্তি মুখমণ্ডল জুড়ে। লিভিংরুমে সকলেই উপস্থিত ছিল। তন্ময়কে দেখতেই জবেদা বেগম ছুটে গেলেন। ছটফট নয়নে ছেলেকে পর্যবেক্ষণ করছেন। মোস্তফা সাহেব গুরু গম্ভীর স্বরে বলেন, ‘আসতে দাও ওকে। কথা আছে।’
জবেদা বেগম না চাইতেও সরে দাঁড়ান। তন্ময় এগিয়ে যায় বাবার দিক। তার চাচারাও পাশাপাশিই বসে। মোস্তফা সাহেবের প্রশ্ন করতে হলো না। তন্ময় নিজেই সম্পূর্ণ বিষয় খুলে বলে।
লোকটার নাম রাজু। এখানকার নয়। হুট করেই তাদের এলাকায় আগমন। অল্পবয়সী মেয়েদের নজরে রাখছে। লোভ দেখিয়ে নিয়ে গিয়ে পাচার করার ধান্দায়। ইতোমধ্যে দু-তিনটে বাচ্চা মেয়েকে কিডন্যাপ করেছে। তথ্যসূত্র পেয়েছে তন্ময়। সব শুনে হাঁফ ছাড়লেন মোস্তফা সাহেব। জানালেন নিজে যাবেন পুলিশ স্টেশন। এই বিষয় নিয়ে খোলামেলা আলোচনা হওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাদের মেয়ের যদি কিছু হয়ে যেতো? আর তার ছেলেটা…মোস্তফা সাহেব নরম গলায় বললেন, ‘যাও ফ্রেশ হয়ে রেস্ট নাও। এরপর থেকে কিছু হলে আমায় জানাবে কেমন? আমিতো আছি সাহায্যের জন্য। তোমার যদি কিছু হতো?’
তন্ময় মাথা দোলায়। ওপরে যেতে নিচ্ছিল। কিছু একটা ভেবে ফিরে এল। দাঁড়াল আনোয়ার সাহেবের সামনে। অসম্ভব গভীর গলায় বলল, ‘চাচ্চু। সুমনা মেয়েটা ভালো না। অরুর সঙ্গে মিশতে দেওয়া ঠিক হচ্ছে না।’
আনোয়ার সাহেবের মখশ্রী থমথমে। তন্ময়ের মাথায় হাত রাখলেন। চুল বুলিয়ে বললেন, ‘তুমি যা বলবে তাই। আমি কথা বলে নেব তোমার চাচীর সঙ্গে।’
_____
গোসল সেড়ে তন্ময় বিছানায় টানটান হয়ে শুয়ে পড়ল। চোখজোড়া বুঁজে নিলো চট করে। ক্রোধে মাথাটা এখনো ব্যথিত। দরজা হতে ঠকঠক শব্দ ভেসে আসছে। তন্ময় আওয়াজ দিল, ‘কে? কী প্রয়োজন?’
অরুর মেয়েলী গলার স্বর শোনা গেল, ‘আমি। কফি পাঠাল বড়ো মা।’
তন্ময় বিছানা ছাড়ল। একটা টি-শার্ট গায়ে জড়িয়ে নিল। দরজা খুলতেই অরু ভেতরে ঢুকল হুড়মুড়িয়ে। কফির মগটা বাড়িয়ে ধরল। তন্ময় গাধাটিকে ভালোভাবে দেখে কফির মগ নিল। চুমুক বসিয়ে চেয়ারে বসল। পিছু-পিছু অরুও আসলো। গাল ভরে হেসে বলল, ‘তন্ময় ভাই। আপনি যখন শয়তান লোকটাকে মারছিলেন না, অনেক হ্যান্ডসাম লাগছিল আপনাকে। একদম হিরো!’
তন্ময় কেশে ওঠে। বড়ো বড়ো চোখে তাকায়। অরুও তখন অবাক চোখে তাকিয়ে। হয়তো তন্ময়ের এমন রিয়াকশন আশা করেনি। তন্ময় চোখ ফেরায়। এদিক-ওদিক তাকিয়ে আদেশ ছুড়ে, ‘পড়া কমপ্লিট করছিস? আজ পড়া দিতে না পারলে খবর আছে কিন্তু!’
অরু তড়িঘড়ি করে বেড়িয়ে যায়। তন্ময় সেদিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে। পরপর আরও দু’চুমুক পান করে।
এইযে.. এই দিনগুলো বড্ড সহজসরল ছিল। তন্ময়ের ভালো লাগার দিন ছিল। ভালোবাসার নয়! তার ভালোবাসার শুরুটা ঠিক অরুর সতেরোতম জন্মদিন থেকে শুরু হয়েছিল। সাথে শুরু হয়েছিল… তার ধৈর্যের পরিক্ষা। নিজেকে আটকে রাখার লড়াই। ভালোবাসার মানুষকে কাছে পেয়েও দূরে ঠেলে দেবার এক অবিশ্বাস্য সংযম।
_______
চলবে ~