শিশিরের বিন্দু পর্ব ১৬

শিশিরের বিন্দু
১৬ তম পর্ব

বিন্দু অবাক হয়ে তাকিয়ে বলল,
__” কি ব্যাপার এমন করে ধরে আছেন যেন কোথাও চলে যাচ্ছি?”
___ ” চলে যেতে দিলে তো “।
শিশির মুচকি হেসে বলল। বিন্দু শিশিরের কাধে আবারো মাথা দিল। আবির পেছনে তাকিয়ে শিশিরকে উদ্দেশ্য করে বলল,
___ ” মাঝে মাঝে ভাবি তুই আর কত কি দেখাবি যে শিশির “।
শিশির কিছু বলার আগেই বিপ্লব বলল,
___ ” শিশির আবার কি কি দেখালো তোরে? ”
বাকি সবার প্রশ্নবোধক চিহ্ন নিয়ে তাকালো আবিরের দিকে। তখন আবির বলতে লাগল,
___ ” প্রথমে গায়ে হলুদের দিনে পলাইলো তারপর দেশে আইসা সেই মেয়েই ইন্ডিয়া বইসা এক রাতের মধ্যে বিয়া করল। আর কিছু শুনতে চাস?”
আবিরের কথা বলার ধরনে সবাই হেসে উঠলো। বিন্দু লজ্জায় লাল হতে লাগল ধীরে ধীরে। ওরা এসে পৌঁছালো তাজমহলের কাছে। তাজমহলের থেকে বেশ কিছু দূরেই ওদের গাড়ি থামিয়ে দিল। কারণ এখান থেকে আর কোন বড় গাড়িই যেতে দেয় না। সবাই গাড়ি থেকে নেমে অটোতে ১০ রুপি করে তাজমহল পর্যন্ত গেল। শিশির আর আবির গেল টিকিট কাটতে। বাইরের চার্টে লেখা যারা ইন্ডিয়ান তাদের টিকিট মূল্য ৫০ রুপি। যারা সার্কভুক্ত দেশের অধিবাসী তাদের জন্য ৫৪০ রুপি আর অন্যান্য দেশের নাগরিকদের জন্য ১১০০ রুপি প্রতি টিকিটের মূল্য। আবির ফিসফিসিয়ে শিশিরকে বলল,
___ ” দোস্ত দুই একটা হিন্দি বলে নিজেরে ইন্ডিয়ান কইয়া চালান দিয়ে টিকিট কেটে আন।”
___ ” পরে যখন ধরা পড়বো তখন বাপ বাপ ডেকেও কুল পাবো না “।
শিশির চোখ গরম করে বলল। সত্যিই শিশিরের ধারনাই ঠিক হল টিকিট কাটার সময় ইন্ডিয়ানদের রেশন কার্ড বা আধার কার্ড শো করা লাগছিল। ওদেরও টিকিট কাটার সময় পাসপোর্ট শো করা লাগল। ছয়টা টিকিট কেটে ওরা যখন ফিরছিল তখন হঠাৎ করেই টিকিট কাউন্টারের পাশে দেখলো একটা লোক টিকিট দেখে দেখে পানি আর সাদা সাদা কি যেন একটা দিচ্ছে। আবির এগোতেই দেখলো এখানে তাজমহলের টিকিট দেখিয়ে এক বোতল পানি আর জুতার উপরে পরার কভার পাওয়া যায়। কারন তাজমহলে জুতা পরে যাওয়ার সিস্টেম নাই হয় জুতা খুলতে হবে না হয় জুতার উপরে কভার পরে নিতে হবে৷ শিশির আর আবির এসব নিয়ে এলে অন্য সবাই অবাক হয়ে রইল। আসলে ওরা কেউই জানতনা যে তাজমহলে এমন সিস্টেম আছে৷ শিশির এসে বিন্দুর হাত ধরল। দুজনে ধীরে ধীরে তাজমহলে ঢোকার গেটের দিকে যেতে লাগল। চেকিং স্ক্যানিং এর পরে যখন ওরা ঢুকলো তাজমহলের গেটের ভিতরে তখনও তাজমহল বেশখানিকটা দূরে। ওরা সবাই আস্তে আস্তে তাজমহলের মেইন গেটের দিকে যেতে লাগল৷ প্রথম যখন শিশির তাজমহল দেখলো যেন ক্ষনিকের জন্য থেমে গেল। বিন্দু নিঃশ্বাস বন্ধ করে ফেলল তাজমহলের প্রথম দর্শনেই। একটা পাথরের ইমারত ভালবাসার প্রতীক হয়ে গেছে তাও শত শত বছর আগ থেকে। শিশিরের মুখ থেকে একটা শব্দই বের হল, ” অসাধারণ “।

এতদিন বইয়ের পাতায়,ছবিতে, ভিডিওতেই তাজমহল দেখেছে বিন্দু। কিন্তু ওর বারবার মনে হচ্ছে তাজমহলের আসল সৌন্দর্যের ১০ ভাগ ও বোঝা যায় না এসবের। নিজেকে যেন ক্ষুদ্র মনে হচ্ছে এই তাজের সামনে। ওরা আস্তে আস্তে এগোতে লাগল তাজমহলের দিকে। নিনা হা করে তাকিয়ে তাকিয়ে তাজমহল দেখছে। হঠাৎ আবিরের দিকে তাকিয়ে বলল,
___ ” দেখেছ শাহজাহান তার বউরে কি পরিমাণ ভাল টাই না বাসতো। আস্ত একটা তাজমহল বানায়ে দিছে বউটারে। আর তুমি…… আমি সামান্য একটু শপিং করলেই আমার সাথে কাউ কাউ শুরু কর।”
আবির জোর করে হেসে বলল,
___ ” জান প্রথম কথা হল শাহজাহানের আব্বা ওরফে মমতাজের শশুর আব্বা বাদশাহ আছিল। কিন্তু কপাল খারাপ তোমার শশুর আব্বা পানি উন্নয়ন বোর্ডে বইসা পানির উন্নয়নে ব্যস্ত। দ্বিতীয় কথা হল মমতাজ আফা মরার পরে শাহজাহান দুলাভাই এইডা বানাইছিল তাই……… “।
___ ” কি? তুমি আমারে মরতে বলতেছ? তুমি কি ভাবছো আমি বুঝি না, আমি মরলেই আরেকটা বিয়া করবা তাই না “।
___ ” না বউ তুমি মরলে আমি তোমার কবরের পাশে টেবিল ফ্যান ফিট করে দেবো। ”
___ ” কেন কেন? টেবিল ফ্যান ফিট করবা কেন?”
___ ” যেন কবরের মাটি তাড়াতাড়ি শুকায়। আমাদের মধ্যে নিয়ম আছে বউয়ের কবরের মাটি না শুকালে বর আরেকটা বিয়ে করতে পারে না “।
এটুকু বলার পরেই নিনা ব্যাগ উঁচু করে আবিরকে মারতে দৌড়ালো। আবিরও দৌড় শুরু করল। শিশির আর বিন্দু হাসতে লাগল ওদের অবস্থা দেখে। তাজমহলের প্রধান বিল্ডিংয়ে ঢুকতেও ওদের আরেক প্রস্ত চেক করা হল। এটা আরো কঠিন ভাবে চেক। তাজমহলের বেদীর উপরে উঠে শিশির বিন্দুর হাত ধরে নিয়ে চলল যমুনা নদী যে পাশে ঠিক সেই পাশটাতে। আবির আর নিনা চারপাশে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছিল। হঠাৎ শিশির হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে বিন্দুর সামনে। তাজমহলের অন্যান্য যে দর্শনার্থীরা রয়েছিল তারাও দাঁড়িয়ে পড়ে। বিন্দু চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইল শিশিরের দিকে। বিপ্লব আর তুলি ছুটে এসে দাঁড়ালো ওদের পাশে। শিশির হাতে একটা আংটি নিয়ে বিন্দুর দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,
___ ” তাজমহল আর তার যমুনাকে সামনে রেখে বলছি সারা জীবন আমাকে সামলানোর জন্য আমার পাগলামী গুলো সওয়ার জন্য আর আমাকে এত এত ভালবাসার জন্য একটা তুমি চাই। হবে আমার সেই তুমিটা? ”
বিন্দুর চোখ দিয়ে অঝোরে পানি গড়াতে লাগল। ও নিচু হয়ে শিশিরের গলা আকড়িয়ে ধরল শক্ত করে। ততক্ষনে ওদের চারপাশে ছোটখাটো একটা ভিড় জমে গেছে। তারা সবাই হাত তালি দিয়ে উঠলো।মাথায় পাগড়ি দেওয়া এক শিখ ভদ্রলোক বলল,
___ ” বিবি জি হ্যা কার দিয়া বহুত আচ্ছা বাত হ্যায়। আব জালদি ছে সাদি কার লি জিয়ে। ”
___ ” ও দোনো পতি পত্নি হ্যা সরদারজি “।
বিপ্লব হাসতে হাসতে বলল। তখন সেই শিখ ভদ্রলোক অবাক হয়ে বলল,
___ ” কিয়া বোল রাহা হো? আগার ইয়ে পতি পত্নি হ্যা তো প্রপোজ কিউ কার রাহা হ্যা”।
___ ” নয়া নয়া পেয়ার হ্যায় ইস লিয়ে। ”
___ ” ভাই গুরু ইস জামানাকে বাচ্চালোক বহুত ক্রিটিকাল হ্যায় “।
তার কথা শুনে সবাই হাসতে লাগল। বিন্দুর হাতে আংটি পরিয়ে দিয়ে শিশির চলল তাজমহলের ভেতরটা দেখতে। এত বড় একটা তাজমহলের ভেতরে বিশাল একটা ঝাঝরি ওয়ালা নেটের মত দিয়ে ঘেরা। ওর মধ্যে মমতাজ মহলের কবর। একদম ঠিক তাজমহলের মাঝ খানে উনার কবরটা। এত ছিমছাম আর এত নিখুঁত কারুকার্য যে পাথর কুঁদে করা যায় সেটা জানা ছিল না। বিন্দু বারবার পিছ ঘুরে ঘুরে দেখছিল তাজমহলকে। আজ যে এই তাজের সাথে ওর ভালবাসাটাও জুড়ে গেল।

তাজমহল থেকে আগ্রা ফোর্ট মাত্র আড়াই কিলোমিটার দূরে। ওরা একটা অটো ভাড়া করল পঞ্চাশ রুপি দিয়ে আগ্রা ফোর্ট যাওয়ার জন্য। বিন্দু সবার কাছ থেকে আগেই তাজমহলের টিকিটটা নিয়ে নিয়েছি সংগ্রহ করে রাখবে বলে। পরে যখন ওরা আগ্রা ফোর্টে ঢোকার জন্য টিকিট কিনতে গেল তখন শুনতে পেল এমনিতে এন্ট্রি ফি আশি রুপি কিন্তু তাজমহলের টিকিট শো করলে ৪০ রুপিতেই টিকিট পাওয়া যায়। ভেতরে ঘুরতে ঘুরতে শিশির বিন্দুকে বলল,
___ ” দেখেছ এটা অনেকটা আমাদের লাল বাগের কেল্লার মত।”
___ ” আমার কাছেও এমনই মনে হচ্ছিল।”
বিন্দু চারপাশ দেখতে দেখতে উওর দিল। আগ্রা ফোর্ট দেখতে দেখতে ওদের বিকাল হয়ে গেল। তাড়াহুড়ো করে বেরিয়ে ওরা আবার গাড়িতে ব্যাক করল। কারণ রাত ১০ টায় ওদের জম্মুর ট্রেন। সারাদিনের ঘোরা ঘুরিতে সবাই প্রচুর টায়ার্ড। তাই গাড়ি ছাড়ার সাতগে সাথেই ঘুমিয়ে পড়ল প্রায় সবাই।বিন্দু শিশিরের কোলে মাথা রেখে ঘুমাচ্ছে। নিনা আর আবির মাথা ঠোকাঠুকি করে ঘুম। বিপ্লবের কাধে মাথা দিয়ে তুলি ঘুমাচ্ছে আর বিপ্লব গেম খেলছে ফোনে। শিশির অবাক হয়ে বিন্দুর মুখের দিকে তাকিয়ে আছে।এই মেয়েটা ঘুমালে এত এত কিউট কেন যে লাগে। হঠাৎ শিশিরের চোখ পড়লো বিন্দুর ঠোঁটের দিকে। কমলার কোয়ার মত ঠোঁট জোড়া। নিচের ঠোঁটটা একটু ভেতরের দিকে ঢোকানো। শিশিরের খুব লোভ হতে লাগল ওই ঠোঁট জোড়ার উপরে। তাড়াতাড়ি বাইরের দিকে তাকিয়ে রইল ও। মনে মনে শিশির হাসতে লাগল আর ভাবতে লাগল, বিয়ে করা বউ তাও এত এত ভয় পাচ্ছে কেন ও। বিশাল এক ট্রাফিকে পড়ল ওরা দিল্লি শহরে ঢোকার মুখে। বিপ্লব শিশিরের দিকে তাকিয়ে বলল,
___ ” দোস্ত ট্রেন না মিস করে বসি।”
শিশিরের কপালেও চিন্তার ভাঁজ পড়লো। দিল্লীর সোনাইরহিলা স্টেশনে ওরা যখন পৌঁছালো তখন ঘড়ির কাটায় ঠিক সাড়ে নয়টা। এবার দিল্লি থেকে জম্মু যাবে ওরা দুরন্ত এক্সপ্রেস ট্রেনে৷ গতবার রাজধানী এক্সপ্রেসে ওরা এসি টু টায়ারে এসেছিল তাই এবার ওরা এসি কেবিন বুক করেছে। ট্রেনে উঠেই শিশির আর বিন্দু অবাক। কারন ওদের জন্য আলাদা সিংগেল কেবিনের ব্যবস্থা করেছে ওদের বন্ধুরা। আর পাশের একটা ডাবল কেবিনে বাকি চারজন। শিশির কেবিনে ঢুকেই অবাক। উপরে একটা বেড নিচে একটা বেড। সত্যিই খুবই সুন্দর। বিন্দু কেমন জানি লজ্জা লাগতে লাগল। বিয়ের পরে এই প্রথম দুইজনে একসাথে। তুলি হাসতে হাসতে বলল,
___ ” এই রাত আর কিন্তু আসবে না “।

চলবে
মারিয়া আফরিন নুপুর

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here