শেষ বিকেলের আলো পর্ব ৫

শেষ বিকালের আলো
তানিশা আহমেদ
পর্ব ৫

প্রতিদিনের সকাল গুলোর মত আজকের সকাল টা হল না। রুমাইসার কাছে আজ সবকিছু ই নতুন নতুন। নতুন বস্তিতে এসেছে আবার নতুন ঠিকানা হয়েছে। আজকের সকালে ওর মেয়েটা ওর কোলে শুয়ে আছে। রুমাইসা চোখ বন্ধ করে দোয়া করে যেন প্রতিটা সকালে ওর মেয়েটা এভাবেই ওর কাছে থাকে।

সময় গুলো বড় নিষ্ঠুর কারো জন্য কেউ থেমে থাকে না। অভি মারা গেছে আজ তিন মাস চলছে। এই তিন টা মাসে কতটা কষ্ট সহ্য করতে হয়েছে রুমাইসা কে কেবল ও জানে আর আল্লাহ। সে দিন গুলোর কথা ভাবলে এখনো চোখে পানি চলে আসে। তবে আজকের জীবন টা ও খুব সুন্দর না। সকালের আলোর সাথে শুরু হবে ওর নতুন যুদ্ধ। এটা টিকে থাকার যুদ্ধ আর ভালো ভাবে বেচে থাকার লড়াই।

এসব ভাবতে ভাবতেই হঠাৎ কালকের পাওয়া টাকা টার কথা মনে হচ্ছে। টাকা টা এখনো গুজে রেখেছে এক পাশে ছুঁয়ে দেখে নি। এখনো ঠিক করতে পারছে না কি করবে। এই চার হাজার টাকায় ঢাকা শহরের মত জায়াগায় সারা মাস চলা টা আকাশ কুসুম কল্পনা।এমন সময় দরজায় টোকা পড়ল। কাল রাতেত কথা মনে হতেই রুমাইসা একটু ঘাবড়ে গেল।

বিছানা থেকে উচু গলায় আওয়াজ করল “কে? ”

“আমি জুই এর মা, দরজা টা খুল দেহি ছেড়ি। ”

রুমাইসা মেয়ে কে শুইয়ে দিয়ে উঠে দরজা খুলে দিল। দেখল সাথে রহিমা নামক মহিলা আর মনির মা নামে মহিলাটা ও আছে। সবাই ঢুকে গেল দরজা দিয়ে ভেতরে। রুমাইসা একটু অবাক ই হল।

জুই এর মা বিছানায় বসে পড়ল। পাশে রহিমা খালা আর মনির মা ও বসল। রুমাইসার একটু অস্বস্তি লাগল। পরক্ষণেই মনে হল এই সমাজে বোধ হয় এতটা ভদ্রতা কিংবা ফর্মালিটির চিন্তা কেউ করে না।এখানে সবাই বুঝি প্রথম দেখায় সবাইকে আপন করে ফেলে।।

জুই এর মা বাচ্চার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল “কালকা রাইতের ঘটনার লেইগা আমি মাফ চাই রে ছেড়ি। আমার পোলাটার মাতা ঠিক নাই। কহন কি করে। রাইত হইলে এই রুমে ছুইটা আহে। ওর বউ টারে নিয়াই এই ঘরে থাকত। পরে ঝগড়াঝাটি কইরা ঘরের তে গেসিল গা। বউটা ও আর থাকে নাই গেসে গা। হের পর তো আরেক ছেড়ি আইয়া গলায় দড়ি দিল। কি কইতাম আর। ঘর টা ই আসলে অপয়া। ”

রুমাইসার আবার ভয় করছিল এসব শুনে। লোকটা কি তাহলে প্রতিদিন এই ঘরে আসবে? এমন করলে থাকবে কি করে। রুমাইসার ভাবনা চিন্তা যেন রহিমা খালা ধরে ফেলল। সে চট করে বলে ফেলল “ডরাইয়ো না, হেতি আর কিচ্ছু করত না তোমারে। আমরা বুঝায় দিমু নে। ”

রুমাইসা কিছু বলল না কেবল মাথা নাড়ল। এবার মনির মা জিজ্ঞেস করল “তোমার জামাই কেমনে মরল গো বইন? ”

রুমাইসার মুখ টা ফ্যাকাসে হয়ে গেল। ও যেন উত্তর দিতে পারছিল না। ওর নীরবতা থেকে মনির মা খোচা দিয়ে বলল ” কি গো জামাই না মইরা গেসে চিল্লায় গলাবাজি কইরা কইলা। অহন দেহি কতা বাইরয় না। ”

রুমাইসা মুখ তুলে তাকাল মনির মার দিকে।ভ্রু কুচকে চেয়ে আছে ওর দিকে। রুমাইসা আসতে আসতে বলল “বাইক এক্সিডেন্ট এ মারা গেছে। ”

উপস্থিত সবাই খুব শব্দ করে একসাথে বলে উঠল “আহারে বেচারা টা। মরল তো মল্ল, মাইয়াডারে এতিম কইরা মল্ল রে। জুয়ান ছেড়ির কফাল ডাই খারাপ গো। ”

রুমাইসার মনে হচ্ছে এটা সহমর্মিতা কম গায়ে খোচা দিয়ে কথা বলছে। এদের কথায় মনে শান্তি না বরং অশান্তির আগুন বাড়ছে। জুই এর মা আবার বলল “তা এইহানে নায় এই মাসের লাইগা ফিরিতে থাকলি, পরের মাসে কি করবি? আর এই বস্তির মেনেজার আমি, কিন্তুক মালিক কইলাম আরেক জন।।হেরে কেমনে বুঝাইবি তুই? ”

রুমাইসা ফ্যাকাশে মুখে চেয়ে রইল জুই এর মায়ের দিকে। বাবুকে কোলে নিয়ে হাত পা ধরে নাড়াচাড়া করছিল রহিমা খালা। যেন এইসব কথা তার কানে যাচ্ছে না। সে বাচ্চাকে জহুরির মত পরখ করতে ব্যস্ত। রুমাইসা খুব আকুতি ভরা গলায় বলল “এইদিকে কোন কাজ পাওয়া যাবে না খালা? ”

জুই এর মা মাথা চুলকাতে চুলকাতে একটা উকুন মাথা থেকে খুজে বের করল। নখের উপর রেখে উকুন টা কে মেরে আবার হাত মাথায় চালান করল নতুন কোন উকুন খুজতে। মনির মা জবাব দিল এই প্রশ্নের। “কাম এর কি অভাব রে ছেড়ি। আমাগো এই বস্তির মানুষের তো আর বইয়া খাওনের অবস্থা নাই। কেউ মাইন্সের বাড়িত কাম করে আর নাইলে কেউ ওই সাহিল গার্মেন্টস এ কাম করে, ১ ঘন্টা দূরের রাস্তায় যেইটা। কেউ রিসকা চালায়, কেউ আবার ময়লা টুকায়। অহন তুই কি কাম করবি হেইটা তুই জানোস। তয় এদিকে কাম পাওন এত সহজ কিসু না বুঝলি। ”

রুমাইসা আতঙ্কিত আর ভীত হচ্ছে এসব কথা শুনে। কিভাবে পারবে ও। কি কাজ করবে এই দুধের বাচ্চাকে নিয়ে। রহিমা খালা এবার বলল “তোরে দেইখা শিক্ষিত লাগে ছেড়ি। কতদূর পড়সস হ্যা? ”

“জ্বি ইন্টার পাস করেছি। আর পড়তে পারি নি। ”

“মেলা দূর পর্যন্ত পড়সস দেহি। জামাই না মরলে তো এদিক ভুলেও আইতি না। আরে কফাল খারাপ তোর। ”

রুমাইসা মাথা নিচু করে ফেলল। চোখে পানি চলে এসেছে। অভির কথা বারবার এরা মনে করাচ্ছে আর কষ্ট হচ্ছে। রহিমা খালা আবার বলতে লাগল “ওই যে সাহিল গার্মেন্টস আসে যে, হুনো আমাগো বস্তির দুইজন মানুষ হুনে কাম করে। হেরা আবার মেট্রিক পাস। তুই হেনো যাইয়া দেখ তোরে যদি কাম দেয় একটা । ”

রুমাইসা যেন চোখে মুখে আলো খুজে পেল একটু। রহিমা খালার দিকে চকচকে চোখে তাকিয়ে বলল “খালা জায়গাটার নাম বলেন। আমি আজকেই যোগাযোগ করব ওইখানে। আমার কাজ টা আর্জেন্ট প্রয়োজন । বসে থাকার সময় নেই একদম। ”

রহিমা খালা বলল “তাইলে রেডি হইয়া ল, ওই ছেড়ি দুইটায় বাইরে যাইব অহন। ওগো লগে চল আমি ওগোরে বুঝায় দিমু নে।”

১০মিনিটের ভেতর রুমাইসা মেয়েকে নিয়ে তৈরি হয়ে গেল। পেটে একটা দানা পানিও পড়ে নি কাল দুপুরের পর। খুব ক্ষুধা লাগছে। কিন্তু কাজ টা দরকার ওর। তাছাড়া বাচ্চা হওয়ার পর কিছু ওষুধ খেতে হয় সেগুলাও কেনার সাধ্য নেই। নিজের বিবেকের সাথে যুদ্ধ করে আজ ওই চার হাজার টাকা থেকে ৫০০ টাকা সাথে নিয়েছে। অভাব মানুষ কে বুঝি দুনিয়ায় সবচেয়ে নিকৃষ্ট কাজ করতেও বাধ্য করে।

মেয়ে দুটি রাস্তায় কোন কথা বলে নি ওর সাথে। বাস থেকে নেমেই রুমাইসা দেখল অনেক গার্মেন্টস কর্মী ভেতরে যাচ্ছে বাচ্চা নিয়ে। মানে বাচ্চাদের রেখেও কাজ করা যায়। যাক কাজ টা পেলে বোধ হয় একটু শান্তি পেত ও।একটা মেয়ে হঠাৎ পরিচিত কাউকে পেয়ে ভেতরে চলে গেল। আরেকটা মেয়ে গেটের সামনে যেয়ে বলল “শুনো, আজকে বড় স্যার আসবে গাড়ি দিয়ে। আমাগো তাড়াতাড়ি কাজে যাইতে হইব। তুমি অপেক্ষা করতে থাহো। আমি বেরেক পাইলে আইসা তোমারে ভিত্রে নিয়া যাব।”।

আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে মেয়েটা চলে গেল। রুমাইসা এই বিশাল গার্মেন্টস এর সামনে নিরুপায় হয়ে দাড়িয়ে রইল। কি বলবে কি করবে বুঝতে পারছিল না। মেয়েটার গায়ে রোদ লাগছে তাই কিছুটা কাপড় দিয়ে মুড়িয়ে দিল। এখনো শীত কমে নি। যদি ও আজ কাল রুমাইসার শীত লাগে না। সব সয়ে গেছে শরীরে। ওর মেয়েটার ও বোধ হয় এক সময় সয়ে যাবে। সামনেই একটা ক্যান্টিন দেখা যাচ্ছে। হাতের টাকা টা মুঠ করে চেপে ধরল রুমাইসা। তারপর সাত পাচ না ভেবে ক্যান্টিনে ঢুকে গেল। তেমন মানুষ নেই সেখানে। ও কে দেখে অনেকে তাকিয়ে আছে। রুমাইসার সৌন্দর্য কোন দিক দিয়ে কম না। কিছুদিন আগে সদ্য বাচ্চা জন্ম দেওয়া রুমাইসা আগে থেকে কিছুটা মোটা হয়েছে আগের তুলনায়। গাল গুলো ফুলে গেছে অনেক।তবে ফর্সা হয়ে গেছে আরো। যার কারনে গালে লাল লাল আভা পড়ে সৌন্দর্য টা আরো বেড়েছে। তাছাড়া পড়নের কাপড় কোন ময়লা ছেড়াও না। তাই যে কার ও কে ভদ্র মেয়ে গন্য করা অস্বাভাবিক কিছু নয়। মেয়েকে কোলে নিয়েই একটা টেবিলে বসে দুটা পরোটা অর্ডার করল। আশেপাশে কোন মহিলা নেই। সব ই পুরুষ লোক বসে আছে। সবার মাঝে নিজেকে খুব অসহ্য লাগছে ওর। চুপচাপ পরোটা খেয়ে বিল মিটিয়ে বের হয়ে গেল। টেবিলে বসে আশেপাশে থেকে মানুষের চাপা গুঞ্জন শুনছিল। এ সমাজে নারী বুঝি ব্যতিক্রমী কিছু করলেই চারিদিকে কথার গুঞ্জন রটে যায়। অথচ এই হোটেলে বসে খাওয়াটা ছিল নিতান্তই একটা স্বাভাবিক ব্যাপার। তবে এটাকেই যেন পুরুষ শাসিত সমাজ বাকা চোখে দেখল।

এসব ভাবতে ভাবতে গার্মেন্টস এর বাইরে হাটছিল। দারোয়ান এসে জানাল এক পাশে চেপে যেতে।বড় সাহেব আসছে এখন। এভাবে কাউকে দেখলে রাগ করবে।ইতিমধ্যে দারোয়ান কে নিজের করুন গল্প টা শুনিয়ে ফেলেছে রুমাইসা।তাই দারোয়ান খুব আন্তরিক ভাবে ও কে সরে যেতে বলল। রুমাইসা এক কোনায় যেয়ে দাড়িয়ে রইল।

গাড়ি থেকে একজন আকাশি রং এর শার্ট পড়া লোক নামল। লোকটা কে দারোয়ান সালাম ঠুকে দিল পাশে দাড়িয়ে। লোকটা জিজ্ঞেস করল দারোয়ান কে কেমন আছে?

দারোয়ান হাসিমুখে জবাব দিল ভালো আছে। লোকটা হাসি দিয়ে ভেতরে ঢুকতে যাবে তখনি ফোন আসল। রুমাইসা বাচ্চা কে নিয়ে এদিক থেকে ওইদিক হাটছে। মেয়েটা কান্না করছে ঘুম থেকে উঠে খাওয়ার জন্য। এখন এই রাস্তার মাঝে দাড়িয়ে কোথায় খাওয়াবে ও মাথায় ঢুকছে না। দারোয়ান যত ই আন্তরিক হোক, নিশ্চয়ই ও কে ভেতরে ঢুকতে দিবে না।

রুমাইসা হাটটে হাটতে মেইন গেটের সামনে চলে এসেছে। দারোয়ান গেটে নেই এখন। সামনের দিকে তাকাতেই দেখল অভির মত একটা লোক দাড়িয়ে আছে। চেহারার অর্ধেক পুরাই অভির মত। কিন্তু বাকি অংশ আর দেখতে পারছে না। কারন লোকটা অন্য পাশে ফিরে আছে। রুমাইসার মাথার তড়িৎ বেগে এটাই খেলে গেল যে এটা অভি। এক ছুটে দৌড়ে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে বলল “অভি তুমি বেচে আছো? ”

লোকটা এমন আচমকা আচরনে অবাক হয়ে পেছনে তাকাল। পেছনে তাকানোর পর দৃশ্যটা একদম অন্য রকম ছিল। মুখটা একদম বিষ্ময়ের চরম সীমানায় পৌঁছে গেল।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here