#শ্রাবণ_তোমার_আকাশে
#লেখনীতে-ইশরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব___২০
‘কখনো হবেনা এটা। আমার মেয়ে যেতে না চাইলেও আমি নিয়ে যাব।’
‘বেলা বউ যেমন আপনার মেয়ে, তেমনই আমার লিগ্যাল স্ত্রী। ওর ওপর আমার সম্পূর্ণ অধিকার আছে!’
নাইমুদ্দীন সাহেব একবার বেলার মুখের দিকে তাকালেন। দৃষ্টি ফিরিয়ে বললেন, ‘আমার মেয়ে আমার সিদ্ধান্তকে যথেষ্ট সম্মান করে। ও আমার সাথেই যাবে৷ ওর চুপ থাকাটাই প্রমাণ করতে যথেষ্ট যে ও তোমাকে ভালোবাসে না। তুমি সাইকোর মতো ব্যবহার করছো শাইনি। ঝামেলাটা এখানেই বন্ধ করলে সবার পক্ষেই ভালো হয়। তুমি তোমার ক্যারেক্টারের মেয়েদের ডিজার্ভ করো। আমার মেয়েকে না। অবশ্য আমারই ভুল। বিয়ের আগে তোমার সম্বন্ধে সবকিছু ভালো করে জেনে নেওয়া উচিৎ ছিল!’
বেলা ওর বাবা আর শাইনিকে কথা কাটাকাটির মাঝে থামিয়ে দিলো।
‘আব্বু প্লিজ থামো। আমার এসব ভালো লাগছেনা।’
‘তুমি আমার সঙ্গে চলো।’ বললেন নাইমুদ্দীন সাহেব।
শাইনি বাঁধা দিলো আবার।
‘যাবেনা বলেছি তো!’
বেলা কথা গোছাতে হিমশিম খাচ্ছে৷ শাইনির এখন চিল্লাচিল্লি করা উচিৎ না, কিন্তু লোকটা তা-ই করছে। নাইমুদ্দীন সাহেবকে চটালে তিনি আরও রাগবেন। তাই বেলা ধমকের সুরে ওকে বলল, ‘আমাদের বাবা মেয়েকে একা কথা বলতে দিন। আমি কোথায় যাব না না-যাব সেটা আমার ব্যাপার। আপনি আপনার ঘরে গিয়ে শুয়ে থাকুন৷ যান।’
শাইনির মনের অবস্থা ভালো নয়। বেলাকে চুপচাপ থাকতে দেখে ও যে দহনে পুড়ছে সেটা বলে বোঝানোর মতোন নয়। এখন আবার ওকে ধমকাচ্ছে? তাহলে বেলার বাবার কথাই ঠিক। শাইনিকে ভালোবাসলে বেলা নিশ্চয়ই ওর বাবার সঙ্গে যেতে চাইতো না। অথচ ও কি-না চুপ করে আছে! এই ওর ভালোবাসা? আর এখন বেলা ওর বাবাকে কী বলতে চায়? শাইনিকে যে দয়া দেখাচ্ছে এটা জানাতে চায়? মন বিষিয়ে উঠলো ওর। বেলার চুপ থাকাটা সহ্য হচ্ছেনা মোটেও। বড় বড় পা ফেলে নিজের ঘরের দিকে চলে গেলো। ঠাস করে ঘরের দরজা বন্ধ করে হাতের কাছে যা পেলো তাই-ই ছুঁড়ে মারলো। ড্রেসিং টেবিলের ওপর রাখা কাচের পারফিউমের বোতলটা মেঝেতে আছড়ে ফেলতেই ঝনঝন শব্দ তুলে সেটা ফেটে চৌচির হয়ে গেলো। এর মধ্যে থেকে সবচেয়ে বড় ভাঙা টুকরোটা হাতে নিয়ে কবজিতে কয়েকটা টান দিলো শাইনি। তারপর! তারপর হাতে-পায়ে, বুকে-পিঠে ইচ্ছেমতো কাটলো। একটুও কষ্ট হচ্ছেনা ওর৷ ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় যেন বন্ধ হয়ে গেছে। অনুভূতিরা মরে গেছে। ভালোবাসায় এত কষ্ট কেন? বেলা নামক মেয়েটিকে ভালোবাসা কি ওর জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল ছিল? মেয়েটি ওকে ভালোবাসেনা? তাহলে এত কেয়ার দেখানোর কি দরকার ছিল? কেন প্রতিরাতে কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বলতো ‘ভালোবাসি’ শব্দটা? ও কী রাস্তায় পড়ে থাকা ডাস্টবিনের কোনো কুকুর? যে সবাই তাচ্ছিল্য করছে? ভালোবাসে সে তাঁর বেলাকে। এটা কেন সবাই মেনে নিতে চাইছেনা? ওফ…! আর ওর মা। মহিলাটি যেন থেকেও নেই। ওর সুখে-দুঃখে এই মহিলাকে পাশে পায়নি কোনোদিনও। অথচ এই নারীজাতিই নাকি পাগলের মতো ভালোবাসতে পারে। কই, মা ওর সাথে তো ভালো করে কথাই বলে না। ছোটবেলা থেকেই তার মা- নামক মহিলাটি কোনোদিন ওকে বুকে তুলে নেয়নি, ভালোবাসেনি শিলার মতো। আর এক বেলা, যে নারীটি ভালো না বেসেও ভালোবাসার নাটক চালিয়ে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত। এই দুজন রমণীর ভালোবাসা পাওয়ার জন্য কাঙ্গাল হয়ে ঘুরেছে এতদিন। আর তা করবেনা শাইনি৷ ঠিক করে নিলো সে! তাছাড়া বেলার বাবা তো আর মিথ্যে বলবেনা। মেয়েকে এতগুলো বছর লালনপালন করে এসেছে। এমনিতেও বেলা অসহায় মানুষের প্রতি দয়াশীল। সবাই ঠিক, শাইনিই শুধু ভুল। ওর এই পৃথিবীতে আসাটাই যেন ভুল। ভালোবাসার যোগ্য নয় সে। বেলা ঠিকই বলেছিল! শেইম অন ইউ শাইনি, শেইম অন ইউ! নিজেকে নিজেই ধিক্কার দিলো সে। হাত থেকে গড়িয়ে পড়া রক্তের ফোঁটা গুলো মেঝেতে ঝরে পড়ছে। সেদিকে ওর খেয়াল নেই৷ ভাবনায় মত্ত্ব শাইনির মনের ভেতর চলা দহনক্রিয়া কেউ জল হয়ে নেভাতে আসেনি। ঘরের ভেতর চলা এই তান্ডবলীলার শব্দ সেদিন কারোর কানেই পৌঁছায়নি সাউন্ড প্রুফ রুম হওয়ার কারণে। কেউ জানতেই পারলোনা বেপরোয়া ছেলেটা ভালোবেসে নিজেকে নিজেই কষ্ট দিয়েছে …
___________________________
বেলা ওর বাবার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। বরাবরই সে তাঁর বাবার রাগকে ভয় পায়। আজও পাচ্ছে। তিনি যেহেতু একবার নিয়ে যাবেন বলেছেন সেখানে নিয়েই যাবেন। কিন্তু বেলা তো শাইনিকে ছেড়ে কোথাও যাবেনা, যা-ই হয়ে যাক না কেন! অতএব একটা রাস্তাই খোলা আছে। বাবাকে বোঝাতে হবে। নাইমুদ্দীন সাহেব নিশ্চয়ই বুঝতে পারবে ওর মনের অবস্থা। মেয়েকে চুপ করে থাকতে দেখে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী বলতে চাও? ওই চরিত্রহীন ছেলেটা..!’
বেলা ওর বাবার দিকে চেয়ে বলল, ‘আব্বু থামো প্লিজ। তোমার সঙ্গে আমার কিছু কথা আছে?’
‘কীসের কথা?’ ধমকে উঠলেন নাইমুদ্দীন সাহেব।
‘দরকারি কথা আব্বু।’
‘বলো!’
‘এখানে নয়। তুমি আমার সঙ্গে চলো।’
নাইমুদ্দীন সাহেব ভ্রু কুঁচকে বললেন, ‘সবার সামনে বললে কী সমস্যা?’
‘আমি শুধু তোমাকেই বলতে চাই।’
নাইমুদ্দীন সাহেব বললেন, ‘চলো তাহলে।’
বেলা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বলল, ‘ছাদে চলো।’
বেলার কথা শুনে আলম সাহেব এগিয়ে এসে বেলাকে বললেন, ‘তার আগে আমার কিছু কথা আছে মা।’
‘জি আংকেল বলুন।’
আলম সাহেব এক কিনারে এসে ধরা গলায় বেলাকে বললেন, ‘দেখো মা! জানিনা তোমার বাবাকে তুমি কী বলবে, কিন্তু একবার আমার ছেলেটার কথা চিন্তা করে তোমার সিদ্ধান্ত নিও। তোমার বাবা তোমাকে নিয়ে যেতে এসেছে, চাইলেই তুমি চলে যেতে পারো। এটা তোমার ওপর ডিপেন্ড করে। আমরা আটকাতে পারবো না। কিন্তু আমার অসুস্থ ছেলের ভালোবাসাকে অবমূল্যায়ন করে যদি সত্যিই তুমি চলে যাও, তাহলে কখনোই না-তো আমি তোমাকে ক্ষমা করতে পারবো, না-তো তুমি নিজেকে নিজে ক্ষমা করতে পারবে। জানো তো শাইনির ব্যাকগ্রাউন্ড! ওর মায়ের মতো শাইনিও আমাকে ছেড়ে যাওয়ার পায়তারা করছে। জানিনা ছেলেটাকে বাঁচাতে পারবো কি-না। কিন্তু এই সময়ে ওর কোনো ইচ্ছা আমি অপূর্ণ রাখতে চাইনা। আমার ছেলেটা শুধু তোমার জন্য নিজের মনোবল বাড়িয়েছে। বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখছে ক্যান্সার নিয়েও।সে ট্রিটমেন্ট ফেলে দেশে এসেছে। এখন তোমাকে ছেড়ে যেতেও চাচ্ছেনা কোথাও। শুধু তোমার জন্য। খুব ভালোবাসে তোমাকে!’
বেলা আলম সাহেবকে বলল, ‘জানি আংকেল। চিন্তা করবেন না আপনি।’
‘তোমার ওপর ভরসা আছে। তোমার বাবা আমাদের কোনো কথা শুনতেই ইচ্ছুক নয়।’
বেলা বলল, ‘আপনি বাবাকে খবর পাঠিয়েছেন? যে আমি এখানে?’
আলম সাহেব অবাক হয়ে বললেন, ‘না। আমিতো ভাবলাম তুমি।’
‘আমি দিইনি।’
‘তাহলে? কেউ না জানালে তো আর তোমার বাবা খবর পেতো না।’
‘আমিও এটাই ভাবছি।’
রুক্ষ দুপুরের তেজদীপ্ত রোদে কমলা রঙ ধারণ করেছে প্রকৃতি। বেলা শাইনির ঘরের সামনে এসে দেখলো দরজা বন্ধ। ভেতর থেকে হালকা টুংটাং শব্দ আসছে। খুব বেশি শব্দ শোনা না গেলেও দেয়ালে কান পাতলে বোঝা যায় ফ্যান ঘুরছে। শাইনি ভেতরেই আছে। বাবার সাথে কথা বলে তারপর ঘরে যাবে বলে ঠিক করলো বেলা৷ নাইমুদ্দীন সাহেবকে নিয়ে ছাদে আসার কারণ, নিচে নাজনীন বেগম আছে। আর ওই মহিলাটির সামনে কথা বলতে চায় না ও। তাই এখানে আসা। নাইমুদ্দীন সাহেব বেলার উপর বিরক্ত হচ্ছেন। মেয়েটা এত ভনিতা করছে কেন? তবে কী ও যেতে চায় না? তিনি কাশি দিয়ে গলা ঝেড়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী বলতে এখানে এনেছো আমাকে?’
বেলা সিমেন্টের বসার জায়গাটায় বসলো। বলল, ‘কথাগুলো শুনে তুমি রাগ করবে জানি। তবে রাগ করলেও আমার কিছু করার নেই আব্বু৷ আমি নিরুপায়।’
নাইমুদ্দীন সাহেব ভ্রু কুঁচকালেন।
‘বলো।’
‘আব্বু, আমি এখান থেকে যেতে চাই না। এখানেই থাকতে চাই।’
রাগ উঠলো নাইমুদ্দীন সাহেবের।
‘কারণ?’
‘ওনি অসুস্থ। হ্যাঁ, ওনার লিউকেমিয়া এবং কাল ওনাকে হসপিটালে এডমিট করা হবে। ওনার থেরাপি শুরু হবে। কথাটা পুরোপুরি সত্য।’
‘তুমি কী চাচ্ছো?’
‘আমি ওনার পাশে থাকতে চাইছি।’
‘তোমাকে অন্ধ বানিয়ে রেখেছে, ব্রেইন ওয়াশ করেছে।’
‘আমি অবুঝ বাচ্চা না আব্বু। ডিভোর্সের কথা আমিই বলেছিলাম তোমাদের!’
‘সে তোমাকে অত্যাচার করে না?’
বেলা মুচকি হেসে বলল, ‘মোটেও না। ভালোবাসে আমায়।’
নাইমুদ্দীন সাহেব কিছুক্ষণ ভেবে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুমি ছেলেটাকে ভালোবেসে ফেলেছো?’
বেলা কথা লুকায় না। সে নত গলায় জবাব দেয়, ‘হুম।’
‘এই ভুলটা কীভাবে করলে তুমি? ছেলেটা তোমাকে ঠেকিয়েছে!’
‘ঠকায়নি। ভালোবাসে ওনি আমাকে৷’
‘তোমাকে কিডন্যাপ করেছে।’
‘তা করেছিলো। কিন্তু ভালোবাসে বলেই করেছিল, আমাকে ছাড়তে পারবেনা বলে করেছিল। আর ওনার সাথে থাকতে গিয়ে, বুঝতে গিয়ে আমি মানুষটাকে না ভালোবেসে থাকতে পারিনি৷ ওনি আমার জন্য অনেক স্যাক্রিফাইস করেছেন। তাঁর বিনিময়ে আমার ভালোবাসাটা ওনার প্রাপ্য ছিল এবং আমি তা করেছিও। আমার মনে হয়না এটা ভুল।’
নাইমুদ্দীন সাহেব বললেন, ‘বিয়ের পরদিন হোটেলে কি করেছিল ভুলে গেলে?’
‘ভুলিনি। বরং এটা আমার জীবনের অন্যতম ভুল বুঝাবুঝি ঘটিয়েছিল।’
বেলা সেদিনের ঘটনা খুলে বললো তাঁর বাবাকে। তবে সন্তুষ্ট হলেন না তিনি। শাইনির সম্বন্ধে এত এত নেগেটিভ কথা শুনেছেন যার ফলে ঘৃণা ছাড়া অন্যকিছু তাঁর মনে আসছেনা। বেলা ভালোবাসায় অন্ধ হয়ে গিয়েছে, তাই আবেগের বশে ঠিক-ভুল বিচার করার ক্ষমতা হারিয়েছে।
‘এখন তুমি আমার সাথে ফিরতে চাও না?’
‘ফিরতে চাই অবশ্যই। তবে শ্বশুরবাড়িই আমার আসল ঘর৷ তোমার বাসায় বেড়াতে যাব।’
‘আমার কিছুই বলার নেই।’
‘রাগ করো না। আর আমি যে এখানে আছি তার খোঁজ কে দিলো তোমাকে? মা বলেনি নিশ্চিত। তাহলে কে?’
‘সে তোমার শুভাকাঙ্ক্ষী। নাম জানতে চেও না। আমি এখন তোমার সাথে কথা বলতে চাচ্ছিনা। আসছি আমি।’
নাইমুদ্দীন সাহেব বেলাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই ছাদ থেকে নেমে গেলেন। অতঃপর বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলেন। বেলা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে শাইনির ঘরে চলে এলো। দরজায় ধাক্কা দিলো, নক করলো। ভেতর থেকে বন্ধ সেটা। দু-একবার টোকা দিতেই ভেতর থেকে শব্দ এলো। বেলা দাঁড়িয়ে পড়লো।
বলবে…ইনশাআল্লাহ! কী হতে যাচ্ছে? এডিট ছাড়া পর্ব। রি-চেইক পর্যন্ত দিইনি।