#সংসার
#পর্ব_২৩
#লেখিকা_সুরাইয়া_ইসলাম_সানজি
“আমি আর তিন মাস তো দূর তিন সপ্তাহ অপেক্ষা করতে পারব না। তোকে চাই একদম আমার নিজের করে চাই।”
আকাশের কথায় জেনি মৃদু হেসে বুকে মাথা রেখে আবার চোখ বন্ধ করে।
বারান্দায় চেয়ার দুইটি একসঙ্গে করে বসে আছে মেঘ আর রুদ্র। দুজনের চোখে মুখে অনন্দের ঝলক। আকাশে তারার ঝলকানিতে সারা শহর ঝাপসা আলোয় ফুটে উঠেছে। ব্যস্ত মেঘগুলো আকাশের একপাশ থেকে ওপাশ ঘুড়ে বেড়াচ্ছে
আমি আকাশ ভাইয়া আর জেনি আপুদের দিকে তাকিয়ে বললাম-
“অবশেষে তাদের মিলটা হয়েই গেল।”
৪৫.
আমার কথা শুনে রুদ্র মৃদু হেসে ওঠে। নিস্তব্ধতা কাটিয়ে রুদ্রের কাধে মাথা রেখে আবেগী গলায় বললাম-
“রুদ্র আমার একটা ছোট্ট ছেলে বাবু চাই। পূর্ণতার খেলার সাথী এনে দিবেন প্লিজ। ওর পূর্ণতার মতো ছোট ছোট হাঁত পা হবে। একসাথে দুটো বাবু সারা বাড়িতে গুটিগুটি পায়ে হেঁটে বেড়াবে।”
,
,
ধমকা হওয়ার সাথে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি। কিছুক্ষণ আগের ঝকঝকে রোদ পালিয়ে গিয়ে সেখানে এখন জায়গা নিয়েছে ঘন আধার। বাম হাতের ঘড়িটা জানান দিচ্ছে এখন বিকেল চারটা। অথচ চারপাশে আবহাওয়া দেখে মনে হচ্ছে সময় রাত নয়টার কাছাকাছি। জেনি জানালার গ্রিল ধরে হঠাৎ বদলে যাওয়া আবহাওয়া আনমনে দেখছে। ঝিরঝির বৃষ্টির কনা গুলো ছিটকে মুখে উপর পড়তেই বিরক্ত নিয়ে গ্রিল ছেড়ে রুমের দিকে পা বাড়ায়। সকাল বেলা বাড়িতে ঢুকার আগে কে জানত তাদের জন্য সামনে কি অপেক্ষা করছে।
আজ সকালে জেনি আর আকাশ নিজের গ্রামের বাড়ি বরিশালে যায়। বাবা মাকে তারাতারি বিয়ের সিদ্ধান্ত জানাবে। আগেই যেহেতু বিয়ে ঠিক করা ছিল তাই টেনশন বা ভয়ের কিছু ছিল না। ভেবেছিল বাড়িতে গিয়ে একটু জোর করে বললেই বিয়েটা হয়ে যাবে।
গ্রামের বাড়ি চারপাশের বাউন্ডারি দিয়ে ভিতরে একই সাথে আফজাল সাহেব আর ফোরকান সাহেবের বাড়ি। বাড়ির মাঝ খানে ফাঁকা মাঠের মতো জায়গা। একপাশে ছোট একটা পুকুর আর অন্যপাশে ফলের বাগান। বাড়ির এত সুন্দর পরিবেশ মাঝখানে একটা দেয়াল উঠে নষ্ট করে দিয়েছে।
আফজাল সাহেব আর ফোরকান সাহেব যথেষ্ট সমাজে জ্ঞানী গুনি লোক হলেও ভিতরের ছেলে মানুষি এখনো যাইনি। যার সূত্র ধরেই তাদের জগড়া।
বাড়ির মাঝে ফাঁপা জায়গায় দুই বন্ধু দুটো দল করে ছোট ছেলেদের সাথে ক্রিকেট বল খেলতে গিয়ে একটা বল এসে ফোরকান সাহেবের মাথায় লাগে আর সেই ছেলেটাকে আফজাল সাহেবের দলের লোক বলে সে কিছু বলেনি। ফোরকান সাহেবে প্রশ্ন কেন ছেলেটিকে কিছু বলে নাই নাকি সে ইচ্ছে করে বল মেরে তাকে মারতে বলছে? এই সামান্য বিষয়টাকে জগড়ায় পরিনত করতে তাদের দুই ঘন্টা সময়ও লাগেনি।তারপর থেকে দুজনে দুজনের সব বিষয় ধরে জগড়া করতে করতে এমন পর্যায়ে গেছেন তাদের বাড়ির মাঝে দেয়াল তুলতে হয়েছে। আর সেখান থেকেই সিদ্ধান্ত নিয়েছে ছেলে মেয়েদের বিয়া টা আর একসাথে দিবে না।
তবে তাদের এই ছেলেমানুষি নিয়ে বড্ড বিরক্ত মেহেতা বেগম আর লাইলি বেগম কিন্তু অতি ভদ্র ফেমিলীর মেয়ে হওয়ার জন্য স্বামীর কথা উপরে কথা বলতে চায় না। গোপনে গোপনে দুই বান্ধবী বেশ ঘনিষ্ঠ থাকলেও স্বামীদের কান পর্যন্ত সে কথা পৌছায় নাই।
আজ সকালে জেনি আর আকাশ বাড়ির মেইন গেইট খুলে বাড়ির মাঝখানে এমন একটা দেয়াল দেখে দুজনেই হতবম্ভ হয়ে গেল। দুজন দুজনের ঘরের দিকে চলে যায়। আকাশ ঘরের ভিতরে ঢুকে দেখে আফজাল সাহেব সোফায় বসে পেপার পড়ছেন আর ফাঁকে ফাঁকে চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছেন। তার সামনেই মেহেতা বেগম একরাশ বিরক্ত নিয়ে এদিক ওদিক তাকাচ্ছেন।
মেহেতা বেগম কে আফজাল সাহেব এমন উশখুশ করতে দেখে সোজা হয়ে তাকিয়ে চশমাটা চোখের উপর ঠেলে দিয়ে জিঙ্গেস করেন-
“এভাবে এদিক ওদিক না তাকিয়ে, কি বলতে চাও বলো?”
“আজ আকাশ আর জেনির আসার কথা, তাই বলছিলাম কি মাঝের দেয়াল টা যদি সরিয়ে ফেলেন। এটা আকাশ দেখলে কী ভালো হবে?”
বউকে কোনো কারন ছাড়াই এমন ভয় পেতে দেখে মনেমনে পৈশাচিক আনন্দ পান আফজাল সাহেব। একটু গম্ভীর গলায় বলেন-
“কোন দেয়াল টেয়াল সরানো যাবে না। বাড়ির মেইন গেটও আলাদা করব তাড়াতাড়ি। আকাশ কে বলে দিও যদি আমার বাড়িতে থাকতে চায় তবে যেন বিয়ে ভেঙে দেয়।”
আকাশ দরজায় পা দিতেই শুধু শেষের বিয়ে ভেঙ্গে দেওয়ার কথা শুনে জিঙ্গেস করে কার বিয়ে ঠিক হইছিল আর কেনই বা ভাঙ্গবে। হঠাৎ পিছন দিক থেকে আকাশের কথা শুনে আফজাল সাহেব ভয়ে ঢুক গিলেন। ছেলের পাগলামি কোন কিছুই অজানা না তার কাছে। তবুও সাহস নিয়ে বলেন-
“ওই ফোরকান্নার মেয়ে জেনির সাথে তোমার বিয়ে ভেঙ্গে দিয়েছি। সেই সাথে ফোরকান ওর মেয়েকে অন্য জায়গায় বিয়ে দিবে বলে ঠিক করেছে তাই আমি তোমার বিয়ের জন্য অন্য জায়গায় মেয়ে পছন্দ করে রেখেছি। মেয়ের বাবা আমাদের থানার দারোগা।”
আকাশ অবাক হয়ে বলর-
“কিন্তু আমাকে এই বিষয়ে কোন কিছুই তো জানানো হয়নি। আর আমি এই বিয়ে না ভাঙ্গবো আর না অন্য বিয়ে করব।”
“আমি তোমার কাছে সিদ্ধান্ত জানতে চাইনি আকাশ। যদি আমাকে সম্মান করো তবে আমার বলার কথাকেও সম্মানের সাথে মেনে নেবে।”
আকাশ তার বাবার এমন কথা শুনে রাগে সামনে থাকা কাচের টেবিলটা ভেঙ্গে নিজের রুমে চলে যায়। জেনির সাথে বাসায় ফেরার পর ঠিক এমনটাই হয়েছে। জেনির বড় ভাবি বেশ কিছুক্ষণ এ বিষয়ে বোঝানোর পর ব্যর্থ হয়ে রুম ত্যাগ করেন। জেনি সিদ্ধান্ত নিয়েছে পালিয়ে যাবে কিন্তু তার আগেই ঝড় শুরু হয়।
হঠাৎ বারান্দায় কিছু পড়ে যাওয়ার শব্দে সেদিকে ছুটে গিয়ে দেখে আকাশ কাক ভেজা অবস্থায় বারান্দায় দাড়িয়ে নিজের ভিজা শার্ট টা মাছি তাড়ানো ভঙ্গিমায় ডান হাত দিয়ে ঝাড়ছে। জেনিকে আসতে দেখে বলল-
“তোর বারান্দাটা আগের থেকে পিচ্ছিল হয়ে গিয়েছে এখন বেয়ে ওঠা বেশ মুশকিল। মুছে রাখিস তো।”
জেনি আকাশের কথায় গুরুত্ব না দিয়ে দৌড়ে রুমের দরজা আটকে দেয়। কে কখন আসে বলা যায় না। দৌড়ে আকাশকে ঝাপটে জড়িয়ে ধরে কান্না করে দেয়।
“আকাশ চল আমরা পালিয়ে যাই। এখানে থাকলে কখনো আমি তোর সাথে থাকতে পারব না।”
“ধুরর বোকা। আমাদের বাবাদের তো চিনিস ছোট ছোট ব্যাপার গুলো নিয়ে বড় বড় কান্ড করে থাকে। আমরা পালিয়ে গেলে তারা কষ্ট পাবে খুব আর সেই সাথে আমাদের কখনো আর ফেরা হবেনা এ বাড়িতে।”
“কিন্তু আকাশ ওরা আমার বিয়ে কাল ঠিক করেছে। কাল এখানে থাকলে আমার বিয়ে হয়ে যাবে।”
“উহু শুধু তোর না কাল আমার বিয়েও ঠিক করেছে। তাই এখনই নিচে গিয়ে সোজা কাকুর পা ধরে কান্না করবি আর আমিও বাবার পা ধরবো দেখবি এমনিতেই তাদের মন ঠিক হয়ে যাবে।
৪৬.
জেনি আকাশের কথায় মাথা নেড়ে রুম থেকে বেড়িয়ে গিয়ে বাবার পায়ের কাছে বসে পা ধরে বলে-
“বাবা আমি কাল বিয়ে করতে পারব না। আমি আকাশ কে ভালোবাসি সেই সাথে তোমাদের ও ভালোবাসি। আমি চাইলে এখন এখান থেকে আকাশের সাথে পালিয়ে যেতে পারি কিন্তু তোমাকে কষ্ট দিতে চাইনা। আমি তোমার সব সিদ্ধান্ত মেনে নিবো তবে তোমার মেয়েটা তখন জীবন্ত লাস হয়ে যাবে। কখনো আর হাসবে না কাঁদবে না। তুমি কি চাও তোমাদের ছোট একটা কারনে আমার ভালোবাসা শেষ হয়ে যাক। তাছাড়া আকাশ কি দোষ করেছে?”
মেয়ের এমন আকুতি দেখে মনটা কেঁদে উঠলো ফোরকান সাহেবের। এত বড় মেয়ে, নিজের থেকে মেয়েকে বেশী বুদ্ধিমান মনে করেন সেই মেয়েকে তার পায়ের কাছে বসেছে কিছুতেই মানতে পারছে না। চোখের সামনে মেয়েকে অন্য জায়গায় বিয়ে দিলে কি হবে কথাগুলো কল্পনায় ভেসে উঠতেই আতকে ওঠে। না সে কখনোই চায়না তার হাসি খুশি মেয়েটা শেষ হয়ে যাক। ছোট ছোট ভুল গুলোর জন্য আজ এমন হয়েছে কিন্তু সে এটা তো ভুল করেনি। আফজালের কাছে গিয়ে ছোট হতে চান না এতে তার সম্মানের ঘাটতি হবে।
“তুই এভাবে বলছিস যখন তখন আমি তোর সব কথা মেনে নিব জেনি। তবে আফজালকে বল আমার সাথে এসে কথা বলতে।”
৩৬.
এতোক্ষণ পাশে বসে বাবা মেয়ের কান্ড দেখছিল লাইলি বেগম। এবার হিংস বাঘের মতো গর্জে ওঠে বলল-
“ক্যান আপনার মেয়ে আপনি বাপ। আপনি নিজে যাবেন আফজাল ভাইয়ের কাছে, সে আসবে কেন? আর আজ যদি আপনি না যান তবে আমি আমার মেয়ে নিয়ে বাপের বাড়ি চলে যাব। এতকাল সব পাগলামি সহ্য করছি কিন্তু এখন আমার মেয়েটার জীবন চোখের সামনে শেষ হতে দিব না।”
স্ত্রী কথায় ভয়ে পেয়ে যায় ফোরকান সাহেব। লাইলি বেগম এক কথার মানুষ সহজে রাগে না আর রাগলে থামানো মুশকিল। আনেক ভেবে সিদ্ধান্ত নেয় সে নিজেই যাবে মেয়ের বিয়ের কথা নিয়ে।
এদিকে অনেক কষ্টে আকাশ তার বাবাকে রাজি করায়। আফজাল সাহেব ওঠে ফোরকান সাহের কাছে যেতে নিলে দরজার ফটিক দিয়ে ফোরকান সাহেব কে আসতে দেখে দৌড়ে এসে নিজের জায়গায় ভাব নিয়ে বসে পড়ে। এই বয়সে তার এমন পাগলামি দেখে আকাশ ঠোঁট চেপে হেসে ওঠে।
দুই পরিবার কথা বলে সিদ্ধান্ত নেয় জেনি আর আকাশকে তারা পালিয়ে দূরে পাঠিয়ে দিবে। নয়তো যাদের সাথে ওদের বিয়ে কাল ঠিক করেছে তারাও নামি দামি লোক হঠাৎ বিয়ে ভেঙ্গে দিলে থানায় কেস দিয়ে দিতে পারে।
দুজনে বাবাদের পাগলামি দেখে গোপনে হেসে উঠে।
মেহেতা বেগম আর লাইলি বেগম বসে বসে পিঠা আর নাস্তা একটা বড় ব্যাগে ভরছে। এই দিয়ে নয় বাটা শুকনো পিঠে ব্যাগে রাখছে। বাসার কাজের লোক জব্বার চোখ দুটি বড় বড় করে বাড়ির মালকিনদের কাজ দেখছে। ফোরকান গোপনে একটা গাড়ি ভাড়া করেছেন, সেই গাড়িতে সবাই মিলে মালামাল রাখছে। আজ আর একটু রাত হলেই আকাশ আর জেনি এই গাড়িতে পালিয়ে যাবে।
গাড়ির সিটে বসে দুজনে অবাক। এত মালামাল দেখে জেনি জিঙ্গেস করে-
“আমরা তো পালিয়ে যাচ্ছি নাকি ডাকাতি করে পালাচ্ছি বলো তো, এত কিছু কেন?”
জেনির কথায় আকাশের মা মেহেতা বেগন বলেন-
“এক সপ্তাহের জন্য যাচ্ছিস, এগুলো সব লাগবে। আর শুন পিছনের ব্যাগে তোর পছন্দের নাড়ু আছে খেয়ে নিস। আর সাবধানের থাকিস। বাড়ি জব্বারের ফোনে প্রতি মিনিটে মিনিটে ফোন দিবি আমাদের কারো ফোনে ফোন দিবিনা সমস্যা হতে পারে।”
ওরা সবার কাছে বিদায় নিয়ে বেড়িয়ে পরে। জেনির সবার পাগলামি দেখে মুচকি হেসে আকাশের দিকে তাকিয়ে বলে-
“অবশেষে আমাদের একটা ইচ্ছে পূরণ হলো। পালিয়ে বিয়ে।”
আকাশ জেনির কথায় ভ্রু কুচকে জিঙ্গেস করে-
“এটাকে পালিয়ে বিয়ে বলে?”
ওরা ওদের বাসা বরিশাল থেকে গাড়ি করে ঢাকায় রুদ্রের বাসায় চলে আসে।
জেনি আপু আর আকাশ ভাইয়া কে এক গাড়ি মালামল দেখে আমি অবাক হয়ে যাই। কাছে গিয়ে জিঙ্গেস করি-
“ভাইয়া তোমরা কি বিয়ে সাদি করে একেবারে চলে এসেছ। কই বললে না তো তোমাদের বিয়ে?”
আকাশ ভাইয়া একটু দম নিয়ে বলে-
“আরে ভাবী বাসা থেকে বিয়ের জন্য পালিয়ে এসেছি।”
আমি ভ্রু কুচকে গাড়ির দিকে ইশারা করে বললাম-
“এসব কেন?”
আমার কথা শুনে সিড়ি দিয়ে নামতে নামতে রুদ্র স্যার বলে-
“মেঘ তুমি এসব বুঝবে না। ওদের পরিবার বাংলা সিনেমা কেও হার মানায়। এক গাড়িতে বস্তা বস্তা সবই খাবার। আংকেল আন্টি ওদের তিন চার দিনের খাবার ভেবে পাঠিয়ে দিয়েছে। কি তাই না জেনি?”
,
জেনি আপু তার বাসায় কি কি হয়েছে সব আমাকে খুলে বলতে আমি হাসতে হাসতে শেষ। তখন কপাট রাগ নিয়ে জেনি আপু বলে-
“মেঘ তুমি হাসছো? তুমি জান যখন শুনি আমার বিয়ে অন্য কোথাও ঠিক করেছে কতটা কষ্ট পাইছি।
জেনি আপুর মুখ থেকে কথা টানে নিয়ে আকাশ বলে-
“আর বলো না মেঘ ভাবছিলাম এইবার বুঝি পেত্নিটা ঘাড় থেকে উঠবে। কিন্তু তাও হলো না আরো বেশি করে চেপেছে।”
আকাশ ভাইয়ার কথা শুনে জেনি আপু পিঠে কয়েকটা কিল বসিয়ে দিতেই আকাশ ভাইয়া দৌড় দেয় পিছন পিছনে জেনি আপুও ছুটে যায়।
আমি তাদের দিকে তাকিয়ে উপরে উঠতে নিলে মাথা ঘুরে সিরি থেকে পড়ে যাই। দৌড়ে রুদ্র আমার কাছে এসে কোলের মাঝে নেয় কিসব বলতে থাকে আমি অনেক কষ্টে চোখ খুলে রুদ্রকে কিছুক্ষণ দেখি। তারপর চোখ বন্ধ হয়ে যাই আমার।
,
,#সংসার
#পর্ব_২৪ (অন্তিম পর্ব)
#লেখিকা_সুরাইয়া_ইসলাম_সানজি।
আমি তাদের দিকে তাকিয়ে উপরে উঠতে নিলে মাথা ঘুরে সিরি থেকে পড়ে যাই। দৌড়ে রুদ্র আমার কাছে এসে কোলের মাঝে নেয় কিসব বলতে থাকে আমি অনেক কষ্টে চোখ খুলে রুদ্রকে কিছুক্ষণ দেখি। তারপর চোখ বন্ধ হয়ে যাই আমার।
৪৭.
চারপাশে নিরব নিস্তব্ধতা, মাথা ঝিমঝিম করছে। আমি মাথা ধরে বিছানায় উপর ওঠে বসি। সামনেই রুদ্র চেয়ারের উপর বসে বসে ঘুমাচ্ছে। আমার ঠিক পাশের বেডে আকাশ ভাইয়া ঘুমাচ্ছে আর তার পাশ ঘেসে রাইমা আপু দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে বসে ঘুমাচ্ছে। আমি চারপাশে তাকিয়ে বুঝার চেষ্টা করছি আমরা কোথায় আছি। এটা কোন হাসপাতালের রুম। পিনপতন নিরাবতার মাঝে কেউ পাশের রুম থেকে মাঝে মাঝে একটু কেশে ওঠে আবার নিরব হয়ে যাচ্ছে।
আমার ডান হাত রুদ্র ধরে রেখেছে, আমি আস্তে আস্তে হাত সরিয়ে নিতে গেলে রুদ্র জেগে যায়।
“তুমি জাগলে কখন, এখন কেমন লাগছে।”
আমি মাথা নেড়ে বললাম-
“হুমম ভালো লাগছে। আমরা এখানে কেন?”
রুদ্র মুচকি হাসলো-
“তোমাকে ছোট্ট আর একটা এনে পূর্নতা দিলে আমাকে কি দিবে বলো?”
আমি তার কথা না বুঝে বললাম-
“উহু আমার ছোট্ট পূর্ণতা না, একটা ছোট্ট পূর্ণক চাই আপনার মতো।”
“না আমার তো তোমার মতো একটা মেয়ে চাই। যে কি রাগী হবে তার আধো অধো ভাষায় তোমার মতো শাসন করবে। আমার দুটো পূর্ণতা চাই।”
আমি একটু ভেবে বলি-
“আমার তাহলে দুটোই চাই, একটা ছোট পূর্ণতা আর আপনার মতো একটা পূর্ণক।”
আমার কথায় রুদ্র মুচকি হেসে ডান হাতটা আমার পেটের উপর রেখে বলে-
“এখানে ছোট্ট একটা বাবু নিয়ে এসেছি। এবার থেকে আমাকে বেশি বেশি আদর দিতে হবে।”
আমি রুদ্রের কথায় অবাক হয়ে ভ্রু কুঁচকে রুদ্রের দিকে তাকালে রুদ্র বাঁকা হেসে মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলে। আমি কিছুক্ষণ অবাক হয়ে পেটের দিকে তাকিয়ে থাকি। এখানে আমার আর একটা সোনামনি আছে। আমি কিছুক্ষণ পর রুদ্রের দিকে তাকাই। খুশিতে রুদ্রের চোখে জল চিকচিক করে ওঠে। আমি দু হাত মেলে দিলি রুদ্র আমাকে জড়িয়ে ধরে কপালে চুমু খায়।
“মেঘ আজ আমি ভীষণ খুশি। আমার জীবনের সব থেকে খুশির দিন আজকে। তোমাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ আমাকে এত সুখ দেওয়ার জন্য। পৃথিবীতে ‘আপনি বাবা হতে চলেছেন’ এর থেকে মধুর বাক্য আর কিছু হতেই পারে না মেঘ। তুমি কখনো মা হতে পারবে না বলে মা তোমার থেকে আমাকে কেড়ে নিয়েছিল। কিন্তু আজ দেখো আল্লাহ আমাদের সব সুখ দিছে। আজ আমরা পরিপূর্ণ সুখী। আমাদের সংসারে কোনো অপূর্ণতার ছাপ নেই।”
রুদ্রের কথায় আমার চোখ থেকে জল গড়িয়ে পরে। শেষের কথা গুলো আমার চরম সত্যের কথা মনে করিয়ে দেয়। আমি যে মা হতে পারব না আর মা হলেও মৃত্যুর আসঙ্খা আছে। কথাটা মনে পরতেই আমার আত্মা কেঁপে ওঠে। না আমি কখনো রুদ্রকে আর পূর্ণতা ছেড়ে যেতে পারব না। আর না তো এই সাজানো সংসার ভাঙ্গতে পারব।
আমি রুদ্রুকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরি।
“রুদ্র আমি আপনাকে ছাড়া কোথাও যেতে পারব না। কোথাও না। খুব ভালোবাসি আপনাকে।”
আমার কথায় মুচকি হেসে রুদ্র বলে-
“এই মেঘ পাগল হয়ে গেলে? কোথায় যাবে তুমি? কি ভাবছো আগের বার যেতে দিছি বলে এবার যেতে দিব?
বাবা মেয়ে মিলে পা ভেঙ্গে ঘরে বসিয়ে রাখব। তখন একটা জিনিস খুব ভালো হবে আদর করতে গেলে লজ্জায় পালিয়ে যেতে তো পারবে না।”
আমি রুদ্রের কথায় শব্দ করে কেঁদে ওঠি। রুদ্র আমাকে শান্ত করে বলে-
“আরে বোকা কাঁদছো কেন? এটা তো আমাদের খুশির দিন কান্না মানায়? দাড়াও তো রাইমা, ফুপি বার বার ফোন দিছিলো ওদের খুশির সংবাদটা দিয়ে নেই।”
আমি রুদ্রের কথায় ভয়ে কেঁপে ওঠি ফোনটা হাত থেকে কেড়ে নিতেই রুদ্র বলে-
“মেঘ এত লজ্জায় পাও কেন বলো তো,? মা হবে এখানে তো খুশির খবর আর তুমি লজ্জায় কাউকে বলতে দিচ্ছো না?”
আমি মুখে হাসি টেনে বললাম-
“উহু এটা এভাবে বলব না। সবাইকে সারপ্রাইজ দিব। কয়েক মাস যাক তারপর পূর্ণতার জন্মদিনে সবাই এই খুশির সংবাদটা দিবো।”
রুদ্র মাথা নেড়ে মুচকি হেসে বলে-
“পাগলি”
আকাশ ভাইয়া আর জেনি আপুকেও সবাইকে বাবু হওয়ার কথা বলতে রুদ্র নিষেধ করেছে, সারপ্রাইজ দিবে বলে। আমি বাসায় এসে রুদ্রের আনন্দ দেখে ঠোঁট টিপে কান্না আটকাই পূর্ণতাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরি। কি করে বলব আমার বাচ্চা জন্ম দেওয়ার ক্ষমতা কতটুকু। আজ যদি বলতাম তবে যে করেই হোক এভারেশন করাত আর আমি কিভাবে পারতাম আমার অনাগত সন্তানকে মারতে। আজ রুদ্রকে যতটা খুশি দেখতে পারছি তা কি কখনো পারতাম?
রাইমা আপুর, ফুপি আর বাবা আমার সব কিছু জানলেও বাহিরের কেউ জানত না। আর কয়েক মাস পর তাদের জানিলে তখন রুদ্র জানলে চাইলেও কিছু করতে পারবে না। পেটের উপর হাত রেখে কয়েক ফোঁটা চোখ থেকে জল গড়িয়ে পরল-
“আমি তোকে কখনোই হারাতে দিব না। নিজের প্রানের বিনিময়ে তোকে এই সুন্দর পৃথিবী দেখাব।”
৪৮.
আকাশ ভাইয়াসআর জেনি আপু আমাদের বাড়িতে এই পাঁচ মাস ধরে লুকিয়ে আছেন। তারা পালিয়ে আসার পর ছেলে পক্ষ আর মেয়ে পক্ষরা অনেক ঝামেলা করে। বাড়ি ভাঙচুর করে।
তখন কথায় কথায় জেনির বাবা ফোরকান সাহেব বলেছিলেন-
“আমরা যে ছেলে মেয়েদের পালাতে সাহায্য করেছি আপনাদের কেন বলব, তাহলে আপনারা যদি ওদের নামে কেস দিয়ে দেন?”
জেনির বাবার বোকামির ফলে তারা সত্যি সত্যি কেস দিয়ে দিছে। তাও আবার মানহাই+নরী নির্যাতন মামলা। সেখানে বলা হয়েছে তাদের মেয়ের সাথে প্রতারণা করে ঠকিয়ে আকাশ পালিয়ে গেছে।
কিন্তু এ নিয়ে তাদের বাবাদের কোন আপসোস নেই দিন দিন আদালতে যেতে অভ্যস্ত তবুও দুই বন্ধু তাদের ছেলে মেয়ে কোথায় আছে বলেনি। আর সেই জন্য এতদিন লুকিয়ে এখানে বসে আছে। যতদিন কেস শেষ না হবে ততদিন না বাড়িতে যেতে পারবে আর না বিয়ে করতে পারবে। আর যদি বাড়িতে যায় তবেই দারোগা তার মেয়ের সাথে বিয়ে দিয়ে দিবে।
,
আকাশ আনমনে জানলার কাছে বসে আছে। জীবনটা তার কাছে ভাল্লাগেনা টাইপ হয়ে গেছে। এতদিনে বউ নিয়ে রোমান্স করার কথা সেখানে এখন ভাইবোনের মতো বাসার ভিতর লুকিয়ে বসে আছে।
“এই জেনি এক গ্লাস পানি দিবি।”
জেনি ফোন টিপতে টিপতে বলল-
“টেবিলের উপর জগ গ্লাস আছে তুই নিয়ে খা। নতুন একটা মাল পেয়েছি। এটাকে পটিয়ে নেই। সালা আমার পিকে কমেন্ট করে ‘সুন্দরী তুমি কি সিঙ্গেল আছো?”
জেনির কথায় আকাশের মুখে কোন ভাবন্তর দেখা গেলো না। সে এগিয়ে এসে গ্লাসে পানি ঠালতে ঠালতে বলল-
“আল্লাহ আমার মতো জীবন তুমি সবাইকে দিও, তাহলে সবাই বুঝবে হবু ব্যাচেলার জামাইদের যন্ত্রণা কতটা কঠিন। বলছিলাম তিন সপ্তাহ অপেক্ষা করতে পারব না সেখানে আজ পাঁচ মাস শেষ হলো।”
জেনি আকাশের কথা শুনেও না শুনার ভাব ধরে ফোন টিপতে থাকলো।
“ও জেনি শুন না? ওইই শুনতে পারছিস তুই।”
আকাশ জোড়ে চেচিয়ে ওঠলে জেনি চেচিয়ে ক্ষিপ্ত গলায় বলে-
“কানের পাশে ভ্যা ভ্যা করিস ক্যান? কি বলবি বল শুনতে পারছি।”
“একটু বাহিরে ঘুরতে যাবি?”
“পুলিশের ডান্ডা খেতে নাকি?”
“আরে চল না ঢেকে ঢুকে যাব, কেউ ধরতে পারবে না।”
“আচ্ছা যাব। দুদিন পর পূর্ণতার জন্মদিন ওর মার্কেট করতে যাব। মেঘ কে জিঙ্গেস কর কখন যাবে?”
জেনির কথা শুনে আকাশের মুখে হাসি ফুটে ওঠে। গলা চেচিয়ে বলে-
“ওও ভাবী, ভাবী শপিংয়ে কখন যাবে। এখানে এর একটু থাকলে মরে যাব। আমাকে বাঁচাও।”
আকাশের চিৎকার শুনে বিরক্ত হয়ে তাকায় আকাশের দিকে। আজকাল আকাশের ওভার এক্টিনয়ে বিরক্ত হয়ে গেছে। যখন জেনি বাহিরে যেতে চায় তখন নেওয়ার ধারে কাছেও যায় না। অথচ যখন যেতে পারবে না তখন আকাশের যেতেই হবে। যতসব বিরক্ত কর।
,
,
সকাল বেলা গোসল করে আয়নার সামনে চুল আচড়াতে গিয়ে আয়নার চোখ পড়ে আমার। পিটপিট করে রুদ্র বেডের উপর শুয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি আয়না থেকে চোখ সরিয়ে পিছন ফিরে রুদ্রের দিকে তাকিয়ে ভ্রু কুঁটকে কি হইছে জানতে চাইলে রুদ্র মাথা নেড়ে না বলে মুচকি হাসে।
“তোমাকে আজকাল সিগ্ধ লাগে। পাঁচ মাসে অনেকটা পরিবর্তন এসেছে তোমার মাঝে। গাল হাত পা গুলুমুলু হয়ে গেছে। নাক ফুলটা আজকাল তোমার চেহেরায় চকচক করছে। আচ্ছা গর্ভবতী মেয়েদের সবাইকে কী এই সময় বেশি সুন্দর লাগে? নাকি শুধু আমার চোখেই?”
আমি রুদ্রের কথায় মুচকি হাসি দিতেই রুদ্র বাঁকা হেসে বলে- “ওগো রমনী এত সুন্দর ঠোঁটে ওমন করে হেসোনা পাগল হয়ে যাব। যদি এই সময়টা এমন সুন্দর লাগে তাহলে আমি দুটো সন্তান না বিশটা সন্তান চাই। অন্তত বিশ বছর তোমার এই সুন্দার্য তো দেখতে পারব।”
জেনি আপু রুদ্রের কথা শুনে রুমে ডুকতে ডুকতে বলে-
“হহ ভাই তোরা বাচ্চা পয়দা করবি আর আমরা ফুপিরা সব গুলো দেখে রাখমু। একদিন সর্বোচ্চ সন্তানের বাবা হয়ে গ্রিস বুকে নাম লেখাবি আর সাথে আমার ছোট করে নাম থাকবে ‘এই সেই মহিলা যে সর্বোচ্চ সন্তান লালন পালন করছেন। আহা কত সুন্দর কথা!”
জেনি আপুর কথায় তাল মিলিয়ে রুদ্র বলে-
“তুই চাইলে এতে আমার কোন আপওি নেই। একমাত্র বান্ধবীর আবদার বলে কথা।”
আমি তাদের কথা শুনে লজ্জায় মাথা নুইয়ে বললাম-
“ছিহহহ। কি সব কথা বলো তোমরা।”
“থাক ভাই তোর এত কিছু করতে হবে না, আগে বউয়ের লজ্জা কমা। আর শুন যা বলতে আসছিলাম কাল তো পূর্নতার জন্মদিন তাই সবাইকে জানিয়ে দিস আর মেঘের এই অবস্থায় মার্কেটে যেতে হবে না তাই আমি রাইমাকে ফোন করে বিকেলে আসতে বলেছি তুই বাকি সবাইকে আসতে বল।”
আমি জেনির আপু কথায় কেঁপে ওঠি। রাকিব ভাইয়ের মা অসুস্থ থাকায় তাদের গ্রামে বাড়ি এতদিন ছিলো বলে কিছুজানতে পারেনি। আজ রাইমা আপু আসলে কি হবে যদি রুদ্রের সামনে সব কিছু বলে দেয়। নাহ যে করেই হোক রুদ্র শোনার আগে আমার রাইমা আপুকে সব বুঝাতে হবে।
আমি গোপনে অনলাইনে কিছু ওষুধ এই ব্যাপারে খাচ্ছি, যেখানে যা শুনেছি সবই নিচ্ছি ইন্টারনেট ঘেটে এর সমাধান হিসেবে পেয়েছি মনে জোর রেখে হাসি খুশি থাকলে আল্লাহ রহমাতে কিছু হবে। আমার মতো এমন অনেকে আছে যারা বাচ্চা জন্ম দিয়ে বেবী মা দুজনেই সুস্থ আছেন। তাহলে আমি কেন পারব না?
৪৯.
বিকেলে জেনি আপু আর আকাশ ভাইয়া মার্কেটে চলে যায় সেখানে রাইমা আপু তার বাসা থেকে আসবে। আমি বেডের একপাশে হেলান দিয়ে বসে গল্পের বই পরছিলাম। রুদ্র উপুড় হয়ে শুয়ে তার পিঠে পূর্ণতাকে বসিয়ে রাখছিল। পূর্ণতা আজকাল অল্প অল্প করে মা বাবা দাদু বলতে পারে। কয়েক পা হেঁটে যায় আর থপ করে বসে পরে। মাঝেমাঝে রুদ্র ধমক দিলে খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে। আজকাল পূর্ণতাকে নিয়েই আমাদের দিন কেটে যাচ্ছে।
আমি গল্প পড়তে পড়তে রুদ্রের দিকে তাকিয়ে বললাম-
“বুঝলেন রুদ্র সংসার মানেই সংগ্রাম। এখানে কে আসলো কে গেলো সেটা কেউ দেখা না। আর সংসার কারো জন্য বসে থাকে না। তাই কখনো ভেঙ্গে পরবে না এই সংসারকে বাঁচিয়ে রাখতে নতুন নতুন মানুষকে মেনে নিয়ে পাশের প্রিয় মানুষ গুলোকে গুছিয়ে রাখতে হয়।”
আমার কথায় আগামাথা না পেয়ে রুদ্র তাকিয়ে থাকে। হঠাৎ লাফিয়ে ওঠে, পূর্ণতা পিঠের উপর বসে বমি করছে। ভরা পেটে পিঠের উপর নিয়ে নাড়াচাড়া দেওয়ার জন্য এমনটা করছে। আমি রুদ্রের অবস্থা দেখে খিলখিলিয়ে হেসে ওঠি। আমাকে হাসতে দেখে পূর্ণতা হাত পা জোড়ে জোড়ে নাড়িয়ে হেসে ওঠে। মনে হচ্ছে সে বহুত ভালো কাজ করে।
রুদ্র কিছুখণ আমার দিকে আবার কিছুখণ মেয়ের দিকে তাকিয়ে বলে- “মা মেয়ে দুজনেই আমার বিপক্ষে। এসব সব বিপক্ষ দলের ষড়যন্ত্র।”
রুদ্র টাওয়াল নিয়ে ওয়াশরুমে শাওয়ার নিতে যায় আর আমি পূর্ণতাকে খাটের উপর শুইয়ে ঘুম পরাই। তখনই রেগেমেগে রাইমা আপু আসে।
“মেঘ এসব কি শুনছি? তুমি প্রেগনেন্ট আর আমাকে জানাও নাই তুমি? কি করে এতবড় সত্যি লুকালে? তুমি কী সব ভুলে গেছ? কি হতে পারে এর পরিনিতি।”
আমি রাইমা আপুকে আর বলার সুযোগ না দিয়ে বারান্দায় টেনে নিয়ে আসি। রুদ্র শাওয়ার নিচ্ছি যদি শুনতে পাই গন্ডগোল বেঝে যাবে।
বারান্দায় নিয়ে এসে ফিসফিসিয়ে বলি-
“আপু আমি কিছু ভুলেনি সব মনে আছে আমার, তুমি এসব রুদ্রকে বলো না। তাহলে ও আর কিছুর বলার সুযোগ রাখবে না বাচ্চা নষ্ট করাবে। আমি আমার সন্তান কে হারাতে পারব না।”
হাতের ইশারায় রুমের দিকে ইশারা করে বললাম-
“ওই দেখো রুমে প্রত্যেকটা খেলনা দুটো দুটো করে কিনে সারা রুম সাজিয়ে রেখেছে। রুদ্রের এমন ছেলে মানুষি আমি আর কখনো দেখিনি। ওর এত খুশি গুলো কি করে কেড়ে নিবো বল। রুদ্র যদি এসব ব্যাপারে জানতে পারে তবে ও খুব কষ্ট পাবে সাথে আমাদের অনগত সন্তান কে মেরে ফেলে আমাকে বাঁচিয়ে রাখতে দ্বিতীয় বার ভাববে না কিন্ত আমি আমার জীবনের বিনিময়ে বাবুকে চাই।”
“মেঘ তুমি একবার ভাবো তোমার কিছু হলে ভাইয়া কি করে বাঁচবে? আর পূর্ণতার কি হবে ভাবতে পারছো? আমরা সবাই ওকে আদর করলেও কিন্তু কতক্ষণ আর সেইটা থাকবে ও তোমার মত অন্য কারো কাছে ভালো থবে?”
আমি চোখের জল টুকু মুছে বললাম-
“আমি আর কিছু ভাবতে চাইনা আপু। আমি রুদ্রকে খুশি রাখতে চাই। বাঁচতে পারব কি না জানিনা তবে শেষ কথাটা রেখো রুদ্রকে কিছু জানাবে না। তোমার পায়ে পরি।”
আমি কথা বলে চলে আসতে নিলে ধমকে দাড়াই। কালো টিসার্টে রুদ্র আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে দু হাতে দুটো কফির মগ।
রুদ্র কফির মগটা পাশে রেখে আমার পাশ ঘেসে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল-
“তুমি ভাবলি কি করে আমি আমার সন্তান কে মেরে ফেলব, আমার কি ওর জন্য মায়া নেই? কিন্তু আমার তোমাকে চাই। আমি তো তোমার সব কথা রেখেছি তার বিনিময়ে তুমি আমাকে এই রকম শাস্তি দিতে পারো না। এতবড় সত্যিই টা লুকিয়ে রাখলে? আমার কথা একবারও ভাবলে না, আমি কখনো তোকে ক্ষমা করব না কখনো না।”
রুদ্র রাগে সেখান থেকে রাগে দরজায় লাথি মেরে চলে যায়, পিছন পিছন রাইমা আপু রুদ্রকে ডাকতে ডাকতে তার দিকে ছুটে যায়।
৪৯.
আজ বাসায় থমথমে পরিবেশ। ফুফির বার বার কল দিয়ে যাচ্ছে আমার ধরার মতো সাহস হচ্ছে না। কিছুক্ষণ আগে রুদ্র আমার হাত ধরে তার জীবন ফিরিয়ে দিতে বললেও আমি তার কথায় বলেছি এভরোশন বাদে যে কোন কথা মেনে নেব। যদি আমাকে জোর করে তবে সারাজীবনের জন্য এ বাসা ছেড়ে চলে যাব। অন্তত আমার সন্তান তো বেঁচে থাকবে। আমার কথা শুনে রুদ্র রাগে রুমে সব জিনিস পএ ভেঙ্গে রুম থেকে চলে গেছে।
আমি ক্লান্ত শরীর নিয়ে পূর্ণতার পাশে শুয়ে পরি। পূর্ণতাকে জড়িয়ে ধরে কান্না করতে করতে ঘুমিয়ে পরি। মাঝ রাতে কারো কান্নার শব্দে ঘুম ভেঙ্গে গেলে দেখি রুদ্র আমার পাশে শুয়ে জড়িয়ে ধরে বাচ্চাদের মতো কাঁদছে। রুদ্রকে এমন অবস্থায় দেখে মনটা হুহু করে কেঁদে ওঠে। আমি ওঠে বসতেই রুদ্র আমার কোলে মাথা রেখে ছোট বাচ্চাদের মতো বলে ওঠে-
“মেঘ আমারকে ছেড়ে কোথাও যেও না, তোমাকে ছাড়া আমি বাঁচবো না।”
চোখের জল টুকু মুছে আবার কড়া গলায় বলে ওঠল- “তোকে আমি কোথাও যেতে দিব না, কোথাও না। এত সাহস তোর হয় কি করে আমাকে ছেড়ে চলে যাবি?”
এইটুকু বলতেই হুহু করে আবার কেঁদে। রুদ্রের চোখের পানি দেখে আমিও ডুকরে কেঁদে ওঠি।
,
,
আজ দুটো মাস পার হয়ে গেছে। এই দু মাসে রুদ্র বেশ পরিবর্তন হয়েছে, প্রয়োজন ছাড়া কথা বলে না। কিছু জিঙ্গেস করলে হু হা বলে উওর দেয়।
জেনি আপু আর আকাশ ভাইয়া আজ চলে যাবে। এক সপ্তাহ পর তাদের বিয়ে। তাদের নামে যে কেস চলছিল সেটা এখন বন্ধ। সেখানে দারোগার মেয়েই নাকি অন্য ছেলের সাথে পালিয়ে গেছে তাই তার কেস তুলে নিয়েছে।
জেনি আপু চলে যাওয়ার সময় আমাকে জড়িয়ে ধরে কান্না করেছে। রুদ্রকে সব কিছু বুঝিয়ে দিয়েছে যাতে আমার সাথে ভালো ভাবে কথা বলে।
আমি ডাক্তারের কাছে যাচ্ছি চেকআপের জন্য। রুদ্র সাথে করে নিয়ে আসলে হাসপাতালের ভিতর ঢুকেনি রাইমা আপুকে ডেকে তার সাথে পাঠিয়ে দিয়েছে।
ডাক্তার আজ চেক করে রাইমা আপুর দিকে তাকিয়ে বলে-
“ডাক্তার রাইমা মিসেস রুদ্রের কন্ডিশণ খুব ভালো, নিয়মিত ওষুধ খেলে মনে জোড় রাখলে আসা করি কিছু হবে না। সামনের মাসে আবার একটু আসবেন তাহলে বুঝতে পারব সম্পূর্ণ আশঙ্কা মুক্ত হয়েছে কি না।”
আজ রুদ্র একটু সাধারণ ব্যবহার করলেও প্রতিদিনের মত আজও রাতে রুমে আসেনি। আমি জেগে বসে আছি রুদ্র আসলে কথা বলব। ও এমন করলে কখনোই মনে জোড় রাখতে পারব না।
আমি বারান্দায় বসে অপেক্ষা করতে করতে সেখানেই ঘুমিয়ে পরি। রাতে কপালে কারো স্পর্শ পেয়ে চোখ মেলে তাকাতেই দেখি রুদ্র আমার সামনে বসে আছে।আমি রুদ্রকে দেখে উৎসাহ গলায় বললাম-
“জানেন আজ ডাক্তার কি বলেছে।”
রুদ্র গম্ভীর গলায় উওর দিল-
“হুমম জানি।”
আমি কিছুক্ষণ নিরব থেকে বললাম-
“এমন করছেন কেন? আমার আপনাকে এখন খুব প্রয়োজন আর আপনি এমন কেন করছেন?”
রুদ্র আমার কথার উওর না দিয়ে বলল-“সেদিন বই পরতে পরতে ওই কথাগুলো মানে কি এটা ছিলো মেঘ?তুমি কেমন করে ভাবছো তুমি চলে গেলে আমি অন্য কাউকে মেনে নিতে পারব। আমি নিজেই তো মরে যাব।তুমি ভুলে গেছো সংসার হয়ত থেমে থাকেনা কিন্তু থেমে থাকে মানুষের মন।”
৫০.
আর দুইদিন পর আকাশ ভাইয়াদের বিয়ে। তারা খুব আপসোস করছে আমরা যেতে পারব না বলে। রুদ্রকে বার বার ফোন করে জিঙ্গেস করছে কখন কোনটা করবে তাকে রুদ্র কিছু বললে উওরে একগাল হাসি দিয়ে বলে- “দোস্ত রাগ করিস ক্যান জীবনের প্রথম বিয়ে আমি কি এসব নিয়ম টিয়ম জানি? তাছাড়া আমার সব কিছুতে তুই যত উপদেশ দিছিস সব কিছু ভালো হয়েছে।”
রুদ্র এই কদিনে স্বাভাবিক ব্যবহার করা শুরু করেছে। আমাকে হাসিখুশি রাখার জন্য প্রানপণ চেষ্টা করছে। ফুপি বাবা শাশুড়ি মা প্রথম প্রথম রেগে থাকলেও এখন রিপোর্ট সাধারণ শুনে সবাই খুশি। ফুপি ছোট বাবুদের বেশ কিছু কাঁথা পাঠিয়েছেন। সেই সাথে রাইমা আপুও সুন্দর সুন্দর ডিজাইনের খাতা দিয়ে গেছেন।
রাইমা আপুর কথা মনে পরতেই তাকে ফোন দিতে বলে।
“মেঘ আমি আরো কিছু কাঁথা বানিয়েছি। এখন ভাবছি এগুলো কি করে দিব দুদিন খুব ব্যস্ত থাকব তারপর দিয়ে যাব কেমন। আর তুমি নিয়মিত ওষুধ খাবা ঠিক আছে।”
আমি রাইমা আপুর কথার উওর না দিয়ে বললাম-
“আপু বাবুদের এত কাঁথা লাগে? তাছাড়া পূর্ণতার কাঁথাও তো আছে। আচ্ছা শুনো আমি একা একটা কাঁথা সেলাই করছি। যেখানে আমার রুদ্রের আর পূর্ণতার নাম লিখছি। এখন রুদ্র চাচ্ছে মেয়ে হলে মেঘলা নাম রাখবে আর ছেলে হলে পূর্ণক। কিন্তু কাঁতার শেষে কি নাম লিখবো বলো তো?”
আমার কথায় রাইমা আপু হেসে দিয়ে বলে-
“তোমরা দুজনেই পাগল হয়ে গেছো বুঝলে। তুমি কাঁতার নামের জায়গা ফাঁকা রাখো বাবু হওয়ার পর লিখো কি নাম লিখবে।”
“ইশশশ আমিও কি বোকা। ভাবছিলাম দুটো নামই লিখে রাখবো।আর তো মাএ দুই মাস তারপরই লিখতে পারবো।”
আমার জেনি আপুদের বিয়ে যেতে ইচ্ছে করলে রুদ্র কে বলি। প্রথমে নিষেধ করলেও পরে রাজী হয়। এই অবস্থায় গাড়িতে যাওয়া ঠিক হবে না তাই লঞ্চ যাব। ঢাকা থেকে অনেক লঞ্চ বরিশালে যায় সেখানের একটা লঞ্চের কেবিন রুদ্র বুক করে রেখেছে। গ্রামের মনোমুগ্ধকর পরিবেশে বিয়ে ভাবতেই গা শিওরে ওঠে।
ফুপি এই অবস্থায় জেতে নিষেধ করছিলো সাথে জুড়ে দিয়েছিল কিছু আদি নিয়মগুলি। এই অবস্থায় বের হলে নাকি মানুষের নজর পরে।
কিন্তু অনেক বুঝিয়ে সুজিয়ে ফুপি মা কে রাজি করাই। রাইমা আপু প্রথমে বকলেও ওখানে যাওয়ার পর আরো হাসি খুশি থাকতে পারব ভেবে কিছু বলে না।কিন্তু সবার কড়া নিষেধ বিয়েতে যেন লাফালাফি না করি।
,
,
আজ মেঘলা আকাশ। চারপাশের প্রকৃতি ধমকা হাওয়ায় জানান দিচ্ছি আজ কাল বৈশাখী ঝড় হতে পারে।
আমি কেবিনের জানালা দিয়ে বাহিরের পরিবেশ দেখছি। আমার জীবন কোথা থেকে কোথায় এসে দাড়িয়েছে। রুদ্র পাশে পূর্ণতাকে কোলে নিয়ে কিছু খাবার আনতে গেছে। হঠাৎ পাশে রুদ্র ফোন বেঝে ওঠায় দেখি আকাশ ভাইয়া কল দিচ্ছে।
“হ্যা রুদ্র, শুন আজকে তো,,,
“ভাইয়া আমি মেঘ। রুদ্র বাহিরে গেছে। ওইতো আসছে এই নেন।
“রুদ্র এই শুন না ভাই। আজকে জেনির বোনেরা আসবে ওদের তো আমি এতকাল বোন ডাকছি এবার কি শালি বলতে হবে। নাকি বোন ডাকলে মাইন্ড করবে।”
“আরে ভাই তোর যা খুশি ডাক। এবার ফোন রাখ, আমরা আসতেছি তারপর দেখা যাবে, রাখছি।”
“ওই ওই ফোন কাটিস না আর একটা কথা শুন, জেনি এখনো আমাকে আকাঈশ্যা বলে ওরে কি করলে আর ডাকবে না বল তো?”
“তুই বিয়ের ঠেলায় পাগল হইছিস বুঝছি। আচ্ছা শুন জেনিকে তুই আগের মতো করে জেনি ছেনি ডাক দেখবি ও শুধরে যাবে। কাটা দিয়ে কাটা তুলতে হয়। রাখছি এখন লঞ্চ ছাড়ছে।”
ফোন কাটতেই এতক্ষণ চেপে রাখা হাসি হাসতে থাকি। আমাকে হাসতে দেখে বলে-
“হহ তোমরা দুজনে প্রশ্ন করতে করতে আমাকে পাবনায় দিও।”
,
,
মাঝরাতে হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে ওঠে বসি। ওয়াশরুমে যেতে হবে। ঝড় ওঠেছে বাহিরে নামতে ভয় করলেও আমি গুটিগুটি পায়ে নামতে নিলে রুদ্র ওঠে বসে। আমাকে ধরে ওয়াশরুমের দিক নিয়ে আসে। আজ পেটে খুব ব্যাথা করছে, এখনো তো দুমাস বাকি তবে কিসের ব্যাথা?
কিছুক্ষণের মাঝে ঝড় ভয়ংকর রুপ নেই। ঝড়ের জন্য লঞ্চের ভিতরে বসা মানুষ এপাশ থেকে ওপাশে যাচ্ছে। আমি রুদ্রকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরি। রুদ্র আমার বাহু ধরে শান্ত হতে বলে কেবিনের দিকে পা বাড়ায়।
হঠাৎ লঞ্চে ভিতর বিকট আওয়াজের শব্দ হয়, সবাই চিৎকার চেচামেচি করছে ইন্জিনরুমে আগুন লেগেছে। আমি ভয়ে রুদ্র বাহু শক্ত করে ধরি। লঞ্চে একপাশ থেকে পানি ডুকতে শুরু করেছে। অন্যপাশে আগুন ধরেছে। হঠাৎ আমি পূর্ণতা পূর্ণতা বলে চিৎকার করে ওঠতেই রুদ্র কেবিনের দিকে দৌড়ে যেতে শুরু করে। কেবিনের ওই দিকটায় আগুন ধরেছে। আমরা যে পাশটায় এখান থেকে অনায়াসে নদীতে লাফিয়ে পরে জীবন বাঁচানো যায়। রুদ্র সেখান থেকে আগুনের দিক যাওয়া ধরলে কিছু লোক ওকে টেনে ধরেহ রুদ্র ওদের ধাক্কা মেরে কেবিনের ভিতর ডুকে।
কেবিনে ডুকতেই কিছুখণের ভিতর আমাদের কেবিন আগুনে জ্বলে ওঠে। আমি চিৎকার দিয়ে সেখানেই বসে পরি। চোখ জ্বলছে মাথাটা ভার ভার লিগছে তখনই দেখি রুদ্র পূর্ণতাকে পিঠের উপর নিয়ে লঞ্চের ভিতর যে পানি ডুকছে সেখান থেকে ওঠে আসছে। আমি দৌড়ে রুদ্রের কাছে গিয়ে জড়িয়ে ধরি। রুদ্রের সারা মুখে কালি লেপ্টে আছে। আমি রুদ্রকে ছেড়ে পূর্ণতাকে কোলে নেই। পূর্ণতা নড়ছেনা, একদম শান্ত হয়ে শুয়ে আছে। আমি পূর্ণতাকে কয়েকবার আদরের স্বরে ডাকলে রুদ্র কমল গলায় বলে-
“আমাদের পূর্ণতা আর উঠবে না মেঘ। ও ওর বাবাইয়ের উপর অভিমান করেছে।”
আমি নিঃশব্দে পূর্ণতাকে নিচে শুইয়ে দেই। সবাই যে যেরকম পারছে এখান থেকে বের হচ্ছে। আমার পেটে আবার ব্যাথা ওঠলে আমি চিৎকার করে কুঁকড়ে ওঠি।
রুদ্র আমার পেট চুমু খায়। পরক্ষণেই পূর্ণতার কপালে চুমু খেয়ে ওঠে দাড়িয়ে পূর্ণতাকে কোলে নিয়ে আমার হাত ধরে। আমি ব্যাথায় উঠতে নিলেও বসে পরে। আমার জন্য রুদ্রও যেতে পারছেনা। লঞ্চের একপাশ তলিয়ে গেছে অন্যপাশের আগুন ক্রমশই আমাদের দিকে তেড়ে আসছে।
আমি কোন রকমে লঞ্চের পাশে এসে রুদ্রকে বললাম-
“আমি তোমার কোন কথাই রাখতে পারলাম। আমাকে কখনো ক্ষমা করো না কখনোই না। পৃথিবীর নিয়মই এটা রুদ্র আর মেঘ একই সাথে একই আকাশে থাকতে পারে না। তুমি আমার পূর্ণতাকে আমার বোন বৃষ্টির কবরের পাশে শুইয়ে রেখে দিও।কেউ যেন বিরক্ত না করে। সোনা মেয়ে ঘুমাচ্ছে ঘুমাক। লক্ষি মেয়েটা আমার।”
পূর্ণতার কপালে চুমু খেয়ে রুদ্র কিছু বুঝে ওঠার আগেই রুদ্রকে লঞ্চ থেকে ধাক্কা দিলাম। শরীরটা ক্লান্ত হয়ে আসছে। চারদিকে আগুনের কালো ধোয়া ছেয়ে গেছে।
আমি পেটে হাত দিলাম।
“আমার সোনা আমাকে ক্ষমা করে দিও, তোমাকে বাঁচানোর জন্য আমি জীবন দিয়ে দিতাম। কিন্তু নিয়তি চায়না তোমাকে এই সুন্দর পৃথিবী দেখাতে। থাক বাবা তোমার এই নিষ্ঠুর পৃথিবীতে থাকতে হবে না যেখানে তোমার বাবা মাকে একসাথে রাখতে চায় না। ক্ষমা করে দিও সোনা।”
রুদ্র কে তো পাঠিয়েছি ভাবতেই ঠোঁটের কোনায় মুচকি হাসি ফুটে ওঠে।
তখনই লঞ্চের পাশ থেকে মৃদু শব্দে মেঘ বলে ডেকে ওঠে। আমি সেদিয়ে ওঠে যেতে নিলে পেটে ব্যাথায় বসে পরি হামাগুরি দিয়ে সেখানে এগিয়ে গিয়ে দেখি রুদ্র একহাতে মেয়েকে জড়িয়ে অন্য হাতে লঞ্চের এককোনা ধরে আমাকে ডাকছে। আমি রুদ্রের দিকে তাকালে ও অশহায় চোখে আমার দিকে তাকায় যার মানে সে আমাকে ছাড়া কোথাও যাবে না।
আমি রুদ্রকে দেখে মুচকি হেসে বললাম-
“মেয়েটা তো দিয়ে দিছি আবার কেন আসলে। এই ছেলেটা আমি নিয়ে যাবো একে তোমার কাছে দিলে ওপারে আমি একলা কি করে থাকবো। যাও তো চলে যাও।”
আমার কথা শুনে রুদ্রের গাল গড়িয়ে কয়েক ফোটা জল পরে।
“বড্ড বোকাই থেকে গেলে তুমি আমি তোমাকে ছাড়া একা থাকতে পারি না তুমি ভুলে গেলে?”
রুদ্র পানির ভিতর থেকে আমার বাহু শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। কপালে চুমু খায়। বড্ড বেশি ভালোবাসি ‘সানু’ তোমাকে। এই নিষ্ঠুর পৃথিবীর আমাদের ভালোবাসা সহ্য হলো না।”
,
,
বিয়ের পোশাকে দুজন ছেলে মেয়েকে এত মানুষের ভিড়ে দৌড়াতে দেখে সবাই তাকিয়ে আছে।
পুলিশ নদী থেকে লাস তুলে এক সাথে রেখে কালো কাপড় দিয়ে ডেকে রেখেছে।
আকাশ আর জেনি সকাল থেকে রুদ্র মেঘের অপেক্ষা করতে করতে বিয়ের পিরতে বসেছে তখনই কেউ পাস থেকে বসে ওঠে আজকে ঢাকা থেকে বরিশাল আসার পথে একটা লঞ্চ ঝড়ে ডুবে গিয়ে অনেক মানুষ মারা গেছে। কথা গুলো শুনে শিউরে ওঠে দুজনে ছুটে চলে আসে নদীর পাড়ে। চারপাশে পুলিশ কারো কাছে যেতে দিচ্ছেনা তবুও জেনি আকাশ তাদেল ঠেলে লাসের ভিতরে যায়।
সবাই একটু একটু করে দেখছে এই আশায় যেন এখানে ওদের না পাওয়া যায়। হঠাৎ জেনি থেমে দাড়িয়ে পরে। জেনিকে থামতে দেখে আকাশ ভ্রু কুঁচকে তাকালে জেনি হাতের ইশারা করলে সেদিক তাকিয়ে দেখে একটা ছোট হাত কালো কাপুড়ের পাশ থেকে বেড়িয়ে রয়েছে। হাতে একজোড়া রূপার সাদা চুড়ি। যেটা জেনি পূর্ণতাকে জন্মদিনে পরিয়ে দিয়েছিলো। জেনি সেখানে বসে কাপড় সরিয়ে শক্ত করে ঘুমিয়ে থাকা পূর্ণতাকে জড়িয়ে ধরে। তার পাশেই একে পরের হাত ধরে রুদ্র আর মেঘ শুয়ে আছে। জেনি আর আকাশ কারো মুখে কোন কথা নেই।
আকাশ নিঃশব্দে সেখানে হাঁটু গেড়ে বসে পরে। কিছু লোক সবাই কে এম্বুলেন্সে ভরে ওদের নিয়ে যায় আর আকাশ সেদিকে তাকিয়ে থাকে। চোখের কোনায় পানি গুলি শুকিয়ে গেছি। জেনি পাশে বসে পাগলের মতো কাঁদছে। রাইমা একের পর এক আকাশের ফোনে কল দিচ্ছে।
“আকাশ ভাইয়া, খবরে দেখলাম লঞ্চের আগুল লেগে ডুবে গেছে। ভাইয়া কই ওরা ঠিক আছে তো। ওদের কাছে ফোনটা দাও তো।”
আকাশের কাছে মনে হচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে কঠিন ভাইয়ের মৃত্যু বোনের কাছে বলা। রুদ্রের কাছে জানতে ইচ্ছে করছে ‘আচ্ছা রুদ্র ভাইয়ের মৃত্যু বোনের কাছে কিভাবে বলতে হয়।
,
,
আজ আকাশ বাবা হয়েছে, হাসপাতালে ছোট মেয়েকে কোলে নিয়ে দ্রুত রুদ্রের নাম্বারের ফোন বাবা হওয়ার আনন্দ কিভাবে প্রকাশ করতে হয় জানতে। কিন্তু ফোনের ওপশ থেকে একজন কর্কশকণ্ঠে বল ওঠে নাম্বারটা বন্ধ আছে। আকাশের চোখ থেকে কয়েক ফোটা জল গড়িয়ে পরে। সংসারটা তাদের ঠিক চলছে মাঝে মাঝে দীর্ঘ শ্বাসের কারনে থেমে যেতে হয়। হাসতে গেলে কষ্ট। খুব ইচ্ছে রুদ্রকে জড়িয়ে ধরে ওর দুঃখ আনন্দের মুহূর্তগুলো বলতে।
রাইমা ছোট্ট একটা কেক নিয়ে পা টিপেটিপে ভাইয়ের রুমে ডুকছে। আজ যে তার ভাইয়ের জন্মদিন। পিছন পিছন রাকিব ধীরু পায়ে রুমে ডুকছে।
রুমের ভিতর ডুকতেই কিছু ছোট ছেলে মেয়ের কন্ঠ ভেসে ওঠে- ‘ফুপ্পি আমি এখানে’ শব্দ গুলো কানে যেতেই দু কান চেপে ধরে বসে পরে।
পাশেই চোখ পরে মেঘের বানানো কাঁথার দিকে। নিচের নামটা ফাঁকা পরে আছে। মেঘের হাসি মুখটা চোখের সামনে ভেসে ওঠে। মেঘ মুচকি হেসে বলে ‘এই তো দু মাস বাকি।”
রাইমা কাঁথাটা বুকে জড়িয়ে হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে। রাকিব রাইমার ঘাড়ে হাত রাখতেই রাইমা ওঠে রাকিব কে জড়িয়ে ধরে।
রাকিবের মনে পরে মেঘকে ধন্যবাদ জানানো হয়নি এত ভালো একজন জীবনসঙ্গিনী দেওয়ার জন্য।
তার চোখ থেকে কয়েক ফোঁটা জল গড়িয়ে পরে। চোখের সামনে ভেসে মেঘের বলা কথা গুলো-
“প্রত্যেক মানুষের জীবনে অতিত থাকে। তাকে কখনো ভুলা যায় না। তাকে নিয়ে যত অনুভূতি থাকে সব জীবনের প্রথম অনুভূতি। আপনি যখন সেই অনুভূতির সাম্মোখিন হবেন ততবার আপনার তার কথা মনে পরবে। তাই বলে এই নয় দ্বিতীয় বার কারো প্রেমে পরা যাবে না। প্রেমে মানুষ পরে বহুবার তবে হৃদয়ের প্রেম একবারই হয়। যাকে সে হৃদয়ের ভিতর রেখে দেয়।
তবে বেঁচে থাকা, ভালো থাকার জন্য আমাদের আরো একজনকে বেঁছে নিতে হয়। দিন শেষে অতীত ভুলে সেই মানুষটার খুশির জন্য আমাদের প্রানপণ লড়তে হয়। কারন আমরা সেই মানুষটাকে সুখী দেখতে চাই।”
#সমাপ্ত
(বিঃ দ্রঃ গল্পটা লিখতে গিয়ে অনেক সমস্যা পরতে হয়েছে, থেমে থেমে লেখার জন্য অনেক আগোছালো হয়েছে। যার জন্য অনেক ভুলও হয়েছে কিছু প্রিয় পাঠকরা ভুল গুলো ধরিয়ে দিছেন তাদের অনেক অনেক ভালোবাসা।
গল্পটা সবার কাছে কেমন লাগলো মন্তব্য আকারে বলার অনুরোধ করছি।
এতো ভালোবাসা দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ। আমার জন্য দোয়া করবেন যেন খুব তাড়াতাড়ি আর একটা গল্প নিয়ে আসতে পারি। ভালোবাসা নিবেন।💚💚)