সংসার পর্ব ৩+৪

#সংসার
#পর্ব_০৩

#লেখিকা_সুরাইয়া_ইসলাম_সানজি

( যাদের যাদের রুদ্রকে নিয়ে অভিযোগ ছিলো সবার অভিযোগ কিছুটা হলেও কমিয়ে নিয়ে এসেছি। পরের পার্টগুলোতে আসা করি রুদ্রের উপর আর পুরোনো অভিযোগ থাকবেনা। নতুন করে অভিযোগ যুক্ত হলে লেখিকা কোনো ভাবে দায়ী না।😏

আর গল্পটায় মেইন চরিত্র মেঘ। তাই মেঘের সবদিকটা তুলে ধরেছি। অনেকেরই প্রশ্ন এটা মেঘের এতো কষ্ট কেনো?
শেষ পর্যন্ত পরলে সবটা বুঝতে পারবেন। আর এটা কোনো বাস্তব জীবন কাহিনী না, এটা গল্প শুধু বিনোদনের জন্য। আসা করি গল্পকে কেউ বাস্তব জীবনের সাথে গুলিয়ে ফেলবেন না। ভালোবাসা নিবেন।💚)
,,,,,,,

আমি রাকিব ভাইয়ের কথার জবাব না দিয়ে সেখান থেকে তাড়াতাড়ি চলে আসি নয়তো রাকিব ভাইয়ার কথা আজ আর শেষ হবে না। লোকটা এমনই অদ্ভুত টাইপের। সবার সামনে গেলে গুলি মারলেও প্রয়োজন ছাড়া কথা বলবে না। কিন্তু আমাকে দেখলেই তার সব কথা পেট থেকে একসাথে বের হয়ে আসে।

আমি ফুপিকে সব কিছু গুছাতে সাহায্য করছি। বাবা আজও খুশি তবে মুখের সেই দীর্ঘ হাসিটা নেই। খারাপ হোক বা ভালো হোক দুটোই তার মেয়ে। একজনের বিয়ে ভেঙ্গে গেছে মনের ভিতর কষ্ট থাকলেও অন্য মেয়েটার ভালো জায়গায় বিয়ে হচ্ছে ভেবে বাবা খুশি।
বৃষ্টিকে আজ পরির মতো লাগছে। গা ভর্তি জিনিস দিয়ে সাজানো। আমি বৃষ্টির কাছে যেতে নিলে ফুপি পেছন থেকে হাত মুচড়ে আমাকে টেনে নিয়ে আসে আর কড়া গলায় বৃষ্টির কাছে যেতে নিষেধ করলো, অপয়া মেয়েদের নাকি সুন্দর জিনিসের কাছে যেতে নেই তাহলে সেখানেও খারাপের ছোঁয়া লাগে।

০৫.
সত্যিই কি অদ্ভুত সময়, আজ বৃষ্টির জায়গায় আমার থাকা উচিত ছিলো। কিন্তু আমি আজ বৃষ্টির কাছে যেতেও পারছি না। ফুপি ঠিকই বলে আসলেই আমি অপয়া।
আজ মা কে খুব মনে পরছে। মায়ের কাছে গিয়ে জানতে ইচ্ছে করছে সেও কি তার দুটি মেয়েকে আলাদা চোখে দেখতে পারতো? একজনকে লক্ষী আর অন্যজনকে অপয়া বলতে পারতো?

কিছুক্ষণ আগে রুদ্র স্যার বৃষ্টির হাতে আংটি পরিয়ে দিলো। ফুপি এতক্ষণ আমাকে সবার সামনে আসতে দেয়নি যদি কোনো অমঙ্গল হয় এটা ভেবে। কিন্তু এঙ্গেজমেন্ট শেষ হওয়ার পর রুমের দরজা খুলে দিছে। আমি দৌড়ে রুম থেকে নিচে নামি বৃষ্টিকে দূর থেকে দেখি। মেয়েটাকে রুদ্র স্যারের পাশে খুব সুন্দর লাগছে । দূর থেকেই ওকে মনে মনে দোয়া দিলাম যতোই হোক আমি ওর বড় বোন মায়ের মতো। আমার আপনজন বলতে তো বৃষ্টিই আছে।

আমাকে রাইমা ম্যাম দেখতেই কাছে এসে জিঙ্গেস করে-

“কিরে মেঘ এতখণ কোথায় ছিলে, সারা বাড়িতে তোমাকে খুজেছি কোথাও পাইনি। আসলে তোমাকে ধন্যবাদ দেওয়ার ছিলো। আজ যদি তুমি আমাকে ফোন না দিয়ে দেশে না নিয়ে আসতে, তবে আমি এতো আনন্দ কোথায় পেতাম বলো? তুমি আমার সব ভুল ধারনা দূর করে দিলে ধন্যবাদ তোমাকে। দেখো ওদের দুজন কে কতো সুন্দর লাগছে। বৃষ্টিও তোমারই মতো মিষ্টি একটা মেয়ে।
আরে মন খারাপ নাকি তোমার, এভাবে মুখ করে আছো কেনো? বলছিলাম না কখনো মন খারাপ করবেনা। তাহলে এর জন্য আমি নিজেকে দায়ী মনে করব।”

রাইমা ম্যামের কথা শুনে আমি হেসে দেয়। ইদানীং সব কথাতেই হাসিটা যেনো বাঝে অভ্যাস হয়ে গেছে। এই বাঝে অভ্যাসও বড্ড উপকার করে এর থেকে অনেক প্রশ্নের জবাব সহজেই ইগনোর করা যায়।

চারদিকে তাকিয়ে দেখছি কেউ কেউ খাবার খাচ্ছে আবার কেউ নাচছে এমন সময় রাকিব ভাই মাইকে আমাকে খান গাওয়ার জন্য ডাক দেয়। ছোট থেকেই গানের গলা ভালো হওয়ায় সব অনুষ্ঠানেই গান গাইতাম। আজ তারই সূএ ধরে রাকিব ভাই গান গাইতে সবার সামনে অনুরোধ করছে। চারপাশের লোকজন আমার দিকে তাকিয়ে আছে গান গাওয়ার জন্য অনুরোধ করছে। আমার হাত পা কাঁপছে এখান থেকে দৌড়ে রুমের ভিতর চলে যেতে ইচ্ছে করছে। মাহমুদের সাথে যেদিন থেকে কথা হয়নি তারপর আর গান গাওয়া হয়নি আজ এতোবছর পর গান প্রায় ভুলেই গেছি।

মাইক হাতে নিয়ে লম্বা করে একটা নিঃশ্বাস নিলাম, বাবা বলত এভাবে নিঃশ্বাস নিলে নিজেকে হালকা লাগে। চোখ বুঝে পরিচিত গানটি খাইতে শুরু করলাম। এই গানটা মাহমুদের খুব পছন্দের ছিলো। আগে মাঝে মাঝেই গাইতাম-

তুমি না ডাকলে আসবো না

কাছে না এসে ভালোবাসবো না

দূরত্ব কি ভালোবাসা বাড়ায়

নাকি চলে যাওয়ার বাহানা বানায়

দূরের আকাশ নীল থেকে লাল গল্পটা পুরোনো

ডুবে ডুবে ভালোবাসি

তুমি না বাসলেও আমি বাসি।
………………………………

গানের পুরোটা সময় চোখ বন্ধ করে ছিলাম। গান শেষ করে সবার দিকে ভয়ে ভয়ে তাকালাম। আজ অনেক বছর পর গান গাইলাম কেমন হইছে জানার জন্য সবার দিকে তাকালাম। তখনই সবাই হাত তালি দিয়ে উঠলো। এতো এতো লোকের প্রশংসা পেয়ে আজ খারাপ লাগার ভিতরেও একটু খানি ভালো লাগা কাজ করছে।

এতক্ষণে আমার বৃষ্টির আর রুদ্র স্যারের দিকে চোখ গেলো। রুদ্র স্যার আমার দিকে এক দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে হনহন করে বাহিরে চলে গেলো। সবাই হতবাকের মতো তাকিয়ে আছে হঠাৎ রুদ্র স্যারের চলে যাওয়ার কারন বুঝতে চেষ্টা করছে। স্যার খুবই রাগী তবে হঠাৎ হঠাৎ রাগের বদ স্বভাব তার নেই। কিন্তু এই মুহূর্তে রুদ্র স্যারের মা সব মেহমানদের বুঝলো ‘রুদ্র স্যারের আগে থেকেই মাথা ব্যাথা ছিলো। হঠাৎ মাইকে এই রকম বেসুরো গলায় গান শুনে আরো মাথা ব্যাথা হওয়ায় রাগ করে চলে গেছে।’

সব মেহমান চলে গেছে, আর ১৫ দিন পরে বৃষ্টি আর রুদ্র স্যারের বিয়ে। ফুপি একের পর এক বকে যাচ্ছে কেনো আমি গান গাইলাম তাই। সারাদিনে কিছু খাইনি তাই আমি চুপচাপ বসে বসে খাচ্ছি। এখন আর ফুপির বকা গায়ে লাগে না ছোট বেলা থেকে বকা শুনতে শুনতে অভ্যাস হয়ে গেছে।

“বলি মেঘ তোর ভিতরে আল্লাহ লজ্জা দিতে কী ভুলে গেছিলো? নিজে তো অপয়া তার উপর নিজের বোনেরও ভালো চাস না তুই? এতো বড় বড় মানুষদের সামনে গান গেয়ে গাইকা হতে চেয়েছিলো। তোর ওই বেসুরো গান শুনে ভ্যাগিস তারা আমাদের কিছু বলেনি। আমারই ভুল হইছে তোকে রুম থেকে যেতে দেওয়া উচিত হয়নি।”

“আহ বড় মা, তুমি মেঘকে কেনো বকছো বলো তো? মেঘ কি ইচ্ছে করে গান গাইছে? বকলে আমাকে বকবে আমিই তো মেঘকে গান গাইতে জোর করলাম। আর কে বলছে মেঘ গান খারাপ গায়? গিয়ে দেখো তোমাদেরর আদুরে হবু জামাইয়ের হঠাৎ হঠাৎ মাথা ব্যাথার অসুখ আছে আর সেটা তার মা মেঘের গানের গলা খারাপ বলে কাটিয়ে নিছে। নয়তো মেঘের যা সুরলো গলা ওতে তো মাথা ব্যাথা ভয়ে পালানোর কথা।”

চুপচাপ একবার ফুপির দিকে তাকিয়ে তার কথা শুনছি আবার মুখের খাবার দিয়ে ঘাড় ঘুড়িয়ে রাকিব ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে কথা শুনছি।
খাওয়া শেষ করে বাবার রুমে ওষুধ নিয়ে গেলাম। বাবা বিয়ের জন্য দেশের বাড়ির জমি বিক্রি করবে লোকও ঠিক হয়েছে। দুই দিনের ভিতরে জমি বিক্রি হয়ে যাবে। বিয়ের সব দায়িত্ব বাবা আমাকে আর রাকিব ভাইকে দিয়েছে। রাকিব ভাই এই ১৫ দিন বাড়িতে যাবে না এখানেই থাকবে। আমার এই বিষয়ে খুব বিরক্ত লাগছে রাকিব ভাইয়ের সাথে ১৫ দিন থাকলে নির্ঘাত তার কথা শুনতে শুনতে জ্ঞান হারাবো।

০৬.
আজ দুইদিন পর আবার অফিসে এসেছি। তবে এইবার আর বৃষ্টি আসেনি কেউ কী আর নিজের হবু স্বামীর অফিসে কাজ করে?
অফিসে ডুকতে নিবো তখনই কোথা থেকে রুদ্র স্যার এসে আমাকে টানতে টানতে তার গাড়িতে বাসায়। সবকিছু এতো দ্রুত হয় আমি আহাম্মকের মতো তার দিকে তাকিয়ে থাকি।

প্রায় দুইঘন্টা পর গাড়ি এসে নির্জন একটা জায়গা নদীর পাশে থামে। এই জায়গাটা আমার খুব পছন্দের আগে মাহমুদকে বার বার বলতাম তার সাথে দেখা করলে এই জায়গাতেই করবো।
কিন্তু রুদ্র স্যার কেন এখানে নিয়ে আসলো? মেরে গুম করে ফেলবে নাতো? আর এখানেই বা কেনো আসলো। নানা রকম প্রশ্ন মনের মাঝে উকি দিলেও আমি সব ভুলে প্রকৃতিকে অনুভব করি। এই জায়গা আমার আর বাবার খুব পছন্দের জায়গা। বাবা বলতো এই জায়গায় নাকি মায়ের সাথে প্রথম বাবার দেখা হয়েছিলো। ছোট বেলায় মাঝে মাঝে আমি আর বাবা দুজনে এখানে আসতাম কয়েক বছর থেকে পড়ালেখা আর কাজের ব্যস্ততায় এখানে আর আসা হয়নি। কিন্তু বৃষ্টি ছিলো এসবের ওল্টো আমি আর বাবা এখানে আসলে বৃষ্টি আর ফুপি যেতো শপিংমলে নয়তো কোনো মেলায়।
দুহাত মেলে পুরোনো শৃত্মি গুলো মনে করছিলাম। আমিই ভুলেই গেছি আজ আমার সাথে বাবা নয় রুদ্র স্যার এসেছেন।

হঠাৎ পিছন থেকে আমার গাওয়া সেই পুরোনো কন্ঠের কল রেকর্ড বেঝে ওঠে। এই গান গুলো আমি মাহমুদকে বলেছিলাম। তবে এগুলো রুদ্র স্যার কিভাবে পেলো।

আমি কাঁপা কাঁপা গলায় রুদ্র স্যার কে বললাম-
“এ এ এগুলো আপ আপনার কাছে কিভাবে আসলো, এসব তো আমার মাহমুদের_”

আমাকে আর কিছু বলতে না দিয়ে, আমার কথার মাঝে রুদ্র স্যার বলতে শুরু করলো-
” আমায় চিনতে পারছো না সানু? আমিই তোমার মাহমুদ। এই শুনো আগের সেই ভয়েজ চিনতে পারছোনা তুমি?”

আমি সেই অাগের ভয়েজ, কথা বলার ভঙ্গি শুনে চিনতে পেরে কাঁদতে কাঁদতে ঘাসের উপর বসে অস্পষ্ট কন্ঠে বলি-
“আপনি আমার মাহমুদ? নাহ আপনি কী করে আমার মাহমুদ হবেন? আপনি তো রুদ্র স্যার। আপনি হতেই পারেন না আমার মাহমুদ।”

স্যার আমার সামনে হাটু গেড়ে বসে দু হাত দিয়ে গাল ধরে অভিমান ভরা কন্ঠে বলেন-
“কোথায় চলে গেছিলে সানু? জানো কত কত জায়গায় খুজেছি তোমায়। তোমার নাম্বার, ফেসবুক একাউন্ট সব বন্ধ পেয়ে পাগলের মতো হয়ে গেছিলাম। এই দেখো আজ সেই হাসিখুশি শান্ত ছেলেটা কতো কঠিন মনের হয়ে গেছে। সেদিন তোমাদের বাড়িতে এঙ্গেজমেন্টের সময় তোমার গানের প্রত্যেকটি সুর আমাকে এলোমেলো করে দিয়েছিলো, হৃদয়ে সেই পুরোনো ঝড় তুলেছিলো। তোমার এতোটা কাছে থেকেও আমি তোমাকে চিনতে পারেনি কতোটা হতভাগা আমি।”

আমি শব্দহীন ভাবে স্যারে দিক তাকিয়ে আছি। আজ বড্ড অপরিচিত লাগছে তাকে। স্যার পাগলের মতো করছে। পকেট থেকে ফোন বের করে আমার দিকে ফিরিয়ে বলে-

“এই দেখো আজো পাগলের মতো মেসেজ দেয় তোমাকে তুমি এসে মেসেজ দেখবে, উওর দিবে এই আশায়। তুমি জানো অফিসে যেদিন ইন্টারভিউ দিতে প্রথম এসেছিলে তখন তোমার নাম মেঘ দেখেই রাইমাকে চাকরি দিয়ে দিতে বলি। “সানজিদা সানজি মেঘ” এই নামটা যে আমার কলিজার সাথে মিশে আছে। যেখানেই এই নামের কাউকে দেখতাম সেখানেই তার ব্যাপারে সব জানতে চাইতাম। মনে আছে তোমার এই নামটা কেটে আমি ছোট করে তোমায় সানু নামে ডাকতাম? কেনো এমন করলে বলো তো কেনো না বলে চলে গেলে? কী ভুল ছিলো আমার,কী ভুল ছিলো?”

স্যার ওখানেই ঘাসের উপর বসে হাটু মুড়ে নিঃশব্দে কেঁদে ওঠে।
#সংসার
#পর্ব_০৪

#লেখিকা_সুরাইয়া_ইসলাম_সানজি।

স্যার ওখানেই ঘাসের উপর বসে হাটু মুড়ে নিঃশব্দে কেঁদে ওঠে।

আমি স্যারের দিকে তাকিয়ে বলি-
“আমাদের চিনতে খুব দেরী হয়ে গেছে স্যার। এখন আপনি অন্যকারো হবু স্বামী। আমাদের পুরোনো আবেগ মাখানো সম্পর্কের এখন আর দাম নেই। আমার বাসায় ফিরতে হবে।”

রুদ্র স্যার আচমকা তার দুহাতে আমার হাত ঝাপটে ধরে। মনে হচ্ছে ছেড়ে দিলেই আমি উড়ে যাব।
“না সানু এভাবে বলো না, দেখো আমি সব আগের মতো ঠিক করে নিব। তোমাকে অনেক কষ্টে খুজে পেয়েছি আর হারাতে দিবো না।”

আমি রুদ্র স্যারের বুকের মাঝে চোখ খিচে বন্ধ করে দু হাত মুঠোবন্দী করে আছি। স্যার খুব শক্ত করে জড়িয়ে ধরে আছে। আমাকে কিছু বলতে না দেখে তার বাম হাত সামনে এনে আংটি দেখিয়ে বলে-

“হ্যাঁ তোমার এইটায় তো সমস্যা এই নেও খুলে ফেললাম। আরো সমস্যা হলে আমরা পালিয়ে কোথাও দূরে চলে যাবো। কারো সামনে আসবো না। কারো মুখোমুখি হবো না আর নাতো কাউকে কিছু জানতে দিব, নাতো কারো জবাবদিহিতা দিতে হবে। তোমাকে ছাড়া আমি বাঁচতে পারব না। চলো আমরা অনেক দূরে কোথাও পালিয়ে যাই।”

০৭.
আমি ঘাড় ঘুরিয়ে আংটির দিকে তাকিয়ে কথা গুলো শুনছি। একটু দূরেই ঘাসের ভিতর থেকে রোদের আলো পরে আংটিটা চিকচিক করছে। আমি স্যারের কথায় জবাব না দিয়ে ঘাস থেকে আংটি টা কুড়িয়ে নিয়ে সামনের দিকে হাটা শুরু করলাম। আজ এই সুন্দর প্রকৃতিকেও বিষাদময় লাগছে। ইচ্ছে করছিল পিছন ফিরে একবার দেখি স্যার কি করছে। ইচ্ছাটা চাপা দিয়ে দ্রুত গতিতে সামনের দিকে পা বাড়াই।। এখনো হয়তো জ্বলজ্বল চোখে আমার যাওয়ার পথের দিক তাকিয়ে আছে। যে চোখের দিকে তাকালে আমি আর সামনে যেতে পারবো না, এখানেই থেমে দৌড়ে তার কাছে ফিরে যেতে হবে।

রাস্তায় হাঁটছি আর মনে মনে ভাবছি, আর একবার সুযোগ দিবো নিজেকে সাজাতে। জীবনটা ছেলেখেলা না নিজেকে নিজেরই সাজিয়ে নিতে হবে।
,
,

আজ দুইদিন পর আবার রুদ্র স্যারের সামনে বসে আছি আমার পাশের চেয়ারে গা ঘেঁষে বসে আছে রাকিব ভাই। টেবিলের উপর টুং টাং শব্দ।। আমি আনমনে সেদিনের ঘাসের ভিতর থেকে কুড়িয়ে নেওয়া আংটি টা টেবিলে ফেলছি আবার তুলে একটু উপর থেকে কাচের টেবিলের উপর ফেলছি।
সবকিছু থমথমে নিরবতা। রুদ্র স্যার মুখে একগাল হাসি নিয়ে রেস্টুরেন্টের ভিতর আসলেও রাকিব ভাইকে আমার পাশে দেখে হাসিখুশি মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে চুপসে যায়। নিরবতা ভেঙ্গে রাকিব ভাই বলে ওঠলো-

“রুদ্র সাহেব আপনাদের সম্পর্কে মেঘ আমাকে সব বলেছে। আসলে আমার বলতে একটু খারাপ লাগলেও বাস্তবতা তো অনেক ভিন্ন। আমরা অল্প বয়সে যেটা করি সেটা শুধুই কিছু দিনের আবেগ মাএ। আবেগ কেটে গেলে আমরা দ্রুত সেখান থেকে পালাই।
আরে ওই রুদ্র সাহেব কি ভাবছেন? আমি কি বলছি বুঝতে পালছেন?”

“হ্যাঁ বুঝতে পেরেছি।”

“আসলে আমি আর মেঘ চার বছর ধরে রিলেশনে আছি। ভালো চাকরি করছি না বলে এখনো পরিবারকে জানাতে পারেনি। আপনার সম্পর্কে মেঘ আমাকে কালই প্রথম বলল আসা করি আপনি সব বুঝতে পেরেছেন।”

রুদ্র স্যার রাকির ভাইয়ের কথার জবাব না দিয় আমার দিকে পলকহীন ভাবে তাকিয়ে আছে। আমি তার দিকে তাকাতে তার চোখে আমার চোখ পরে। সেই গভীর চোখ বলে দিচ্চি এসব মিথ্যা আমি এসব বিশ্বাস করিনা। প্লিজ সানু তুমি একবার বলো এসব সত্যি না।
আমি স্যারের চোখের দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে টেবিলের দিকে তাকিয়ে তার সামনে আংটি রেখে ভাঙ্গা গলায় বলি।

“এসব কিছু মিথ্যে না রুদ্র সাহেব। প্রথম জীবনে আবেগের বসে ভুলটা আপনি আকরে ধরে থাকবেন বুঝেনি। তবে এটা আমার ভুল না আপনার ভুল। আপনার বুঝতে সমস্যা হয়েছিল হঠাৎ করে কেউ এমনি চলে যায় না, সব কিছু থেকে ছাড়া পাওয়ার জন্য ছেড়ে চলে গেছিলাম। তবে সেই পিছু ছুটতে ছুটতে আপনি এখানে। ক্ষমা করবেন আমাকে।
এই নেন আংটি, আমার বোনকে কখনো এসব ব্যাপারে জানতে দিবেন না। আমার আবেগ গুলো মিথ্যে হলেও আপনার আবেগ গুলো সত্যিই আর সেই আবেগ আজ আপনার কাছে অনুরোধ করে বলছি কখনো আমার বোনকে কষ্ট দিবেন না। খুব সুখে রাখবেন যতোটা আমাকে রাখতে চেয়েছেন।”

চোখের পাশের জলগুলো লুকাতে দ্রুত পায়ে রাকিব ভাইয়ের হাত ধরে সেখান থেকে বেড়িয়ে আসলাম। রাস্তায় নামতেই হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে। আমার সাথেই কেনো এসব হচ্ছে? সব ভালোবাসা পেয়েও কেনো হারিয়ে ফেলি, আর যে ভালোবাসা হারাবেনা বলে কথা দেয়, তার থেকে পালিয়ে আসতে হয়।
বুক ফেঁটে কান্না আসছে, আজ সারাজীবনের জন্য মাহমুদকে হারালাম, প্রতিদিন একটা আসা নিয়ে বেঁচে থাকতাম হয়তো মাহমুদ একদিন আবার আমার জীবনে আসবে। কিন্তু আজ নিজের ইচ্ছায় সব কিছু হারালাম। হয়তোবা রুদ্র স্যার কখনো এর পিছনের গল্পটা জানতেও পারবেনা। ভুল বুঝে আজীবন ঘৃণা করে যাবে।
নিজের অজান্তেই পাশে থাকা রাকিব ভাইকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকি। ভাইয়া আমাকে বার বার শান্ত হতে বলছে।

আমি পাবলিক প্লেসে আছি মনে হতেই সাথে সাথে রাকিব ভাইকে ছেড়ে দূরে দাড়ায়। হঠাৎ চোখ যায় রুদ্র স্যারের গাড়ির দিকে স্যার আমার দিকে একদৃষ্টিতে ঘৃণার চোখে তাকিয়ে আছে। আমার চোখে চোখ পরতেই স্যার তাড়াতাড়ি গাড়ি নিয়ে দিয়ে চলে যায়।

০৮.
ফ্লাস ব্যাক,,,

সেই দিন নদীর পাড় থেকে এসে সরাসরি বাবার রুমে চলে যায়। বাবার কাছে জীবনের শেষ আবদার হিসেবে আজ রুদ্র স্যারকে চাইবো।
কিন্তু বাবার রুমের সামনে যেতেই দেখি বৃষ্টি, বাবা আর ফুপি বসে কথা বলছে। কিছুক্ষণ আগেই ফুপি আর বৃষ্টি গিয়ে বিয়ের সাজ কিনে নিয়ে এসেছে। বৃষ্টি বাবার সামনে বসে বিয়ের লেহেঙ্গা পরে ঘুড়িয়ে ঘুড়িয়ে দেখাচ্ছে কেমন লাগবে বিয়ের দিন।

বাবার গ্রামের প্রিয় জমি বিক্রি করা টাকা হাতে নিয়ে বসে আছে। একবিন্দু আপসোস হচ্ছেনা তার চোখে মুখে খুশির ঝলক।
“আরে মেঘ মা তুই, আজ অফিস এতো তাড়াতাড়ি শেষ? এই দেখ তোর জন্যও একটা লেহেঙ্গা কিনেছি, বৃষ্টির বিয়ের দিন এটা পরলে তোকে পুতুলের মতো লাগবে মা।”

আমি কাঁপা কাঁপা গলায় নিচু স্বরে বাবার দিকে তাকিয়ে বলি- “বাবা এই বিয়ে যদি না হয়, তাহলে কি হবে? যদি ওতো বড়লোক বাড়ির ছেলে আমার বোনকে বিয়ে না করে? যদি ওই ছেলে কারো হাত ধরে পালিয়ে,,,,,”

আমাকে আর কিছু বলতে না দিয়ে ফুপি রাগে আমার দু গালে দুইটা চড় মেরে চিৎকার করে বলে ওঠলো- “দেখলে দাদা কি অলক্ষুণে কথা তোমার বড় মেয়ের মুখে, অপায়া মেয়েদের মুখে এসব কথা এখন না জানি কি হয়।”

আমি কান্না ভেজা চোখে বাবার দিকে তাকাতেই বাবা বলল- “মারে এমন কথা মুখেও আনিস না। আমার আব্বার স্বপ্নের জমিটা আজ বিক্রি করে মেয়ের বিয়ে দিচ্ছি আল্লাহ না করুক এমন কিছু যদি হয় আমি বাঁচবো নারে মা।”

বাবা মুখে ‘আমি বাঁচবো নারে মা’ এই কথাটা কানে যেতেই মনে হলো কে যেনো বুকের ভিতরে খাঁমচে ধরলো।
দৌড়ে রাকিব ভাইয়ের রুমে গেলাম, এই বাসায় বাবা আর রাকিব ভাইকে মন খুলে ভরসা করতে পারি।
রাকিব ভাইকে গিয়ে সব খুলে বললাম। আর আমাকে এই বিষয়ে সাহায্য করতে বললাম। যদিও রাকিব ভাই প্রথমে রাজি ছিলোনা কিন্তু আমার বার বার অনুরোধ ফেলতে পারেনি।

কেন জানি না বৃষ্টিও সেদিন আমার কাছে এসে সন্দেহের চোখে বারবার অনুরোধ করেছিলো এমন কিছু যেনো না হয়।
পরে রাকিব ভাইয়ের কাছ থেকে জানতে পারি রুদ্র স্যার এঙ্গেজমেন্ট আগেই বৃষ্টিকে তার প্রথম ভালোবাসার কথা বলেছে। সেদিন থেকে বৃষ্টি আমার উপর সন্দেহ করলেও এঙ্গেজমেন্টের দিন স্যারের ওই ভাবে চলে যাওয়া দেখে একে বারে সিওর হয় যে স্যারের প্রথম ভালোবাসা তার নিজের বড় বোনই।
এই কথা গুলো আগে থেকেই ফুপি জানতো তাই এঙ্গেজমেন্টের দিন রুমে আটকে রেখেছিলো।
যেদিন বৃষ্টি ফুপিকে এসব বলেছিলো সেদিনই রাকিব ভাই সব শুনেছিলো কিন্তু কথার অর্থ সেদিন না বুঝলেও আজ বুজতে পেরে আমাকে জানিয়েছে।

আস্তে আস্তে বিয়ের দিন চলে আসে। বিয়ের আগের দিন বাবাকে পুরোনো কলেজের কাজের বাহানা দিয়ে একটা বান্ধবীর বাসায় চলে আসি এটা বলে যে বিয়ের ঠিক সময় বাসায় এসে পৌছাবো। কিন্তু অসুস্থ কথা বলে আর বিয়ের দিন বাসায় ফিরেনি। এই ব্যাপারে ফুপি অনেক হেল্প করেছে। ফুপি কে এটা বুঝেয়েছি আমার এখানে থাকলে বৃষ্টির যদি কিছু হয় তাই বিয়ের পর চলে আসবো। বাবাকে যেনো আমাকে যেতে দিতে বলে।
সেদিন নিজের উপর বড্ড ঘৃর্না হচ্ছিলো এতো মিথ্যে বলে আজ নিজের ভালোবাসার থেকে পালাতে হচ্ছে। তবে কি করবো আমি যে পরিস্থিতির শিকার। আজ চাইলেও আমি ছুটে চলে যেতে পারি না আমার হাত পা যে বাধা। আজ আমি নিজের কথা ভাবলে সারাজীবনের জন্য ছাড়তে হবে বাবাকে। যে বাবা আমাদের জন্য সেই ছোট্ট বয়সে মা মরে যাওয়ার পরও বিয়ে করেনি তার মেয়েদের ভেবে। সেই বাবাকে কী করে এতো কষ্ট দিবো, কী করে তার বিশ্বাস ভাঙবো?
,

ওদের বিয়ের পর আমি রুদ্র স্যারের অফিসের কাজ ছেড়ে দেই। তার ছয় মাসের মাথায় শুনি বৃষ্টি অসুস্থ, বাচ্চা হবে। সেদিন ফুপি খুশিতে যাকে পেয়েছে তাকেই মিষ্টি খাইয়েছে। মনে মনে তাছিল্য হেসে ভেবেছিলাম এই ছিলো তার ভালোবাসা? এতোই যদি ভালোবাসতো তাহলে এত তাড়াতাড়ি বৃষ্টির রুপে গলে যেত না। আবার নিজেকেই ওল্টো প্রশ্ন করতাম, আমি বা আর কী ভালোবাসতাম, ভালোবাসলে কি তাকে ছেড়ে থাকা যায়?

#চলবে,,,,,
(বিঃ দ্রঃ আস্তে আস্তে পুরোনো অতিতের সব রহস্য খুলবে, ধৈর্য ধরে শেষ পর্যন্ত পড়তে থাকুন)
#চলবে…….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here