সংসার পর্ব ১+২

০১.কিছুক্ষণ আগে আমার বিয়ে হয়েছে ছোট বোনের জামাইয়ের সাথে। তিন মাসের ছোট মেয়ে পূর্ণতাকে কোলে নিয়ে বসে আছি বাসর নামের সাজানো ঘরটিতে।
আজ থেকে তিন মাস আগে যে ছিলো আমার ছোট বোনের স্বামী আজ সে আমার স্বামী।

প্রতিটা মেয়ের বাসররাত নিয়ে আলাদা স্বপ্ন থাকে, আলাদা করে ভাবনা থাকে। কিন্তু আমি মনেহয় এমন একজন মেয়ে যে কিনা একরাশ দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বসে আছে।
এই মুহূর্তে আমার কিছুটা ভয় আর লজ্জা নিয়ে বসে থাকা উচিত কিন্তু অবাক করা বিষয় দুটোর একটি জিনিসও আমার ভিতরে নেই। সামনের দিনগুলোই কিভাবে এইলোক টার সাথে মানিয়ে নিবো, কিভাবে সারাটা জীবন একসঙ্গে থাকবো, আদৌও কি আমাকে মেনে নিবে? হাজার প্রশ্ন মনের মধ্যে চেপে রেখে কোলে ছোটবাবু নিয়ে বসে আছি বাসর ঘরে।

হঠাৎ দরজা খুলার শব্দে একটু নড়েচড়ে বসলাম। মৃদু আলোয় অন্ধকার রুমে পায়ের শব্দে বুঝলাম রুদ্র আমার দিকে এগিয়ে আসছে। ভয়ে গায়ে কাঁটা দিচ্ছে, এই ভয়টা আমার আজ হেরে যাওয়ার ভয়। ভাবছিলাম রুদ্র হয়তো সব গল্পের মতো আমার কাছে এসে ঘৃণা চোখে বলবে,
“কখনো আমার থেকে স্বামীর অধিকার চাইতে আসবেনা। তোমাকে আমার মেয়ের জন্য বিয়ে করেছি, তুমি আমার মেয়ের ঠিকভাবে যত্ন নিবে। আমি তোমার সব অভাব, স্বপ্ন পূরণ করব বিনিময়ে আমার মেয়েকে ভালোবাসবে। তুমি শুধু আমার মেয়ের সৎ মা তাছাড়া আর কিছুই না।”

রুদ্র আমার সব ভাবনায় জল ঠেলে, আমার কাছে এসে নিজের সাথে আমাকে মিলিয়ে নিলো। কাঁপা কাঁপা হাতে আমায় স্পর্শ করছে সম্পূর্ণ নিজের মতের বিরুদ্ধে।
আমার বাসররাত নিয়ে স্বপ্নটা এমন থাকলেও আজকে কখনো এমনটা হবে ভাবিনি। রুদ্র সব স্বামীর মতো ব্যবহার করলেও রুদ্রের ছোঁয়ায় দ্বায়িত্ব কর্তব্য ছাড়া ভালোবাসা খুজে পেলাম না।
অস্বস্তি সাথে রুদ্রকে মেনে নিলেও মনের মতো করে পাইনি। অসহ্য ব্যাথায় অচেতন হয়ে পরে রইলাম। রুদ্রের সেদিকে কোনো খেয়াল নেই। সে স্বামীর কর্তব্য পূরণ করতে ব্যস্ত। কিছুখন পর রুদ্র রুম থেকে চলে গেলো। আমি অচেতন অবস্থায় সেখানেই পরে রইলাম।
,

আজানের সুর শুনে ঘুম ভেঙ্গে যায়। নিজের দিকে তাকাতেই রাতের কথা মনে পরে যায়। বিছানার চাদর গায়ে জড়িয়ে কোনো রকমে ওয়াশরুমে আসি। গোসল করে নামাজ পরে নেই। ছোট বেলা থেকে যতোই কষ্ট হতো না কেন, কারো কাছে অভিযোগ করতাম না। নামাজে বসে আল্লাহর কাছে শুকরিয়া করতাম আমার থেকেও খারাপ অবস্থায় আরো মানুষ আছে তাদের থেকে তো আমি ভালো আছি সুস্থ আছি এটাই শুকরিয়া।
কিন্তু আজ সৃষ্টিকর্তার কাছে খুব অভিযোগ করতে ইচ্ছে করছে। কেনো আমার জীবনটা এমন হলো?
,

পূর্ণতাকে আমি জন্ম না দিলেও আজ থেকে আমি ওর মা। আজ থেকে ওর সব আবদার আমার কাছে। দোলনা থেকে কোলে তুলে জানলার সামনে দাড়ালাম। হালকা রোদের আভা পেয়ে পূর্ণতা হাত পা ছড়িয়ে দিলো। এটাই প্রত্যেক মায়ের কাছে স্বর্গে দেখা শ্রেষ্ঠ দৃশ্য। আমি আমার মাকে কখনো দুচোখে দেখিনি। জন্ম হওয়ার পর থেকে ফুপির কাছে ছিলাম ফুপি অযত্নে না রাখলেও মায়ের ভালোবাসা কখনো পাইনি। তাই আজ পূর্ণতাকে ছুয়ে ওয়াদা করলাম পূর্নতাকে কখনো মায়ের অভাব বুঝতে দিবোনা। সব সময় আদরে বড় করবো। যে ভালোবাসা আমি পাইনি সে ভালোবাসা থেকে আমি পূর্ণতাকে বঞ্চিত করবো না।
,

সকাল ১২টা। রাত থেকে এখন পর্যন্ত রুদ্র একবারের জন্যও রুমে আসেনি, বাড়িতে তেমন কারো সাড়া নেই। সবাই নিজের কাছে ব্যস্ত। কিছুক্ষণ আগে রাইমা রুমে নাস্তা আর বাবুর ফিটার রেখে গেছে। নাস্তা খেয়ে কিছুটা ভয় আর সংকোচ নিয়ে বাবুর জন্য গরম পানি করতে রুমের বাহিরে বের হয়।
সোফায় বসে বসে রুদ্র ফোন টিপছে। শাশুড়ি মা নিজের মতো করে সোফায় বসে বসে কফি খাচ্ছে আর পেপার পরছে। বাসার এতো কাজের লোক থাকা সত্বেও কারো মুখে কোনো কথা নেই, সবাই সবার সাথে চুপচাপ কথা বলছে। আমাকে সবাই কেমন যেনো এড়িয়ে যাচ্ছে, কেউ আমাকে চিনে না এমন ভাব। শাশুড়ি মায়ের সামনে গিয়ে নিচু স্বরে সালাম দিলাম। শাশুড়ি মা আমার দিকে এক পলক তাকিয়ে আবার পেপার পড়ার মন দেয়। রুদ্র একবারের জন্য আমার দিকে তাকায়নি।
রান্নাঘরে একটা পাতিলে গরম পানি দিতে গেলে একটা বয়স্ক মহিলা চুপচাপ আমার হাত থেকে পানির পাতিল নিয়ে গরম পানি করা একটা ফ্লাক্স হাতে ধরিয়ে দেয়।
,

রামে এসেই হাউমাউ করে কেঁদে ওঠি। এমন পরিবার আমি চাইনি, যেখানে আমি সব পাবো কিন্তু মন খুলে কারো সাথে কথা বলতে পারবো না। চোখ থেকে অঝোরে জল পরছে, আজ চেষ্টা করেও কান্না ধামাতে পারছিনা। কেনো আমার সাথেই এমন হলো? যাকে পাবোই না তাকে তো ভুলেই গেছিলাম তাহলে সে কেন আবার আমার জীবনে আসলো? যে অতীত বার বার ভুলতে চাই সেই অতীত বার বার কেন সামনে আসে?
,

০২.অতীত,,,,,,
আমি আর বৃষ্টি জমজ হলেও বাবা বলতো আমি বৃষ্টির থেকে ১৫ মিনিটের বড় ছিলাম। বৃষ্টির গায়ের রং ছিলো ধবধবে ফর্সা আর চঞ্চল প্রকৃতির কিন্তু আমি ছিলাম ওল্টো উজ্জ্বল শ্যামলা মায়াবতী লাজুক স্বভাবের।

ফুপির কোনো সন্তান ছিলো না, একসঙ্গে বাবার দুটো মেয়ে হওয়ায় বাবার ছোট মেয়েকে ফুপিকে দিয়ে দেয়। তার প্রায় ছয় মাসের মাথায় বাবার সরকারি চাকরি চলে যায়, তার তিন মাস পরে সিড়ি থেকে পরে গিয়ে মা মারা যায়।
তারপর থেকে আমি আর বৃষ্টি একসাথে ফুপির কাছে থাকি। মা খুব শখ করে আমাদের দুই বোনের নাম রেখেছিলো মেঘ আর বৃষ্টি।

যখন আমাদের তিনবছর বয়স তখন ফুপির হাসবেন্ড গাড়ির সাথে এক্সিডেন্ট করে মারা যায় সেই থেকেই আমি ফুপির চোখের বিষ ছিলাম। ফুপির ধারনা আমি অলক্ষী। ফুপি সব সময় আমায় বলতো জন্মের পর বাবার চাকরি আর মাকে খেয়েছি এখানে এসে তার স্বামীকে মেরে ফেলেছি। আমার মতো অপয়া আর কোথায় আছে।

ছোট বেলা থেকেই অযত্নে বড় হই। বৃষ্টি আমার সব আদর কেড়ে নেয় তবুও কখনো হিংসা হয়নি ছোট বোন তো। বাবা সব সময় বলতো ছোটোরা যাই করে না তাদের বুঝিয়ে বলবে। তাদের বকতে হয় না ভালোবাসা দিয়ে পরিবর্তন করতে হয়।
বৃষ্টি ছোট থেকেই চালাক ছিলো, কোনো ভুল করলেও আমার নামে চালিয়ে দিতো যার ফলে ফুপি আমাকে আরো বকতো। ফুপি বাবাকে কিছু বলতো না কষ্ট পাবে তাই। কিন্তু বাবা তো সে, সবই বুঝতো। ফুপির কাছে আমার ভালোবাসার পরিমাণ কম থাকলেও বাবার কাছে ভালোবাসা আদর সব পেয়েছি।

এইচ এস সি শেষ হওয়ার পর বাবা বৃষ্টির অনুরোধে ওকে ফোন কিনে দেয় সেই সাথে আমাকেও। ফোনের ব্যপারে আমার একটুও আগ্রহ ছিলো না, ফোনের কিছুই জানতাম না। বাবা এক প্রকার জোর করে আমাকে ফোন দেয়। বৃষ্টির থেকে টুকটাক যতোটা শিখতে পারতাম ততো টাই চালাতাম।
একবার বৃষ্টির সাহায্যে ফেসবুক একাউন্ট খুলি সেখানে পরিচয় হয়েছিলো মাহমুদ চৌধুরী নামের একটা ছেলের সাথে। তারপর থেকে আমার যতো সমস্যা হতো মাহমুদ বললাম ও কেমন করেই যেনো সব ঠিক করে দিতো। আস্তে আস্তে আমি মাহমুদকে ভালোবেসে ফেলি। ততদিনেও আমরা দুজন দুজনকে দেখিনি শুধু মেসেজে কথা বলতাম। সে কখনো আমাকে ভালোবাসে কিনা বলেনি তবে মাহমুদের লুকানো কেয়ারিং দেখে মনে হতো ও আমাকে ভালোবাসে।

বৃষ্টিকে মাঝে মাঝে তার ব্যাপারে বললে ও তুচ্ছের ছলে বলত-
“আগে তো নিজের চেহারা দেখ, আর এই যুগে ছবি না দেখে ভালোবাসা হয় না। ছেলেটা তোকে ইউজ করছে নয়তো কি দেশে মেয়ের অভাব পরছিলো যে তোকে ভালোবাসবে?’

আসলেই তো বৃষ্টির কথাই ঠিক ছিলো দেশে কি মেয়ের অভাব যে আমাকে ভালোবাসবে। তবুও মন মানতো না লুকিয়ে লুকিয়ে ফোনে কথা বলতাম। মাঝে মাঝে ভয়েজে গান শুনাতাম। মাহমুদেরও যেনো আমার গান না শুনলে ঘুম আসতো না আর আমারো ওকে গান না বললে চোখে ঘুম আসতো না।
এভাবেই দিন কাটছিলো হঠাৎ একদিন বাবা অসুস্থ হয়ে পরে। হাতে কারো কাছে টাকা ছিলোনা তখন আমি আমার ফোন বিক্রি করে বাবার চিকিৎসা করাই সে সময়ও ফুপি বলেছিলো- “অপয়া অলক্ষি মেয়ে তোর জন্য আমার ভাইটার জীবন দেখবি একদিন শেষ হয়ে যাবে। এবার একটু আমাদের নিজেদের মতো বাঁচতে দে। কোথাও চলে যা এ বাড়ি ছেড়ে।”
আস্তে আস্তে মাহমুদ কে মনের গহিনে রেখে ওর কথা ভুলতে চেষ্টা করি।

পড়ালেখা শেষ করে আমি আর বৃষ্টি কাজের জন্য বিভিন্ন অফিসে যায় এমনই একদিন “মাহমুদ মাহ্দি রুদ্র চৌধুরী” কোম্পানির সন্ধান পাই।
সেখানে গিয়ে আমার উন্নত মানের চাকরি হলেও বৃষ্টির হয়েছিলো নিম্নমানের চাকরি। পড়ালেখায় বৃষ্টি কখনোই ভালো ছিলোনা তাই ভালো সার্টিফিকেট ছিলো না।
অফিসে ইন্টারভিউ জন্য যখন গিয়েছিলাম তখন অফিসের একজন রাইমা নামের লেডি বস বৃষ্টিকে বলেছিলো-
“এই তো সার্টিফিকেট তার উপর ভালো চাকরি খুজছেন, লজ্জা করছেনা? আপনার তো হাড়ি পাতিল ঘষার মতো সার্টিফিকেট এখানে কেনো এসেছেন? বেড়িয়ে যান।”

তখন আমি রাইমা ম্যামের হাতে পায়ে অনুরোধ করে বৃষ্টির জন্য চাকরি ভিক্ষা চাই। আমার সবকিছু সেদিন পজিটিভ দেখে আমার অনুরোধে বৃষ্টিকে সেদিন কাজ দেয় তবে খুব নিম্নমানের।

বৃষ্টি তখন থেকে রাইমার ম্যামের উপর প্রতিশোধ নিতে চাইছিলো। ছোট বেলা থেকেই কেউ ওকে অপমান করলে ও তার প্রতিশোধ নিতে নিতে এক প্রকার জেদ কাজ করতো ওর ভিতর। ভালো হোক বা খারাপ হোক নিজের ইগোকে কেউ ছোট করলে তাকে শাস্তি দিবেই।

একদিন অফিসের জন্য রেডি হচ্ছিলাম তখন দেখি বৃষ্টি ফুপির সাথে প্লান করেছিলো কিভাবে রাইমা ম্যামকে শিক্ষা দিবে। কিন্তু আমি গোপনে ওর প্লান সবটা শুনি। অফিসে পৌছে আমি ওর পিছন পিছন থাকতাম।
সেদিন অফিসের লিফট বন্ধ হওয়ায় সবাই সিড়ি দিয়ে যাওয়া আসা করতো। বৃষ্টি সেই সুযোগ কাজে লাগায়। রাইমা ম্যাম কে কেবিন থেকে বের হতে দেখে ও সিড়িতে তৈল ফেলে দেয়।
সিড়িতে তৈল থাকায় ম্যাম পা পিচলে সাত তলা থেকে গড়িয়ে পরতে থাকে। গড়িয়ে গড়িয়ে যখন নিচে পরছিলো সবাই তাকিয়ে ছিলো কিন্তু কেউ কাছে যায়নি। আমি দৌড়ে গিয়ে রাইমা ম্যামকে ধরি, কিন্তু তাল সামলাতে না পেরে আমি নিজে পরে যায়। সেদিন রাইমা ম্যাম ঠিক থাকলেও আমার মাথা ফেটে রক্ত বের হয় আর সেখানেই জ্ঞান হারিয়ে ফেলি।
যখন জ্ঞান ফিরে তখন শুনি ডাক্তার বাবা আর ফুপিকে বলছে-
“রোগী এখন সুস্থ তবে এক্সিডেন্টের কারনে পেটে ব্যাথা পাওয়ায় অপারেশন করতে হয়েছে। আমারা দুঃখিত আমাদের অপারেশনে একটু ভুলের জন্য রোগীর সন্তান হওয়ার ক্ষমতা একেবারে কমে গেছে। এই রকম রুগীর যদি বাচ্চা নেয় তবে কেউ একজন বেঁচে থাকবে। তাই আগে থেকেই সাবধান থাকবেন ভবিষ্যতে যেন এমন খারাপ কিছু না হয়।”
#সংসার
#পর্ব_০২

#লেখিকা_সুরাইয়া_ইসলাম_সানজি

যখন জ্ঞান ফিরে তখন শুনি ডাক্তার বাবা আর ফুপিকে বলছে- “রোগী এখন সুস্থ তবে এক্সিডেন্ট কারনে পেটে ব্যাথা পাওয়ায় অপারেশন করতে হয়েছে। আমরা দুঃখিত আমাদের অপারেশনে একটু ভুলের জন্য রোগীর সন্তান হওয়ার ক্ষমতা একেবারে কমে গেছে। এই রকম রুগীর যদি বাচ্চা নেয় তবে কেউ একজন বেঁচে থাকবে। তাই আগেই সাবধান থাকবেন ভবিষ্যতে যেন এমন খারাপ কিছু না হয়।

ডাক্তারের কথাশুনে বাবা সেখানেই থম মেরে নিচের চেয়ারে বসে থাকে, ফুপি বাবাকে সান্তনা দেওয়ার জন্য কাধে হাত রাখতেই বাবা শব্দ করে কেঁদে ওঠে।
“বল তো রেনু (ফুপির নাম) কেন আমার মেয়েটার সাথেই বারবার এমন হয়। কি পাপ করছিলো মেঘ, ছোটবেলা থেকে একের পর এক কষ্ট পেয়ে যাচ্ছে মেয়েটা। বলতে পারিস রেনু?”

“দাদা তুমি এমন করো না,শান্ত হও। হার্টের রুগী তুমি অসুস্থ হয়ে গেলে তোমার মেয়েদের কে দেখবে। আর তাছাড়া বৃষ্টির কি হবে। তোমার কিছু হলে মেয়েটা সামলাতে পারবেনা।”

“কি করে শান্ত হবো বল? রেনু তুই মেঘকে এসব ব্যাপারে কিছু জানতে দিস না আর বাহিরে কাউকে বলিস না এসব শুনলে কে নিবে আমার মা মরা মেয়েটাকে।”

বাবার চোখে জল দেখে আমার চোখ থেকে অজান্তেই জল গড়িয়ে পরতে থাকলো। অন্যের ভালো চাইতে গিয়ে নিজের এতো বড় ক্ষতি করে বাবাকে কষ্ট দিলাম। আজ বৃষ্টির পাপের শাস্তি আমি পাচ্ছি যা সারাজীবন বয়ে বেড়াতে হবে।

০৩.
আজ রাইমা ম্যাম আর আমাদের কোম্পানির মালিক নিজে এসেছেন আমাকে দেখতে। আগে কখনো দেখিনি এই ভদ্রলোক রুদ্র সাহেবকে।
ম্যাম অনেকক্ষণ থেকে আমার পাশে বসে আছেন।বড় স্যার কিছুক্ষণ থেকে চলে গেছে। তার বোনের প্রান বাঁচালাম তার পরিবর্তে একবারও জানতে চাইলোনা আমি কেমন আছি বা ঠিক আছি কিনা? বড়লোক বলে কথা এখানে সময় নষ্ট করে এসেছে এটাই তো অনেক। ভদ্রলোক অনেকগুলো ফলমূল আমার বেডের পাশে রেখে বাবার হাতে কতগুলো টাকা দিয়ে চলে গেলো কিন্তু রাইমা ম্যাম মাথা নিচু করে অপরাধি ভঙ্গিতে বসে আছে।

বাবার থেকে জানতে পারি রাইমা ম্যাম এই হাসপাতালের ডাক্তার। আজ সে যদি না থাকতো তাহলে যেভাবে আঘাত লাগছে তাতে আরো খারাপ কিছু হতে পারতো।
বাবা রাইমা ম্যামের কাছে গিয়ে অনুরোধ করে বলে কাউকে যেনো না বলে আমি কখনো সন্তান জন্ম দিতে পারবো না। ম্যাম তখন বাবার কান্না জড়িত অনুরোধ দেখে আমার দিকে তাকিয়ে বলে-

“মেঘ তোমার কাছে কিছু চাইলে আমাকে দিবে প্রমিজ করো?”

“ম্যাম এভাবে বলছেন কেনো? আপনি চাইলে দিতে পারলে অবশ্যই দিবো।”

“আমি তোমাকে চাই, আমার ভাইয়ের বউ করে নিতে চাই। যাতে আজীবন আমার জন্য কষ্ট পেতে না হয়।”

“কি বলছেন ম্যাম! কোথায় আমি আর কোথায় আপনারা। এসব হয় না, আমরা সাধারণ মানুষ আপনাদের মতো না তাছাড়া স্যার আমাকে মানবে না। না আছে রূপ আর না আছে সন্তান জন্ম দেওয়ার ক্ষমতা। আপনার পরিবারের তারা কেউ এটা মানবে না ম্যাম।”

“মেঘ মানবেনা বা মানবে সেটা আমি বুঝবো। তুমি আমার অনুরোধটা রাখো প্লিজ নয়তো কখনো আমি নিজেকে নিজে ক্ষমা করতে পারবো না। ভাইয়া প্রথমে না মানলেও আমি জানি তুমি তোমার ধৈর্য দিয়ে মানিয়ে নিতে পারবে। তোমার মতো একজনই আমার ভাইয়ের যোগ্য। আর কি গ্যারান্টি আছে ভাইয়াকে অন্য কোথাও বিয়ে দিলে বাচ্চা হবে।”

সেদিন রাইমা ম্যামের কথা ফেলতে পারিনি। বাবাও এই বিয়েতে খুব খুশি ছিলো। কিছুদিনের ভীতর হাসপাতাল থেকে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে আসি। তার দুইদিন পরে রাইমা ম্যামের পরিবার আমাকে দেখতে আসে। এক প্রকার জোর করেই রাইমা ম্যাম তাদের নিয়ে আসে । তাদের কথা শুনে বুঝতে পারি আমি যে বাচ্চা জন্ম দিতে পারবো না এটা তারা জানেনা। তখন রাইমা ম্যামকে আড়ালে নিয়ে গিয়ে জিঙ্গেস করলে বলে-

“মেঘ এটা নিয়ে তুমি চিন্তা করো না। আমার ভাইয়ের সাথে একবার মানিয়ে নিতে পারলে বাচ্চা না হওয়াটা ব্যাপার না। দরকার হলে দওক নিবে। তবে এখন কাউকে বলবেনা।”

খুব বড় করে এগেন্জমেন্টের ব্যবস্থা করে। শহরের বড় বড় মানুষরা আসবে সেদিন যেখানে আমরা সামান্য একজন মানুষ। আমিও সব ভুলে নতুন করে আবার স্বপ্ন বুনতে শুরু করি। আজ কাল বাবার মুখের হাসি দীর্ঘ হয়েছে, এই হাসিটা দেখলে পুরোনো সব কষ্ট এমনিতেই ভুলে যাই।

০৪.
হঠাৎ একদিন কে জানি রাইমা ম্যামের মাকে আমার সব সত্যিটা বলে দেয়। তখন বড় ম্যাডাম আমাদের বাড়িতে এসে বিয়ে ভেঙ্গে দেয়। কিন্তু এতে তাদের সম্মানে আঘাত হানবে তাই আবার বিয়ে ঠিক করে তবে আমার সাথে না আমার ছোট বোন বৃষ্টির সাথে।

এবার রাইমা ম্যাম হাজার চেষ্টা করেও বিয়ে ভাঙ্গতে পারিনি। সেই রাগে সে বাড়ি থেকে বিদেশে চলে যায়। স্যারের একমাত্র ছোট বোন আমার কারনে বিদেশ চলে গেছে তাই সে আমার উপর আরো ক্ষেপে গেছে।
“নিজেকে খুব সুন্দরী মনে হয়? আপনার জন্য আমার বোন আজ আমার বিয়েতে থাকছে না। আপনি আমার সরল বোনটাকে ভুল বুঝিয়ে মন কেড়েছেন। আপনার থেকে বৃষ্টি অনেক ভালো। একই ফেমেলীতে দুটো বোন কিভাবে এতো পরিবর্তন হয়?
আজ যদি বৃষ্টি না থাকতো তবে আপনার ভালো মুখের আড়ালে লোভী চেহারাটা দেখতেই পারতাম না। বৃষ্টি অনেক ভালো মেয়ে ওকে বিয়ে করতে আমার আপত্তি নেই, তবে যদি আমার বোন আমার বিয়েতে না থাকে তাহলে আমিও এই বিয়ে করবোনা।”

তখন আমি রাইমা ম্যামকে ফোন করে দেশে নিয়ে আসি এটা বলে যে আপনার সেইদিন হাসপাতালে বসে অনুরোধ রেখেছিলাম আর আজ আপনি আমার অনুরোধ রাখতে দেশে আসবেন। আমি আজ আরো বেশি খুশি আমার বোন আপনাদের বাড়িতে যাচ্ছে। এখন আপনি না আসলে বড় স্যার বিয়ে করবেনা আর এবারও বিয়ে না হলে বাবা অসুস্থ হয়ে পরবে।

জানিনা ম্যাম সেদিন আমার হাসিমুখের আড়ালে চেহারাটা দেখতে পেয়েছিলো কিনা। সেদিন ম্যাম বলেছিলো “দেখো মেঘ তোমার জীবনে আরো ভালো কেউ আসবে, তুমি আসলেই খুব ভালো মেয়ে তবে ওয়াদা দাও তুমি সব সময় হাসিখুশি থাকবে। কখনো মন খারাপ করে থাকবে না তাহলে আমার মনে হবে এর জন্য আমি দায়ি।”

আস্তে আস্তে সময় এগিয়ে যায়। মনের ভিতর থাকা আবেগ আর ভালোবাসা দুটোই চাপা দিয়ে রাখি। আজ সন্ধ্যায় বৃষ্টি আর রুদ্র স্যারের এঙ্গেজমেন্ট বাড়িতে মেহমান ভরপুর। হঠাৎ মেহমানদের ভিতরে একজন দেখে চমকে ওঠি। রাকিব ভাই ফুপির দেবরের ছেলে। ফুপি কোনো ছেলে ছিলো না তাই রাকিব ভাইকে নিজের ছেলের মতোই দেখে। আমাদের কোনো সমস্যা হলে আগে রাকিব ভাইকেই বলতো ফুপি।
এই ছেলেটা আমাকে ছোট বেলা থেকে পাগলের মতো ভালোবাসে। মোটামুটি ভালো চাকরি করছে তবে তার এই ভালোবাসা আমার কেন জানি বিরক্ত লাগে। মাঝে মাঝে তার জন্য মায়া লাগলেও ভালোবাসা হয়ে ওঠিনি। মনের ভীতরে একজনকে যত্ন করে রাখলে বাকি সবাইকে তার জায়গায় বসাতে বিরক্ত লাগে।

“কেমন আছো ময়না, আজ কি বিরক্ত লাগছে না আমাকে? জানো তোমার মুখে ‘আপনাকে খুব বিরক্ত লাগছে’ শুনতেও খুব ভালো লাগে।”

“হ্যা ভাই আলহামদুলিল্লাহ ভালোই আছি। আপনি তো দেখি এই পাঁচ বছরে একটুও বদলে যান নি। দেখতে চেহারায় পরিবর্তন আসলেও মুখের ভাষা বদলেনি। এখনো একবারেই সব কথা বলে শেষ করার প্রতিযোগিতা করতে চান?”

রাকিব ভাই শব্দ করে হেসে ওঠলো-
“মেঘ তোমার মুখের সব কথাই বেশ ইন্টারেস্টিং মনে হয়। তোমার বলা একটা শব্দ যদি শুনতে না পাই বা বাসাতে হারিয়ে যায় তবে মনে হয় বড় কোনো কিছু মিস করে ফেলেছি শুনতেই হবে।
আর তুমি না বলেছিলে তোমার সামনে না আসতে তাই তোমার কথা রাখতে এই পাঁচ বছর আসিনি। জানো এটাও বেশ মজার ব্যাপার। প্রত্যেকটি দিন কেটে যাওয়ার পর ভাবতাম তোমার কথা আমি আরো একদিন রাখতে পেরেছি।
চেহারায় পরিবর্তন তো উপর আল্লাহ দিয়েছে কিন্তু কথার পরিবর্তনটা আমার নিজের ভিতর যা কখনো করতে পারবো যতোদিন তুমি আছো। তোমাকে দেখলেই আমার সব কথা একসঙ্গে বলতে ইচ্ছে হয়।”

রাকিব ভাই চারদিকে তাকিয়ে এবার সিরিয়াস ভঙ্গিতে বললো-
“দেখো মেঘ কতো লাল নীল ফুলে ঘর সাজানো আচ্ছা তোমার ইচ্ছে হয়না তোমাকে কেন্দ্র করেও এমন করে সাজানো হোক? আমি তোমাকে বৃষ্টির হবু জামাইয়ের মতো এতোকিছু দিয়ে সাজাতে না পারলেও তার থেকেও বেশি ভালোবাসা দিয়ে সাজাতে পারবো?”

আমি রাকিব ভাইয়ের কথার জবাব না দিয়ে সেখান থেকে তাড়াতাড়ি চলে আসি নয়তো রাকিব ভাইয়ার কথা আজ আর শেষ হবে না। লোকটা এমনই অদ্ভুত টাইপের। সবার সামনে গেলে গুলি মারলেও প্রয়োজন ছাড়া কথা বলবেনা। কিন্তু আমাকে দেখলেই তার সব কথা পেট থেকে একসাথে বের হয়ে আসে।

#চলবে,,,,,,,,,,
#সংসার

#লেখিকা_সুরাইয়া_ইসলাম_সানজি।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here