সঞ্চারিণী পর্ব -০৮

সঞ্চারিণী
আফনান লারা

৮.
-‘আশাকে রেদোয়ানের সঙ্গে বিয়ে দেওয়ার আগে আপনার সংসার চলতো কি করে?’

-“আমি একজন মুদি দোকানদার ছিলাম। ক্যাশে বসে থাকতাম।দোকান আশাই চালাতো।আমি বসে টাকা গুনতাম।
আমার মেয়েটা একা হাতে সব করতো।আমি তো ওকে বিয়ে দিতেই চাইছিলাম না।রেদোয়ান আমাকে হাত জোড় করে বলেছিল সে আশাকে সুখে রাখবে।আমার সব খরচ সে দেবে।তাই রাজি হলাম।লোভে!
মেয়েকে ভালো ঘরে সুখী হতে দেখার লোভে।লোভ বড় জঘন্য জিনিস।একদিন না একদিন ঠিক ধংস করবেই।এই যে আমার লোভে আমার মেয়েটার জীবন গেলো।বড় লোকদের টাকা বেশি,সাথে তাদের রাগ বেশি,অহংকার বেশি,দাপট বেশি থাকে।এটা আমি যেন জেনেও অস্বীকার করেছিলাম।
ভাবছো এত বড় ঘরে বিয়ে কি করে দিলাম??রেদোয়ান আমার দূর সম্পর্কের ফুফাতো ভাইয়ের ছেলে।এমনটা নয় যে রেদোয়ানকে ওর পরিবার জোর করে বিয়ে দিয়েছে আশার সঙ্গে।বরং রেদোয়ান নিজেই আশাকে পছন্দ করে বিয়েটা করেছিল।তাহলে এমন কেন হলো তার উত্তর আমি আজও পেলাম না।আশা আমাকে ওর বিয়ের আগে রেদোয়ানের সাথে কিছু মেলামেশা করে বলেছিলো রেদোয়ান ছেলেটা অনেক কেয়ার করে ওর।শুনে আমার কলিজা ঠাণ্ডা হয়ে গিয়েছিলো।তাছাড়া ওর সম্পর্কে এমন মানুষ পেলাম না যারা খারাপ বলেছে।নিয়তি কত জলদি বদলে যায়।’
——–
মেধা জানালা ধরে নড়াচড়া করছে।পারছেনা জানালা ধরে ঝুলে পড়ছে।সিরিয়াস টাইমে বাঁদরামি করা নিয়ে অস্কার দেওয়া উচিত তাকে এটা সবসময় বলে মা।এখন অবশ্য বাবা ও বলে।কিছুদিন পর শাওন ও বলবে।
কেমন একটা গটরগটর আওয়াজ ভেসে আসছে কানে।শাওন আশার বাবার কথা ঠিকমত শুনতে পারছেনা মেধার করা এমন আওয়াজের জন্য।বিরক্তির সীমা ছাড়িয়ে আসছে।বয়স্ক মানুষ সামনে,তা নাহলে মেধাকে দোতলা থেকে ছুঁড়ে মারতো শাওন।
রায়হানের দিকে তাকিয়ে ইশারা করে শাওন উঠে দাঁড়ালো।এক হাত পকেটে ঢুকিয়ে অন্য হাত দিয়ে মেধার হাত শক্ত করে ধরে টেনে নিয়ে গেলো সে।একেবারে নিচ তলায়।

-‘আরে!এমন করছেন কেন?ওখান থেকে নিয়ে আনলেন কেন?’

-‘তুমি নিজে তো কোনো কাজ করোনা।উল্টে আমার কাজে বাধা সৃষ্টি করো কি জন্যে?’

-‘কে বলেছে কাজ করিনা?এই যে এসব ফুলদানি উপুড় করে মাটি ফেলেছি ভেতরে কিছু আছে কিনা দেখার জন্য।এগুলো কি কাজ নয়??আপনি শুধু নিজের কাজই দেখেন?মাঝে মাঝে জুনিয়রদের কাজের ধরণ ও দেখতে হয়।ছোটদের বাহবা দিলে তারা মন থেকে দোয়া করে’

শাওন কপাল চাপড়িয়ে চলে যাওয়া ধরতেই আটকে গেলো।ওর ঘড়ির সঙ্গে মেধার কোমড়ের বেল্ট আটকে গেছে তাই।
প্রথমে বিষয়টা স্বাভাবিক ভাবে নিলেও যখন তিনবারের টানেও ছুটলোনা তখন সে মেধাকে একটা ধমক দিয়ে বললো,’ধরেছিলাম তোমার হাত।বেল্টের সাথে আটকালো কি করে?দাঁড়িয়ে দেখছো কি?খুলতে পারোনা?’

-“আজব তো।আমার এক হাতে প্লাস্টার, আমি কি করে খুলবো?’

শাওন মনযোগ দিয়ে খোলার চেষ্টা করছে।কি করে আটকালো তাই বুঝে উঠতে পারছেনা।বাড়ির পেছনের সাইডে গেস্ট হাউজটা তাই আলো বাতাস একেবারেই কম।অন্ধকারের তোড়ে ভালোভাবে ফোকাস করা মুশকিল
হয়ে উঠছে। এরই ফাঁকে শাওন হঠাৎ মুখটা ফ্যাকাসে করে ডানে তাকালো।মেধাও তাকালো।শাওন দেখতে পেলো রশ্নিকে কিন্তু মেধা কিছু দেখলোনা।শাওন চোখের পলক ফেলছেনা।এক দৃষ্টিতে ওদিকেই তাকিয়ে আছে।
মেধা হাত উঠিয়ে শাওনের চোখের সামনে হাত নড়াচড়া করে বললো,’আপনার অদৃশ্য প্রেমিকাকে পরে দেখবেন।আমাকে মুক্ত করুন আগে।আমি হলাম ধৈর্য্যহীনলিমিউয়াস’

শাওন মাথা তুলে বললো,’হোয়াট?’

-‘ধৈর্য্যহীনলিমিউয়াস হলো একটা স্বভাবের নাম।মানে এটাতে আপনি এক জায়গায় বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার ধৈর্য্য হারাবেন’

শাওন বেল্ট টাইট করে ধরে বললো,’আমাকে বাচ্চা ছেলে পেয়েছো?উল্টো পাল্টা লজিক বুঝিয়ে দেবে আর আমি সেটা বুঝেও যাবো?’

-‘তো বুঝবেন না।’

শাওন হাঁপিয়ে গেছে তাও পারছেনা।বেল্টের সাথে যেন পার্মানেন্টলি লক হয়ে গেছে।
সেসময়ে রায়হান নিচে নেমে বললো,’এনি প্রব্লেম? ‘

-‘এটা খুলতে পারো কিনা দেখো তো!এসেছি কাজ করতে আর এই মেয়েটা আমাকে অন্য কাজে ব্যস্ত রাখে সবসময়।ওর কারণে রেদোয়ানের কেস শেষ হতে বছর লেগে যাবে।ভিডিও কনফারেন্সে সোজা ওর দোষ দেবো আমি’

রায়হান বেল্ট ধরে বললো,”আমি পারলে ছিঁড়ে ছুটাতে পারি’

-‘দেখো আমার ঘড়ি যেন না ভাঙ্গে।আমাকে রশ্নি দিয়েছিলো ঘড়িটা।ছিঁড়লে ওর বেল্ট ছিঁড়ো’

মেধা কোমড়ে হাত দিয়ে বললো,’খবরদার!আমার বেল্টটা আমি পকেটমানি বাঁচিয়ে কিনেছিলাম।এটার সাথে অনেক স্মৃতি জড়িয়ে আছে।’

শাওন চোখ রাঙিয়ে বললো,”তো তুমি কি চাও সারাজীবন এভাবে থাকতে?’

-‘আপনার ঐ অদৃশ্য প্রেমিকাকে বলুন না জাদুটোনা করে এটা ছুটাতে।তাহলেই তো হয়’

শাওন বিরক্ত হয়ে জোরে টান মারলো।মেধার বেল্ট ছিঁড়লো সাথে শাওনের ঘড়িটাও খানিকটা ভেঙ্গে গেছে।মেধা কিছুক্ষণ চেঁচামেচি করে বেরিয়ে চলে গেলো।শাওন ঘড়ি খুলে হাতে নিয়ে ছলছল চোখে তাকিয়ে আছে।রশ্নির দেওয়া প্রথম উপহার ছিল এটা।এভাবে নষ্ট হবে কখনও ভাবতে পারেনি সে।
রশ্নিকে একবার পানি থেকে বাঁচিয়েছিলো সে।সেই থেকে আস্তে আস্তে দেখা-সাক্ষাৎ,অতঃপর প্রেম গড়া।পানির কারণে শাওনের হাতের ঘড়ি নষ্ট হয়ে গিয়েছিলো বলে রশ্নির দেওয়া প্রথম উপহার এই ঘড়িটাই ছিল।শাওন কষ্টে পেয়েছে দেখে রশ্নি ওর পাশে বসে মুখে হাসি ফুটিয়ে বললো,’আজ বাসায় ফেরার সময় ঘড়ির দোকানে যাবে।আমি পছন্দ করে দেবো আর তুমি কিনবে।’

শাওন মাথা তুলে তাকালো ওর দিকে।রায়হান চলে গেছে রেদোয়ানের বাড়ির দিকে।শাওনের চোখের দিকে তাকিয়ে রশ্নি রাগ করে বললো,’কথায় কথায় ছেলেরা কাঁদেনা।
এই কথাটা তুমি আমায় সবসময় বলতে আর এখন নিজেই কথায় কথায় চোখে পানি এনে ফেলো।কান্না থামাবে নাকি আমি একা একা আজিমপুর চলে যাবো?’

শাওন চোখ মুছে বললো,’না।কাঁদছিনা।আচ্ছা তুমি জানো কে মেরেছে রেদোয়ানকে?’

রশ্নি ফিক করে হেসে দিয়ে বললো,’শাওন আমি তোমার মনে বাস করি।আমি তোমায় ছাড়া আর কিছু নিয়ে আলোচনা করতে পারিনা।করতে জানিনা।আজ তোমাদের বাসায় তৃনা আপুর হবু শ্বশুর বাড়ির লোকেরা আসবে কথাটা তৃনা আপু তোমায় বলেছে কিছুদিন আগে।তুমি ভুলে গেছো।আমি তোমার পাশে থেকে শুনেছি।সেটাই বলেছি তোমায় তাও আজ সকালে।তুমি যা শুনো আমি তাই শুনি।তুমি যা দেখো আমিও তাই দেখি।যেদিন তুমি দেখা বন্ধ করে দেবে সেদিন আমি থাকবোনা’

শাওন ব্রু কুঁচকে বললো,’আমি তোমায় দেখা বন্ধ করবোইনা।

রশ্নি শাওনের মাথায় হাত রেখে চুলগুলোকে বুলিয়ে দিয়ে বললো,’একদিন তুমি আমায় দেখবেনা।দেখতে ভুলে যাবে।আমি সেদিনের অপেক্ষা করবো।কারণ এভাবে জীবন চলেনা’
——
মেধা জানালার গ্রিল ধরে ঝুলে আছে।তার সামনেই জানালার ওপারে সোফায় বসে শাওন তার পাশে কেউ একজনের সঙ্গে কথা বলছে।কিন্তু কার সঙ্গে বলছে তাই বুঝছেনা মেধা।দৃঢ় দৃষ্টিতে দেখতে গিয়ে দেখলো শাওনের কোটের ভেতরের শার্টের বোতাম গুলো আপনা আপনি লেগে আসছে।এতক্ষণ এগুলো খোলা ছিলো।
-‘ও মাগো ভূত!’
মেধা চোখ বড় করে মাথায় হাত দিয়ে নিচে পড়ে গেছে জ্ঞান হারিয়ে।কিসের যেন আওয়াজ পেয়ে শাওন ও ছুটে আসলো দেখবে বলে।এসে দেখলো গেস্ট হাউজের বাহিরে মেধা অজ্ঞান হয়ে ঘাসের উপর পড়ে আছে।শাওন কাছে এসে ওর মুখ টিপে ধরে ঘুরিয়ে-ঘারিয়ে বললো,’এ তো অজ্ঞান হয়ে গেছে।অজ্ঞান হলো কেন?তাও এই জায়গায়।খুনিকে দেখলো না তো?’

-‘শাওন আমার মনে হয় আমার সঙ্গে কথা বলছো দেখে জ্ঞান হারিয়েছে।সে তো আমায় দেখতে পাবেনা।নাকি দেখেছে?এটা অসম্ভব। সে আমায় কেন দেখবে?
সেই প্রথমদিন থেকে দেখছি মেয়েটা চোট পেয়েই যাচ্ছে।এর তো হাত কাঁচা,কাজকর্ম ও একেবারে বাচ্চা বাচ্চা টাইপের।এত জলদি চাকরিতে জয়েন হওয়া ঠিক হয়নি’

শাওন ঘাঁড় ঘুরিয়ে বললো,’একদম ঠিক।ওর হসপিটালে ভর্তি হওয়া উচিত ছিল।তাও পাবনা মেন্টাল হসপিটালে।রায়হান?নিতু???জলদি আসো।আশ্চর্য এত করে ডাকার পরেও কেউ আসছেনা কেন?আমার আওয়াজ কি ওদের কাছে পৌছাচ্ছে না?
এরে আমাকে তুলতে হবে নাকি?আমি পারবোনা।ওরে কোলে নেওয়ার ভয়ে ৫কিলোমিটার পথ হেঁটে এসেছি।এখন সেই ওকেই কোলে নিতে হবে নাকি?’

শাওন উঠে দাঁড়িয়ে রায়হানকে ডাকতে যেতেই রশ্নি থামালো ওকে।ব্রু কুঁচকে বললো,’শাওন এটা স্বাভাবিক একটা ব্যাপার।বিপদে পড়ে কোলে নিচ্ছো।আনন্দে নিচ্ছো না।ওকে এখানে ঘাসের উপর বেশিক্ষণ রাখা ঠিক হবেনা।
কত পোকামাকড় থাকতে পারে।এত গভীর ঘাস আমি দেখিনি আগে।অনেকদিন মনে হয় পরিষ্কার করা হয়নি।
ক্ষতিকর পোকা দংশন করতে পারে।তুলে নাও।কিছু হবেনা’

শাওন বিড়বিড় করে এসে মেধাকে কোলে তুলে নিলো। সোজা রেদোয়ানের বাসার সোফায় এনে রাখলো ওকে।নিতু আর রায়হান উপরের তলায় ছিল। তারা ছুটে এসে মেধার জ্ঞান ফেরাতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে এখন।
চলবে♥
#Afnan_Lara

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here