সমাপ্তির প্রহরে সন্ধি পর্ব -২৮+২৯

#সমাপ্তির_প্রহরে_সন্ধি
#সমুদ্রিত_সুমি
পর্ব ২৮

গোধুলির আলো-আঁধারের প্রান্তসীমায় সবে সন্ধ্যা নামবে নামবে ভাব। মৃদু হাওয়ায় দুলছে শাড়ির আঁচল। কপালে কৃষ্ণ গৌড় কালো রঙের টিপ জ্বলজ্বল করছে,ক্ষণেক্ষণে ঝংকার তুলছে হাতের রেশমি চুড়ি। কর্ণের ছোট্ট ছিদ্রে শুভ্র নির্মল একজোড়া সাদা পাথরের দুল আছে কিনা সেটা বর্ণ জানে না,কারণ নদী হেজাব পড়ে আছে। ঠোঁট জোড়ায় খুব গাঢ় না হলে-ও হাল্কাপনা রঙে রাঙানো হয়েছে। ডাগর আঁখি জোড়ায় কোন কাজল নেই, আছে একরাশ বিরক্ত। সেই বিরক্ত মাখা আঁখি জোড়া নিবদ্ধ নদীর টলটলে জলের নিকট। পাশে বসে আছে স্বপ্নের প্রেমিক পুরুষ। যে হয়েও হয়নি আপন। দু’জনের মাঝে বিস্তার ফারাক। কারো মুখেই কোন কথা নেই। এখানে আসার পথে হাজারটা কথা সাজিয়ে এলে-ও তা যেন কয়েক সেকেন্ডে নদীর এমন অপরুপ সৌন্দর্য দেখে হারিয়ে গেছে। সময় চক্র ঘুরে কেটে গেছে প্রায় চারদিন। এই চারদিনে চলন্তগাড়ির মতো নদীর সামনে পিছনে ঘুরেছে বর্ণ। শুধু একবার, একবার যেন তাঁকে সুযোগ দেওয়া হয় কিছু বলার জন্য। আজ যখন সময় সুযোগ দু’টোই আছে, তখন বলার মতো কথার ঝুলিতে অবশিষ্ট কোন ভাষা নেই। অথচ রাত পোহালেই পাশে বসে থাকা রমনী অন্য কারো লিখিত সম্পদ হয়ে যাবে। নিজের দিক থেকে সবটা প্রায় গুছিয়ে নিয়েছে বর্ণ,এখন নদীর দিক থেকে স্বাড়া পেলেই সবটা সুন্দর হবে। নিজের ভাবনায় নিজেই হারিয়ে গেছে বর্ণ। হঠাৎ নদীর ফোনের রিংটোনে তাঁর সম্বিৎ ফিরে এলো। সে তাকাতেই দেখতে পেলো নদী ফোনটা কেটে বন্ধ করে দিয়েছে। খুব বিরক্ত সহকারে বর্ণের মুখোপানে তাকালো নদী বিরক্তের চোটে রাগ হয়ে মুখ থেকে বেরিয়ে এলো শালার ভীতু মনুষ্যি একটা ।

_ সমস্যা কি আপনার? এসেছি প্রায় আধা ঘন্টা, এই আধা ঘন্টায় না আপনি কিছু বলছেন না আমায় বলতে দিচ্ছেন। বাড়ি থেকে বারবার ফোন দিচ্ছে আমায় ফিরতে হবে।

_ চলেই তো যাচ্ছিস চিরদিনের জন্য, আর কিছুটা সময় থেকে গেলে খুব ক্ষতি হবে কী?

_ কিসে ক্ষতি আর কিসে ভালো সেটাই তো আপনি ভালো করে জানেন না।

_ অবশ্য তুই ঠিক বলেছিস। সে যাইহোক আমি গেছে কাল রাতে মায়ের মুখোমুখি হয়েছি। মায়ের এমন আচরণের জন্য কি কারণ সেটাও জানতে চেয়েছি। মায়ের সাথে আমার কি কথা হয়েছে, সেটা জানাতেই তোকে এখানে ডেকে আনা।

বর্ণের কথায় নদী আকস্মাৎ ভয়ে নিজেকে গুটিয়ে নিলো। তৎক্ষনাৎ বলার মতো কিছু পেলো না যেন। হাত-পা যেন ভেঙে আসতে চাইলো । সর্বনাশের বিচ বর্ণ পুঁতে ফেলেছে তাহলে। এবার সর্বনাশ হওয়া বাকি শুধু। না এবার আর চুপ থেকে লাভ নেই। তাই বক্ষঃস্থল থেকে এক জোর নিশ্বাস ফুঁকে বলতে শুরু করলো।

_ আপনার মা নিশ্চয়ই এটা জানিয়েছেন, আমি হ্যা বললে তিনি আব্বুর কাছে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে যাবে। কথা বলবে আমাদের এক হওয়ার ব্যপারে। এমন কী আমার সাথে যে দেখা করতে আসছেন সেটাও আপনার মা’কে বলে এসেছেন ।

বর্ণ খানিক বিমূঢ় দৃষ্টিতে তাকালো নদীর দিকে। তাঁর আর তাঁর মায়ের যে এমন কথাই হয়েছে নদী কী করে জানলো। সত্যি সে তাঁর মা’কে বলে এসেছে, সে নদীকে কনভিন্স করার জন্য এখানে আসছে। নিজের কৌতুহল যে সে চাপিয়ে রাখতে পারলো না,তাই নদীকে প্রশ্ন করলো–

_ তুই কি করে জানলি এসব?

বর্ণের কথায় নদী মুচকি হাসলো। ডান হাতের তালুতে শাওনের নামের উপর একবার চোখ বুলালো সে। ঝর্ণা জোড় করেই হাতে মেহেদী লাগিয়ে দিয়েছে, সাথে শাওনের নাম। মেহেদী রঙের গাঢ় রঙ যেন দুঃখের আগাম সতর্কসংকেত জানানোর চেষ্টা করে গেছে। নদী আজ নিজের বক্ষঃপঞ্জরের চাপিয়ে রাখা দীর্ঘশ্বাসটা লুকালো না। অন্ধকারে নিমজ্জিত গগনচুম্বী পালের দিকে তাকিয়ে নীরবে প্রসন্নচিত্তে বের করলো এতোদিনের চাপিয়ে রাখা দীর্ঘশ্বাস। বর্ণের মুখোপানে তাকিয়ে বের করলো নিজের অন্তরালের ব্যক্তিসত্তাটিকে।

_ আজ পর্যন্ত আপনি এমন কিছু করেছেন আমার জন্য, যাঁর দোহাই দিয়ে বলবেন আপনার জীবনে আমায় থেকে যাওয়া উচিত। বুকে হাতে দিয়ে বলতে পারবেন,আপনি আমায় বুঝতে পারেন। আমার বলতে না পারা কষ্ট গুলো আপনি নিমেষেই বাষ্পীভূত হয়ে উড়িয়ে দিতে পারবেন । কখনো এমন কোন কাজ করেছেন,যে কাজের জন্য আমি আপনার প্রতি মুগ্ধ হতে পারি। আমি যতোটা আপনায় বুঝতে পারি,তার সিকি ভাগও আমায় আপনি বুঝেন না। আপনি দূর্বল প্রেমিক পুরুষ, যে আমাকে কষ্ট দেয় সাথে নিজে কষ্ট পায়। কিন্তু আপনার হওয়া উচিত ছিলো একজন কঠিন হৃদয়ের প্রেমিক পুরুষ। যে নিজের কষ্ট আড়াল করে আমার কষ্ট গুলো ফানুশের মতো উড়িয়ে দিবে। সকল কথার তীর, আঘাত গুলো নিজের সবটা দিয়ে আঁটকে রাখবে। আমার চোখের জল আর বিকৃত স্বর শুনে বলতে পারবে আমি কখন কাঁদছি আর কখন হাসছি। কিন্তু আপনি তো নিজের কষ্টগুলোই সহ্য করতে পারেন না! আমার কষ্ট কীভাবে দূর করবেন। যে নিজেই আমাকে অন্য কারো কাছে রেখে আসতে পারে,সে কোনদিন যে আমাকে বিপদের মুখে ফেলবে না, কি করে বিশ্বাস করবো। নিজের অধিকার খাটাতে যাঁর হাত-পা কাপে তাঁর মতো পুরুষকে নিজের জীবন সঙ্গী বানানোর থেকে একজন অন্ধলোককে জীবন সঙ্গী বানানো অনেক ভালো। অন্তত মনকে এটা বলে বুঝ দিতে পারবো– সে চোখে দেখে না,তাই আমার সামনের গর্ত তাঁর নজরে পড়েনি। কিন্তু আপনি, আপনি কি জানেন বর্ণ ভাইয়া! আপনি হচ্ছেন সেই প্রেমিক পুরুষ যে কিনা যেচেই আমায় পাহাড়ের কিনারে দাঁড় করে জিজ্ঞেস করেন,তুমি পাহাড় ডিঙিয়ে আমার কাছে আসতে পারবে। আপনি নিজে থেকে কিছু করবেন না, অথচ আমায় বলছেন আপনার কাছে থেকে যেতে। এই কথাগুলো আপনার মুখে কখন মানাতো জানেন বর্ণ ভাই! যখন আপনি ভালোবাসার আসল মানে জানতেন৷ ভালোবাসা বললেই ভালোবাসা হয়ে যায় না। ভালোবাসা বড্ড তেঁতো, তাঁকে মিষ্টি করতে হয়। আপনার হওয়া উচিত ছিলো একজন ব্যক্তিত্ববান মানুষ।
যাঁর ব্যক্তিত্বের প্রেমে আমার বারবার পড়া উচিত ছিলো। কিন্তু আপনি একজন ব্যক্তিত্বহীন মানুষ, যাঁর নিজের বলতে কিছু নেই। আজ আমি বিপদে পড়লে আপনার ক্ষমতা নেই আমাকে আগলে নেওয়ার। যে প্রেম দহনের আগুনে আমি জ্বলেছি বা জ্বলছি তাঁর আন্দাজ করতে আপনার পুরো একটা বছর লেগে যাবে। এই যে শক্ত আবরণে সুপ্ত অনুভূতি গুলো আমি কীভাবে লুকিয়ে রাখলাম তা আপনি এতো বছরেও টের পেলেন না। অথচ আমি আপনার অনুভূতির সম্পর্কে আরো আগে থেকেই জানতাম। প্রতিনিয়ত আপনার মা আমাকে কথার তীরে এই নরম হৃদয়টা ছিন্নভিন্ন করে দিয়েছে, অথচ আমার পাশে থেকেও আপনি টের পেলেন না। আমার চরিত্র নিয়ে আপনার মা প্রশ্ন তুলেছে! আর আপনি সেই চরিত্র কাঁদা ছিটাতে উঠে পড়ে লেগেছেন। আপনি জানেন না,আমার বাড়িতে আমার জন্য কি অপেক্ষা করছে। আপনার জন্য আজ কতবড় সর্বনাশ আমার হতে চলেছে। সব শেষে একটা কথাই বলবো আপনার কোন যোগ্যতা ছিলো না আমার প্রেমিক হওয়ার আর না কোনদিন হবে। যে আমার প্রেমিক হতে পারেনি,সে আর যাইহোক কখনো একজন কেয়ারিং স্বামীও হতে পারবে না। আপনি প্রশ্ন তুলতেই পারেন,প্রেমিক হতে পারিনি বলে যে কেয়ারিং স্বামী হতে পারবো না তোকে কে বললো? তাহলে আমি বলবো আপনাকে সব প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার দায় আমার নেই,কিছু দায় আপনারও নেওয়া উচিত। দয়া করে এই কাপুরুষোচিত আচরণে আমায় ব্যতিব্যস্ত করবেন না বারংবার। আমার কষ্ট হয় আপনার এমন রূপ আর আচরণে। যতোই অস্বীকার করি ভালো তো আমি আপনাকেই বাসি।

সয়াহ্নের লগ্ন শেষ করে অন্ধকার ছড়ালো পশ্চিমাআকাশে। কিঞ্চিৎ দৃঢ়তা সম্পন্ন করে চাঁদের প্রচেষ্টা পৃথিবীকে আলোকিত করার। সিগ্ধ চাঁদের আলোয় ধরণী সেজে উঠলেও বুকের ভেতরে চলতে রইলো রক্তক্ষরণ। শীতল বাতাসের স্পর্শে শস্যশ্যামল ধানের ডগার মতো দুলছে চিকন সরু কৃষ্ণচূড়া গাছের সবুজ পাতা। সেই সাথে উড়ছে একটুকরো আকাশ। যা নদীর শাড়ির আঁচল । নীরব, নির্জন হয়ে হেঁটে চলছে তাঁর গন্তব্যের উদ্দেশে। একবারও কঠিন মনের মেয়েটা পিছু ফিরে তাকালো না। পিছু ফিরে একবারও ভেঙে যাওয়া বর্ণের মুখোপানে তাকালো না সে। সত্যিই কী সে ব্যর্থ? এতো প্রেম দহনে পুড়েও কি সে খাঁটি সোনা হতে পারেনি। তাহলে কি খাঁটি সোনা হতে হলে তাঁকে নদীকে চিরতরে হারিয়ে ফেলতে হবে। আজকের এই তিমির রাতের আকাশ কেটে যখন সূর্যের স্নিগ্ধ আলো ধরণীর সুদূর পরাহত থেকে বেরিয়ে আসবে! তখন এই কঠিন মেয়ে চিরতরে তাঁর থেকে হারিয়ে যাবে। তাঁকে আর পাওয়া হবে না। বুকের ভেতরে জ্বলতে থাকা দহনের আগুন আর নেভানো হলো না নদীর শীতল জল দিয়ে। এবার এই আগুনে বর্ণ জ্বলসে যাবে নির্ঘাত। প্রতিনিয়ত তাঁকে না পাওয়ার তীব্রতা আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে নিবে। পথের ধুলো তাঁকে নিয়ে হাসবে,শুভ্র মেঘের দল তাঁকে দেখে আফসোস করবে,শিশিরে ভেজা গোলাপটা তাঁকে নিয়ে ব্যঙ্গর্থ করবে। শহরের আনাচে-কানাচের ব্যর্থ পাগল প্রেমিক গুলো তাঁকে নিয়ে উপহাস করবে। তুমি ব্যর্থ বর্ণ, তুমি ব্যর্থ, তুমি কারো ভালোবাসা পাওয়ার যোগ্যতা রাখো না। তুমি ঠিক মেঘ থেকে ঝড়ে পড়া একপশলা বৃষ্টি মতো, যা সূর্যের তাপে শুকিয়ে যায়। তুমি নদীর বুকে জনস্রোতের মতো,যে বয়েই চলে থামে না কোথাও। নদী বলে চিৎকার করে উঠলো বর্ণ,হাঁটু গেড়ে সেখানেই মুখ চেপে বসে পড়লো সে। কান্না গুলো সব দলা পাকিয়ে গলায় আঁটকে গেছে। আজ তাঁদের সামনে আসার কড়া নিষেধাজ্ঞা করা হয়েছে। বর্ণের চৈত্র মাসের খড়া বুকের মাঝে একপশলা বৃষ্টি হতে কে যেন নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। যে নিষেধাজ্ঞা করেছে তাঁকে কারাদণ্ড দেওয়া হোক। তাঁর কষ্টে কেন নদী ব্যথিত হয়নি,তাঁকে সেই কষ্টে বেঁধে দেওয়া হোক বর্ণের বুকে।

————

নীরবতা ঝড়ের পূর্বাভাস। এমনটাই মনে হচ্ছে নদীর কাছে। পুরো বাড়ি যেন নীরব বিক্ষোভ মিছিলে নেমেছে। কারো কোন স্বাড়া পাওয়া যাচ্ছে না। তাহলে সে যা ভাবছে তেমন কিছুই কি হয়েছে। নিজের বৈষম্য বিমোচক ধারাটি দুর্বল হয়ে গেছে কয়েক মুহূর্তে কিছু একটা ভেবে। হৃদপিণ্ডটা চলছে দ্রুত গতিতে। সন্তপর্ণে এগিয়ে সে নিজের ঘর অবধি পৌঁছালো। কিন্তু নিজের ঘরে বাড়ির প্রতিটা সদস্যকে দেখে পিলে চমকে উঠলো নদীর। আব্বু,আব্বু কোথায়। হঠাৎ মান্নান সাহেবকে এখানে না দেখতে পেয়ে যেন নদীর ভয়টা কয়েকগুণ বেড়ে গেলো।
হৃদপিণ্ড কেঁপে উঠলো ক্রমাগত বর্জনের আওয়াজে। পাংশুটে ম্রিয়মাণ হয়ে গেছে মুখের অধল। বিচলিত কন্ঠে প্রশ্ন করতে চাইলো সবাইকে। কেন তাঁরা এই অসময়ে এখানে? কিন্তু কোন কথাই যেন কণ্ঠনালি থেকে বেরিয়ে আসতে নারাজ।

_ কোথায় ছিলি এতোক্ষণ নদী? ফোন বন্ধ কেন তোর?

সাগরের গম্ভীর কণ্ঠ আর অদ্ভুত প্রশ্নে নদী সম্বিৎ ফিরে পেলো যেন৷ আকস্মাৎ বলার মতো কোন কথা খুঁজে পেলো না সে। জিহ্বা দ্বারা ঠোঁটদ্বয়ের অংশটা ভিজিয়ে নিলো। কিছু বলতে নিলে তাঁকে হাত ইশারা করে থামিয়ে দিলো সাগর। আগের থেকে আরো কয়েকগুণ নিজের কন্ঠে গম্ভীরতা টেনে বললো–

_ বানোয়াট কোন গল্প বানিয়ে বলার চেষ্টা করবি না। আমরা কিন্তু সত্যিটা জেনে গেছি। তাই প্রতিটা কথা সাবধানের সাথে আর সত্যি বলবি।

সাগরের শৈথিল্য স্বরের কথায় নদী একপ্রকার হুমকি খুঁজে পেলো। নিজের ভয়টা বিদ্যমান করতে পারলো না সে! দরদর করে ঘামতে রইলো তাঁর সমস্ত শরীর। শিরা-উপশিরায় বয়ে গেলো এক শীতল পরশ। সব শেষে কী তাহলে নিজের চরিত্রে কাঁদা লেপে দিলো তাঁর ভালোবাসা। যে ভালোবাসা সে নিজের করেনি কখনো! শেষে কিনা সেই ভালোবাসা তাঁকে পরিবারের কাছে অপ্রীতিকর ঘটনার সামনে দাঁড় করালো। আয়শার সর্তক বানী তাহলে এটাই ছিলো কী?
#সমাপ্তির_প্রহরে_সন্ধি
#সমুদ্রিত_সুমি
পর্ব ২৯

সাগরের শৈথিল্য স্বরের কথায় নদী একপ্রকার হুমকি খুঁজে পেলো। নিজের ভয়টা বিদ্যমান করতে পারলো না সে! দরদর করে ঘামতে রইলো তাঁর সমস্ত শরীর। শিরা-উপশিরায় বয়ে গেলো এক শীতল পরশ। সব শেষে কী তাহলে নিজের চরিত্রে কাঁদা লেপে দিলো তাঁর ভালোবাসা। যে ভালোবাসা সে নিজের করেনি কখনো! শেষে কিনা সেই ভালোবাসা তাঁকে পরিবারের কাছে অপ্রীতিকর ঘটনার সামনে দাঁড় করালো। আয়শার সর্তক বানী তাহলে এটাই ছিলো কী?

_ কিরে কথা বলছিস না কেন?

সাগরের ধমকে লাফিয়ে উঠলো নদী। বলার মতো যে সে কিছুই খুঁজে পাচ্ছে না। কি বলবে সে। তাই চুপ করে থাকা ছাড়া কোন উপায় নেই। মাথা নিচু করে নীরবে চোখের জল বির্সজন দিয়ে গেলো নদী।
ঠিক তখনই নিজের গালে চড় অনুভব করলো। চোখটা উপরে তুলতেই বুঝলো চড়টা তাঁর বড় ভাই সাগর মেরেছে। সাগরের এমন অগ্নিরূপ দেখে নদী কিছুটা সময়ের জন্য থমকে দাঁড়ালো। এটা তাঁর ভাই কিনা সেটা সে পরখ করে নিলো। কিন্তু সত্যি এটাই, সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটা তাঁর মায়ের পেটের আপন ভাই। আজ কি এমন হলো যাঁর জন্য নদীকে সে এতো অবিশ্বাস করছে। যে বোনকে কখনো একটা ধমক অবধি দেয়নি,আজ সেই বোনের গায়ে কিনা হাত তুলতেও দ্বিধাবোধ করলো না। আরো অবাক হলো এটা দেখে,তাঁর পরিবারের প্রতিটা মানুষ চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। মুখ তুলে কিছু বলতে যাবে নদী ঠিক তখন সাগর চুপ করতে বললো। জোরে একটা শ্বাস নিয়ে বলতে শুরু করলো।

_ অনেক লায়েক হয়ে গেছিস তাই না। বাবা-র সম্মানের কথা চিন্তা করে, জীবনের সুখ বির্সজন দেওয়ার জন্য উঠে পরে লেগেছিস। তুই কেন বাবা-র সম্মানের কথা এতো চিন্তা করিস!যেখানে আমরা বড় হয়ে কখনো করিনি?
তোর এতো দায় কেন সবার ভালো করার? কি জন্য তুই এতো বড় ঋণের বোঝা আমাদের উপর চাপিয়ে দিতে চাইলি। এতোটা কষ্ট মনের মধ্যে চাপা দিয়ে প্রতিটা নিশ্বাসের সাথে বিষ গ্রহণ করেছিস আর আমরা টের পায়নি সেটা। আসলে তুই বোন হিসেবে স্বার্থক হলেও আমরা তোর ভাই-বোন হিসেবে স্বার্থক নই। দিনের পর দিন তোকে মেজ চাচি কষ্ট দিয়েছে, আর তুই — তুই কিনা সবটা আমাদের থেকে আড়াল করে গেলি। এই তুই এতো বেঈমান কেন? তোকে কি আমরা ভালোবাসায় কমতি দিয়েছিলাম কোথাও? হ্যা দিয়েছি হয়তো,তাই তুই আর বর্ণ এতো বড় সত্যি আমাদের থেকে লুকিয়ে গেলি। আজ যদি মেজ চাচি আমাদের বাড়িতে ঝামেলা না করতো কি হতো তাহলে? কাল তুই অন্য কারো বউ হয়ে যেতি। সময়ের পাল্লায় সামনে এগিয়ে গিয়ে ভুলে যেতিস নিজের ভালোবাসাকে। দায়িত্ব নিতে নিতে নিজের অস্তিত্ব বিলীন করে দিতো কোন দক্ষিণার হাওয়ায়। আর বর্ণ– সে হয়তো নিজের জীবন উৎসর্গ করে হারিয়ে যেতো পরপারে। তুই জানিস বর্ণ বিষ কিনে বাড়িতে রেখে তারপর তোর সাথে দেখা করতে। তুই যদি ওকে ফিরিয়ে দিস তাহলে বাড়িতে গিয়ে বিষ খেয়ে চিরজীবনের জন্য ঘুমিয়ে যাবে। আল্লাহ আমি ভাবতে পারছি না আমার ছোট্ট ছোট্ট ভাই-বোনেরা আমাদের থেকে এতো বড় সত্যি লুকিয়ে গেছে। আল্লাহ দয়া না করলে কি হতো সেটা ভাবলেই আমার গায়ে কাঁটা দিচ্ছে। সময় মতো যদি সবটা খোলাসা না হতো কি হতে পারতো জানিস? এখন হয়তো কারো মৃত্যু সংবাদ আমাদের কানে এসে যেতো। মা তুমি কিছু বলো,আমি আর কিছু বলতে পারছি না আমার হাত-পা অসম্ভব কাঁপছে।

সাগর সরে দাঁড়াতেই সামনে এগিয়ে এলো মিনা বেগম। মা’কে এগিয়ে আসতে দেখে এবার যেন নদী নিজেকে সামলে নিতে পারলো না। মায়ের বুকে ঝাপিয়ে পড়ে কান্না করতে শুরু করলো। বোনের মাথায় হাত রাখলো ঝর্ণা। মিনা বেগম মেয়েকে বুকে জড়িয়ে বললেন–

_ এতো বড় সত্যি আমাদের থেকে কেন লুকালি মা? কেন জানালি না তুমি আর বর্ণ একে-অপরকে ভালোবাসিস। কথা বল মা। আজ যদি তোর বা বর্ণের কিছু হয়ে যেতো তখন কি হতো বলতে পারিস?নিজেদের কখনো ক্ষমা করতে পারতাম আমরা। তোর বাবা সব সত্যি শুনে নিজেকে বারংবার দায়ী করতে রইলেন। লোকটার মুখের দিকে আমি তাকাতে পারছি না। ভেতর থেকে একদম ভেঙে গেছে। কীভাবে মেনে নিবে বল! যে মানুষটা মেয়ে অন্ত প্রাণ, নিজের অজান্তেই কিনা সেই মেয়ের এতো বড় ক্ষতি করতে বসেছিলো। এটা ভাবতেই তো তোর বাবা-র চোখ ভিজে উঠছিলো। মানুষটাকে সামলে নেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব না। তোর জন্য হয়েছে এবার তুই বোঝাপড়াটা কর তোর বাবা-র সাথে।

_ মা আমি–

_ আমি জানি তোর বাবা-র ঋণ আর তোর মেজো চাচিকে দেওয়া কথা রাখতেই তোর এই সিদ্ধান্ত। কিন্তু তুই কি জানিস তোর চাচির চোখে এতোদিন পট্টি বাঁধা ছিলো। তাহলে আসল ঘটনা কি সেটা শোন।

_ পারভীন তোর বাবা-র গ্রামের মেয়ে,সেই সুবাধে তাঁদের কিছুটা পরিচয় ছিলো। এই মুখেমুখে জানাশোনা আরকি। পারভীনের বড় বোন পারু তোর বাবাকে ভালোবাসতো। কিন্তু সেই কথা তোর বাবাকে জানালে তিনি সরাসরি বলে দেয় না। সে নিজের পরিবারের বাহিরে কিছু করবে না। আর এই প্রেম ভালোবাসা তো একদম নয়। যদি কপালে থাকে তাহলে না-হয় দেখা যাবে,কিন্তু নিজে থেকে কখনোই এমন কিছুতে সে জড়াবে না।
আগের কালের মানুষ আমরা সম্মানকে খুব ভালোবাসতাম। আর তোর বাবা-র কথা তো তুই জানিস। হঠাৎ তোর দাদু আমায় পছন্দ করলেন,হুট করেই আমাদের বিয়ে হয়ে গেলো। কিন্তু এই ঘটনাটা পারু মেনে নিতে পারেনি! আত্মাহত্যা করেছিলো সেদিন। পারভীন পুরো ঘটনা না জেনে ভুল বুঝেছিলো তোর বাবাকে। ভেবেছে তোর বাবা তাঁর সহজ সরল বোনকে ঠকিয়েছ। সেই দুঃখ মেনে নিতে পারেনি তাঁর বোন,তাই সে আত্মাহত্যা করেছে। প্রতিশোধের আগুনে তখন সে জ্বলছিলো। বোনের মৃত্যুর প্রতিশোধ নিতেই তোর চাচাকে বিয়ে করে। তখন আমরা সবাই একসাথেই ছিলাম। তোর চাচি প্রায়শই আমার তোর বাবা-র মাঝে ঝামেলা বাঁধিয়ে দিতে চেয়েছে! কিন্তু তাতে আমাদের সম্পর্ক আরো শক্ত হয়েছে। হঠাৎ এই বিষয়ে অবগত হয় শাহজাহান। ও সবটা লুকিয়ে চাকরির দোহাই দিয়ে পারভীনকে সরিয়ে নিয়ে যায় পরিবার থেকে দূরে। আর এই পুরো বিষয়টা তোর বাবা-র অগোচরে ঘটেছে,কারণ পারু যখন আত্মাহত্যা করে তখন তোর বাবা আমাদের বাড়িতে। বাড়িতে ফিরেই খুলনায় চলে আসে ছুটি শেষ হওয়ায়। তাই পরে পারুর ঘটনাটা শুনলেও তিনি গভীরে ভাবে ভেবে দেখেনি। তুই তোর বাবা-র সব থেকে বড় দূর্বলতা। তাই পারভীন তোকে কষ্ট দিয়ে সস্থি পেতো। তোকে কষ্ট দিলে পারভীনের মনে হতো ও তোর বাবাকে কষ্ট দিচ্ছে। তাঁর বোনের অপ্রিয়কর মৃত্যুর প্রতিশোধ নিচ্ছে সে। বড় বোনের অকালেই এভাবে চলে যাওয়া পারভীন মেনে নিতে পারেনি তাই এসব করেছে। সব কিছু যখন আজ খোলাসা হয়েছে পারভীন তোর বাবা-র পা ধরে ক্ষমা চেয়ে গেছে। নিজের করা সব অপকর্ম স্বীকার করে গেছে। আর বলে গেছে তোর আর বর্ণের ভালোবাসার কথা। আমরা প্রতিটা মানুষ আশ্চর্য হলাম এই ঘটনার মুখোমুখি হতেই। আমাদের পরিবারের ছোট্ট মেয়েটাকে আমরা আসলে উপর থেকে আগলে রেখেছি,ভেতর থেকে তো সে নিজেই নিজেকে সামলে নিয়েছে। কিন্তু মা সব ছেলে তো পারফেক্ট হয় না। কিন্তু আমি হরফ করে বলতে পারি বর্ণ তোকে খুব ভালোবাসে। তোর বাবা গেছে নিজের ঋণ নিজেই শোধ করতে। তুই এসব নিয়ে একদম চিন্তা করিস না,সব ঠিক হয়ে যাবে। মা আমার এতো বড় কবে হলি? আমি নিজেও তোর কষ্ট বুঝতে পারলাম না মা হ’য়ে। আমার মতো মা যেন কারো না হয়।

_ মা এভাবে বলো না,আমার কষ্ট হচ্ছে।

_ আমার এতো আদরের মেয়েটা এভাবে কষ্ট পেলো আর আমরা বুঝলামই না।

কেটে গেলো প্রায় অনেকটা সময়। হঠাৎ নদীর ফোনটা বেজে উঠলো। ফোনের স্কিনে ভেসে উঠলো শাওনের নাম। শাওনের নামটা ভেসে উঠতেই নদীর বক্ষঃস্থল ভয়ে চুপসে গেছে। না জানি কোন প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয় তাঁকে এখন। এই মানুষটাকে তো না চাইতেই ঠকানো হয়ে গেছে। নিস্বার্থে মানুষটা ভালোবেসে গেছে! আর আজ বিনিময়ে কিনা–। কাঁপা হাতেই ফোনটা রিসিভ করলো নদী। কর্ণকুহের কাছে ফোনটা তুলে নিলো। নীরবতা ঘিরে ধরলো দু’পাশেই। একসময় সবটা কাটিয়ে শাওন বলে উঠলো।

_ আমি তোমাকে আমার করে পেতে চেয়েছি হৃদয় থেকেই। একান্ত আমার হওয়া একটা মানুষ চেয়েছি। কিন্তু তুমি তো বহু আগেই অন্য কারো হয়ে গেছো মন থেকে। তাই এখানে তোমাকে পাবার যুদ্ধে আমি নামতে চাই না। আমি চাই তুমি তোমার ভালোবাসাকে পেয়ে সুখি হও। অপূর্ণ ভালোবাসা না-হয় আমার হয়েই থাকুক। ভালোবাসাকে পাওয়ার থেকে ভালোবাসাকে ভালো রাখা বড় মুশকিল কাজ। আমি সেই মুশকিল কাজ করলাম না হয়। ভুল করে ভুলে আমায় মনে করো,সেটাই আমার তৃপ্তি। আজ তোমার একজন শত্রু হয়ে নয় বন্ধু হয়ে পাশে থাকছি। কখনো তোমার সাথে রাস্তার কোন মোড়ে দেখা হলে আমি যেন মাথা উঁচু করে কথা বলতে পারি। ভালোবাসা পাবার দাবিতে আন্দোলন করা আমার সাজে না,যেখানে তুমি নামক মানুষটা আমায় ভালোবাসো না। তুমি যদি আমায় ভালোবাসতে তাহলে না-হয় রাজপথে নেমে খুন করে খুনি হতাম। যেহেতু তুমি আমায় ভালোবাসো না,তাই আমি খুনি তো দূর বেঈমান হতেও রাজি নই। রাখছি ভালো থেকো।

ভালো থেকো,এই বাক্যটা কতো ভারি তা সবাই বোঝে না। যে বলে হয়তো সেই একমাত্র বোঝে। শেষের কথাগুলো বলতেই শাওনের গলা ভারি হয়ে এলো। দলা পাকিয়ে কষ্ট গুলো কন্ঠ নালিতে বেঁধে গেলো। তাই তো আরো কিছু বলার থাকলেও বলতে পারলো না সে। বলতে পারলো না মনের জমিয়ে রাখা শেষ কিছু বাক্য– আমিও তোমায় খুব ভালোবাসি নদী। এভাবে পেয়েও তোমায় হারিয়ে ফেলার কষ্টটা বড্ড অসহায় বানিয়ে দিলো আমায়। এই ভেঙে যাওয়া শাওনকে কে গড়বে নদী। তোমার সুখের বৃষ্টি তো বর্ণ চিহ্নিত করেই দিলো। আমার সুখের বৃষ্টি যে হারিয়ে গেছে। আমার না হওয়া আকাশের চাঁদ অন্য কারো আকাশে জোছনা ধরার রশ্মি ছড়াবে। আর আমার আকাশে আজ থেকে অমাবস্যার আঁধার নেমেছে। তবুও বলবো ভালো থেকো। চাইলেই কি ভালো থাকা যায়,ভালো থাকতে চাওয়াটা বড্ড দায়।

ফোনটা বিছানার উপরে ফেলে দিয়ে দিয়ে অসহায় চোখে একবার বোনের নিকট তাকালো। ঝর্ণা বোনের মাথায় হাত রেখে শান্তনা দেওয়ার চেষ্টা করলো। আকম্মাৎ সাগর ছুটতে ছুটতে বিচলিত কন্ঠে মায়ের উদ্দেশ্য বললো

_ মা যে ভয়টা পেয়েছি সেটাই হয়েছে।

_ সাগরকে অস্থির হয়ে কথা বলতে শুনে সবাই বিমূঢ় দৃষ্টিতে তাকালো। মিনা বেগম ছুটে ছেলের কাছে এগিয়ে গেলেন।

_ কি হয়েছে খুলে বল

_ মা,মা বর্ণ

_ বর্ণ কি ভাইয়া?

বর্ণের নামটা শুনতেই হৃদপিণ্ডটা দ্রুত গতিতে চলতে রইলো। নিজেকে বিদ্যমান করে রাখতে পারলো না নদী। ভয়ে তাঁর গলা শুকিয়ে গেছে। ভাইয়ের বাহু ধরে ঝাকাতে রইলো,আর বলতে রইলো।

_ কি হয়েছে ভাইয়া বলো। কি হয়েছে বর্ণ ভাইয়ার।

নদীর প্রশ্নের প্রত্যুত্তরে আকস্মাৎ কিছু বলে উঠতে পারলো না সাগর। রয়েসয়ে উত্তর দিলো।

_ বর্ণ সুইসাইড করেছে।

বর্ণ সুইসাইড করেছে কথাটা নদীর কর্ণকুহরে সাময়িক ভাবে প্রতিধ্বনি তুলছে। ক্ষণিকের জন্য কিছু তুরঙ্গিত করতে পারলো না সে। অসহায় দৃষ্টিতে একবার ভাইয়ের দিকে তাকালো। বর্ণ বলে চিৎকার করে ওখানেই লুটিয়ে পড়লো নদী।

ইনশাআল্লাহ চলবে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here