#সাত_সমুদ্রের_তিমির
পর্বঃ০৭
#সুমাইয়া_আফরিন
অনু রাগে গন্তব্যহীনভাবে হনহন করে হেঁটে যাচ্ছে। হঠাৎ অনুর হাত পেছন থেকে কেউ আকড়ে ধরে। অনু মাথা আরো গরম হয়ে যায়। অনু চোখ গরম করে পেছনে তাকিয়ে দেখল মিমি তার হাত ধরে আছে। অনু এক ঝটকায় নিজের হাত ছাড়িয়ে নিল। পর মুহুর্তেই কিছু বলতে যাবে কিন্তু আর বলল না সে। বড় বড় স্বাস নিয়ে নিজেকে শান্ত করল অনু। তারপর মিমির দিকে তাকিয়ে বলল,
‘কি রে?কি হয়েছে?’
‘আমার কি হয়েছে মানে?তুই বল তোর কি হয়েছে?এতো হাইপার হয়ে আছিস কেন? আর হঠাৎ করে কোথায় চলে গেলি?তুই জানিস তোকে কোথায় কোথায় খুজেছি আমরা?আর…….
‘আরে বাবা থাম, প্রশ্নের বন্যা বইয়ে দিচ্ছিস তুই। কোথায় আবার যাবো, এইদিকেই ছিলাম।’
‘এতো রেগে ছিলি কেন? কি হয়েছে?’
‘একটা বেড়ালের সাথে দেখা হয়েছিল। তাই এত রেগে ছিলাম।’
মিমির সাথে কথা বলার সময় লারা আর ইরাও উপস্থিত হলো। লারা আর ইরাও অবাক হয়ে গেছে অনুর কথায়। লারা কিছু বলতে যাবে তার আগেই অনু বলে উঠল,
‘আরশি কোথায়? চল, ওর কাছে যাই।’
লারা, ইরা আর মিমি অনুর কথায় আরশির রুমের দিকে পা বাড়ালো। অনু কোনো রকমে নিজেকে শান্ত রেখেছে। অনু মোটেও চায় রাফাতের সাথে তার বারবার দেখা হোক। অনু এবার বুঝতে পারছে, সবাই কেন তার দিকে এভাবে তাকাচ্ছিল। রাফাত এসেছে এই বাড়িতে তাই সবাই অনুর দিকে এভাবে তাকাচ্ছিল।
রাফাত দুই বছর আগে ঢাকায় এসেছে। দেশে আসার পর একবারও নিজের গ্রামে আসেনি সে। এই ভয়ে যে,অনুর সাথে তার দেখা হয়ে যাবে। অনুদের গ্রাম অর্থাৎ সোনালীপুর গ্রামটা অনেক বড় একটা গ্রাম। অনুদের বাড়ি থেকে রাফাতের বাড়ি বেশ দূরে। এই সাত বছরে একবারও রাফাতের পরিবার যোগাযোগ করেনি অনুর পরিবারের সাথে। রাফাতের মা অনুকে চিনলেও রাফাত অনুকে চেনে না। রাফাত মন থেকে অনেক চেষ্টা করেছে অনুকে মেনে নেওয়ার। রাফাত ঢাকায় এই উদ্দেশ্যেই এসেছিল যে, অনুর সাথে নতুন জীবন শুরু করবে সে। রাফাত জানে, সে মানুক আর নাই মানুক অনুর সাথেই সারাজীবন কাটাতে হবে তাকে। যার জন্য পনেরো বছরে রাফাত কোনো মেয়ের সাথে কথা বলেনি। কিন্তু পনেরো বছর পর মেয়েদের থেকে এড়িয়ে চলার চেষ্টা চালাতে চালাতে রাফাতের পক্ষে আর সম্ভব হয় না। একদিন রাফাত নিজের অজান্তেই প্রেমে পড়ে যায় একটি মেয়ের। নিজেকে আর সামলাতে পারে না সে। তার মনের মধ্যে অনুকে ছেড়ে সেই মেয়ের সাথে সংসার করার বাসনা জাগে। যার জন্য রাফাত অনুকে আজও আপন করে নিতে পারেনি।
অনু মুখ গোমরা করে আরশির পাশে বসে আছে। আরশি পরিবারের মধ্যে কেউ অনুর সাথে ঘটা কাহিনী জানে না। তারা এটাও জানে না যে অনুর বিয়ে হয়েছে। গ্রামে প্রথম প্রথম এই নিয়ে অনেক কথা বার্তা চলতো কিন্তু এখন আর এইসব নিয়ে কথা হয় না। কিন্তু সমাজের সবাই সবসময় চুপ করে থাকে না। তাই আজও অনু কেউ না কেউ খোটা দেয়। কিন্তু অনুর এই নিয়ে কোনো মাথা ব্যাথা নেই। অনু এইসব কথা আর গায়ে মাখায় না।
আরশি অনুর এভাবে বসে থাকাতে গুতো দিয়ে জিজ্ঞাসা করলো,
‘কি হয়েছে আপু?এভাবে মন খারাপ করে বসে আছো কেন?’
অনু কি বলবে বুঝতে পারছে না। সে তো আর আরশিকে বলতেও পারবে না যে কেন তার মন খারাপ।কিছু না ভেবেই অনু আমতা আমতা করে বলল,
‘তুই আমার থেকে অনেক দূরে চলে যাবি তো তাই এত মন খারাপ আমার।’
আরশি অনুর কথায় একটা হাসি দিয়ে জড়িয়ে ধরে অনুকে। অনুও আপন করে নেয় আরশিকে। অনুর পাশেই তার তিন বান্ধবী বসে আছে। কিন্তু তিনজনই ফ্রি ফায়ার খেলতে ব্যাস্ত। অনু তাদের দিকে তাকিয়ে মুখে বিরক্তির ছাপ এনে বলল,
‘তোরা বিয়ে বাড়িতে এসেও ফোনে ফ্রি ফায়ার খেলছিস?’
ইরা ফোন থেকে নিজের চোখ সরিয়ে নিল।তারপর অনুকে উদ্দেশ্য করে বলল,
‘অনু ভুলভাল কথা বলিস না।এইটা মোটেও বিয়ে বাড়ি নয়, এইটা গায়ে হলুদের বাড়ি।’
অনু ইরার কথায় অনেকটা বিরক্ত বোধ করল কিন্তু তা প্রকাশ করল না। অনু ইরার থেকে মুখ ঘুরিয়ে আরশির দিকে নজর দিল।অনু খেয়াল করল আরশিকে আজ বেশ সুন্দর লাগছে। অবশ্য গায়ে হলুদের সাজে প্রত্যেকটা মেয়েকেই সুন্দর লাগে অনুর কাছে। আরশি অনুর দিকে ভ্রু কুচকে জিজ্ঞাসা করল,
‘আপু তোমার থেকে আমি ছোট হয়ে বিয়ে করে নিলাম অথচ তুমি এখনো বিয়ে করলে না। কবে করবে বিয়ে?’
আরশির এমন প্রশ্নে অনু চমকে উঠল।অনুর হাস্যজ্জল মুখ মুহূর্তেই মলিন হয়ে গেল। অনু কি বলবে তা বুঝতে পারছে না। আরশি খেয়াল করল অনুর চোখে অস্ফুট কষ্ট ভেসে উঠেছে। আরশি ভ্রু কুচকে অনুর দিকে তাকিয়ে রইল।অনু কোনো কথা না বলে চুপ করে রইল।হঠাৎ পেছন থেকে একজন অট্টহাসিতে মেতে উঠল। সবাই অবাক চক্ষুতে মহলাটির দিকে তাকিয়ে আছে। মহিলাটি মুখ বাকিয়ে বলল,
‘আরশি রে, হাসালি রে হাসালি।’
আরশি জিজ্ঞাসু চাহনিতে মহিলাটির দিকে তাকিয়ে আছে। মহিলাটির কথায় অনুর বুকের ভেতর ছ্যাৎ করে উঠল। অনু চায় না আরশি বা আর কেউ এই বিষয়ে জানতে পারে। আরশি অবাক হয়ে মহিলাটিকে জিজ্ঞাসা করল,
‘কেন কাকি, হাসানোর কি বললাম আমি।’
‘ক্যা রে,তুই জানিস না। তোর এই আদরের বুনের সাত বছর আগে বিয়া হইয়া গেছে গা।’
আরশি যেন আকাশ থেকে পড়ল কথাটা শুনে।আরশি অগ্নিদৃষ্টিতে অনুর দিকে তাকিয়ে আছে। অনু মাথা নিচু করে বসে আছে আরশির পাশে। অনুর চোখের কোণে পানি জমে গেছে। অনুর নিশ্বাস ঘন হয়ে আসছে। পেছনের বয়ষ্ক মহিলাটির হাসি যেন আরো বেড়ে গেছে। ইরা, লারা,মিমি মোবাইল রেখে অনুর দিকে তাকিয়ে রয়েছে। মিমি অনুকে উদ্দেশ্য করে আস্তে করে বলল,
‘অনু চল এখান থেকে। কিছু কিছু মানুষ আছে যারা মানুষের বাস্তবতটা বুঝতে পারে না। জ্ঞানের বড়ই অভাব তাদের।’
মিমির কথাটা বলতে দেরি হতে পারে কিন্তু মহিলাটির পাল্টা জবাব দিতে দেরি হলো না। মিমির দিকে অগ্নিদৃষ্টিতে তাকিয়ে মহিলাটি বলে উঠল,
‘ওই মাইয়া, এহনো নাক টিপলি দুত বাড়ায় তুই আবার আমার মুহির উপর দিয়া কতা কইস। এই অনুর সাত বছর বিয়া হইছে, তারপরেও শশুর বাড়ি পা দিয়া দেকলো না। কুন জায়গায় পেমটেম কইরা বেড়ায় তার নাই ঠিক। মেলা বছর আগেও ছেলেগের সাতে শুয়ে বেড়াইছে ও। চরিত্রের নাই ঠিক আবার বড় বড় কতা কয়।’
মহিলাটি মুখ ভেংচি দিয়ে দরজা দিয়ে বের হতে গেল। অনু নিজের রাগ সামলাতে না পেরে মহিলাটিকে উদ্দেশ্য করে বলল,
‘শুনলাম, আপনার মেয়ে মরিয়ম নাকি নিজের স্বামীকে ছেড়ে অন্য ছেলের হাত ধরে পালিয়ে গেছে। আবার সেই ছেলের বাচ্চা পেটে নিয়ে নাকি স্বামীর কাছে ফিরে এসেছে।ঠিক শুনেছি না ভুল শুনেছি চাচী?’
মহিলাটি অগ্নিদৃষ্টি নিক্ষেপ করে অনুর দিকে তাকিয়ে রয়েছেন। দাঁত কিটমিট করতে করতে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন তিনি। অনু অশ্রুসিক্ত চোখ নিয়ে তাকিয়ে আছে মহিলার যাওয়ার দিকে। আরশি অনুর কাধে হাত রেখে বলল,
‘তোমার এত আগে বিয়ে হয়েছে আমাদের তো বললে আপু।’
অনু বজ্রচোক্ষুতে তাকিয়ে আছে আরশির জিজ্ঞাসু মুখস্রির দিকে। আরশি অনুর অশ্রিসিক্ত চোখ দেখে বুঝতে পেরে গেল তার বোন কষ্ট পাচ্ছে কথাগুলোয়। আরশি কথা ঘুরিয়ে হাসি মুখে বলল,
‘আচ্ছা বাদ দাও তো, আপু একটু দেখো না, এই ক্লিপটা কেমন যেন খুলে খুলে যাচ্ছে।’
অনু নিজের চোখ সাবধানতার সাথে মুছে নিয়ে আরশির ক্লিপ ঠিক করতে ব্যস্ত হয়ে গেল। ঘরের সবার দৃষ্টি আকর্ষন করে নিয়েছে কিছুক্ষন আগের ঘটে যাওয়া ঘটনাটি। তাই সবাই অনুর দিকে তাকিয়ে রয়েছে। অনু সবার দৃষ্টি উপেক্ষা করে নিজের কাজে সর্বোচ্চ মনোযোগ দিল।
____________
আরশির গায়ে হলুদ হয়ে গেছে প্রায় দুই ঘন্টা আগে। সব মেহমানরাও চলে গেছে। অনু ওই ঘর থেকে আর বের হয়নি। গায়ে হলুদে এসেই মন খারাপ হয়ে গেছে তার। আর ভালো লাগছে না ঘোরাফেরা করতে। না চাইতেও অনুর খুব কষ্ট হয় যখন তার চরিত্র নিয়ে কথা ওঠে। আর যাই হোক অনু তো একজন মেয়ে। প্রত্যেকটা মেয়ের কাছে তার জীবনের থেকে নিজের সম্মান বেশি মূল্যবান হয়ে থাকে। আর যখন এই সম্মান ক্ষুন্ন হয় তখন বেঁচে থাকার কোনো মটিভ থাকে না। যখন একজন মেয়ের চরিত্র নিয়ে বাজে কথা হয় তখন সে মেয়ের কাছে সেই মুহূর্ত বিষাক্ত হয়ে ওঠে।
________
পুরো বাড়ির মধ্যে রাফাতের চোখ শুধু একজনকেই খুজে যাচ্ছে। তাকে খুজছে যার নাম, ঠিকানা কিছুই জানে না সে। শুধু এটাই জানে যে মেয়েটা একজন নিউ ডক্টর। রাফাত কখনো ভাবতেও পারেনি তার ভালোবাসার মানুষকে সে এই গ্রামে দেখতে পারবে। কোনো কিছু না ভেবে রাফাত নির্বিকারভাবে খুজে যাচ্ছে তার ভালোবাসার সেই মানুষটাকে। যাকে একবার দেখেই প্রেমে পড়ে গেছিল সে।
অনুকে খুজতে খুজতে হঠাৎ রাফাতের চোখ পড়ে একজন বয়ষ্ক মহিলার দিকে। রাফাত তাকে দেখেই চমকে উঠল। রাফাত অনুকে ভালোভাবে না চিনলেও অনুর মাকে খুব ভালো করে চেনে সে। রাফাতের সামনে অনুর মা দাঁড়িয়ে একজনের সাথে কথা বলছেন। অনুর মা রাফাতের দিকে তাকাতেই রাফাত নিজেকে আড়াল করে নিল। রাফাত সেখান থেকে অনেকটা দূরে চলে গেল। হাঁটতে হাঁটতে রাফাত একটা রুমে ঢুকে পড়ল।
রুমের ভেতরে তাকাতেই মুখের কোণে হাসি ফুটে উঠল তার। রাফাতের সামনে অনু আরশির পাশে বসে আছে। রিয়া রাফাতকে দেখেই অবাক হয়ে হা করে উঠল। ঘরের মধ্যে বেশি কেউ ছিল না। সেখানে উপস্থিত অনুর বান্ধবী আর আরশি রিয়ার এমন অবাক হওয়া চেহারা দেখে সামনে তাকাতেই দেখল রাফাত দাঁড়িয়ে আছে। অনু আর আরশি ছাড়া সবাই অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে রাফাতের দিকে। তারা মোটেই রাফাতকে আশা করেনি এখানে।
কিছুক্ষন এভাবেই অনু আর রাফাতের মধ্যে চোখাচোখি চলল। রাফাত আর কারো দিকে যেন তাকাতেই পারছে না। রাফাতের এমন তাকানোতে রিয়া জ্বলে পুরে শেষ হয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ বাইরে থেকে চিৎকারের আওয়াজ আসতেই সবার মনোযোগ বাইরে আবদ্ধ হলো। অনু নিজের মায়ের কন্ঠস্বর পেতেই চমকে উঠল। শুধু যে অনুর মায়ের কন্ঠস্বর পাওয়া গেল ঠিক তা নয় রাফাতের মায়েরও কন্ঠস্বর পাওয়া যাচ্ছে। যার কারনে অনু আর রাফাত নিজেদেরকে শান্ত রাখতে না পেরে দৌড়ে ছুটে গেল সেখানে। পেছন পেছন ইরা, লারা,মিমি, রিয়া আর আরশিও বের হয়ে আসলো।
রাফাত সর্বপ্রথম সেখানে উপিস্থিত হলো এবং প্রচন্ড হতাশ হলো সে। ঠিক যেই জিনিসটার ভয় পাচ্ছিল সেটাই হয়েছে। অনু কিছুক্ষন পর পৌছে গেল সেখানে। বাইরে যা ঘটছে এসবকিছু দেখে অনু ভীষন অবাক হয়ে গেল। সে কখনো আশা করেনি যে আজকের দিনে এমন কিছু একটা ঘটবে।
#সাত_সমুদ্রের_তিমির
পর্বঃ০৮
#সুমাইয়া_আফরিন
রাফাত সর্বপ্রথম সেখানে উপিস্থিত হলো এবং প্রচন্ড হতাশ হলো সে। ঠিক যেই জিনিসটার ভয় পাচ্ছিল সেটাই হয়েছে। অনু কিছুক্ষন পর পৌছে গেল সেখানে। বাইরে যা ঘটছে এসবকিছু দেখে অনু ভীষন অবাক হয়ে গেল। সে কখনো আশা করেনি যে আজকের দিনে এমন কিছু একটা ঘটবে।
অনুর সামনে রাফাতের মা কাকলি সরকার মুখে যা আসছে তাই বললে অপমান করছেন অনুর মা হাফসা বেগমকে। হাফসা বেগম কিছু বলতে চাচ্ছেন কিন্তু কাকলি সরকার তা বলতে দিচ্ছেন। অনু কিছু বলতে যাবে হাফসা বেগম ইশারায় থামিয়ে দিল তাকে। অনুর বাবা ইসাক আহমেদও নেই সেখানে। তিনি এক কাজে অনেক আগেই চলে গেছেন এখান থেকে। অনুর পেছনে আরশি, রিয়া, লারা,ইরা আর মিমি হতভম্বের মতো দাঁড়িয়ে আছে৷ এখানে কি হচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছে না তারা।
রাফাত নিজের মাকে চুপ করানোর অনেক চেষ্টা করছে কিন্তু কিছুতেই সফল হচ্ছে না সে। রাফাত কিছু বলতে গেলেই তার ছোট বোন আর দাদি চুপ করিয়ে দিচ্ছে। কারন তারাও চায় অনুর পরিবারকে একটু অপমান করতে।রাফাতের মা অগ্নিদৃষ্টিতে হাফসা বেগমের দিকে তাকিয়ে বললেন,
‘কি আছে টা কি তোমার মেয়ের হাফসা? একটা অশিক্ষিত গাইয়া মেয়ে তোমার। আমার ছেলের নখেরও যোগ্যতা নেই তোমার মেয়ের। জানো আমার ছেলে আজকে যে পাঞ্জাবী পড়েছে তার প্রাইস কতো? শুনলে হয়তো তুমি পাগল হয়ে যাবে। শুনেছি তোমার মেয়ে নাকি জব করে? কিসের জব করে শুনি? গার্মেন্টসে? নাকি হোটেলের প্লেট ধোয়ার কাজ করে?আমার ছেলের স্ট্যান্ডার্টে……..
আর কিছু বলতে পারলেন না কাকলি সরকার। অনুর রাগের বাধ ভেঙে গেছে। নিজের চোখের সামনে নিজের পরিবারের অপমান সহ্য করতে পারছে না সে। নিজের রাগকে কন্ট্রোল করতে না পেরে কাকলি সরকারকে উদ্দেশ্য করে বলল,
‘এক্সকিউজ মি আন্টি, আপনাদের ব্যাবহার প্রতিনিয়ত আমাকে অবাক করে দিচ্ছে। আপনার সো কল্ড হাজবেন্ট আমার সাথে যেটা করেছে সেই টার পরে আপনি কীভাবে আমাদের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন আমি শুধু সেইটাই ভাবছি। আপনার তো আচল দিয়ে মুখ ঢেকে রাখার কথা। নিজের স্বামীর তো চরিত্র ঠিক নেই, তো এখানেই বোঝা যায় আপনার ছেলের চরিত্র কেমন হবে।আপনার ছেলের সাথে যদি আমার সংসার করার ইচ্ছা থাকতো তাহলে এতদিনে আমি আপনার বাড়িতে থাকতাম। আপনার ছেলের মতো মানুষের সাথে আমার সংসার করার কোনো ইচ্ছা নেই। আপনাদের মতো মানুষদের আমি ডিজার্ভ করি না। আর হ্যা,ডিভোর্স পেপার আমার বাড়িতে পাঠিয়ে দেবেন।’
অনু কথাগুলো বলে জোড়ে জোড়ে শ্বাস নিতে থাকল। রাগে তার চোখ রক্তবর্ণ ধারন করেছে। হাতের মুঠো বারবার শক্ত হয়ে আসছে তার। মাথার রগগুলো ফুলে উঠেছে অনুর। কাকলি সরকার বজ্র চোক্ষুতে অনুর দিকে তাকিয়ে আছেন। অনুর এমনভাবে প্রতিবাদ করবে তা কাকলি সরকার কখনো ভাবতেও পারেনি। মুখের ভাষা হারিয়ে গেছে তার।কারন অনুর বলা প্রত্যেকটা কথা সত্য। তার স্বামী অনু সাথে যা করেছে তা ক্ষমার অযগ্য।
হাফসা বেগম অনুর দিকে রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। তার কাছে অনুর এভাবে কথা বলাটা ঠিক হয়নি। তার মতে তারা অনুর বিষয়ে কিছুই জানে না তাই এমন করছে। তাই তাদের সাথে শান্ত ভাবে কথা বলা উচিত। তাদের ভালোভাবেই বোঝানো প্রয়োজন।
অনু আর এক মুহূর্তও দাড়ালো না সেখানে। বাড়ির মেইন দরজা দিয়ে বের হতে গেল সে। কিন্তু দরজার কাছে গিয়েই থেমে গেল তার পা। পেছন ফিরে তাকিয়ে রাফাতকে উদ্দেশ্য করে বলল,
‘খুব শিঘ্রই আমি আপনার হাজবেন্টকে জেলে পাঠাবো। মিস্টার আলি উদ্দীন চৌধুরিকে যদি আমি জেলের ভাত না খাইয়ে ছেড়েছি তাহলে আমার নামও হুমাশা রহমান অনু নয়।’
এবার রাফাত নিজেকে আর শান্ত রাখতে পারল না। নিজের পরিবারকে যদি কেউ অপমান করে তাহলে কেউ নিজেকে শান্ত রাখতে পারে না। অনু তার বাবাকে অপমান না করে তার মা আর তাকে কেন অপমান করছে তা রাফাতের বোধগম্য নয়। কিছু না ভেবেই রাফাত অনুর দিকে তার অগ্নিদৃষ্টি নিক্ষেপ করে রাগী কন্ঠে বলল,
‘শাট আপ অনু। আমার বাবা তোমার সাথে যা করেছে অনেক অন্যায় করেছে আই আগ্রি ইট। বাট আমার মা কিছু করেনি যে আচল দিয়ে মুখ ঢেকে রাখবে। আর আমার সম্পর্কে কি জানো তুমি? যদি তুমি আমার সম্পর্কে কিছু জানতে তাহলে আমাকে চরিত্রহীন বলতে না। সো, আগে নিজের বিহেভিয়ার ঠিক করো দেন কথা বলতে এসো।’
‘রিয়েলি? আপনার মা আমার মায়ের সাথে যে ব্যবহারটা করলো সেটা কি খুব ভালো একটা কাজ ছিল? আমার মাকে যা নয় তাই বলে ইনসাল্ট করেছেন তিনি। আর এরপরেও আপনি বলছেন আমি চুপ থাকবো?লিসেন মিস্টার রাফাত চৌধুরি, আপনি যেমন আপনার মায়ের অপমান সহ্য করতে না পেরে চুপ থাকতে পারেননি, আমিও পারিনি।আর রইল আপনার কেরেক্টার, আপনি যদি এতই ভালো মানুষ হতেন তাহলে অন্য কোনো মেয়েকে ভালোবেসে তাকে নিজের স্ত্রী করার সপ্ন দেখতেন না।
রাফাত কিছু একটা বলতে চাইল কিন্তু অনু হাত উচু করে থামিয়ে দিল তাকে। কারন অনু আর কিচ্ছু শুনতে চায় না রাফাতের মুখে। রাফাতের প্রত্যেকটা কথা অনুর হৃদয়ে তীরের মতো গিয়ে আঘাত করে। অনুর নিষ্পাপ চোখ দিয়ে অনবরত নোনা জল গড়িয়ে পড়ছে। অনু আর সহ্য করতে পারছে না এসবকিছু।
অনু বড় বড় পা ফেলে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল। অনুর এভাবে বের হওয়া দেখে ইরা, লারা আর মিমি প্রচন্ড ভয় পেয়ে গেল। নিজেদের সামলাতে না পেরে অনুকে ডাকতে ডাকতে তারাও অনুর পেছন পেছন চলে গেল।
রাফাত ছলছল চোখে তাকিয়ে আছে অনুর যাওয়ার পানে। নিজের অজান্তেই রাফাতের চোখে নোনা অশ্রু জল হানা দিয়েছে। রাফাত কখনো সপ্নেও ভাবতে পারেনি সাত বছর আগে বিয়ে করা মেয়েটিই তার ভালোবাসার সেই মেয়েটি। রাফাত নিজের অজান্তেই ভালোবেসে ফেলেছে অনুকে। রাফাত আর কিচ্ছু ভাবতে পারছে না। একটা শুকনো ঢক গিলে বাড়ি থেকে বের হয়ে গেল সে।
বাড়িতে এখন বেশি কেউ নেই। শুধু মাত্র আরশি ও তার বাবা মা, রিয়া,কাকলি সরকার ও তার ছোট ছেলে ও ছোট মেয়ে আর হাফসা বেগম রয়েছেন।আরশি ও তার বাবা মা আর রিয়া হতভম্বের মতো দাঁড়িয়ে আছে। এখানে কি হচ্ছে কিছুই তাদের বোধগম্য নয়। সবাই শুধু এইটুকুই বুঝতে পেরেছে যে অনু আর রাফাতের বিয়ে হয়েছে তাও অনেক আগে।
রিয়া অবাকের চুড়ান্ত সীমায় ঝুলছে। রিয়ার বুকের ভেতরটা দুমরে মুচরে যাচ্ছে। রাফাত আর অনুর বিয়েটা সে কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না। তিনবছর ধরে রাফাতের ছবি নিজের বুকে চাপিয়ে ঘুমিয়েছে সে। রাফাত আর অনুর বিয়ে হলেও সে রাফাতকে ছেড়ে দেবে না এমনটা তার প্রতিজ্ঞা।রাফাতকে এ জনমে নিজের করেই ছাড়বে সে।
হাফসা বেগম কাকলি বেগমের কাছে গিয়ে অপরাধসূচক কন্ঠ নিয়ে বললেন,
‘কাকলি তুমি অনুর কথা কিছু মনে করো না। আসলে ওর সাথে যা হয়েছে তারপরে ও……..
হাফসা বেগমকে আর কিছু বলতে দিলেন না কাকলি সরকার।কাকলি সরকার অভিমানী কন্ঠে বললেন,
‘থাক হাফসা, বুঝতে পেরেছি আমি। আসলে এই সতেরো বছর ধরে তো আর কম কথা শুনিনি। রাস্তায় বের হলেই মানুষজন বলাবলি করে,ওই দেখো, ওনার হাজবেন্ট একটা মেয়ের জীবন নষ্ট করে দিয়েছে।
এইসব কথা শুনতে শুনতে অভ্যস্ত হয়ে গেছি আমি।’
কাকলি সরকার চুপ হয়ে গেলেন। হাফসা বেগম বুঝতে পারলেন তার কথা বলতে কষ্ট হচ্ছে। কাকলি বেগমের সব কষ্ট যেন গলায় এসে আটকে গেছে। এক অদ্ভুত নিরবতা বিরাজ করল বাড়িটায়। কাকলি সরকার আবার বলতে শুরু করলেন,
‘হাফসা আমাকে ক্ষমা করে দিও। আমি এভাবে তোমার সাথে কথা বলতে চাইনি। আসলে হাফসা রাফাতকে অনেক পার্টিতে যেতে হয় যেখানে যেতে হলে অনেক স্মার্ট হতে হয়। কথায় কথায় ইংলিশ বলতে হয়। কিন্তু অনু তো এতটা স্মার্ট নয়। ওকে অনেক অপমানিত হতে হবে সেখানে। তাই আমি চাইছিলাম রাফাতের মতোই বিদেশে পড়াশোনা করা একটা মেয়ের সাথে রাফাতের বিয়ে দেবো। অনু কখনো আমাদের সাথে সুখী হতে পারবে না। যা হওয়ার হয়ে গেছে হাফসা, বিষয়টাকে আর বাড়িয়ে কোনো লাভ নেই।’
হাফসা বেগম নিস্তব্দ্ধ হয়ে গেলেন। তিনি ভেবেছিলেন আজকেই কাকলি সরকারকে বকে দেবেন যে অনু ডক্টর। কিন্তু রাফাতের পরিবারের চাহিদা অনেক। অনু ডক্টর হলেও বিদেশে পড়াশোনা করেনি যার কারনে কাকলি সরকার মেনে নিতে পারবেন না অনুকে। এখন হাফসা বেগমেরও মনে হয়ে লাগল যে অনু আর রাফাতের ডিভোর্স হয়ে গেলেই ভালো।
কাকলি সরকার তার ছেলে মেয়েদের নিয়ে চলে গেলেন। অনুর চাচা চাচী এই বিষয়ে জিজ্ঞাসা করলে হাফসা বেগম সবটা খুলে বকেন তাদের। সবকিছু শুনে হতভম্বিত হয়ে যান তারা। আরশি আর রিয়াও উপস্থিত ছিল সেখানে। আরশি আর রিয়া যেন আকাশ থেকে পড়ল। হা করে তাকিয়ে আছে হাফসা বেগমের দিকে।
,,
,,
,,
,,
অনু কোনো দিকে না তাকিয়ে নির্বিকার ভাবে হেঁটে যাচ্ছে। পেছন থেকে অনুর বান্ধবীরা আর ভাই বোন অনবরত ডেকে যাচ্ছে কিন্তু সেসব কিছুই কানে ঢুকছে না অনুর। অনু রাগে থরথর করে কাঁপছে। অনুর জুতাটা একটু উচু হওয়ায় পা টা হঠাৎ মুড়িয়ে যায়। অনুর পায়ের কিছু অংশ ছিলে গেছে কিন্তু অনু সেইদিকে কোনো ভ্রুক্ষেপ না করে এগিয়ে চলে তার বাড়ির দিকে।
অনুর শাড়ির কুচি হালকা নেমে গেছে। মাথায় বাধা গোলাপ আর গাদা ফুলের মিশ্রিত মালাটি নিচে পড়ে পড়াগড়ি খেতে লাগল। সবকিছু উপেক্ষা করে অনু হনহন করে বাড়ির ভেতরে ঢুকে গেল। কিছুক্ষন পর অনুর ফ্রেন্ডরা আর ভাই বোন বাড়িতে ঢুকে গেল। বাড়িতে ঢুকেই অনুকে খুজতে লাগল তারা। নিচে কোথাও অনুকে খুজে না পেয়ে অনুর রুমের দিকে পা বাড়ালো সবাই।
রুমের ভেতর হুমড়ি খেয়ে ঢুকে পড়ল সবাই। রুমে ঢুকেই অবাক হয়ে সবাই তাকিয়ে রইল অনুর দিকে। সবাই যেন আকাশ থেকে পড়ল অনুর কান্ড দেখে। রাসেল অবাক চক্ষুতে অনুকে জিজ্ঞাসা করল,
চলবে,
(।)