সুখের পাখি পর্ব -০৫+৬

#সুখের_পাখি


তনুর বাবা ওর সাথে এই বাড়িতে তাদের থাকার ব্যাপারটা নিয়ে কথা বলতে এসেছে। অনেক দিনই তো হলো এখানে পড়ে আছে ওরা। সাবিনা কিছু না বললেও ওর স্বামীর তো আপত্তি থাকতেই পারে। কেউই নিজের বাড়িতে উটকো ঝামেলা চাইবে না। তনু বাবার কথা শুনে কিছুটা চিন্তিত মুখে বলে,

–‘এটা তুমি ঠিক বলেছ বাবা। ফুপা বাড়িতে এলে আমাদের দেখে আপত্তি করতে পারে। হয়তো আমাদের সাথে ভালোই আচরণ করবে। আমাদেরকে সামনে কিছু বুঝতে দিবেন না। কিন্তু আড়ালে ফুপু আম্মার সাথে এই নিয়ে ঝামেলা বাঁধতে পারে। আমাদের এই বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়াই উচিত।’

–‘আমিও এটাই ভাবছিলাম।’

–‘কিন্তু বাবা আমরা যাব কোথায়?’

‘যাব কোথায়?’ এটাই এখন একমাত্র প্রশ্ন। এই ঢাকা শহরে ওরা চিনেই বা কতটা? কোথায় যাবে? বুড়ো বয়সে কেউ কাজ দিবে উনাকে? কাজ না করলে ভাড়ি ভাড়া, তনুর স্কুলের খরচ কীভাবে চালাবে? সাবিনার কাঁধেও বেশিদিন বোঝা হয়ে থাকা যাবে না। বাবা ভাবেন। তনুও বাবার ভাবনার সাথে পাল্লা দিয়ে নিজের মনে মনে ভাবে। এখানেই তো ভালো আছে ওরা। তাই বলে এখানে থাকা, খাওয়া, পড়ার সুযোগ সুবিধা পেয়ে নিজেদের আত্মসম্মান ভুলে যাবে! অন্যের ঘাড়ে বোঝা হয়ে চেপে বসবে! না। চলে যাওয়াই ঠিক হবে। ফুপু আম্মা হয়তো অনেক জোর করবে। ওদের থেকে যেতে বলবে। ফুপু আম্মার কথা না শুনে চলে গেলে হয়তো রাগও করবে। তবুও যেতে হবে। নিজের চোখে ছোট হয়ে গেলে বেঁচে থাকার মানে থাকবে না। এসব ভেবেই সারাটা বিকেল তনুর মন খারাপ ছিল। আজ তার ছোটাছুটি একদম কমে গেছে। ফুলি কয়েকবার এসে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ওকে ডেকে গেছে। সে প্রতিবার এক কথাই বলেছে।

–‘ফুলি আপা আমার মন ভালো নেই। ডেকো না আমাকে।’

ফুলি ভেতরে আসেনি। দরজার সামনে থেকেই উৎকণ্ঠিত গলায় জানতে চেয়েছে।

–‘মন খারাপ ক্যান তনু? কে তোমারে কী কইছে? ভাইজান বকছে?’

–‘না।’

–‘বকে নাই! তাইলে মন খারাপ ক্যান? মন খারাপের কারণটা তো কইবা।’

–‘ফুলি আপা। আমার এমনিতেই মন খারাপ হয়েছে। সব সময় মন খারাপের নির্দিষ্ট কোন কারণ থাকে না। মাঝে মাঝে এমনিতেই বিনা কারণে মন খারাপ হয়।’

তনুর কথা ফুলি কিছুই বুঝতে পারে না। চিন্তিত মুখে কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে সে চলে যায়। দশ বিশ মিনিট পর আবার আসে। আবার ডাকে। তনু এবার আর কথা বলে না। চুপচাপ শুয়ে থাকে।
ফুলি আর ডাকতে আসেনি ঠিকই। কিন্তু ইহানের গিটারের সুর ঠিকই কানে ভেসে আসে। তনু উঠে বসে। আজ দিনের বেলা থ্রি কোয়ার্টার গান গাইছে।

–‘আমার মন খারাপ অথচ থ্রি কোয়ার্টারের মনে রঙ লেগেছে। আজ দিনদুপুরে গলা ছেড়ে চেঁচাচ্ছে। প্রতিদিন তো রাত একটার পরে মনে রঙ লাগে। আজ ঠিক দুপুরে লেগেছে। উহম অসহ্য! এই বাড়িতে মন খারাপ করে কিছুসময় শুয়েও থাকা যাবে না।’

তনু বিছানা ছেড়ে উঠে পড়ল। পা টিপেটিপে ছাদের দিকে যেতে লাগল। ইহানের সাথে দেখা হয়ে যাবার ভয়ে ছাদে আসেই না সে। ফুপু আম্মার বজ্জাত ছেলের যা বাজে ব্যবহার! কখন ধমকে দেয় কে জানে? সেই ভয়েই তনু এখন আর ইহানের ঘরের আশেপাশেও আসে না। সেদিন তো একটু গিটারটাই হাতে নিয়েছিল। বাজাতে চাইছিল, ভেঙে তো ফেলছিল না।
তনু দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে মাথা উঁচিয়ে উঁকি দিয়ে ঘরের ভেতর দেখল। ইহানের দেখা পেল না। তবে গলা শোনা যাচ্ছে। ইহান ভেতরেই কোথাও আছে।

…..তোর মন খারাপের দেশে যাব প্রেমের খেয়ায় ভেসে।
তোর মনটা ভালো করে দেব অনেক ভালোবেসে। ডাকলে কাছে আসিস…..

গানটা শুনে তনুর কেনই যেন লজ্জা লাগতে লাগল। মনে হচ্ছে এই গানটা ওর জন্যেই গাওয়া হচ্ছে। কারণ এই মুহূর্তে ওরও তো মন খারাপ ছিল।

–‘ইশশ কেউ যদি সত্যিই আমার মন খারাপের সময় এই গানটা শোনাত। তাহলে সাথে সাথে আমার মন ভালো হয়ে যেত। কিন্তু আফসোস সেই কেউ টাই তো নেই। সেই মানুষটার অভাবে আমার জীবন মরুভূমি হয়ে আছে।’

তনু আবার গান শোনায় মনোযোগ দিল। ইহানের গানের গলা সত্যিই সুন্দর। তনু না চাইতেও প্রশংসা করে ফেলছে।

–‘উনি ইঞ্জিনিয়ার না হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে ভালোই করেছেন। সবাই যদি ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার হয় তাহলে গায়ক নায়ক কে হবে? উনি গান গেয়ে সত্যিই একদিন নাম করবে। দেশের সবাই উনাকে উনার গলার জন্য চিনবে।’

–‘এখানে দাঁড়িয়ে লুকিয়ে লুকিয়ে আমার গান শোনা হচ্ছে! ‘

–‘বাবাগো!’

হঠাৎ কারো গলা পেয়ে তনু ভয় পেয়ে যায়। ধরফরিয়ে পেছন ফিরে দাঁড়ায়। ইহান ওর সামনে দাঁড়িয়ে আছে। কখন এলো? সে যে এখানে আছে তা কীভাবে জানল? তখন দেখে ফেলেছিল তাকে?
তনু ভয় পেয়ে বুকে থুথু দেয়। বুক ভরে দম নিয়ে বলে,

–‘এভাবে কেউ কাউকে ভয় পাইয়ে দেয়!’

ইহানের মুখে সামান্য হাসি দেখা গেল। হাসিটা খুব সামান্য হলেও তনু ঠিকই লক্ষ্য করল। থ্রি কোয়ার্টার হাসতেও জানে! হাসলে তো সুন্দরই লাগে। ওর গানের গলার মতো ওর হাসিটাও সুন্দর।

–‘এভাবে চুরি করে কেউ কারো গান শুনে!’

তনুর রাগ হলো। বারবার চুরি করে, চুরি করে বলছে কেন? সে চুরি করে গান শুনতে যাবে কেন? এই কাওয়ালি সঙ্গীত নিচে তার ঘরে বসেও শোনা যায়। যা গলা ছেড়ে গায় উপরে এসে শোনার কোন দরকার পড়ে না। তনুও মুখ বাঁকিয়ে সাথে সাথে জবাব দেয়।

–‘কারো ঘরে গেলে তো আবার অসভ্য অভদ্র হয়ে যেতে হয়। তাই ভেতরে যাওয়ার ইচ্ছে হলো না।’

ইহান এবার তনুকে দেখিয়েই হাসল। তনু ড্যাবড্যাব চোখে ইহানের দিকে চেয়ে থাকল। চোখের পলক ফেলল না। ইহান ওকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে আরেকটু হাসল। বলল,

–‘ভেতরে এসো।’

তনু নড়ল না। ভেতরে যাবে না সে। সেদিনের অপমান এখনও ভুলেনি তনু। ইহান হঠাৎ একটা কাজ করে বসল। তনুর কনুই ধরে টেনে ওকে ঘরে নিয়ে যেতে যেতে বলল,

–‘আরে আসো তো। আর সেদিনের জন্য সরি। এবার তো রাগ ঝেড়ে ফেলো। সেদিন আমার মেজাজ আগে থেকেই খারাপ ছিল। তার উপর তুমি আবার অনুমতি না নিয়ে আমার গিটার ছুঁয়েছিলে। তখন আরও রাগ উঠে যায়। আবারো সরি তনু। ওইদিন তোমার সাথে আমার ওরকম ব্যবহার করা ঠিক হয়নি।’

তনুর সব রাগ ফুঁস হয়ে গেল। এতো সুন্দর করে গুছিয়ে সরি বলার পর কারো রাগ থাকতে পারে? তনু অন্যদের কথা জানে না। তবে তার রাগ থাকবে না। যেমন ইহানের সব বাজে ব্যবহার এক নিমিষে ভুলে বসে আছে সে।
ইহান খাটে বসল। তনুকে সোফায় বসতে ইশারা করলো।

–‘সোফাটায় আরাম করে বসো। তুমি গান শোনো? গান শুনতে পছন্দ করো? আমার গান শুনেছ কখনও তুমি?’

–‘অতগুলো প্রশ্নের উত্তর একসাথে কীভাবে দেব?’

ইহান হেসে ফেলল। গিটার হাতে নিয়ে বলল,

–‘গান শুনতে পছন্দ করো আর না করো। এখন আমার একটা গান গাইতে ভীষণ ইচ্ছে করছে। ভালো না লাগলেও তোমাকে শুনতে হবে। বসে থাকো চুপচাপ। আমার অর্ধেক গানের মাঝে ওঠে যেও না। তাহলে ওটাও কিন্তু অভদ্রতা হবে। শুনতে কষ্ট হলে কান চেপে ধোরো কেমন?’

তনুর বলতে ইচ্ছে করছিল, এতটাও বাজে গাননা আপনি। আপনার গান আমি শুনেছি। বলা যায় প্রতি রাতে আপনার গান শুনেই আমার ঘুম আসে। কিন্তু বলা হলো না। তার আগেই ইহান গিটারে টুংটাং শব্দ তুলে গাইতে লাগল।

….তোর মন খারাপের দেশে যাব প্রেমের খেয়ায় ভেসে… তোর মনটা ভালো করে দেবো অনেক ভালোবেসে….

…..ডাকলে কাছে আসিস পারলে একটু হাসিস, বুকটা রাখিস পেতে ভালোবাসা নিতে।
সব অভিমান ভেঙে দেবো তোর কাছে এসে…..

ইহান গাইতে গাইতেই একবার তনুকে দেখল। তনু চোখ বন্ধ করে মনোযোগ দিয়ে গান শুনছে। ইহান মুচকি হাসল।

….মনগড়া অভিযোগ জানি ভুলে যাবি তুই, কাছে এসে আলতো করে যদি তোর হাতটা ছুঁই…

শুনতে শুনতে তনুর কান গরম হয়ে যাচ্ছে। গালও লাল হয়ে গেছে। ইহান চোখ বুজে গাইছে। তনু তার পরের সারাটা সময় এক ধ্যানে পলকহীন ভাবে ইহানকে দেখে গেছে। হঠাৎ তনুর কী হলো তনু নিজেও জানে না। তার এতো লজ্জা পাচ্ছে কেন সে বুঝতে পারছে না। সাধারণ একটা গানই তো গাইছে ইহান। এই গান শুনে তার কান দিয়ে কুকারের সিটি বের হওয়ার মানে কী? তনু বসে থাকতে পারল না। একপ্রকার ছুটে পালিয়ে এলো সে। তার এখনও মনে হচ্ছে গানটা ইহান ভাই তার জন্য গাইছে।

–‘নিজেকে কী ভাবিস তুই তনু? কোন রাজ্যের রাজকুমারী? তোর জন্য ইহান ভাই কেন গান গাইবে? খেয়েদেয়ে কাজ নেই উনার। নিজেকে এতো গুরুত্বপূর্ণ ভাবছিস কেন গাধী।’

পরের দুইটা দিন তনুর ভীষণ ব্যস্ততায় কাটল। স্কুল থেকে একগাদা বাড়ির কাজ দিয়ে দিয়েছে। অংক স্যারটা এমন পাষাণ। আজরাইল একটা। ছোট ছোট বাচ্চা ছেলেমেয়ে গুলোকে দিয়ে অংক করিয়ে ওদের জান নিতে চায়। এমনিতেই তনু অংকে কাঁচা। তার উপর আবার এতো জ্বালা। বাড়ির কাজ করে না নিয়ে গেলে আবার পুরো ক্লাস ভর্তি ছেলেমেয়ের সামনে কান ধরে দাঁড় করিয়ে রাখে।

–‘জ্বালা জ্বালা আর ভালো লাগে না। লেখাপড়াই ছেড়ে দেব। পড়াশোনা করতে করতে মরে গেলে ভূত সমাজে শিক্ষিত ভূত হয়ে কোন লাভ হবে না।’

তনু বই খাতা বিছানায় ছড়িয়ে রেখে উঠে যায়। অত প্যারা নেওয়া সম্ভব না। মাথা ফেটে যাচ্ছে। ইহানের সাথে দেখা করতে যায় তনু। সেদিন ওভাবে চলে আসার পর থেকে আর দেখা হয়নি। তনুকে ছাদে যেতে হলো না। ইহান আজ নিজের বেডরুমে আছে। কোথাও বেরুবার জন্য রেডি হচ্ছে সে। বেশ সাজগোজ করেছে। ছেলেদের অবশ্য সাজগোজই বা আর কী? এই শার্ট প্যান্ট পরবে। চুলে জেল লাগাবে। হাতে ঘড়ি গায়ে একটু পারফিউম। ব্যস।
তনু ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে থেকে বলল,

–‘আসব ইহান ভাই?’

–‘না। আমি এখন বের হবো।’

ইহানের কথায় আবার আগের মতন রুক্ষতা এসে গেছে। সেদিন তনু যে ইহানকে দেখেছিল সে যেন কোথাও হারিয়ে গেছে। হয়তো হারায়নি। ইহানের দুইটা রূপ। একটা ভীষণ কোমল। আরেকটা ভীষণ কঠিন। ইহান সব সময় কঠিন রূপে থাকে। মাঝে মাঝে তার ভেতর থেকে সেই কোমল রূপটা বেরিয়ে আসে। সেটাও আবার খুব অল্প সময়ের জন্য।
ইহান তনুর দিকে তাকাল না পর্যন্ত। তনুকে পাশ কাটিয়ে চলে গেল। তনুর কেনই যেন কান্না পেয়ে গেল। তার সাথে ভালো ভাবে একটু কথা বললে কী এমন ক্ষতি হয়ে যায়!

–‘আর কখনও আপনার সাথে কথা বলব না। কোনোদিনও না। আপনাদের বাড়িতে থাকি বলেই এরকম করতে পারেন। নইলে এমন কঠিন ব্যবহার করতেন না। চলে যাব। সারাজীবন এই বাড়িতে থাকব না। জলদিই অন্য কোথাও চলে যাব। তখন আর বাজে ব্যবহার করার জন্য তনুকে পাবেন না।’
#সুখের_পাখি


তনুর স্কুলে প্রথম সেমিস্টার পরীক্ষা শুরু হয়েছে। গাধার মতো রাতদিন খাটাখাটুনি করে তনু পরীক্ষা দিচ্ছে। দিনরাত এক করে পড়াশোনা করে। সারাদিন বইয়ে মুখ গুঁজে পড়ে থাকে। ফুলি আপার সাথে আড্ডা দেয় না। ফুপু আম্মার সাথে চায়ের আড্ডাও বাদ যাচ্ছে আজকাল। সারারাতও পড়ে। ইহানের জ্বালা রোজ রাত একটার পরেই শুরু হয়ে যেত। তনু ফুপু আম্মাকে বলে ইহানের গান বন্ধের ব্যবস্থা করে। ইহান এখন রাতে গান গায় না। দিনেও না। তনু শান্তিতে পরীক্ষা গুলো দিতে পারছে। পরীক্ষার দিনগুলো তনু দিনের আলো খুব কমই দেখেছে। খাওয়াদাওয়ার প্রতিও মনোযোগ দেয়নি। তনুর পরীক্ষা শেষ হয়। হাফ ছেড়ে বাঁচে সে। স্বস্তির শ্বাস নেয়। এখন কয়দিন দিনরাত চব্বিশ ঘণ্টা ঘুমিয়ে কাটাবে। কয়দিন যা চাপ গেছে বাবাহ!

–‘ফুলি আপা! ও ফুলি আপা! কই গো তুমি?’

–‘ও মা! তনু নাকি? সূর্য কোন দিক দিয়া উঠছে আজ! আজ যে তনুর দেখা পেলাম।’

–‘দূর, পরীক্ষা ছিল। কয়দিন আমার উপর দিয়ে তুফান গেছে ফুলি আপা। পড়াশোনা তো করোনি। করলে বুঝতে পারতে শালার পড়াশোনা কত প্যারা দেয়। বয়ফ্রেন্ডের প্যারা সহ্য করা যায়। পড়াশোনার প্যারা সহ্য করা যায় না বুঝলে।’

–‘অহন তো পরীক্ষা শেষ।’

–‘হ্যাঁ। ফুলি আপা আজ বাইরে ফুচকা খেতে যাবে?’

ফুলি উৎসাহী গলায় বলল,

–‘তুমি খাওয়াইলে যামু।’

–‘আচ্ছা। আমিই খাওয়াব। তুমি শুধু আমার সাথে যেও।’

তনু ফুলির সাথে কথা বলে ছাদে আসে। তার মনে ক্ষীণ আশা ছাদে এলে যদি ইহান ভাইয়ের সাথে দেখা হয়ে যায়। তার পরীক্ষা শেষ। এখন ইহান ভাই রাতে গান গাইতে পারে। দু’দিন ধরে ইহানের গান না শুনে তার ঘুম আসে না। ইহান হয়তো জানে না যে তনুর পরীক্ষা শেষ। তনু কতক্ষণ ছাদে এলোমেলো ভাবে হাঁটে। সাহস করে ইহানের ঘরে উঁকি দেয়। আজ ইহান কেমন মুডে আছে? আজও তার সাথে খারাপ ব্যবহার করবে না তো। ইহান ভাই ওরকম ভাবে কথা বললে দু-তিন দিন পর্যন্ত তনুর মন খারাপ থাকে। সেই মন খারাপ সবাই বুঝতে পারে। কোনোভাবেই কেউ তনুর মন ভালো করতে পারে না। থেকে থেকে তনুর তখন কান্না আসে। সে নিজেও বুঝে না কেন এমন হয় তার।

–‘তনু! ভেতরে এসো।’

ইহান তনুকে ডাকে। তনুর বুকের ভেতর কেউ ড্রাম পেটাতে শুরু করেছে। গুপ্ত এক অভিমান মনের ভেতর মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। তনুর গলা কাঁপে। চোখ জ্বালা করে। ইহান নরম সুরে আবার ডাকে।

–‘ভেতরে এসো তনু।’

তনু ইহানের ডাক উপেক্ষা করতে পারে না। অভিমানে বুক ভার হয়ে থাকলেও ইহানকে সেটা বুঝানোর উপায় নেই। ভেতরে আসে সে। চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। ইহান তনুকে দেখে। মনে মনে হাসে। মুখে বলে,

–‘বসো। কোন কাজে এসেছিলে?’

–‘হু, না। না মানে, কোন কাজে না। এমনি এসেছি।’

–‘ওহ আচ্ছা। বসো তাহলে।’

তনু বসে। ইহান তনুর উপস্থিতি ভুলে গিয়ে নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। তনু অনেকক্ষণ বসে থাকে। চুপিচুপি কয়েকবার চুরি করে ইহানকে দেখে। ইহান তাকে একফোঁটাও গুরুত্ব দিচ্ছে না। দিব্যি নিজের কাজ করছে। তনুই বোকা। সেধে সেধে কেন এসেছে সে। যেচে পড়ে ঢঙ দেখাতে কে বলেছিল তাকে। তনু মনে মনে নিজেকে গালি দেয়৷ নিজের উপর রাগ হয়। ইহানের উপর অভিমান হয়।

–‘ইহান ভাই!’

–‘হুম।’

–‘আমার পরীক্ষা শেষ।’

–‘অহ। পরীক্ষা কেমন হয়েছে?’

–‘ভালো।’

–‘ভালো হলেই ভালো। পড়াশোনাটা জীবনে ভীষণ জরুরি তনু। পড়াশোনা ছাড়া তুমি জীবনে কিছুই অর্জন করতে পারবে না। তাই মন দিয়ে পড়ো কেমন।’

–‘আপনি তাহলে ইঞ্জিনিয়ারিং কমপ্লিট করলেন না কেন ইহান ভাই?’

ইহান তনুর দিকে তাকায়। তনু নিজেও ভাবতে পারেনি সে এমন একটা কথা বলে বসবে। ইহান এই বুঝি রেগে যাবে। তার উপর রাগ দেখিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে বলবে। কিন্তু ইহান সেরকম কিছুই করল না। তনুর ধারণা ভুল প্রমাণ করে দিয়ে ভীষণ মিষ্টি করে সে হাসল।

–‘আমি তো গায়ক হবো। গান আমার নেশা তনু। এই নেশাকেই আমি পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছি। পড়াশোনা যেটুকু করেছি তাতে ভক্তদের অটোগ্রাফ দিতে পারব।’

–‘গায়করা বুঝি শুধু অটোগ্রাফ দেওয়ার জন্য পড়াশোনা করে? অনেক গায়কই গানের পাশাপাশি অনেক বড় বড় ডিগ্রিও অর্জন করে। আপনিও নাহয়…

তনু ইহানের দিকে তাকিয়ে চুপ করে যায়। ইহানের দৃষ্টি তার কথা কেড়ে নেয়। তাকে বোবা করে দেয়৷ ইহান এই বাচ্চা মেয়ের মুখে জ্ঞানের কথা শুনে হাসে। তার এই হাসি বড় রহস্যময়। সেই রহস্য তনুর ছোট মস্তিষ্ক বুঝতে পারে না। ইহান নিজে থেকে আর কিছু বলছে না। তনুই বলল,

–‘আমার পরীক্ষা শেষ ইহান ভাই। এবার থেকে আপনি আবার আগের মতো রাতে গান গাইতে পারেন। আমার কোন সমস্যা হবে না।’

তনু এই কথাটা বলার জন্যই এসেছিল। কথাটা বলা হয়ে গেলে তনু আর এক মুহূর্তও দাঁড়াল না। আর দাঁড়ানোর মানেও হয়না। ইহান এখন ভালো আছে। একটু পরে হয়তো ধমকে উঠবে। ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে বলবে। তার আগে তনুই চলে এলো।

আজ রাতে তনু বিছানায় শুয়ে এপাশ-ওপাশ করছিল। ঘুম আসছেই না তার। নিজের উপর এত বিরক্ত লাগছে। দুই হাতে চুল টেনে ধরল তনু।

–‘মরার ঘুম! কোথায় গেলি তুই? তোকে পেলে কাঁচা মরিচ দিয়ে কচলে খেতাম। পানি দিয়ে গুলে শরবত বানিয়ে খেতাম।

আর ঠিক তখনই শোনা গেল।

shayad kabhi na keh sakun main tumko
Kahe bina samajh lo shayad…

Shayad mere khayal main tum ik din,
milo mujhe kahin pe gum shayad,

Jo tum na ho, rahenge hum nahi.
Jo tum na ho, rahenge hum nahi…

Na chahiye kuch tumse zyada tumse kam nahin….

Jo tum na ho, toh hum bhi hum nahi…

ইহানের গলা! তনু কেন যে এতো খুশি হলো, খুশিতে চোখে পানি এসে গেছে তার। ইহান ওর কথা শুনেছে। তনু বুঝতে পারল, এতদিন ইহানের গলা মিস করেছে সে। আর তাই প্রতিরাতে এমন ছটফট করত সে। তনু সব ভাবনা একপাশে রেখে ওঠে বসে সব মনোযোগ দিয়ে ইহানের গান শুনছে। কী মিষ্টি গলা! কী মিষ্টি সুর! ইহান কি শুধুই গান গাইছে। নাকি গানের কথাগুলো কাউকে শোনাতে চাইছে। কাকে উদেশ্য করে গায় সে? সবাই তো কাউকে না কাউকে উদেশ্য করে গায়। যে গান লিখে সে নিজেও তার কল্পনায় কারো মুখ সামনে এনে তার জন্য গান লিখে। কথাগুলো তাকে উদেশ্য করে। যা কখনও হয়তো ওই মানুষটাকে বলা হয়নি বা হবে না। সে কথাগুলো গানের মাধ্যমে মানুষটাকে শোনাতে চায়। শোনায়। ইহানের সেরকম কেউ আছে কি?

–‘ইহান ভাই কি কাউকে ভালোবাসে? ওর গার্লফ্রেন্ড আছে?’

তনু এলোমেলো সব কথা ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়ে। কয়দিন পর ওর রেজাল্ট দেয়। পরীক্ষা সে ভালোই দিয়েছিল। এতো কষ্ট করে রাত জেগে পড়েছে। সব সাবজেক্ট থেকে ভালো নাম্বারই এলো। শুধু অংশে বত্রিশ এসেছে। মানে ফেল। এক নাম্বারের জন্য ফেল! তনু কখনও ভাবেনি সে ফেল করবে। গ্রামের স্কুলে পড়ার সময় মোটামুটি ভালো ছাত্রীই ছিল সে। হঠাৎ স্কুল পাল্টানো, আবার মাঝে কয়েকমাস গ্যাপ যাওয়ায় পড়াশোনার এই অবস্থা হয়েছে ওর। অত ভালো ছাত্রী না হলেও এর আগে কখনও ফেল করেনি সে। তাই আজও এটা সে কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছে না। নিজে হেরে গেছে। ক্লাসের এতগুলো ছেলেমেয়ের সামনে লজ্জা পেয়েছে। বাড়িতে গিয়ে বাবাকে কী বলবে? বাবা কত কষ্ট করে তাকে লেখাপড়া করিয়েছে। ফুপু আম্মা! উনাকেই বা কী বলবে তনু। স্কুল ছুটির পর বাড়ি ফিরতে ইচ্ছে করছিল না তনুর। মন খারাপ নিয়ে বাড়ি ফিরে সোজা নিজের ঘরে চলে যায়। ফুলি পেছন থেকে ডাকে, তনু কোন সাড়া দেয়নি।

–‘এই তনুটা আজব মেয়ে! কহন ওর কী হয় ও নিজেও জানে না। এই মাইয়ার সাথে ভূত পেত্নী আছে।’

ঘরে গিয়ে ব্যাগ ছুড়ে ফেলে, কাপড় না ছেড়ে উপুড় হয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ে তনু। দীর্ঘ সময় ধরে শুয়ে থাকে। সাবিনা ওকে ডাকতে আসে। ওর পাশে বসতে বসতে বলে,

–‘কী কাণ্ড! কাপড় না ছেড়ে শুয়ে আছিস দেখছি। স্কুল থেকে ফিরেছিস। কাপড় ছাড়বি। কিছু খাবি। তা না তুই এখন শুয়ে আছিস। ফ্যানটাও চালাসনি। আজ যা গরম পড়েছে।’

সাবিনা নিজে গিয়ে ফ্যান চালু করে দিল।

–‘এই তনু, কী হয়েছে তোর? কী রে। এই মেয়ে!’

ফুপু আম্মার অনেক ডাকাডাকির পর তনু উঠে বসে। ফুপু আম্মা কিছু জিজ্ঞেস করার আগে তনু কেঁদে ফেলে। ওকে কাঁদতে দেখে সাবিনা হতভম্ব। ব্যস্ত হয়ে তিনি তনুকে ধরে জানতে চাইছেন,

–‘এই মা, এই তনু। এভাবে কাঁদছিস কেন তুই? কে কী বলেছে তোকে? ইহান কিছু বলেছে? বকেছে ও তোকে? এই তনু, কথা বল মা। না বললে আমি বুঝব কীভাবে? অমন করে কাঁদে না মা। কান্না থামা না একটু। বল আমাকে কী হয়েছে।’

তনুর ফর্সা মুখ রক্তিম বর্ণ ধারণ করেছে। নাকের ডগা লাল হয়ে ওঠেছে। চোখ দু’টো জলে ভেজা ফোলা ফোলা। ফোঁপাতে ফোপাঁতে তনু যা বলল তা সাবিনা প্রথমে বুঝতে পারল না। কপালে ভাঁজ ফেলে সে আবার জানতে চাইল,

–‘কী বলছিস তুই মা? আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না। স্পষ্ট করে বল। বল না রে তনু। কী হয়েছে তোর। আমার তো প্রেসার বেড়ে যাচ্ছে রে।’

–‘আমি পরীক্ষায় ফেল করেছি ফুপু আম্মা।’

এবারও কথা স্পষ্ট হলো না।

–‘কি?’

–‘আমি পরীক্ষায় ফেল করেছি। অংকে বত্রিশ পেয়েছি। একের জন্য ফেল। গ্রামে থাকতে আমি কখনও ফেল করিনি। আমি খারাপ ছাত্রী না। সব সময় ষাট সত্তরের উপরে পেয়েছি। এবার আমি কেন ফেল করেছি?’

এই সামান্য বিষয়টা নিয়ে তনু এভাবে কাঁদছে! সাবিনা ভেবেছিল কী না কী হয়ে গেছে। এই মেয়ে আস্ত পাগল। ফেল করলে কেউ এভাবে কেঁদেকেটে চোখ মুখ ফুলিয়ে ফেলে। তনু এমনিতেই কাঁদছে সাবিনা ওকে রেজাল্ট খারাপ করা নিয়ে আর বকতে পারবে না। নিজের ছেলেদের লেখাপড়ায় সাবিনা কখনও নাক গলায়নি। ওরা নিজেদের মতো পড়েছে। ভালো রেজাল্টও করেছে। সাবিনা তনুকে সান্ত্বনা দিয়ে বলল,

–‘এর জন্য এভাবে কাঁদছিস তুই? পাগল মেয়ে। পাশ, ফেল তো মানুষই করে। এবার ভালো করতে পারিসনি। সামনের বার ভালো করবি। এটা তো ফাইনাল পরীক্ষা না। সামনে আরও কত পরীক্ষা বাকি আছে। এই নিয়ে এখন মন খারাপ করলে হবে? কান্নাকাটি করলে নাম্বার বেড়ে যাবে? যদি বলিস বেড়ে যাবে তাহলে আমিও তোর সাথে কতক্ষণ কাঁদি।’

চলবে🌼

Jerin Akter Nipa-জেরিন আক্তার নিপা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here