#সুখের_পাখি
৪৭
তনু তার ভেতরে চেপে রাখা কষ্টগুলো কারো কাছেই বলতে পারছে না। ইহান ভাইয়ের সাথে কথা বলতেও ইচ্ছে করছে না। ইহান ভাই যদি বলে তার এখনও ওই মেয়েটার কথা মনে পড়ে তাহলে তনু মরেই যাবে। মেয়েটা কে তনু জানে না। তবে মেয়েটা ভীষণ ভাগ্যবতী। ইহান ভাইয়ের প্রথম পছন্দ সে। তাকে বড্ড দেখতে ইচ্ছে করছে। আবার ওর সাথে দেখা করার কথা ভাবতে ভয়ও লাগছে। মেয়েটা কি দেখতে তার থেকেও সুন্দর? তার থেকেও ফর্সা! লম্বায় কতটুকু? সে তো ইহান ভাইয়ের কাঁধে পড়ে। মেয়েটা কি আরও লম্বা? সমান সমান? ইহান ভাইয়ের তো ভালো স্টুডেন্ট পছন্দ। মেয়েটা কি পড়াশোনায় অনেক ভালো? তনু তো প্রথমে ফেল্টুস ছিল। এখন অবশ্য ভালো হয়েছে। এসব ভাবতে ভাবতেই তনু কেমন মন মরা হয়ে গেল। ভীষণ কান্না পাচ্ছে তার।
–‘এই তনু! এই!’
পাশ থেকে মিতা ওর কাঁধে ধাক্কা দিল। তনুকে সকাল থেকেই কেমন দেখাচ্ছিল। এখন ওকে এতটা অন্যমনস্ক দেখে মিতা রীতিমতো চিন্তায় পড়ে গেল। কী হয়েছে গাধীটার!
–‘এই তনু! কী হয়েছে তোর? হ্যাঁ, আমাকে বল।’
তনু আর নিজেকে রাখতে পারল না। তার ভেতর চেপে রাখা কান্না প্রকাশ পেয়ে গেল। মিতাকে জড়িয়ে ধরে হু হু করে কেঁদে ফেলল সে। মিতা হতবাক! তনু কাঁদছে কেন? কী হয়েছে ওর!
–‘আমার সব শেষ হয়ে গেছে রে মিতা। সব শেষ। কিচ্ছু নেই আমার। আজ জানতে পারলাম নিজের বলতে যা ছিল সেটাও অন্যের। আমি এতটা একা কেন রে?’
প্রথমটায় মিতা কিছুই বুঝতে পারছিল না। তনুর সব কথা ওর মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে। কী শেষ হয়ে গেছে? ওর কোন জিনিস অন্য কার?
মিতা তনুকে টেনে তুলে দু’হাতে ওর মুখ তুলে ধরে নিজের দিকে ফিরালো।
–‘কী হয়েছে আমাকে বল। কাঁদিস না তো। কাঁদলে কিছু ঠিক হবে?’
তনু ফোঁপানোর জন্য কথা বলতে পারছে না। হেঁচকি তুলতে তুলতে দম নিতে পারছে না। টকটকে লাল চোখ দু’টো থেকে অঝোর ধারায় পানি পড়ছে।
–‘বল। বল না রে তনু। কে এত দুঃখ দিয়েছে তোকে? কেন কষ্ট পাচ্ছিস আমাকে বল।’
–‘ইহান ভাই, ইহান ভাই…
মিতার এত রাগ হলো! ওর আর বুঝতে বাকি রইল না তনুর কান্নার পেছনে ইহানের হাত আছে। ইহান তনুকে কিছু বলেছে? কিছু করেছে নাকি তনুর সাথে? আজকালকার ছেলেগুলো যা চালু মাল! রিলেশনের দু’তিন দিনেই বহুত কিছু চেয়ে বসে।
কাটকাট গলায় মিতা জানতে চাইল,
–‘ইহান! ওই ইহানই তাহলে সব নষ্টের মূল? কী করেছে ও? বল আমাকে। আমি ওর খবর করে ছাড়ব। শালার বাপ দাদার নাম ভুলিয়ে দিব। নয়তো আমার নামও মিতা না।’
–‘ইহান ভাই অন্য একটা মেয়েকে ভালোবাসে।’
এই কথাটা শোনার জন্য মিতা মোটেও প্রস্তুত ছিল না। ভালোবাসে মানে! মুখের কথা নাকি ভালোবাসে! বললেই হলো? অন্য মেয়েকে ভালোবাসে তাহলে তনুকে কেন ভালোবাসার লোভ দেখাল? কেন মিথ্যে বলে তনুর মন ভাঙল।
–‘শান্ত হ তুই। আগে তুই কান্না থামা। ভালোবাসে বললেই হলো? ভালোবাসা হাতের মোয়া নাকি? ওর ভালোবাসা আমি ছুটিয়ে দেব না! কী মনে করেছে ও।’
তনু শান্ত হতে পারছে না। তার কেমন লাগছে তা শুধু সে-ই বুঝতে পারছে।
–‘মেয়েটা আমার আগে ওর জীবনে এসেছে। আমার আগে ওকে ভালোবেসেছে। ইহান ভাইও ওকে ভালোবেসেছে।’
–‘তুই কী বলছিস কিছুই আমার মাথায় ঢুকছে না। তোদের দু’জনের মাঝে হঠাৎ অন্য একটা মেয়ে এলো কোত্থেকে?’
–‘ওই মেয়ে আমাদের মাঝে আসেনি। বরং আমিই ভুল সময়, ভুল জায়গায় চলে এসেছি। ইহান ভাই আমার জন্য না রে।’
–‘ওই মেয়েটা কে? কোথায় থাকে? নাম, ঠিকানা সব বল আমাকে। ওই চরিত্রহীনের কথা মেয়েটাকে জানাতে হবে। গার্লফ্রেন্ড থাকতেও ইহান কোন বুঝে তোকে ভালোবাসার কথা বলল!’
তনু বুঝতে পারছে মিতা তার কথার সম্পূর্ণ উল্টো মানে বুঝেছে। সে শান্ত হয়ে মিতাকে সব খুলে বলল। সব শুনে মিতা হেসে বলল,
–‘দূর পাগল! এই সামান্য ব্যাপার নিয়ে তুই এরকম কেঁদেকেটে সাগর বানাচ্ছিস! অতীতে কে কী করেছে তা দেখার মানে হয়? তোর কথা শুনে মনে হচ্ছে ইহান তার অতীত কবেই ভুলে গেছে। আর তাইতো তোকে অ্যাকসেপ্ট করেছে ও। ওই মেয়েকে এখনও মনে রাখলে তোকে লাই দিত! ইহান এখনও ওই মেয়েকে মনে রাখলে তুই ওর সামনে গিয়ে ভালোবাসি বলার আগেই গালে ঠাস করে একটা পড়ত।’
–‘উঁহু। ভুলে গেলে ফুপাকে কেন এখনও ক্ষমা করতে পারেনি? ফুপার সাথে কেন সম্পর্ক ভালো হয়নি? ফুপার জন্যই তো ওই মেয়েকে হারিয়েছে ও। ফুপরা সাথে ইহান ভাই আজও কথা বলে না। সামনে যায় না। বাবা ছেলেকে দেখলে তুই বুঝবিই না ওরা বাবা ছেলে।’
–‘হয়তো কেউই তেমন করে সম্পর্কটা ঠিক করতে চায়নি। সব বাবা মা’ই কিন্তু ছেলেমেয়ের ভালো চায়। ইহান তখন মাত্র কলেজে পড়ত। তোকে প্রথম ও কেন ফিরিয়ে দিত? তোর বয়স কম বলেই তো। এই বয়সে সব সময় ভুল সিদ্ধান্তই নেয়া হয়। সে-ও নিয়েছে। আর আজ এই কথাটা সেও ভালোই বুঝে। তোকে যা বোঝাতে চায় তা নিজে বুঝবে না!’
–‘ওই মেয়েকে আমি খুঁজে বের করব।’
মিতা অবাক গলায় বলল,
–‘কেন?’
–‘ওকে না দেখে আমি শান্তি পাব না।’
–‘দেখেই বা কী করবি?’
–‘মেয়েটার যদি এখনও বিয়ে না হয়! ও যদি এখনও ইহান ভাইয়ের অপেক্ষায় থাকে…
–‘না তনু, একদম না। তুই সাবানার মত এখন এটা বলিস না যে, তুই ওই মেয়েটার সাথে ইহানের বিয়ে দিবি। নিজেই নিজের সতীন আনবি। সতীন আনার এত শখ থাকলে আমাকে সতীন কর। ওই মেয়েকে আর আমাদের গল্পে টানতে হবে না। এতদিন ও বাইরে ছিল, এখনও বাইরেই রাখ। তুই মেইন ক্যারেক্টার। আমি সেকেন্ড রোল প্লে করছি। তুই জানিস তোর ভাইটাকে সেই প্রথম দিন দেখেই আমি কাত হয়ে গিয়েছিলাম। দু’জনে এক স্বামী নিয়ে সুখে শান্তিতে সংসার করব। জীবনেও ঝগড়া করব না। বাচ্চা কাচ্চাও সমান সমান নিব।’
দুঃখের মাঝেও মিতার কথা শুনে হেসে ফেলল তনু। মিতাটা মরলেও ভালো হবে না। সবসময় এমনই থাকবে।
–‘তুই শুধু শুধুই ব্যাপারটা বাড়িয়েছিস তনু। ফুলির কাছ থেকে যেটুকুই শুনেছিস, তুই তো পারতিস ইহানকে জিজ্ঞেস করে সব জেনে নিতে। ও নিশ্চয় তোকে মিথ্যে বলত না। এটুকু বিশ্বাস নেই ওর উপর! এ-ই নাকি আবার ভালোবাসা! তোরা যে ভালোবাসা শব্দটার কী মানে বুঝিস আমি জানি না।’
–‘আমি ইহান ভাইকে বিশ্বাস করি। আমি ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম রে। কখনও তো এরকম পরিস্থিতির সামনা করিনি। ঘাবড়ে গিয়েছিলাম।’
–‘পরিস্থিতি যতই সাঙ্ঘাতিক হোক সেটাকে এড়িয়ে গিয়ে কিচ্ছু হবে না। ঠান্ডা মাথায় ধৈর্য ধরে পরিস্থিতির সামনা করতে হবে। নইলে সবকিছু আরও প্যাঁচালো হয়ে যাবে।’
–‘আমার বড় একটা ভুল হয়ে গেছে, তাই না রে?’
–‘না। এখনও কিছুই হয়নি। তুই যে সব জেনে ফেলেছিস এটা এখনও ইহান জানে না। ওর সাথে নরমাল বিহেভ করবি। তারপর সময় বুঝে কুপ বসিয়ে দিবি।’
–‘তুই না থাকলে আমার যে কী হতো!’
–‘কী আর হতো! ‘
–‘কে আমাকে এরকম ভাবে বুঝাতো বল?’
–‘তখন তুই নিজেই বুঝতি।’
–‘আমি মাঝে মাঝে মন খারাপ করে কান্নাকাটি করে। আল্লাহকে জিজ্ঞেস করি কেন এই পৃথিবীতে তিনি আমাকে একা করে দিলেন। আমার মনেই ছিল না আল্লাহ সবার জায়গা তোকে দিয়ে পুষিয়ে দিয়েছে। আমরা সারাজীবন বন্ধু থাকব। কক্ষনো কেউ কাউকে ভুলব না।’
কলেজ গেটে থেকে বেরিয়ে আজও তনু সামনে ইহানকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল। ইহানের রাগান্বিত দৃষ্টি তনুর উপর নিবদ্ধ। মিতা পেছন থেকে তনুকে ইহানের দিকে ঠেলে দিল। তনু ওর দিকে আসছে দেখে ইহান দাঁড়াল না। উল্টো পথে হাঁটতে লাগল সে। তনু পেছন থেকে দৌড়ে আসছে আর ডাকছে।
–‘ইহান ভাই! দাঁড়ান। আরে আপনি চলে যাচ্ছেন কেন? আমাকে নিয়ে যান। ইহান ভাই…
ইহান তনুর কোন কথা শুনছেই না। কাল সারাটা দিন তনুর দেখা পায়নি সে। রাতে কতগুলো কল দিয়েছে। তনু তো ছাদে যায়ই নি বরং তার কল তোলারও প্রয়োজন মনে করেনি। সত্তরটার উপরে কল দেওয়ার পরও যে মেয়ের খোঁজ থাকে না, গার্লফ্রেন্ড হিসেবে এমন মেয়ে তার দরকার নেই।
–‘ইহান ভাই দাঁড়ান না। আরে আজব তো।’
দৌড়ে এসে তনু ইহানের সামনে পথ আটকে দাঁড়াল। হাঁপাচ্ছে ও। ইহান চাপা স্বরে বলল,
–‘সামান্য থেকে সরো।’
–‘আপনি আমাকে দেখেও চলে যাচ্ছেন কেন?’
–‘কে তুমি?’
তনু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। বলল,
–‘আমি কে? আমাকে আপনি চিনেন না!’
–‘না।’
–‘না! তাহলে আমার কলেজের সামনে কী করছিলেন?’
–‘এই কলেজে তুমি একাই মেয়ে? আর কোন মেয়ে পড়ে না? তুমি কেন ভাবছ আমি তোমার জন্য এসেছি।’
–‘কী হয়েছে আপনার বলুন না।’
–‘আমার কী হবে? কিচ্ছু হয়নি।’
–‘আপনি আমার উপর রাগ করেছেন?’
–‘রাগ! তোমার উপর! কেন? আমার কি খেয়েদেয়ে আর কোন কাজ নেই?’
তনু বুঝতে পারছে ইহান ভাই রেগে বোম হয়ে আছে। দোষ তো তারই।
–‘এইবারের মত ক্ষমা করুন প্লিজ।’
–‘ক্ষমা! কেন? তোমার মনে হয় কোন অন্যায় করেছ তুমি? তাহলে ক্ষমা কেন?’
–‘আমি জানি আপনি আমার উপর রাগ করেছেন…
এই মুহূর্তে ইহান আর রাগ ধরে রাখতে পারল না। চেঁচিয়ে উঠল সে।
–‘তোমার মত মেয়েকে আমি ভালোবেসেছি! দোষ আমারই। তুমি যে একটা দায়িত্বজ্ঞানহীন মেয়ে তা আমার থেকে ভালো কারো জানার কথা না। নিজের ফোনটা বের করে দেখো তো। দেখো কতবার কল করেছি। আমি যে রাতে নিচে যাইনি, চোখে পড়েনি তোমার? আমার খোঁজ নিয়েছ তুমি? সকাল হবার আগে কলেজে এসে বসে আছো? আমার থেকে পড়াশোনা বেশি হয়ে গেল! তোমার জন্য আমি কেন শুধু শুধু প্যারা নিব? লাগবে না আমার এরকম রিলেশন। মুক্তি দিলাম তোমাকে। আজ এই মুহূর্ত থেকে আমি ব্রেকআপ করলাম। কোন জিনিস পেয়ে গেলে যে তার মূল্য থাকে না তা তোমাকে দেখেই প্রমাণ হয়। থাকো তুমি তোমার মত। একদম আমার পিছু পিছু আসবে না। ভোর হওয়ার আগ পর্যন্ত আমি তোমার ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে ছিলাম। ইচ্ছে করছিল লাথি মেরে দরজা ভেঙে ফেলি। সেটা পারছিলাম না বলে নিজের মাথা ঠুকেছি। তোমার সাথে রিলেশনে থাকলে আমার পাগল হতে বেশি সময় লাগবে না।”
ইহান রেগেমেগে চলে যাচ্ছে। তনু হাঁ করে তাকিয়ে ওকে চলে যেতে দেখছে। যাহ বাবা! রাগ করার কথা ছিল কার? আর রাগ করেছে কে? তনু তো জিজ্ঞেসই করতে পারল না ওই মেয়ের কথা ইহান ভাই লুকিয়েছে কেন? কোথায় সে রাগ করবে ইহান ভাই রাগ ভাঙাবে তা না করে, ইহান ভাই রাগ করেছে এখন তাকে রাগ ভাঙাতে হবে। কথায় আছে না জোর যার মুল্লুক তার। তনু আবার পেছন পেছন দৌড়াতে লাগল,
–‘ইহান ভাই দাঁড়ান। আমাকে রেখে যাবেন না। আমাকেও নিয়ে যান। সরি বলেছি তো। এত রাগ করছেন কেন? ভুল হয়ে গেছে। শেষ বারের মত ক্ষমা করুন। আর এমন হবে না।’
#সুখের_পাখি
৪৮
টেস্ট পরীক্ষা তনু ভালো ভাবেই দিল। ইহান ভাই তাকে অনেক সাহায্য করেছে। সারাদিন ধমকের উপর রেখেছে। ওকে একটু বাইরে দেখলেই হলো তখনই,
–‘এই তুমি বাইরে কী করো? কী কাজ আছে এখানে? আমাকে বলো। টেস্টে ফেল করলে কিন্তু সোজা ব্রেকআপ। অমন ফেল্টু গার্লফ্রেন্ড আমার লাগবে না।’
বাধ্য হয়ে তনুকে তিনগুণ পড়তে হয়েছে। এমনিতেই তো ও এখন ভালো ছাত্রী। পাস নিয়ে তার কোন চিন্তা আছে নাকি? তবুও ইহান ভাইটা যে কী! তনুর একেক সময় মনে হয়েছে,
–‘আমি কি এটা বয়ফ্রেন্ড পেয়েছি? নাকি প্রাইভেট টিচার! আল্লাহ আল্লাহ! এত প্যারা দিতে পারে! আজ পর্যন্ত বান্ধবী গুলোর থেকে ওদের বয়ফ্রেন্ড নিয়ে যে গল্প গুলো শুনে এসেছি সব এখন মিথ্যা মনে হচ্ছে। উনি তো পড়াশোনার বাইরে আমার সাথে অন্য কোন কথাই বলে না। কোথায় ঘুরতে নিয়ে যাওয়া? আর কোথায় হাত ধরে হাঁটাহাঁটি করা? জীবনটাই তো পড়তে পড়তে কেটে যাচ্ছে।’
এখন পরীক্ষা শেষে তনু ইহানের কাছে বায়না ধরল,
–‘আমাকে আজ ঘুরতে নিয়ে যেতে হবে।’
ইহান কপালে ভাঁজ ফেলে বলেছে,
–‘এটা কি তোমার অনুরোধ? নাকি হুকুম?’
–‘যেভাবে বললে আপনি ঘুরতে নিয়ে যাবেন। সেভাবেই বলেছি।’
ইহান হেসে ফেলল।
–‘তুমি যে দিনদিন চালাক হচ্ছ তা কি টের পাচ্ছ?’
–‘দেখতে হবে না গার্লফ্রেন্ডটা কার?’
ইহান তনুর মুখের দিকে তাকিয়ে মনে মনে বলল,
–‘তুমি শুধু অনার্সটা কমপ্লিট করো তনু। তারপরই তোমাকে বউ করে নিব। আরতো কয়েকটা বছর।’
–‘কী ভাবছেন?’
–‘কিছু না।’
–‘নিয়ে যাবেন তো?’
–‘তুমি আমার কাছে কোন আবদার করেছ আর তা আমি পূরণ করিনি, এমনটা হয়েছে কখনও?’
তনু মৃদু হেসে গর্বের সাথে বলল,
–‘কক্ষনো না।’
–‘বিকেলে রেডি হয়ে থেকো।’ ইহান কিছু ভাবল। তারপর চট করে বলে ফেলল, ‘শাড়ি পরবে তনু?’
–‘শাড়ি! বড্ড ঝামেলা লাগে। হাঁটতে হাঁটতে হাজার বার হুঁচট খাই।’
–‘আচ্ছা তাহলে বাদ দাও।’
সেদিন বিকেলে ওদের ঘুরতে যাওয়া হলো না। তনু ঘরেই ছিল। রেডি হচ্ছিল সে। তখন অনেক চেঁচামেচি শুনে ঘর থেকে বেরিয়ে আসে সে। ফুপার গলা শোনা যাচ্ছে। সাথে ইহান ভাইয়েরও। তনু গিয়ে দেখল বাবা ছেলেতে প্রচন্ড ঝগড়া বেঁধে গেছে। দূর থেকে সে দাঁড়িয়ে দেখল। ফুপা উত্তেজিত হয়ে বলছে,
–‘কার উপর রাগ দেখাচ্ছ তুমি? তুমি ভুলে যাচ্ছ আমি তোমার বাবা।’
–‘আর তুমি অনেক আগেই ভুলে গেছ আমি তোমার ছেলে।’
–‘বাজে বকো না। তোমার ভালোটাই সবসময় চেয়েছি আমি।’
–‘কেমন চেয়েছ তা দেখাই আছে।’
–‘ইহান! এত বড় হলে তবুও এখনও তুমি নিজের ভালোটা বুঝতে শিখলে না। কোনটা তোমার জন্য ভালো, কোনটা খারাপ তা আজও তোমার অজানা।’
–‘আমার ভালো চাইলে তুমি আমাকে আমার মত ছেড়ে দাও।’
–‘মিউজিক নিয়ে কী করতে পারবে তুমি? তুমি মনে করো তোমার কোন ফিউচার আছে? ইঞ্জিনিয়ারিং কমপ্লিট করলে না। যাত্রাদলে যোগ দিলে। আমি সেটাও মেনে নিলাম। এত বছরেও তো কিছু করতে পারলে না। আগামী পাঁচ বছরেও পারবে না। ওদিকে তোমার ভাই ডক্টর হয়ে নেক্সট ইয়ারে ফিরে আসছে।’
তাচ্ছিল্য ভরে হালস ইহান।
–‘ছোট থেকেই তোমার ওই ছেলেই তোমার ফেভারিট ছিল। আমি কখনও তোমার মনের মতন ছিলাম না। আর না কখনও হতে চাই।’
–‘তোমার মন মর্জি মত চলতে চাইলে আমার বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাও। তোমার যেখানে খুশি চলে যাও। গিয়ে যা খুশি করো। আমার কোন আপত্তি থাকবে না। আমার বাড়িতে থাকলে আমার কথা শুনতেই হবে।’
–‘বাহ! এটাই বাকি ছিল। দারুণ। এতদিনে তোমার এই ইচ্ছেটাও পূরণ হচ্ছে। বাড়ির দাপট দেখাচ্ছ আমাকে? বেশ থাকলাম না তোমার বাড়িতে। তাতে যদি আমাকে রাস্তায় থাকতে হয় এতেও আমি খুশি।’
কথাগুলো বলেই ইহান লম্বা পা ফেলে গটগট করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। ও সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় তনু পেছনে দৌড়ে গেল। ও ইহানকে ডাকার আগেই ফুলি ডেকে উঠল,
–‘ভাইজান! যাইয়েন না ভাইজান। ভাইজান থামেন। আম্মাজান বাড়ি ফিরা নিক৷ ভাইজান কই যাইতাছে?’
ইহান চোখের আড়াল হয়ে যেতেই তনুর দু-চোখ উপচে পানি আসতে লাগল। ইহান ভাইয়ের কথা রাখতে শাড়িই পরেছিল সে। কিন্তু মানুষটা তাকে দেখলও না। এত রাগ কেন ওদের? তনু এটা ভেবেও কষ্ট হচ্ছে ইহান ভাই এখন তাকে ভালোবাসে। তবুও ফুপাকে কেন ক্ষমা করতে পারছে না। ওই মেয়েকে ভুলে গিয়ে যদি তাকে ভালোবাসতে পারে তাহলে ফুপার উপর থেকে রাগ কেন কমছে না! ফুপা তো ভুল কিছু বলছে না। ইহান ভাই তো শুধু বাড়িতেই গান গায়। ওর তো কোন গানের অ্যালবাম বের হচ্ছে না। বেকার দিন কাটাচ্ছে ও। ফুপা তো ছেলের ভবিষ্যতের কথা ভেবেই কথাগুলো বলেছে।
তনু চোখ মুছে ফেলল। তার এমন একটা অবস্থা হয়েছে যে, কাউকে দেখিয়ে কাঁদতেও পারবে না সে। এই কান্নার কী কারণ দিবে? ফুলি অসহায় মুখে এদিকওদিক তাকাল। তনুকে দেখতেই বলল,
–‘ভাইজান চলে গেল! না জানি আজ কী হয়! আম্মাজান আইসা ভাইজান চলে গেছে শুনলে আম্মাজানও এই বাড়িতে থাকব না। ভাইজান ফিরে না আসলে আমিও থাকমু না। গ্রামে চলে যামু।’
তনু মনে মনে বলল,
–‘তোমরা সবাই চলে যাও। আমি কোথায় যাব? আমাকে এখানেই থাকতে হবে। কারণ আমার তো যাওয়ার আর কোন জায়গা নেই। ফুপু আম্মা না থাকলেও আমাকে থাকতে হবে। আমি চাইলেও ইহান ভাইয়ের সাথে চলে যেতে পারতাম না।’
তনু ইহানকে ফোনে অনেকবার ট্রাই করল। কিন্তু ওর ফোন বন্ধ। সাবিনা বাড়ি এসে শুনেছে ইহান রাগ করে বাড়ি থেকে চলে গেছে। শুনেই সাবিনা চিৎকার চেঁচামেচি করতে লাগল।
–‘একটু সময় আমি বাড়িতে ছিলাম না। এতেই তুমি আমার ছেলেটাকে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছ! তোমার এই বাড়িতে তুমিই থাকো। আমিও আমার ছেলের সাথে চলে যাব। যেই বাড়িতে আমার ছেলে থাকবে না সেই বাড়িতে আমি থাকব নাকি?’
–‘ছেলে তোমার একা? ইহান আমার ছেলে না?’
–‘তোমার ছেলে হলে তুমি ওকে দু’চোখে দেখতে পারো না কেন? কেন ওকে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছ?’
–‘আমি যা বলেছি, করেছি ওর ভালোর জন্যই।’
–‘তোমার এমন ভালো করা আমার ছেলের দরকার নেই। থাকো তুমি তোমার বাড়ি নিয়ে। আমিও বাপের বাড়ি গেলাম।’
–‘তুমিও ছেলের মত পাগলামি করো না সাবিনা। দুই তিন দিনের মধ্যেই ইহান চলে আসবে। কয়দিন বন্ধুদের বাসায় থাকতে পারবে? বাস্তবতা অনেক কঠিন সাবিনা। তোমার ছেলের তা বুঝতে হবে।’
সাবিনা আর স্বামীর সাথে কথা বাড়ালেন না। কিচ্ছু ভালো লাগছে না উনার। এতদিন পর স্বামী ফিরে এসেছে। সংসারটা ভরা লাগছিল তার। এখন আবার ছেলে বাড়ি ছেড়ে চলে গেছে। ইহান কোনোদিনও নিজে থেকে বাড়ি ফিরবে না। ছেলের রাগ উনি ভালো করেই জানেন। না জানি কোথাও আছে ও। কার কাছে থাকবে? ইহান তো নিজের বিছানা ছাড়া ঘুমাতে পারে না। মায়ের হাত ছাড়া কারো রান্না ওর মুখে রোচে না।
রাতে ইহানই তনুকে কল করেছে। তনু ফোন তুলেই কথা বলার আগে কান্নায় ভেঙে পড়ল। ইহান ওকে শান্ত করার চেষ্টা করছে। তনুর কান্না থামছেই না।
–‘এই পাগল! তনু, কাঁদছ কেন তুমি? এই, কী হয়েছে তোমার?’
কান্না জড়িত গলায় তনু বলল,
–‘আপনি আমাকে ছেড়ে চলে গেছেন কেন?’
–‘তোমাকে ছেড়ে চলে গেছি মানে! দূর, তোমাকে ছাড়ব কেন? আমি শুধু বাড়ি ছেড়ে এসেছি। তোমাকে ছাড়ার প্রশ্নই আসে না।’
–‘আপনি আর বাড়িতে আসবেন না? আমি আপনাকে কীভাবে দেখব?’
–‘বাড়িতে না এলেও আমি কি তোমাকে না দেখে থাকতে পারব!’
তনু কেঁদেই যাচ্ছে। তার মনে হচ্ছে ইহান ভাই তার থেকে দূরে চলে গেছে।
–‘আমি যেখানেই যাব তোমাকে সাথে নিয়েই যাব তনু। তুমি সারাজীবন আমার সাথে থাকবে।’
–‘তাহলে এখন কেন রেখে চলে গেলেন?’
–‘তুমি আমার সাথে আসবে? আমি তোমাকে নিতে আসছি। রেডি হও৷ ওই বাড়ি থেকে কিচ্ছু নিতে হবে না। তুমি শুধু তোমার বইপত্র গুছাও। এক্ষুনি আসছি।’
–‘না,না।’
–‘কেন?’
–‘আমি কীভাবে যাব আপনার সাথে? ফুপু আম্মাকে কী বলব? আপনার সাথে গেলে লোকে কী বলবে? কোন পরিচয়ে আপনার সাথে থাকব আমি?’
–‘আমি কি টাইমপাস করার জন্য তোমার সাথে প্রেম করছি? বিয়ে করব আমরা। তুমি আমার বউ হয়ে আমার সাথে থাকবে। আমার কিছু নেই জেনে কি তুমি আমার হাত ধরবে না তনু? চলো আমরা আজই বিয়ে করে ফেলি।’
তনু কিছুই বুঝতে পারছিল না। কী বলবে সে? ফুপু আম্মা কি ওকে ছেলের বউ রূপে মেনে নিবে? বাবার কাছে ও কথা দিয়েছিল, কখনও ফুপু আম্মাকে কষ্ট দিবে না। ফুপু আম্মার কথার বাইরে যাবে না। ফুপু আম্মা যা বলবে তনু তা-ই করবে। আজ ও ইহান ভাইয়ের সাথে চলে গেলে, কাউকে কিছু না জানিয়ে বিয়ে করে ফেললে ফুপু আম্মা কষ্ট পাবে না?
–‘ইহান ভাই, ফুপু আম্মাকে না জানিয়ে কীভাবে বিয়ে…
–‘মা’র চিন্তা তুমি করো না। আমি মা’কে ঠিক ম্যানেজ করে নিব। তুমি আমাকে ভালোবাসো তো নাকি?’
–‘বাসি। তবে আমি ফুপু আম্মার অনুমতি নিয়ে তবেই আপনার বউ হতে চাই। মায়ের মত যে আমাকে আদর দিয়েছে, আগলে রেখেছে তাকে আমি ঠকাতে পারব না।’
ইহান হাসল। ও জানত তনু এরকমটাই বলবে। তনু মুখে যত কথাই বলুক ওর সাহস যে কতটুকু তা ইহান জানে।
–‘ধরো মা তোমাকে আমার বউ করতে চাইবে না। তাহলে কি তুমি আমাকে বিয়ে করবে না? ছেড়ে দিবে আমাকে?’
তনু চুপ করে রইল। দু’টার থেকে একটা করাও তার পক্ষে সম্ভব না। ফুপু আম্মার অবাধ্য সে কখনও হবে না। আবার মরে গেলেও ইহান ভাইকে ছাড়তে পারবে না।
–‘আপনি বাড়ি ফিরবেন না? কেন নিজের বাবার সাথে রাগ করছেন? বাবা কি কখনও ছেলের খারাপ চাইবে।’
–‘তুমি জানো না তনু। আমার বাবা তোমার বাবার মত না। আমি ওই বাড়িতে আর কোনদিনও ফিরব না।’
ফুপার সাথে এখনও তনুর তেমন ভালো ভাবে কথা হয়নি। ফুপা মানুষটা রাগী, বদমেজাজি নাকি ভালো মানুষ ঠিক বুঝতে পারছে না সে। ফুপার সাথে কথা বলতে ভয় লাগে তার। সেদিন কেমন চেঁচাল!
একদিন ফুপার সাথে তার আলাপ হয়েই গেল। ফুপাকে বাইরে থেকে দেখলে মনে হয় মানুষটা কত রাগী। অথচ তনুর মনে হয়েছে ফুপার মনে অনেক দুঃখ।
–‘আমার ছেলে শেষ কবে আমাকে বাবা ডেকেছে জানো তুমি? তুমি জানবে কীভাবে? আমারই তো মনে নেই। ইহান আমাকে বাবা ডাকে না। আমার উপর অনেক রাগ তার। আমি কেন ওকে শাসন করি? আমি কি মজা পাই? না। ওর ভবিষ্যত নিয়ে ভাবি বলেই আমার চিন্তা হয়। আমার ছেলে প্রতিষ্ঠিত হোক। সমাজে মাথা উঁচু করে বাঁচুক। এটা চাওয়া কি আমার অপরাধ? তুমিই বলো না। তোমার বাবা কি তোমাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখত না? আমার বউ, ছেলেরা শুধু শাসনটাই দেখেছে। ভালোবাসা কোনোদিনও দেখেনি।’
চলবে🍂
#জেরিন_আক্তার_নিপা