সে_আমারঃ (আপডেট) পর্বঃ ৩ /৪

0
2500

সে_আমারঃ (আপডেট)
পর্বঃ ৩ /৪
মোর্শেদা হাবিবঃ
***************
সাহেদা ঘুমিয়েছিলেন বলে রক্ষে নতুবা তিনি পৌষীর হাত দেখলে সব বুঝে ফেলতেন!পৌষী বাম হাতটা ডান হাতের উপর বুলালো!কব্জির উপর পাঁচ আঙ্গুলের দাগ পড়ে গেছে!ড্রয়ার থেকে বাম বের করে হাতের উপর মেখে নিলো সে!
তারপর টেবিলে গিয়ে বই নিয়ে পড়তে বসলো!
সেদিনের সেই দুর্ঘটনার পর থেকে পেছন বারান্দায় যাওয়া পুরোপুরি বন্ধ করে দিয়েছে পৌষী! সে এখন রান্নাঘরের পাশেই একটা দড়ি টাঙিয়ে নিয়েছে সেখানেই কাপড় দেয়!যদিও এই পাশটাতে রোদ তেমন আসেনা বললেই চলে!তবে এপাশটাতে মামী বা তার মেয়েরাও তেমন একটা আসেনা! ছেলে তো একদমই আসেনা!
বড়মামাদের বাড়ীটা বিশাল বড় হওয়ায় এই সুবিধেটা হয়েছে!যে কোনো কাজের জন্য সুবিধে মতো জায়গার অভাব নেই!
চারপাশে প্রচুর জায়গা পড়ে আছে!বিকেলে বা সন্ধ্যের দিকে সবাই যখন ঘুমিয়ে থাকে পৌষী নিজের মত হাঁটাহাঁটি করে!
…..
রাতে যখন পড়তে বসেছে।তখনি নীরা উঁকি দিয়ে বললো-“পৌষীপু…মা তোমাকে ডাকছে!”
পৌষী ঘাড় ফিরিয়ে বলল,তুমি যাও আমি আসছি!”
সাহেদা চোখে চশমা দিয়ে কাপড় সেলাই করছিলেন!পৌষী ওর চওড়া ওড়নাটা দিয়ে নিজেকে ভালো করে ঢেকে নিয়ে মামীর রুমের দিকে রওনা দিলো!
মামীর রুমের সামনে এসে গেটে নক করে বলল-“আসবো মামী? ”
রাণী শুয়েছিলেন।তিনি পৌষীকে ভেতরে ডাকলেন!
পৌষী ঘরে ঢুকে বলল-“আমাকে ডেকেছেন মামী?”
-“হ্যাঁ…ডেকেছি!শোন্…তুই তো কমার্সের ছাত্রী….তাই না?আমাদের মীরাকে একটু একাউন্টিংটা দেখিয়ে দিস তো মা!ও একাউন্টিংয়ে দুর্বল..! কি পারবিনা?”
-“জ্বী….ইনশাআল্লাহ!ও যখন ফ্রি থাকে তখন….!”
পৌষীর মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বলল-“না না তুই ই একটা সময় বের করে ওকে প্রতিদিন এক ঘন্টা করে নিয়ে বসলি…কি বলিস ?”
-“প্রতিদিন?”পৌষী একটু অবাকই হলো মামীর এহেন আব্দারে!
-“হ্যাঁ….শুক্রবারে তো মেহমান টেহমান আসে,সেদিনটা নাহয় বাদ দে…আরে যে কোচিংটাতে ওকে ভর্তি করিয়েছি সেখানে ও তেমন একটা ইমপ্রুভমেন্ট দেখাতে পারছেনা!”
পৌষী কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল -“ঠিকআছে,কাল থেকে নাহয় সন্ধ্যের পরপর ওকে নিয়ে বসবো!”

“এখনই জয়েন করুন আমাদের গল্প পোকা ডট কম ফেসবুক গ্রুপে।
আর নিজের লেখা গল্প- কবিতা -পোস্ট করে অথবা অন্যের লেখা পড়ে গঠনমূলক সমালোচনা করে প্রতি সাপ্তাহে জিতে নিন বই সামগ্রী উপহার।
আমাদের গল্প পোকা ডট কম ফেসবুক গ্রুপে জয়েন করার জন্য এখানে ক্লিক করুন



বলে পৌষী উঠে দাঁড়ালো-“আমি তাহলে যাই…মামী?”
-“ওহ্…আরেকটা কথা…বলে মামী উঠে ড্রয়ার থেকে একটা নতুন জর্জেট বের করে ওর হাতে দিয়ে বললেন-“একটু কষ্ট করনা মা…এই শাড়ীটাতে একটু ফলস লাগিয়ে দে….!কাল সকালেই এটা আমার লাগবে!কি যে ভুলো মন আমার…দেখনা।গতকাল মার্কেটে গেলাম অথচ ফলস লাগাতে ভুলে গেছি!”
-“কালই লাগবে এটা?”পৌষী অসহায় গলায় বলল!কারন ওর পড়া এখনও বাকি আছে!
মামী বললো-“তুই তোর পড়া শেষ করে রাতে এক ফাঁকে লাগিয়ে দিস রে মা..!”
পৌষী দীর্ঘশ্বাস গোপন করে মুচকি হাসি দিয়ে বললো-“জ্বী,মামী!”
…..
পরদিন সকালে দশটার দিকে পৌষী শাড়ীটা মামীকে দিতে তার রুমে গেলো!
সাধারনত এ সময়ে রাজ তো বটেই… ইরা মীরাও ঘুমিয়ে থাকে!তাই পৌষী স্বচ্ছন্দে মামীর রুমে নক করে ভেতরে ঢুকে গেলো!
ঢুকেই নার্ভাস হয়ে গেলো!
রাজ একটা টাওয়েল ঘাড়ে দিয়ে খালি গায়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মোবাইল টিপছে।
দরোজা খোলার শব্দে রাজ তাকালো! পৌষী ভীষণ চমকে উঠে ঘোমটা টেনে একপাশে সরে দাঁড়ালো!
রাজ বললো-“কি চাই?”
পৌষী শাড়ীটা বিছানার উপর রেখে মৃদু স্বরে বললো-“এটা রেখে গেলাম!”বলে দ্রুত পায়ে বেরিয়ে যেতে নিলে মামী পেছনের বারান্দা থেকে বেরিয়ে এসে ডাকলেন-“কে রে…পৌষী নাকি?”
-“জ্বী…মামী!শাড়ীটা রেখে গেলাম!”কাঁপা কাঁপা স্বরে কোনমতে কথাগুলো বললো পৌষী তার কারন রাজ মোবাইল ফেলে হা করে ওর দিকেই তাকিয়ে আছে!
পৌষী চলে যেতে গিয়েও পারলোনা।রানী পেছন থেকে ওকে ডাকলেন-“একটু দাঁড়া, দেখে নেই।”বলে রাণী সুলতানা সন্তষ্ট চিত্তে বারান্দা থেকে ঘরে এসে শাড়ীটা নেড়েচেড়ে দেখে বললেন-“হুম,,ঠিকআছে।কষ্ট দিলাম তোকে কিছু মনে করিস না আবার!”
পৌষী কোনোমতে মাথা ঝাঁকিয়ে বেরিয়ে গেলো।
রানী নিজের মনেই বললেন-
“মেয়েটা কাজ জানে..!কি সুন্দর করে ফলসটা লাগিয়েছে!”
রাজ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো-“এটা কে মা? একেবারে সোজা তোমার বেডরুমে ঢুকে গেলো?প্রথমে ভেবেছিলাম কাজের মেয়ে টেয়ে হবে।এখন তো মনে হচ্ছে…!”
রাজের মা হেসে দিলেন
-“দুর..বোকা..কাজের মেয়ে হতে যাবে কেন?তুই পৌষীকে চিনিস না? তোর সাহিদা ফুপ্পির মেয়ে সিদরাহ !ডাক নাম পৌষী!তোর অবশ্য না চেনার কারন আছে।কারন তোর খুব ছোটবেলায় ওরা কয়েকবার এসেছিলো আমাদের আগের বাড়ীতে! তখনো পৌষীর জন্ম হয়নি।তারপর ওরা ওর দাদার বাড়ী করাচীতে কয়েক বছর ছিলো!এর পরে দেশে আসলেও তোর বাবার সাথে আর তেমন যোগাযোগ ছিলোনা।আমরাও বাসা বদলালাম।তোর বাবার সাথে মাঝেমধ্যে তোর ফুপির ফোনে যোগাযোগ হতো কিন্তু আমাদের মধ্যে আসাযাওয়াটা একদমই ছিলোনা….তাই…এসব তোদের মনে নেই!”
রাজ চরম বিস্ময় নিয়ে বলল-“এটা সাহেদা ফুপ্পির মেয়ে?সাহেদা ফুপ্পিকে তো চিনি, উনিও এসেছেন?তা ওরা আমাদের বাড়ীতে কেন?মানে কোনো সমস্যা?”
-“তোর ফুপা মারা যাবার পর সাহিদা ফুপি পৌষীকে নিয়ে একা বাড়ীতে থাকতে পারছিলো না।সেয়ানা মেয়ে….লোকজন তো বিরক্ত করবেই।তাই তোর ফুপি ফ্ল্যাট বেচে দিয়ে আমাদের এখানে এসে উঠেছে।তোর ফুপা মারা যাবার সময় বেশ কিছু টাকার দেনাও করে ফেলেছিলো তোর ফুপি।ফ্ল্যাট বিক্রির টাকা থেকে দেনা শোধ করে বাকি টাকাটা একটা ইসলামিক ব্যাংকে মেয়ের নামে রেখেছে।সেই টাকা দিয়েই ওরা চলে।পৌষী আবার একটু খুঁতখুঁতে মোল্লা টাইপ।এ যুগের মেয়ে হয়েও ইসলামিক মাইন্ডের। মাথায় ঘোমটা টেনে রাখে বুড়িদের মতো।বাইরের লোকদের সামনে তেমন একটা যায়না বললেই চলে!”
রাজ কোমড়ে হাত রেখে মনোযোগ দিয়ে চুপচাপ পুরো কথা শুনলো।মনে পড়লো মেয়েটাকে গতকাল তুই বলে কথা বলেছে সে!মেয়েটা না জানি কি ভাবছে।কাজটা খুব খারাপ হয়ে গেছে।কিন্তু স্যরি বলার তো কোনো উপায়ই দেখা যাচ্ছেনা।এই মেয়ে কারো সামনে আসেনা।
রাজ মৃদুস্বরে বললো-“ভেরী স্যাড….শুনে খারাপ লাগলো।বাপ্পী ভালো করেছে ওনাদের এখানে নিয়ে এসেছে!”
বলে রাজ কিছুটা অন্যমনস্ক হয়ে পড়লো!
রাণী ছেলেকে তাগাদা দিয়ে বললেন
-“এখন তুই জলদি গোসলে যা তো!তোর না কলেজে প্রোগাম আছে।
আমি দারোয়ানকে বলে দিয়েছি,ও..পানির মিস্ত্রী আনিয়ে তোর বাথরুমের কলটা সারিয়ে রাখবে !”
রাজ বাথরুমে ঢোকার আগে হঠাৎ মায়ের দিকে তাকিয়ে বললো-“মা…একটা কথা! আমি কলেজে যাবার আগে পৌষীকে স্যরি বলতে চাই কারন আমি ওনাকে মেইড সার্ভেন্ট ভেবে সেদিন তুই তুই করে কথা বলেছিলাম!”
-“এতে স্যরি বলার কি আছে…তুই তো আর জানতি না!”রানী স্বগোতক্তি করলেন।
রাজ নিজের মাথা চুলকে কাচুমাচু ভঙ্গিতে বললো-
-“তবুও….ব্যপারটা কেমন হয়ে গেলো না?
সে আমার কাজিন,অথচ আমি তাকে মেইড সার্ভেন্ট ভেবে….নাহ্,খুব বিশ্রী লাগছে।
তুমি ওকে একটু ডাকাও না তোমার রুমে!প্লিজ মা!”
-“আচ্ছা…ডাকবো রে বাবা ,তুই যা তো…আগে গোসল সেরে বের হ!”
রাজ মনের খুশি চেপে শূন্যে ফাঁকা ঘুষি চালিয়ে বাথরুমে ঢুকে গেলো!তারপর আয়নায় নিজেকে দেখে গুনগুনিয়ে উঠল।
দ্বিতীয়বার পৌষীর ডাক পড়লে সে কলেজ যাবার অযুহাতে এড়িয়ে গেলো!পৌষির মনে হচ্ছিলো রাজ এখনো মামীর রুমেই আছে!
কিন্তু পৌষী জানতো না,রাজ ব্যপারটাকে এতো গুরুত্বের সাথে দেখবে!রাতে শুতে যাবার আগে দরোজা নক হলো! পৌষী চুল আঁচড়াচ্ছিল।
সেখান থেকেই মায়ের দিকে তাকালে সাহেদা উঠে গিয়ে দরোজা খুললেন।
প্রথমে রাণী ঢুকলেন-“ঘুমিয়ে পড়েছিলে তোমরা?”
সাহেদা হাসলেন-“এই তো ঘুমোতে যাচ্ছিলাম!”
-“আর বোলোনা,তোমার ভাতিজা তো পাগল করে ফেললো তোমার সাথে দেখা করবে আর পৌষীকে স্যরি বলবে!”
পৌষী বিষয়টা বুঝতে না পেরে একটু অবাক হয়ে তাকালো! রাণী গেটের দিকে তাকালেন-“কই আয়…..রাজ?”
পৌষী বুঝতে পেরে অতি দ্রুত ওড়নাটা টেনে নিয়ে নিজেকে ঢেকে ফেললো।ততক্ষণে রাজের চোরাচাহনী ওকে এক ঝলক দেখে নিয়েছে।
পৌষী ঘরের এক কোণে জানালার পর্দার সামনে সরে দাঁড়ালো!
রাজ ঢুকে সাহেদার পা ছুঁয়ে সালাম করতে নিলে সাহেদা দ্রুত বাধা দিয়ে বলল-“আরে কি করছো বাবা…পা ধরে সালাম করতে হয়না!কত্ত বড় হয়ে গেছো মাশাআল্লাহ! তাই না ভাবী?”
-“হমমম…তুমিতো ওকে শেষ যেদিন দেখেছিলে তখন ওর বয়েস সাত কি আট হবে!”
রাজ আন্তরিক ভাবেই সাহেদার হাত টেনে নিয়ে বললো-
-“ফুপি আপনার জীবনে এতবড় একটা ডিজাষ্টার ঘটে গেলো। এই সময়ে যদি আপনার ছেলে হিসেবে আপনার কাজে না আসি তাহলে সত্যিই লজ্জার কথা!”
-“না,বাবা।আমি তোমাদের পেয়ে আল্লাহর শোকর করি।আমার ভাইজান…তোমার আম্মু’ এরা আমার জন্য যথেষ্ট করছেন।
রাজ একপলক পৌষীর দিকে তাকিয়ে চোখ সরিয়ে বললো-“ফুপি,আমি আরেকটা ব্যপারে “স্যরি” বলতে চাচ্ছিলাম! ”
-“কেন রে বাবা…স্যরি কিসের?”
-“ইয়ে…মানে পৌষীকে বাইরের লোক মনে করে তুই বলে ফেলেছি!”
সাহেদা হেসে বললেন-“ওহ্,এই কথা।পৌষী তোর কত্ত ছোট।তুই বললেই বা সমস্যা কি!”
রানী মাঝখান থেকে বলে উঠলেন-“আরে ও পৌষীকে নতুন মেইড সার্ভেন্ট ভেবে তুই বলে ফেলেছে।”রাজ মা’কে বাধা দিতে ডান হাতটা তুলেও হতাশ ভঙ্গিতে নামিয়ে আনলো।রাজ মনে মনে কিছুটা বিব্রত হলো! মায়ের এই কথাটা বলার কি দরকার ছিলো!পৌষী কি ভাববে এখন।রাজ পৌষীর দিকে তাকানোর সাহস পেলোনা।মুখ নিচু করে রাখলো।সাহেদা কিছুটা দমে গেলেন অবশ্য।রানী একাই হাসছেন!
-“তুই পৌষীকে কাজের মেয়ে ভাবলেও ভুল ভাবিস নি।মেয়ে হিসেবে ও অকাজের না।বড্ড কাজের মেয়ে।”
রাজ চরম অস্বস্তি নিয়ে ফুপির দিকে তাকালো-“ফুপি,আম…আমি আসি।তোমার যে কোনো প্রয়োজনে আমাকে নিজের ছেলে মনে করে ডাকবে।”
সাহেদা সামান্য হাসলেন-
“আচ্ছা,ঠিকআছে…বাবা।”
রাজ দ্রুত বেরিয়ে এলো সেখান থেকে।রানী হেসে পৌষীর দিকে তাকালেন।সে পর্দার আড়ালে লুকিয়ে আছে।তিনি ওকে উদ্দেশ্য করে বললেন-‘দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে যা তো মা!”
বলে তিনিও বেরিয়ে গেলেন।
রাজ বাইরে এসে মা’কে আস্তে করে বলরো-“মেইড সার্ভেন্ট কথাটা না তুললে কি হতো না?”
-“ওমা,খারাপ কি বলেছি?”
-“সেটা যদি বুঝতে তাহলে তো হতোই!”
রাজ ফোঁস করে দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিজের ঘরের দিকে চলে গেলো।
রানী বাঁকা হাসি হেসে বললেন!’তুই আমার পেটে জন্মেছিস না আমি তোর পেটে।কিছু বুঝিনা মনে করেছিস?”
রাজ কিছুটা আফসোস নিয়ে নিজের ঘরে ফিরে এলো।পৌষি কি এটা শুনে ওর ওপর রাগ করবে ?একটা কথাও তো বললো না!জীবনে এই প্রথম কোনো মেয়ে ওর প্রতি কোনো আগ্রহই দেখালো না!সে কারনেই কিনা কে জানে!রাজ…অন্যরকম এক আকর্ষণ বোধ করলো পৌষীর প্রতি।এ যাবৎ পর্যন্ত ও নিজেই ছিলো মেয়েদের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু।মেয়েরা ওকে দেখলে কথা বলার জন্য,বন্ধুত্ব করার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠে…এটাই রাজের এতদিনের অভিজ্ঞতা! কিন্তু এ কেমন মেয়ে একটিবার তাকিয়ে দেখারও প্রয়োজন বোধ করলোনা!
প্রতিদিনের মতো আজো সাহেদা দুপুরের খাবার পর রান্নাঘরের তদারকী শেষে নিজের ঘরের দিকেই আসছিলো।তখনি রাণী উত্তেজিত অবস্থায় ছুটে এলো-“এই…সাহেদা…দারুন একটা খবর আছে রে…এইমাত্র পাত্রপক্ষের বাড়ী থেকে ফোন এলো!ওরা আমার ইরাকে পছন্দ করেছে!”
সাহেদা অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল।রাণী গড়গড় করে কথা বলে চলছে!
পরবর্তী এক ঘন্টার মধ্যে রাণী পুরো বাড়ী গরম করে ফেললো!তার ইরার বিয়ে বিশিষ্ট শিল্পপতি ইয়াজউদ্দিনের ছেলে ব্যারিষ্টার ইমতিয়াজেরর সাথে পাকা হতে যাচ্ছে।এই খুশিতে তার পাগল হওয়া বাকী!
পাত্রপক্ষ আগামী পরশুই মেয়েকে আংটি পড়িয়ে সমন্ধটা পাকা করতে চাচ্ছে।সেদিনই বিয়ের দিন তারিখ ঠিক করা হবে।
রাণীর খুশি যেন ধরেনা!
….
তার পরের দিন থেকেই রাণী ভিলাতে বিয়ের আমেজ শুরু হয়ে গেলো!
ইরা’কে প্রতিদিনই কাচা হলুদ মেখে গোসল করতে হচ্ছে!এরই মধ্যে ফেসিয়ালও করে এসেছে ইরা!
সন্ধ্যের চা নাস্তা খাবার পরপরই সবাই মিলে মেহেদী লাগাতে বসে গেছে।ইরার বান্ধবীরাও এসেছে!ওদের সাথে বসে পৌষীও চুপচাপ ওদের মেহেদী লাগানো দেখছিলো।
নীরা এবার পীড়াপীড়ি শুরু করলো পৌষীকেও মেহেদী লাগানোর জন্য।সে টান দিয়ে পৌষীর বাম হাতে মেহেদী লাগানো শুরু করলো!
মেহেদী অর্ধেক লাগানো হয়েছে এমন অবস্থাতেই রাজ এসে ঢুকলো!
ওকে দেখে পৌষী একহাতেই ওড়না টেনে নিজেকে ঢাকলো!
পৌষীর এই লজ্জাটুকু দারুন উপোভোগ করে রাজ!
আজকালকার মেয়েদের মধ্যে সব আছে কেবল লজ্জারই অভাব।তাদের সব থাকলেও নেই কেবল লজ্জা!
রাজ এটা ওটা বলে মীরার সাথে দুষ্টুমী করলেও ওর চোখ কিছুক্ষণ পরপর চলে যাচ্ছিলো পৌষীর দিকে! কিভাবে ওর সাথে একটু কথা বলা যায় ভেবে পাচ্ছেনা রাজ।
অবশেষে নীরাকে ধরলো!ও যেন পৌষীর সাথে একটু কথা বলিয়ে দেয়!
নীরা সাফ জবাব দিলো-“কাজ হবেনা….পৌষীপু সবার সাথে কথা বলেনা!ও অনেক রেস্ট্রিকশন মেনে চলে”!রাজ তবু নীরাকে গিফটের লোভ দেখিয়ে রাজী করালো!অবশেষে নীরা রাজী হলো!

কথা মতো মেহেদী লাগানো শেষে পৌষীকে জোর করে নিজের ঘরে ধরে নিয়ে এলো নীরা! ওর নতুন থ্রিপীসটা দেখানোর জন্য পীড়াপীড়ি শুরু করলো-“পৌষীপু…তুমি আমাকে ড্রেস সিলেক্ট করে দেবে!”
তারপর পৌষীকে টেনে নিজের ঘরে নিয়ে এলো ওর ড্রেস দেখাতে যেটা ওর জন্য বাবা গতমাসে ব্যাংকক থেকে কিনে এনেছিলেন !তারপর আলমারী খুলে চারপাঁচটা ড্রেস বের করে বিছানায় ফেলল নীরা!
-“বলো না পৌষিপু…কাল কোনটা পড়বো?”
পৌষির বাম হাতে মেহেদী তাই বাম হাত সরিয়ে রেখে সাবধানে ডান হাত দিয়ে ড্রেস গুলো উল্টেপাল্টে দেখছিলো তখনি হঠাৎ রাজের আবির্ভাব ওকে চমকে দিলো!
ওড়না দিয়ে মাথা ঢাকাই ছিলো সেটাকে টেনে লম্বা করে দিলো পৌষী।রাজ নীরাকে বলল-“তোর কাছেই একটা কাজে এসেছিলাম…যাক ওনাকেও পেয়ে গেলাম।(বলে নীরাকে ইশারা করলো)!
নীরা বুঝতে পেরে পৌষীর কাছে গিয়ে বলল-“পৌষিপু..ভাইয়া বোধহয় তোমাকে কিছু বলতে চায়…একটু শুনবে?”
পৌষির হাতে নীরার একটা ড্রেস তখনো ধরা ছিলো।সে ওটার দিকে তাকিয়েই বলল-“জ্বী….বলুন!”
-“মমম….একচুয়েলি আ’ম রিয়েলি স্যরি! আমি আপনাকে চিনতে পারিনি বলে সেদিন ওভাবে তুই করে….মানে….আপনি আমার ঘরটা চমৎকার সাজিয়েছিলেন….. সেজন্য অসংখ্য ধন্যবাদ।ইয়ে….আমাকে ক্ষমা করেছেন তো?”
পৌষি মৃদু শব্দে বলল-“না…ঠিকআছে।ভুলতো হতেই পারে!”
পৌষীর কন্ঠটা রাজের কাছে অন্যরকম মনে হলো।যেন শব্দটা দাঁতের ফাঁক গলে এক অদ্ভুত শব্দে অনুরনিত হচ্ছে।ওর কন্ঠটা আরেকবার শুনতে মনটা অস্থির হয়ে উঠল।রাজ বলল-“আপনার আসল নামটা যেন কি বলেছিলেন,ভুলে গেছি..!’
-“সিদরাতুল মুনতাহা! ”
-“হমমম,সুন্দর নাম!”
নীরা ইশারায় চোখ দেখিয়ে রাজকে এবার যেতে বললে রাজ ডান হাত দিয়ে কপালে চাপড় মেরে চলে গেলো!

পরদিন পাত্রপক্ষ আসার আগেই মামী নীরা মীরা সবাই পার্লারে চলে গেলো!
নীরা পৌষীকে সাথে নিয়ে যেতে প্রচুর অনুরোধ করেছিলো কিন্তু পৌষী মানা করে দিলো।সে এতো সাজতে ভালোবাসেনা।
রাতে বিয়ে উপলক্ষে প্রচুর অতিথি আসলো।বাগানে লাইটিং করা হয়েছে ! খাবারের আয়োজনে ক্যাটারার নিয়োগ করা হয়েছিলো বলে বাড়ীতে রান্নার কোনো চাপ নেই।মহিলারা যেন রান্নার ঝামেলায় আনন্দ করতে অসুবিধা বোধ না করে সেকারনেই আমজাদ চৌধুরী এই ব্যবস্থা করেছেন।
খুব ধুমধামের মধ্য দিয়ে ইরার আংটি পড়ানো শেষ হলো।
সবাই সবার মতো অনুষ্ঠানটা এনজয় করলেও রাজ পৌষীকে এক নজর দেখার জন্য অস্থির হয়ে উঠলো।নীরার পীড়াপীড়িতে পৌষী আজ শাড়ী পড়েছে।হালকা বেগুনী রঙের বুটিদার স্কার্ফ দিয়ে মাথায় হিজাব পড়েছে।চোখে কাজল আর ঠোঁটে ন্যাচারাল কালারের লিপস্টিক।
তাতেই মনে হচ্ছিলো পৌষী অন্য কোনো জগৎ থেকে এখানে এসে পড়েছে।একবার
তাকালে দুবার তাকাতে বাধ্য হবে যে কেউ! রাজ জানালা দিয়ে উঁকি মেরে খুঁজছিলো।হঠাৎ পৌষির দিকে চোখ পড়তেই নিজের জায়গাতেই স্থির হয়ে গেলো!ফাটাফাটি রকমের সুন্দর লাগছে পৌষীকে।রাজ ভেতরে ভেতরে একধরনের অস্থিরতা বোধ করলো।
হঠাৎ মনে হলো পৌষীকে নিজের করে না পেলে ও মনে হয় নিজেকে বাঁচাতে পারবেনা…মরেই যাবে! নিজের এ ধরনের ছেলেমানুষী চিন্তায় নিজেই হাসলো!
রাতে অতিথিরা একে একে বিদায় নিতে শুরু করলো! রাজ দাঁড়িয়ে থেকে অতিথিদের বিদায় দিচ্ছিলো!
এমন সময় ইরার ফুপাত দেবর রাজকে দেখে দুঠোঁট চেপে নার্ভাসের হাসি হাসলেন।
তারপর বললো-“আপনাদের সাথে সম্পর্ক দুদিক দিয়ে মজবুত হতে যাচ্ছে এবার!”
রাজ বুঝতে না পেরে হেসে বললো -“ঠিক বুঝলাম না।”
আমার আম্মা অনেক দিন থেকেই আমার জন্য পাত্রী খুঁজছেন।আম্মার যা খুঁতখুঁতে স্বভাব।তবে আপনার ফুপাত বোনকে দেখে পছন্দ করে আমাকে ওনার ছবি দেখালেন। এই…..আরকি!”
রাজ শক্ত হয়ে গেলো!
অজান্তেই ওর চোয়াল শক্ত হয়ে গেলো!বুকের ভেতর হাতুড়ীর বাড়ি পড়লো যেন।”
ইসতিয়াক হাসল-“আম্মা ওয়ান্টস টু টক টু হার প্যারেন্টস…ইট মিন…বুঝতেই পারছেন!সি ইজ সো লাভলি!আই ওয়ান্ট টু ম্যারি হার!”
রাজের ইচ্ছে হলো এক ঘুষিতে ইসতিয়াকের নাকটা ফাটিয়ে দিতে! কিন্তু দাঁতে দাঁত চেপে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো রাজ।ওর মনে হলো কেউ যেন ওর কলিজা ধরে টান দিয়েছে।
…..
চলবে…..
সে_আমারঃ
পর্বঃ-৪
*************
পৌষী শাড়ী বদলে ঘরোয়া পোষাক পড়ে নিয়েছে।পৌষী জানতো ঈশার নামাজটা অনুষ্ঠান শুরুর আগে না পড়লে পরে কাযা হয়ে যাবার ভয় আছে,তাই সে নামাজটা আগেই পড়ে নিয়েছে!
সাহেদা শোয়ার আয়োজন করছিলো,পৌষী মায়ের কাছে এসে বসল!সাহেদা বললেন-“কি হলো…ঘুমাবিনা?”
-“হমম,ঘুমাবো!আচ্ছা…মা,আমরা কি অন্য বাসায় ভাড়া চলে যেতে পারিনা?”
-“হঠাৎ একথা কেন বলছিস রে মা?কিছু হয়েছে?”
-“না…কি আর হবে? এরা তো পুরোপুরি বিজাতীয় রীতিনীতি পালন করে চলে।এতো জোরে গান বাজাচ্ছিলো যে আমার মাথা ধরে গিয়েছিলো!তাছাড়া আজকের অনুষ্ঠানে যে পরিমান টাকা খরচ করা হয়েছে এই টাকা দিয়ে পাঁচটা বিয়ের অনুষ্ঠান করা যেতো!তুমিই বলো,আংটি পড়ানো কি কোনো ইসলাম সম্মত অনুষ্ঠান? অথচ বর কনে এখন এই অনুষ্ঠানের সুবাদে দেখা করবে,কথা বলবে…একসাথে বেড়াতে যাবে!গুনাহের পরিস্থিতি তৈরী হলো! বিয়েটা তো নাও হতে পারে!বরং এসব না করে কাবিন করিয়ে ফেলাটা শরীয়ত সম্মত হতো!”
সাহেদা মেয়ের কথা শুনে মৃদু হাসলেন!
-“তোর কথা ঠিক আছে।কিন্তু এখানে তুই কাকে বোঝাবি এসব কথা? আমরা তো আজকে নামের মুসলিম! আমাদের ভেতর ইসলাম কই?আর তুই বাড়ী ভাড়া করে অন্যত্র থাকার কথা বলছিস?তোর তো সবই জানা আছে,কোন্ পরিস্থিতিতে আমরা নিজেদের ফ্ল্যাট বিক্রি করে দিয়ে আজ অন্যের বাড়ীতে এসে উঠেছি।তোকে নিয়ে একা একটা বাড়ীতে থাকা আমাদের জন্য নিরাপদ না এটাতো জানিস।নইলে আমার কি ভালো লাগে দিনের পর দিন পরের বাড়ী পড়ে থাকতে?তার উপর মাসে মাসে বাড়ী ভাড়া গোনার সামর্থ্য কি আমাদের আছে,বল্?”
পৌষী চুপ মেরে গেলো!কথা তো সত্য!ওরা নিজেদের বাড়ীতেও কত বড় বড় বিপদের সম্মুখীন হয়েছিলো।মাথার উপর একজন পুরুষ না থাকাটা একজন মেয়ের জন্য বড় গ্লানির এটা পৌষীর চেয়ে বেশী আর কে বোঝে?একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বালিশে মাথা রাখলো পৌষী!
সাহেদা ওর মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন-“তোর একটা ভালো বিয়ে না হওয়া পর্যন্ত আমার দুশ্চিন্তা যাবে না!একটা ভালো ছেলে…..!”
এ পর্যায় পৌষী হঠাৎ উঠে বসল-“ভালো ছেলে মানে কি ধনী?”
-“না ধনী কেন হবে,সৎ চরিত্র কর্মক্ষম….!”
-“আসলটাই তো বললেনা,একটা কথা বলে রাখি মা….আমি কিন্তু দ্বীনদার ছাড়া বিয়ে করবোনা!সে গরীব হোক তবু আমার দ্বীনদার চাই!আমার এই একটাই অনুরোধ তোমার কাছে!”
-“আমাকে অনুরোধ না করে আল্লাহর কাছে বল্!তোর ইচ্ছে পূরণের ক্ষমতা ঐ আল্লাহ ছাড়া কার আছে!আমি নিজে তো এতো বুঝতাম না ইসলাম সম্পর্কে!তুই বই পড়ে লেকচার শুনে যতটা পালন করিস আমরা তো তোকে সেই তরবীয়ত দিয়ে বড় করতে পারিনি!এটা তো আল্লাহর দান যে তুই হেদায়েত পেয়েছিস!”
পৌষী চিন্তিত সুরে বলল-“মা,তোমাকে একটা কথা বলা হয়নি।সন্ধ্যের অনুষ্ঠানে এক মহিলা আমার নানান খোঁজখবর নিচ্ছিলো।কেন যে এতো কথা জিজ্ঞেস করলো বুঝতে পারলাম না!”
-“তুই অবিবাহিত মেয়ে,লোকে প্রশ্ন করতেই পারে!”
পৌষী কিছু একটা বলতে যাবে তখনি দরোজায় টোকা পড়লো!সাহেদা উঠে দরোজা খুলল। দেখলো রানী এসেছে,ওর পেছনে রাহেলা দুটো বাটি হাতে দাঁড়িয়ে আছে!সাহেদা অবাক হলো-“এসব কি ভাবি?”
-“আরে পৌষী আর তোমার জন্য রসমালাই আর রাবড়ী।ঘুমুতে যাচ্ছো?”
-“হ্যাঁ,তা তুমি আবার এসব আনতে গেলে কেন?কাল সবার সাথেই খাওয়া যেতো!”
-“না,এখনি পৌষিকেও দাও,নিজেও খাও,তোমার ভাই এখনি না দিলে আবার রাগারাগি করবে! ইয়ে…. সাহেদা তোমার সাথে একটা কথা ছিলো!”
-“বলো…ভাবী!”
-“এখানে না…বাইরে এসো!”
সাহেদা একটু বিভ্রান্ত হলেন,এতো রাতে আবার কি হলো!তার আজকাল অল্পতেই ভয় লাগে।একটা উঠতি বয়সের মেয়েকে নিয়ে অভিভাবকহীন মায়ের যে কি চিন্তা তা ভুক্তভোগী ছাড়া কেউ বুঝবেনা!সাহেদা পৌষীকে শুয়ে পড়তে বলে রানির পিছু পিছু ড্রইংরুমে এলেন!রানী বলল-“বসো সাহেদা!”
রানীর এতো অমায়িক আচরনে সাহেদা মনে মনে চিন্তিত হলো!হঠাৎ কি এমন হলো যে রানী তাকে সমীহ করে কথা বলছে?
-“কি হয়েছে ভাবী? কোনো সমস্যা?”
-“সমস্যা কিছু না,আমাদের ইরার হবু শ্বশুড়ের ছোটভাই নিয়াজউদ্দিনের কথা তো শুনেছো!তার একমাত্র ছেলে ইসতিয়াক হলো সচিবালয়ের বড় অফিসার!ওর মা তোমার পৌষীকে কোন ফাঁকে যেন দেখেছে।দেখে ওর মামীকে দিয়ে তোমাদের খোঁজখবর নিয়েছে!মনে হয় বিয়ের সমন্ধ পাঠাবে!ওর মামী তো তাই বললো! তোমার মেয়ের তো রাজকপাল,এমন অবস্থায় এমন পরিবার থেকে সমন্ধ এসেছে!তোমার আর কি!মেয়ে কোটিপতির ঘরে যাবে..!এখন ওরা যদি পৌষীকে দেখতে আসতে চায় তখন কি করবে আগে থেকেই ভেবে রাখো!”
সাহেদার বুকে আনন্দের তুফান উঠতে গিয়েও তা বিলীন হয়ে গেলো।একটু আগেই পৌষী বলেছে সে দ্বীনদার পাত্র চায়!সাহেদা বিরাট সমস্যার মধ্যে পড়ে গেলেন!রানী আবার বললেন-
-“কি ভাবছো এতো!ছেলের মায়ের নাকি খুবই আগ্রহ।ছেলেকে আমাদের পৌষীর ছবি দেখিয়েছে,সে তো রাজী।এখন বড় ঘাটে নৌকা বাঁধতে গেলে তোমাকেও তো মোটা দড়ির যোগান দিতে হবে।কি বলছি,বুঝতে পারছো তো?”
সাহেদা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন-“ভাবী,আমার মেয়ে তো দ্বীনদার ছেলে ছাড়া নাকি বিয়ে করবেনা!এই প্রস্তাবে কি ও রাজী হবে?”
রানী চোখ কপালে তুলে বলল-“তুমি কি পাগল না ছাগল?তোমার মেয়ে একেবারে কোথাকার অলি আউলিয়া যে দ্বীনদার চেয়ে ঠেঁটিয়ে বসে থাকবে?তোমার সাত কপালের ভাগ্য যে তোমার মেয়ের জন্য এমন পরিবার থেকে প্রস্তাব এসেছে।মেয়ে বললো আর তুমিও ওর কথায় নাচা শুরু করে দিলে!কেন আমরা কি ইসলাম জানিনা? সব বিধান তোমার মেয়েই জানে নাকি…যত্তসব…!ওর কথা ছাড়ো! ছেলে পক্ষ আগ্রহ করলে নিজের যা আছে বেচে টেচে মেয়ে পার করো!তোমার আর কি,এ বাড়ীতে তোমার দিন একরকম কেটেই যাবে!আমরাতো আর তোমাকে ফেলে দিচ্ছিনা!আরে মেয়ের হাতে ক্ষমতা যখন আসবে সে তখন তোমাকে নিজের কাছে নিয়ে রাখতে পারবে!তোমার তো পাঁচ আঙ্গুল ঘিয়ে।তোমার এসব ছন্নছাড়া কথা আর কাউকে বলোনা,মানুষ তোমাকে পাগল ভাববে নতুবা মনে করবে তোমার মেয়ের অন্য কোথাও লাইনজাইন আছে! বুঝেছো?”
সাহেদা পুরোপুরি দমে গেলেন।রাণীর কথাবার্তার ধরন তার ভালো না লাগলেও কিছু বলার নেই।সে খুব একটা মিথ্যে তো বলেনি!
সাহেদা উঠে দাঁড়িয়ে বলল-“ভাবী আমি পৌষীর সাথে কথা বলি আগে!বাপ মরা মেয়ে আমার।ওর ইচ্ছের বিরুদ্ধে আমি ওকে চাপ দিতে চাইনা!আমি জানি আপনি ওর ভালো চান।কিন্তু মেয়েটারও তো একটা মতামত আছে!”
-“না…ঠিকআছে!তুমি ওকে বোঝাও।তোমাদের এখন যে অবস্থা!মাথা কুটলেও এমন রিস্তা পাবেনা।এটা তোমার মেয়ের সৌভাগ্য!সে তার নামাজ রোজা করবে কে মানা করেছে?আমরা করিনা?যত্তসব ঢং?এখন মেয়ের কথা শুনতে গেলে পরে পস্তাবে এই বলে দিলাম !”
সাহেদা দ্রুত নিজের ঘরে চলে এলেন!পৌষী বসেই ছিলো!
সে জিজ্ঞেস করলো-“,কি হয়েছে মা? কোনো সমস্যা? তোমার চেহারা এমন চিন্তিত দেখাচ্ছে কেন?”
সাহেদা মেয়ের পাশে বসে ওর হাত ধরে বললেন-“তোকে একটা কথা বলবো….রাখবি?”
পৌষী মায়ের দিকে কিছুটা অবাক হয়েই তাকালো-“কি কথা মা?”
-“তোর একটা বিয়ের প্রস্তাব এসেছে ইরার শ্বশুড়বাড়ীর দিক থেকে।ওরা হয়তো দু একদিনের মধ্যে তোকে দেখতে আসতে পারে।তুই কিন্তু মানা করিস না মা!”
-“ছেলে কি ধার্মিক মাইন্ডের? কি করে সে?”
সাহেদা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন-“অতোটা জানিনা।আগে হোকে দেখে যাক।পরে তোর মামীকে জিজ্ঞেস করবো এসব ব্যপারে!”সাহেদার খারাপ লাগছিলো মেয়েকে এভাবে ডাহা মিথ্যা কথা বলতে।কিন্তু কি করবে সে?পাত্র পক্ষ আগে দেখে যাক্,পরে পৌষীকে বুঝিয়ে রাজী করানো যাবে।নইলে এখন সে সামনে যেতেই রাজী হবেনা।
রাজ রাতে কিছুই খেলোনা!
নিজের ঘরে ঢুকে অযথাই পায়ের জুতাটা সোফার নিচে ছুঁড়ে মারলো।পাঞ্জাবীট
া একটানে খুলে বেডের ওপর ছুড়ে ফেলে শুধু পাজামা পড়ে বিছানার ওপর বসে রইল!ডান হাতটা ডান হাঁটুর উপর রেখে বারবার মুঠি খুলতে আর লাগাতে লাগলো ব্যায়াম করার মতো করে।ওর চেহারায় রাগ স্পষ্ট যেন যাকেই সামনে পাবে তাকেই চিবিয়ে খাবে!
এমন সময় ওদের পুরোনো কাজের লোক সাবুমিয়া ঘরে ঢুকলো-“ভাই,খাইবেন না?আম্মায় আপনেরে ডাকতেছে!”
রাজ কটমটিয়ে তাকালো-“আমি কিছু খাবোনা,যাও এখান থেকে!”
সাবুমিয়া কথা না বাড়িয়ে মানে মানে কেটে পড়লো!
রাজ দুহাতে চুলে আঙ্গুল চালিয়ে হাতগুলোকে হাঁটুর উপর রেখে গভীর ভাবনায় ডুব দিলো!আপনমনেই মাথা নাড়লো!যেভাবেই হোক,এই ইসতিয়াকের ভেজালটা বাড়ার আগেই শেষ করতে হবে!শালা বাড়ী ভর্তি মেয়ে আর ইসতিয়াকের মায়ের চোখ গিয়ে পড়লো পৌষীর উপর?ছেলেও একলাফে রাজী।শালার চোখ গেলে দেয়া উচিত।রাগে গা কিড়মিড় করছে রাজের।
তারপর কি মনে হতে হাতের কাছে সিডিটা অন করলো।
হাইবিটে ধুমধাড়াক্কা বাজনা শুরু হলো!রাজ দ্রুত সেটা বন্ধ করে দিয়ে সিডি বদলে কিশোর কুমারের সিডি প্লে করলো।কিশোর কুমার তার ভরাট গমগমে সুরে গেয়ে উঠলো-
“হামে তুমসে প্যায়ার কিতনা ইয়ে হাম নাহি জানতে…..!
মাগার জী নাহি সাকতে..তুমহারে বিনা…!”
…..
পৌষী দু হাতে কান চেপে উঠে বসলো!সাহেদা তাকালেন-“কি রে কি হলো?”
-“ঐ যে তোমার বেআদব ভাতিজার শুরু হয়েছে…ফালতু একটা ছেলে!গানবাজনা ছাড়া থাকতে পারেনা!এমন কেন সে?”
-“ছিঃমা, এভাবে বলিস না।ওর ভেতর ইসলামের জ্ঞান নেই বলেই তো ও এসবে আনন্দ খুঁজে পায়!ওকে সেই আদব দিয়ে তো বড় করা হয়নি,ছোটবেলা থেকে এই পরিবেশেই বড় হয়েছে,এসবেই সে অভ্যস্ত!”
পৌষী বিষম বিরক্ত হয়ে ঘুমাতে চেষ্টা করলো!কিন্তু কানের মধ্যে গানটা আপনা হতেই চলে যাচ্ছে…কি অদ্ভুত কথাগুলো!
পৌষী ভাবতে চেষ্টা করলো, অর্থ কি এই কথার?নাকি মিনিংলেস চেঁচামেচি? ওর মনে পড়লো,আমাদের রাসুল সাঃ বাঁশীর শব্দ শুনলেও কান চেপেছিলেন!
পৌষী দুহাতে কান চেপে শুতে চেষ্টা করলো।ওদিকে সাহেদার ঘুম উরে গেছে মেয়ের চিন্তায়!পৌষি সাফ মানা করে দিয়েছে এই প্রস্তাবে সে রাজী নয়।সাহেদা এতক্ষণ ওকে বোঝাচ্ছিলেন কিন্তু পৌষী কেঁদেকেঁটে একসা।সে কিছুতেই টাখনুর নিচে প্যান্ট পড়া দাঁড়িবিহীন মেয়েলী পুরুষ বিয়ে করবেনা।তার জন্য যদি আজীবন কুমারী থাকা লাগে তো থাকবে!
নিজের মেয়ের জেদ আর তার ভাইবৌয়ের কড়াকথার মাঝে সাহেদার অবস্থা শিলনোড়া(পাটাপুতা)র মাঝে পেষা মসলার মতো হয়েছে!
……
……
“হামে ইন্তেজার কিতনা ইয়ে হাম নাহি জানতে….
মাগার জী নাহি সাকতে তুমহারে….”
…খট করে গানটা বন্ধ হয়ে গেলে রাজ চোখের উপর থেকে হাত সরালো!সে চিৎ হয়ে শুয়ে শুয়ে গানটা শুনছিলো।হাত সরিয়ে তাকালো,দেখলো মা নিজেই এসেছে। তার পাশে সাবুমিয়ার হাতে ট্রে!রাজ বিরক্ত হয়ে উঠে বসলো-“আমি বললাম না খাবোনা!এসব নিয়ে যাও আর লাইটটা অফ করে সিডিটা প্লে করে দিয়ে যাও!”
রানী ছেলের পাশে বসে মাথায় হাত রাখলেন-
-“আমার বাবাটার মন এতো খারাপ কেন? রাগ করেছিস আমার উপর?”
-“আরে…..মা তোমার উপর রাগ করবো কেন?”
-“তাহলে? কি হয়েছে তোর? আর আজ তোর কোনো বান্ধবীকেও তো পার্টিতে দেখলাম না!ওদের বলিসনি?সিঁথি তো তোর বেষ্ট ফ্রেন্ড!ওকে তো বলতে পারতি..?”বলে রানী সাবুকে ট্রে রেখে চলে যেতে ইশারা করলেন!সাবু চলে গেলো।
রাজ উঠে বসে বিমর্ষ মুখে বলল-“না…ওদের সাথে ওঠাবসা এখন কমিয়ে দিয়েছি।”
-“কেন রে?ঝগড়া হয়েছে কারো সাথে?”
-“আরে না…মেয়েদের সাথে চলাফেরাটা সবাই ভালো চোখে দেখেনা।তাছাড়া এটা নাকি অনেক বড় গুনাহের কারন।আচ্ছা মা,তুমি কখনো আমাকে এসব শেখাওনি কেন? বরং মেয়েদের সাথে চলতে উৎসাহ দিয়েছো!কেন বলোতো?”
রানী ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বললেন-“কি সব আজগুবি কথা শুরু করলি হঠাৎ? কি হয়েছে তোর?
রাজ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল-“যারা এসব মানেনা,গুনাহ মনে করে তাদের চোখে নিশ্চয়ই আমি অনেক গুনাহগার,তাই না?”
*”তোর আজ কি হলো বলতো? কেউ কিছু বলেছে? আমাদের এত কাউকে তোয়াক্কা করার কিছু নেই!যার কাছে তোর এসব ভালো না লাগবে সে দুরে গিয়ে মরুক।আমার ছেলেকে কষ্ট দেবার অধিকার কারো নেই!”
রাজ হতাশ চোখে সামনের দিকে তাকিয়ে ভাবছে…আজ না হোক কাল..!কেউ না কেউ পৌষীকে একদিন ওর চোখের সামনে দিয়ে উড়িয়ে নিয়ে যাবে!কি করে সহ্য করবে রাজ?পৌষী কি কোনোদিন ওকে নিজের করে নিতে আগ্রহী হবে?সে তো কথাটুকু পর্যন্ত বলতে চায়না।
ভাবনার এ পর্যায়ে রানী কাস্টার্ডের বাটি হাতে তুলে নিয়ে বললেন-“আরে এসব রাখ,তোকে আরেকটা ভালো খবর দেই।তোর সাহেদা ফুপ্পির দুঃখ এবার দুর হতে চললো!আমাদের ইরার দেবরকে চিনিসনা? ঐ যে ইসতিয়াক!ওর মা আমাদের পৌষীকে বিয়ের প্রস্তাব করবে মনে হয়! ওর মামী আমাকে ডেকে বলেছে!”
রাজের বুকে ড্রাম বাজা শুরু হলো!আতঙ্কিত চোখে মায়ের দিকে চেয়ে বলল-“ফুপি কি শুনেছে এসব কথা ?”
-“হ্যাঁ…শুনেছে!একটু আগে আমিইতো সব বললাম!”
-“,সে কি বললো? নিশ্চয়ই রাজী?”
ঠান্ডা স্বরে বলে চলল রাজ!তারপর দুচোখ বন্ধ করলো কারন চোখ গুলো জালা করছে ওর!কিন্তু মায়ের কথায় হ্রৎপিন্ডটা লাফিয়ে উঠল!
-“আরে তোর ফুপুটা যেমন বোকা মেয়েটা তারচে বড় বোকা!বলে কিনা দ্বীনদার ছেলে ছাড়া বিয়ে করবেনা!পৌষী রাজী হবেনা! বুঝে দেখ এবার কেমন বোকা মা মেয়ে এরা? এসব প্রস্তাব কেউ হাতছাড়া করে?”
রাজ শান্ত স্বরে বললো-“কারো উপর সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেয়া ঠিক না মা!ফুপি যখন বলেছে ভেবে চিন্তেই বলেছে!পৌষীর মতামত না নিয়ে সে তো এখানে মত দিতে পারবেনা!দেয়া উচিতও না।তাছাড়া ইসতিয়াকের সাথে পৌষীকে একদম মানাবেনা!”
-“কেন মানাবে না,লম্বা ফর্সা ছেলে,ভালো চাকরী করে,ফার্ষ্ট ক্লাস গেজেটেড অফিসার….পৌষীর তো সৌভাগ্য!”
ছেলের হাতে কাস্টার্ডের বাটি ধরিয়ে দিয়ে বললেন-“নে এটা অন্তত খা!”
রাজ কাস্টার্ড নাড়তে নাড়তে বলল-“আমার মনে হয় ইসতিয়াকের ব্যাপারে আরেকটু খোঁজখবর করা উচিত।আজকাল ছেলেদের ভেতরে কত রকম সমস্যা!ওর বাবা নেই বলে আমরা কি খোঁজ না নিয়েই মেয়েটাকে গছিয়ে দেবো নাকি?”
-“এসব ঝামেলা কে করবে?খোঁজটোজ নেবে কে?”
-“কেন..আমি?”(রাজ কাস্টার্ড খেতে খেতে স্বাভাবিক সুরে বলল)!
-“তুই…?”
-“হমমম….!কেন অসম্ভব কিছু তো না।তাছাড়া ফুপি তার মেয়েটাকে নিয়ে আমাদের কাষ্টডিতে আছে।আমরা কিভাবে পৌষীকে যার তার হাতে ছেড়ে দিতে পারি?”
রানী কোনো কথা বললেন না।ছেলের দিকে তাকিয়ে রইলেন।রাজ কাষ্টার্ডের বাটি ফিরিয়ে দিয়ে বললো-
-“তুমি একটু পৌষীকে দিয়ে কাল আমার সেলফটা গুছিয়ে দেবার ব্যবস্থা করো তো!কিছু বই খুঁজে পাচ্ছিনা!উনি আমার সেল্ফটা যেন গুছিয়ে দেয়!”
-“আচ্ছা….বলবোনে।নে এবার ফ্রেশ হয়ে শুয়ে পড়।রাত জাগিস না!”
পরদিন বাইরে চলে রাজ চলে যাবার পরে পৌষী রাজের সেলফ খেকে বইগুলো সব নামালো!রাহেলা ওকে সাহায্য করছিলো! পৌষী যথাসম্ভব দ্রুততার সাথে কাজ করার চেষ্টা করছিলো কিন্তু কাজ শেষ করার আগেই রাজ রুমে এসে ঢুকলো!
পৌষী ওকে দেখেই ওড়না টেনে রাজস্থানী মেয়েদের মতো নিজেকে পুরো ঢেকে ফেললো!ও বুঝতে পারেনি,রাজ এত তাড়াতাড়ি এসে হাজির হবে।ও তো বলতেও পারছেনা যে আপনি বাইরে যান।
রাজ পেছন থেকে মৃদু শব্দে বলল-“স্যরি,আপনাকে বিরক্ত করতে চাইনি,আপনার কষ্ট হচ্ছে নিশ্চয়ই। আমি আপনাকে সাহায্য করি?”
পৌষী দ্রুত হাত বইগুলো তাকে তুলে রাখছিলো! রাহেলা বোকার মতো একবার রাজের দিকে আরেকবার পৌষীর দিকে তাকাতে লাগলো!
রাজ আবারো বলল-“আপনি কি বিরক্ত হচ্ছেন আমার উপর?”
পৌষী শেষ বইটা রেখে ত্রস্তপায়ে বেরিয়ে যেতে যেতে বলল-“না…না…আমার কাজ শেষ।”বলে পৌষী বেরিয়ে গেলো!
রাজ দীর্ঘশ্বাস ফেলে অসহায়ের মতো সেদিকে তাকিয়ে রইলো!
……
চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here