সে_আমারঃ (আপডেট) শেষ পর্বঃ ২৭

সে_আমারঃ (আপডেট)
শেষ পর্বঃ
মোর্শেদা হাবিবঃ
*****************
“ঠিকানাটা আবার বল্!”
নীরা ঠিকানা বললো।তারপর কাঁপা স্বরে বলল-
-“ভাইয়া,আস্তে চালাও!একসিডেন্ট হতে পারে!আজ তোমার বিয়ে!”
অসহায়ের মতো বসে আছে নীরা।
রাজ কোনো কথা না বলে এঁকে বেঁকে ওভারটেক করে ড্রাইভ করতে লাগলো।

নীরা কিছুক্ষণ সামনের দিকে তাকিয়ে কাঁদো কাঁদো কন্ঠে বললো-“ভাইয়া,আ’ম স্যরি ভাইয়া।তুমি হঠাৎ এতো রেগে গেলে কেন?ওনাকে ফোন করার সময়ওতো এতো রেগে ছিলেনা! হঠাৎ কি হলো তোমার!”

রাজ গাড়ী বাম দিকে টার্ণ নিয়ে বললো-“তুই ওকে বলবিনা যে,আমি এসেছি।তুই একা যাবি ভেতরে!”
রাজ এমনভাবে কথা বলছে যেন নীরার কোনো কথাই ওর কানে যায়নি।
নীরা ভীরু দৃষ্টিতে ভাইয়ের তাকিয়ে দেখলো রাজের কপালের শিরাগুলো ফুলে আছে।নীরা বললো-
-“কাউকে কিছু বলা লাগবেনা ভাইয়া,কোনো দাওয়াত দেবার দরকার নেই।আমারই ভুল হয়েছে, চলো বাড়ী ফিরি,ভাইয়া….প্লিজ।আমাদের দেরী হয়ে যাবে!”

রাজ সেকথায় কান না দিয়ে সামনের রিক্সাকে পাশ কাটিয়ে বললো-
-“তোকে যা বলেছি,তুই সেভাবেই করবি!”
বলতে বলতেই রাজের বুক পকেটের মোবাইলটা বেজে উঠলো!
রাজ একহাত দিয়ে সেটা রিসিভ করলো-
-“হ্যাঁ,বল্ ফিন….না,আমি একটু বাইরে আছি…..না,ওসব কিছু না।অন্য একটা কাজ!” বলেই রাজের মনে হলো ফিনকে ব্যপারটা জানানো দরকার।মারুফ সেখানে কি খেলা পেতে আছে কে জানে!
সে বললো-“ফিন এক মিনিট।তুই কি একটু আসতে পারবি?আমতলা মোড়,মারুফদের পুরোনো বাসাটায়।ইটস আর্জেন্ট….হ্যাঁ..হ্যাঁ…রাইট। তুই একটু আয় দোস্ত।এ্যাজ সুন এ্যাজ পসিবল….আই নিড ইউ!বাই!”
“এখনই জয়েন করুন আমাদের গল্প পোকা ডট কম ফেসবুক গ্রুপে।
আর নিজের লেখা গল্প- কবিতা -পোস্ট করে অথবা অন্যের লেখা পড়ে গঠনমূলক সমালোচনা করে প্রতি সাপ্তাহে জিতে নিন বই সামগ্রী উপহার।
আমাদের গল্প পোকা ডট কম ফেসবুক গ্রুপে জয়েন করার জন্য এখানে ক্লিক করুন



ফোন রাখতেই নীরা বললো-“মারুফ কে?”
রাজ একবার বোনের দিকে তাকিয়ে বললো-“যে তোর ভাবীর ছবি আম্মুকে পাঠিয়েছিলো!”
নীরা মনে মনে আঁতকে উঠলো।
এই সজীব কি তাহলে সেই মারুফ! তাহলে ওর নাম সজীব বললো কেন!আর বিদেশ থেকে এসেছে একথাই বা বললো কেন?
নীরা আকাশ পাতাল ভেবে কোনো কুল কিনারা পেলোনা।সজীব ওর সাথে এমন করতে পারেনা।নীরার কান্না পাচ্ছে।
রাজ আর কোনো কথা বললোনা।
সে আধাঘন্টার পথ বাইশ মিনিটে অতিক্রম করলো।

গাড়ীটা গন্তব্য থেকেও কয়েক গজ দুরে দাঁড় করালো রাজ।নেমেই ঘড়ি দেখলো।তবে গাড়ী থেকে নামলো না।এমন সময় নীরার মোবাইলে বেজে উঠতেই ও ভীষন চমকে গিয়ে রাজের দিকে তাকালো।
রাজ স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে অপেক্ষাকৃত শান্ত স্বরে বললো-
-“ফোন রিসিভ কর্।করে বল্,আমি আসছি,পথে আছি।”
নীরা দ্বিধাগ্রস্তের মতো একবার মোবাইল আরেকবার রাজের দিকে তাকালো।রাজ চোখ দুটো কুঁচকে সামনের দিকে তাকিয়ে আছে।নীরার মোবাইল বাজতে লাগলো।রাজ চাবুকের মতো শপাং করে গর্জে উঠলো-“ধরিস না কেন?যেভাবে বলেছি সেভাবে বল!”
নীরা কাঁপা হাতে ফোন রিসিভ করতেই মারুফ বলে উঠলো-
-“কি ব্যপার নীরুমনি! কোথায় তুমি?আসবে না? ”
নীরা এক সেকেন্ড দম নিয়ে বললো-“আ..আমি আসছি।পথে আছি!”
-“ওহ্ ফাইন…জানু!তুমি আসছো তাহলে! প্লিজ কাম!তখন যেভাবে ফোন কেটে দিলে, ভেবেছিলাম কোনো সমস্যা হলো কি না…নাকি আসবেই না।বাসা চিনতে কোনো সমস্যাই হবে না।একদম সোজা আমতলা মোড়ে এলেই দেখবে একটা ফার্মেসী! নাম জনতা ফার্মেসী।ওটার দোতলায়! ঠিকআছে?লাভ ইউ বেবী!”

নীরা কান থেকে ফোন নামিয়ে রাজের দিকে তাকালো।
রাজ ইশারা করলো কল কাটতে!নীরা শুকনো মুখে বললো-“কেটেছি!”
-“কি বললো?”
-“ওদের বাড়ী জনতা ফার্মেসীর দোতলায়!”
-“আমি চিনি!এটা ওদের পুরোনো বাসা।এখানে কেউ থাকে না।ভাড়া দিয়েছে!”
গম্ভীর থমথমে মুখে বললো রাজ।
নীরা বোকার মতো চেয়ে রইলো।
রাজ আবার ঘড়ি দেখলো।
মিনিট দশেকের মাথায় রাজের ফোন বাজলে সে ফোন রিসিভ করে গাড়ী থেকে বেরুলো।পেছনের দিকে গেলো।
তারপর কয়েক মিনিট পর ফিনসহ এসে গাড়ীতে উঁকি দিয়ে নীরাকে বললো-“বেরিয়ে আয়!”
নীরা মলিন মুখে বেরিয়ে এলো।চোরাচোখে একবার ফিনের দিকে তাকিয়েই চোখ সরিয়ে নিলো।ফিন রাজের কানে কানে কিছু একটা বললো।
রাজ মাথা নেড়ে নীরাকে বললো
-“যা,ভেতরে ঢোক্!”
নীরা কোনো উচ্চবাচ্য করলোনা।হেঁটে ওরা দোতলায় উঠলো।
রাজ নীরাকে মারুফদের ফ্ল্যাটের গেটের সামনে দাঁড় করিয়ে নিজে এককোণায় সরে দাঁড়ালো!সে নীরাকে বারবার বুঝিয়ে বলেছে কি করতে হবে।রাজ নীরার মোবাইলে কল দিয়ে সেটা না কেটে হোল্ড করে রেখেছে যেন ভেতরের সব কথা রাজ বাইরে দাঁড়িয়েও শুনতে পায়।দুবার বেল বাজতেই গেট খুলে গেলে রাজ দেয়ালের দিকে মুখ করে চট করে সরে গেলো!

নীরা কিছু বলার আগেই মারুফ হাত বাড়ীয়ে নীরাকে টেনে নিয়ে বাইরে এক ঝলক উঁকি মেরে চারিদিক দেখে গেট আঁটকে দিলো।
রাজ আগুন গরম চোখে সেদিকে তাকিয়ে রইলো।তারপর ফোনটা হাতে নিয়ে গেটের সামনে এসে দাঁড়ালো।ফোনটা কানে ঠেকিয়ে রেখেছে রাজ।
একটু পর ফিন আর ওর কাজিন জাহিদকে উঠতে দেখা গেলো সিঁড়িতে।রাজ ঠোঁটের উপর আঙ্গুল রেখে ওদের সতর্ক করলো।মোবাইলে কান পেতে মনোযোগ দিয়ে শোনার চেষ্টা করলো ভেতরের কথাগুলো।ভেতরে ক’জন আছে সে সম্পর্কে কোনো ধারনা নেই রাজের তাই ওকে একটু সাবধানতা অবলম্বন করতে হচ্ছে।

মারুফ নীরার হাত ধরে ভেতরের ঘরে নিয়ে বসালো।নীরা অবাক হয়ে লক্ষ্য করলো এখানে তেমন কোনো আসবাব নেই।রুমের দুপাশে দুটো চৌকী আর দুটো পড়ার টেবিল।একটা চৌকীর উপর আবার মশারী ঝুলছে।অবস্থাদৃষ্টে নীরার মনে হলো এটাতে সজীবের বোন কি করে থাকতে পারে।এটা তো দেখতে একটা মেসের মতো!সম্ভবত এখানে দুজন ছাত্র থাকে।
মারুফ নীরার হাত ধরেই রেখেছে।সেভাবেই বললো-“চা… ঠান্ডা কি খাবে বলো!
-“কিছুনা,আপনার আপা কোথায়?এখানে তো তিনি থাকেন বলে মনে হচ্ছে না!”

মারুফ মিষ্টি একটা হাসি দেবার চেষ্টা করলো-“তুমি ঠিক ধরেছো,আপা এখানে থাকে না।এটাতে মেস ভাড়া দেয়া হয়েছে।তুমি একটু আরাম করে বসো। আপাকে ফোন দিয়েছি,সে আসবে!”
-“আপনার আপা এখানে আসবে?”
নীরার মাথা কাজ করছে না।ওকেই যেখানে আপার বাসায় নেবার কথা সেখানে আপা এখানে আসবে কেন!তাছাড়া ঘরটার মধ্যে কোনো আভিজাত্যের ছাপ নেই।বরং নোংরা স্যাঁতসেতে একটা ভাব রয়েছে।একটা গন্ধও পাওয়া যাচ্ছে।অনেক দিন রুম বন্ধ করে রাখলে এমন গন্ধ পাওয়া যায়।নীরার অস্বস্তিবোধ হতে লাগলো।সজীব ওকে এমন বাড়ীতে ডেকে আনালো কেন?তাহলে কি সে মিথ্যা বলে ওকে আনিয়েছে?”
এবার নীরার হঠাৎ একটু ভয় ভয় হতে লাগলো।
মারুফ একটা ফানটা নিয়ে গ্লাসে ঢাললো।
-“এই নাও!”
-“আমি কিছু খাবো না, আমার এখানে ভালো লাগছেনা।আমি এখন যাবো!”
-“আরে যাবেই তো!আমি তোমাকে এগিয়ে দিয়ে আসবো।ততক্ষণে একটু গলাটা ভিজিয়ে নাও।আপার সাথে দেখা করবেনা।তাহলে দাওয়াত দেবে কাকে?আমি তো তোমার দাওয়াত পেয়েই গেছি!”

নীরা সংকুচিত হয়ে বসে রইলো।হঠাৎ মনে পড়লো,মোবাইল হোল্ড করা।রাজ ওদের কথা শুনছে।নীরার বুকের ভেতর কিছুটা সাহস তৈরী হলো।
মারুফ গ্লাস বাড়িয়ে ধরে ওর দিকে তাকিয়ে আছে।ওর দৃষ্টিটাও আজ নীরার কাছে ভালো লাগছেনা।মারুফ বারবার বিশ্রীভাবে ওর ওড়নার দিকে তাকাচ্ছে!
নীরা অস্বস্তিতে নড়েচড়ে বসলো!মারুফ কিছুটা ধমকের সুরে বললো-
-“কই,খাচ্ছো না কেন?”
নীরা গ্লাসটা হাতে নিলো।সেটাকে রাখার জন্য আশেপাশে তাকিয়ে দেখলো টেবিলটা আরেকটু দুরে।নীরা গ্লাসটা সেখানে রাখতে গেলে মারুফ ওর হাত চেপে ধরলো।
-“আরে রাখছো কেন?খাও….!”মারুফের কন্ঠটা যেন আদেশের মতো শোনালো।

নীরা কিছু একটা বলতে গেলে মারুফ আবার ধমকালো -“অন্তত একটা চুমুক দাও আগে।”
-“আপনি আমাকে এটা খাওয়ানোর জন্য এতো অস্থির হয়ে আছেন কেন!আমি ফানটা খাইনা!”এবার নীরার গলা সবল হলো।
মারুফ নীরার দিকে তাকিয়ে হাসলো-
-‘”আজকে খাও,আর হাত থেকে মোবাইল রাখো তো!”বলে সে ছোঁ মেরে মোবাইলটা নিয়ে একপাশের চৌকীর উপর ছুঁড়ে দিলো!কাজটা এতো দ্রুত ঘটলো যে,নীরা বাধা দেবার আগেই মোবাইলটা ওর হাতছাড়া হয়ে গেলো।এবার ওর সত্যিকারের ভয় হতে লাগলো।লাইনটা কেটে গেলো না তো!ভাইয়া সব শুনছে তো…!
মারুফের চেহারায় আগের সেই ভদ্রভাবটা এখন নেই।সে হঠাৎ নীরার মুখের সামনে গ্লাসটা ঠেলে দিয়ে বলছে -“নাও….খাও,এটা!”
-“না,আমি খাবো না!একবার বলেছি না,ফানটা খাইনা!”
-“তুই খাবিনা তর বাপে শুদ্দা খাইবো।খা হারামজাদী….ভালো মুখে কইতাছি ভাল্লাগতাছেনা, না? কানের নিচে দিমু,তখন ঠিকই খাবি!”মারুফ এবার স্বরূপ ধারন করলো!

ভয়ে আতঙ্কে নীরার পেট সেঁধিয়ে যাবার যোগাড় হলো।সে কেঁদে ফেলে বললো-“আপনি আমার সাথে এভাবে কথা বলছেন কেন?”
-“একটু পরে আরো সোহাগ কইরা কমু নে।এহন গিল আগে।মেজাজটা খারাপ করিসনা, দেরী কিন্তু হইতাছে!”
নীরা এবার জোরে কেঁদে উঠলো-“ভাইয়াআআ….!”
মারুফ এক ধমক দিয়ে চিৎকার করে পাশের রুম থেকে কাউকে ডাকলো-“অই,বাবুল এদিকে আয় তো,শালীরে জোর কইরা খাওয়াইতে হইবো!”
নীরার ভয়ের চোটে অজ্ঞান হবার দশা।বাবুল নামের লোকটা এলো,তার হাতে ভিডিও ক্যামেরা।

একপলকে দেখে যা বোঝার বুঝে নিলো নীরা।মারুফ নীরার গাল চেপে ধরে ওর মুখে গ্লাসটা ধরার আগেই মনে হলো বাড়ীর উপর বাজ পড়েছে।প্রচন্ড শব্দ হলো মেইন গেটে।বাবুল দ্রুত ঘর থেকে বেরিয়ে উঁকি দিতে গিয়েই প্রচন্ড জোরে লাথির আঘাত খেয়ে মুখ থুবড়ে পড়লো।ওর হাত থেকে ক্যামেরা দুরে ছিটকে পড়লো।মারুফ একলাফে বেরিয়ে যাবার পাঁয়তারা করতেই চোয়াল বরাবর মুগরের বাড়ী খেলো।সাথে সাথে ঠোঁটের কোনায় রক্ত দেখা গেলো,থু করতেই দাঁতের ভাঙ্গা টুকরা থুতুর সাথে বেরিয়ে এলো।সামলে ওঠার আগেই আরেকটা।
বাবুল নিজেকে সামলে নিয়ে পড়িমরি করে ওদের মারামারির একপাশ দিয়ে দৌড়ে বেরিয়ে গিয়ে মেইন দরজায় গিয়ে আটকা পড়লো।সেখানে দুজন লোক দাঁড়িয়ে আছে।
রাজ মারুফের কলার মুঠি করে ধরে হিসহিসিয়ে বললো-“তুই আসলেই মানুষের বাচ্চা না।তোর কত্ত বড় সাহস আমার বোনের দিকে চোখ দিস্!শু* বাচ্চা, তোর চোখ আমি গেলে দেবো।বাষ্টার্ড।”

ফিন বাবুলকে ধরে ঘরে ঢুকে বললো-রাজ…এই দুটোকে থানায় নিয়ে চল্।মশা মেরে হাত নষ্ট করিসনা।রাজিব এখানকার থানার সেকেন্ড অফিসার।ওর সাথে আমার কথা হয়েছে।এই নরকের কীটটা যেন বেরোতে না পার তার ব্যবস্থা করবো।এখানে কোনো ঝামেলা না।নীরা সাথে আছে তাই সিনক্রিয়েট করিসনা।জাহিদ তুই নীরাকে গাড়ীতে নিয়ে যা।

নীরা দুই হাতে মুখ চেপে কান্না করছিলো এককোণে বসে।জাহিদ ওকে ডাকলো-“চলুন,এখান থেকে দ্রুত বেরিয়ে পড়তে হবে।প্লিজ আসুন!”
নীরা একবার রাজের দিকে তাকালো।রাজ মাথা নাড়তেই নীরা জাহিদের সাথে বেরিয়ে গেলো।রাজ আচমকা প্রচন্ড জোরে চড় কষালো মারুফের গালো।চড় খেয়ে সে মুখ থুবড়ে পড়লো।

সবাই কনে আনতে যাবার জন্য তৈরী।আমজাদ সমানে রাজের মোবাইলে ফোন দিচ্ছেন কিন্তু রাজ ধরছেনা।তিনি চিন্তিত বোধ করলেন।রাজ গেলো কোথায় এখনো ফিরছেনা কেন।সাবু মিয়ার ভাষ্যানুযায়ী রাজ বিকেলে নীরাকে নিয়ে বেরিয়েছে।এদিকে রাত আটটা বাজতে চলেছে।কি হলো ওদের।কোনো এ্যাকসিডেন্ট করলো না তো!
রানী বার কয়েক স্বামীকে তাগাদা দিয়ে গেছেন।নীরা তাকে না বলে চলে যাওয়ায় তিনি বেশ রেগে আছেন ওর ওপর।
এমন সময় রাজের গাড়ী ঢুকতে দেখে আমজাদ মনে মনে স্বস্তি বোধ করলেন।রাজকে কিছুটা বিধ্বস্ত দেখাচ্ছে।

আমজাদ কি বুঝলেন, কে জানে।ছেলের কাঁধে হাত রেখে বললেন-“আগে তুই ফ্রেশ হ,পরে কথা হবে!”
রাজ নীরার দিকে তাকিয়ে বললো-“তুই তোর রুমে যা!”

বাড়ীতে অন্যান্য মেহমানদের দেখে রানী চেপে গেলেন।কেবল মেয়ের দিকে কড়া চোখে তাকাতেই নীরা মা’কে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলে বলরো-“স্যরি,মা।আর কখনো তোমার অবাধ্য হবো না!”
রানী নীরা আচরনে কিছুটা হকচকিয়ে গিয়ে বলল-“আচ্ছা,যা তাড়াতাড়ি তৈরী হ।তোর ছোট খালামনি কখন এসে নিচে বসে আছে।”

রাত নয়টা বেজে যাবার পর,ইরা বিরক্ত হয়ে একবার মা’কে ফোন দিচ্ছে একবার রাজকে আরেকবার ফিনকে।
এতো দেরীর কারন কি সে বুঝতে পারছেনা।পৌষী লাল টুকটুকে বৌ সেজে বসে আছে।সে ইচ্ছে করেই রাজকে কোনো ফোন দেয়নি।
অবশেষে রাত সাড়ে নয়টার দিকে বরযাত্রী এলো।সবাইকে প্রথমেই ঠান্ডা শরবত দিয়ে আপ্যায়ন করা হলো।
কাছের একটা রেষ্টুরেন্টেই খাবারের আয়োজন করা হয়েছে।আমজাদ রানী আর সাহেদাকে বললেন সবাইকে নিয়ে সেখানে চলে যেতে।ইরা নীরা সবাই পৌষীর সাথে বাড়ীতেই রইলো।এটা আগেই ঠিক করা হয়েছে,পৌষীকে ওয়ালিমার দিনও ষ্টেজে বসানো হবেনা।ওকে আলাদা একটা রুমে বসানো হবে কেবল মহিলারা সেখানে গিয়ে বউ দেখে আসবে।

মহিলাদের ভীড়ে রাজ এক ঝলক পৌষীর দেখা পেয়েছিলো।পরে ফিনের তাগাদায় আর ভেতরে বসা সম্ভব হয়নি।
খাওয়া দাওয়া সেরে বউ নিয়ে ফিরতে রাত প্রায় বারোটা বাজলো।
বউ নিয়ে ফিরেও রাজ পৌষীর আশেপাশে বসার সুযোগ পেলোনা কারন সারাক্ষণই পৌষীকে ঘিরে আছে কেউ না কেউ।ইরা আর মীরাতো পৌষীর সাথেই বসে আছে।নেহালের ডাকে একবার মীরা উঠে গিয়েও ফিরে এসে বসে পড়ে।নেহাল রাতে এখানে থাকতে চাচ্ছে না।মীরা জানালো সে আজ রাতে নতুন ভাবীর সাথে এখানেই থাকবে।
অগত্যা নেহালকে একাই চলে যেতে হলো।

রাত দুটো পর্যন্ত গল্প আড্ডা চললো।রাজও ওদের সাথে আড্ডায় যোগ দিলো।তবে নীরাকে অন্যান্য দিনের মতো হাসিখুশি উচ্ছল দেখাচ্ছে না।পৌষীর মনে হলো রাজকেও আজ বেশ অন্যমনস্ক দেখাচ্ছে।

রাত তিনটের পরপর যে যার মতো ঘুমাতে চলে গেলো।পৌষীর ঠাঁই হলো নীরার রুমে।
শুতে যাবার আগে পৌষী হাত মুখ ধুয়ে শাড়ী বদলে একটা সুতির শাড়ী পড়লো। চুল আঁচড়ানোর সময় দরোজায় টোকা পড়লো।পৌষীই দরজা খুললো।
রাজ দাঁড়িয়ে আছে।পৌষী কিছুটা লাজনম্র কন্ঠে বললো-“আপনি?”
-“নীরা কই?”
পৌষী খাটের দিকে তাকিয়ে বললো-
-“ও তো ঘুমুচ্ছে!”
-“একটু বাইরে আসবে প্লিজ!”
পৌষী চিরুনী রেখে চুল হাতখোপা করতে গেলে রাজ বাধা দিলো।
-“খোলাই থাক না,সুন্দর লাগছে!”
পৌষী দরজা টেনে রাজের সাথে বাইরে এসে দাঁড়ালো।রাজ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো-“এমন সুন্দর সময় অথচ উপোভোগ করতে পারছিনা!”
পৌষী রাজের কাঁধে হাত রাখলো-
-“গতকাল থেকেই লক্ষ্য করছি আপনি কেমন চুপচাপ হয়ে আছেন।কি হয়েছে বলুন তো!নীরাকেও দেখলাম কেমন মনমরা! কোনো সমস্যা?”
রাজ দীর্ঘশ্বাস ফেলে ধীরে ধীরে মারুফের ঘটনাটা সব খুলে বললো পৌষীকে।
পৌষী হতভম্ব হয়ে মুখের ওপর হাত রাখলো!
-“ইন্নালিল্লাহ…!কি ভয়ংকর!”
-“হমম…ব্যপারটা আসলেই ভয়ংকর হয়েছে।বলতে পারো আমি একটা ঝুঁকিই নিয়েছি।নীরাকে সাথে না নিলেও পারতাম কিংবা মারুফের সাথে ওকে একা ঘরে না পাঠালেও পারতাম কিন্তু নীরা ছেলেমানুষ।এ বয়সে মনে একবার একটা কিছু বসে গেলে সেটা দুর করা মুশকিল।মারুফকে শাস্তি দিতাম ঠিকই কিন্তু নীরার মনে মারুফ থেকে যেতো।সে মারুফের স্বরূপটা বুঝতে পারতো না।তাই ওকে কঠিন বাস্তবতাটার মুখোমুখি করালাম।কারন আমি চেয়েছি,নিজ চোখে ও মারুফের কুৎসিত রূপটা দেখুক!সেটা দেখেই ও বড় একটা ধাক্কা খেয়েছে। আশাকরি,এখন থেকে আর চট করে কারো প্রেমে পড়ে যাবেনা!ওদের বয়সটাই তো এমন!”
পৌষী দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো-“নীরার জন্য খারাপ লাগছে।বেচারী।ওর নিশ্চয়ই খুব ভয় লেগেছিলো!”

-“ওর কথা বলছো,ও যখন ভেতরে গিয়েছে আমার যে কেমন লেগেছিলো।এই দ্যাখো!”বলে নিজের ডান হাতটা উপুড় করে দেখালো।পৌষী দুহাতে রাজের হাতটা ধরলো।রাজের ডান হাতের উপরের একটা অংশ থেতলে গেছে।রক্ত চটচট করছে তাতে।পৌষী হঠাত সেখানে চুমু খেয়ে নিজের বুকের সাথে চেপে ধরলো হাতটা।ওর চোখে পানি!
-“ইস,কি করেছেন হাতটা!”
রাজ মুচকি হেসে বললো-“হাতটার কি সৌভাগ্য!”
পৌষী আরক্ত মুখে হাতটা ছেড়ে দিয়ে বললো-“সবসময় ফাজলামী!”
রাজ এবার পৌষীকে দুহাতে আগলে ধরে ওর কপালে চুমু খেয়ে বললো-“অনেক ভালোবাসি!”
পৌষী রাজের বুকে আলতো করে মাথা রেখে বললো-“আমিও…!”

সুন্দরভাবেই রাজের ওয়ালিমা সম্পন্ন হলো।রাজের ওয়ালিমাতে ফিনদের সপরিবারে দাওয়াত করা হয়েছে।ফিনের মা ইরাকে দেখে চট করে নিজের গলার চেইনটা খুলে ওর গলায় পড়িয়ে দিয়ে ইরার কপালে চুমু খেলেন।
রানীর হাত ধরে বললেন-“আপনার যদি আপত্তি না থাকে তো ওর ইদ্দতকালীন সময় শেষ হবার পরদিনই আমরা আকদ করিয়ে ফেলতে চাই।কি বলেন!
রানী হেসে ফেলে বললেন-“আল্লাহ ভরসা।”
বলেই ভাবলেন,তাকে পৌষীর অভ্যাস পেয়ে বসেছে।সবকিছুতেই এখন আল্লাহর উপর ভরসা করতে ভালো লাগে। নিজেকে নির্ভার মনে হয়।

রাজের ওয়ালিমা শেষে বিদায় নেবার আগে ফিন রাজের হাতে একটা খাম ধরিয়ে দিয়ে বললো-“নে,এটা আমার পক্ষ থেকে!”
-“কি, এটা?”
-“তোর জন্য হানিমুন ট্রিপ!”
রাজ হেসে ফেলে ফিনকে জড়িয়ে ধরে পিঠে চাপড় দিয়ে বললো-“যাজাকাল্লাহ!
ফিন বললো-“আচ্ছা,শোন্,মারুফকে কাল কোর্টে তোলা হবে।আমি চাচ্ছি ও কয়েকটা দিন চৌদ্দ শিকের ভেতরে থাক্,ওর জামিনটা যেন না হয়।সে ব্যবস্থাই কি করবো? তুই কি বলিস?”
রাজ কিছুক্ষণ ভেবে বললো-“থাক্,বাদ দে।আমার যতটুকু প্রতিশোধ নেবার আমি নিয়েছি।তবে দোষটা আমার বোনের।সে ওর ফাঁদে পা দিতে গেলো কেন!বেশী কিছু করার দরকার নেই।তখন এটা জুলুম হয়ে যাবে।কারো সাথে তার অন্যায়ের সমান প্রতিশোধ নেয়াটা যায়েজ কিন্তু এর অতিরিক্ত করতে গেলে সেটা জুলুমের পর্যায়ে চলে যায়।আমি বাড়াবাড়ি করতে চাইনা।আল্লাহক ওকে হেদায়েত দিক।নীরার মন থেকে এটা দুর করতেই এতো হাঙ্গামা পোহাতে হলো নইরে তো অন্যভাবে পুরো ব্যপারটা হ্যান্ডেল করা যেতো!”
-“হুমম…!তাহলে থাক্!আমি চলি।তোর জন্য শুভ কামনা রইলো! মেনী হ্যাপী রিটার্নস অফ দ্যা ডে!”
রাজ হাত মিলিয়ে ফিনকে বিদায় দিলো।

ফিন বেরিয়ে আসতেই ওর কাজিন জাহিদ এসে ফিনের হাত ধরলো।
-“ভাইয়া,তোমার ফ্রেন্ডকে কিছু বলেছো?”
-“কি বলবো?ওহ্,তোর কথা? আরে পাগল,নীরা সবেমাত্র কলেজে পড়ছে।এক্ষুনি ওকে বিয়ে দেবেনা।তোর ডাক্তারী পড়াও তো এখনো শেষ হয়নি।ভালোভাবে পাশ করে বেরো।আমি তোর ইরার ভাবীকে দিয়ে আলাপ করাবো।হলো?”
জাহিদ লাজুক হাসলো!

পুরো বাড়ী নিস্তদ্ধ হয়ে আছে।রাজ আজ আশ্রয় পেয়েছে তার প্রিয়তমার বুকে।পৌষী মৃদু স্বরে বললো-“কত কথা যে বলার আছে আমার।কোনটা রেখে কোনটা বলবো ভেবে পাচ্ছিনা!”
রাজ সদর্পে পৌষীর উপর নিজের আধিপত্য বিস্তার করে বললো-“আজ কোনো কথা নয়।এতোদিন শুধু কথাই বলেছি!আজ শুধু ভালোবাসা বাসি!”
পৌষী কিছু বলার আগেই রাজ পৌষীর মুখ বন্ধ করে দিলো।পৌষী ডুবন্ত মানুষের মতো রাজকে আঁকড়ে ধরলো।


তিন বছর পরের কথা।
রানী ভিলায় আজ আবার উৎসবের আমেজ লেগেছে।
রানী আজ মহাখুশি।
আজ তার সব নাতি নাতনীরা এসেছে।
তারা এলে পুরো বাড়ী সরগরম হয়ে ওঠে।
ড্রইংরুমে বাচ্চাদের চিৎকার চ্যাঁচামেচিতে কান টেকা দায়।
পৌষী বসে নীরাকে মোহেদী লাগিয়ে দিচ্ছে।তখন রাহেলা এসে বললো-“ভাবীই…বড় ভাইজান আমনের অক্ষনে ডাকে।রূপুমনি জিদ করতাছে।”
-“ওহ্ হো,আমি আসছি।এই মেয়েটা যে কি জেদ করে!”বলে পৌষী মেহেদীর টিউবটা সরিয়ে রেখে নিজের ঘরে আসতেই রাজ পেছন থেকে ওকে জড়িয়ে ধরলো!
পৌষী নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে ব্যর্থ হয়ে বললো-“এসব কি ছেলেমানুষী আপনার।বাড়ীভর্তি মানুষ আর আপনি দরজা লাগিয়ে রেখেছেন।সরুন না প্লিজ!
-“নো!আগে আমার দাবী মেটাও।একদফা একদাবী!”
-“রূপু কোথায়?”পৌষী হতাশ কন্ঠে বললো!
-“রূপু ইরার মেয়ের সাথে খেলছে!একটু আগে জেদ করে গেছে।সে আমার ডাম্বেলগুলো দিয়ে খেলবে।একটা হাত থেকে ছুটলে পায়ের অবস্থা খারাপ হয়ে যাবে।বুঝিয়ে ফেরত পাঠিয়েছি!”
-“আচ্ছা,এবার সরুন আমি যাবো!একটু পরে মীরা ওর বরকে নিয়ে চলে আসবে।ওরা শপিংয়ে গেছে ওর ছেলেকে রেখে গেছে।বাচ্চাগুলোকে দেখে না রাখলে একটা না একটা দুর্ঘটনা ঘটিয়ে ফেলবে।”
রাজ পৌষীকে জড়িয়ে ধরে রেখেই বললো-“সবাই বলে একটা বাচ্চা থাকলে বেশী জ্বালায়।দুটো হলে দেখবা সব ঠিক!”
-“তাই…না?”
-“ভেবে দেখো,আমাদের কিন্তু আরেকটা বাবু দরকার।”
-“যখন সময় হবে তখন দেখা যাবে!”
-“তা সময়টা কখন আসবে?”
-“উফ্,রাজ…ছেলেমানুষীরও একটা সীমা থাকে।এটা কি এসব কথা বলার সময়?নীরার শ্বশুড়বাড়ীর লোক চলে আসবে যে কোনো সময়।যে কোনো সময় আম্মু আমাকে ডাকবে!”
-“আম্মুর আর কাজ কি সারাদিন পৌষী পৌষী করা ছাড়া!”রাজ পৌষীর ঘাড়ে মুখ গুঁজলো!
-“আপনিও তো ঐ পদেরই…!”
-“কি করবো,সকালে রুম থেকে বের হও,রাত বারোটার আগে তোমাকে পাইনা।সেই রাত বারোটার সময়ও তুমি মেয়ের দখলে থাকো।এটা আমার উপর জুলুম কিনা বলো!আমার ও তো অনেক কথা বলার থাকতে পারে!”
পৌষী এবার নরম সুরে বললো-“কি করবো বলেন,আম্মু আমাকে ছাড়া কোন সিদ্ধান্ত নেবেন না!”
-“হুমমম….এটা সত্যি পৌষী।তোমাকে ছাড়া রানী ভিলা অন্ধকার।তুমি আমাদের পুরো পরিবারটাকে বদলে দিয়েছো।আম্মার মতো স্যেকুলার মাইন্ডের মানুষও এখন পর্দার গুরুত্ব বোঝে।নীরার বিয়েটা তিনি একেবারে ঘরোয়াভাবে দিচ্ছেন।সবকিছু কেমন বদলে গেছে!”
-“এটা আল্লাহরই রহমত!”
-“তোমার কারনে আমার জীবন আমূল বদলে গেছে।একথাটা শুধু শুনেছি,আজ তার সত্যতা দেখলাম যে,সংসার সুখের হয় রমনীর গুণে!
তোমার গুণে আমাদের সংসারটা সুন্দর হয়েছে।আমি আল্লাহর শোকর করি!”
-“সব ক্রেডিট একা আমার নয়।আপনিও এর ভাগিদার।কারন সংসার সুখের হয় রমনীর গুণে।
গুনবান পতি যদি মেলে তার সনে!”
বলে পৌষী রাজের বুকে মাখা রাখলো।

~~~~~সমাপ্ত~~~~~

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here