সেদিন বসন্ত ছিল পর্ব -২৪+২৫

#সেদিন_বসন্ত_ছিল
#রাহনুমা_রাহা
#পর্বঃ২৪

“এখন অনেক রাত,
তোমার কাঁধে আমার নিঃশ্বাস
আমি বেঁচে আছি তোমার ভালোবাসায়।
ছুঁয়ে দিলে হাত,
আমার বৃদ্ধ বুকে তোমার মাথা
চেপে ধরে টলছি কেমন নেশায়
কেন যে অসংকোচে অন্ধ গানের কলি,
পাখার ব্লেডের তালে সোজাসুজি কথা বলি।
আমি ভাবতে পারি নি,
তুমি বুকের ভেতর ফাটছো আমার
শরীর জুড়ে তোমার প্রেমের বীজ
আমি থামতে পারি নি,
তোমার গালে নরম দুঃখ
আমায় দুহাত দিয়ে মুছতে দিও প্লিজ।”

আধো আলো আধো ছায়ায় ঘেরা চিরপরিচিত বদ্ধ কক্ষে বসে গিটারে টুংটাং শব্দ তুলে গাইছে রিফাত। নোভা সামনে বসে অপলক নয়নে চেয়ে আছে।
রিফাত বন্ধ চোখজোড়া খুলে সোজাসুজি তাকাল নোভার চোখে। আশ্চর্যজনক ভাবে নোভা আজ নজর সরালো না। কেঁপে উঠল না তার দৃষ্টি। বরং কিছু একটা খুঁজে চলছে অনবরত সামনে বসা মানুষটার চোখে।
অগ্যতা রিফাতকেই সংযত হতে হলো। গিটারের তারে যত্ন করে হাত বুলিয়ে বলল,
“এখন মধ্যরাত থেকে মধ্য দুপুরে ফিরে আসি?”
নোভা মাথা নেড়ে নিষেধাজ্ঞা জারি করল।
রিফাত নরম গলায় বলল,
“আর কত?”
“আগে ওই গানটা শোনাও।”
রিফাত কনফিউজড হয়ে বলল,
“কোনটা?”
“এই রাত তোমার আমার, ওই চাঁদ তোমার আমার।”
রিফাত দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল।
“রাতটা যে কখনো তোর আমার হবে না নোভা। চাঁদ টাও না। তবে কেন মিছে কষ্ট পাচ্ছিস? কষ্টের শিকড় গভীরে পৌঁছার আগেই উপড়ে ফেলে দে।”
নোভা ঠোঁট প্রসারিত করে হাসল। স্নিগ্ধ হাসি অথচ কণ্ঠে একরাশ বিষাদ ঝরিয়ে বলল,
“ভালবাসার ছোট্ট চারাগাছটা আজ বিশাল বটবৃক্ষে পরিণত হয়েছে রিফাত ভাই। শিকড়গুলো পৌঁছে গেছে গভীর থেকে আরও গভীরে। চতুর্দিক থেকে পেঁচিয়ে ফেলেছে আমাকে। ঘিরে রাখছে রাত দিন, প্রতিটা মূহুর্তে। এখন শিকড়সমেত তুলে ফেললে উপড়ে পড়া গাছের মত হবে। গাছটা কিন্তু একা পড়ে না। পড়ে শিকড়ের সাথে আঁটকে থাকা প্রতি বিন্দু মাটি সমেত। তুমি চাইলে আমার মনে বেড়ে ওঠা বটবৃক্ষ উপড়ে ফেলতেই পারো। তবে এতে মরণ নিশ্চিত।”
রিফাত উত্তর দিতে চেয়েও পারল না। তার ভেতরটাও যে জ্বলছে। কি করে বোঝাবে এই একরত্তি মেয়েটাকে। কি করে!

“তুমি আছ আমি আছি তাই
অনুভবে তোমারে যে পাই
শুধু দুজনের
এই রাত তোমার আমার
ওই চাঁদ তোমার আমার
শুধু দুজনের
এই রাত শুধু যে গানের
এই ক্ষণ এদুটি প্রাণের
কুহু কুজনের
এই রাত তোমার আমার
ওই চাঁদ তোমার আমার
শুধু দুজনের।”

গানে মনোনিবেশ করে থাকা নোভা সহসাই কেঁদে উঠল। ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে একসময় হেঁচকি তুলে কাঁদতে শুরু করল।
রিফাত হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইল। গিটার সাইডে সরিয়ে এগিয়ে এলো নোভার কাছাকাছি। দু’হাতের আঁজলা ভরে মুখটা তুলে বুড়ো আঙুলের সাহায্যে চোখ মুছে দিয়ে বলল,
“এত কান্না কিসের? আমি কি মরে গেছি? নাকি বিয়ে করে নতুন বউ নিয়ে বাসর ঘরে ঢুকছি?”
নোভা তবুও হেঁচকি তুলছে থেকে থেকে।
রিফাত মুখ এগিয়ে এনে ভেজা গলায় বলল,
“হুসসস। আর কান্না নয়। সংসার চাইছিলি তো। দিয়ে দিছি। তবুও কান্না কিসের?”
নোভা তাচ্ছিল্য হেসে বলল,
“হুম, সংসারই বটে। একদিনের সংসার।”

“একদিনেরই তো চেয়েছিলি।”

“সারাজীবনের জন্য চাইলে দেবে?”

“চাস না নোভা। আমার সাধ্যের বাইরে কিছু চাস না।”

নোভা মাথা নিচু করে ফেলল। পরক্ষণেই আকুতি ভরা কণ্ঠে বলল,
“আমাকে কি তোমার একটুও ভালো লাগে না রিফাত ভাই?”
রিফাত চোখমুখ শক্ত করে বলল,
“না লাগে না।”
“শুধু ভাল লাগা নয় নোভা। আমি তোকে ভালবাসি। যতটা তুই চাস তার থেকেও বেশি। যতটা তুই বুঝতে পারিস,অনুভব করতে পারিস তার থেকেও শতশত গুণ বেশি। একটু একটু করে জমতে জমতে পর্বতসম হয়ে ধরা দিচ্ছে রে পিচ্চি। তুই বুঝবি না। তুই জানবি না। তুই কখনো এটা জানবি না ছোট্ট তোকে চোখের সামনে একটু একটু করে বড় হতে দেখার মাঝে কতটা আনন্দ মিশ্রিত ছিল। কতটা ভাললাগা মিশে ছিল তোর স্কুলে ফার্স্ট রেজাল্টে আনন্দে আত্মহারা হয়ে আমার কাছে ছুটে যাওয়াতে। তুই কখনো এটাও জানবি না যে, আমার উপস্থিতি তোকে আন্দোলিত করলে আমি ভেতরে ভেতরে কতটা আন্দোলিত হই। বুঝবি না তুই নোভা। বুঝবি না তোর জন্য আমার ঠিক কতটা পোড়ে। কতটা হাহাকার করে আমার শূন্য হৃদয়। জানবি না কোনোদিন। জানতে দেব না আমি। তোর ভালবাসার চেয়েও আমার কাছে মায়ের মমতা দামী। দামী ভাইসম বন্ধুর ভালবাসা। তোর আমার সুপ্ত ভালবাসা সেখানে নস্যি। সয়ে নে পিচ্চি। সব যন্ত্রণা মুখ বুজে বুক চেপে সয়ে নে। ঠিক আমার মত।”
মনে মনে এভাবে আওড়ানো হাজারো কথার কবর হয়ে গেল মনের ঘরেই। হাজার হাজার হাত মাটির নিচে। যেখানে শতবর্ষ খুঁড়লেও একটা কথাও বের করতে সক্ষম হবে না কেউ।
নোভা আলতো ধাক্কা দিয়ে বলল,
ভালোও বাসো না?”
রিফাত নড়েচড়ে বসল। গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
“না।”
নোভা মলিন হাসল। এটাই তো হওয়ার ছিল। সে তো জানে এই সহজ প্রশ্নের কঠিন উত্তরগুলো। তবুও বেহায়া মনটা কেন এত পোড়ে!

“কাঁচাগোল্লা, এই কাঁচাগোল্লা। বউ, ও বউ, ঘুমিয়েছো?”
আধো ঘুমন্ত ইভানা ঘুম জড়ানো কণ্ঠে শুধালো,
“কি হয়েছে?”
আবরার মুচকি হেসে বলল,
“ঘুমিয়েছো?”
ইভানা ভ্রু যুগল কুঁচকে ফেলল। দেখছে ঘুমাচ্ছে। তবুও জানতে চাইছে ঘুমিয়েছে কি-না। এমন পাগল কি গাছে ধরে?
আড়মোড়া ভেঙে ওঠে বসল। ঘুম ঘুম গলায় বলল,
“দেখছেন ঘুমাচ্ছিলাম। ডেকে তুলে আবার জিজ্ঞেস করছেন?”
আবরার অপরাধী মুখ করে বলল,
“সরি কাঁচাগোল্লা বউ। এখন ঘুমাও।”
ইভানা চোখ ছোট ছোট করে বলল,
“সিরিয়াসলি? ডাকাতের মত ডেকে তুলে এখন ঘুমাতে বলছেন? ঘুম আসবে এখন?”
আবরার সরু চোখে তাকাল। বলল,
“আমি ডাকাত?”
ইভানা হাসল।
“হ্যান্ডসাম ডাকাত। যে ডাকাতি করে এক নিষ্পাপ তরণী কে তুলে এনেছে। এখন টর্চার চালাচ্ছে।”

“আচ্ছা! আমি ডাকাত। নিজে কি? নিজে তো একটা চুন্নি বিলাই। পিচ্চি কালে আমার নিষ্পাপ, কোমল মনটা চুড়ি করে নিয়েছে। আবার বড় বড় কথা বলছে। তোমার নামে মামলা করা উচিৎ।”

“ওহ তা-ই-না? মামলা করার আগেই তো আপনি আমায় গরাদের পেছনে ঢুকিয়ে দিয়েছেন। কারাদণ্ড দিয়ে দিয়েছেন একেবারে। একদম যাবজ্জীবন কারাদণ্ড।”

আবরার মুচকি হাসল। মুখ এগিয়ে কানের কাছে ফিসফিস করে বলল,
“আমরণ কারাদন্ড। মৃত্যুর আগে নিস্তার নেই।”

ভরদুপুরে মধ্যরাতের অনূভুতি পেতে নোভা জানালা দরজা বন্ধ করে রেখেছিল। দুজনের উষ্ণ অনুভূতিতে সফলও হয়েছিল বিষয়টা।
বিকেলের সময়টা অনুভব করতে পুনরায় জানলা খুলে দিল। দু’মগ কফি নিয়ে বারান্দায় বসল। নোভা বসে আছে বারান্দায় পাতা সিঙ্গেল সোফায়। রিফাত রেলিং ঘেঁষে দাঁড়িয়ে।
নোভা একদৃষ্টে তাকিয়ে বলল,
“একটা সত্যি কথা বলবে রিফাত ভাই?”
রিফাত নিজস্ব ভঙ্গিতে বলল,
“বলো কি জানতে চাও।”
নোভা উঠে আসল। পাশাপাশি দাঁড়িয়ে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল রিফাতের দিকে। রিফাত নড়েচড়ে দাঁড়াল। ভ্রু উঁচিয়ে ইশারা বোঝাল -কি হয়েছে?
নোভা আলতো হাতে রিফাতের হাতটা তুলে নিল। ক্রমেই তা উপরে উঠতে উঠতে মাথা স্পর্শ করল। রিফাত ভ্রুকুটি করে তাকাতেই নোভা নরম গলায় বলল,
“নোরা নামের কেউ আছে পৃথিবীতে? তোমার পৃথিবীতে। আছে?”

চলবে….#সেদিন_বসন্ত_ছিল
#রাহনুমা_রাহা
#পর্বঃ২৫

“নোরা নামের কেউ আছে পৃথিবীতে? তোমার পৃথিবীতে। আছে?”
রিফাত নির্নিমেষ তাকিয়ে রইল। উচ্ছল কিশোরীর পরিবর্তিত রূপ অবলোকন করল দুচোখ ভরে।
নোভা তাড়া দিল। অধৈর্য গলায় বলল,
“বলো না রিফাত ভাই। নোরা আছে? নোভা ছাড়াও কেউ আছে তোমার?”
শেষোক্ত কথাগুলো প্রবল আকুতি মিশ্রিত গলায় বলল নোভা।
রিফাত দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। চোখ বন্ধ করে নিজেকে সামলে নিল। স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
“নেই।”
চিকচিক করে উঠল নোভার নেত্র যুগল। হয়তো আনন্দে, নয়তো বেদনায়।
রিফাত পুনরায় বলল,
“এর মানে এটা নয় যে আমি তোকে ভালবাসি। আমি তোর যন্ত্রণা থেকে বাঁচতে মিথ্যে বলেছিলাম। তুই তো নিজের মধ্যে ছিলিস না। এখনো নেই। তোর পাগলামি কমাতেই মিথ্যে বলেছিলাম আমি। ”
নোভার চোখের কার্নিশ বেয়ে দুফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল। মলিন হেসে ভেজা গলায় বলল,
“আমি তোমার জন্য যন্ত্রণা! আরও আগে বললেই পারতে। আই’ম সরি রিফাত ভাই। আই’ম রিয়েলি ভেরি সরি। পারলে তোমাকে যন্ত্রণা দেওয়ার অপরাধ মওকুফ করো। নইলে আমার নরকেও ঠাঁই হবে না।”

রিফাত কিছু বলার আগেই হনহন করে রুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে ফেলল নোভা। রিফাত অগ্যতা একরাশ চিন্তা নিয়ে দরজার বাইরে অপেক্ষা করতে লাগল।

কিছুক্ষণ পর ধবধবে সাদা সালোয়ার কামিজে নিজেকে সাজিয়ে ধীর পায়ে কক্ষ ত্যাগ করল নোভা। দরজা খুলে বাইরে পা ফেলতেই রিফাতের নজর আটকালো শুভ্র রজনীগন্ধার গুচ্ছে। মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল ক্ষণিক সময়। নোভা খুশি হতে পারল না সেই দৃষ্টি দেখে। আন্দোলিত হলো না তার অষ্টাদশী শরীর, মন। যান্ত্রিক বস্তুর ন্যায় একবার রিফাতের দিকে তাকিয়ে নজর সরিয়ে নিল।

“বধূবেশ ছেড়ে বিধবা সেজেছিস কেন? আমাকে মৃত ভেবে নিয়েছিস? এত অল্প সময়ে?”
রিফাতের বলা বাক্য শুনে নোভা যন্ত্রের ন্যায়ই হাসল।
অনুভূতিহীন গলায় বলল,
“এটা বিধবা বেশ নয়। এটা কাফনের কাপড়। কাফনের কাপড় তো সাদাই হয়, না?”
রিফাত চমকাল। থমকে গেল কিছু সময়ের জন্য।

শহরের বাইরের সুবিশাল খোলা মাঠের সামনে দাঁড়িয়ে আছে আবরার ইভানা। সরু রাস্তার দুইপাশে অসংখ্য গাছগাছালির সমারোহ। যতদূর চোখ যাচ্ছে শুধু খোলা ময়দান। দূর থেকে আরও বহুদূরে দেখা যাচ্ছে ছোট ছোট গাছগাছালি। ঘন আচ্ছাদন। জঙ্গল মনে করে ইভানা আবরারের উদ্দেশ্যে বলল,
“ওইদিকে বন? নাম কি ওই জঙ্গলের?”
আবরার জিজ্ঞাসু চোখে তাকিয়ে বলল,
“কোনটা? কোনদিকে?”
ইভানা হাত উঁচিয়ে দেখালে আবরার মুচকি হেসে বলল,
“ওগুলো বন নয়। ওটা একটা গ্রাম। স্বাভাবিকের তুলনায় ওইখানে একটু বেশিই গাছপালা। যেদিকটা তোমার বন মনে হচ্ছে ওখানে আসলে নদী।”
ইভানা মুগ্ধ চোখে পুনরায় তাকাল সেদিকে। আবরার মৃদুস্বরে বলল,
“যাবে?”
ইভানা চকিতে তাকিয়ে বলল,
“ওইখানে?”
আবরার মাথা নাড়াল। ইভানা অমায়িক হেসে হাত জড়িয়ে ধরে বলল,
“চলুন।”
আবরার ধরে রাখা হাতের দিকে তাকিয়ে ঠোঁট কামড়ে হাসল। দুষ্টু গলায় বলল,
“আজ আমাদের প্রথম ডেট, তাই না?”
ইভানা চোখ ছোট ছোট করে তাকাল। ভ্রুকুটি করে বলল,
“সিরিয়াসলি?”
আবরার মাথা নাড়াল। ইভানা মাথা নিচু করে হাসল। হাত ছেড়ে দিয়ে বলল,
“চলুন এখন।”
আবরার পুনরায় হাত টেনে আগের মত করে ধরিয়ে দিয়ে বলল,
“প্রথম ডেটিং এ এত দূরে দূরে থাকতে নেই কাঁচাগোল্লা। এতে ভালবাসা জন্মানোর আগেই পরলোকগমন করবে।”
ইভানা সরু চোখে তাকাল। কিছু বলতে চেয়েও প্রডঙ্গ ঘুরিয়ে বলল,
“আপনি আমায় কাঁচাগোল্লা কেন ডাকেন?”
আবরার মুচকি হেসে বলল,
“তুমি তো কাঁচাটাই খাওয়ার যোগ্য, তাই।”
ইভানা ভ্রু কুঁচকে তাকাল।
“মানুষ খাওয়ার যোগ্য? এটা কেমন কথা?”
আবরার ঠোঁট কামড়ে হেসে মাথা নিচু করে ফেলল। কিঞ্চিত সময় পর বলল,
“এ খাওয়া সে খাওয়া নয় বউ। তুমি চাইলে আমি বুঝিয়ে দিতে পারি। এক্ষুণি। আমার কোনো সমস্যা নেই। যদি তুমি চাও…”
বলে কাছাকাছি আসতেই ইভানা বুকে হাত দিয়ে বাঁধা প্রয়োগ করে বলল,
“বুঝেছি। আর বুঝানোর দরকার নেই স্যার।”
আবরার মুখ গোমড়া করে অন্য দিকে তাকাল। ইভানা হঠাৎ রাগার কারণ বুঝতে পারল না। সে কি বাড়াবাড়ি করে ফেলল!
খানিক সময় পর নিচু গলায় বলল,
“আ’ম সরি।”
আবরার মলিন কণ্ঠে বলল,
“কেন?”
“আপনাকে বাঁধা দেওয়ার জন্য।”
আবরার মৌনতা পালন করল। ইভানা পুনরায় বলল,
“আমি বাঁধা দিতে চাই নি। কিন্তু আমরা তো রাস্তায়। একটু বুঝুন। আগে বাসায় যাই, তারপর… ”
আবার তৎক্ষনাৎ ইভানার দিকে তাকিয়ে বলল,
“তারপর কি বউ?”
ইভানা মাথা নিচু করে ফেলল।
আবরার গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
“আমি কি কাছে আসব?”
ইভানা মাথা উঁচু করে সরাসরি আবরারের মুখের দিকে তাকাল। ভাবগতিক বুঝার চেষ্টা করতেই আবরার গা কাঁপিয়ে হেসে উঠল। হাসির তোড়ে কেঁপে কেঁপে উঠল গোটা শরীর।
ইভানা সরু চোখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে অসহায় কণ্ঠে শুধালো,
“আর কতবার আবরার?”
আবরার থামল। সিরিয়াস ভঙ্গিতে তাকাল। কাছাকাছি দাঁড়িয়ে মুখ নামিয়ে দিল কানের কাছে। ফিসফিস করে বলল,
“যতদিন এ দেহে প্রাণ আছে।”
ইভানা শিউরে উঠল। বিরক্ত হলো না। অসহ্য লাগল না। কেবল মিষ্টি একটা অনুভূতি তড়তড় করে বয়ে চলল পা থেকে মাথা অবধি।

“একটা মেয়ে যখন তার সংসারে প্রথম পদার্পণ করে তখন সে লাল শাড়িতে বধূ সেজেই আসে। আমিও এসেছিলাম। হোক না খেলনা! একদিনের সংসার! তবুও এটা আমার কাছে আমার সংসার ছিল।
সেই নববধূ গৃহপ্রবেশের সাথে সাথে এটা বলে মৃত্যুর আগে যেন তার সংসারের সাথে বিচ্ছেদ না হয়। চলে না যেতে হয় সংসার ছেড়ে। আমিও বলেছিলাম। কিন্তু আমার সংসার তো তাশের ঘর। হাওয়া পেতেই গুঁড়িয়ে গেল। সাথে গুঁড়িয়ে গেল আমার স্বপ্ন, আশা,আকাঙ্খা। সংসার থেকে বের হওয়া মানে লাশ হয়েই বের হওয়া। আর লাশ কখনো লাল শাড়িতে দাফন হয় না। তাই তো কাফনের কাপড়ের রঙে সেজেছি। মরে গেছি অথচ কেউ জানাযা পড়বে না, কবর দেবে না। ক’দিন পর তো পচন ধরবে শরীরে। সোনার অঙ্গ ক্ষয়ে যাবে। তখন বোধহয় রূপ বেয়ে বেয়ে পড়বে না, তাই না রিফাত ভাই?”

নির্বাক রিফাত কেবল চেয়ে চেয়ে দেখল স্বপ্নভাঙা হৃদয়ে এক বসন্ত দূতের বিদায়ী দৃশ্য।

সন্ধ্যা নাগাদ নোভা নিজের বাড়ির গেইট পার করে দোরগোড়ায় এসে দাঁড়াল। কলিং বেল টিপতেই দরজা খুলে দিল ইভানা। আবরার সোফায় বসে ফোন ঘাঁটছিল। নোভা কিছু না বলে মাথা নিচু করে নিজের রুমের দিকে পা বাড়ালো।
ফাহিমা করিম পেছন থেকে ডেকে বললেন,
” এত তাড়াতাড়ি এলে? রাত হবে বলেছিলে যে?”
নোভা পায়ের গতি থামিয়ে দিল। চেঁচিয়ে বলল,
“এসেছি খুশি হও নি? আবার চলে যাব?”
ফাহিমা করিম হতবাক হয়ে তাকালেন। এরকম করে তো মেয়েটা কথা বলে না তার সাথে।
আবরার ভ্রু কুঁচকে তাকাল। কিছু বলার আগেই হনহন করে হেঁটে নিজের রুমে প্রবেশ করল নোভা।
মায়ের দিকে তাকিয়ে নোভার কক্ষের দিকে অগ্রসর হলল আবরার। পেছন পেছন ছুটল ফাহিমা করিম এবং ইভানা।
উল্টো হয়ে শুয়ে মুখে বালিশ চাপা দিয়ে তীব্র স্বরে কাঁদছে নোভা। যাকে বলে গগনবিদারী চিৎকার। বালিশের জন্য চিৎকারগুলো বাইরে আসার ফুরসত পাচ্ছে না। ফেটে যাচ্ছে বুকের ভেতরটা। ঠিক যেখানে হৃদয়ের বসবাস।

আবরার দরজা ঠেলে ভেতরে আসতে চাইলে বাঁধা পেল ভেতর থেকে লাগানো ছিটকিনিতে।
হাঁকডাকের খানিক সময় পর দরজা খুলে গম্ভীর কণ্ঠে শুধালো,
“কি হয়েছে দাদাভাই? কিছু বলবে?”
আবরার নোভার ফ্যাকাসে মুখ দেখে কিছু বলতে চেয়েও বলল না। পেছনে মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল,
“মা দুইকাপ চা বানিয়ে দেবে প্লিজ।”
ফাহিমা করিম ভ্রু কুঁচকে তাকালে চোখের ইশারায় বোঝালো ,
“আমি আছি তো।”
ফাহিমা করিম দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন।
ইভানার দিকে তাকিয়ে বলল,
“ইভানা, যাও। মা চা বানিয়ে দিলে তুমি বরং নিয়ে এসো।”
ইভানা বিনা প্রশ্নে পিছু হটল।
আবরার ভেতরে ঢুকে নোভার দিকে স্থির দৃষ্টি ফেলে নরম গলায় বলল,
“ছেলেটা কে? যার জন্য উতলা হয়ে কাঁদছো!”

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here