#সোনাবউঃ♥
শেষপর্বের ১ম খন্ডঃ
মোর্শেদা হোসেন রুবী
****************
বাড়ী ফেরার পর থেকে কোনো কথা বলেনি স্বর্ণা।কিছুক্ষণ পরপর আড়ালে চোখ মুছেছে।
ঐ ঘটনার পর আলিফ কাউকে কিছু না বলে স্বর্ণাকে নিয়ে চলে এসেছে।খাওয়া দাওয়াও করেনি।বাসায় মা’কে কি বলবে ভেবে আলিফ নিজেই কিছু খাবার কিনে নিয়ে এসেছে।অবশ্য এসে দেখে মা ঘুমিয়ে পড়েছে, তাই ওনাকে কিছু বলার দরকারও পড়েনি।
…
স্বর্ণা কাপড় বদলে চুপ করে বসেছিল।আলিফ ওকে কিছু না বলে একটা প্লেটে করে খাবার নিয়ে এলো।স্বর্ণার হাত ধরে টান দিয়ে বলল-“এসো খেয়ে নেই”!
স্বর্ণার চোখ তুলে তাকাল আলিফের দিকে!
আলিফ দীর্ঘশ্বাস ফেলে স্বর্ণাকে কাছে টেনে নিয়ে বলল-“এতো আপসেট হয়োনা তো!যাহা মুশকিল তাহা আসান।আল্লাহ নিশ্চয়ই এ থেকে পরিত্রানের পথ বের করে দেবেন।”
-“সব আমার জন্য।আজ আমাকে বিয়ে না করলে আপনার এসব ঝামেলা পোহাতে হতোনা।”স্বর্না মুখ নামিয়ে বলল!ওর চোখ থেকে পানি পড়ছে।
-“তোমাকে বিয়ে না করলে তো তোমাকে পেতাম না।তুমি আমার কাছে আল্লাহ প্রদত্ত নি’মাত!এসব কথা না বলে চলো খেয়ে নেই!আমার খিদে পেয়েছে!”
এটা শুনে স্বর্ণা খাবারের প্লেট থেকে খাবার তুলে দিতে গেলে আলিফ বাধা দিল-“উঁহুঁ….আলাদা না,একপ্লেটে খাবো।এই সুন্নতটা নিয়মিত করার চেষ্টা করবো!আমাদের মধ্যে ভালোবাসা আরো বাড়বে!”বলে হাসল।
..
স্বর্ণা কিছু বললনা,খাবারের লোকমা তুলে দিল আলিফের মুখে,আলিফ ডান হাত দিয়ে ওকে থামিয়ে দিল-“এমন গোমড়া মুখে খাবোনা,একটু হাসিও চাই!”
-“হাসি আসছেনা!”ম্লান স্বরে বলল স্বর্ণা।
বলেই”আউ”করে উঠে তারপর খিলখিলিয়ে হেসে উঠল।আলিফ দুহাতে ওকে জড়িয়ে ধরে সুড়সুড়ি দিচ্ছে-“এখন আসছে?”
-স্বর্ণা ওকে ছাড়িয়ে বলল-“হয়েছে..প্লিজ প্লিজ..আর না!”
-“গুড,এভাবেই হাসবে,নো মুখ গোমড়া!দাও,এবার খাইয়ে দাও!”
স্বর্ণা ওর মুখে খাবার তুলে দিয়ে বলল-“আপনি তখনকার সবগুলো কথা শুনেছিলেন?”
-“কখনকার? ওফ্….আবার সেই চ্যাপ্টার?”
-“ন্..না মানে..আপনার মনে প্রশ্ন জাগতে পারে মেরাজ আমাকে কি কি বলেছে!”
-“আমি সব শুনেছি,তুমি রিং দেবার পরপরই রিসিভ করি আমি,পুরোটা শোনার অপেক্ষা করিনি!সাথেসাথেই দৌড় দেই…..আর…পুরোটা শোনার তো দরকারও নেই!তোমাকে যতটুকু জানি,ততটুকু বিশ্বাসও করি!”
-“আল্লাহপাক যেন আপনার বিশ্বাস বজায় রাখার তৌফিক আমাকে দান করেন,কখনো যেন আপনার বিশ্বাসে চিড় না ধরে!”
-“আমিন!”
স্বর্ণা কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল-“চলুন,আমারা বাসাটা ছেড়ে দেই।”
আলিফ মাথা নাড়ল-“পৈত্রিক ভিটা,ছেড়ে কোথায় যাবো,তাছাড়া এটাইতো সমাধান না।দেখা যাক না কি হয়!”
দুজনে এ নিয়ে আর কথা বাড়ালো না!
……
শেষরাতে আলিফের ঘুম ভেঙ্গে গেল।ঘুমের মধ্যেই অভ্যেসবশতঃ হাত বাড়িয়ে স্বর্ণাকে খুঁজল।না পেয়ে লেপ সরিয়ে উঠে বসল।তাকিয়ে দেখলো স্বর্ণা সিজদায় পড়ে কাঁদছে আর বিড়বিড়িয়ে কিসব যেন বলে চলছে।ওর কান্নার ধরনে আলিফের চোখেও পানি চলে আসলো।ওপরের দিকে তাকিয়ে মনে মনে বলল-“স্ত্রী’র কান্নায় স্বামীর চোখে যদি পানি আসে তো তুমি তো বান্দার প্রতি দয়াবান, রাব্বুল আ’লামীন…..রাহমানুর রাহিম,দয়ালুদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ দয়ালু,নিশ্চয়ই তুমি বান্দার ফরিয়াদ শোনো।এই ফিতনা থেকে আমাদের বাঁচাও।”
মনে মনে দুআ করে অযু করতে উঠে পড়ল আলিফ।
….
ফজরের নামাজ পড়ে মনটা হালকা লাগলেও বুকটা ভার ভার ঠেকছে স্বর্ণার।মাথাটা যেন সোজা রাখতে পারছেনা।শরীরটা খুব দুর্বলও লাগছে।গতরাতের ঘটনাটার পর থেকে মনটা কিছুতেই শান্তি পাচ্ছেনা।এক অস্থিরতা ঘিরে আছে স্বর্নাকে।
সকালেও নাস্তা খেতে পারলোনা।কোনোরকম আলিফকে বিদায় দিয়েই বিছানায় এসে শুয়ে পড়ল।ভেতরটা যেন কেমন করছে।উঠে বসতে গিয়ে মুখ চেপে ধরল।তারপর দৌড়ে বেসিন পর্যন্ত পৌঁছানোর আগেই হড়হড় করে বমি করে ভাসিয়ে দিল,সকালে যেটুকুও খেয়েছিল সব পড়ে গেল।বমির শব্দে শ্বাশুড়ী দৌড়ে এলেন।স্বর্ণাকে ধরে শুইয়ে দিয়ে আলিফের কাছে ফোন করতে গেলে স্বর্ণাই বাধা দিয়ে বলল-“থাক্ না,মা ও অযথা টেনশন করবে!”শ্বাশুড়ী ওর পাশে এসে বসলেন।
…..
….
ঘুম ভাঙার পর থেকেই মেরাজ এক অজানা অপরাধবোধে ভুগতে লাগলো।মনটা লজ্জায় সংকুচিত হয়ে আছে।গতরাতেও এমন অনুভূতি ছিলোনা।
সে স্বর্ণার মন জিততে চেয়েছিল,ওকে অনুরোধ করতে চেয়েছিল,আলিফের মনে সন্দেহের কাঁটা বিধাতে চেয়েছিলো,তার কোনটাই হলোনা।বরং উল্টো স্বর্ণার চোখে ও ভিলেনে রূপান্তরিত হলো।স্বর্ণা এখন ওকে আর কোনদিনই বিশ্বাস করবেনা বরং নারী লোলুপই মনে করবে।মনের অজান্তেই বারান্দার দিকে তাকালো।বড় একটা চাদর ঝুলিয়ে দিয়েছে স্বর্ণা।
বারান্দার চাদরটাই বলে দিচ্ছে যে স্বর্ণার মনেও তার প্রতি বিদ্বেষের আরো অনেক বড় দেয়াল উঠে গেছে।
কি ভেবে মোবাইলটা তুলে নিল মেরাজ।
ভাবল-ক্ষমা চাইবে স্বর্ণার কাছে?কিন্তু…ও কি ক্ষমা করবে?”
সাতপাঁচ ভেবে ফোন করল মেরাজ !
স্বর্ণা শুয়ে ছিল।আলিফ ভেবে ফোনটা সরাসরি রিসিভ করে সালাম দিয়ে বলল-“জ্বী…বলুন!”
মেরাজের বুকের মধ্যে বৈশাখের ঝড়।কি বলবে,কিভাবে বলবে..ভেবে পাচ্ছেনা!ওর কন্ঠ শুনলে যদি রেখে দেয়?”
-“হ্যালো….শুনতে পাচ্ছি না….?”
-“স্..স্বর্ণা..আ..আমি মেরাজ বলছিলাম!প্লিজ..ফোনটা রেখোনা…প্লিজ..!”
-“আর কত গুনাহগার করবেন আমাকে?(উত্তেজনায় উঠে বসল স্বর্ণা) বলুন,শহর ছেড়ে চলে যাবো? নাকি মেরে ফেলবেন আমাকে বলেন?আমার এসব আর সহ্য হচ্ছেনা!একজীবনে অশান্তির আগুনে জ্বালিয়েছেন!আজ যখন সুখের মুখ দেখেছি তো আমার সুখের সংসারে অশান্তির আগুন জ্বালাচ্ছেন,কি চান আপনি,বলুন?আল্লাহর দোহাই লাগে,আমাদের জীবন থেকে দুর হয়ে যান্!আল্লাহকে ভয় করুন,আল্লাহকে ভয় করুন!”বলে কাঁদতে লাগলো স্বর্ণা।একদমে কথাগুলো বলে কিছুটা হাঁপাতে লাগলো।মেরাজ কিছু বলার আগেই ফোনটা কট করে কেটে দিলো স্বর্ণা!
….
…….
কলেজ থেকে ফিরে গোসল সেরে খাবার টেবিলে এসে দেখল স্বর্ণার চোখেমুখে এক অন্যরকম দীপ্তি।সকালে তো যাবার সময় মুখটা মলিন দেখে গেছে।যাক্,ভালো হয়েছে ও গতদিনের ডিজাষ্টারটা হয়ত ভুলতে পেরেছে।পেছন থেকে গিয়ে স্বর্ণাকে জড়িয়ে ধরে বলল-“তোমার হাসিমাখা মুখ আমাকে কত শান্তি দিচ্ছে তুমি জানোনা!
স্বর্ণা ওকে টেনে টেবিলে বসিয়ে বলল-“খেয়ে নিন্,কথা আছে!”
-“এখনি বলো!”
-“না..আগে খেয়ে নিন্!”খাওয়া দাওয়া শেষে চায়ের কাপ হাতে দুজন বারান্দায় এসে বসলো।আলিফ চাদর দেখিয়ে বলল-“এটা কি?”
-“আমি ঝুলিয়েছি!”
আলিফ কোনো মন্তব্য করলোনা! বললো-“,আচ্ছা,তোমার কি কথা আছে সেটা বলো,শুনি!”
স্বর্ণা কিছুটা লজ্জা পেয়ে আলিফের কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিসিয়ে কিছু বলল যা শুনে আলিফ স্থির হয়ে গেল।তারপর হাত থেকে চায়ের কাপটা রেখে স্বর্ণার দিকে তাকিয়ে হেসে বলল-“সত্যি?”
-“জ্বী,ইনশাআল্লাহ!আমাদের উপরের ফ্লোরে ‘ডাঃ কানিজ ফাতেমা ‘আছেন না,আম্মা ওনাকেই ডেকে নিয়ে এসেছিলেন,উনি অনেকক্ষণ চেকআপ টেকআপ করে এটা বলেছেন,সন্ধ্যায় আপনাকে সাথে নিয়ে ওনার চেম্বারে যেতে বলেছেন!”
-“অবশ্যই যাবো!আমার তো খুশিতে লাফাতে ইচ্ছে হচ্ছে!”বলে স্বর্ণাকে হ্যাচকা টানে নিজের বুকের সাথে জড়িয়ে ধরল-“উফ্..ভাবতেই পারছিনা…’আমি বাবা হবো,আর তুমি মা”….. আলহামদুলিল্লাহ!”
ভালোলাগার অদ্ভুত আবেশে স্বর্ণা দুচোখ বন্ধ করে আলিফের বুকে মিশে গেল।
কিছুক্ষণ পর স্বর্ণা হঠাৎ আলিফের হাতটা চেপে ধরে বলল-“আপনাকে একটা অনুরোধ করবো,রাখবেন?”
-“হমম,বলো…!”
……
…
….
আজই ঢাকায় ফিরেছেন রাজিয়া।ছেলেটার জন্য নতুন করে দুশ্চিন্তায় ভুগছেন তিনি।ভালো বউটাকে ধরে রাখতে পারলোনা।চোখের চটকে এক রঙ্গীলাকে নিয়ে এলো,কয়েকটা মাসও টিকলোনা।ভেঙ্গে গেলো সংসার।কে বোঝাবে এই ছেলেকে?বদমেজাজ আর অতি আধুনিকতা এদের জীবনকে জাহান্নাম বানিয়ে ছেড়েছে।তিনি চোখ বুঁজলে ছেলেটার কি যে হবে!বারো ভুতে লুটে পুটে খাবে ওকে!
এটা তারই ভুল!একমাত্র ছেলে বলে তার অবাধ স্বাধীন জীবন যাপনে বাধা না দিয়ে স্বেচ্ছাচারীতাকে প্রশ্রয় দিয়ে ওরই ক্ষতি করেছেন তিনি! যার ফল আজ তার ছেলেই ভোগ করছে।
…
এসব ভাবতে ভাবতে ছেলে ঘুম থেকে উঠেছে কিনা দেখতে যাবেন এমন সময় বেল বাজলো!তিনি আগে দরোজা খুলতে গেলেন!দরজা খুলে বিস্ময়ে তিনি বাকরুদ্ধ হয়ে গেলেন!
স্বর্ণাই আগে সালাম দিয়ে বললো-“ভালো আছেন আপনি?”
চোখটা ছলছল করে উঠল-“মা..তুমি..এ..এখানে?”
-“আমি এসেছেন জেনে আপনার সাথে দেখা করতে এলাম!”
-“এসো..মা..!”
স্বর্ণাকে হাত ধরে বসালেন তিনি।স্বর্ণা বোরকার নেকাব সামান্য নামিয়ে চারপাশ তাকাল।রাজিয়া বুঝতে পেরে বললেন-“মেরাজ এখনো ঘুমে…তুমি নিশ্চিন্তে বসো..মা..!”
স্বর্ণা একটা দীর্ঘশ্বাস চাপল।তারপর রাজিয়ার হাত ধরে বলল-“আপনার সাথে খুব জরুরী একটা কথা ছিল!”
….
মেরাজ বাথরুম থেকে বেরিয়ে শুনল মা কারো সাথে কথা বলছে।ঘরের পর্দা সরিয়ে বাইরে উঁকি দিয়ে দেখলো বোরকা পরিহিতা কোনো মহিলা মা’র সাথে কথা বলছে।সে শেভ করার জন্য পুনরায় বাথরুমে ঢুকল।
….
রাজিয়া বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে বলল-“এসব তুমি কি বলছো,মা?মেরাজ এতো নিচে নামতে পারলো?”
স্বর্ণা চোখের পানি মুছে বলল-“আপনি উনাকে শুধু একটা কথাই বলবেন,আমি এতদিন কারো মেয়ে ছিলাম…..আজ কারো স্ত্রী…এবং আজ থেকে আমি একজন “মা”ও….!মাতৃত্বের মর্যাদা যদি উনি না বোঝেন তবে উনি একজন সন্তান হিসেবে ব্যর্থ।উনি যদি নিজেকে এ থেকে সরিয়ে না নেন্…শেষমেষ আমাকে বাধ্য হয়ে এই শহর ছাড়তে হবে!আর কিছুনা,এটুকুই বলতে এসেছিলাম!”
রাজিয়া লজ্জিত হয়ে স্বর্ণার হাত ধরে বললেন-“ওর হয়ে আমি ক্ষমা চাচ্ছি মা…তুমি ভেবোনা,আমি ওর ব্যবস্থা করছি।ওর জন্য আমার বড় ভাইয়ের মেয়েটার কথা অনেক দিন থেকেই ভাবছিলাম,ঐ শাকচুন্নিটার পাল্লায় না পড়লে এতদিনে…যাক্….ভেবেছিলাম আগে ওর মতামত নেবো….এখন ভাবছি….মতামতের কোনো দরকার নেই…এবার ওকে জোরই করতে হবে!যত দ্রুত সম্ভব……দরকার হলে আজই!”রাজিয়া দৃঢ় কন্ঠে বললেন!
..
…….
স্বর্ণা বিদায় নেবার জন্য উঠে দাঁড়িয়ে বলল-“আল্লাহর শোকর,আপনি আমাদের জন্য এভাবে ভাবলেন!আমাদের জন্য দু’আ করবেন! ”
-“অবশ্যই মা…আল্লাহ তোমার কোল ভরে দিন!”
-“আমিন!”
মেরাজ পেছন থেকে ডাকল-“মা?”
স্বর্ণা ততক্ষণে বিদায় নিয়েছে!
রাজিয়া দরজা বন্ধ করে ছেলের দিকে তাকালেন!মেরাজ বলল-“কে এসেছিলো?”
রাজিয়া কড়াচোখে ছেলের দিকে তাকিয়ে বললেন-“সেটা পরে বলছি,তার আগে তোকে জানিয়ে রাখি,সন্ধ্যায় আমার সাথে তোর বড়মামার বাসায় যেতে হবে,কোনো এপয়েন্টমেন্ট রাখিস না!”
-“হঠাৎ বড়মামার বাসায় কেন?তাও আবার আমাকে নিয়ে?তুমি যাও..!”
-“তোর বিয়ে তোকে নিয়ে যাবো না তো কাকে নিয়ে যাবো?”
-“আমার বিয়ে মানে?”
-“হ্যাঁ,তোর বিয়ে…মিমির সাথে..আজই…..এমনিতে অনেক দেরী হয়ে গেছে..আর না! এটাই আমার সিদ্ধান্ত।নিজের সিদ্ধান্তে তো জেসমিনকে এনেছিলি ফলাফল তো দেখলি..!”
মেরাজ মাথা নিচু করে বলল-“,তোমার পছন্দে তো স্বর্ণাকেও এনেছিলাম..কিন্তু…!”
-“ওকে নিজের দোষে হারিয়েছিস,এখন এসব বাদ দে..নাস্তা খা তোর সাথে অনেক জরুরী কথা আছে,আয় বোস্..!”
…
মেরাজ নাস্তা খেতে বসলে রাজিয়া শান্ত স্বরে বলল-“গত পরশু রাতে মুনিয়াদের বিয়েতে কি করেছিস তুই?”
নাস্তা গলায় আটকে গেলে কেশে উঠল মেরাজ।পানির গ্লাস এগিয়ে দিলেন রাজিয়া! মেরাজ পানি খেয়ে বললেন–“ত্..তুমি কি করে জানলে?”
-“একটু আগে স্বর্ণা এসেছিলো!”
মেরাজ এবার চুপ মেরে গেল।
….
….
মায়ের কঠিন জেদের কাছে মেরাজকে হার মানতে হলো।তাছাড়া এভাবে জীবনটাও একঘেয়ে হয়ে উঠেছে।মনটা খারাপও লাগছে।ভীষন লজ্জা বোধ হচ্ছে।স্বর্ণা ‘মা’ হতে যাচ্ছে সংবাদটা ওর জন্য বজ্রপাতের মত ছিলো।
কিভাবে ক্ষমা চাবে ওর কাছে?”
….
রাজিয়া সারাটা দিন ভীষন ব্যস্ততায় কাটালেন।বড়ভাইকে ফোন করে প্রায় একঘন্টা কথা বললেন!মেরাজ আজ মায়ের কথামত তাড়াতাড়িই বাড়ী ফিরল।
বড়মামার বাড়ী যাবার আগে মা’কে অভিযোগের সুরে বলল-“মা..তুমি বিয়ে ঠিক করেছো ভালো কথা,তাই বলে মেয়েটাকে একবার দেখবোনা?এটা কেমন কথা?না দেখে বিয়ে হয় নাকি আজকাল?পছন্দ হলে আংটি পড়াবো নইলে….!”
রাজিয়া ওর কথা পাত্তা না দিয়ে বললেন-“তোর বড়মামাকে কথা দিয়ে ফেলেছি।রাতেই কাজী ডেকে বিয়ে পড়িয়ে দেবো!শোন্…রূপ চোখ জুড়ায় কিন্তু গুন মন জুড়ায়।খালি রূপ দেখলে জীবন চলবেনা, রূপের সাথে গুনও চাই।মিমি সবদিক দিয়ে চৌকস মেয়ে,তোর ভালো লাগবে।আর দেখিসনি বলছিস কেন?মিমিকে তো কতবার দেখেছিস!”
-“কোথায় কতবার দেখেছি,সেই স্কুলে থাকতে শেষ দেখেছি,মোটা চশমা পড়ে বেনী দুলিয়ে ঘুরতো,এখনো কি তেমন? ”
রাজিয়া হাসি চাপলেন-“,হ্যাঁ,তেমনই তো।যাক্,ওসব ধানাইপানাই ছাড়,মেয়ে ভালো তুই সুখী হবি।আর বিগত দিনগুলো থেকে শিক্ষা নে।উপযুক্ত সঙ্গীর অভাবে মানুষের জীবন নরক হতে দেরী হয়না,এটা কি এখনো বুঝিসনা?”
-“তাই বলে আজই?”
-“হ্যাঁ,শুভকাজে দেরি করতে নেই!””
মেরাজ আর কথা বাড়ালোনা।চিন্তিত মুখে নিজের ঘরে চলে গেল।চুপচাপ মায়ের হম্বিতম্বি দেখতে লাগল।ড্রাইভারকে দিয়ে মিষ্টি আনালেন।ফোন করে ছোটখালাকে আনিয়ে নিজে মার্কেট গিয়ে কি সব কেনাকাটা করে আনলেন!
সন্ধ্যের পরপরই বড়মামার বাড়ী পৌঁছুলো মেরাজ।ওরাও সব আয়োজন করে রেখেছে।
মা’কে আড়ালে ডেকে বলল-“একবার অন্তত আলাপ না করে কিন্তু আমি মতামত দেবোনা,বলে দিলাম”!
রাজিয়া ত্রস্তে ভেতরে চলে গেলেন।
তার মিনিট খানেক পরেই একটা মেয়ে ঢুকল।চোখে মোটা চশমা পড়ে।কাচের পুরুত্বের জন্য মেয়েটার চোখগুলো ভালো করে দেখা যাচ্ছিলোনা!টাইট দুটো বেনী দুদিকে কার্টুন স্টাইলে ছড়িয়ে আছে।
মেরাজ ঢোক গিলল।মা শেষমেষ ওর এই সর্বনাশটা করলো?
মেয়েটি এসেই মেরাজের সামনে বসে পড়ল,তারপর হাত বাড়িয়ে বলল-“কেমন আছেন ভাইয়া?”
মেরাজ জবাব দিলোনা!মেয়েটি ওর দিকে চুইংগাম বাড়িয়ে ধরে হাসল।দাঁতের সারিতে দাঁত সমান করার ক্লিপ বসানো।এ তো ভয়ংকর অবস্থা।মা কি দেখে এই মেয়েকে ওর জন্য ঠিক করলো?কেবল গায়ের রং আর ছিপছিপে ফিগার দেখেই মা রাজী হলো?মেয়েটি বেশ কিছু প্রশ্ন করলেও মেরাজ তেমন কোন জবাব না দিয়ে একবার ধমকের শুরে বলল-“যাও এখান থেকে…..আমার আম্মুকে ডেকে নিয়ে আসো!”
-“আমাকে পছন্দ হয়েছে কিনা বললেন নাতো?অবশ্য পছন্দ না হলেও উপায় নেই,বিয়ে তো আজ হবেই,আজই বাসর রাত…হি..হি..হি..!”বলে যাবার সময় মেরাজের গালটা টেনে দিয়ে গেল!
মেরাজের গায়ে কাঁটা দিলো-‘এ কেমন তর মেয়ে?বেহায়া….?”মনে মনে মা’কে খুঁজল।তৃতীয়বার বিয়ে করবে দেখে যাচ্ছেতাই ধরিয়ে দেবে মা ওকে?
…
মায়ের সাথে কথা বলার আর সুযোগ পেলোনা মেরাজ।লোকজনের ভীড়ে মা’কে পেলোনা।দশটার দিকে ছোটমামা ওর কাঁধে ধরে বসিয়ে মাথায় টুপি পড়িয়ে দিলেন।ওদিকে কাজী সাহেব তেলাওয়াৎ শুরু করে দিয়েছেন।মেরাজের এই প্রথম খীঁচে দৌড় দিতে ইচ্ছে হচ্ছে!
…..
ঠেলেঠুলে বাসর ঘরে ঢুকিয়ে দেয়া হলো মেরাজকে।আড়চোখে খাটের দিকে তাকাল।বদমাশ মেয়েটা চুপচাপ বসে আছে।
মেরাজ কোনো কথা না বলে পা দুটো লম্বা করে একটা সোফায় বসে মোবাইলে গেম অন করে মনোযোগ দিয়ে ট্রিঁট্রিঁট্রিঁ শব্দে গেম খেলতে লাগল।হঠাৎ পায়ে কারো হাতের ছোঁয়ায় চমকে উঠল।তারপর বিস্ময়ে হতবাক হয়ে সামনে তাকিয়ে রইল!
…
চলবে…..
আগামী খন্ডে সমাপ্য!