#হলুদ_বসন্ত
#পর্ব_১১
#Eshika_Khanom
আদ্রাফ টানা কিছুক্ষণ সেই কবরের দিকেই চেয়ে রইল। আর আয়াত একবার কবরটা দেখে তো একবার আদ্রাফকে। কিছুক্ষণ পর আদ্রাফ আয়াতকে প্রশ্ন করল,
“জানো আয়াত এটা কার কবর?”
আয়াত না-বোধক উত্তর প্রকাশ করল। আদ্রাফ বলল,
“এটা আমার আরেক বন্ধুর কবর যাকেও আমি হারিয়ে ফেলেছি।”
আয়াত কিছু বলল না আর। আদ্রাফের চোখ রক্তবর্ণ ধারণ করেছে। দেখেই বোঝা যাচ্ছে অন্তরটা তার জ্বলে পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে। তবে আয়াতের কাছে আদ্রাফকে স্বান্তনা দেওয়ার জন্যে কোনো ভাষা নেই। সে তো আদ্রাফের সম্পর্কে ভালোমতো জানেই না। আদ্রাফ নিজে থেকেই বলতে থাকলো,
“নুহাশ তো পড়তে বিদেশে চলে যায়, দেশে থেকে যাই আমি আর জীম। জীমের আর্থিক অবস্থা ভালো ছিল না দেখে আমি আর নুহাশ ওকে নানাভাবে সাহায্যে করতাম। ওর স্বপ্ন ছিল সবকিছুতে প্রথম থাকার। কিন্তু ভার্সিটির টপে সবসময়কার স্থানটা ছিল আমার, আর তার পরের স্থান ছিল ফরহাদের। খুব ভালো বন্ধুত্ব ছিল আমাদের মধ্যে। কিন্তু কখনোই বুঝতে পারিনি ও আমার বন্ধু নয়, এক বিষধর সাপ ছিল। জীমের টপার হওয়ার স্বপ্ন পূরণ হয়নি বলে ও আমার উপর প্রতিশোধ নেয় আয়াত।”
আয়াত আদ্রাফের দিকে তাকিয়ে বলে, “কি করেছিলেন তিনি?”
আদ্রাফ বলে, “আমার জীবনে অন্ধকার নামিয়ে আনে সেই প্রতিশোধ। একদিন আমায় ডেকে পাঠায় ফরহাদ নিজের বাড়িতে। আমিও ওর ডাকে ওর বাড়িতে যাই। প্রচুর মারামারি হয় আমাদের সেদিন। কিন্তু ওর প্রতিশোধের শক্তি এতোই বেশি ছিল যে আমি পরাজিত হয় মারামারিতে। একসময় নিজের সব শক্তি হারিয়ে পড়ে থাকি মেঝেতে। আর জীম আমার শরীরে একটা ইঞ্জেকশন পুশ করে সেই সময়। জানো সেটা কিসের?”
আয়াত প্রশ্ন করল, “কিসের?”
আদ্রাফ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “ওইটায় ছিল এইচআইভি ভাইরাস। ”
তারপর চিৎকার করে বলতে থাকে আদ্রাফ,
“আমার জীবনটাকে শেষ করে দিয়েছে এই শয়তান। বন্ধু নামের কলঙ্ক ছিল ও। আজ আমি এইডস আক্রান্ত ওর জন্যে, প্রিয়জনদের হারাবো আমি ওর জন্যে। আমার জীবনটাকে অভিশাপে পরিণত করেছে জীম।”
অশ্রু ঝরছে আদ্রাফের চোখজোড়া থেকে। আয়াত স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে সেই কবরের দিকে।মানুষ এতোটাই খারাপ হতে পারে? নিজের সৎমায়ের প্রতিও মনে কখনো এতো ঘৃণা জন্ম নেয়নি যতোটা ঘৃণা হচ্ছে এই মৃত মানুষটার প্রতি। ক্রোধ কতই না ভয়ানক হতে পারে যে বন্ধুও শত্রুতে পরিণত হয়। শীতল হাওয়া বইছে চারিদিকে, নিস্তব্ধ পরিবেশে দুইটা প্রাণ এখনোও দাঁড়িয়ে আছে সেই বিশ্বাসঘাতকের কবরের সামনে।
.
.
.
পুরো গাড়িতে আদ্রাফ এবং আয়াতের মধ্যে আর কোনো কথা হয়নি। আয়াতের বিশ্বাস ছিল আদ্রাফ কোনো অনৈতিক কাজে জড়িত ছিল না। তবে আদ্রাফের বর্তমানের অবস্থার জন্যে দায়ী এই মারাত্মক ঘটনা শুনে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছে সে আগেই। আদ্রাফ প্রতিদিন মরছে আগাম মৃত্যুর হাঁকে। হয়তো ওর কষ্ট কেউই বুঝতে পারবে না। আসলে এটা অসম্ভব। ব্যস্ত রাস্তায় নিশ্চুপ দুই মানব পাশাপাশি বসে রয়েছে ও ফিরছে নিজেদের বাসস্থলে। এইডস আক্রান্ত ব্যক্তি মানেই সে অনৈতিক কাজে জড়িত সেটা কিন্তু নয়। মাঝে মাঝে প্রতিশোধ এতোই ভয়ানক রুপ নেয় যে এটি মানুষের জীবন বিপন্ন করে তোলে।
খেয়েদেয়ে যার যার ঘরে চলে গিয়েছে সবাই। অনেকে ইতিমধ্যে ঘুমিয়েও পড়েছে। তবুও একই বাড়িতে চোখে ঘুম নেই ছয় জোড়া নয়নের। বিছানায় শুয়ে শুয়ে মৃতু্র প্রহর গুনছে আদ্রাফ। জানেনা সে আর কতদিন বাঁচবে। এইডস রোগ হয়েছে এক বছর ছাড়িয়ে গেল। মেডিসিন নিতে নিতে জিহবা বিষাক্ত হয়ে গিয়েছে। মাঝে মাঝে ইচ্ছে হয় তার খুব জলদিই মরে যেতে। আবার নিজের ভালোবাসা এবং প্রিয়জনদের টানে থমকে যায় সে। আয়াতকে ছাড়া সে বাঁচতেই পারবেনা এই কথাটা চিন্তা করলেই নিজেকে বিদ্রুপ করতে থাকে আদ্রাফ। ও তো মরেই যাবে আবার আয়াতকে ছাড়া বাঁচবে না মানে কি? হাস্যকর লাগে নিজেকে। কেন সে টপার হয়েছিল? এতো ভালো রেজাল্ট তাকে কি এনে দিয়েছে? মৃত্যু! মৃত্যুর সম্মুখে দাঁড়িয়ে রয়েছে সে। প্রতিহিংসা জিনিস এমনই।
আয়াত চোখ বন্ধ করে ঘুমানোর চেষ্টা করছে, কিন্তু পারছেনা। চোখ বন্ধ করলেই সেই কবরটা তার চোখের সামনে ভেসে উঠছে। আচ্ছা জীম কি করে মারা গেল? জানা হয়নি তার। এতোকিছু যেহেতু আদ্রাফ নিজে থেকেই তাকে বলেছে তাহলে হয়তো জীমের মৃত্যু কিভাবে হলো তাও বলবে। যথা চিন্তা তথা কাজ। উঠে গেল আয়াত শোয়া থেকে। ফোনটা হাত নিয়ে আদ্রাফকে কল দিল। রিসিভ করল আদ্রাফ। অপর পাশ থেকে ভেসে এলো এক উদগ্রীব কণ্ঠস্বর। আদ্রাফ বলল,
“কোনো সমস্যা হয়েছে কি আয়াত? আমায় কল দিয়েছ যে?”
আয়াত বিনিময়ে বলল, “আপনি কষ্ট করে কি একটু বাগানে আসবেন?”
আদ্রাফ প্রশ্ন করল, “কেন?”
আয়াত বলল, “প্লিজ আসুন।”
কল কেটে দিল আয়াত। আদ্রাফ কিছুক্ষণ ফোনের দিকে তাকিয়ে চিন্তা করল আয়াতের এভাবে ডাকার কারণ। খুজে পেল না উত্তর। চলে গেল সে বাগানে।
আদ্রাফ বাগানে গিয়ে দেখলো সেখানে দোলনায় বসে রয়েছে আয়াত। চোখে মুখে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে সে অপেক্ষা করছে কারো জন্যে। আদ্রাফকে দেখে সে এক মুঠো হাসি তাকে উপহার দিল। ইশারা করে আদ্রাফকে তার পাশে বসতে বল। চুপটি করে আদ্রাফ তার পাশে বসলো। আয়াত নিজের হাত বাড়িয়ে দিল আদ্রাফের দিকে। আদ্রাফ এক হাত রাখলো আয়াতের হাতের উপর। আয়াত প্রশ্ন করল,
“আমি একটা প্রশ্ন করলে কি আপনি তার সঠিক উত্তর দিবেন?”
আদ্রাফ জিজ্ঞেস করল, “কি প্রশ্ন?”
আয়াত আদুরে স্বরে বলল, “আগে বলুন উত্তর দিবেন।”
আদ্রাফ হালকা হেসে বলল, “চেষ্টা করব।”
আয়াত নিজের হাসির পরিধি আরেকটু বাড়িয়ে বলল, “তাহলেই চলবে।”
“আচ্ছা।”
“জীম কিভাবে মারা গিয়েছেন?”
আদ্রাফের কপাল সংকুচিত হল। জিজ্ঞেস করল,
“তুমি জেনে কি করবে?”
আয়াতের দায়সারা উত্তর, “আমি জানতে চাই।”
আদ্রাফ প্রশ্ন করল, “কেন?”
আয়াত বলল, “আমার অধিকার আছে।”
আদ্রাফ বলল, “তুমি সবসময়ই এটা বলো।”
আয়াত চোখ রাঙিয়ে বলল, “আমি জানতে চেয়েছি।”
আদ্রাফ মৃদু হাসলো আয়াতের কান্ডে। তারপর বলল,
“তবে শুনো, আমার দেহে জীম এইচআইভি ভাইরাসে ঢুকানোর পর কতক্ষণ আমি নিস্তেজ হয়ে পড়ে থাকি ওর বাড়িতে। আমায় একা ফেলে রেখে জীম বেরিয়ে যায় বাসা থেকে। হয়তো জেদের বসে কাজটা করে ভয় পেয়েছিল। পালিয়ে যায় সে নিজের বাড়ি থেকে। রাস্তা দিয়ে হাঁটছিল তখন সে কার এক্সিডেন্ট করে। জীমকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয় এবং আমি যতটুকু জানি সে কয়েকদিন লাইফ সাপোর্টে ছিল। অবস্থার অবনতি হতে থাকে জীমের। এবং শেষে ও মারা যায়।”
“ওহ”
“আচ্ছা তুমি ঘুমোতে যাও, অনেক রাত হয়েছে। কাল আমার কাজ আছে আমি ঘুমোতে গেলাম। শুভ রাত্রি।”
আয়াতের তরফ থেকে কোনো উত্তর না নিয়েই আদ্রাফ চলে গেল বাড়ির ভিতরে। আয়াত দোলনায় একা একা বসে রইল। জীমের জন্যে তার মোটেও আফসোস হচ্ছে না। নিজের পাপের শাস্তি পেয়েছে সে। এবং আরও পাবে। কারণ সে দুর্বিষহ করে তুলেছে আদ্রাফের জীবন। অভিশাপে পরিণত করেছে তার জীবনকে। যে অভিশাপ থেকে মুক্তির একমাত্র পথ মৃত্যু।
#চলবে
[