হলুদ বসন্ত পর্ব -১০

#হলুদ_বসন্ত
#পর্ব_১০
#Eshika_Khanom

আদ্রাফ এক ভারী দীর্ঘশ্বাস ফেলে মুচকি হেসে আয়াতের পানে দৃষ্টি মেলে বলল,
“হয়তো আগমনী হলুদ বসন্তেই পড়বে আমার শেষ নিঃশ্বাস। ”

কথাটা বলা শেষ হলেই আয়াত ঝাপিয়ে পড়ল তার প্রাণপ্রিয়ের বুকে। অশ্রুধারার বর্ষণ পরিবেশটাকে আরও বেশি ভারী করে ফেলছে। একটি ভালোবাসার গল্পে শোভা পাচ্ছে হারিয়ে ফেলার ভয় ও বেদনা। এই শীতের মধ্যেও শুরু হলো বর্ষণ। হয়তো প্রকৃতিও আজ তাদের হৃদয়ের ব্যথায় ব্যথিত। প্রকৃতিও নিজের অশ্রুকে আটকে রাখতে পারেনি দুইটি ভালোবাসার মানুষের না পাওয়া ভালোবাসাকে দেখে। তাই তো এই শীতের মধ্যেও পড়ছে বৃষ্টি। অশ্রুর মধ্য দিয়ে প্রকাশিত হচ্ছে ভালোবাসা। আর এই ভালোবাসার সাক্ষী হয়ে আছে প্রকৃতি, খোদা তায়ালা আর দূরে বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকা এক মানব। নীরবে অশ্রু ফেলছে সে। আদ্রাফ এবং আয়াত পরস্পরের ভালোবাসা বিনিময় করছে কান্নার মাধ্যমে। কিন্তু সেই মানব, নুহাশের বুকে জমছে হাহাকার, বেদনা। নুহাশ কাঁদছে প্রচুর, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে প্রচুর কাঁদছে। আদ্রাফ ও আয়াতের কষ্টের সাক্ষী সবাই হলেও নুহাশের কষ্টের সাক্ষী সে নিজে, প্রকৃতি এবং আল্লাহ তায়ালা ছাড়া কেউই হবেনা। কাঁদছে নুহাশ প্রিয় বন্ধুকে হারাবে বলে। কাঁদছে নুহাশ দুইটি ভালোবাসার মানুষের আর্তনাদে। কাঁদছে নুহাশ প্রিয় মানুষটি কখনোই তার আপন হবেনা তাই।

“অক্ষিতে অশ্রুর সঞ্চার ঘটে রোজ,
হিয়া বোঝে না প্রিয়- কোথা পাই খোঁজ?
নয়নে নয়নে বাধা সে প্রনয় বাধন-
আনন্দ বদলে আজ হয়েছে রোদন!”

থাকতে পারছেনা নুহাশ আর, সরে আসলো সে বারন্দা থেকে। অপরদিকে কান্নার মাধ্যমে নিজেদের ভালোবাসা প্রকাশ করে নিজেদের ঘরে ফিরে গেলো দুইটি ভালোবাসার পাখি। নুহাশ বিছানায় বসে পড়ল, অঝোরে কাঁদতে লাগলো। আশেপাশে থেকে যেন কেউ বলে চলেছে,
“বেইমান হবি তুই নুহাশ, তোর সুযোগ এসে পড়েছে, অতি সন্নিকটেই সেই মূহূর্ত, কাজে লাগা নুহাশ কাজে লাগা।”

অপরদিকে হয়তো অন্য কেউ তাকে বলছে,
“নুহাশ তোর ইমান নষ্ট করিস না, দুইটি ভালোবাসার মানুষকে আলাদা করিস না। ব্যথিত হৃদয়ের ব্যথা মাঝে মাঝে প্রকাশ না করাই উত্তম।”

জোরে জোরে কেঁদে উঠলো নুহাশ। জানেনা সে কি করবে, বুঝতে পারছেনা কি করা উচিত তার। বড্ড অবুঝ লাগে তার নিজেকে। জানা নেই নুহাশ কার কথা শুনবে। বেছে নিবে সে কার পথ? বেইমানির পথ নাকি যে পথে রয়েছে শুদ্ধতা, পবিত্রতা?
.
.
.
আজ অনেকদিন পর সাজতে বসেছে আয়াত। শেষ সেজেছিল নিজের বিয়েতে তবে স্বেচ্ছায় নয়। তবে নিজের ইচ্ছে থেকে এর আগে কবে প্রসাধনী ছুয়েছিল সেটা মনে পড়েনা তার। মাঝে মাঝে নিজের সৎমাকে ধন্যবাদ জানায় সে মনে মনে। কারণ সে এই পদক্ষেপ নিয়ে আয়াতকে একটা ভালো পরিবার উপহার করেছে। আবার আয়াত নিজেকে প্রশ্নও করে,”আদ্রাফ যখন থাকবে না তখন সে কি করে বাঁঁচবে?” এই কয়েকদিনে যে সে আদ্রাফকে খুব আগের চেয়েও খুব বেশি ভালোবাসে ফেলেছে। আদ্রাফের প্রতি ভালোবাসা তার মনে জেগেছিল নীরবে, আদ্রাফের কাণ্ডকারখানায় মুগ্ধ হয়ে পড়েছিল সে। প্রথম প্রথম প্রেম তো এভাবেই জাগে।নিয়তি তাকে এবং আদ্রাফকে অলৌকিকভাবেই মিলিয়ে দিয়েছে। আবার মিলিয়েও মিলায়নি। আসলে সবকিছু সবসময়ই পূর্ণতা পায় না। মাঝে মাঝে কিছুটা অপূর্ণতাও রয়ে যায়। আদ্রাফবিহীন নিজেকে ভাবলেই শিউরে উঠে সে। চোখ ভরে আসে নীরে। যদি তাকে সবাই আবার বিয়ে দিয়ে দিতে চায়? না করবেই না সে। কিছুতেই আর রাজী হবেনা। দাদীর খেয়াল রেখে এবং আদ্রাফের স্মৃতিগুলোকেই আঁকড়ে ধরে কাটিয়ে দিবে বাকিজীবন। পরপারেই মিলিত হবে ভালোবাসার সাথে। হয়তো জান্নাতের কোনো হলুদ বসন্তের মাঝে মিলন ঘটবে তার সাথে তার প্রাণপ্রিয়ের।

বাড়ির বাহিরে অপেক্ষা করছে আদ্রাফ আয়াতের জন্যে। আজ মেয়েটার সাথে বাহিরে যাবে, কিছু কেনাকাটা করে দিবে সাজেকে যাবে বলে। সেই উদ্দেশ্যেই আজ এতো প্রস্তুতি। চোখ দুইটি অধির আগ্রহে অপেক্ষা করছে আয়াতের জন্যে। অবশেষে তার অপেক্ষার প্রহর শেষ হলো, আগমন ঘটলো আয়াতের। নিজে একটু সেজে নিলেও আবৃত করে রেখেছে নিজেকে খিমারের মাধ্যমে। পরিপূর্ণ পর্দাশীল নারীতে পরিণত সে। আদ্রাফ এই রুপ একদমই আশা করেনি। শুধু কাজলরাঙ্গা দুইটি নয়ন দেখা যাচ্ছে তার, যা আদ্রাফকে বিমোহিত করার জন্যে যথেষ্ট। আদ্রাফ এক ধ্যানে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল আয়াতের দিকে। বিপরীতে আয়াত পর্দার আড়ালে মুচকি হাসলো আদ্রাফের অভিব্যক্তিতে। পরবর্তীতে আদ্রাফ আয়াতকে গাড়ির মধ্যে বসিয়ে নিজেও বসলো। ড্রাইভার গাড়ি চালানো শুরু করল, দুইজন্যে রওয়ানা দিলো তাদের আজকের গন্তব্যে।

গাড়ির মধ্যে বসে রয়েছে আয়াত এবং আদ্রাফ। দুইজনেই নিশ্চুপ, আটকে পড়েছে জ্যামে। বাংলাদেশের প্রধান প্রধান সড়কের ট্রাফিক অবস্থা বেশিরভাগ সময়ই অপরিবর্তনীয়। চোখ খুললেই যেন ট্রাফিকের দেখা পাওয়া যায়। হঠাৎ করে যেন আদ্রাফের মধ্যে এক কবি প্রতিভা প্রকাশিত হলো। আচ্ছা ভালোবাসলেই কি কবি প্রতিভা বেড়ে যায়? জানা নেই। আদ্রাফ বলতে শুরু করল,

“পড়েছি প্রেমে আমি গভীর ঐ দৃষ্টিতে
এমন মোহময়ী আর নেই সৃষ্টিতে।”

আয়াত অবাক হয়ে তাকালো আদ্রাফের দিকে তার মুগ্ধ মোহনীয় দৃষ্টি নিয়ে। আদ্রাফ মৃদু হাসলো আয়াতের চাহুনীতে। আদ্রাফ আবার বলতে লাগলো,

“সঞ্চারিনী ভেবে করো নাকো ভুল
এ প্রেম পেতে ঠিক হবে ব্যাকুল,
স্বর্গের অপ্সরাও মেনে যাবে হার
ও চোখের প্রেমেতে পড়বো বারংবার।”

থেমে গেল আদ্রাফ, গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল আয়াতের পানে। আয়াত বরাবরের মতোই মুগ্ধ হলো আদ্রাফের আবৃত্তিতে। আয়াত কিছু বলতে যাবে তখনই আদ্রাফ আবার বলল,

‘শোনো হে শোনো কামিনী-
ও মায়বী চোখের অধিকারীনি-
জেনে নিও ডুবতে চাই আমি ঐ চোখে
দুঃসাহস কার মোরে রুখে?”

স্তব্ধ আয়াত, পুনরায় নিশ্চুপ আদ্রাফ। গাড়িতে বিরাজমান পিনপতন নীরবতা। সাহস নিয়ে নীরবতা ভেঙ্গে দিয়ে ড্রাইভার বললেন,
“সত্যিই স্যারের মতো সাহসী আর কেউ নাই। কার আর দুঃসাহস থাকবে যে তাকে বাধা দিবে?”

এটা বলেই মুখে তালা লাগালেন যেন ড্রাইভার। আদ্রাফ বলল,
“দুঃসাহস আমার এই রোগ দেখিয়েছে, রুখে দিয়েছে আমায়।”

আয়াত বিনিময়ে কিছু বলল না। মুখ থেকে বের করলো না কোনো শব্দ। নীরবে মাথা এলিয়ে দিল আদ্রাফের কাঁধে।
.
.
.
কিছু কেনাকাটা শেষে বাড়িতে ফেরার বদলে আদ্রাফ আয়াতকে অন্য এক স্থানে নিয়ে এলো। আয়াত বারবার জিজ্ঞেস করার পরও আদ্রাফ তাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে সেটা বলেনি। তাই মুখ ফুলিয়ে বসে রয়েছে আয়াত। আদ্রাফের অভিব্যক্তিও এতে খুব সামান্য। গাড়ি নামলো একটা নিরিবিলি জায়গায়। গাড়ি থেকে নেমে গেল আদ্রাফ এবং আয়াত। আয়াত দেখতে পেলো একটা খ্রিস্টান কবরস্থানের সামনে এসে তারা দাঁড়িয়েছে। বুক ধক করে উঠলো আয়াতের। আদ্রাফ তখনো চোখ মুখ শক্ত করে দাঁড়িয়ে রয়েছে। কোনো কিছু না বলেই আয়াতের এক হাত ধরে সামনে এগিয়ে যেতে লাগলো আদ্রাফ। কবরস্থানের গেট পার করে ভিতরে ঢুকতে পেল তারা। নীরব এক জায়গা সেখানে, পরিবেশটা কেমন যেন ছমছমে। শীতল হাওয়া বইছে সেখানে। শীতও সেখানে অন্যান্য স্থানের তুলনায় তীব্র যেন। কিছুটা ভয় লাগছে আয়াতের। এক হাত দিয়ে আদ্রাফের হাত খামচি মেরে ধরে রইল সে ভয়ে, আর অপর হাত দিয়ে আদ্রাফের জ্যাকেট শক্ত করে ধরে রইল। আদ্রাফের কোনো রিয়েকশন নাই। সেভাবেই আরও সামনে দিকে এগিয়ে যেতে লাগলো তারা। অনেক মানুষ চিরনিদ্রায় শায়িত হয়ে আছেন এখানে। শত শত কবরের পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে তারা। সময়ের সাথে সাথে তারাও এগিয়ে যাচ্ছে। কাকের কা কা ডাক যেন সেই সাথেই আরও বেড়ে যাচ্ছে। আয়াত দূর থেকে কবরস্থানের অপর পাশে দেখলো নতুন কাউকে কবর দিচ্ছে তার স্বজনেরা। চোখ ফিরিয়ে নিল সে। তার এতোই ভয় লাগছে যেন সে পারলে আদ্রাফের সাথে মিশে যায়, কিন্তু আদ্রাফ এখনো স্থির। এভাবেই হেঁটে হেঁটে একটা কবরের সামনে এসে দাঁড়ালো। আদ্রাফ টানা কিছুক্ষণ সেই কবরের দিকেই চেয়ে রইল। আর আয়াত একবার কবরটা দেখে তো একবার আদ্রাফকে। কিছুক্ষণ পর আদ্রাফ আয়াতকে প্রশ্ন করল,
“জানো আয়াত এটা কার কবর?”

#চলবে

[

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here