হৃদমাঝারে পর্ব -০৬

#হৃদমাঝারে
#নাঈমা_জান্নাত
(৬)

গৌধূলী আবহাওয়া খুবই আরামদায়ক লাগে। সূ্র্য যখন ত্যাজহীন হয়ে পড়ে গরমের প্রকোপটাও কমে যায়। তখন আকাশের রংটাও পাল্টে যায়। পাখিরা নিজেদের নীড়ে ফেরার জন্য প্রস্তুত হয়। এই ছোট ছোট ঘটনা গুলো শুভ্রতার কাছে দারুণ লাগে। তাই তো আজ আর রুমে বসে না থেকে ছাদে চলে এসেছে। ছাদে এসে তো অবাক। কতো মহিলা গল্প করছে,রেলিং থাকার কারণে বাচ্চারাও খেলা করছে। এই বাসায় এসেছে থেকে শুভ্রতা একটিবারও বের হয় নি। নিজেকে দু’রুমের মধ্যেই আবদ্ধ করে রেখেছিলো। আজকে খোলা বাতাস পেয়ে,খোলা আকাশ পেয়ে মন ভালো হয়ে গেলো। প্রশান্তির হাওয়া বয়ে গেলো। কিন্ত এতোগুলো অচেনা মুখের মাঝে দাঁড়িয়ে থাকতে কেমন যেনো লাগছে। তাই ছাদের দরজার কাছেই দাঁড়িয়ে রইলো।
‘আরে তুমি মেঘের বউ না?’ হঠ্যাৎ একজন মহিলার কথায় কেঁপে উঠে শুভ্রতা। ঠিক মহিলাও বলা যায় না যুবতী মেয়ে। শুভ্রতা কি বলবে বুঝতে পারে না। তাই কোনো মতে মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বুঝালো। মহিলাটি তা দেখে বসা থেকে উঠে শুভ্রতার কাছে গেলো।

তারপর মিষ্টিসুরে বলে,,’আমি মিতালী। তুমি আমাকে মিতালী আপু বলে ডেকো কেমন? তোমার নাম টা যেনো কি?’
শুভ্রতা হালকা হেসে বলে,,’শুভ্রতা!’
মিতালী এবার কিছুটা ভাবার ভঙ্গিতে বলে,,’শুভ্রতা নামটা তোমার মতোই মিষ্টি!’
তারপর শুভ্রতার হাত ধরে আরো কয়েকজন মহিলার কাছে নিয়ে গেলো। সবাই খুব সুন্দর ভাবে কথা বললো। শুভ্রতার সারাদিনের অবসাদ এক নিমিষে কেটে গেলো। শুভ্রতা আবার সহজেই মিশে যেতে পারে।
‘আম্মু এটা কে?’ মিতালীর ছেলে এসে শুভ্রতার দিকে আঙ্গুল তাক করে বলে।
মিতালী হেসে বলে,,’এ তোমার আরেকটা আন্টি। শুভ্রতা আন্টি।’ ছেলেটা বেশ ছোট, এখনও অনেক শব্দ স্পষ্ট উচ্চারণ করছে পারে না। যার জন্য সে শুভ্রতার নামটা ‘শুভতা!’ উচ্চারণ করে। ওর কথায় সবাই হেসে ফেলে। শুভ্রতা বাচ্চাটাকে কোলে নিয়ে বলে,,’থাক বাবু তুমি আমাকে ‘শুভা’ বলে ডেকো কেমন?’
বাচ্চাটা মাথা দুলিয়ে বলে,,’তুমি খুব চুইট!’ ওর সুইট উচ্চারণ শুনে আরেক দফা হাসির রোল পড়লো। শুভ্রতা বাচ্চাটার দুগাল টেনে বলে,,’তোমার নাম কি বাবু?’
‘আমার নাম জায়েদ ইবনে সিফাত!’ এরপর সবাই আরো কিছুক্ষণ গল্প করলো। মাগরিবের আযান পড়লে সবাই একযোগে নিজেদের বাসার দিকে যায়। মিতালী যাওয়ার আগে শুভ্রতাকে কাল আসার জন্য বলে গেলো। শুভ্রতাও সম্মতি জানালো। শুভ্রতাদের সামনের ফ্ল্যাটটাই মিতালীদের।
_____________________
রাতে খাওয়ার জন্য চুলায় ভাত বসিয়ে মেঘের অপেক্ষা করতে লাগলো শুভ্রতা। এই দু’দিনেই কেমন যেনো মায়া পড়ে গেছে লোকটার উপর। সারাদিন খেটে এসে যখন বিছানায় গা এলিয়ে দেয় তখন শুভ্রতার কাছে খুব খারাপ লাগে। সে তো সারাদিন শুয়ে বসেই থাকে। সব কাজ তো প্রায় অন্য কেউই করে দিয়ে যায়। শুভ্রতার ভাবনার মাঝে কলিংবেল বাজার শব্দ এলো। মেঘ এসেছে বুঝতে পেরে দ্রুত পায়ে দরজার দিকে চলে যায়। দরজা খুলে মেঘের ঘামার্ত মুখ দেখে শুভ্রতার মনটা কেমন খারাপ হয়ে গেলো। মেঘ রুমের ডুকতে ডুকতে বলে,,’সারাদিন কেমন গেলো?’
এটা যেনো মেঘের অভ্যেস হয়ে গেছে। প্রথমেই শুভ্রতাকে এই প্রশ্নটা করা। শুভ্রতা কিচেনের দিকে যেতে যেতে বলে,,’ভালো কেটেছে।’ মেঘ সেদিকে তাকিয়ে হাতের প্যাকেটটা টেবিলে রেখে রুমে চলে যায়। কাঁধ থেকে ব্যাগটা নামিয়ে আলমারি খুলতে নিলে শুভ্রতা এসে হাজির। মেঘের দিকে এক গ্লাস লেবুর শরবত এগিয়ে দিয়ে বলে,,’জামা,কাপড় ওয়াশরুমে আছে। শরবতটা খেয়ে আস্তে ধীরে যান!’

শুভ্রতার কান্ডে মেঘ খানিক অবাক হলেও তা দমিয়ে রাখলো। এক ঢোকে শরবতটা খেয়ে বলে,,’থ্যাংস! বাট আজ এতো কৃপা পড়লো?’
শুভ্রতা মুখ ভেংচি দিয়ে বলে,,’আমি আবার কারো ঋণ রাখি না। আপনি প্রতিদিন আসার সময় আমার জন্য আইসক্রিম, ফুল ইত্যাদি নিয়ে আসেন তাই আমিও আপনাকে হেল্প করলাম। আর কিছু না!’
শুভ্রতার কথায় মেঘ মাথা নাড়তে নাড়তে ওয়াশরুমে চলে যায়।

মেঘ যেতেই শুভ্রতা আপন মনে বিড়বিড়িয়ে বলে,,’আপনার প্রতি যে আমার মনে খানিক পরিমাণ দুর্বলতা সৃষ্টি হয়েছে, সেটা আমি চাইলেও অস্বীকার করতে পারবো না। কিন্ত আমার মনে যে দ্বিধা যে সংশয় সেটাও আমি কাটিয়ে উঠতে পারছি না। কিন্ত আমি মন থেকে চাই সব ভুলে আপনাকে নিয়ে থাকতে,আপনাতে মত্ত হতে। কিন্ত সেটা কি আদৌ সম্ভব?’
শুভ্রতা আর কিছু না ভেবে কিচেনের দিকে যায়। ভাত নিশ্চয়ই হয়ে এসেছে। যাওয়ার আগে টেবিলের উপর থেকে আইসক্রিমটা ফ্রিজে রাখে দিলো। ডিনার করার পর খাবে। আর ফুলের মালাটা ড্রেসিংটেবিলের উপর যত্ন করে রেখে দিলো।
_____________________
‘আচ্ছা মা-বাবা আমাদের সাথে এসে থাকতে পারে না?’ শুভ্রতার কথায় মেঘ মুখের ভাতটা গিলে বলে,,
‘বাবা ওখানে শিক্ষকতা করে। এখনও রিটায়ার্ড হয় নি। মা বাবাকে ছেড়ে আসতে চায় না। তাই উনারা ওখানেই থাকবে। এখানে আসার জন্য রাজি হচ্ছে না!’
শুভ্রতা আঙ্গুল দিয়ে ভাত নাড়তে নাড়তে বলে,,’ওহ!’ এরপর আর কোনো কথা হলো না দুজনের মাঝে। রাতেও দুজন একসাথেই শুয়েছে কিন্ত দুজনের মাঝে বিস্তর পার্থক্য! এভাবে আর কতোদিন কে জানে?

‘আচ্ছা আমি কি মেঘকে ঠকাচ্ছি? সে তো কোনো অন্যায় করে নি। মা-বাবা আমায় জোর করে বিয়ে দিয়েছে। এতে মেঘের কি দোষ? আমি মেঘকে বৈবাহিক সম্পর্ক থেকে কেনো বিচ্ছিন্ন করছি? কিন্ত মেঘ তো সব জেনেই আমাকে বিয়ে করেছে। সব জেনেও কি কেউ কুয়োতে ঝাপ দেয়? নাকি মেঘ আমার কথাগুলো বিশ্বাসই করে নি? মেঘ আমায় বিয়ে না করলে বাবা-মাও কি থেমে থাকতো? উঁহু ওরা অন্য একজনের সাথে বিয়ে দিয়ে দিতো! তবে কি সবটাই আমার ভূল?’ শুভ্রতা পাশ ফিরে মেঘের দিকে চাইলো। ড্রিমলাইটের আলোয় মেঘের মুখটা আবছা দেখাচ্ছে। কিন্ত বুঝা যাচ্ছে মেঘ গভীর ঘুমে। শুভ্রতা মেঘের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই ঘুমিয়ে পড়লো।
___________________
সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে রুটি বানিয়ে নিলো শুভ্রতা। কাল রাতে মনে মনে ঠিক করে নিলো মেঘকে আর ঠকাবে না। আর পাঁচটা রিলেশনের মতো তাদের রিলেশনটাও এগিয়ে নিয়ে যাবে।
‘শুভ্র নাস্তা হলো?’ মেঘ রুম থেকে বেরিয়ে আসতে আসতে বলে।
‘হ্যাঁ। আসুন।’ তারপর দুজনে মিলে নাস্তা করে নিলো। মেঘ শুভ্রতার থেকে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে গেলো। কিন্ত বিদায়ের বেলায় মেঘ অদ্ভুত একটা কান্ড করে বসলো। যেটার জন্য শুভ্রতা কোনো মতেই প্রস্তুত ছিলো না। মেঘ শুভ্রতার কপালে নিজের ওষ্ঠদ্বয় ছুঁইয়ে দিয়ে গেলো। তারপর আর একমিনিটও দাঁড়াল না। সোজা হেটে বেরিয়ে গেলো। হয়তো পেছন ফিরে তাকালে লজ্জায় রাঙা একটা মুখ দেখতে পারতো। শুভ্রতা নিজের কপালে হাত দিলো। বিয়ের এই কয়েকদিনের মধ্যে মেঘ একবার শুধু তার হাত ধরেছে আর আজ স্পর্শ করেছে। শুভ্রতার কি রকম অনুভূতি হচ্ছে ঠিক বুঝতে পারছে না। শুধু মেঘের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলো।

#চলবে?

(

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here